একসময় আমার প্রিয় জায়গা ছিল চট্টগ্রামের পাবলিক লাইব্রেরী। আশি নব্বই দশকের ছাত্রজীবনের অনেকগুলো দুপুর কেটেছে লাইব্রেরীতে। শুনে মনে হতে পারে খুব ভালো ছাত্র ছিলাম। আসলে একেবারেই উল্টো। আমার একাডেমিক বইয়ের একটা পাতাও কোনদিন আমি উল্টাইনি লাইব্রেরীতে। ওখানে যেতাম শুধু আনন্দ পাঠের জন্য, আউট বইয়ের খোঁজে, যে বইগুলোতে পৃথিবীর আলো হাওয়া ভেসে বেড়ায় সেই বইয়ের সমুদ্রে স্নান করার জন্য যেতাম। বেহুদা ক্লাসের বই পড়ে কে সময় নষ্ট করে।
বিনাপয়সায় অকাজের বই পড়ার জন্য আমার পছন্দের জায়গা ছিল তিনটা।
১) চট্টগ্রাম পাবলিক লাইব্রেরী(তখন এটা ছিল মুসলিম হলের ভেতরে, পরে নতুন ভবনে আসে),
২) চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরী(এটা ছিল তখন আর্টসফ্যাকাল্টির সামনের এডমিন বিল্ডিং এ,
বর্তমান অবস্থায় এসেছে নব্বই সালের পরে পাহাড়ের পাদদেশে),
৩) বৃটিশ কাউন্সিল লাইব্রেরী (তখন এটা ছিল লালদিঘির দক্ষিণ পাড়ে)।
একটা সময় আবিষ্কার করি লালদীঘির পাড়ে বৃটিশ কাউন্সিলের উপর তলায় আরেকটা লাইব্রেরী আছে, যার নাম মিউনিসিপ্যাল পাবলিক লাইব্রেরী। অনেকে এটার খোঁজ জানে না। এই লাইব্রেরীতে উপনিবেশ আমলের বই পত্রিকাও দেখেছিলাম। এটা চতুর্থ নাম্বার হতে গিয়েও হয়নি, কারণ এই লাইব্রেরীতে নিয়মিত যাতায়াত ছিল না।
এই লাইব্রেরীগুলোতে বই পড়া, বই খোঁজা ইত্যাদি খুব সহজ ছিল। সহজ মানে হাতের নাগালে থাকতো বইয়ের তাকগুলো। নিজে পছন্দ করে বই নিতে পারতাম। সব লাইব্রেরীতে এই সুবিধা থাকে না। ঢাকা গেলে আমি ঘুরঘুর করতাম পাবলিক লাইব্রেরীর আশেপাশে। ঢুকতে সাহস হতো না। একদিন সাহস করে ঢুকে গেলাম। কিন্তু ওখানে দেখি কঠোর নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থা। আমার ভালো লাগলো না। ওখানে দুয়েকবার গিয়ে বিরক্ত হয়ে এসেছি। কয়েক বছর পর চট্টগ্রাম পাবলিক লাইব্রেরী বাদে চট্টগ্রামের বাকীগুলোতেও ঢাকার সিস্টেমে বই পড়া চালু হয়। তখন থেকে আমি লাইব্রেরীতে যাতায়াত বন্ধ করে দেই। গত দুই দশক আমি আর লাইব্রেরীতে যাই না। চট্টগ্রাম পাবলিক লাইব্রেরী এখন কি অবস্থায় আছে জানি না। ইচ্ছে করলেও সময় মেলাতে পারি না। ওরা যখন খোলে আমি তখন অফিসে, আমি যখন বের হই অফিস থেকে ওরা তখন বন্ধ করে চলে যায়।
ছেলেবেলায় বই কেনার জন্য প্রিয় জায়গা ছিল নিউমার্কেটের দোতলার বইঘর। এটা বন্ধ হয়ে যায় আমি বড় হতে হতে। যদ্দুর মনে পড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে শুরু করার পরও ছিল দোকানটা। বেশ কিছু দুর্লভ বই কিনেছিলাম শেষবারে। তারপর একদিন দেখি বইঘরে তালা। তারও কিছুদিন পর দেখি এটা স্বর্নের দোকান হয়ে গেছে। আমার বুক থেকে নিঃশব্দে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে গিয়েছিল। বইঘর আমার কাছে কেবল একটা দোকান ছিল না। আমার শৈশবে এই্ দোকানের মাধ্যমেই আমি বই পড়তে ভালোবেসেছিলাম। আমি ক্লাস থ্রিতে পড়ার সময় বাবা আমাকে নিয়ে এই দোকানে গিয়েছিল। সেই শৈশবেই ভালোবেসে ফেলেছিলাম দোকানটাকে। ওই স্মৃতিটা এখনো তরতাজা। ওই স্মৃতিকে আমি এখনো প্রবলভাবে ভালোবাসি।
বইঘর হারিয়ে ঝুঁকে পড়ি কারেণ্ট বুক সেন্টার, মনীষা, অমর বইঘর ইত্যাদির দিকে। এক তলায় লাইসিয়াম নামে একটা দোকান ছিল, সেখানেও বিস্তর বই ছিল। দামী দামী বই থাকতো লাইসিয়ামে। কেনার সাধ্য ছিল না আমার। তবু হাতে নিয়ে নেড়ে চেড়ে দেখতে এত ভালো লাগতো! কারেন্ট বুক সেন্টারেও সব দামী বই ছিল, কিন্তু তাদের পেছনে গুদামে বেশ কিছু পুরোনো এডিশনের বই থাকতো। সেখান থেকে সস্তায় বেশ কিছু বই কিনেছিলাম। বইঘরের পর কারেন্ট বুক সেন্টারের কাছে আমার ঋন। একসময় অমর বইঘরের খোঁজ পেয়ে যাই। সেই প্রথম পুরোনো বইয়ের সাম্রাজ্যে ঢুকে পড়ি। অনেক বছর বুঁদ হয়ে ছিলাম সেখানে। নিউমার্কেটের মণীষা প্রিয় ছিল রাশিয়ান বইগুলোর জন্য। আমার রাশিয়ান কালেকশানের অনেকটাই ওখান থেকে নেয়া। আন্দরকিল্লার কথাকলির কথাও উল্লেখ করতে হয়। এটাও ছিল খান্দানী বইয়ের দোকান। দাম ধরাছোয়ার বাইরে। তবু বইয়ের ঘ্রাণ নিতে স্পর্শ পেতে, সস্তা এডিশনের কোন বইয়ের খোঁজে ঘুরে বেড়াতাম এই দোকানগুলোতে। বইয়ের একটা মজা ছিল গায়ের দামে কেনা যেত। আমি পাকিস্তান আমলে প্রকাশিত ৫ টাকা দামের মোটা একটা বই বিশ বছর পরেও একই দামে কিনেছি কারেন্ট বুক সেন্টার থেকে।
কারেন্ট বুক সেন্টারে আজকাল যাওয়া হয় না। যাওয়া হয় না অমর বইঘরেও। মণীষা তো নেই। বইকেনার যাতায়াত এখন বাতিঘর, বিশদ বাঙলায় সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে। অবাক লাগে শহরে জনসংখ্যা যানবাহন হাটবাজার শপিং সেন্টার বেড়েছে অগণিত, কিন্তু বই কেনার জায়গা বেড়েছে মাত্র তিন চারটে। যতটা বেড়েছে তার চেয়ে বন্ধ হয়ে যাওয়া দোকানের সংখ্যা বেশী। কারেণ্ট বুক সেন্টারকে চারপাশের ফুটপাত হকার যেভাবে গ্রাস করে রেখেছে ওটার নিঃশ্বাস নেবার জায়গাটুকুই কেবল আছে এখন।
আমি বইকেনার দিনগুলোর কথা ভেবে বিষন্নবোধ করি। তখন যদি আরেকটু স্বচ্ছলতা থাকতো, আরো কিছু বেশী বই কিনতে পারতাম, আরো কিছু বেশী পড়তে পারতাম। এখন সামর্থ্য আছে সময় নেই। মানুষের গোটা জীবনটাই এরকম নানাবিধ বৈপরীত্যে কেটে যায়। বিনাপয়সায় অকাজের বই পড়ার জন্য আমার পছন্দের জায়গা ছিল তিনটা।
১) চট্টগ্রাম পাবলিক লাইব্রেরী(তখন এটা ছিল মুসলিম হলের ভেতরে, পরে নতুন ভবনে আসে),
২) চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরী(এটা ছিল তখন আর্টসফ্যাকাল্টির সামনের এডমিন বিল্ডিং এ,
বর্তমান অবস্থায় এসেছে নব্বই সালের পরে পাহাড়ের পাদদেশে),
৩) বৃটিশ কাউন্সিল লাইব্রেরী (তখন এটা ছিল লালদিঘির দক্ষিণ পাড়ে)।
একটা সময় আবিষ্কার করি লালদীঘির পাড়ে বৃটিশ কাউন্সিলের উপর তলায় আরেকটা লাইব্রেরী আছে, যার নাম মিউনিসিপ্যাল পাবলিক লাইব্রেরী। অনেকে এটার খোঁজ জানে না। এই লাইব্রেরীতে উপনিবেশ আমলের বই পত্রিকাও দেখেছিলাম। এটা চতুর্থ নাম্বার হতে গিয়েও হয়নি, কারণ এই লাইব্রেরীতে নিয়মিত যাতায়াত ছিল না।
এই লাইব্রেরীগুলোতে বই পড়া, বই খোঁজা ইত্যাদি খুব সহজ ছিল। সহজ মানে হাতের নাগালে থাকতো বইয়ের তাকগুলো। নিজে পছন্দ করে বই নিতে পারতাম। সব লাইব্রেরীতে এই সুবিধা থাকে না। ঢাকা গেলে আমি ঘুরঘুর করতাম পাবলিক লাইব্রেরীর আশেপাশে। ঢুকতে সাহস হতো না। একদিন সাহস করে ঢুকে গেলাম। কিন্তু ওখানে দেখি কঠোর নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থা। আমার ভালো লাগলো না। ওখানে দুয়েকবার গিয়ে বিরক্ত হয়ে এসেছি। কয়েক বছর পর চট্টগ্রাম পাবলিক লাইব্রেরী বাদে চট্টগ্রামের বাকীগুলোতেও ঢাকার সিস্টেমে বই পড়া চালু হয়। তখন থেকে আমি লাইব্রেরীতে যাতায়াত বন্ধ করে দেই। গত দুই দশক আমি আর লাইব্রেরীতে যাই না। চট্টগ্রাম পাবলিক লাইব্রেরী এখন কি অবস্থায় আছে জানি না। ইচ্ছে করলেও সময় মেলাতে পারি না। ওরা যখন খোলে আমি তখন অফিসে, আমি যখন বের হই অফিস থেকে ওরা তখন বন্ধ করে চলে যায়।
ছেলেবেলায় বই কেনার জন্য প্রিয় জায়গা ছিল নিউমার্কেটের দোতলার বইঘর। এটা বন্ধ হয়ে যায় আমি বড় হতে হতে। যদ্দুর মনে পড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে শুরু করার পরও ছিল দোকানটা। বেশ কিছু দুর্লভ বই কিনেছিলাম শেষবারে। তারপর একদিন দেখি বইঘরে তালা। তারও কিছুদিন পর দেখি এটা স্বর্নের দোকান হয়ে গেছে। আমার বুক থেকে নিঃশব্দে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে গিয়েছিল। বইঘর আমার কাছে কেবল একটা দোকান ছিল না। আমার শৈশবে এই্ দোকানের মাধ্যমেই আমি বই পড়তে ভালোবেসেছিলাম। আমি ক্লাস থ্রিতে পড়ার সময় বাবা আমাকে নিয়ে এই দোকানে গিয়েছিল। সেই শৈশবেই ভালোবেসে ফেলেছিলাম দোকানটাকে। ওই স্মৃতিটা এখনো তরতাজা। ওই স্মৃতিকে আমি এখনো প্রবলভাবে ভালোবাসি।
বইঘর হারিয়ে ঝুঁকে পড়ি কারেণ্ট বুক সেন্টার, মনীষা, অমর বইঘর ইত্যাদির দিকে। এক তলায় লাইসিয়াম নামে একটা দোকান ছিল, সেখানেও বিস্তর বই ছিল। দামী দামী বই থাকতো লাইসিয়ামে। কেনার সাধ্য ছিল না আমার। তবু হাতে নিয়ে নেড়ে চেড়ে দেখতে এত ভালো লাগতো! কারেন্ট বুক সেন্টারেও সব দামী বই ছিল, কিন্তু তাদের পেছনে গুদামে বেশ কিছু পুরোনো এডিশনের বই থাকতো। সেখান থেকে সস্তায় বেশ কিছু বই কিনেছিলাম। বইঘরের পর কারেন্ট বুক সেন্টারের কাছে আমার ঋন। একসময় অমর বইঘরের খোঁজ পেয়ে যাই। সেই প্রথম পুরোনো বইয়ের সাম্রাজ্যে ঢুকে পড়ি। অনেক বছর বুঁদ হয়ে ছিলাম সেখানে। নিউমার্কেটের মণীষা প্রিয় ছিল রাশিয়ান বইগুলোর জন্য। আমার রাশিয়ান কালেকশানের অনেকটাই ওখান থেকে নেয়া। আন্দরকিল্লার কথাকলির কথাও উল্লেখ করতে হয়। এটাও ছিল খান্দানী বইয়ের দোকান। দাম ধরাছোয়ার বাইরে। তবু বইয়ের ঘ্রাণ নিতে স্পর্শ পেতে, সস্তা এডিশনের কোন বইয়ের খোঁজে ঘুরে বেড়াতাম এই দোকানগুলোতে। বইয়ের একটা মজা ছিল গায়ের দামে কেনা যেত। আমি পাকিস্তান আমলে প্রকাশিত ৫ টাকা দামের মোটা একটা বই বিশ বছর পরেও একই দামে কিনেছি কারেন্ট বুক সেন্টার থেকে।
কারেন্ট বুক সেন্টারে আজকাল যাওয়া হয় না। যাওয়া হয় না অমর বইঘরেও। মণীষা তো নেই। বইকেনার যাতায়াত এখন বাতিঘর, বিশদ বাঙলায় সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে। অবাক লাগে শহরে জনসংখ্যা যানবাহন হাটবাজার শপিং সেন্টার বেড়েছে অগণিত, কিন্তু বই কেনার জায়গা বেড়েছে মাত্র তিন চারটে। যতটা বেড়েছে তার চেয়ে বন্ধ হয়ে যাওয়া দোকানের সংখ্যা বেশী। কারেণ্ট বুক সেন্টারকে চারপাশের ফুটপাত হকার যেভাবে গ্রাস করে রেখেছে ওটার নিঃশ্বাস নেবার জায়গাটুকুই কেবল আছে এখন।
No comments:
Post a Comment