যে বৃক্ষের পাতা শুকিয়ে যায়, তার ডালে কোন পাখি বসে না। পত্রশূন্য মৃতবৎ সেই বৃক্ষের জন্য অপেক্ষায় থাকে জ্বালানীর পরিণতি।
**********************************************************************
রাহুলের সাথে ক্লাস এইট থেকে বন্ধুত্ব অনীকের। অসম্ভব মিশুক, কৌতুকপ্রিয় এবং বন্ধুত্বপূর্ন ছেলে রাহুল। বিশ্ববিদ্যালয়ে ওঠার পরও অনেক বন্ধুর ভীড়ে অনীক আর রাহুল আলাদা বন্ধুত্বে জড়িয়ে থাকে। প্রতিদিন বিশাল আড্ডা বসে রাহুলের ছাদে। অন্য সব বন্ধু আড্ডার পর চলে গেলেও অনীক রাহুলের ঘরে পড়ে থাকে। দুজনের কথা শেষ হয় না। আবার আলাদা আড্ডার আসর জমায় ওরা। লুকিয়ে সিগ্রেট খায় দুবন্ধু মিলে। জানালা দিয়ে ধোঁয়া ছাড়ে। পাশের বাড়ীর দোতালায় দাড়ানো মেয়েটির সাথে রাহুলের ভাব আছে, অনীকও তাদের সাহায্য করে। পছন্দের গান বাজায় ক্যাসেট প্লেয়ারে। উদাস হয়ে আকাশ দেখে। অনীকের কেউ নেই, তাই রাহুল যখন জানালায় দাড়িয়ে ওই মেয়েটির দিকে ভাব বিনিময় করে, অনীক তখন চোখ বুজে তার অদেখা মানবীর স্বপ্নে ডুবে যায়।
দিন কেটে যায়। রাহুল পাশ করে চাকরীতে ঢোকে। পরপর অনীকও চাকরী পায়। কিছুদিন পর অন্য সব বন্ধু মিলে একটা আড্ডাক্লাব বানায়। সেখানে চাঁদা নেয়া হয় নিয়মিত। রাহুল সেই ক্লাবের সভাপতি জনপ্রিয়তার সুত্রে। একসময় সেই ক্লাবের একটা অফিস হয়, একটা ব্যবসা দাড় করায়। ব্যবসার টাকা দিয়ে কেউ পকেট ভর্তি করে না। কিন্তু বছরে একবার দুরে কোথাও গিয়ে ঘুরে আসে। পিকনিকের মতো। বছর দুই গড়াতেই ভালো লাভের মুখ দেখে ব্যাবসা।
ঠিক সেই সময় রাহুলের অফিসে কি একটা ঝামেলা যাচ্ছিল, সেই ঝামেলার জন্য রাহুল চাকরী ছেড়ে দেয়। বন্ধুদের এসে বলে, সে এখন এই ব্যবসা দেখাশোনা করবে। বন্ধুরা সানন্দে রাজী হয়। অন্তত একটা কিছু করে খাক সে। রাহুল কিছুদিন ব্যবসা করার পর আরো বড় কিছু করতে উদ্যত হয়। প্রস্তাব করে অনীককে। অনীক দোনোমোনো করে। ঠিক রাজী হতে পারে না। কারন রাহুলের প্রস্তাবের একাংশে আছে পুরো ব্যবসাটা কব্জা করার পরিকল্পনা। রাহুল বলে কেবল অনীককে নিয়েই সে ব্যবসা করতে চায়। এত লোক দিয়ে ব্যবসা হবে না। ওদের টাকা ওদের ফেরত দিয়ে পুরোটা কিনে নেই আমরা।
অনীক বলে সে তার শেয়ার ছেড়ে দিতে পারে, কিন্তু অন্যরা ছাড়বে কিনা জানে না। রাহুল ওকে অনুরোধ করে বন্ধুদের রাজী করানোর জন্য। কারন অনীকের গ্রহনযোগ্যতা খুব বেশী। অনীক বন্ধুর জন্য এটুকু করতে রাজী হয়। সে বাকীদের রাজী করায়। কিন্তু টাকা দেবার সময় রাহুল বলে, সে অর্ধেক টাকা দেবে। কারন অফিসের কম্পিউটার ফার্নিচার যা কিছু কেনা হয়েছিল তার দাম বর্তমান বাজারে অর্ধেক। তাই সে পুরো দেবে না। এই কথায় অনীক খুব শকড হয়। সে ভাবতেই পারে না রাহুল এরকম কিছু বলতে পারে। তবু কষ্ট চেপে রাহুলের প্রস্তাবটা নিয়ে সে অন্য বন্ধুদের কাছে যায়। ওদের বোঝায়। সে বলে, রাহুল ঠিক বলেছে, কারন এখন তো ওসবের মূল্য অনেক কমে গেছে। তাছাড়া রাহুলের আর্থিক অবস্থা ভালো নয়। আমি তো আমার পুরো টাকাটাই মাফ করে দেব।
অনীকের কাছে এইসব শুনে বাকীরা নিমরাজী হয়ে ছাড় দেয়। অনীক বাসায় এসে হিসেব করে, খুব বেশী না প্রত্যেকে হাজার দশেক টাকা লস দিয়েছে। কিন্তু এটা তো তাদের লস হবার কথা ছিল না। তারা ক্লাব অফিস বানিয়েছিল আড্ডা দেবার জন্য। টাকা কামানোর ধান্ধা ছিল না। কিন্তু রাহুল এসে ওখান থেকে টাকা বের করার জন্য পুরো ব্যবসাটা কিনে নিতে চায়। রাহুলের এই মতলব ভালো নয়। বন্ধুত্বের জন্য খুব ক্ষতিকর। কিন্তু রাহুলকে এসব কিছুই বলা যাবে না। অন্য বন্ধুদেরও বলা যাবে না। তাহলে বন্ধুত্ব নষ্ট হয়ে যাবে।
রাহুল প্রতিদিন টাকার গল্প, লাভের গল্প বলে। অনিকের তাতে বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। তবু রাহুল যখন ওসব গল্প করে সে তাকে নিরুৎসাহিত করে না। বরং টুকটাক মন্তব্য করে উৎসাহ যোগায়। রাহুল দ্বিগুন আগ্রহে প্রতিদিন নতুন নতুন আইডিয়ার কথা বলে। প্রত্যেক আইডিয়াতে অবশ্যই অনীক থাকে। সে বলে, তার কোন আইডিয়া পূর্নতা পেত না যদি অনীক না থাকতো। ওদিকে দিনের পর দিন রাহুলকে মিথ্যে সায় দিতে দিতে অনীক রীতিমত অসুস্থ বোধ করে। হাজার হলেও মানুষের শরীর তো। কতটা মিথ্যা সহ্য হয়। তবু রাহুলের বন্ধুত্ব হারাতে চায় না বলে সে সহ্য করে নেয় সবকিছু। রাহুলকে সত্য বললে রাহুল ওর কাছে আসা বন্ধ করে দেবে। অন্যদের কাছে খারাপ হলেও অনীকের সাথে রাহুল কখনো খারাপ কিছু করেনি। তাই তার সাথে মিথ্যে দিয়েও দারুন চলে যায়।
একদিন গল্প করতে করতে অনীকের মুখ দিয়ে ফস করে বেরিয়ে পড়ে, তুই এত টাকার লোভী কেন রে? এত মানুষের টাকা নিয়েও তোর তৃপ্তি নেই?
সামান্য একটা শব্দ। কিন্তু রাহুল কখনো কল্পনাও করতে পারেনি সে এই জিনিস শুনবে অনীকের মুখে। অনীকের সাথে তার টাকার সম্পর্ক না। টাকাটা সে গল্পের জন্যই বলে। কিন্তু অনীকের জন্য তার ছেলেবেলার মায়া। দুজনে হাত ধরে বড় হয়েছে। একসাথে কতদিন রাত কেটেছে। সেই অনীক আজ তাকে লোভী বললো?
সেও পাল্টা বলে বসে, “আমি যদি লোভী হই, লোভী মানুষের সাথে তোর কোন বন্ধুত্বের দরকার নেই।” বলে আর দাড়ায় না, হুট করে দরজা খুলে বেরিয়ে যায়। পেছন থেকে অনীক ডাকতে থাকে, কিন্তু রাহুল শোনে না। সে চলে যায়। রাহুল আর অনীকের বাসায় আসেনি। অনীক পরপর কয়েকবার ফোন করেছে রাহুলের নাম্বারে। কিন্তু রাহুলের ফোন বন্ধ দেখা যায়।
কয়েকদিন পর অনীক রাতে শুয়ে শুয়ে ভাবতে থাকে, রাহুলের সাথে এতদিনের বন্ধুত্বটা কি শেষই হয়ে গেল চিরতরে? তার বুকটা হু হু করে উঠে। কিন্তু আবার ভাবতে থাকে, বোধহয় ভালোই হলো। এরকম বন্ধুত্ব থাকার চেয়ে না থাকাই উত্তম। রাহুল তার নিজের জন্য তো বটেই, অন্য বন্ধুদের জন্যও ক্ষতিকর বন্ধু ছিল। অভিনয় করে কতদিন আর অপবন্ধুকে সহ্য করা যায়? রাহুলের বন্ধুত্বের সজীবতা নষ্ট হয়ে গেছে লোভের উত্তাপে। মৃত বন্ধুত্বের জন্য আর কোন শোক উথলে উঠবে না আর।
এই বন্ধুতা পতনে শতবর্ষী একটা বৃক্ষের পতন হলো যেন!
No comments:
Post a Comment