হাজীপাড়ায় সেই বাড়িটার নাম ছিল সিরাজী মহল। বাসার এক তলায় আমাদের সদাশয় বাড়িওয়ালা বাস করতেন। তিনি নিতান্তই ভদ্রলোক। একসময় সিনেমায় অভিনয়ও করেছিলেন। নবাব সিরাজদৌলার যে সিনেমায় আনোয়ার হোসেন অভিনয় করে বাংলাদেশ কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন, সেই সিনেমায় তিনি গোলাম হোসেন চরিত্রে অভিনয় করেছেন। ভদ্রলোকের নাম ছিল শাহ গোলাম আহমেদ। গেট দিয়ে ঢুকতেই ওনার সদর দরজা। সেই দরজার পাশে একটা সাইনবোর্ড সর্বদা টাঙ্গানো। সাইনবোর্ডে লেখা - শাহ সাহেব বাড়িতে নেই।
এরকম বিচিত্র সাইনবোর্ড আমরা আগে কখনো দেখিনি। আমাদের বাড়িতে আগত অতিথিরাও কখনো দেখেনি। তাই সবাই আসা যাওয়ার পথে সাইনবোর্ড পড়ে হাসতে থাকে, কেউ কেউ সশব্দে উচ্চারণও করতো- শাহ সাহেব বাড়িতে নেই। ভদ্রলোকের পাওনাদারের সংখ্যা বেশী ছিল কিনা জানি না, কিন্তু তাঁর পাঁচ কন্যা আর এক পুত্রের কাণ্ড কিন্তু কম ছিল না।
দোতলা বাড়ির ছাদ আমাদের মাথার উপরই। একটা সুবিধা হলো, জামাকাপড় শুকানো যাবে ইচ্ছেমতো। কিন্তু বাড়িতে ওঠার একদিন পর বাসার এক অতিথি গোসল সেরে শাড়ি শুকাতে দেবার এক ঘন্টা পর তিনি কাপড় আনতে গেলে দেখেন তাঁর শাড়িটা নীচে লুটাচ্ছে। পাশে দাড়ানো বাড়িওয়ালার কন্যাকে জিজ্ঞেস করে জানা গেল, এটা ওদের ছাদ, তাই এখানে অন্য কারো জামা কাপড় শুকাতে দেয়া নিষেধ। তখনো ওদের পরিবারের কারো সাথে পরিচয়ই ঘটেনি। শুধু বাড়িওয়ালাকে দেখেছি আমরা। বাকীদের সাথে পরিচয় হবার আগেই শুরু হলো ছাদ কাহিনী।
তখনো জানার অনেক কিছু বাকী ছিল। সন্ধ্যার সময় সামনের দোকানে চাল কিনতে গেলে দেখা হলো আমাদের স্কুলের হেডস্যারের সাথে। স্যার আমাকে দেখে অবাক। বললেন,তুমি এখানে কি করো? বললাম, আমি তো ওই বাসায় উঠেছি। সাথে সাথে স্যারের চোখ কপালে। তুমি? ওই বাড়িতে? কেমনে উঠলা? কখন উঠলা? কালকেও তো খালি দেখলাম।
আমি স্যারের কথার মাথামুণ্ডু কিছু বুঝতে পারছিলাম না। এই বাসায় উঠলে সমস্যা কি?
স্যার তখন বললেন, পাশের একতলা টিনশেড বাড়িটায় উনি ভাড়া থাকেন। ওটাও সেই শাহ সাহেবের বাড়ি। কিন্তু ওটা তো পাগলের কারখানা। তোমরা খোঁজ খবর না নিয়েই উঠে গেছো? দোতলার বাসাটায় তো কোন ভাড়াটে তিন মাসও টেকে না।
আমি বললাম, খোঁজ নেবার সুযোগ ছিল না। বিপদে পড়ে উঠে গেছি। স্যার বললেন, উঠেছো যখন কি আর করা। দেখে শুনে চলবে।
চিন্তায় পড়ে গেলাম। দুপুরে বিনা বাক্য ব্যয়ে খালাম্মার শাড়িটা যেভাবে ছুড়ে ফেলে দিয়েছে, ভবিষ্যতে আরো কি কাণ্ড দেখায় কে জানে!
ওদের ছোট মেয়েটা অবশ্য খুব ভালো। দেখতে খুব মিষ্টি, পাকা পাকা কথা বলে। বয়স চার বছরের মতো। একমাত্র ওই পিচ্চিটার সাথেই আমাদের যোগাযোগ হয়। মেয়েটাকে আমরা সবাই খুব আদর করতাম বলে মেয়েটাও আমাদের বাসায় নিশ্চিন্তে খেলতো শোকেসের জিনিসপত্র নিয়ে। ছোটবোনের জন্মদিনে সে আমাদের সাথে বসে বসে সারাদিন বেলুন ফোলালো, ঘর সাজালো। সব কাজ শেষে অনুষ্ঠান শুরুর আগে ওকে বললাম, যাও নতুন জামা পরে আসো, ছবি তুলবো।
বাড়িওয়ালার বাসার সবাইকে দাওয়াত দেয়া হয়েছিল। কিন্তু সন্ধ্যায় দেখা গেল ওরা তো আসেইনি, ছোট মেয়েটাকেও আসতে দেয়নি। বেচারী কেঁদেকেটে ঘরে আটকে আছে। মনটা খারাপ হয়ে গেল আমাদের। এ কেমন মানসিকতা?
ওর বড় আরো চারবোন ছিল। ওরা আট থেকে বারো ক্লাস পর্যন্ত বিভিন্ন ক্লাসে পড়তো। কি পড়াশোনা করতো জানি না তবে দিনের বেলার অধিকাংশ সময় ওরা ছাদে কাটাতো। ওদের ছাদ বিহার ওই পাড়ার তরুণদের অন্যতম বিনোদন। ওরা যখন ছাদে থাকতো তখন আশেপাশের নানান ছাদে ভিড় করতো উঠতি বয়সের তরুণেরা।
আমি কখনো ছাদে উঠতাম না। একদিন কিছু বন্ধুবান্ধব বেড়াতে আসলে ওদের নিয়ে একটা বিকেল ছাদে কাটালাম। বাড়িওয়ালীর কন্যাদের নিত্যদিনের কর্মসূচী সেদিন বাধার সম্মুখীন হলো। ওরা ছাদে উঠে আমাদের দেখে নেমে গেল। নেমে গিয়ে কি করেছে সেটা টের পেলাম সন্ধ্যার সময়।
বন্ধুদের বিদায় দিতে আমি বের হলাম ঘর থেকে। গলিপথে কিছুদূর যাবার পর একদল ছেলে আমাদের পথ আটকালো। বললো, আমরা কোন সাহসে ওই ছাদে উঠেছি।
আমি বললাম, ওটা আমার বাসা। আমার ছাদে উঠতে সাহস লাগবে কেন?
ওরা বললো, আমাদের কাছে অভিযোগ এসেছে তোমরা ওই মেয়েদের উত্যক্ত করেছো। তোমাদের সাবধান করে দিচ্ছি। আর যদি কোনদিন ছাদে উঠো, তাহলে ঠ্যাং ভেঙ্গে হাতে ঝুলায় দেবো।
মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। ওই পাড়ায় আমি নতুন হলেও আমার কিছু দশাসই বন্ধুবান্ধবও ছিল যার মধ্যে দুয়েকজনের বেপরোয়া মাস্তানির খ্যাতি ছিল। ঘটনাটা তাদের কানে গেলে সেই পাতি মাস্তানদের ডেকে উল্টো হুমকি দিল। পাল্টাপাল্টি হুমকির ঘটনায় আমাদের জিত হওয়ায় ছাদের উপর আমাদের আপাতঃ রাজত্ব কায়েম হলো।
রাজত্ব কায়েম হলেও আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম ছাদে না উঠে বাসার সামনের খোলা বারান্দায় বসে আড্ডা দেবো। ওরা ওদের ছাদ নিয়ে থাকুক। ভেজালের দরকার নাই।
কিন্তু বারান্দার সামনে বসা নিয়েও ঝামেলা লাগলো আবার। এবারের ঝামেলা একটা পেয়ারা গাছ। নীচতলার ঘরের সামনে বাড়ীওয়ালার একটা পেয়ারা গাছ ছিল। পেয়ারা গাছটা হঠাৎ সেবছর বড় হয়ে গেল লকলক করে এবং সুন্দর সুন্দর পেয়ারা ধরে আমাদের বারান্দার দিকে হাত বাড়িয়ে দিল। গাছটা হাত বাড়িয়ে দিলেও আমরা পেয়ারা গাছে নজর দেয়া ছাড়া আর কিছু করলাম না, কেননা গাছটা আমাদের না। তাছাড়া পেয়ারাগুলো এখনো অনেক ছোট। খাবার যোগ্য হলে তখন দেখা যাবে।
আমরা ধৈর্য ধরলেও বাড়িওয়ালার মেয়েরা ধৈর্য ধরতে পারলো না। ওরা একদিন আমাদের বারান্দায় ঢুকে কাঁচা কাঁচা সব পেয়ারা পেড়ে নিয়ে কিছু দাঁতে কাটলো আর অধিকাংশ নর্দমায় ফেলে দিল। আশংকা এই যে পেয়ারা যদি কোনদিন বড় হয় তাহলে আমরা যে কোন সুযোগে তা হাপিস করে দেবো। আমাদের কোনরকম সুযোগ না দেবার জন্য অকালে সবগুলো পেয়ারাকে নর্দমায় আশ্রয় নিতে হলো।
তখনকার দিনে পাড়ায় কে কার সাথে 'লাইন' করে সেটা কিভাবে যেন সবাই জেনে যেতো। বিশেষ করে আমাদের ছাদবিলাসী কন্যাগুলো লাইনের ব্যাপার পাড়ায় রসের অন্যতম যোগানদার। বিভিন্ন ছেলের সাথে চোখাচোখি, কানাকানি, চিঠিপত্র, ফোনাফুনি সবকিছুই একসময় প্রকাশ পেয়ে যেতো। সেই সুত্রে তিন মাসের মধ্যে জেনে গেছি কোন মেয়ের সাথে কার কার 'লাইন' আছে। আমাদের হুমকিদাতারাও ছিল সেই লাইনের দলে।
বাড়িওয়ালার মেয়েদের সাথে আমার সাথে সাপে নেউলে সম্পর্ক হওয়াতে আমাদের পরিবার নিশ্চিন্ত ছিল যে ওদের কারো সাথে আমার অন্ততঃ 'লাইন-টাইন' হবে না। ওই মেয়েরা স্কুল কলেজের সময় বাদে ছাদেই থাকতো দিনের অধিকাংশ সময়।
একদিন আমার দুপুরের ভাতঘুমটা ভেঙ্গে গেল ছাদের উপর থেকে আসা একটা শব্দে। আমি প্রথমে ভাবলাম উপরে কেউ দরকারি কোন কাজ করছে। কিন্তু না। শব্দটা যেন কেউ একজন পা দিয়ে একটা ইঠ নাড়াচ্ছে। নাড়াচ্ছে তো নাড়াচ্ছে। একটু বিরতি দিয়ে আবারো। গরমে অস্থির এমনিতে, তার উপর ওই শব্দটা ঘুমের বারোটা বাজিয়ে দিল। আমি গায়ে শার্ট গলিয়ে ছাদে উঠে দেখলাম বাড়িওয়ালার ক্লাস নাইনে পড়ুয়া মেয়েটা পা দিয়ে একটা ইঠ এদিক সেদিক নাড়াচ্ছে। আমাকে দেখামাত্র সে নিপাট ভদ্রলোক। আমি কিছু না বলে বিরক্ত চাউনি দিয়ে নীচে নেমে এলাম।
এসে শোবার সাথে সাথে আবারো সেই শব্দ। প্রতিদিন এই যন্ত্রণা দিতে থাকলো মেয়েটা। আন্দাজ করতে পারছিলাম এই শব্দ করে সে আমাকে ছাদে আহ্বান করছে, কিন্তু কেন আহ্বান করছে সেটা বোঝার মতো মানসিক অবস্থা ছিল না অথবা মেজাজটা তার অনুকুল ছিল না। তাই সাড়া দেবার বদলে একদিন আমি একটা পাথর এনে আমার ফ্লোরে ঘষাঘষি শুরু করলাম। সেই শব্দে থামাতে নীচতলা থেকে ছুটে এলো বাড়িওয়ালার জ্যৈষ্ঠ কন্যার অভিযোগের আঙুল। আমি তখন পাল্টা আঙুল দিয়ে ছাদের দিকে ইঙ্গিত করে বললাম, ওটা বন্ধ হলে এটাও বন্ধ হবে। দুপুরের যন্ত্রণা লাঘব হলো সেদিন থেকে।
কবেকার ঘটনা ওটা? ২৮ বছর পার হয়ে গেছে? আশ্চর্য! সময় কত দ্রুত চলে যায়।
এই সেদিন ইন্টার পরীক্ষার রেজাল্টের দিন সকালে বন্ধুরা সবাই মিলে কাপ্তাই গেলাম বেড়াতে। নদীর ওই পাড়ের জঙ্গলগুলো টানছিল খুব। সাম্পান ভাড়া করে ওই পাড়ে গেলাম। ওপারের সীতার ঘাটে সাম্পান থেকে নেমে পাহাড়ে উঠলাম। পাহাড়ে ঘুরে হৈ হল্লা করে ফেরার পথে সাম্পানে ওঠার সময় পা পিছলে ধপাস করে পড়ে গেলাম লেকের পানিতে। আমি সাঁতার জানতাম না। সেদিন সেই অচিন মাঝি ঝাঁপিয়ে পড়ে আমাকে উদ্ধার না করলে আজকে এই গল্প লেখার সুযোগ হতো না। আচ্ছা সেদিন যদি আমি ডুবে যেতাম, এত বছরে আমাকে কেউ মনে রাখতো? মা ছাড়া আর কেউ মনে রাখতো না আমি নিশ্চিত। আমাদের পরিবারের মোড়টাই ঘুরে যেতো না তখন? বর্তমান অবস্থায় থাকার কোন সম্ভাবনাই থাকতো না। কারণ এর দশ বছর পর আবার বাবা মারা যেতো। কন্যাদের নিয়ে অসহায় মা দুর্বিষহ জীবন কাটাতো।
ভাগ্যিস যাইনি সেদিন। আমার এক বন্ধু কিন্তু চলে গিয়েছিল। আরো আগে সেই ক্লাস সেভেনেই। তুখোড় স্মার্ট একটা ছেলে। সেই প্রথম একটা বন্ধু হারিয়ে কষ্ট পেয়েছিলাম। এটা আরো আগের কথা। তখন আমরা সরকারী কলোনীতে থাকতাম, সেই ৩৪ বছর আগে। যত পেছনে তাকাই, আরো পেছনে চলে যাই। এ বুঝি পেছনে যাবার নেশা। মাঝে মাঝে এই পেছনের দিনগুলো এমন করে টানে, তখন আর বর্তমানে থাকা মুশকিল হয়ে দাঁড়ায়। নাহ এবার লাগাম টেনে ধরতে হয়। আর পেছনে গেলে ধাক্কা খাবার সম্ভাবনা আছে।
তার চেয়ে পেছনের একটা গান শোনা যাক। আমার হারিয়ে যাওয়া দিনের প্রিয় একটা গান। গুড্ডি ছবিটা টিভিতেই দেখেছিলাম বহুবছর আগে। আবার দেখতে চেয়েছিলাম। এখানে অনেক খুঁজেছি, পাইনি। অতএব গানটাই শোনা যাক।
No comments:
Post a Comment