ভয়ানক দুঃসময় অতিক্রম করছে অনেক মানুষ। অনেক না কিছু মানুষ? বেশীরভাগ মানুষ কি ভালো আছে? আমি কি ভালো আছি? আমি ভালো থাকলেই 'কিছু' মানুষের দুঃখ গায়ে কাঁটা দেয় না? এখন কিসের দুঃসময়? কতটা দুঃসময়? এক বন্ধু বললো এখনো তেমন দুঃসময় ঠিকভাবে এসে উপস্থিত হয়নি। এখনো দেখার অনেক বাকী। অনেক অন্ধকার এখনো বিষদাঁত লুকিয়ে আড়ালে অপেক্ষা করছে। সেই দাঁতাল অন্ধকার এসে উপস্থিত হলে এই যে লেখাটা টাইপ করছি, সেটাও কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। এই যে প্রাত্যাহিক ইন্টারনেট বিচরণ সেখানেও পড়বে করাল থাবা। তখন কেবল অন্ধকারেরই প্রবল রাজত্ব থাকবে।
তবু............এটা............বিচ্ছিন্ন............ একটা..........লেখা। এটার সাথে বাস্তবের কোন সম্পর্ক না থাকলেই ভালো হতো।
(... ... ... . .... .... .... ... ... ...)
______শূন্যতা_____
এটা কি?
এটা একটা দায়সারা শূন্যতা। এই যে বন্ধনীর ভেতর দেড় ইঞ্চির শূন্যস্থান - সেখানে আসলে কয়েক হাজার বা লক্ষ পৃষ্ঠা। একেকটা মানুষের সর্বনাশের ইতিহাস, সর্বনাশের বেদনার কথা কয়েক হাজার পৃষ্টা হবে যা লেখার সাধ্য আমার নেই। আমি প্রতিদিন পত্রিকার পাতা খুলে সংবাদ পাঠ করতে সাহস পাই না। শুধু হেডলাইন আর থেতলানো ঝলসানো শরীরগুলোর দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে নেবার পর আমার বুকের ভেতরে ক্রোধ আর বেদনা পরস্পরের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয় তখন আমার ইচ্ছে করে একটা নিউট্রন প্রোটন বা হাইড্রোজেন বোমায় পৃথিবীটা ধ্বংস করে দেই। কিন্তু কিছু করা হয় না। অতঃপর অক্ষমতার আগ্রাসনে এক টুকরো শূন্যস্থানে আমি লুকিয়ে থাকি। এ আমার দায়সারা শূন্যতা।
আমার কি দায়? সে তুমি বুঝবে না। কারণ তোমার প্রিয়তম সন্তান এখনো পোড়েনি। তোমার বটবৃক্ষ বাবা এখনো বোমার আঘাতে থেতলে যায়নি। তোমার আদরের ভাই/বোনটা এখনো নিরাপদে বাড়ি ফিরে আসছে, এমনকি তোমার প্রিয় বন্ধুটি বলতে পারছে, চল আজ 'রোদেলা বিকেলে' বসে একটা আড্ডা দেই। তোমার কাছে এই সর্বনাশগুলো তৃতীয় কোন পক্ষের ঘটনা, কেবলই একটা খবরের হেডলাইন কিংবা নেহায়েত ২০ ফন্টের একটা ব্লগ টাইটেল।
অথচ কি জানো, কুড়িয়ে পাওয়া ককটেল বিস্ফোরিত হয়ে হাতের পাঁচটি আঙুল হারালো যে সাড়ে তিন বছরের শিশু লিমা -তার জন্য, তার অসহায় বাবা মায়ের জন্যও লেখা যাবে কয়েকশো পৃষ্ঠা। আর গত এক মাসে দেশের সর্বনাশ হওয়া মানুষের কথার যোগফল লেখার মতো কাগজ সমগ্র বাংলাদেশেই নেই।
তাদের সবার জন্য ওই শূন্যস্থানটি। ওই শূন্যস্থানেই আমার শোকগাঁথা। বাংলাদেশে মানুষের জীবন এখন ঢাকা শহরের সীসা মিশ্রিত দুষিত বাতাসের চেয়েও সস্তা হয়ে গেছে। দাঁতাল শুয়োরের (শমসেরের) বাচ্চারা তবু বলছে এরকম পরিস্থিতিতে এটাই স্বাভাবিক। এই দেশ আফগানিস্তান হয়ে গেছে? ইরাক হয়ে গেছে? পাকিস্তান হয়ে গেছে? এই মৃত্যু, এই জীবন্ত দাহ্য শরীরগুলো সব স্বাভাবিক হয়ে গেছে শমসেরের বাচ্চাদের কাছে। তাদের চোখে স্বপ্নের সর্বনাশ গদিয়ান হয়ে মসনদী জয়গান গাইছে। তবু ওই বানচোত হয়তো একদিন গোলাপী ওড়নায় চড়ে দেশ বিদেশে বাংলার পতাকা নিয়ে দেশবিদেশে পররাষ্ট্র সেবা করবে। গ্রেনেড বোমা গুলি পেট্রোল বারুদের গন্ধ এড়িয়ে বেঁচে থাকলে আমার দুর্ভাগা চোখও কি তা দাঁতে দাঁত পিষে সহ্য করে নেবে?
এখানে যাদের সর্বনাশ হয়ে গেছে তাদের আর উপায় নেই। যাদের হয়নি তারা যে কোন সময় আশংকার করছে সর্বনাশের। যারা কোন রাজনীতি করে না, যাদের সাথে রাজনীতির কোন প্রেম বিদ্বেষের সম্পর্ক নেই, যারা কেবল নিজের কাজ করে, কাজ সেরে বাজারে যায়, শাক ডাল সবজি কিনে বাড়ি ফিরে, রান্না করে গরম তুলতুলে ভাত খায়, খাওয়া শেষে শক্ত বিছানায় তৈলাক্ত বালিশে মাথা রেখে ঘুমায়, জগতের আর কোন ত্রিবিধ ব্যাপারে যারা কখনো মাথা ঘামায় না, রাজনীতির দুষ্টচক্র তাদেরকেও রেহাই দিচ্ছে না। কামড়ে ধরছে তাদের ঘাড়, কাঁধ, নাক মুখ চোখ। যে নির্বিবাদী মানুষটা কাজ করে বাড়ি ফিরছে তার সর্বনাশ করছে রাজনীতি, যে কর্মক্লান্ত মানুষ বাজারে গিয়ে পরিবারের জন্য পঞ্চাশ টাকার আলু ডাল কিনে আনছে তাদেরও সর্বনাশ করছে রাজনীতি, যারা কোথাও কোন পক্ষ নয়, কারো বাদ বিবাদ যোগ বিয়োগে নেই, রাজনীতি তাদেরকেও সুস্থ জীবন ধারণে বাধা দিচ্ছে। গুলি বোমা বারুদের ভাষায় ডেকে ডেকে বলছে, এই দেখ আমরা শুয়োরের বাচ্চারা এই দেশে আছি, এই দেশে বাস করেও এই দেশ জ্বালিয়ে দিচ্ছি। আমাদের লোহার নল দিয়ে গুলি ফুটাই, তোর বুক পেট মুণ্ডু ফুটা করি, কি করতে পারিস তুই?
এই ভূখণ্ডে বসবাস করাটাই অপরাধের পর্যায়ে পড়ে যাচ্ছে।
কেউ কেউ বলছে, এখানে আর থাকা যাবে না, এদেশ বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। এখান থেকে পালিয়ে যাও। কিন্তু নিজের দেশ ছেড়ে, নিজের জন্মভূমি ছেড়ে, নিজের আত্মীয় পরিজন ছেড়ে কোথায় পালাবে মানুষ? সবার পালিয়ে যাবার সামর্থ্য নেই। অনেকের সামর্থ্য থাকলেও পালাবে না। পালাতে পারবে না। পালিয়ে কোন সমাধান হবার নয়।
তাহলে কি মরে যাওয়াই সমাধান? এখনো যথেষ্ট মরেনি মানুষ? এখনো লাশের টার্গেট পুরণ হয়নি? এখনো কবরে জায়গা খালি রয়ে গেছে? নিঃশেষে প্রাণ এখনো করিতে পারো দান?
হায় রবীন্দ্রনাথ, তুমি শত বছর আগেই বুঝেছিলে অপরিণামদর্শী বাঙালীর মন। শতবর্ষ পেরিয়েও তাই তোমার কবিতা প্রাসঙ্গিক থেকে যায়-
বহে মাঘমাসে শীতের বাতাস,
স্বচ্ছসলিলা বরুণা।
পুরী হতে দূরে গ্রামে নির্জনে
শিলাময় ঘাট চম্পকবনে,
স্নানে চলেছেন শতসখীসনে
কাশীর মহিষী করুণা।
সে পথ সে ঘাট আজি এ প্রভাতে
জনহীন রাজশাসনে।
নিকটে যে ক'টি আছিল কুটির
ছেড়ে গেছে লোক, তাই নদীতীর
স্তব্ধ গভীর, কেবল পাখির
কূজন উঠিছে কাননে।
আজি উতরোল উত্তর বায়ে
উতলা হয়েছে তটিনী।
সোনার আলোক পড়িয়াছে জলে,
পুলকে উছলি ঢেউ ছলছলে--
লক্ষ মানিক ঝলকি আঁচলে
নেচে চলে যেন নটিনী।
কলকল্লোলে লাজ দিল আজ
নারী কণ্ঠের কাকলি।
মৃণালভুজের ললিত বিলাসে
চঞ্চলা নদী মাতে উল্লাসে,
আলাপে প্রলাপে হাসি-উচ্ছ্বাসে
আকাশ উঠিল আকুলি।
স্নান সমাপন করিয়া যখন
কূলে উঠে নারী সকলে
মহিষী কহিলা, "উহু! শীতে মরি,
সকল শরীর উঠিছে শিহরি,
জ্বেলে দে আগুন ওলো সহচরী--
শীত নিবারিব অনলে।'
সখীগণ সবে কুড়াইতে কুটা
চলিল কুসুমকাননে।
কৌতুকরসে পাগলপরানী
শাখা ধরি সবে করে টানাটানি,
সহসা সবারে ডাক দিয়া রানী
কহে সহাস্য আননে--
"ওলো তোরা আয়! ওই দেখা যায়
কুটির কাহার অদূরে,
ওই ঘরে তোরা লাগাবি অনল,
তপ্ত করিব করপদতল'--
এত বলি রানী রঙ্গে বিভল
হাসিয়া উঠিল মধুরে।
কহিল মালতী সকরুণ অতি,
"একি পরিহাস রানীমা!
আগুন জ্বালায়ে কেন দিবে নাশি?
এ কুটির কোন্ সাধু সন্ন্যাসী
কোন্ দীনজন কোন্ পরবাসী
বাঁধিয়াছে নাহি জানি মা!'
রানী কহে রোষে, "দূর করি দাও
এই দীনদয়াময়ীরে।'
অতি দুর্দাম কৌতুকরত
যৌবনমদে নিষ্ঠুর যত
যুবতীরা মিলি পাগলের মতো
আগুন লাগালো কুটিরে।
ঘন ঘোর ধূম ঘুরিয়া ঘুরিয়া
ফুলিয়া ফুলিয়া উড়িল।
দেখিতে দেখিতে হুহু হুংকারি
ঝলকে ঝলকে উল্কা উগারি
শত শত লোল জিহ্বা প্রসারি
বহ্নি আকাশ জুড়িল।
পাতাল ফুঁড়িয়া উঠিল যেন রে
জ্বালাময়ী যত নাগিনী।
ফণা নাচাইয়া অম্বরপানে
মাতিয়া উঠিল গর্জনগানে,
প্রলয়মত্ত রমণীর কানে
বাজিল দীপক রাগিণী।
প্রভাতপাখির আনন্দ গান
ভয়ের বিলাপে টুটিল--
দলে দলে কাক করে কোলাহল,
উত্তরবায়ু হইল প্রবল,
কুটির হইতে কুটিরে অনল
উড়িয়া উড়িয়া ছুটিল।
ছোটো গ্রামখানি লেহিয়া লইল
প্রলয়লোলুপ রসনা।
জনহীন পথে মাঘের প্রভাতে
প্রমোদক্লান্ত শত সখী-সাথে
ফিরে গেল রানী কুবলয় হাতে
দীপ্ত-অরুণ-বসনা।
সামান্য ক্ষতি -রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
এটা একটা দায়সারা শূন্যতা। এই যে বন্ধনীর ভেতর দেড় ইঞ্চির শূন্যস্থান - সেখানে আসলে কয়েক হাজার বা লক্ষ পৃষ্ঠা। একেকটা মানুষের সর্বনাশের ইতিহাস, সর্বনাশের বেদনার কথা কয়েক হাজার পৃষ্টা হবে যা লেখার সাধ্য আমার নেই। আমি প্রতিদিন পত্রিকার পাতা খুলে সংবাদ পাঠ করতে সাহস পাই না। শুধু হেডলাইন আর থেতলানো ঝলসানো শরীরগুলোর দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে নেবার পর আমার বুকের ভেতরে ক্রোধ আর বেদনা পরস্পরের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয় তখন আমার ইচ্ছে করে একটা নিউট্রন প্রোটন বা হাইড্রোজেন বোমায় পৃথিবীটা ধ্বংস করে দেই। কিন্তু কিছু করা হয় না। অতঃপর অক্ষমতার আগ্রাসনে এক টুকরো শূন্যস্থানে আমি লুকিয়ে থাকি। এ আমার দায়সারা শূন্যতা।
আমার কি দায়? সে তুমি বুঝবে না। কারণ তোমার প্রিয়তম সন্তান এখনো পোড়েনি। তোমার বটবৃক্ষ বাবা এখনো বোমার আঘাতে থেতলে যায়নি। তোমার আদরের ভাই/বোনটা এখনো নিরাপদে বাড়ি ফিরে আসছে, এমনকি তোমার প্রিয় বন্ধুটি বলতে পারছে, চল আজ 'রোদেলা বিকেলে' বসে একটা আড্ডা দেই। তোমার কাছে এই সর্বনাশগুলো তৃতীয় কোন পক্ষের ঘটনা, কেবলই একটা খবরের হেডলাইন কিংবা নেহায়েত ২০ ফন্টের একটা ব্লগ টাইটেল।
অথচ কি জানো, কুড়িয়ে পাওয়া ককটেল বিস্ফোরিত হয়ে হাতের পাঁচটি আঙুল হারালো যে সাড়ে তিন বছরের শিশু লিমা -তার জন্য, তার অসহায় বাবা মায়ের জন্যও লেখা যাবে কয়েকশো পৃষ্ঠা। আর গত এক মাসে দেশের সর্বনাশ হওয়া মানুষের কথার যোগফল লেখার মতো কাগজ সমগ্র বাংলাদেশেই নেই।
তাদের সবার জন্য ওই শূন্যস্থানটি। ওই শূন্যস্থানেই আমার শোকগাঁথা। বাংলাদেশে মানুষের জীবন এখন ঢাকা শহরের সীসা মিশ্রিত দুষিত বাতাসের চেয়েও সস্তা হয়ে গেছে। দাঁতাল শুয়োরের (শমসেরের) বাচ্চারা তবু বলছে এরকম পরিস্থিতিতে এটাই স্বাভাবিক। এই দেশ আফগানিস্তান হয়ে গেছে? ইরাক হয়ে গেছে? পাকিস্তান হয়ে গেছে? এই মৃত্যু, এই জীবন্ত দাহ্য শরীরগুলো সব স্বাভাবিক হয়ে গেছে শমসেরের বাচ্চাদের কাছে। তাদের চোখে স্বপ্নের সর্বনাশ গদিয়ান হয়ে মসনদী জয়গান গাইছে। তবু ওই বানচোত হয়তো একদিন গোলাপী ওড়নায় চড়ে দেশ বিদেশে বাংলার পতাকা নিয়ে দেশবিদেশে পররাষ্ট্র সেবা করবে। গ্রেনেড বোমা গুলি পেট্রোল বারুদের গন্ধ এড়িয়ে বেঁচে থাকলে আমার দুর্ভাগা চোখও কি তা দাঁতে দাঁত পিষে সহ্য করে নেবে?
এখানে যাদের সর্বনাশ হয়ে গেছে তাদের আর উপায় নেই। যাদের হয়নি তারা যে কোন সময় আশংকার করছে সর্বনাশের। যারা কোন রাজনীতি করে না, যাদের সাথে রাজনীতির কোন প্রেম বিদ্বেষের সম্পর্ক নেই, যারা কেবল নিজের কাজ করে, কাজ সেরে বাজারে যায়, শাক ডাল সবজি কিনে বাড়ি ফিরে, রান্না করে গরম তুলতুলে ভাত খায়, খাওয়া শেষে শক্ত বিছানায় তৈলাক্ত বালিশে মাথা রেখে ঘুমায়, জগতের আর কোন ত্রিবিধ ব্যাপারে যারা কখনো মাথা ঘামায় না, রাজনীতির দুষ্টচক্র তাদেরকেও রেহাই দিচ্ছে না। কামড়ে ধরছে তাদের ঘাড়, কাঁধ, নাক মুখ চোখ। যে নির্বিবাদী মানুষটা কাজ করে বাড়ি ফিরছে তার সর্বনাশ করছে রাজনীতি, যে কর্মক্লান্ত মানুষ বাজারে গিয়ে পরিবারের জন্য পঞ্চাশ টাকার আলু ডাল কিনে আনছে তাদেরও সর্বনাশ করছে রাজনীতি, যারা কোথাও কোন পক্ষ নয়, কারো বাদ বিবাদ যোগ বিয়োগে নেই, রাজনীতি তাদেরকেও সুস্থ জীবন ধারণে বাধা দিচ্ছে। গুলি বোমা বারুদের ভাষায় ডেকে ডেকে বলছে, এই দেখ আমরা শুয়োরের বাচ্চারা এই দেশে আছি, এই দেশে বাস করেও এই দেশ জ্বালিয়ে দিচ্ছি। আমাদের লোহার নল দিয়ে গুলি ফুটাই, তোর বুক পেট মুণ্ডু ফুটা করি, কি করতে পারিস তুই?
এই ভূখণ্ডে বসবাস করাটাই অপরাধের পর্যায়ে পড়ে যাচ্ছে।
কেউ কেউ বলছে, এখানে আর থাকা যাবে না, এদেশ বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। এখান থেকে পালিয়ে যাও। কিন্তু নিজের দেশ ছেড়ে, নিজের জন্মভূমি ছেড়ে, নিজের আত্মীয় পরিজন ছেড়ে কোথায় পালাবে মানুষ? সবার পালিয়ে যাবার সামর্থ্য নেই। অনেকের সামর্থ্য থাকলেও পালাবে না। পালাতে পারবে না। পালিয়ে কোন সমাধান হবার নয়।
তাহলে কি মরে যাওয়াই সমাধান? এখনো যথেষ্ট মরেনি মানুষ? এখনো লাশের টার্গেট পুরণ হয়নি? এখনো কবরে জায়গা খালি রয়ে গেছে? নিঃশেষে প্রাণ এখনো করিতে পারো দান?
হায় রবীন্দ্রনাথ, তুমি শত বছর আগেই বুঝেছিলে অপরিণামদর্শী বাঙালীর মন। শতবর্ষ পেরিয়েও তাই তোমার কবিতা প্রাসঙ্গিক থেকে যায়-
বহে মাঘমাসে শীতের বাতাস,
স্বচ্ছসলিলা বরুণা।
পুরী হতে দূরে গ্রামে নির্জনে
শিলাময় ঘাট চম্পকবনে,
স্নানে চলেছেন শতসখীসনে
কাশীর মহিষী করুণা।
সে পথ সে ঘাট আজি এ প্রভাতে
জনহীন রাজশাসনে।
নিকটে যে ক'টি আছিল কুটির
ছেড়ে গেছে লোক, তাই নদীতীর
স্তব্ধ গভীর, কেবল পাখির
কূজন উঠিছে কাননে।
আজি উতরোল উত্তর বায়ে
উতলা হয়েছে তটিনী।
সোনার আলোক পড়িয়াছে জলে,
পুলকে উছলি ঢেউ ছলছলে--
লক্ষ মানিক ঝলকি আঁচলে
নেচে চলে যেন নটিনী।
কলকল্লোলে লাজ দিল আজ
নারী কণ্ঠের কাকলি।
মৃণালভুজের ললিত বিলাসে
চঞ্চলা নদী মাতে উল্লাসে,
আলাপে প্রলাপে হাসি-উচ্ছ্বাসে
আকাশ উঠিল আকুলি।
স্নান সমাপন করিয়া যখন
কূলে উঠে নারী সকলে
মহিষী কহিলা, "উহু! শীতে মরি,
সকল শরীর উঠিছে শিহরি,
জ্বেলে দে আগুন ওলো সহচরী--
শীত নিবারিব অনলে।'
সখীগণ সবে কুড়াইতে কুটা
চলিল কুসুমকাননে।
কৌতুকরসে পাগলপরানী
শাখা ধরি সবে করে টানাটানি,
সহসা সবারে ডাক দিয়া রানী
কহে সহাস্য আননে--
"ওলো তোরা আয়! ওই দেখা যায়
কুটির কাহার অদূরে,
ওই ঘরে তোরা লাগাবি অনল,
তপ্ত করিব করপদতল'--
এত বলি রানী রঙ্গে বিভল
হাসিয়া উঠিল মধুরে।
কহিল মালতী সকরুণ অতি,
"একি পরিহাস রানীমা!
আগুন জ্বালায়ে কেন দিবে নাশি?
এ কুটির কোন্ সাধু সন্ন্যাসী
কোন্ দীনজন কোন্ পরবাসী
বাঁধিয়াছে নাহি জানি মা!'
রানী কহে রোষে, "দূর করি দাও
এই দীনদয়াময়ীরে।'
অতি দুর্দাম কৌতুকরত
যৌবনমদে নিষ্ঠুর যত
যুবতীরা মিলি পাগলের মতো
আগুন লাগালো কুটিরে।
ঘন ঘোর ধূম ঘুরিয়া ঘুরিয়া
ফুলিয়া ফুলিয়া উড়িল।
দেখিতে দেখিতে হুহু হুংকারি
ঝলকে ঝলকে উল্কা উগারি
শত শত লোল জিহ্বা প্রসারি
বহ্নি আকাশ জুড়িল।
পাতাল ফুঁড়িয়া উঠিল যেন রে
জ্বালাময়ী যত নাগিনী।
ফণা নাচাইয়া অম্বরপানে
মাতিয়া উঠিল গর্জনগানে,
প্রলয়মত্ত রমণীর কানে
বাজিল দীপক রাগিণী।
প্রভাতপাখির আনন্দ গান
ভয়ের বিলাপে টুটিল--
দলে দলে কাক করে কোলাহল,
উত্তরবায়ু হইল প্রবল,
কুটির হইতে কুটিরে অনল
উড়িয়া উড়িয়া ছুটিল।
ছোটো গ্রামখানি লেহিয়া লইল
প্রলয়লোলুপ রসনা।
জনহীন পথে মাঘের প্রভাতে
প্রমোদক্লান্ত শত সখী-সাথে
ফিরে গেল রানী কুবলয় হাতে
দীপ্ত-অরুণ-বসনা।
সামান্য ক্ষতি -রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
No comments:
Post a Comment