ব্যাপারটা তুচ্ছ। আবার ফেলে দেবার মতোও নয়। একটা উঠোন, দুটো বাড়ি, এক ফালি জ্যোৎস্না এবং চাঁদের কলংক পাহাড়।
মেঝ নানার বাড়িতে গেলেই আমাকে টানতো উঠোনটা। উঠোনের চারপাশে গাছের শাখাপ্রশাখাগুলো বাতাসের ছন্দে নাচতে নাচতে জ্যোৎস্নার বান ডাকতো। আমার তেমনই মনে হতো। অথচ চাঁদ উঠলে জ্যোৎস্না খেলবে এতো নতুন কোন কথা না। তবু আমার মনে হতো এই উঠোনে জ্যোৎস্নাগুলো একটু বেশীই যেন উজ্জ্বল। বড় হবার পর অমন কোজাগরী রাত আর কখনো দেখিনি। সেই উঠোন নেই, সেই গাছ নেই, চাঁদখানা শুধু যথাস্থানে আছে, তার জ্যোৎস্নায় চোখ রাখার যত্নটা আর নেই।
কিন্তু বাংলার রূপ খোঁজার এই উৎসবে আনন্দ খুঁজে পেত না তেমন একজনও ছিল মুখোমুখি বাড়িটাতে। এই উঠোনে তাদেরও অংশ আছে, ওই গাছের শাখায় তার জন্যও বাতাস দুলতো, ধবল জ্যোৎস্নাগুলো তার জন্যও আলো বিলাতো। তবু সে কখনো উঠোনে নামতো না। বড়জোর দরোজায় দাড়িয়ে উঠোনের দিকে মাথা বাড়িয়ে আমাদের আনন্দগুলো উপলব্ধি করার চেষ্টা করতো। আমরা খুব করে ডাকতাম ওকে, কিন্তু সে কিছুতেই উঠোনে খেলতে নামতো না। আমি অবাক হতাম। এত এত সুন্দর, কিছুই কী টানে না তাকে? কেমন বিষাদময় চোখে তাকিয়ে থাকতো জ্যোৎস্নার দিকে। আমি যতবার ওই উঠোনে খেলতে যেতাম, অবধারিতভাবে আমার চোখ খুঁজে বেড়াতো সেই বিষন্ন চোখ দুটো। সেই চোখ আমাকে এতটা মুগ্ধতা নিয়ে দেখতো, তবু কাছে আসতো না, একদিন বেশী ডাকাডাকি করাতে দরজাটাই বন্ধ করে দিল।
খুব অপমান লাগলো। রাগে দুঃখে প্রতিজ্ঞা করলাম ওকে আর কোনদিন ডাকবো না। আমার কি দায়, আমার কি দায়? আমার কোন দায় নেই। ওর যা খুশী করুক। অভিমানে চোখ ফেটে জল আসে প্রায়।
আরো কিছুকাল পর, যখন পৃথিবীর বয়স আরো কয়েক বছর বেড়ে গেছে, যখন আমি জীবনকে আরো একটু গভীরভাবে জানতে শিখেছি, সেরকম এক সময়ে বিপন্ন বিস্ময় নিয়ে জানলাম কেন ওর জ্যোৎস্না ভালো লাগতো না, কেন উঠোনের আনন্দে যোগ দিত না, কেন আমাদের ডাকে সাড়া দিত না। দুই বাড়ি এক উঠোনের মালিক হলেও ওদের রান্না ভিন্ন হাড়িতে। ওদের হাড়িতে সবসময় ভাত থাকতো না, ভাত থাকলেও তরকারী থাকতো না। ওর বাবা ছিল না। মা প্রতিবেশীর বাড়িতে কাজ করে আধপেটা খেয়ে সংসার চালাতো। ওর বাইরে যাবার মতো একটাও জামা ছিল না। উৎসবে যোগ দেয়া তো অনেক পরের কথা। এসব কিছু যখন আমি জানতে পারলাম, তখন অতীতের একটা ক্ষত যেন মুহুর্তেই সেরে গেল। যেন শোধ হয়ে গেল কৈশোরের একটা কলংক দেনা।
যদিও তখনো সুকান্তের কবিতাটা পড়িনি, তবু আমি বুঝে গেলাম খালি পেটে সৌন্দর্যের বন্দনা একেবারেই অসম্ভব। চাঁদের সৌন্দর্যের চেয়ে কলংকের দিকেই নজর বেশী থাকে তখন।
No comments:
Post a Comment