মাসুদা ভাট্টির চমৎকার একটা লেখা পড়লাম আজ বাংলানিউজ২৪ডটকমে
মানবের বিরুদ্ধে দানবের যুদ্ধ চলছে বাংলাদেশেমাসুদা ভাট্টি, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর
বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
বিএনপি'র ভাইস-চেয়ারম্যান শমসের মোবিন চৌধুরী ঠিকই বলেছেন, দেশে যুদ্ধাবস্থাই চলছে। একে যদি যুদ্ধাবস্থা না বলি তাহলে আর কাকে বলা যাবে? কিন্তু এ যুদ্ধ কার বিরুদ্ধে কে করছে?
এরকম প্রশ্ন নিয়ে যদি আজকের তরুণ প্রজন্মের সামনে দাঁড়াই তাহলে তারা নিঃসন্দেহে বলবে যে, এ যুদ্ধ মানবের বিরুদ্ধে দানবের; শুভ'র বিরুদ্ধে অশুভ'র। দুঃখজনক সত্যি হলো, এদেশের একদল অশুভাকাঙ্ক্ষীর সঙ্গে বিদেশের একদল "লোভাতুর" ব্যক্তি মানবাধিকারের দোহাই দিয়ে দানবাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য আজ আদা-জল খেয়ে লেগেছে।
আইনি প্রক্রিয়া নিয়ে কথা বলা উচিত নয় এবং তা দেশের প্রচলিত আইনি ব্যবস্থাকে প্রশ্নেরই সম্মুখীন করে মাত্র। কিন্তু এ প্রশ্ন তো আজ তোলা প্রয়োজন যে, যুদ্ধাপরাধের দায়ে ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত কাদের মোল্লার ফাঁসি যেভাবে গতকাল (১০ ডিসেম্বর, ২০১৩) রাতে বন্ধ করা হলো, কোনো উন্নত গণতান্ত্রিক দেশেও এ ধরনের নজির পাওয়া যাবে না। আমরা এতোদিন শুনে আসছিলাম যে, এ দেশে আইনের শাসন নেই, যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রক্রিয়ায় আন্তর্জাতিক মান অনুসরণ করা হচ্ছে না। কিন্তু কালকে যে কাজটি আদালত প্রাঙ্গণ থেকে জেলখানা পর্যন্ত ঘটলো তাকে আমরা কোন্ মানদণ্ডে বিচার করবো? এরপরও কি আমাদের শুনতে হবে যে, বিচার প্রক্রিয়া আন্তর্জাতিক মানের হয়নি?
এতোটা দ্রুততার সঙ্গে যেদেশে একজন রাষ্ট্র-বিরোধী দণ্ডপ্রাপ্ত আসামির ফাঁসির রায় স্থগিত করা যায় সেদেশে আইনের শাসন আছে, সেকথা কি পাগলেও বিশ্বাস করবে? না করা উচিত? কিন্তু এদেশ সব সম্ভবের দেশ।
এদেশে ফাঁসির আসামিকে বাঁচানোর জন্য দেশব্যাপী চরম সহিংসতার ঘটনা ঘটে। গণ-পরিবহনে আগুন দিয়ে মানুষ পুড়িয়ে মারা হয়। রেললাইন উপড়ে ফেলে হাজারে হাজারে যাত্রীর জীবননাশের চেষ্টা চলে। মিডিয়াকে ব্যবহার করা হয় যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচানোর জন্য মিথ্যাচারের কাজে। তারপরও এদেশে মানবাধিকার লংঘিত হচ্ছে বলে বিশ্বের বড় বড় মানবাধিকারবাদীরা প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি লেখেন।
আমরা জানি যে, জাতিসংঘ থেকে প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি দিয়ে অনুরোধ জানানো হয়েছে কাদের মোল্লার ফাঁসি স্থগিত করার জন্য। আমরা সত্যিকার জাতিসংঘের কথা বলছি কিন্তু! যারা সাদ্দাম হোসেনের ফাঁসি কার্যকর করার সময় সেদেশের প্রচলিত আইনের প্রতি শ্রদ্ধা দেখিয়ে চুপ করে ছিল। আমরা সেই জাতিসংঘের কথা বলছি যারা ওসামা বিন লাদেনকে হত্যা-দৃশ্য সুদূর মার্কিন মুলুকে বসে সরাসরি সম্প্রচার-কাণ্ডে কোনো কথা বলেনি। এ জাতিসংঘ সেই জাতিসংঘ যারা ১৯৭১ সালে এদেশে যখন মুক্তিযুদ্ধ চলছিলো, চলছিলো হলোকাস্টের চেয়েও ভয়ঙ্কর ঘটনা তখন চুপ করে না থেকে পাকিস্তানকে অনৈতিক সুযোগ-সুবিধা করে দিয়েছিল গণহত্যা চালিয়ে যেতে।
শুধু জাতিসংঘ নয়, ব্রিটেন এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নও কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে দেয়া ফাঁসির রায়কে মানবাধিকার লংঘন বলে অভিহিত করে এ রায় যাতে কার্যকর করা না হয় তার অনুরোধ জানিয়েছে। বাহ্ চমৎকার!! ২০১১ সালে সৌদি আরবে ৮ বাংলাদেশির শিরশ্ছেদ করা হয় একজন মিশরীয়কে হত্যার জন্য। কিন্তু পরে প্রমাণিত হয় যে, তারা নির্দোষ ছিলো। কিন্তু এ নিয়ে কোনো শব্দ আমরা শুনিনি পশ্চিমাদের দিক থেকে। বাদ দিই বাংলাদেশীদের কথা, তারা তো মিসকিন গোত্রের।
২০১২ সালে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল পরিচালিত গবেষণায় দেখা গেছে সবচেয়ে বেশি ফাঁসি/মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয় চীনে। তালিকায় ক্রমানুসারে চীনের পরেই রয়েছে ইরান, ইরাক, সৌদি আরব, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইয়েমেন, সুদান, আফগানিস্তান, গাম্বিয়া এবং জাপান। সংখ্যানুসারে ফাঁসি/মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার সংখ্যা চীনে ২০১২ সালে এক হাজারের ওপরে, ইরানে ৩১৪, জাপানে ৭ এবং এর মধ্যবর্তী দেশগুলির প্রত্যেকটিতেই দশটিরও অধিক; যুক্তরাষ্ট্রে ৪৩ জন। এবার বলুন মহাশয়, এতো এতো ফাঁসির ঘটনার কোথায় আপনাদের "মহান বিবেক" কেঁদেছিল? কোথায় আপনারা চিঠি দিয়ে ফাঁসির রায় স্থগিত করার অনুরোধ জানিয়েছিলেন? আমরা এ বিষয়ে কিছু জানি না, ব্যাপারটা খোলাসা করলে খুশি হই খুউব!!!
১৯৭১ নিয়ে আপনারা উচ্ছ্বসিত না হোন, তাতে আপনাদের দোষ দেবো না। কারণ, ১৯৭১ সালে বাঙালি যা অর্জন করেছিল তা আপনারা অনেকেই চান নি। চাইবেন কেন? পৃথিবীর কোনো দেশেই জনগণের প্রাণের দাবির প্রতি আপনাদের সমর্থন থাকার কথা নয়, নেইও। কারণ তাতে, আপনাদের নিজেদেরই অনেকেরই পশ্চাদ্দেশ উদোম হয়ে যাওয়ার ভয় থাকে। আমরা সে ভয়ের কারণটা বুঝি। বুঝি বলেই কিন্তু আপনারা যখন ইরাক আক্রমণ করেন, আমরা কথা বলি না।
চুপ করে থাকি, আর ভাবি যে, বড় ভাইয়ের সিদ্ধান্ত, আমরা ছোট মানুষ চুপ করে থাকাটাই নিরাপদ। আমাদের মতো ছোটরা কেউ যদিবা মুখ খোলে তার ওপর আপনাদের "স্যাংকসনের" খড়্গ নেমে আসতে সময় নেয় না।
তাই ভয়ও পাই খুউব। কিন্তু ১৯৭১ যেহেতু বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসে একমাত্র বড় অর্জন সেহেতু এ নিয়ে বাঙালির উচ্ছ্বাসকে আপনারা থামিয়ে দিতে চেয়েছেন ১৯৭৫ সালেই। আমরা সে-ও সহ্য করে এগিয়ে এসেছি। আবার আজকে যখন ১৯৭১ সালের অপরাধীদের বিচার করছি আপনাদেরই দেখানো আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে (নুরেমবার্গ ট্রায়ালসহ অন্যান্য দেশে গণহত্যার বিরুদ্ধে বসানো স্বীকৃত কমিশন অনুসরণে) তখন আপনারা বলছেন, বিচার আন্তর্জাতিক মানের হয়নি।
আপনারা ধূয়া তুলছেন মানবাধিকারের। কিন্তু মশাই, ১৯৭১ সালে ওরা তো মানবের মতো কাজ করেনি, কাজ করেছে দানবের মতো। আপনারা ওদের জন্য 'মানবাধিকার' শব্দটি খরচ না করে 'দানবাধিকার' শব্দটি প্রয়োগ করলে যথার্থ হতো বলে আমরা মনে করি। মানবে আর দানবে যে বিশাল পার্থক্য রযেছে সেটি আপনাদেরকে বুঝতে হবে। আপনারা বুঝবেন না জানি, কারণ, আপনাদের কাছে পৌঁছেছে দানবের বাণী, মানবের বাণী আপনাদের কানে কখনও পৌঁছেনি, পৌঁছবেও না কোনোদিন।
আজকে বাংলাদেশের দিকে তাকান। কী দেখতে পান? দেশটা জ্বলছে। আপনাদের কি ধারণা? এ কেবল রাজনীতির কারণে? দু'টি রাজনৈতিক দল ঐকমত্যে পৌঁছতে পারছে না, সেজন্য? একটুও না। যারা এরকমটি মনে করেন, তারা হয় অতি সরল, নয় অতি চালাক। সরল বলছি এ কারণে যে, তারা শুধু ওপরে ওপরে দু'টি পক্ষের রাজনৈতিক কোন্দল দেখতে পাচ্ছেন। তারা ভুলে গিয়েছেন যে, বাংলাদেশে রাজনৈতিক কোন্দল অতীতেও হয়েছে কিন্তু এরকম সহিংসতা, এতো অগ্নুৎসব কখনও হয়নি। প্রাণহানিও হয়নি এমন।
তারা সরল বলে সেসব বিচারের পক্ষপাতি নয়। আরা যারা চালাক তারাতো এসবই চাইছেন, যাতে এই আগুনে তারা ক্ষমতার ছোলা পুড়িয়ে খেতে পারেন। জাতিসংঘ, ব্রিটেন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন--- আপনারা তো সকলেই বিবেকবান, সকলেই বুদ্ধিমান আর মানবতাবাদী। একটু মানবিকভাবে বিষয়টা ভেবে দেখুন তো! এই সেদিনও যারা এদেশকে আফগানিস্তান বানানোর হুমকি দিয়েছে, এদেশের সৃষ্টিশীল মানুষদের কুপিয়ে রক্তাক্ত করেছে, সারাদেশে বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে এদেশকে একটি ধর্মভিত্তিক উগ্রবাদী রাষ্ট্রে পরিণত করতে চেয়েছে আজকে তাদের জন্য আপনাদের মানবতাবাদী বিবেকের দরদ উথলে উঠেছে।
আপনারা তো গণতন্ত্রবাদী, সংখ্যাগরিষ্ঠের রায়কে মেনে নেন। আপনারা নিশ্চয়ই মানবেন যে, ২০০৮ সালে এদের বিপক্ষেই একটি রাজনৈতিক দলকে দুই-তৃতীয়াংশেরও বেশি সংখ্যাগরিষ্ঠতা দিয়ে ক্ষমতায় পাঠিয়েছিল এদেশের জনগণ। আপনারা নিশ্চয়ই একথাও মানবেন যে, তারা তাদের নির্বাচনীয় ইশতাহারেও ১৯৭১ সালের মানবতা-বিরোধী অপরাধীদের বিচারের প্রতিশ্রুতি জনগণকে দিয়েছিল।
এখন যখন জনগণকে দেয়া প্রতিশ্রুতি তারা রক্ষা করতে চাইছে তখন কেন আপনাদের বিবেকের দংশন (?) হচ্ছে, জানতে পারি কি? জানি, এ উত্তর অজ্ঞাত, আপনাদেরও হয়তো জানা নেই।
কোন্ সে যাদু আপনাদের মানবাধিকারবোধকে জাগ্রত করছে তা আপনারাই ভালো বলতে পারবেন, আমাদের তা না জানলেও চলবে।
তবে, একটা কথা। একটু আগেই বলেছি, এদেশে এখন চলছে যুদ্ধাবস্থা। দুই বিবদমান রাজনৈতিক দলের একপক্ষের ভাইস চেয়ারম্যানই আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকার দিয়ে সেটি স্বীকার করেছেন। তিনি আপনাদেরই উদাহরণ টেনেছেন, বলেছেন, আফগানিস্তান এবং ইরাকের কথা।
এবং এটাই বলতে চেয়েছেন যে, ওখানে যদি মানবাধিকার লংঘন না হয়ে থাকে, আপনারা দোষ না করে থাকেন তাহলে এদেশেও তারা এই হত্যা, ধ্বংস আর মিথ্যাচার চালিয়ে অন্যায় কিছু করছেন না। এবার বুঝুন তবে, আপনারা কিন্তু সবদিক দিয়েই ব্যবহৃত হচ্ছেন:
এক. আপনাদের দিয়ে বলানো হচ্ছে যে, এদেশে মানবাধিকার লংঘিত হচ্ছে; দুই. আবার আপনাদের মানবাধিকার লংঘনের ঘটনাই উদাহরণ হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। এতে ক্ষতিটা কিন্তু আপনাদেরই হচ্ছে। পৃথিবীটা তো গোল, একা পশ্চিমও চলতে পারে না, পুবও পারবে না। তাই আপনারা পুবকে এভাবে আহত করে ছেড়ে দিলে আপনারা এক সময় বিচ্ছিন্ন হবেন, সন্দেহ নেই। আপনাদের গবেষকরাই কিন্তু বলছে, "পুব জাগছে" (ইস্ট ইজ রাইজিং)। এখন প্রশ্ন হলো, এই জাগন-প্রক্রিয়ায় আপনারা কোন্ পক্ষে থাকবেন? মানবের নাকি দানবের? আপনারা দয়া করে জানার চেষ্টা করুন, এদেশে সত্যিই এখন মানব আর দানবে যুদ্ধ চলছে।
দানবের হাতে আক্রান্ত মানব, মানবতা এবং সভ্যতা। এরা এই দেশকে ফিরিয়ে নিতে চাইছে মধ্যযুগে।
আফগানিস্তানে যেমন পারেননি তাদেরকে সভ্যতায় ধরে রাখতে, এদেশেও যদি ওরা জয়ী হয়, এখানেও তাদের সভ্যতায় ধরে রাখতে পারবেন না। তাই হয় আপনারা মানবের পক্ষে দাঁড়ান, না হয়, এদেশের মানুষের ন্যায় যুদ্ধ এদের নিজেদেরকেই করতে দিন। জয়-পরাজয় পরে দেখা যাবে। অন্ততঃ দানবের পক্ষে গলাবাজি করে আপনারা দুর্নামের ভাগিদার হবেন না। দোহাই আপনাদের।
--------------------------------------------------------------------------------------------------
মন্তব্য:মানবাধিকার সংস্থাগুলো আজকাল বাংলাদেশে ঢুকে দানবাধিকার রক্ষা সংস্থায় বিবর্তিত হচ্ছে।
No comments:
Post a Comment