সুমন চট্টোপাধ্যায় যখন কবীর সুমন হননি, তখন থেকে আমার বিশেষ
পছন্দের। বিশেষ করে নব্বই দশকের প্রথমার্ধে আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের
একটা অংশ সুমন ঘোরে কেটেছিল। আমাকে নচিকেতা টানেনি, অঞ্জনদত্ত টানেনি, কিন্তু সুমন চ্যাটার্জি খুব টেনেছিল। যখন আমি সুমনের নামও শুনিনি তখন এক সন্ধ্যায়
প্রিয় বন্ধুটি তার ওয়াকম্যানের হেডফোনটা আমার কানে লাগিয়ে শুনিয়েছিল "প্রথমতঃ আমি তোমাকে চাই...."। আমি ঠিক সেই সময়ে ওরকম করে কাউকে চাইতে শুরু
করেছিলাম।
আমার গান শোনার ব্যাপারটা ছিল এরকম। যখন যার উপর আছর পড়ে শুধু তার গানই শুনতে ইচ্ছে করে ঘুরেফিরে বারবার। কিছুকাল জগজিতে, কিছুকাল হেমন্তে, কিছুকাল শ্রীকান্তে, কিছুকাল অজয়ে, এরকম একেকসময় একেকজনের ঘোরে পড়ে যাই। এই গানটা শোনার পর আমি বেশ কিছুদিনের জন্য সুমনে বুঁদ হয়ে যাই।
কিছুকাল পর একবার ঢাকায় গেলাম বন্ধুর বাসায়। তখন সেই বন্ধু তার ওয়াকম্যানের হেডফোনটা আমার কানে লাগিয়ে দিয়ে শুনিয়েছিল "ও গানঅলা, আরেকটা গান গাও, আমার আর কোথাও যাবার নেই...."। ওই সময় আমার আসলেই কোথাও যাবার ছিল না। দিশেহারা সেই সময়ে দ্বিতীয় সুমন অবসেশান শুরু। অবাক ব্যাপার হলো যারা আমাকে ওয়াকম্যান দিয়ে গান শুনিয়েছিল সেই দুজনই আমার প্রিয়জন এবং দুজনই সুমনের ভেতর প্রোথিত করেছিল আমার মনযোগ।
এরপর দীর্ঘ বিরতি। এক যুগের বেশী সুমনের গান শুনিনি। মাত্র কয়েকদিন আগে আরেক প্রিয় বন্ধু দিল জাতিস্মর। এবার আর ওয়াকম্যান নয়, একটা মাত্র গান নয়, এবার আস্ত একটা সিনেমা। সুমনের গানের সিনেমা। আবারো সুমন ঘোর শুরু। কদিন ধরে আবারো সুমন শুনছি। খুঁজে বেড়াচ্ছি সুমনের পুরোনো গানগুলো। জাতিস্মর গানটা আমার আগেই পছন্দের ছিল, এবার আরো বেশী পছন্দ হলো সিনেমাটার কারণে। নতুন কটা ভালো গান আছে ওই সিনেমায়। জাতিস্মর ছাড়াও শুনছি, "এক মুহুর্তে...... ফিরিয়ে দিলে,...... সহজ চোখের .....তাকিয়ে থাকা"।
আবার কালকের তুমুল বৃষ্টিভেজা দুপুরে বাড়ি ফেরার পথে রিকশায় উঠে মাথার ভেতর হঠাৎ বাজতে শুরু করলো - তোমার তুলনা আমি খুঁজি না। প্রথমে বুঝতে পারিনি গানটা কার। মাথার ভেতরে রেকর্ডটা ঘুরতে ঘুরতেই বাসায় ফিরলাম। তারপর নেটে ঢুকে সার্চ দিয়ে বের করলাম, এও সুমন। বহুবছর আগে শুনেছি বলে ভুলে গিয়েছিলাম কার গান। কিন্তু আচমকা এই গান কেন। অদ্ভুত ব্যাপার।
একবার উত্তরবঙ্গে যাবার সময় আরিচা থেকে মাঝরাতে ফেরী পার হবার সময় মগ্ন হয়ে শুনেছিলাম "যত দূরে... দূরে যাবে বন্ধু, একই যন্ত্রণা পাবে"। বন্ধু দূরে যেতে কষ্ট পেয়েছিল কিনা তখন আমার জানা ছিল না। কিন্তু আমার কষ্ট হয়েছিল এটা খুব সত্যি। তবু সেই আকালেও আমরা হতাশাগ্রস্থ বন্ধুগন আলোর ইশারা পেয়েছিলাম আবছা আঁধারে।
নিজ থেকে খুঁজে খুঁজে গান শোনার যুগ আমার শেষ হয়ে গেছে নব্বই দশকের অবসানের সাথে সাথেই। গানের ক্যাসেটের যুগ শেষ হবার পর দীর্ঘকাল কোন গান কিনিনি। মাঝে দুয়েকটা সিডি উপহার পেয়েছি। তাও তেমন করে শোনা হয়নি। তাছাড়া গানটান তো এখন তো ফ্রি পাওয়া যায়। ইউটিউব বা সাউণ্ডক্লাউডই গানের ভাণ্ডার। বন্ধুর সৌজন্যে শোনা হয়ে যায় ভালো গানগুলো। পুরোনো গানগুলো আবার কবে শোনা হতো জানি না। কিন্তু জাতিস্মর এসে আমার ১৪ বছরের ব্ল্যাকআউটে না শোনা গানগুলো আবার শোনাতে শুরু করলো, শোনার অনুপ্রেরণা জাগাতে লাগলো। আমারো যেন পূনর্জন্ম হলো গানের জগতে। স্পষ্ট বলতে গেলে, সুমনের গানে।
No comments:
Post a Comment