নবাব মিয়ার দিকে আমি তাকাতে পারি না অদ্ভুত এক অপরাধবোধে।
আমাদের কমিউনিটিতে ৬০টা অ্যাপার্টমেন্টে ৬০ পরিবার থাকে। প্রতিটা ফ্লোরে ৬টি অ্যাপার্টমেন্ট। এখানে সবাই ভাড়াটে। দালানের মালিক একজন। তিনি দেশের বাইরে থাকেন। এই কমপ্লেক্স চালাবার জন্য ১ জন ম্যানেজার এবং ৫ জন কর্মচারীসমৃদ্ধ একটা অফিস আছে ১২ তলায়। মূল মালিকের হয়ে তারাই এই কমপ্লেক্সের তত্ত্বাবধায়ক সরকার।
আধুনিক নগরগুলোতে বিচ্ছিন্ন জীবনযাপনের অলিখিত সংস্কার বা নিয়ম মেনে এই ৬০ পরিবারও যার যার মতো বিচ্ছিন্ন জীবনযাপন করে। এখানে এমনকি একই ফ্লোরের সব মানুষকে চেনে না সবাই। খুব ব্যক্তিগত সম্পর্ক না হলে কেউ কারো বাসায় যায় না। আমার ঠিক নীচের ফ্ল্যাটে কে থাকে আমি জানি না। আমার পাশের ফ্ল্যাটে আমি কখনো যাইনি। ওই ভদ্রলোকও কখনো আসেনি। আমাদের দেখা হয় লিফটে লবিতে। আমরা সৌজন্য হাসি বিনিময় করি মাত্র। এই ফ্লোরের ছয় পরিবারের অর্ধেক গৃহকর্তারও নাম জানি না। এখানে কোন বিধিনিষেধের ব্যাপার নাই, তবু সবাই কেমন যেন একটা দূরত্ব মেনে জীবনযাপন করে। শিশু-কিশোর পরিষদ যতটুকু পারে হৈ চৈ করে নিজেদের মধ্যে এই দূরত্ব ঘোচাবার চেষ্টা করলেও উচ্চ মধ্য পরিষদে সুশীল নীরবতা। অবশ্য অবসরপ্রাপ্ত অতি প্রবীন সমাজ নিজেদের মধ্যে সামান্য কিছু যোগাযোগ রাখে পরকাল সমৃদ্ধ করার তাগিদে।
আমি আজ লিখতে বসেছি একজন অবসরপ্রাপ্ত প্রবীণের কথা যিনি আমার কথিত কূলীন সমাজের অন্তর্ভুক্ত নন। যিনি রাত জেগে এই দালানের নিরাপত্তার দেখাশোনা করেন। তিনি এই দালানের নিরাপত্তা বিভাগের ৬ জনের একজন। সংসারের প্রয়োজন কতটা গুরুত্বপূর্ন হলে সত্তরোর্ধ অসুস্থ একজন মানুষকে কাজ করে যেতে হয় সেটা বোঝার জন্য সমাজবিজ্ঞানী হবার দরকার নেই। লোকটার চেহারায় সমীহ জাগানোর মতো কিছু একটা আছে। বাকী পাঁচ জনের চেয়ে তিনি কেমন আলাদা। তবু এরকম মানুষগুলোকে আসা যাওয়ার পথে সালাম বিনিময় ছাড়া ভালো করে জানা হয় না কখনো।
আমার সাথে তাঁর কোন কাজ নেই, কোন যোগসুত্র নেই, এমনকি আমি তাঁর নামও জানি না। নামের চেয়ে বুড়া সিকিউরিটি পরিচয়টাই বড় হয়ে সামনে এসে গিয়েছিল বলেই কি? একদিন রাতে অফিস থেকে ফেরার পথে বুড়া সিকিউরিটি আমার হাতে একটা হলুদ খাম দিয়ে বলে - স্যার এটা আপনার জন্য।
আমি বাসায় ঢুকে চা খেতে বসে খামটা খুলে দেখি আমার নামে কম্পিউটারে টাইপ করা একটা চিঠি। লিখেছেন নবাব মিয়া নামের একজন মানুষ। যিনি গলার ক্যান্সারে ভুগছেন দীর্ঘদিন ধরে। চিকিৎসা করাতে গিয়ে সর্বশান্ত হয়ে গেছেন। তিনি না বাঁচলে তাঁর পরিবারও বাঁচবে না। চিকিৎসার জন্য সাহায্য চেয়েছেন। আমি এই নামে কাউকে চিনি না। কে এই নবাব মিয়া?
১২ তলার তত্তাবধায়ক সরকারের অফিসে ফোন করে জানতে পারলাম আমাদের বুড়া সিকিউরিটিই নবাব মিয়া। চমকে উঠেছিলাম খুব। আমার ক্যান্সার হলেও ব্যয়বহুল চিকিৎসা করাতে গিয়ে ফতুর হয়ে যেতে হবে, আর এই দরিদ্র সর্বহারা বুড়া সিকিউরিটি কি করবে? কত টাকা লাগবে, কতটা করতে পারি আমি, এসব ভেবে খুব অসহায় লাগলো আমার। সবচেয়ে খারাপ লাগছে নবাব মিয়া আমার উপর এরকম একটা সাহায্য প্রত্যাশা রেখেছে। এই প্রত্যাশার দায় আমারই। আমি কি করে এই দায় মেটাবো? এমন সময় চিঠিটা এলো যখন আমার চাকরীর লে অফ নোটিশ আসতে পারে যে কোন সময়। নিজের চিন্তায় অস্থির এখন নবাব মিয়ার জন্য কি করবো?
কি করবো সিদ্ধান্ত নিতে না পেরে চেষ্টা করতে লাগলাম নবাব মিয়ার মুখোমুখি না হতে। প্রতিদিন গেট দিয়ে বেরুবার সময় নিজেকে চোরের মতো লাগে। এক অদ্ভুত অপরাধবোধ আমাকে গ্রাস করে। দুদিন পর আমি নবাব মিয়ার হাতে কোনমতে দুহাজার টাকা দিয়ে পালিয়ে আসি। কেননা আমার মনে হচ্ছিল নবাব মিয়া আমার কাছ থেকে বিশ হাজার টাকার প্রত্যাশা করেছিল। আমি এত কম দিয়ে দায় সারলাম? পরে জানতে পারি নবাবমিয়া আরো কয়েকজনের কাছ থেকে সাহায্য পেয়ে চিকিৎসা শুরু করে। কি চিকিৎসা আমি ভয়ে জিজ্ঞেস করি না। চিকিৎসা চলার সময় তার গলা চেহারা সব কালো হয়ে যায়।
মাসখানেক চিকিৎসা করার পর সে আবারো কাজে যোগ দেয়। আমার সাথে চোখাচোখি হলে 'কেমন আছেন' ইত্যাদি বলে সৌজন্য দায় সারি। এগিয়ে জিজ্ঞেস করি না, কতটাকা লাগলো, আর কত লাগবে?
সেদিন বাড়ি ফেরার পথে নবাব মিয়া বলে আমাকে দেখে বলে, স্যার একটা কথা ছিল। কথা শুনে আমি দাড়াই। সংক্ষেপে জানালো, গলার চিকিৎসার প্রাথমিক পর্ব আপাততঃ শেষ, এখন এই চিকিৎসার প্রতিক্রিয়া ঠেকাতে যে ওষুধ দিয়েছে সেটা কিনতে সারা মাসের বেতন শেষ হয়ে যায়। এই ওষুধ কতদিন খেতে হবে জানে না। গাল গলা সব ফুলে যাচ্ছে।
আমি আবারো অপরাধী চোখে নবাব মিয়ার দিকে তাকাই। তারপর মানিব্যাগ খুলে একটা পাঁচশো টাকার নোট হাতে তুলে দেই এবং যত দ্রুত সম্ভব চলে আসি তাঁর কাছ থেকে। আমার মনে হচ্ছিল নবাব মিয়া আমার কাছ থেকে কমপক্ষে দু হাজার টাকা আশা করেছিল। আমার মানিব্যাগে দুহাজার টাকার বেশী ছিল। তবু আমি পাঁচশো টাকা দিলাম কেন? আমাকে আরো কয়েকজন নবাবমিয়াকে সাহায্য করতে হয় বলে? আমার ক্ষমতা কম বলে? নাকি আমারও বেকারত্বের ভয় আছে বলে?
আমাদের কমিউনিটিতে ৬০টা অ্যাপার্টমেন্টে ৬০ পরিবার থাকে। প্রতিটা ফ্লোরে ৬টি অ্যাপার্টমেন্ট। এখানে সবাই ভাড়াটে। দালানের মালিক একজন। তিনি দেশের বাইরে থাকেন। এই কমপ্লেক্স চালাবার জন্য ১ জন ম্যানেজার এবং ৫ জন কর্মচারীসমৃদ্ধ একটা অফিস আছে ১২ তলায়। মূল মালিকের হয়ে তারাই এই কমপ্লেক্সের তত্ত্বাবধায়ক সরকার।
আধুনিক নগরগুলোতে বিচ্ছিন্ন জীবনযাপনের অলিখিত সংস্কার বা নিয়ম মেনে এই ৬০ পরিবারও যার যার মতো বিচ্ছিন্ন জীবনযাপন করে। এখানে এমনকি একই ফ্লোরের সব মানুষকে চেনে না সবাই। খুব ব্যক্তিগত সম্পর্ক না হলে কেউ কারো বাসায় যায় না। আমার ঠিক নীচের ফ্ল্যাটে কে থাকে আমি জানি না। আমার পাশের ফ্ল্যাটে আমি কখনো যাইনি। ওই ভদ্রলোকও কখনো আসেনি। আমাদের দেখা হয় লিফটে লবিতে। আমরা সৌজন্য হাসি বিনিময় করি মাত্র। এই ফ্লোরের ছয় পরিবারের অর্ধেক গৃহকর্তারও নাম জানি না। এখানে কোন বিধিনিষেধের ব্যাপার নাই, তবু সবাই কেমন যেন একটা দূরত্ব মেনে জীবনযাপন করে। শিশু-কিশোর পরিষদ যতটুকু পারে হৈ চৈ করে নিজেদের মধ্যে এই দূরত্ব ঘোচাবার চেষ্টা করলেও উচ্চ মধ্য পরিষদে সুশীল নীরবতা। অবশ্য অবসরপ্রাপ্ত অতি প্রবীন সমাজ নিজেদের মধ্যে সামান্য কিছু যোগাযোগ রাখে পরকাল সমৃদ্ধ করার তাগিদে।
আমি আজ লিখতে বসেছি একজন অবসরপ্রাপ্ত প্রবীণের কথা যিনি আমার কথিত কূলীন সমাজের অন্তর্ভুক্ত নন। যিনি রাত জেগে এই দালানের নিরাপত্তার দেখাশোনা করেন। তিনি এই দালানের নিরাপত্তা বিভাগের ৬ জনের একজন। সংসারের প্রয়োজন কতটা গুরুত্বপূর্ন হলে সত্তরোর্ধ অসুস্থ একজন মানুষকে কাজ করে যেতে হয় সেটা বোঝার জন্য সমাজবিজ্ঞানী হবার দরকার নেই। লোকটার চেহারায় সমীহ জাগানোর মতো কিছু একটা আছে। বাকী পাঁচ জনের চেয়ে তিনি কেমন আলাদা। তবু এরকম মানুষগুলোকে আসা যাওয়ার পথে সালাম বিনিময় ছাড়া ভালো করে জানা হয় না কখনো।
আমার সাথে তাঁর কোন কাজ নেই, কোন যোগসুত্র নেই, এমনকি আমি তাঁর নামও জানি না। নামের চেয়ে বুড়া সিকিউরিটি পরিচয়টাই বড় হয়ে সামনে এসে গিয়েছিল বলেই কি? একদিন রাতে অফিস থেকে ফেরার পথে বুড়া সিকিউরিটি আমার হাতে একটা হলুদ খাম দিয়ে বলে - স্যার এটা আপনার জন্য।
আমি বাসায় ঢুকে চা খেতে বসে খামটা খুলে দেখি আমার নামে কম্পিউটারে টাইপ করা একটা চিঠি। লিখেছেন নবাব মিয়া নামের একজন মানুষ। যিনি গলার ক্যান্সারে ভুগছেন দীর্ঘদিন ধরে। চিকিৎসা করাতে গিয়ে সর্বশান্ত হয়ে গেছেন। তিনি না বাঁচলে তাঁর পরিবারও বাঁচবে না। চিকিৎসার জন্য সাহায্য চেয়েছেন। আমি এই নামে কাউকে চিনি না। কে এই নবাব মিয়া?
১২ তলার তত্তাবধায়ক সরকারের অফিসে ফোন করে জানতে পারলাম আমাদের বুড়া সিকিউরিটিই নবাব মিয়া। চমকে উঠেছিলাম খুব। আমার ক্যান্সার হলেও ব্যয়বহুল চিকিৎসা করাতে গিয়ে ফতুর হয়ে যেতে হবে, আর এই দরিদ্র সর্বহারা বুড়া সিকিউরিটি কি করবে? কত টাকা লাগবে, কতটা করতে পারি আমি, এসব ভেবে খুব অসহায় লাগলো আমার। সবচেয়ে খারাপ লাগছে নবাব মিয়া আমার উপর এরকম একটা সাহায্য প্রত্যাশা রেখেছে। এই প্রত্যাশার দায় আমারই। আমি কি করে এই দায় মেটাবো? এমন সময় চিঠিটা এলো যখন আমার চাকরীর লে অফ নোটিশ আসতে পারে যে কোন সময়। নিজের চিন্তায় অস্থির এখন নবাব মিয়ার জন্য কি করবো?
কি করবো সিদ্ধান্ত নিতে না পেরে চেষ্টা করতে লাগলাম নবাব মিয়ার মুখোমুখি না হতে। প্রতিদিন গেট দিয়ে বেরুবার সময় নিজেকে চোরের মতো লাগে। এক অদ্ভুত অপরাধবোধ আমাকে গ্রাস করে। দুদিন পর আমি নবাব মিয়ার হাতে কোনমতে দুহাজার টাকা দিয়ে পালিয়ে আসি। কেননা আমার মনে হচ্ছিল নবাব মিয়া আমার কাছ থেকে বিশ হাজার টাকার প্রত্যাশা করেছিল। আমি এত কম দিয়ে দায় সারলাম? পরে জানতে পারি নবাবমিয়া আরো কয়েকজনের কাছ থেকে সাহায্য পেয়ে চিকিৎসা শুরু করে। কি চিকিৎসা আমি ভয়ে জিজ্ঞেস করি না। চিকিৎসা চলার সময় তার গলা চেহারা সব কালো হয়ে যায়।
মাসখানেক চিকিৎসা করার পর সে আবারো কাজে যোগ দেয়। আমার সাথে চোখাচোখি হলে 'কেমন আছেন' ইত্যাদি বলে সৌজন্য দায় সারি। এগিয়ে জিজ্ঞেস করি না, কতটাকা লাগলো, আর কত লাগবে?
সেদিন বাড়ি ফেরার পথে নবাব মিয়া বলে আমাকে দেখে বলে, স্যার একটা কথা ছিল। কথা শুনে আমি দাড়াই। সংক্ষেপে জানালো, গলার চিকিৎসার প্রাথমিক পর্ব আপাততঃ শেষ, এখন এই চিকিৎসার প্রতিক্রিয়া ঠেকাতে যে ওষুধ দিয়েছে সেটা কিনতে সারা মাসের বেতন শেষ হয়ে যায়। এই ওষুধ কতদিন খেতে হবে জানে না। গাল গলা সব ফুলে যাচ্ছে।
আমি আবারো অপরাধী চোখে নবাব মিয়ার দিকে তাকাই। তারপর মানিব্যাগ খুলে একটা পাঁচশো টাকার নোট হাতে তুলে দেই এবং যত দ্রুত সম্ভব চলে আসি তাঁর কাছ থেকে। আমার মনে হচ্ছিল নবাব মিয়া আমার কাছ থেকে কমপক্ষে দু হাজার টাকা আশা করেছিল। আমার মানিব্যাগে দুহাজার টাকার বেশী ছিল। তবু আমি পাঁচশো টাকা দিলাম কেন? আমাকে আরো কয়েকজন নবাবমিয়াকে সাহায্য করতে হয় বলে? আমার ক্ষমতা কম বলে? নাকি আমারও বেকারত্বের ভয় আছে বলে?
সিদ্দিক মিয়ার জন্যও থেমে থাকেনি। সিদ্দিক মিয়া তিন বছর আগে নবাব মিয়ার চেয়ারে বসতো। আমার বাচ্চাদের স্কুলে যেতে রিকশা ঠিক করে দিত। স্কুল থেকে ফিরলে রিকশা থেকে নামিয়ে দিত। বৃষ্টি হলে ছাতা ধরে এগিয়ে দিত। সেই সিদ্দিক মিয়া একদিন এই চেয়ারে ঢলে পড়েছিল। সিদ্দিক মিয়াও একজন অবসরপ্রাপ্ত প্রবীণ ছিলেন। অবসরপ্রাপ্ত প্রবীণদের কাজ করতে দেখলে আমি একইরকম অপরাধবোধে ভুগতে শুরু করি।
No comments:
Post a Comment