Sunday, April 18, 2010

দুর্বিসহ ভ্রমন কান্ড (দুই)

চরম হতাশার মধ্যেও দুটো সুখবর পাওয়া গেল। এক. এই ট্রেনটা চট্টগ্রামেই যাচ্ছে। দুই. ট্রেনটা সামনের একটা স্টেশানে থামবে যেখানে নেমে গিয়ে সুবর্ন এক্সপ্রেসের জন্য অপেক্ষা করা যায়, যদিও সুবর্ন এক্সপ্রেস ওখানে থামবে না।

না থামলেও কি করে চলন্ত ট্রেনে উঠতে হবে সেটার প্রশিক্ষন ও পরামর্শের জন্য আমাদের চারপাশে মোটামুটি একটা ভীড় জমে গেল। বাংলাদেশে জ্ঞানী ও পরামর্শকের অভাব কোনকালেই ছিল না। সুতরাং চারপাশ থেকে উপদেশের বন্যা এমন প্লাবিত করতে থাকলো, আমরা দুজনই পরামর্শসাগরে নিমজ্জিত হয়ে বুদ্ধিশুদ্ধি হারিয়ে ফেলবার পথে। কিছুক্ষন হৈচৈএর পর উপদেষ্টা মন্ডলীর মধ্যেও দুটি দল হয়ে গেল।

এক দল বললো-
ক) এই ট্রেন থেকে নেমে সুবর্ন এক্সপ্রেস যে পাশ দিয়ে যাবে সেদিককার রেললাইনের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা এবং হাত উঁচিয়ে টিকেট নাড়াতে থাকা যদি গার্ড বা ড্রাইভারের চোখে পড়ে যায়, তাহলে ঘ্যাচাং করে ব্রেক কষে দাঁড়াবে ট্রেন।

অন্য দল এই পরামর্শকে হেসে উড়িয়ে দিল, বললো সুবর্ন এক্সপ্রেস জীবনেও থামে নাই এখানে। তারচে বরং এরকম করা যাক-
খ) ট্রেনটা এখানে না থামলেও গতি কমায়। সেই গতিতে ট্রেনের হ্যান্ডেল ধরে ঝুলে পড়া সহজ। তারপর দরজার ফাঁক দিয়ে চীৎকার করলে লোকজন দরজা খুলে ঢুকিয়ে নেবে ভেতরে।

দুইটা পদ্ধতিই গায়ে কাঁটা দিল। এরা বোধহয় আমাদের জেমস বন্ড মনে করেছে পোষাক আষাক দেখে। দুই দলই উৎসাহ যোগাচ্ছে তাদের পছন্দের পদ্ধতি বেছে নিতে। কিন্তু আমরা সিদ্ধান্ত নিতে পারছি না। কারন ক-পদ্ধতিতে ট্রেন না থামলে এই বেজাগায় রাত কাটাবো কোথায় ভাবতে শিউরে উঠলাম। আবার খ-পদ্ধতিতে যদি ওরা দরোজা না খোলে, তাহলে চট্টগ্রাম পর্যন্ত হাতলে ঝুলে শীতে জমে মরার চেয়ে লাফ দিয়ে ট্রেনের নীচে পড়ে আত্মহত্যা করা বরং সহজ।

সুতরাং দুই দলকে নিরুৎসাহিত করে সীটের পাশে হেলান দিয়ে সাতঘন্টা কাটিয়ে দেবো বলে সিদ্ধান্ত নিলাম দুজনে।

ট্রেনটা পরের ষ্টেশানে থামলেও আমরা নামলাম না। খানিক পর ঝমঝম শব্দ করে সুবর্ন এক্সপ্রেস চলে গেল আমাদের কাঁচকলা দেখিয়ে। ট্রেনটা আমাদেরকে অতিক্রম করার সময় আমার পরামর্শক মন্ডলীর মধ্যে চিত্তচাঞ্চল্য দেখা গেল। "আহারে কি আফসোস......উহু কি করলেন ভাই ফাস্টক্লাস চলে যাচ্ছে রে...." ইত্যাদি নানা রকম সহমর্মীতা ও টিটকারী উভবিধ মন্তব্যে ভরে গেল বগি। ওটা যাবার পর আমাদের ট্রেনটা ছাড়লো।

পরামর্শক দল যার যার আসনে ফিরে গেছে। আমরা দাড়িয়ে আছি। কিছুক্ষন চুপচাপ সব। তারপর তৃতীয় এক ব্যক্তির আবির্ভাব ঘটলো আমাদের সামনে। বগির কোনার দিকে আঙুলের ইশারা দিয়ে কানের কাছে ফিস ফিস করে বললো, "আপনাদেরকে ডাকতেছে"।

বিস্মিত হয়ে ওদিকে এগিয়ে গেলাম। মাঝবয়েসী স্বাস্থ্যবান একটা লোক। চেহারায় কেমন একটা কতৃত্বের ছাপ। সুবিধার লাগলো না প্রথম দৃষ্টিতেই। কিন্তু লোকজনের সমীহ দেখে মনে হলো ইনি এই ট্রেনের "বিশেষ কেউ"। রেলের মালিক সরকার, এই জিনিসটা জানা না থাকলে ওনাকেই ট্রেনের মালিক ভেবে বসতাম। আমাদের টিকেটটা হাতে নিয়ে পরখ করলো। তারপর আপাদমস্তক দেখলো। সহমর্মী হয়ে বললো, "বিপদে পড়েছেন। উপায় নাই। কিছুক্ষন অপেক্ষা করেন। ঘন্টাখানেক পরে সিট পাবেন।"

ওরেবাপস। এটা কে? ভীষন ক্ষমতাধর মানুষ মনে হচ্ছে। গডফাদার টাইপ সুর পেলাম যেন। থাক, উপায় তো নাই। ঘন্টাখানেক পরে কি যাদুতে সিট দেবে খোদা জানে। আমরা ফিরে গিয়ে ওপাশের একটা সীটে হেলান দিয়ে রইলাম। উদাস হয়ে জানালার বাইরে অন্ধকার দেখার চেষ্টা করছি। জানালা বন্ধ, তবু ছুটে চলা অন্ধকার আর ট্রেনের প্রবল ঝিক ঝিক শব্দের মধ্যে ছন্দ খুঁজে সময় কাটানোর চেষ্টা করছি।

খানিক পর অদ্ভুত একটা ব্যাপার নজরে এল। ট্রেনের যাত্রীরা সবাই ওনার কাছে যাচ্ছে আর ফিরে আসছে। সবার সাথে ঠাট্টার সুরে কথা বলছেন। সবার খুব পরিচিত মনে হলো ভদ্রলোককে। ফাস্ট ক্লাসের সব যাত্রী যেন ওনার নিয়ন্ত্রনে। অবাক হলাম ব্যাপার দেখে। কৌতুহল দমাতে না পেরে একজনকে জিজ্ঞেস করেই ফেললাম, ওনার কাছে কেন যাচ্ছে সবাই।

জবাব শুনে চোখ কপালে আমার। এই বগির টিকেটের দায়িত্ব নাকি ওনার। যেসব মানুষ বসে আছে তারা সবাই ওনার কাছে মাথাপিছু পঞ্চাশ টাকা দিয়ে ফাস্টক্লাসের সীট পেয়েছে। যাত্রীদের প্রায় সবাই ব্রাম্মনবাড়িয়া নেমে যাবে ঘন্টাখানেক পর। এই ট্রেনের নিয়মিত ব্যাপার এটা। জিজ্ঞেস করলাম, "উনি কি রেলওয়ের কর্তা?" বললো, "না, উনি এই বগির কর্তা। রেলের লোক ওনাকে ঘাঁটায় না।" কেন ঘাটায় না জিজ্ঞেস করার সাহস হলো না।

এতক্ষনে ওনার সীট পাইয়ে দেবার ক্ষমতার উৎস বুঝলাম। অক্ষম একটা নিঃশ্বাস বেরিয়ে গেল ভেতর থেকে। ভাবলাম আমাদের কাছেও টাকা চাইবে না তো আবার? নাহ, আমাদের কাছে টাকা চেয়ে বিব্রত করেনি গডফাদার।

মজার ব্যাপার হলো ব্রাম্মনবাড়িয়া আসে। ট্রেনটা থামার আগেই সব ফার্স্টক্লাস প্যাসেঞ্জার গাট্টিবোচকা সহকারে দরোজায় ভীড় করলো। ট্রেন থামতে না থামতেই দরোজা খুলে হুড়মুড় করে পুরো বগি খালি করে নেমে গেল সবাই। গডফাদারকে দেখা গেল না ওই কোনায় আর।

তারপর আমাদের জনা সাতেক লোককে নিয়ে প্রায় খালি বগিটা চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে হুইসেল বাজালো।

[আপাততঃ শেষ। অন্য কোন যাত্রাকালের ভ্রমন খন্ড পরে আসতে পারে]

No comments: