Sunday, April 18, 2010

সফল অযাত্রা

-চলেন যাই। ভুটান যাই। এবার যেতেই হবে।
-হ্যাঁ যেতেই হবে। সিদ্ধান্ত যখন নিয়েছি এবার যেতেই হবে।
-আর তেড়িবেড়ি চলবে না। এক্ষুনি বেরোন।
-হ্যাঁ এক্ষুনি বেরুতে হবে। নইলে দেরী হয়ে যাবে।
-দাঁড়ান আমি জুতোটা পরে নেই।
-আচ্ছা পরেন, আমি কাগজপত্র গুছিয়ে নেই।
-আচ্ছা গোছান।

গোছানো হলে বেরিয়ে পড়লাম। আমি আর আশরাফ সাহেব। পথে সাইদুল সাহেব ফোনে বললেন তিনিও যাবেন। তাকেও নিলাম তুলে গাড়ীতে। আমরা তিনজন। সাইদুল সাহেব, আশরাফ সাহেব, আমি। ষাট, পঞ্চাশ, চল্লিশ, এই তিন বয়সের তিনজন। চরম ও পরম উৎসাহী ভ্রমন পিয়াসী। তিনজনের কমে ভ্রমন আনন্দ নেই। ভুটান যাবার স্বপ্নটা দুই বুড়োর ভেতর সঞ্চারিত করতে পেরে আমি পুলকিত। খরচ নির্ঘাত অর্ধেক কমে যাবে আমার।

পথে ঠান্ডা পানীয় কিনলাম রাস্তার পাশের দোকান থেকে। একটাই কিনতে চাইছিলাম, কিন্তু বাকী দুজন ডাক্তারের বারন ভুলে হা করে তাকিয়ে আছে। কি করি, তিনটাই কিনতে হলো। গাড়ীতে বসে ভুস ভুস করে শেষ করে ফেললাম। আশরাফ সাহেবের গাড়ীটায় চড়ে আরাম। ভুটান যেতে গাড়ীটা তেঁতুলিয়া সীমান্ত পর্যন্ত যাতে যায় সে ব্যবস্থা নিতে হবে। আরামের যাত্রা হোক। সবকিছু ঠিক ঠাক। যাত্রার শুরুটা ভালো হলে সব ঠিক।

গন্তব্যে গিয়ে দেখি বিশাল লাইন। রোদে পুড়ছে লাইন। লাইনে দাঁড়ানো শিশু বৃদ্ধ যুবক নারী এমনকি অসুস্থ মানুষও। লাইনে দাঁড়াতেই হবে। একেকজনের ডাক আসছে, ফিরে আসছে অনেক পর। আমাদের লাইন রাস্তার উপর চলে এসেছে। রোদের নীচে। তবু ভুটান যাবার স্বপ্নের ছাতাটা মাথার উপরে গনগনে সূর্যের উত্তাপটা উপেক্ষা করলো। হিমালয় মাথায় নিয়ে আমরা লাইনে দাড়াই। আরেকটু সময়। ক্লিয়ারেন্সটা পেলেই হবে। আহ্। ভ্রমন কি তৃপ্তিদায়ক ব্যাপার!

সাইদুল সাহেব একটু অধৈর্য মানুষ। একঘন্টায় লাইন দুই গজও এগোয়নি। কি করছে লোকজন ভেতরে। একটা কাগজ দেখতে এত সময় নিলে কেমনে কী। ভুটান পৌঁছাতে তো রাত বারোটা পেরিয়ে যাবে।

যাবো ভুটান কিন্তু পেরোতে হবে ভারত। ভারতে ঢুকে আবার ভারত পেরোতে হবে। হ্যাপা কম না তাই। ভারতের কাছে জবাবদিহি করতে করতে কাহিল সবাই। কেনু ভুটান যাবে, কেনু কেনু কেনু? ভারতে কী ওই সৌন্দর্যের কমতি আছে? ছাড়ো ডলার কিছু ভারতে ছড়ায়ে যাও। এই কারবার।

সূর্যের তাপের সাথে পাল্লা দিয়ে হতাশা বাড়তে থাকে। পাকস্থলীতে কোল্ডডিংক্সগুলো গড়বড় শুরু করেছে খালি জায়গা পেয়ে। সাঈদুল সাহেব হার্টের রোগী। মাথার টেপমার খারাপ হয়ে যাচ্ছে। আশরাফ সাহেব উৎসাহী মানুষ। মালয়েশিয়া ব্যাংককে হরদম যাতয়াত থাকলেও দরিদ্র ভুটান যাবার কথা ভাবেনি কখনো। আমার কাছ থেকে অভিনব ভ্রমনের প্রস্তাব পেয়ে উৎসাহী হয়েছিলেন। দেখা গেল বেলা বাড়ার পর থেকে আমাদের দুজনের হতাশার মিটারের উর্ধ্বগতি তার মধ্যেও সঞ্চারিত হচ্ছে।

লাইনে দাঁড়ানোর অনভ্যাসে তিনজনের মাথাই দুঘন্টার মধ্যে নড়বড় হয়ে গেল। অধৈর্যের মিটারটা যখন চরম শিখরে সাইদুল সাহেব তখন উঁকি দিলেন কাউন্টারের ভেতরে। দরজাটা ভেজানো ছিল বলে মৃদু ঠেলা দিয়ে রাগ চেপে মাখন গলায় ভেতরের কেরানীকে জিজ্ঞেস করে, "দাদা আর কতক্ষন লাগপে?"

কিন্তু জবাবে ভেতর থেকে যে হুংকার আসে তা ছিল অপ্রত্যাশিত। সবাই চমকে উঠে। আমরা ভয় পেয়ে যাই -"গেট আউট" শব্দটা শুনে। আমি সাইদুল সাহেবের রগ চিনি। বুড়ো মারাত্মক ক্ষ্যাপাটে। সহজে সহজ, কঠিনে কঠিন। জীবনে কারো কাছ থেকে এই শব্দটা শোনেনি। পাল্টা আক্রমন হবে নিশ্চিত।

সাইদুল সাহেব দুই সেকেন্ডেরও কম সময়ে তার মোলায়েম কন্ঠকে 'তোর গেট আউটের গুষ্টি কিলাই ইউ বাস্টার্ড'-এ রূপান্তর করে ভেতরে ঢুকে যে ভাষায় পাল্টা হুংকার শুরু করলো, তা মাথার উপরে ছাদ না থাকলে আকাশের জমাট মেঘের সাথে ধাক্কা খেয়ে বজ্রবৃষ্টির তুফান সৃষ্টি করতো খুলশীর পাহাড়ে। যেমন মাল্টি ল্যাংগুয়েজ তেমনি স্পীকারের ভোল্টেজ। আমরা কানে আঙ্গুল দিলাম আর লাইনে দাঁড়ানো লোকজন ডিনামাইট ফাটার প্রতিক্রিয়ায় ছুটোছুটি শুরু করেছে যেন হাইড্রোজেন বোমা মারা হয়েছে। প্রধান ফটক বন্ধ করা হলো দ্রুত।

কিছুক্ষন পর সাঈদুল সাহেবকে পুলিশের দুজন সেপাই দুই বগলে আলগে ধরে 'আয় ব্যাটা আজ তোরে মজা দেখাই', বলে গেটের বাইরে নিয়ে যেতে দেখে আশরাফ সাহেব আর আমি বোবা এবং অন্যমনস্ক হয়ে গেলাম তড়িৎ। এখন আমাদের চিত্ত চঞ্চল হলেই ধরা পড়ার সম্ভাবনা। নিশ্চিত বুঝলাম গ্রেফতার করা হলো সাঈদুল সাহেবকে। তাতে আমাদের করার কিছু নাই। বাঘে ছুঁলে আঠারো ঘা, পুলিশে ছুলে ছত্রিশ ঘা। এখন আমাদের উত্তম কর্তব্য হলো নিরাপদ জায়গায় গিয়ে সাঈদুল সাহেবকে রক্ষা করার চেষ্টা করা। নিজে বাঁচো অন্যকে বাঁচাও। লিভ এন্ড লেট লিভ।

তাছাড়া এই মুহুর্তে সাঈদুল সাহেবকে বাংলাদেশ সরকারের আতিথ্যে না পাঠালে অন্যায় হবে, কারন হুংকারটা উনিই দিয়েছিলেন। কিন্তু মুশকিল হলো পুলিশ যে কোন গ্রেফতারের পর সঙ্গীসাথীর খোঁজ করে। যেন দলবদ্ধভাবেই পরিকল্পনা ছাড়া এদেশে কোন কাজ হয় না। সেক্ষেত্রে আমাদেরও রাজ অতিথি হবার হুমকি থেকে যায়।

সুতরাং আমরা 'তার সাথের লোক না' মনোভাব নিয়ে সটকে গেলাম দুতাবাসের ভেতর থেকে। কিন্তু গাড়ীর কাছে গিয়ে পৌঁছাতে না পৌঁছাতেই পেছন দিয়ে সাঈদুল সাহেবের গলা শুনে রাস্তার আলকাতরায় পা আটকে গেল আমাদের-

-কই যান?
-যাই না তো
-গাড়ীতে কেন?
-আপনার সাথে যাবার জন্য
-আমি কোথায় যাই
-পুলিশের সাথে
-পুলিশ কোথায় নেবে
-থানায় বা হাজতে
-আপনারা কোথায় যাবেন
-আপনার সাথে সাথে
-সাথে কই? গাড়ীতে উঠছেন যেন
-উঠছি না, আপনাকে এগিয়ে দিতে যাচ্ছি
-আমাকে এগিয়ে দিতে হবে না, আমিই আপনাদের এগিয়ে নিয়ে যেতে আসছি। আসেন, আমার সাথেই যাবেন। পুলিশ ডাকে আপনাদেরকেও
-আমাদেরও? (দুজন একসাথে কঁকিয়ে উঠলাম)

বুড়ো সাঈদুল সাহেব ফাঁসিয়ে দিল আমাদের। ভুটান না গিয়ে সেবার গেলাম হাজতে। ভারতীয় দুতাবাসের কাগজপত্র তছনছ করে মূল্যবান দলিলপত্র লুট করার গভীর ষড়যন্ত্রের অপরাধে তিন বছর তিন মাসের জেল হয়ে গেল তিন জনের।

No comments: