লাঞ্চ থেকে ফিরে ব্রাউজার অন করে জিমেইলে চোখ বুলায় মারুফ।
প্রতিদিনের মতো ওর পুরোনো চিঠিগুলো খুলে খানিকটা পড়ে। তারপর ইন্টারনেটে চোখ বুলায়, আড্ডার জায়গাগুলোতে ক্লিক করে। এখানে সেখানে কত মানুষের আড্ডামেলা - ব্লগে, ফোরামে, ফেসবুকে। কখনো কখনো ওইসব আড্ডায় যোগ দেয় মারুফ। আজ যেন সবকিছু পানসে।
এত মানুষের ভীড়েও তার ভীষণ একলা লাগে। মাউসটা ক্লিক করেও যেন যুত পাচ্ছে না। এলোমেলো ক্লিক করে দুম করে বন্ধই করে দেয় ব্রাউজারটা। টেবিলে পড়ে থাকা অনেকগুলো জবাব না দেয়া মেইলের দিকে তাকায়। নিদারুণ নীরস কাজ। প্রিন্টআউটগুলোতে চোখ বুলায় বিরক্তি নিয়ে। আজকের মধ্যে এগুলোর জবাব দেয়া উচিত। কিন্তু আজ ভীষণ একটা অবসন্নতা আজ কর্মঠ হাত দুটোতে।
আজকের দুপুরটাও নিদারুণ নির্জন, ভীষণ নিঃসঙ্গ! গতকাল দুপুরটাও ছিল তেমন। পরশুরটাও। পরপর তিনদিন নিঃসঙ্গ সে।
সকালে অফিসে আসার পথে প্রতিদিন মনে মনে যার প্রতীক্ষা করে সে হলো একটা চিঠি। আজ তিনদিন কোন চিঠি নেই। থাকার কথাও ছিল না। তবু গত চার বছর ধরে ভোরে অফিসে ঢুকে অফিস মেইল চেক দিয়েই ফায়ারফক্স ওপেন করে সরাসরি জিমেইলে লগইন করে। ওখানে একটা চিঠি এসে অপেক্ষা করে প্রতিদিন ভোরে। ওই চিঠির প্রতীক্ষার অভ্যেস তার প্রতিটা দিন।
চার বছর আগে এমন কিছু ছিল না। তার ইমেইল ব্যবহারের বয়স এক যুগেরও বেশী। কিন্তু কখনো কারো চিঠির জন্য প্রতীক্ষা ছিল না। এই যুগে কেউ কাউকে চিঠি লেখে না। ইমেইলে কেবল দরকারী কথা থাকে, থাকে কাজের কথা। ইমেইলের জন্য কখনো ডাকপিয়নের প্রতীক্ষা যোগ হবে তা কখনো ভাবেনি মারুফ।
চিঠির অভ্যেসটা হঠাৎ হলো একদম অপ্রত্যাশিতভাবে। একবার একটা বিশেষ দিবসে ছোট্ট একটা কৌতূহলী চিঠি এল। প্রেরক অচেনা। যে নাম থেকে চিঠি এসেছে সেই নামটা একটা নদীর নাম। ওরকম অচেনা কারো কাছ থেকে চিঠি আসা অস্বাভাবিক। তবু ওই চিঠিটা যেন কোনো গ্রহ নক্ষত্রের যোগাযোগের ফসল হিসেবে চলে এসেছিল।
চিঠিটার জবাব দিয়েছিল মারুফ। আবারো চিঠি এলো কদিন পর। আবারও জবাব গেল। চিঠিতে চিঠিতে আলাপের একদিন জানা গেল পত্র লেখক একজন নারী। নাম অনামিকা। এই নামটা শুনেও ছদ্মনামই মনে হলো। তবু কৌতুহলকে সীমা লংঘন করতে দিল না মারুফ।
নারীত্বের পরিচয় পেয়েই বোধহয় মারুফের কৌতূহলের সাথে যোগ হলো আগ্রহও। অর্ধযুগের প্রবাসী জীবনে একটাও নারীবন্ধু যোগ হয়নি তার। হয়নি তার নিজের কারনেই। কারন একদা তার 'কেউ একজন' ছিল বাংলাদেশে। ওই সম্পর্ককে বিসর্জন দিতে হয়েছিল বলে পরিবার দেশ সব ছেড়ে পালিয়ে এসে এই দক্ষিন গোলার্ধে ঢেরা বেঁধেছিল সে। আর দেশে ফেরা হয়নি তার। সব পিছুটান কেটে ফেলে দিয়েছিল। কিন্তু সেই চিঠিটা এসে একটা নতুন যোগাযোগ অধ্যায়ের সূচনা করলো।
অনামিকার সাথে বন্ধুত্বের মাত্রাটা গভীরে পৌঁছালো বছর না পেরোতেই। প্রতিটি নতুন চিঠিতে বন্ধনটা গাঢ় হতে থাকে। চিঠি লেখার, চিঠি পাবার এক অভিনব নেশার জন্ম হয় দুজনের। বছর গড়াতেই দেখা গেল দৈনিক একাধিক চিঠি আসা যাওয়া করছে। চিঠির সংখ্যাধিক্য এক পর্যায়ে চিঠিকে সংকুচিত করে চিরকুটে পরিনত করলো। ই-চিরকুট। ই-চিরকুটের সংখ্যাও বাড়তে বাড়তে দৈনিক সেঞ্চুরী করে ফেলার রেকর্ড হয়ে যায় ওদের। তবু অতৃপ্তি...।
গত চার বছরে চার দিনের বিরতিও ছিল না কখনো। এত চিঠি লিখেছে তবু ওরা কেউ কাউকে দেখেনি কখনো। কন্ঠও শোনেনি। দুজনেই ওই কৌতূহলের গলাটা যেন টিপে রেখেছিল। কেবল শব্দে শব্দেই চেনা। এই চেনাটাই বা কতটুকু? দুজনের কেউ কারো ঠিকানা জানে না। জানে কেবল ভৌগোলিক অবস্থান বা দেশের নাম। আর ফোন নাম্বার। উত্তর গোলার্ধের একটা শীতপ্রধান দেশে অনামিকার বসবাস। আর দক্ষিন গোলার্ধে মারুফ।
উত্তর আর দক্ষিন গোলার্ধের এই সম্পর্কটা কখনো সংজ্ঞায়িত করা হয় না। একাকীত্ব প্রিয় দুজন মানুষের বন্ধনটা কি ছিল সেটা অজানাই থেকে যায়।
মারুফ ভাবে, এটা কি প্রেম? কি করে হয়? ওরা তো সেরকম কিছ বলেনি কখনো। অনামিকা ভাবে, আমার তো এক জীবনের প্রেম শেষ হয়ে গেছে। এ আবার কোন অনুভুতি? প্রতিদিন এত রাত জেগে কেন বসে থাকা ওর জন্য? মাঝে মাঝে একটু অপরাধবোধেও ভোগে অনামিকা। প্রাক সম্পর্কের প্রতি অবিশ্বস্ততা হয়ে যাচ্ছে কিনা ভেবে অস্থির হয়। মারুফেরও তো আরেকটা পূর্ব জীবন ছিল। সেদিন মারুফের কাছ থেকে সম্পর্কের সংজ্ঞা সম্পর্কিত একটা প্রশ্নের উত্তর শুনে অনামিকা দারুন কষ্ট পায়। মারুফও অন্যরকম অস্থিরতায় ভোগে।
শুরুটা বন্ধুত্বই ছিল, কিন্তু বন্ধুত্বের গন্ডীটা আরেকটু গভীরতায় পৌঁছালে সম্পর্কটা ঠিক কি বুঝতে পারে না মারুফ। অনুভুতিকে নিয়ন্ত্রন করার কোন চেষ্টাই করেনি সে। চোখ বুঝে ভালোলাগায় ডুবে ছিল। সেদিন অনামিকার মুখ থেকে ন্যায় অন্যায় প্রশ্ন উঠে আসায় মারুফ দ্বিধান্বিত হয়। ভাবে, অনামিকা হয়তো ভুল থেকে বেরিয়ে আসতে চায়। অনামিকার আক্ষেপ অস্থিরতার কারন অনুমান করে মারুফ আরো বিব্রত হয়। কথায় কথায় কোথায় যেন খোঁচা লেগে যায় অনামিকার। চার বছরে এই প্রথমবারের মতো সেদিন অনামিকা ঘোষনা দিল, কাল থেকে সে আর কোন চিঠি লিখবে না। অবসান হোক সকল ভুল বোঝাবুঝির। মারুফও প্রবল তেজে জবাব দিয়েছিল- চাইনা আর চিঠি যন্ত্রনা। নিয়ন্ত্রনহীন মুখ দিয়ে কীসব অস্থির শব্দমালা নির্গত হয়েছিল।
মারুফ বারবার স্ক্রীনের দিকে তাকায়। সত্যি সত্যি কোন চিঠি লেখেনি অনামিকা গত তিনদিন। সেও লেখেনি অভিমানে।
খুব অস্থির এবং শূন্য শূন্য লাগছে। কি করবে? আর কখনো যোগাযোগ হবে না ওদের? তা কি করে হয়। আজীবন বন্ধুতার বাঁধন কি একদিনের তর্কেই ছিঁড়ে যায়? অনামিকার ফোন নাম্বার আছে ওর কাছে। ফোন করবে? কখনো ফোন করেনি। ফোন করলে যদি না ধরে, যদি কঠিন কথা বলে, অপমান করে যদি?
এইসব নানান 'যদি'র আশংকায় ফোন করতে দ্বিধাবোধ করে। কিন্তু অনামিকাকে ফেরাতে হলে ফোন করা ছাড়া উপায় নাই। জীবনে প্রথমবারের মতো তাই ডায়াল করে অনামিকাকে। গলাটা শুনতে কেমন লাগবে ওর? মিষ্টি গলার মেয়ে নিশ্চয়ই, এত সুন্দর চিঠি লিখে, গলাটাও তেমন হবে। রিং হয়। কিন্তু ফোন ধরছে না কেউ ওই প্রান্তে।
বাজতে বাজতে কেটে যায় লাইন। দশবারের মতো ফোন করে মারুফ হতাশ হয় খুব। ইচ্ছে করে ফোন ধরছে না অনামিকা? তা তো হতে পারে না। নিশ্চয়ই ফোন থেকে দুরে আছে অনামিকা। গাড়ীর চাবিটা নিয়ে অফিস লক করে বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দেয় মারুফ। বাসায় পৌঁছে আবার চেষ্টা করবে। দেড় ঘন্টার ড্রাইভ। আজকে রাস্তায় একদম ট্রাফিক নেই। ড্রাইভ করে আরাম হবে।
হাইওয়েতে উঠে স্পীডটা একটু বেশীই তুলেছিল বোধহয়। অনামিকাকে ফোনে না পাবার হতাশার জেদটা পায়ের নীচে চেপে রাখা এক্সিলেটরের উপরই গিয়ে পড়ে অনেকটা। ফলে পাশের রাস্তা থেকে একটা লাল রঙের পিকআপ যখন আচম্বিতে উদয় হলো তখন ব্রেকে পা দেয়া হলেও খুব দেরী হয়ে গেছে। মারুফের গাড়ীটা শূন্যে তিনটা ডিগবাজি খেল এবং সশব্দ পতন ঘটলো কংক্রিটের হাইওয়েতে। তার কিছুক্ষন পর এম্বুলেন্স পুলিশের গাড়ী এসে হৈ চৈ শুরু করে। ঘন্টাখানেক পর একটা লাশ আর দুমড়ানো গাড়ী নিয়ে রাস্তাটা পরিষ্কার করে চলে গেল সবাই। আবারো নিস্তব্ধ হয়ে পড়ে আদিগন্ত বিস্তৃত হাইওয়েটা।
রাতের গভীরে ঠিক ওই জায়গাটায় প্রান্তরের নিস্তব্ধতা চিরে ক্ষুদে একটা পাখির ডাক শোনা গেল হঠাৎ। দিনের পাখি, রাতে ডাকার কথা নয়। ডাকটা আসছে রাস্তার পাশের একটা কাঁটাঝোপ থেকে। কোন সুখপাখির ডাক নয়, একটা পরিত্যক্ত মোবাইলের রিং টোন ওটা। পাখির ডাকের সাথে স্ক্রীনে ভেসে উঠেছে উত্তর গোলার্ধের একটা দেশের ডায়ালিং কোড। কিছুক্ষন পরপর পাখিটা অস্থির ডেকে উঠছিল। ফোনটা অসংখ্যবার বাজলো সেই রাতে। ব্যাটারির চার্জ শেষ না হওয়া পর্যন্ত বেজেই গেছে সেটি।
তারপর আর কখনোই ডাকেনি পাখিটা।
No comments:
Post a Comment