Saturday, May 31, 2014

এক বৃষ্টি দিনের চড়ুইভাতি

সকালের বৃষ্টির ঝাঁঝালো শব্দ ছাপিয়ে টিঁউটিঁউ করে একটা কোলাহলময় মিষ্টি শব্দ কানে এলো। শব্দটা তেমন জোরালো না। একটু খেয়াল করে শুনলেই বোঝা যাচ্ছে। শব্দের উৎস খুঁজতে জানালার দিকে চোখ গেলে দেখলাম একজোড়া চড়ুই কার্নিশের আড়ালে বসে পালকের পানি ঝাড়ছে তিরতির করে। আমি জানালার এপাশে। ওরা নীলচে কাঁচের আড়ালে আমাকে দেখতে না পেলেও আমি ওদের স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। পাখির জগত প্রায় সবসময় জুটিময়। তবে হলিউডের অ্যাকশান মুভিতে যেমন পুরুষের পাশে জোর করে একটা নারী চরিত্রকে বসিয়ে দেয়া হয় সেরকম আরোপিত কিছু না। প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মে ওরা পাশাপাশি থাকে।

পাশাপাশি থাকলেও ওরা কি একই জুটি কিনা সেটা নিশ্চিত হতে পারি না। মানুষের চোখে সব চড়ুই একই চেহারার। কোনটি কার জুটি তা বোঝা মুশকিল। ওরা কি নিজেদের জুটি চিনতে পারে? পারে নিশ্চয়ই। নইলে অনাচার দুরাচারে ভরে যেতো পক্ষী সমাজ। পাখি সমাজে বিয়ের প্রচলন নেই। মানুষ ছাড়া আর কারো বিয়েশাদীর ঝামেলাও নেই। যে যার মতো জুটি পছন্দ করে। তবু কোথাও অনাচার অজাচার নেই। পশুপাখি সমাজ মানব সমাজের চেয়ে অনেক বেশী গোছানো আর নিয়ন্ত্রিত। বলা হয়, মানুষকে সভ্য নিয়ন্ত্রিত যৌনজীবন যাপনে বাধ্য করার জন্য বিবাহ প্রথার প্রচলন হয়েছিল আদিযুগে। আসলেই কি তাই? মানুষকে তাহলে সৃষ্টি সেরা জীব বলা যায় কিসের যুক্তিতে। যে মানুষ বিয়ের শৃংখলে না থাকলে অসভ্য হয়ে যায়, সেই মানুষ কি করে সেরা প্রাণী হলো? কেন হলো? জ্ঞান বুদ্ধি বিবেকের পাল্লা ভারী বলে? সব জ্ঞানবুদ্ধি কি মঙ্গলময় কাজে লাগানো হয়? নাহ, মানুষকে আমি ঠিক শ্রেষ্ঠত্বের পাল্লায় ফেলতে পারি না।

কিচির মিচির শব্দের ধাক্কায় আমি ভাবুক জগত থেকে বাস্তবে এলাম। পাখি দুটোর মধ্যে কি একটা বিষয়ে যেন তর্ক চলছে। পুরুষ পাখিটা কিছু একটা বোঝাতে চাইছে, কিন্তু নারী পাখিটা মাথা নেড়ে আপত্তি জানাচ্ছে। পুরুষটা আবার একটু পেছনে ফিরে জানালার ফাঁকে উঁকি দিচ্ছে ভেতরে। সে মনে হয় বলতে চাইছে, ওই ফোকরে ঢুকে বসি, ওদিকে বৃষ্টি লাগবে না গায়ে। কিন্তু নারী পাখিটা অধিক সতর্ক। সে বলে-
-মানুষগুলারে একটা খুদের বিশ্বাসও নাই।
-ক্যান? বিশ্বাস নাই ক্যান? কোনদিন দেখছো কোন মানুষ চড়ুই শিকার করছে?
-ঐ তুই আমাত্তে বেশী বুঝস? দুনিয়ার হালচাল কি বুঝস তুই, অ্যাঁ, কি বুঝস? আছিস তো খালি ঘুরে ঘুরে এ-ডাল ও-ডাল টাংকি মারার তালে
-ঐ চুপ কর!! একদম ফালতু বাত করবি না। তোর বাসার জন্য সেদিন খড়ের টুকরা, ঘাসের ডগা, গাছের ডাল, একটা আম পাতা, দুইটা নিমপাতা, তিনটা ম্যাচের টুকরা এসব কে যোগাড় করলো অ্যাঁ?
-যা ব্যাটা ওগুলা কোন কাজের কাজ হইলো নিকি? ঘর বানাই আমি, ডিম পাড়ি আমি, বাচ্চা ফুটাই আমি, দুনিয়ার সব কাজ আমারে করতে হয়, দেখা তো দেখি একটা ডিম পেড়ে একদিন!!

এখানে এসে পুরুষ পাখিটা হার মেনে যায়। ভালো করেই জানে হাজার পরিশ্রম করলেও সে কোনদিন ডিম পেরে দেখাতে পারবে না। ফুড়ুৎ করে উড়ে গিয়ে সামনের গাছের মগডালে গিয়ে বসে। পেছন পেছন গরবিনী মেয়ে চড়ুইটিও উড়ে গিয়ে বসে। এবার মনে হয় একটু আপোষ হয়েছে। দুজনে কিছু শলা পরামর্শ করছে ফিসফিসিয়ে। কথা শোনা যাচ্ছে না কিন্তু ঠোঁট নড়ছে সমানে।

আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে জানালা থেকে ঘরের ভেতরে চোখ ফেরালাম। টেবিলের উপর একটা খাম রাখা। খামের ভিতর একটা চিঠি। খানিক আগে চিঠিটা পড়ে মন উদাস হয়ে আছে।
আগামী সপ্তাহে অনুষ্ঠিতব্য একটি আন্তর্জাতিক চড়ুইভাতি থেকে আমার নামটা বাদ যাবার জন্য দুঃখিত পত্র। অথচ এই ভ্রমণের জন্য আমি গত তিন মাস যাবত প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। কত কি কেনাকাটাও করলাম। আমার নামটা ছিল ২১ নাম্বারে। আমি বাদে বাকী ২০ জন সুযোগ পেল। বলা হয়েছে সর্বশেষজনকে বাদ দিতে হলো বাজেট সংকোচনের কারণে।

আসল ঘটনা অন্য। এই চিঠি তেমন সমস্যা না, কিন্তু আসল সমস্যার চিঠি এখনো আসেনি। আসবে আগামী সপ্তাহে। আমার চাকরীর আয়ু বড়জোর আর এক মাস। পত্রিকায় খুব গোপনে বিজ্ঞাপন দিয়ে লোক নিয়োগ দেয়া হয়েছে। উর্ধ্বতন কতৃপক্ষের সাথে অসদাচরণের অভিযোগে আমাকে অব্যাহতি দেবার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।

অপ্রকাশিত অসদাচরণটি হলো পরিচালক-যোগাযোগ মহোদয় এক শিক্ষানবীশ তরুণীকে তার কক্ষে ডেকে অনৈতিক প্রস্তাব দেবার পর আমার কাছে খবর আসলে আমি তার দরোজায় গিয়ে প্রচণ্ড এক লাথিতে লকটা ভেঙ্গে ফেলেছিলাম। আমার লাথির প্রমাণ দরোজায় জ্বলজ্বল করলেও তার অনৈতিক প্রস্তাবটির কোন বাস্তব স্বাক্ষী প্রমাণ নেই। তাই শাস্তির ব্যবস্থাটি আমার বিরুদ্ধেই অবস্থান নিল।
তরুণীটি আমার পরিচিত কেউ না। আমার সাথে কখনো তার কথাও হয়নি।

কয়েক মিনিট ভেবে একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম। সর্বশেষ পত্রটি হাতে আসার আগে আমি নিজেই একটি বিচ্ছেদ পত্র লিখে জানালার পাশে দাঁড়ালাম। চড়ুইদুটোকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। বৃষ্টির জোর কমে গেছে। দূরে নদী মোহনা পাড়ি দিচ্ছে একটা জাহাজ। পাঁচ বছরের একটা বন্ধন এই একটি পত্র দিয়েই ছিন্ন হয়ে গেল।

কিছুক্ষণ পর পত্রটি যথাস্থানে জমা দিয়ে জমাট একটা ব্যথা বুকে বয়ে সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেলাম নীচে। অফিসের পাশে একটা টং দোকানের ঝাঁপির নীচে গিয়ে দাঁড়ালাম। সামনের রাস্তায় জল জমে গেছে আধঘন্টার বৃষ্টিতেই। কোথায় যাবো বুঝতে পারছিলাম না। বৃষ্টিটা কমে গেলে কিছুক্ষণ এলোমেলো হাঁটবো। যখন কোন গন্তব্য থাকে না, তখন এলোমেলো হাঁটাই একমাত্র উপায়।

বৃষ্টি থামতে সময় লাগবে। ঘুরে দাঁড়িয়ে একটা চায়ের অর্ডার দিতে যাচ্ছিলাম, তখন পেছন থেকে একটা নারীকন্ঠ বলে উঠলো, দু'কাপ প্লীজ।

অবাক হয়ে দেখি নবনীতা। অফিসের সেই অপমানিত তরুণীটি। হাসিমুখে আমার হাতে একটা কাগজ বাড়িয়ে দিয়ে বললো-
-আপনি চলে যাচ্ছেন, এরপর আমার মাথায় ছাতা ধরবে কে? রিলিজ নিয়ে এলাম আমিও।

আশ্চর্য হবো কিনা ভাবতে ভাবতেই আমিও পাল্টা হেসে দিলাম। কোন কোন ঘটনায় খুব অপরিচিত মানুষও আপন হয়ে যেতে পারে। এবার নিজেকে আর একেবারে গন্তব্যহীন মনে হচ্ছে না।

চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে আড়চোখে নবনীতার দিকে তাকালাম। আবারো হাসলো সে। এবারের হাসিটায় পরিষ্কার বন্ধুতার স্নিগ্ধতা। এত সুন্দর হাসি মেয়েটার, আগে কখনো খেয়াল করিনি। হঠাৎ মনে হলো, অন্ততঃ আজ দুপুরের জন্য দুজনের একটা চড়ুইভাতি করা যায় না? বংশালের শমসের আলীর ভূনা খিচুড়ী খাই না অনেক দিন।

চা শেষ করে নবনীতা বললো, বৃষ্টি থেমে গেছে, চলুন হাঁটতে শুরু করি।
নবনীতা কোথায় যাবে জানি না। কিন্তু আমি মনে মনে বংশালের পথে হাঁটতে থাকি। ভাবছি সামনের মোড়ে গিয়ে ওকে বলবো কথাটা।

মোড়ে পৌঁছে নবনীতা থমকে দাঁড়ালো। একটা খালি রিকশা দাঁড়ানো ওখানে। আমি কিছু বলার আগেই সে আমাকে অবাক করে দিয়ে বলে উঠলো-
-এরকম দিনে খিচুড়ি হলে মন্দ হয় না। কী বলেন?
-হ্যাঁ আমিও তাই ভাবছিলাম। রিকশা নিলে দশ মিনিটে শমসের আলীর খিচুড়ির দোকানে পৌঁছে যেতে পারি কিন্তু।
-খুবই ভালো আইডিয়া। যান খেয়ে আসুন। এরকম দিনে খিচুড়ি মিস করা ঠিক হবে না। আমিও বাড়ি গিয়ে মাকে বলবো খিচুড়ি রাঁধতে। রিকশাটা আপনি নেবেন নাকি আমি?

আমি অপ্রত্যাশিত একটা ধাক্কার বুকভাঙ্গা স্বরে বললাম, রিকশাটা আপনিই নিয়ে যান।


৩১ মে ২০১৪, শনিবার

No comments: