Thursday, May 15, 2014

অতল জলের প্রতিচ্ছবি

আমরা যারা ভদ্র শ্রেণীর লোক বলে নিজেদের দাবী করি, তারা প্রত্যেকে একেকটা মুখোশ আঁটা মানুষ। সভ্যতা কিংবা ভব্যতা যতটা অনুমোদন দেয় হিসেব করে ঠিক ততটাই প্রকাশ করি আমরা। আনন্দ বিষাদ কিংবা বিরক্ত ক্রোধ সবকিছুরই সীমানা নির্ধারিত হয়ে আছে নিজস্ব সুশীলতায়। এর বাইরে কে অমানুষ, কে জানোয়ার, কে ভুক্তভোগী, কে নীরবে ক্ষরিত হয় কেউ জানে না। আমাদের প্রকাশগম্যতার দৌড় বড়জোর ঘনিষ্ট বন্ধু।

সেরকম বন্ধুর ভাগ্যও আমাদের সবার নেই। কারো কারো আছে। তবে চিরকালের বন্ধু বলে কিছু নেই। কিছুকালের জন্য মানুষ ভালো বন্ধুর অধিকারী হয়। সেই ভালো বন্ধুর মধ্যে কোন কোন বন্ধু সীমিত সময়ের জন্য ভালো শ্রোতা হলেও একসময় সেও সীমালংঘনে বিরক্ত। সুতরাং সেই পথও বন্ধ হয়ে যায় যথাসময়ে। তখন মুখোশ ছাড়া আর কিছুই প্রকাশের বাকী থাকে না।

বয়স হতে হতে মুখোশের সংখ্যা, মুখোশের পুরুত্ব বৃদ্ধি পেতে থাকে। একসময় কোলাহলপ্রিয় মানুষও হয়ে যায় প্রবল নিঃসঙ্গ এক নাবিক। ততদিনে তার হাল ভেঙ্গে গেছে, পাল ছিড়ে গেছে, নাও ফুটো হয়ে গেছে। তখন তার মুখোশটা আপনাতেই খসে যায়। সেই মুখোশ ছাড়া মুখ আয়নায় দেখে সে নিজেই ভাবতে বসে এই কী আমি? আমার ভেতর বাস করেছে কতজনা। এই চেহারা কাহার চেনা?
আমার বন্ধুভাগ্য বেশ ভালো। ঈর্ষণীয় রকম ভালো। সংখ্যায় খুব বেশী না, কিন্তু ত্রিশ বছরের পুরোনো বন্ধুও আমার এখনো বহাল আছে। এমনকি কঠিন প্রেমের বিয়ের সংসারও ত্রিশ বছর ধরে সুখে থাকে না। আমার অনেক বিপদে বন্ধুরাই ছিল একমাত্র মানব সন্তান যারা নির্দ্বিধায় আমার কাছে থেকেছে।

বন্ধুতা ব্যাপারটা কী? এটা একটা ওপেন রিলেশানশীপ। কেউ কারো প্রতি কমিটেড না, শর্তযুক্ত না, কিন্তু প্রত্যেকে প্রত্যেকের হৃদয়ের অবিচ্ছেদ্য বন্ধনে আবদ্ধ। এই বন্ধনের কথা আমরা কেউ কাউকে বলি না, কাজেকর্মে প্রমান করি। যখনই বন্ধুকে বিপদগ্রস্থ দেখি, তখন কিছু করার না থাকলেও যদি পালিয়ে না গিয়ে পাশে গিয়ে চুপটি করে বসি, তাহলেও আমি সত্যিকারের বন্ধু।
আমরা ঘরে একটা মুখোশ পরি, অফিসে আরেকটা মুখোশ পরি, বাজারে একটা, পার্টিতে আরেকটা, এরকম নানান জায়গায় নানান রকম মুখোশ নিয়ে ঘুরে বেড়াই। কিন্তু যখন বন্ধুর কাছে থাকি, তখন  কোন মুখোশ থাকে না। তখন আমি যেন আমার কাছেই থাকি। সেরকম বন্ধুকে বোধহয় বলে, আয়না।
আমার পাওয়ার ভাগ বেশী, দেয়ার ভাগ অনেক কম। যদি কোনদিন আমার সবচেয়ে ভালো লেখাটা শেষ করতে পারি, সেটি আমার আয়নাকে উৎসর্গ করতে চাই। আর যদি তার আগেই ঠেঁসে যাই, তাহলে এই বেহাল কবিতাটি তার জন্য।



No comments: