Wednesday, May 14, 2014

সহমরন

কয়েকদিনের অসহ্য গরমের পর সকালের বৃষ্টিটা গোপীনাথের প্রাণে যেন স্বর্গের সুবাস এনে দিল। 

জরুরী একটা কাজ ছিল আগ্রাবাদে। একজন কিছু পাওনা টাকা ফেরত দেবে। প্রায় বিশ হাজার টাকা। অনেক দিনের পাওনা টাকা। তাছাড়া এই মুহুর্তে টাকাটা খুব দরকার। শর্মিলার জন্য একটা শাড়ি, পুলকের স্কুলের জন্য একটা ব্যাগ, আর নিজের জন্য একটা ছাতা। 

গোপীনাথের ছোট একটা বইখাতার দোকান আছে কিন্তু এখন ব্যবসার অবস্থা তেমন বালো না, তাই ওখান থেকে বাজার খরচ ছাড়া আর কিছু বের করা যায় না। আজকে টাকাটা পাওয়া যাবে শুনে মনটা আনন্দে ভরপুর হয়ে আছে। 

সকালে চায়ের কাপ হাতে বৃষ্টি দেখতে অপূর্ব সুন্দর লাগছিল। গুনগুন করে গানও চলে এসেছিল ঠোঁটের কোনায়, "এমনই বরষা ছিল সেদিন, শিয়রে প্রদীপ....."
শর্মিলার সাথে তার প্রেমের বিয়ে নয়, তবু মাঝে মাঝে ওকে প্রেয়সীর ভূমিকায় দেখতে ইচ্ছে করে। কিন্তু কেন যেন  বউরা ঠিক প্রেয়সী হয়ে উঠতে পারে না। আজকেও তেমন ইচ্ছে হচ্ছিল তার। সে যখন চা খায় শর্মিলা পাশে বসে হাতে হাত রেখে । দুজনের যুগল চোখে বৃষ্টির নাগরিক ধোঁয়া মেঘের আমেজ সৃষ্টি করে। 
কিন্তু শর্মিলার অত সময় নেই। সে চা তুলে  দিয়েই রান্নাঘরে ছুটে গেছে আবার। ওখানে স্যাঁতস্যাঁত করে কি জানি ভাজছে। পুলকের জন্য ডিমের অমলেট হয়তো। আজ কি পুলক স্কুলে যাবে? মাত্র কেজিতে পড়ে ছেলেটা। এই বৃষ্টিতে স্কুলে না গেলেই কি? সে উঁকি দিয়ে দেখে পুলকও ছোট একটা মোড়া নিয়ে রান্নাঘরের দরোজায় বসে বসে মায়ের ডিম ভাজা দেখছে।
বৃষ্টি কমলে বাইরে বেরুবে ঠিক করেছিল। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে বৃষ্টি আরো ঝেঁপে নেমেছে। ঘড়ি দেখলো। সাড়ে বারোটা বেজে গেছে। দেড়টার মধ্যে আগ্রাবাদ পৌঁছানোর কথা। নাহ আর বসে থাকা যায় না। ঝড়বাদল যাই হোক, আজকে তার বেরোতেই হবে। আজ যখন দেবে বলেছে, না গেলে আবারো দেরী করার একটা উসিলা পেয়ে যাবে। আজকাল লোকের কোন বিশ্বাস নেই। ধারকর্জ নিয়ে ত্যক্ত আছে গোপীনাথ। আরো কয়েকজনের কাছে টাকা পাবে। সবাই ঘুরাচ্ছে কমাস ধরে।
শার্ট প্যান্ট পরে তৈরি হয়ে নিল সে। প্যান্টটা গুটিয়ে নিল হাঁটু পর্যন্ত। প্লাস্টিকের স্যাণ্ডেল বের করে পরলো। তারপর বৃষ্টির অবস্থা ভালো করে বোঝার জন্য বারান্দায় গেল সে। 

দোতলার বারান্দা থেকে দেখতে পেল সামনের রাস্তায় কয়েক ইঞ্চি পানি জমে গেছে। নালা নর্দমা ভরাট হয়ে পানি সরতে দিচ্ছে না। নর্দমার কালো ময়লাগুলোয় রাস্তা থিকথিক করছে। এই বাড়ির সবকিছু ভালো, কিন্তু বর্ষার এই থিকথিকে পানি একদম অপছন্দ।
রাস্তার পাশে চোখ পড়তেই আঁতকে উঠলো সে। এ-কি? ওটা কে? রাস্তার উপর একটা স্কুলের বাচ্চা ছেলে পড়ে থরথর করে কাঁপছে। আহা কার না কার ছেলে অমন করে আছাড় খেল। সে দ্রুত নেমে গেল। বৃষ্টি মাথায় নিয়ে ছেলেটার কাছে পৌঁছালো। আশেপাশে কেউ নেই। সবাই বৃষ্টি থেকে বাঁচতে নিরাপদ জায়গায় আশ্রয় নিয়েছে।

ছেলেটার কি হয়েছে? খিচুনী এসেছে মনে হচ্ছে। অমন কাঁপছে। -অ্যাই কি হইছে তোমার? উঠে বসো দেখি।
ছেলেটা তবু কাঁপতে আছে। মৃগী রোগী নাকি? গোপীনাথ ভাবতে বসলো। কাউকে ডাকা দরকার। কে আছে। ওই য লণ্ড্রির ছেলেটা। ওকে ডাক দেবো নাকি। ভাবতে ভাবতে গোপীনাথ ছেলেটার হাত ধরে টান দিয়ে তুলতে গেল।
অমনি আরেকটা ঝাঁকুনি, এবার গোপীনাথের পালা। সে বুঝতে পারলো  তার সমস্ত শরীর ঝাকি দিয়ে ফেলে দিল বিশাল কোন শক্তি। কিন্তু মুখ দিয়ে কোন শব্দ বের করতে পারলো না। পড়ে গেল ছেলেটার পাশেই। এবার দুজনেই কাঁপতে কাঁপতে ভিজতে লাগলো অঝোর বর্ষণে। 

খানিকপর লোকজন দৌড়ে এসে দেখতে পেলো বৈদ্যুতিক পিলারের পাশে দুজন মানুষ বিদ্যুতায়িত হয়ে পড়ে আছে। তখন একটা শোরগোল উঠলো তুমুল। শোরগোল শুনে দোতলার বারান্দায় আসলো শর্মিলা। পেছন পেছন পুলকও। ছোট্ট পুলক দেখতে পেল রাস্তায় পড়ে থাকা তাদের বাবাকে ঘিরে কিছু লোক চিৎকার করে  বলছে-
-কারেন্ট..... কারেন্টত ধইজ্জেদে।
-কাছে ন যাইস। দূরে থাক।
-ভিজা আতত ন ধরিস
-উগ্গা লাডি দে। ফুয়ানা লাডি।
-ওডা পিডিবিরে ফোন গর, লাইন বন্ধ গর
-ইতারা মরি যারগুই। ধর ধর। টেক্সি ডাক। মেডিক্যাল নেওন ফরিবু।
 
বিদ্যুত লাইন বন্ধ করে যখন ওদের টেক্সিতে করে মেডিক্যালে নেয়া হলো, তখন দুজনই শেষ। স্কুল ছাত্র ইশতিয়াক হোসেন আর ক্ষুদ্রব্যবসায়ী গোপীনাথ দত্ত।

জাতধর্মনিরেপক্ষ বিদ্যুত দুজনকে একই যমদূতের হাতে তুলে দিল।

No comments: