Thursday, December 26, 2013

কংকাল


অসময়ে ক্রিং করে বাজলো কলিংবেলটা। এই ভর দুপুরে কে এল? দরোজা খুলতেই আচমকা একটা লোক তাকে ধাক্কা মেরে ঘরে ঢুকে ধারালো ছুরিটা গলার মধ্যে এমনভাবে চেপে বসালো যাতে সে একটু নড়লেই নালী কেটে যায়। প্রচণ্ড ভয় পেয়ে চিৎকারও করতে পারছে না। ঘরে কেউ নেই। স্বামী স্ট্রোক করে মারা গেছে দুবছর আগে। দুটো ছেলেমেয়ে। ওরা এখন স্কুলে। বিকেলে ফিরবে। পাশের বাসাটাও খালি। এসব কি হচ্ছে? মতলব কি লোকটার? দেখে তো ভদ্র মনে হচ্ছিল তাই দরোজা খুললো। তাছাড়া একদম অচেনাও মনে হচ্ছে না। স্বামীর বন্ধুদের কেউ কি? কিন্তু কোথায় দেখেছে ঠিক মনেও করতে পারছে না রাবেয়া বেগম।

চেহারায় ভদ্র আচরণে নিষ্ঠুর লোকটা তার চুলের মুঠি চেপে ধরে গলায় ছুরির ধারালো ফলাটা আটকে রেখেছে। সে বেশী নড়াচড়া করলে ছুরিটা গলার ভেতরে ডেবে যাবে। রাবেয়া বেগম বুঝে গেল আর উপায় নেই। সে বাধা দেবার বদলে আত্মসমর্পন করার জন্য মনে মনে প্রস্তুত হলো। ছেলেমেয়ে দুটোর জন্য তাকে বাঁচতে হবে। এভাবে বেফাঁস মারা পড়া চলবে না। লোকটা যা যায় বিনা আপত্তিতে দিয়ে দেবে। কিন্তু কি চায় সে?

লোকটা কানের কাছে হিসহিস করে বললো - ত্রিশ লাখ টাকা!!

রাবেয়া বেগম চমকে উঠলো। হ্যাঁ এবার মনে পড়েছে। এই সেই ব্যাংক ম্যানেজার। যে ব্যাংক ঋন দেবার প্রক্রিয়া চলার সময় এই বাড়িতে এসেছিল। সেই একবারই। ঘরটা তখন এমন খুঁটিয়ে দেখছিল, দলিলপত্র এমন চিপে চিপে দেখছিল, আর তাকে বেছে বেছে এমন কঠিন জেরা করছিল, যেন সে টাকাটা মেরে পালিয়ে যাবে। লোকটাকে প্রথম দর্শনেই অপছন্দ করেছিল রাবেয়া। তবু স্বামী মারা যাবার পর সংসারকে টিকিয়ে রাখতে তার একটা আয়ের দরকার ছিল। ঢাকা শহরের এই বাড়ি ছাড়া আর কোথাও কোন আশ্রয় নেই তার। বাড়িটা দিয়েই তাদের বেঁচে থাকতে হবে।

বাড়িটা ব্যাংকে বন্ধক রেখে ত্রিশ লাখ টাকা ঋন নিয়েছিল বছরখানেক আগে। মাসে মাসে ঋনের কিস্তি পরিশোধ করতে হয় ৫০ হাজার টাকা। ঋনের টাকা দিয়ে একটা কাভার্ড ভ্যান কিনে ভাড়ায় দিয়েছিল একটা কোম্পানীকে। বড় ভাইয়ের পরিচিত কোম্পানী। সেই সব ব্যবস্থা করে দেয়। সেই কোম্পানী মাসে ৮০ হাজার টাকা করে দেয়। কিস্তি পরিশোধ করার পার বাকী টাকায় তাদের তিনজনের সংসার খুব সুন্দর চলে। সে ঠিকমতোই ব্যাংকে টাকা জমা দিচ্ছিল। গত ১২ টা কিস্তির একটাও হেরফের হয়নি। নিশ্চিন্তে চলছিল সবকিছু।

কিন্তু তবু এই লোক, মানে ব্যাংক ম্যানেজার জাফর সাহেব এভাবে তার উপর চড়াও হলো কেন? কেন বলছে ত্রিশ লাখ টাকার কথা? সে তো মাসে মাসেই টাকাটা ফেরত দেবার কথা। একসাথে ফেরত চাইছে কেন এখন? সব কেমন এলোমেলো লাগছে।

তাছাড়া সে কল্পনাও করেনি কখনো কোন ব্যাংকের লোক এসে গলায় ছুরি ধরে টাকা ফেরত চায়। চোখ ফেটে জল আসছে তার। সে কোথা থেকে টাকা দেবে? তার জীবনটা দিয়ে দিলেও তো সে টাকাটা এখন দিতে পারবে না। আরো পাঁচ ছয় বছরে সব টাকা শোধ হবে। তার আগে কেন সে টাকা ফেরত চাইবে? দেশে কি আইন কানুন নেই? এমন তো কথা ছিল না।

কিন্তু কে বলতে যাবে তাকে এই কথা। নিষ্ঠুর লোকটা তার গলায় ছুরিটা চালিয়ে দিলে কেউ বাঁচাতে পারবে না। জাফর সাহেব তখনো দাঁত খিঁচিয়ে বলে যাচ্ছে, আমার ত্রিশ লাখ টাকা ফেরত দে!!

গলায় ব্যথা লাগছে রাবেয়া বেগমের। রক্ত বেরিয়ে গেছে মনে হয়। গলা দিয়ে কোন শব্দ বের হচ্ছে না। তার গলায় কি পোচ দিয়ে ফেলেছে লোকটা? কিছুই ভাবতে পারছে না। ঝাপসা লাগছে, কেমন ধোঁয়াশা। সে মরে যাবার আগে প্রাণপনে চিৎকার দিতে চাইল একটা। চীৎকার বের হচ্ছে না, কেমন গোঁ গোঁ শব্দ শুধু।

সেই চিৎকারেই ঘুম ভেঙ্গে গেল রাবেয়ার। চোখ মেলে দেখলো, বাইরে দুপুর নেমে গেছ। ঘরের দরোজা বন্ধ। কেউ আসেনি। সে এতক্ষণ দুঃস্বপ্ন দেখছিল। হাঁপ ছেড়ে বাঁচলো। কিন্তু গলার ব্যথাটা এখনো খচখচ করছে। ব্যথাটা মাছের কাঁটার।

দুপুরে কই মাছ আর শিমের বিচির ঝোল দিয়ে তৃপ্তির সাথে ভাত খাওয়ার সময় গলায় একটা কাঁটা লেগে যায় তার। কই মাছের কাঁটা জিনিসটা বড়শির মতো। ভয়ে কোনদিন কইমাছ কেনে না সে। আজ বোনের বাসা থেকে রান্না করে পাঠালে সে ভাবলো একটু খেয়ে দেখি। খেতে গিয়েই ঝামেলাটা হয়ে গেল। কোন উপায়েই বের করা গেল না। বিকেলে পাড়ার ডিসপেন্সারির সাধন ডাক্তারের কাছে গিয়ে ব্যবস্থা করতে হবে ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়েছিল।


রাবেয়া বেগম উঠে এক গ্লাস পানি খেল।
ব্যথাটা একটু কমেছে। মাছের কাঁটা নাকি আপনাআপনি নেমে যায় অধিকাংশ সময়।

ছেলেমেয়েদের আসার সময় হয়ে গেছে। তাদের জন্য নাস্তা বানাতে হবে।

স্বপ্নের কথাটা ভেবে শিউরে উঠলেও মনে মনে হাসলো।
ছি! সে ব্যাংক ম্যানেজারকে প্রথম দর্শনে অপছন্দ করেছিল বলে এরকম বাজে স্বপ্ন দেখেছে। লোকটা অতটা খারাপ না। ঋনের চেকটা হাতে নেবার সময় জাফর সাহেবকে বরং দয়ালুই মনে হয়েছিল।

ফ্রিজ থেকে কিমা বের করে কয়েকটা রোল বানিয়ে টেবিলে সাজিয়ে রাখলো। ছেলেমেয়ে দুজনই পছন্দ করে এই খাবার তেঁতুলের সস দিয়ে খেতে। ঘরে তৈরী সসও আছে।

বেসিনে হাত ধুয়ে কলিং বেলের শব্দের জন্য অপেক্ষা করছে রাবেয়া। এসময়ের কলিংবেলটা তার খুব প্রিয়। কিন্ত কলিং বেলের বদলে বাজতে শুরু করলো মোবাইলটা। বড় ভাইয়ের নাম্বার। তার খুব ভরসার নাম্বার এটি। সে খুশী হয়ে ভাবলো, ভাইয়াদের আসতে বলি। এই কিমাভর্তি রোলটা ভাইয়ারও খুব পছন্দ। ওদের বাসা কাছেই।

ফোন ধরে বললো, ভাইজান আগে আমার কথা শোনো, তোমরা কিন্তু আজ বিকালে আমার এখানে চা খাবা।

ভাইয়া কেমন থম ধরা গলায় বললো, আসবো। তার আগে একটা খারাপ খবর শোন। আজ দুপুরে সীতাকুণ্ডে কয়েকটা গাড়িতে আগুন দেবার খবর দেখেছিস টিভিতে?

রাবেয়ার আর শুনতে হলো না। বুঝে গেল বাকী অংশ। রাবেয়ার গলায় ব্যাংক ম্যানেজারের ছুরিটা গলায় করাত হয়ে বসে হিসহিস করতে লাগলো, ত্রিশ লাখ টাকা! 

আজ হরতাল ছিল না, অবরোধ ছিল না। তবু জামাত শিবিরের বর্বর হামলায় তাদের বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বনটা লোহার কংকালে পরিণত হয়ে গেল।

No comments: