পাঠকের কি মৃত্যু হয় নাকি বিবর্তন হয়?
একসময় আমি দস্যু বনহুরের ভক্ত ছিলাম। কৈশোরের রোমাঞ্চকর নায়ক বনহুর। ক্লাস এইট পার হয়ে নাইনে ওঠার পর কুয়াশায় পেয়ে বসে। কুয়াশার ঘোর কাটতে না কাটতে মাসুদ রানা এসে উঁকি ঝুকি দিতে শুরু করে ক্লাস টেনে। মাসুদ রানা সর্বোচ্চ সময় ধরে রাখে ভার্সিটির মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত। পাশাপাশি সেবার অন্যন্য ক্লাসিক অনুবাদ, ওয়েষ্টার্ন।
ইন্টারে পড়ার সময় পাশাপাশি হুমায়ুন আহমেদের আছর হয় নন্দিত নরকে পড়ার পর। ইন্টার পাশ করার পর চোখ খুলে দুনিয়া ব্যাপি হাজারো বইয়ের জগতে। তবে সেবা প্রকাশনীর জন্য আজীবন নষ্টালজিক থাকবো, মাসুদ রানার জন্যও। গুরুগম্ভীর বইতে যখন মন বসে না তখন পেপারব্যাক খুব টানে। পড়া হয়না যদিও বহুদিন। একসময় পত্রিকার ষ্টলে দাড়িয়ে অর্ধেক পত্রিকা পড়ে ফেলতে ইচ্ছে করতো সেই যাযাদি, পূর্বাভাস, বিচিন্তা, খবরের কাগজের যুগে।
শফিক রেহমানের নষ্টামিতে নিউজপ্রিন্ট ম্যাগাজিনই ছেড়ে দিলাম পড়া। আজকের কাগক, ভোরের কাগজ হয়ে প্রথম আলোতে যখন থিতু হলাম, বিচিত্রা বন্ধ হয়ে যাবার পর ২০০০ এ মজে গেছি যখন, একদিন আবিষ্কার করি পত্রিকা পড়ার সময় হয় না আমার। আধপড়া বইগুলো পড়ে থাকে শেলফের আনাচে কানাচে।
একদিন দেখলাম পত্রিকা পড়ার সময় হয় না আমার। তখন একদিন আবিষ্কার করি ব্লগ। দৈনিক তিনটা পত্রিকা পড়ে থাকে হাতের নাগালে, একটাও পড়া হয় না। এখন পড়ি ব্লগ। ব্লগে বুদ হয়ে গেছে পত্রিকা পাঠক।
পাঠক বিবর্তিত হয়ে যায় এভাবে। ব্লগের নেশা কেটে গেলো কোন দিকে ছুট দেবে পাঠক?
Sunday, April 18, 2010
মোলায়েম ছিনতাই
খাস্তগীর স্যার আমাদের স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। ব্যপক জনপ্রিয়, সুরসিক মানুষ ঘরে বাইরে স্কুলে। একদিন রিক্সায় করে স্কুল থেকে ফেরার পথে পড়লেন খুচরা ছিনতাইকারীর হাতে। রিক্সা থামালো ওরা বাসার কাছাকাছি এলাকায়। উনি ভয় পাবার বদলে একটু অবাক হলেন। ওনাকে ছিনতাইকারী ধরতে পারে সেটা অবিশ্বাস্য।
কারন এই এলাকায় মুড়ি মুড়কি বিক্রেতা থেকে ছিনতাইকারী সবগুলোর মধ্যে ওনার ছাত্র আছে। ফলে ওনাকে রাস্তায় আটকানোর সাহস কারো থাকার কথা না। যারা আটকেছে তারাও কোন এককালে তার স্কুলে গেছে হয়তো। যাইহোক ছিনতাইকারীরা যখন আটকিয়েই ফেললো, উনি স্বভাবসুলভ স্বরে জানতে চাইলেন, "কিরে কি করস তোরা এখানে?"
ছিনতাইকারীদের কোন একজন বোধহয় চিনলো ইনি কে। কিন্তু ছুরি যখন ধরে ফেলেছে ফিরে যাওয়া লজ্জার ব্যাপার। তাই মোলায়েম স্বরে ছিনতাইপর্ব শুরু হলো। ওনার সাথে যে সংলাপগুলো হলো সেগুলো এরকম-
-স্যার আপনার পকেটে কি আছে দেখি।
-কী আছে তাতে তোর কি?
-দেখি না কি আছে
-মানিব্যাগ আছে।
-মানিব্যাগটা দেখি?
-মানিব্যাগ দেখার কি আছে
-একটু দেখবো খালি
-দেখালে তো লই দৌড় দিবি
-না স্যার, দৌড় দিমু না
-সত্য বলতেছস?
-কসম স্যার
খাস্তগীর স্যার পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে হাতে তুলে দেখালেন।
-হাতে নিয়ে দেখি স্যার?
-আরে হাতে নিলে তো দৌড় দিবি
-দৌড় দিমুনা
-সত্য তো?
-খোদার কসম স্যার।
স্যার মানিব্যাগটা ওর হাতে দিতেই সেটা খপ করে নিয়ে ভোঁ দৌড়ে পগার পার সবাই। আর পেছন থেকে খাস্তগীর স্যার চিৎকার করে বলছে,
-ওই ব্যাটা, আমি তখনই বলছিলাম, দেখাইতে গেলেই নিয়ে দৌড় দিবি তোরা। এবার দেখলি তো কার কথা সত্যি হলো? হারামজাদারা আমার কথা বিশ্বাসই করলি না।
গজগজ করতে করতে বাড়ী ফিরে গেলেন রসিক মানুষটা। মানিব্যাগ হারানোর চাইতেও মনে হলো ছেলেরা তার কথা বিশ্বাস করলো না সেটাতেই আক্ষেপটা বেশী।
কারন এই এলাকায় মুড়ি মুড়কি বিক্রেতা থেকে ছিনতাইকারী সবগুলোর মধ্যে ওনার ছাত্র আছে। ফলে ওনাকে রাস্তায় আটকানোর সাহস কারো থাকার কথা না। যারা আটকেছে তারাও কোন এককালে তার স্কুলে গেছে হয়তো। যাইহোক ছিনতাইকারীরা যখন আটকিয়েই ফেললো, উনি স্বভাবসুলভ স্বরে জানতে চাইলেন, "কিরে কি করস তোরা এখানে?"
ছিনতাইকারীদের কোন একজন বোধহয় চিনলো ইনি কে। কিন্তু ছুরি যখন ধরে ফেলেছে ফিরে যাওয়া লজ্জার ব্যাপার। তাই মোলায়েম স্বরে ছিনতাইপর্ব শুরু হলো। ওনার সাথে যে সংলাপগুলো হলো সেগুলো এরকম-
-স্যার আপনার পকেটে কি আছে দেখি।
-কী আছে তাতে তোর কি?
-দেখি না কি আছে
-মানিব্যাগ আছে।
-মানিব্যাগটা দেখি?
-মানিব্যাগ দেখার কি আছে
-একটু দেখবো খালি
-দেখালে তো লই দৌড় দিবি
-না স্যার, দৌড় দিমু না
-সত্য বলতেছস?
-কসম স্যার
খাস্তগীর স্যার পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে হাতে তুলে দেখালেন।
-হাতে নিয়ে দেখি স্যার?
-আরে হাতে নিলে তো দৌড় দিবি
-দৌড় দিমুনা
-সত্য তো?
-খোদার কসম স্যার।
স্যার মানিব্যাগটা ওর হাতে দিতেই সেটা খপ করে নিয়ে ভোঁ দৌড়ে পগার পার সবাই। আর পেছন থেকে খাস্তগীর স্যার চিৎকার করে বলছে,
-ওই ব্যাটা, আমি তখনই বলছিলাম, দেখাইতে গেলেই নিয়ে দৌড় দিবি তোরা। এবার দেখলি তো কার কথা সত্যি হলো? হারামজাদারা আমার কথা বিশ্বাসই করলি না।
গজগজ করতে করতে বাড়ী ফিরে গেলেন রসিক মানুষটা। মানিব্যাগ হারানোর চাইতেও মনে হলো ছেলেরা তার কথা বিশ্বাস করলো না সেটাতেই আক্ষেপটা বেশী।
পতন
যে বৃক্ষের পাতা শুকিয়ে যায়, তার ডালে কোন পাখি বসে না। পত্রশূন্য মৃতবৎ সেই বৃক্ষের জন্য অপেক্ষায় থাকে জ্বালানীর পরিণতি।
**********************************************************************
রাহুলের সাথে ক্লাস এইট থেকে বন্ধুত্ব অনীকের। অসম্ভব মিশুক, কৌতুকপ্রিয় এবং বন্ধুত্বপূর্ন ছেলে রাহুল। বিশ্ববিদ্যালয়ে ওঠার পরও অনেক বন্ধুর ভীড়ে অনীক আর রাহুল আলাদা বন্ধুত্বে জড়িয়ে থাকে। প্রতিদিন বিশাল আড্ডা বসে রাহুলের ছাদে। অন্য সব বন্ধু আড্ডার পর চলে গেলেও অনীক রাহুলের ঘরে পড়ে থাকে। দুজনের কথা শেষ হয় না। আবার আলাদা আড্ডার আসর জমায় ওরা। লুকিয়ে সিগ্রেট খায় দুবন্ধু মিলে। জানালা দিয়ে ধোঁয়া ছাড়ে। পাশের বাড়ীর দোতালায় দাড়ানো মেয়েটির সাথে রাহুলের ভাব আছে, অনীকও তাদের সাহায্য করে। পছন্দের গান বাজায় ক্যাসেট প্লেয়ারে। উদাস হয়ে আকাশ দেখে। অনীকের কেউ নেই, তাই রাহুল যখন জানালায় দাড়িয়ে ওই মেয়েটির দিকে ভাব বিনিময় করে, অনীক তখন চোখ বুজে তার অদেখা মানবীর স্বপ্নে ডুবে যায়।
দিন কেটে যায়। রাহুল পাশ করে চাকরীতে ঢোকে। পরপর অনীকও চাকরী পায়। কিছুদিন পর অন্য সব বন্ধু মিলে একটা আড্ডাক্লাব বানায়। সেখানে চাঁদা নেয়া হয় নিয়মিত। রাহুল সেই ক্লাবের সভাপতি জনপ্রিয়তার সুত্রে। একসময় সেই ক্লাবের একটা অফিস হয়, একটা ব্যবসা দাড় করায়। ব্যবসার টাকা দিয়ে কেউ পকেট ভর্তি করে না। কিন্তু বছরে একবার দুরে কোথাও গিয়ে ঘুরে আসে। পিকনিকের মতো। বছর দুই গড়াতেই ভালো লাভের মুখ দেখে ব্যাবসা।
ঠিক সেই সময় রাহুলের অফিসে কি একটা ঝামেলা যাচ্ছিল, সেই ঝামেলার জন্য রাহুল চাকরী ছেড়ে দেয়। বন্ধুদের এসে বলে, সে এখন এই ব্যবসা দেখাশোনা করবে। বন্ধুরা সানন্দে রাজী হয়। অন্তত একটা কিছু করে খাক সে। রাহুল কিছুদিন ব্যবসা করার পর আরো বড় কিছু করতে উদ্যত হয়। প্রস্তাব করে অনীককে। অনীক দোনোমোনো করে। ঠিক রাজী হতে পারে না। কারন রাহুলের প্রস্তাবের একাংশে আছে পুরো ব্যবসাটা কব্জা করার পরিকল্পনা। রাহুল বলে কেবল অনীককে নিয়েই সে ব্যবসা করতে চায়। এত লোক দিয়ে ব্যবসা হবে না। ওদের টাকা ওদের ফেরত দিয়ে পুরোটা কিনে নেই আমরা।
অনীক বলে সে তার শেয়ার ছেড়ে দিতে পারে, কিন্তু অন্যরা ছাড়বে কিনা জানে না। রাহুল ওকে অনুরোধ করে বন্ধুদের রাজী করানোর জন্য। কারন অনীকের গ্রহনযোগ্যতা খুব বেশী। অনীক বন্ধুর জন্য এটুকু করতে রাজী হয়। সে বাকীদের রাজী করায়। কিন্তু টাকা দেবার সময় রাহুল বলে, সে অর্ধেক টাকা দেবে। কারন অফিসের কম্পিউটার ফার্নিচার যা কিছু কেনা হয়েছিল তার দাম বর্তমান বাজারে অর্ধেক। তাই সে পুরো দেবে না। এই কথায় অনীক খুব শকড হয়। সে ভাবতেই পারে না রাহুল এরকম কিছু বলতে পারে। তবু কষ্ট চেপে রাহুলের প্রস্তাবটা নিয়ে সে অন্য বন্ধুদের কাছে যায়। ওদের বোঝায়। সে বলে, রাহুল ঠিক বলেছে, কারন এখন তো ওসবের মূল্য অনেক কমে গেছে। তাছাড়া রাহুলের আর্থিক অবস্থা ভালো নয়। আমি তো আমার পুরো টাকাটাই মাফ করে দেব।
অনীকের কাছে এইসব শুনে বাকীরা নিমরাজী হয়ে ছাড় দেয়। অনীক বাসায় এসে হিসেব করে, খুব বেশী না প্রত্যেকে হাজার দশেক টাকা লস দিয়েছে। কিন্তু এটা তো তাদের লস হবার কথা ছিল না। তারা ক্লাব অফিস বানিয়েছিল আড্ডা দেবার জন্য। টাকা কামানোর ধান্ধা ছিল না। কিন্তু রাহুল এসে ওখান থেকে টাকা বের করার জন্য পুরো ব্যবসাটা কিনে নিতে চায়। রাহুলের এই মতলব ভালো নয়। বন্ধুত্বের জন্য খুব ক্ষতিকর। কিন্তু রাহুলকে এসব কিছুই বলা যাবে না। অন্য বন্ধুদেরও বলা যাবে না। তাহলে বন্ধুত্ব নষ্ট হয়ে যাবে।
রাহুল প্রতিদিন টাকার গল্প, লাভের গল্প বলে। অনিকের তাতে বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। তবু রাহুল যখন ওসব গল্প করে সে তাকে নিরুৎসাহিত করে না। বরং টুকটাক মন্তব্য করে উৎসাহ যোগায়। রাহুল দ্বিগুন আগ্রহে প্রতিদিন নতুন নতুন আইডিয়ার কথা বলে। প্রত্যেক আইডিয়াতে অবশ্যই অনীক থাকে। সে বলে, তার কোন আইডিয়া পূর্নতা পেত না যদি অনীক না থাকতো। ওদিকে দিনের পর দিন রাহুলকে মিথ্যে সায় দিতে দিতে অনীক রীতিমত অসুস্থ বোধ করে। হাজার হলেও মানুষের শরীর তো। কতটা মিথ্যা সহ্য হয়। তবু রাহুলের বন্ধুত্ব হারাতে চায় না বলে সে সহ্য করে নেয় সবকিছু। রাহুলকে সত্য বললে রাহুল ওর কাছে আসা বন্ধ করে দেবে। অন্যদের কাছে খারাপ হলেও অনীকের সাথে রাহুল কখনো খারাপ কিছু করেনি। তাই তার সাথে মিথ্যে দিয়েও দারুন চলে যায়।
একদিন গল্প করতে করতে অনীকের মুখ দিয়ে ফস করে বেরিয়ে পড়ে, তুই এত টাকার লোভী কেন রে? এত মানুষের টাকা নিয়েও তোর তৃপ্তি নেই?
সামান্য একটা শব্দ। কিন্তু রাহুল কখনো কল্পনাও করতে পারেনি সে এই জিনিস শুনবে অনীকের মুখে। অনীকের সাথে তার টাকার সম্পর্ক না। টাকাটা সে গল্পের জন্যই বলে। কিন্তু অনীকের জন্য তার ছেলেবেলার মায়া। দুজনে হাত ধরে বড় হয়েছে। একসাথে কতদিন রাত কেটেছে। সেই অনীক আজ তাকে লোভী বললো?
সেও পাল্টা বলে বসে, “আমি যদি লোভী হই, লোভী মানুষের সাথে তোর কোন বন্ধুত্বের দরকার নেই।” বলে আর দাড়ায় না, হুট করে দরজা খুলে বেরিয়ে যায়। পেছন থেকে অনীক ডাকতে থাকে, কিন্তু রাহুল শোনে না। সে চলে যায়। রাহুল আর অনীকের বাসায় আসেনি। অনীক পরপর কয়েকবার ফোন করেছে রাহুলের নাম্বারে। কিন্তু রাহুলের ফোন বন্ধ দেখা যায়।
কয়েকদিন পর অনীক রাতে শুয়ে শুয়ে ভাবতে থাকে, রাহুলের সাথে এতদিনের বন্ধুত্বটা কি শেষই হয়ে গেল চিরতরে? তার বুকটা হু হু করে উঠে। কিন্তু আবার ভাবতে থাকে, বোধহয় ভালোই হলো। এরকম বন্ধুত্ব থাকার চেয়ে না থাকাই উত্তম। রাহুল তার নিজের জন্য তো বটেই, অন্য বন্ধুদের জন্যও ক্ষতিকর বন্ধু ছিল। অভিনয় করে কতদিন আর অপবন্ধুকে সহ্য করা যায়? রাহুলের বন্ধুত্বের সজীবতা নষ্ট হয়ে গেছে লোভের উত্তাপে। মৃত বন্ধুত্বের জন্য আর কোন শোক উথলে উঠবে না আর।
এই বন্ধুতা পতনে শতবর্ষী একটা বৃক্ষের পতন হলো যেন!
**********************************************************************
রাহুলের সাথে ক্লাস এইট থেকে বন্ধুত্ব অনীকের। অসম্ভব মিশুক, কৌতুকপ্রিয় এবং বন্ধুত্বপূর্ন ছেলে রাহুল। বিশ্ববিদ্যালয়ে ওঠার পরও অনেক বন্ধুর ভীড়ে অনীক আর রাহুল আলাদা বন্ধুত্বে জড়িয়ে থাকে। প্রতিদিন বিশাল আড্ডা বসে রাহুলের ছাদে। অন্য সব বন্ধু আড্ডার পর চলে গেলেও অনীক রাহুলের ঘরে পড়ে থাকে। দুজনের কথা শেষ হয় না। আবার আলাদা আড্ডার আসর জমায় ওরা। লুকিয়ে সিগ্রেট খায় দুবন্ধু মিলে। জানালা দিয়ে ধোঁয়া ছাড়ে। পাশের বাড়ীর দোতালায় দাড়ানো মেয়েটির সাথে রাহুলের ভাব আছে, অনীকও তাদের সাহায্য করে। পছন্দের গান বাজায় ক্যাসেট প্লেয়ারে। উদাস হয়ে আকাশ দেখে। অনীকের কেউ নেই, তাই রাহুল যখন জানালায় দাড়িয়ে ওই মেয়েটির দিকে ভাব বিনিময় করে, অনীক তখন চোখ বুজে তার অদেখা মানবীর স্বপ্নে ডুবে যায়।
দিন কেটে যায়। রাহুল পাশ করে চাকরীতে ঢোকে। পরপর অনীকও চাকরী পায়। কিছুদিন পর অন্য সব বন্ধু মিলে একটা আড্ডাক্লাব বানায়। সেখানে চাঁদা নেয়া হয় নিয়মিত। রাহুল সেই ক্লাবের সভাপতি জনপ্রিয়তার সুত্রে। একসময় সেই ক্লাবের একটা অফিস হয়, একটা ব্যবসা দাড় করায়। ব্যবসার টাকা দিয়ে কেউ পকেট ভর্তি করে না। কিন্তু বছরে একবার দুরে কোথাও গিয়ে ঘুরে আসে। পিকনিকের মতো। বছর দুই গড়াতেই ভালো লাভের মুখ দেখে ব্যাবসা।
ঠিক সেই সময় রাহুলের অফিসে কি একটা ঝামেলা যাচ্ছিল, সেই ঝামেলার জন্য রাহুল চাকরী ছেড়ে দেয়। বন্ধুদের এসে বলে, সে এখন এই ব্যবসা দেখাশোনা করবে। বন্ধুরা সানন্দে রাজী হয়। অন্তত একটা কিছু করে খাক সে। রাহুল কিছুদিন ব্যবসা করার পর আরো বড় কিছু করতে উদ্যত হয়। প্রস্তাব করে অনীককে। অনীক দোনোমোনো করে। ঠিক রাজী হতে পারে না। কারন রাহুলের প্রস্তাবের একাংশে আছে পুরো ব্যবসাটা কব্জা করার পরিকল্পনা। রাহুল বলে কেবল অনীককে নিয়েই সে ব্যবসা করতে চায়। এত লোক দিয়ে ব্যবসা হবে না। ওদের টাকা ওদের ফেরত দিয়ে পুরোটা কিনে নেই আমরা।
অনীক বলে সে তার শেয়ার ছেড়ে দিতে পারে, কিন্তু অন্যরা ছাড়বে কিনা জানে না। রাহুল ওকে অনুরোধ করে বন্ধুদের রাজী করানোর জন্য। কারন অনীকের গ্রহনযোগ্যতা খুব বেশী। অনীক বন্ধুর জন্য এটুকু করতে রাজী হয়। সে বাকীদের রাজী করায়। কিন্তু টাকা দেবার সময় রাহুল বলে, সে অর্ধেক টাকা দেবে। কারন অফিসের কম্পিউটার ফার্নিচার যা কিছু কেনা হয়েছিল তার দাম বর্তমান বাজারে অর্ধেক। তাই সে পুরো দেবে না। এই কথায় অনীক খুব শকড হয়। সে ভাবতেই পারে না রাহুল এরকম কিছু বলতে পারে। তবু কষ্ট চেপে রাহুলের প্রস্তাবটা নিয়ে সে অন্য বন্ধুদের কাছে যায়। ওদের বোঝায়। সে বলে, রাহুল ঠিক বলেছে, কারন এখন তো ওসবের মূল্য অনেক কমে গেছে। তাছাড়া রাহুলের আর্থিক অবস্থা ভালো নয়। আমি তো আমার পুরো টাকাটাই মাফ করে দেব।
অনীকের কাছে এইসব শুনে বাকীরা নিমরাজী হয়ে ছাড় দেয়। অনীক বাসায় এসে হিসেব করে, খুব বেশী না প্রত্যেকে হাজার দশেক টাকা লস দিয়েছে। কিন্তু এটা তো তাদের লস হবার কথা ছিল না। তারা ক্লাব অফিস বানিয়েছিল আড্ডা দেবার জন্য। টাকা কামানোর ধান্ধা ছিল না। কিন্তু রাহুল এসে ওখান থেকে টাকা বের করার জন্য পুরো ব্যবসাটা কিনে নিতে চায়। রাহুলের এই মতলব ভালো নয়। বন্ধুত্বের জন্য খুব ক্ষতিকর। কিন্তু রাহুলকে এসব কিছুই বলা যাবে না। অন্য বন্ধুদেরও বলা যাবে না। তাহলে বন্ধুত্ব নষ্ট হয়ে যাবে।
রাহুল প্রতিদিন টাকার গল্প, লাভের গল্প বলে। অনিকের তাতে বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। তবু রাহুল যখন ওসব গল্প করে সে তাকে নিরুৎসাহিত করে না। বরং টুকটাক মন্তব্য করে উৎসাহ যোগায়। রাহুল দ্বিগুন আগ্রহে প্রতিদিন নতুন নতুন আইডিয়ার কথা বলে। প্রত্যেক আইডিয়াতে অবশ্যই অনীক থাকে। সে বলে, তার কোন আইডিয়া পূর্নতা পেত না যদি অনীক না থাকতো। ওদিকে দিনের পর দিন রাহুলকে মিথ্যে সায় দিতে দিতে অনীক রীতিমত অসুস্থ বোধ করে। হাজার হলেও মানুষের শরীর তো। কতটা মিথ্যা সহ্য হয়। তবু রাহুলের বন্ধুত্ব হারাতে চায় না বলে সে সহ্য করে নেয় সবকিছু। রাহুলকে সত্য বললে রাহুল ওর কাছে আসা বন্ধ করে দেবে। অন্যদের কাছে খারাপ হলেও অনীকের সাথে রাহুল কখনো খারাপ কিছু করেনি। তাই তার সাথে মিথ্যে দিয়েও দারুন চলে যায়।
একদিন গল্প করতে করতে অনীকের মুখ দিয়ে ফস করে বেরিয়ে পড়ে, তুই এত টাকার লোভী কেন রে? এত মানুষের টাকা নিয়েও তোর তৃপ্তি নেই?
সামান্য একটা শব্দ। কিন্তু রাহুল কখনো কল্পনাও করতে পারেনি সে এই জিনিস শুনবে অনীকের মুখে। অনীকের সাথে তার টাকার সম্পর্ক না। টাকাটা সে গল্পের জন্যই বলে। কিন্তু অনীকের জন্য তার ছেলেবেলার মায়া। দুজনে হাত ধরে বড় হয়েছে। একসাথে কতদিন রাত কেটেছে। সেই অনীক আজ তাকে লোভী বললো?
সেও পাল্টা বলে বসে, “আমি যদি লোভী হই, লোভী মানুষের সাথে তোর কোন বন্ধুত্বের দরকার নেই।” বলে আর দাড়ায় না, হুট করে দরজা খুলে বেরিয়ে যায়। পেছন থেকে অনীক ডাকতে থাকে, কিন্তু রাহুল শোনে না। সে চলে যায়। রাহুল আর অনীকের বাসায় আসেনি। অনীক পরপর কয়েকবার ফোন করেছে রাহুলের নাম্বারে। কিন্তু রাহুলের ফোন বন্ধ দেখা যায়।
কয়েকদিন পর অনীক রাতে শুয়ে শুয়ে ভাবতে থাকে, রাহুলের সাথে এতদিনের বন্ধুত্বটা কি শেষই হয়ে গেল চিরতরে? তার বুকটা হু হু করে উঠে। কিন্তু আবার ভাবতে থাকে, বোধহয় ভালোই হলো। এরকম বন্ধুত্ব থাকার চেয়ে না থাকাই উত্তম। রাহুল তার নিজের জন্য তো বটেই, অন্য বন্ধুদের জন্যও ক্ষতিকর বন্ধু ছিল। অভিনয় করে কতদিন আর অপবন্ধুকে সহ্য করা যায়? রাহুলের বন্ধুত্বের সজীবতা নষ্ট হয়ে গেছে লোভের উত্তাপে। মৃত বন্ধুত্বের জন্য আর কোন শোক উথলে উঠবে না আর।
এই বন্ধুতা পতনে শতবর্ষী একটা বৃক্ষের পতন হলো যেন!
নক্ষত্র গজব
ভিনগ্রহবাসীর আক্রমনে ঘুমটা ভেঙ্গে গেল।
মুহুর্মুহু আক্রমন হঠাৎ করে। কোন আগাম সতর্কবানী নেই, কোন বিপদাংশকা ছিল না আগে থেকে। বিকেল থেকেই আকাশটা লালনীল রঙের মেঘে ভরপুর ছিল। তেরঙ্গা ঘুড্ডির মতো মেঘগুলো উড়ে উড়ে উত্তরের পানে ছুটছিল। সেই মেঘগুলোর ফাঁক দিয়ে হঠাৎ ঝিকিমিকি তারকা দেখে বিস্ময়ে হা হয়ে তাকিয়েই ছিলাম অনেকক্ষন। কিন্তু সেই তারাগুলো যখন মেঘ ছুঁয়ে আরো নীচে নেমে আসতে লাগলো তখন ভাবনায় খেললো না এই সময়ে ওগুলোর নেমে আসার কথা কিনা। কিংবা ওই বস্তুসমূহ কি?
ভাবতে ভাবতে অদুরের ভবনের উপর যখন সেই তারকাটা পতন ঘটলো, তখন দুনিয়া কাঁপানো বিষ্ফোরনে কেপে উঠলো চারপাশ। অতঃপর হুশ হলো ওগুলো বোমা কিংবা আকাশ থেকে নেমে আসা গজব। পালানো কথা মনে এলেও কোথায় পালাবো তার কোন দিশে করতে না পেরে দিশেহারা ছুটলাম রাস্তায় রাস্তায় আরো অনেক মানুষের সাথে। সবাই ছুটছে। সেই তারকার পর আরো তারকা পতন ঘটতে লাগলো। কোন একটা তারকা কান ফুটো করে বেরিয়েও গেল আমার। আশ্চর্য কানে একটু গরম অনুভুতি হলেও দিব্যি বেঁচে রইলাম। গোলার মধ্যে ছুটছি কোথায় নিরাপদ আশ্রয়। আকাশ ছেয়ে গেছে তারকা গজবে। কমলা রঙের নক্ষত্রের মতো সুন্দর বস্তুগুলি ছেয়ে ফেলেছে শহরের আকাশ। নগরটা কয়েক মিনিটের মধ্যেই নরকে পরিনত হল।
আমার দম বন্ধ হয়ে গেল ছুটতে ছুটতে। হঠাৎ পায়ের গোড়ালীতে শেলের আঘাত পেয়ে চোখ মেললাম আবছা আলোতে। দেখি পায়ের কড়ে আঙুলটা ধরে টেনে ছিঁড়ে ফেলতে চাইছে সুলতা। বিরক্তস্বরে বলছে, "সাড়ে ছটা বেজে গেছে লোকটা এখনো ঘুমায়!"
বলে কী? আমি বিশ্বাসই করতে পারছি না আমি চিমটা খেয়ে জেগে উঠেছি। পায়ের গোড়ালীতে তখনো ভিনগ্রহীদের শেলের আঘাত পিনপিন করছে। বুকের ভেতর ভয়ের কাঁপুনি। সত্যই ভয় খাইছিলাম মারাত্মক!!
ভাগ্যিস জেগে উঠছিলাম, নইলে......।।
মুহুর্মুহু আক্রমন হঠাৎ করে। কোন আগাম সতর্কবানী নেই, কোন বিপদাংশকা ছিল না আগে থেকে। বিকেল থেকেই আকাশটা লালনীল রঙের মেঘে ভরপুর ছিল। তেরঙ্গা ঘুড্ডির মতো মেঘগুলো উড়ে উড়ে উত্তরের পানে ছুটছিল। সেই মেঘগুলোর ফাঁক দিয়ে হঠাৎ ঝিকিমিকি তারকা দেখে বিস্ময়ে হা হয়ে তাকিয়েই ছিলাম অনেকক্ষন। কিন্তু সেই তারাগুলো যখন মেঘ ছুঁয়ে আরো নীচে নেমে আসতে লাগলো তখন ভাবনায় খেললো না এই সময়ে ওগুলোর নেমে আসার কথা কিনা। কিংবা ওই বস্তুসমূহ কি?
ভাবতে ভাবতে অদুরের ভবনের উপর যখন সেই তারকাটা পতন ঘটলো, তখন দুনিয়া কাঁপানো বিষ্ফোরনে কেপে উঠলো চারপাশ। অতঃপর হুশ হলো ওগুলো বোমা কিংবা আকাশ থেকে নেমে আসা গজব। পালানো কথা মনে এলেও কোথায় পালাবো তার কোন দিশে করতে না পেরে দিশেহারা ছুটলাম রাস্তায় রাস্তায় আরো অনেক মানুষের সাথে। সবাই ছুটছে। সেই তারকার পর আরো তারকা পতন ঘটতে লাগলো। কোন একটা তারকা কান ফুটো করে বেরিয়েও গেল আমার। আশ্চর্য কানে একটু গরম অনুভুতি হলেও দিব্যি বেঁচে রইলাম। গোলার মধ্যে ছুটছি কোথায় নিরাপদ আশ্রয়। আকাশ ছেয়ে গেছে তারকা গজবে। কমলা রঙের নক্ষত্রের মতো সুন্দর বস্তুগুলি ছেয়ে ফেলেছে শহরের আকাশ। নগরটা কয়েক মিনিটের মধ্যেই নরকে পরিনত হল।
আমার দম বন্ধ হয়ে গেল ছুটতে ছুটতে। হঠাৎ পায়ের গোড়ালীতে শেলের আঘাত পেয়ে চোখ মেললাম আবছা আলোতে। দেখি পায়ের কড়ে আঙুলটা ধরে টেনে ছিঁড়ে ফেলতে চাইছে সুলতা। বিরক্তস্বরে বলছে, "সাড়ে ছটা বেজে গেছে লোকটা এখনো ঘুমায়!"
বলে কী? আমি বিশ্বাসই করতে পারছি না আমি চিমটা খেয়ে জেগে উঠেছি। পায়ের গোড়ালীতে তখনো ভিনগ্রহীদের শেলের আঘাত পিনপিন করছে। বুকের ভেতর ভয়ের কাঁপুনি। সত্যই ভয় খাইছিলাম মারাত্মক!!
ভাগ্যিস জেগে উঠছিলাম, নইলে......।।
যে লোকটা পাহাড়কে ভালোবাসতো
কালকেও লোকটাকে লিখতে দেখেছি। রাতভোর না পোহাতেই শুনি লোকটা গভীর খাদে পড়ে মারা গেছে। লোকটাকে চিনতাম, খানিকটা জানতাম, শোকাহত আমি সেই ভোর থেকে। খাদের কিনারায় কেন গিয়েছিল লোকটা জানা যায়নি।
লোকটা পাহাড় ভালোবাসতো, ঝর্নার গড়িয়ে চলা ভালোবাসতো, আকাশে মেঘেদের সাথে মিতালী পাতাতে ভালোবাসতো।
লোকটা হিমালয় চড়তে চাইতো, হিমালয় ছুঁতে না পেরে লোকটা নিকট পাহাড়ে ছুটতো। পাহাড়ে যেতে যেতে লোকটা পাহাড়ী বুনো হয়ে গিয়েছিল।
হয়তো সে পাহাড়ে উঠতে গিয়ে খাদের কিনারায় দাঁড়িয়েছিল। লোকটা পাহাড় ভালোবাসতো বলে পাহাড়ের কাছে পড়ে থাকতো। কেউ জানে না পাহাড়টা ভালোবেসেই লোকটাকে খাদের কোলে রেখে দিল কিনা।
লোকটার হিমালয় দেখা হলো না, মেঘ ছোঁয়া হলো না, ঝরনা জলে স্নান করা হলো না, লোকটা তার কোন স্বপ্নকে ছুঁতে পারলো না।
লোকটা পাহাড় ভালোবাসতো, ঝর্নার গড়িয়ে চলা ভালোবাসতো, আকাশে মেঘেদের সাথে মিতালী পাতাতে ভালোবাসতো।
লোকটা হিমালয় চড়তে চাইতো, হিমালয় ছুঁতে না পেরে লোকটা নিকট পাহাড়ে ছুটতো। পাহাড়ে যেতে যেতে লোকটা পাহাড়ী বুনো হয়ে গিয়েছিল।
হয়তো সে পাহাড়ে উঠতে গিয়ে খাদের কিনারায় দাঁড়িয়েছিল। লোকটা পাহাড় ভালোবাসতো বলে পাহাড়ের কাছে পড়ে থাকতো। কেউ জানে না পাহাড়টা ভালোবেসেই লোকটাকে খাদের কোলে রেখে দিল কিনা।
লোকটার হিমালয় দেখা হলো না, মেঘ ছোঁয়া হলো না, ঝরনা জলে স্নান করা হলো না, লোকটা তার কোন স্বপ্নকে ছুঁতে পারলো না।
এক অলস বিড়ালের প্রেম ও এক 'সুশীল' মানুষের অমানবিকতার গল্প
শব্দটা ক্ষীন, কিন্তু বাঁশীর মতো তীক্ষ্ণ। আধোঘুমে বুঝতে পারছিলাম না ঠিক কোথা থেকে শব্দটা আসছে। বাইরে থেকেও হতে পারে। আমি যে ঘরে ঘুমোতাম তার দুটো জানালা ছিল। খাটের পায়ের দিকে একটা, বামদিকে আরেকটা। জানালা খোলা, পর্দাগুলো নামানো। আরেকটু ঘোর কাটতেই শব্দটা আরো পরিষ্কার হলো। বেড়াল ছানার আওয়াজ নয়তো?
আমাদের একটা পোষা বিড়ালনী ছিল। তাকে বাচ্চা অবস্থায় আমরা সংগ্রহ করেছিলাম ইঁদুর তাড়ানোর জন্য। কিন্তু জন্ম থেকেই তার ইঁদুর-ভীতি কিংবা ইদুর-অরুচির কারনে তার ছয় বছরের কর্মজীবনে ছয়টা ইঁদুরও ধরতে পারেনি। না পারলেও তাকে ফেলে দেয়া যায়নি কারন আমার ছোটবোনের প্রচন্ড বিড়ালপ্রীতি। বিড়ালটাকে সে রীতিমতো দুধেভাতে রেখেছে, কদাদিৎ যদি বিড়ালটার উপর কোন অত্যাচার করা হয়, সে রীতিমত বিদ্রোহ করে বসতো বিড়ালাধিকার রক্ষায়। বিড়ালের জন্য জুতোর বাক্সে ফ্লীচের কম্বল দিয়ে বিছানা পাতা আছে, খাবার পাত্রে খাবার, পানির পাত্রে পানি, আর আলাদা বাথরুমের ব্যবস্থা করা আছে। এত সুবন্দোবস্তের পরও বিড়ালনী মাঝরাতে চুপি চুপি গিয়ে ঘুমোবে ড্রইংরুমের ফোমের সোফাটায়। এহেন আরাম আয়েশ সমেত গ্যারান্টেড চাকরী যেখানে, সেখানে দায়িত্ব পালনের কোন ব্যাপার নাই। সুতরাং তাকে দিয়ে ইঁদুর ধরানোর আশা ছেড়ে দিয়ে আমরা ইঁদুরের কলের প্রতি মনোযোগী হলাম।
কিন্তু সেয়ানা ইঁদুর কলে ধরা না দিলেও কলের ভেতরে রক্ষিত কেক বিস্কুট কলা সব খেয়ে আলগোছে কলের ফাঁদ এড়িয়ে কি করে যে বেরিয়ে যায় সেটা খোদা মালুম। এতে একটা জিনিস বুঝলাম মানুষের মতো অন্য প্রানীদেরও বিবর্তন হচ্ছে বিদ্যা বুদ্ধিতে, টেকনোলজিতে। হয়তো দেখা যাবে এক লক্ষ বছর পরে পৃথিবীতে ইঁদুরেরা রকেট-ফকেট নিয়ে এই গ্রহে সেই গ্রহে ঘুরে বেড়াচ্ছে আর মানুষেরা ফিরে গেছে গুহায়।
ধান ভানতে শিবের গীত হয়ে যাচ্ছে। ফিরে যাই বিড়াল গল্পে।
বিড়ালনী কর্মযজ্ঞে অলসের চুড়ান্ত হলেও প্রেমের ক্ষেত্রে মেরিলিন মনরোর চেয়েও এগিয়ে। তার বছর বছর নিত্য নতুন বয়ফ্রেন্ড আসে যায়। পাড়ার যত হুলো বেড়াল আছে সবগুলার সাথে ডেটিং করে বেড়ায় সুন্দরী বিড়ালনী। মাঝে মাঝে বয়ফ্রেন্ডদের মধ্যেকার আন্তঃকলহ রক্তারক্তির ঘটনাও প্রত্যক্ষ করেছি আমরা। মারামারির ধরন দেখলেই বুঝা যায় 'সখী তুমি কার' যুদ্ধ। সেই সব উপদ্রপও মেনে নিলাম।
কিন্তু চুড়ান্ত বিরক্তিকর ব্যাপার হলো তার প্রেমের ফসলগুলো। কয়েকমাস পর পর পোয়াতি হতো বিড়ালনী এবং কমপক্ষে দুটো করে বাচ্চার জন্ম হয় প্রতিবারে, কখনো বা তিনটে। বিড়াল সমাজের এত হাই প্রোডাক্টিভিটি হজম করা কঠিন হয়ে যায় আমাদের জন্য। কারন বিড়ালনীকে পুষলেও তার ছানাপোনাকে পোষার ক্ষমতা আমাদের ছিল না। তবু একেবারে শিশু বয়সে বাচ্চাগুলোকে ফেলতে পারতাম না। বিপদজনক বয়স পার হবার পর মা কাজের বুয়াকে দিয়ে বিড়ালগুলোকে দুরে কোথাও পাঠিয়ে দিত। বিড়াল ছানা পার করতে করতে আমাদের বুয়াও বিরক্ত। হিসেব করলে বিড়ালটা যে কয়েক ডজন বাচ্চা আমাদের বাসায় দিয়েছে সেগুলোর বংশবৃদ্ধি হলে পাঁচ বছরে কয়েকশো বিড়ালের বিশাল একটা খামার হয়ে যেতো।
সেদিন রাতের থেকে কিউ কিউ শব্দটা শুনে খানিকপর নিশ্চিত হলাম ওটা বিড়াল ছানার কান্না। বিড়ালনী নিশ্চয়ই বাচ্চা দিয়েছে আবার। এবং বেড়ালছানাগুলোকে আমার খাটের নীচে গুঁজে রেখে প্রেম করতে বেরিয়ে গেছে কোথাও। মেজাজ খাপ্পা হয়ে যায় আমার। বাতি জালিয়ে শব্দের উৎস খুঁজতে খুঁজতে যে জায়গায় পেলাম ওদের সেটা একটা অগম্য জায়গা। আমার স্টীলের বিশাল বুক শেলফের পেছনের চিপার ভেতরদিকে। যেখানে মানুষের হাত যাবে না, অন্য কিছু ঢুকানোও কঠিন। কিন্তু কি করে বজ্জাত বিড়ালছানা দুটো ওখানে ঢুকেছে বুঝলাম না।
টর্চ মেরে বয়স আন্দাজ করলাম। দেখে মনে হলো এখনো হাঁটতে পারে না। বেশ কিছুক্ষন শিউ শিউ করেও বের করা গেল না। এমন জায়গায় আটকে আছে যেখান থেকে নিজে না আসলে কেউ আনতে পারবে না। খোদ বিড়ালনীও না। পরদিন ভোরে অফিস আমার। রাত তিনটের সময় ঘুম থেকে জেগে বিড়ালছানা উদ্ধার কর্ম কেমন লাগে? কিন্তু ওদের বের না করলে ওদের চেয়েও আমার অসুবিধা বেশী। কিউ কিউ শব্দে ঘুম আসবে না আমার।
বাসার কাউকে না জাগিয়ে আমি লম্বা একটা পাইপ নিয়ে ওদের বের করার চেষ্টা করলাম। কিন্তু বিড়ালছানা দুটো বয়সে পুঁচকে হলেও গলায় চিতাবাঘের তেজ। আমি এলুমিনিয়ামের পর্দার পাইপটা ঢোকানো মাত্র ফোঁস ফোঁস করে উঠলো। যেন শত্রু এসে গেছে। অবচেতন বলে দেয় ওদের। ফলে ওরা সহযোগিতার বদলে প্রতিরোধ গড়ার ইচ্ছে প্রকাশ করলো। আমি যতই আনার চেষ্টা করি, ওর ততই ফোঁস ফোঁস করে পিছিয়ে যায়। পেছোতে পেছোতে এমন জায়গায় গেল, যেখান থেকে টেনে আনার সাধ্য ক্রেনেরও নাই। বুকশেলফটা সরাতে তিনচারজন শক্তিমান মানুষ লাগবে।
আমার অসহায়ত্ব তখন হঠাৎ করে মমত্ব থেকে প্রচন্ড রাগে পরিনত হলো। ব্যাটা, ওখানে আনঅথরাইজ ঢুকছস, আবার তেজ দেখাস। দিলাম পাইপ দিয়ে কয়েক ঘা ওই ফাঁক দিয়ে। ওরে, বাপস এরপর আরো তেজ, দুটোর কিঁউ কিঁউ চিৎকারে আশেপাশের বাড়ীতেও ঘুম ভেঙ্গে যাবার দশা। গেলে যাক আমার রোখ চেপে গেছে তখন। আমি নিশ্চিত বিড়ালাধিকার লংঘন করছি। কিন্তু মেজাজ এত খারাপ হলো যে, প্রায় পিটিয়ে পিটিয়ে খুঁচিয়ে বের করলাম দুটোকে সেই চিপা থেকে, আধাঘন্টার উদ্ধারকর্মে রীতিমতো গলদঘর্ম। মেজাজ তখনো খুব খারাপ, বের করে এনে গলাটা টিপে ধরতে ইচ্ছে হলো।
কিন্তু বের করার পর পুঁচকে তেজী বিড়ালছানা দুটোর আহত খোঁচানো মুখ দেখে আমার এমন কষ্ট লাগলো যে নিমেষেই সমস্ত রাগ অনুশোচনায় পরিনত হলো। কারন একটা বিড়ালের চোখ প্রায় নষ্ট করে দিয়েছি গুতিয়ে। অপরাধবোধে মিইয়ে গিয়ে বিড়ালছানাদুটোকে হাতে তুলে নিয়ে বাইরের বারান্দায় ছেড়ে আসলাম। বিড়ালনী তখনো ফেরেনি অভিসার থেকে। ফিরে এসে শুয়ে পড়লাম বাতি নিভিয়ে। আহত বিড়ালছানা দুটো বাইরে কুঁই কুঁই করছে। আমার ঘুম এলো না সে রাতে আর।
অনেক বছর কেটে গেছে। আমিও বাবা হয়েছি একসময়। কখনো কখনো মাঝরাতে আমার শিশুসন্তানের ডাক শুনে আমি চমকে উঠি। সেও মাঝে মাঝে কিঁউ কিঁউ অস্ফুট শব্দ করে পাশে শুয়ে থাকা মায়ের আশ্রয় খোঁজে। আমি একটু কেঁপে উঠি সেই বিড়ালছানাগুলোর কথা ভেবে।
আমাদের একটা পোষা বিড়ালনী ছিল। তাকে বাচ্চা অবস্থায় আমরা সংগ্রহ করেছিলাম ইঁদুর তাড়ানোর জন্য। কিন্তু জন্ম থেকেই তার ইঁদুর-ভীতি কিংবা ইদুর-অরুচির কারনে তার ছয় বছরের কর্মজীবনে ছয়টা ইঁদুরও ধরতে পারেনি। না পারলেও তাকে ফেলে দেয়া যায়নি কারন আমার ছোটবোনের প্রচন্ড বিড়ালপ্রীতি। বিড়ালটাকে সে রীতিমতো দুধেভাতে রেখেছে, কদাদিৎ যদি বিড়ালটার উপর কোন অত্যাচার করা হয়, সে রীতিমত বিদ্রোহ করে বসতো বিড়ালাধিকার রক্ষায়। বিড়ালের জন্য জুতোর বাক্সে ফ্লীচের কম্বল দিয়ে বিছানা পাতা আছে, খাবার পাত্রে খাবার, পানির পাত্রে পানি, আর আলাদা বাথরুমের ব্যবস্থা করা আছে। এত সুবন্দোবস্তের পরও বিড়ালনী মাঝরাতে চুপি চুপি গিয়ে ঘুমোবে ড্রইংরুমের ফোমের সোফাটায়। এহেন আরাম আয়েশ সমেত গ্যারান্টেড চাকরী যেখানে, সেখানে দায়িত্ব পালনের কোন ব্যাপার নাই। সুতরাং তাকে দিয়ে ইঁদুর ধরানোর আশা ছেড়ে দিয়ে আমরা ইঁদুরের কলের প্রতি মনোযোগী হলাম।
কিন্তু সেয়ানা ইঁদুর কলে ধরা না দিলেও কলের ভেতরে রক্ষিত কেক বিস্কুট কলা সব খেয়ে আলগোছে কলের ফাঁদ এড়িয়ে কি করে যে বেরিয়ে যায় সেটা খোদা মালুম। এতে একটা জিনিস বুঝলাম মানুষের মতো অন্য প্রানীদেরও বিবর্তন হচ্ছে বিদ্যা বুদ্ধিতে, টেকনোলজিতে। হয়তো দেখা যাবে এক লক্ষ বছর পরে পৃথিবীতে ইঁদুরেরা রকেট-ফকেট নিয়ে এই গ্রহে সেই গ্রহে ঘুরে বেড়াচ্ছে আর মানুষেরা ফিরে গেছে গুহায়।
ধান ভানতে শিবের গীত হয়ে যাচ্ছে। ফিরে যাই বিড়াল গল্পে।
বিড়ালনী কর্মযজ্ঞে অলসের চুড়ান্ত হলেও প্রেমের ক্ষেত্রে মেরিলিন মনরোর চেয়েও এগিয়ে। তার বছর বছর নিত্য নতুন বয়ফ্রেন্ড আসে যায়। পাড়ার যত হুলো বেড়াল আছে সবগুলার সাথে ডেটিং করে বেড়ায় সুন্দরী বিড়ালনী। মাঝে মাঝে বয়ফ্রেন্ডদের মধ্যেকার আন্তঃকলহ রক্তারক্তির ঘটনাও প্রত্যক্ষ করেছি আমরা। মারামারির ধরন দেখলেই বুঝা যায় 'সখী তুমি কার' যুদ্ধ। সেই সব উপদ্রপও মেনে নিলাম।
কিন্তু চুড়ান্ত বিরক্তিকর ব্যাপার হলো তার প্রেমের ফসলগুলো। কয়েকমাস পর পর পোয়াতি হতো বিড়ালনী এবং কমপক্ষে দুটো করে বাচ্চার জন্ম হয় প্রতিবারে, কখনো বা তিনটে। বিড়াল সমাজের এত হাই প্রোডাক্টিভিটি হজম করা কঠিন হয়ে যায় আমাদের জন্য। কারন বিড়ালনীকে পুষলেও তার ছানাপোনাকে পোষার ক্ষমতা আমাদের ছিল না। তবু একেবারে শিশু বয়সে বাচ্চাগুলোকে ফেলতে পারতাম না। বিপদজনক বয়স পার হবার পর মা কাজের বুয়াকে দিয়ে বিড়ালগুলোকে দুরে কোথাও পাঠিয়ে দিত। বিড়াল ছানা পার করতে করতে আমাদের বুয়াও বিরক্ত। হিসেব করলে বিড়ালটা যে কয়েক ডজন বাচ্চা আমাদের বাসায় দিয়েছে সেগুলোর বংশবৃদ্ধি হলে পাঁচ বছরে কয়েকশো বিড়ালের বিশাল একটা খামার হয়ে যেতো।
সেদিন রাতের থেকে কিউ কিউ শব্দটা শুনে খানিকপর নিশ্চিত হলাম ওটা বিড়াল ছানার কান্না। বিড়ালনী নিশ্চয়ই বাচ্চা দিয়েছে আবার। এবং বেড়ালছানাগুলোকে আমার খাটের নীচে গুঁজে রেখে প্রেম করতে বেরিয়ে গেছে কোথাও। মেজাজ খাপ্পা হয়ে যায় আমার। বাতি জালিয়ে শব্দের উৎস খুঁজতে খুঁজতে যে জায়গায় পেলাম ওদের সেটা একটা অগম্য জায়গা। আমার স্টীলের বিশাল বুক শেলফের পেছনের চিপার ভেতরদিকে। যেখানে মানুষের হাত যাবে না, অন্য কিছু ঢুকানোও কঠিন। কিন্তু কি করে বজ্জাত বিড়ালছানা দুটো ওখানে ঢুকেছে বুঝলাম না।
টর্চ মেরে বয়স আন্দাজ করলাম। দেখে মনে হলো এখনো হাঁটতে পারে না। বেশ কিছুক্ষন শিউ শিউ করেও বের করা গেল না। এমন জায়গায় আটকে আছে যেখান থেকে নিজে না আসলে কেউ আনতে পারবে না। খোদ বিড়ালনীও না। পরদিন ভোরে অফিস আমার। রাত তিনটের সময় ঘুম থেকে জেগে বিড়ালছানা উদ্ধার কর্ম কেমন লাগে? কিন্তু ওদের বের না করলে ওদের চেয়েও আমার অসুবিধা বেশী। কিউ কিউ শব্দে ঘুম আসবে না আমার।
বাসার কাউকে না জাগিয়ে আমি লম্বা একটা পাইপ নিয়ে ওদের বের করার চেষ্টা করলাম। কিন্তু বিড়ালছানা দুটো বয়সে পুঁচকে হলেও গলায় চিতাবাঘের তেজ। আমি এলুমিনিয়ামের পর্দার পাইপটা ঢোকানো মাত্র ফোঁস ফোঁস করে উঠলো। যেন শত্রু এসে গেছে। অবচেতন বলে দেয় ওদের। ফলে ওরা সহযোগিতার বদলে প্রতিরোধ গড়ার ইচ্ছে প্রকাশ করলো। আমি যতই আনার চেষ্টা করি, ওর ততই ফোঁস ফোঁস করে পিছিয়ে যায়। পেছোতে পেছোতে এমন জায়গায় গেল, যেখান থেকে টেনে আনার সাধ্য ক্রেনেরও নাই। বুকশেলফটা সরাতে তিনচারজন শক্তিমান মানুষ লাগবে।
আমার অসহায়ত্ব তখন হঠাৎ করে মমত্ব থেকে প্রচন্ড রাগে পরিনত হলো। ব্যাটা, ওখানে আনঅথরাইজ ঢুকছস, আবার তেজ দেখাস। দিলাম পাইপ দিয়ে কয়েক ঘা ওই ফাঁক দিয়ে। ওরে, বাপস এরপর আরো তেজ, দুটোর কিঁউ কিঁউ চিৎকারে আশেপাশের বাড়ীতেও ঘুম ভেঙ্গে যাবার দশা। গেলে যাক আমার রোখ চেপে গেছে তখন। আমি নিশ্চিত বিড়ালাধিকার লংঘন করছি। কিন্তু মেজাজ এত খারাপ হলো যে, প্রায় পিটিয়ে পিটিয়ে খুঁচিয়ে বের করলাম দুটোকে সেই চিপা থেকে, আধাঘন্টার উদ্ধারকর্মে রীতিমতো গলদঘর্ম। মেজাজ তখনো খুব খারাপ, বের করে এনে গলাটা টিপে ধরতে ইচ্ছে হলো।
কিন্তু বের করার পর পুঁচকে তেজী বিড়ালছানা দুটোর আহত খোঁচানো মুখ দেখে আমার এমন কষ্ট লাগলো যে নিমেষেই সমস্ত রাগ অনুশোচনায় পরিনত হলো। কারন একটা বিড়ালের চোখ প্রায় নষ্ট করে দিয়েছি গুতিয়ে। অপরাধবোধে মিইয়ে গিয়ে বিড়ালছানাদুটোকে হাতে তুলে নিয়ে বাইরের বারান্দায় ছেড়ে আসলাম। বিড়ালনী তখনো ফেরেনি অভিসার থেকে। ফিরে এসে শুয়ে পড়লাম বাতি নিভিয়ে। আহত বিড়ালছানা দুটো বাইরে কুঁই কুঁই করছে। আমার ঘুম এলো না সে রাতে আর।
অনেক বছর কেটে গেছে। আমিও বাবা হয়েছি একসময়। কখনো কখনো মাঝরাতে আমার শিশুসন্তানের ডাক শুনে আমি চমকে উঠি। সেও মাঝে মাঝে কিঁউ কিঁউ অস্ফুট শব্দ করে পাশে শুয়ে থাকা মায়ের আশ্রয় খোঁজে। আমি একটু কেঁপে উঠি সেই বিড়ালছানাগুলোর কথা ভেবে।
দুর্বিসহ ভ্রমন কান্ড (দুই)
চরম হতাশার মধ্যেও দুটো সুখবর পাওয়া গেল। এক. এই ট্রেনটা চট্টগ্রামেই যাচ্ছে। দুই. ট্রেনটা সামনের একটা স্টেশানে থামবে যেখানে নেমে গিয়ে সুবর্ন এক্সপ্রেসের জন্য অপেক্ষা করা যায়, যদিও সুবর্ন এক্সপ্রেস ওখানে থামবে না।
না থামলেও কি করে চলন্ত ট্রেনে উঠতে হবে সেটার প্রশিক্ষন ও পরামর্শের জন্য আমাদের চারপাশে মোটামুটি একটা ভীড় জমে গেল। বাংলাদেশে জ্ঞানী ও পরামর্শকের অভাব কোনকালেই ছিল না। সুতরাং চারপাশ থেকে উপদেশের বন্যা এমন প্লাবিত করতে থাকলো, আমরা দুজনই পরামর্শসাগরে নিমজ্জিত হয়ে বুদ্ধিশুদ্ধি হারিয়ে ফেলবার পথে। কিছুক্ষন হৈচৈএর পর উপদেষ্টা মন্ডলীর মধ্যেও দুটি দল হয়ে গেল।
এক দল বললো-
ক) এই ট্রেন থেকে নেমে সুবর্ন এক্সপ্রেস যে পাশ দিয়ে যাবে সেদিককার রেললাইনের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা এবং হাত উঁচিয়ে টিকেট নাড়াতে থাকা যদি গার্ড বা ড্রাইভারের চোখে পড়ে যায়, তাহলে ঘ্যাচাং করে ব্রেক কষে দাঁড়াবে ট্রেন।
অন্য দল এই পরামর্শকে হেসে উড়িয়ে দিল, বললো সুবর্ন এক্সপ্রেস জীবনেও থামে নাই এখানে। তারচে বরং এরকম করা যাক-
খ) ট্রেনটা এখানে না থামলেও গতি কমায়। সেই গতিতে ট্রেনের হ্যান্ডেল ধরে ঝুলে পড়া সহজ। তারপর দরজার ফাঁক দিয়ে চীৎকার করলে লোকজন দরজা খুলে ঢুকিয়ে নেবে ভেতরে।
দুইটা পদ্ধতিই গায়ে কাঁটা দিল। এরা বোধহয় আমাদের জেমস বন্ড মনে করেছে পোষাক আষাক দেখে। দুই দলই উৎসাহ যোগাচ্ছে তাদের পছন্দের পদ্ধতি বেছে নিতে। কিন্তু আমরা সিদ্ধান্ত নিতে পারছি না। কারন ক-পদ্ধতিতে ট্রেন না থামলে এই বেজাগায় রাত কাটাবো কোথায় ভাবতে শিউরে উঠলাম। আবার খ-পদ্ধতিতে যদি ওরা দরোজা না খোলে, তাহলে চট্টগ্রাম পর্যন্ত হাতলে ঝুলে শীতে জমে মরার চেয়ে লাফ দিয়ে ট্রেনের নীচে পড়ে আত্মহত্যা করা বরং সহজ।
সুতরাং দুই দলকে নিরুৎসাহিত করে সীটের পাশে হেলান দিয়ে সাতঘন্টা কাটিয়ে দেবো বলে সিদ্ধান্ত নিলাম দুজনে।
ট্রেনটা পরের ষ্টেশানে থামলেও আমরা নামলাম না। খানিক পর ঝমঝম শব্দ করে সুবর্ন এক্সপ্রেস চলে গেল আমাদের কাঁচকলা দেখিয়ে। ট্রেনটা আমাদেরকে অতিক্রম করার সময় আমার পরামর্শক মন্ডলীর মধ্যে চিত্তচাঞ্চল্য দেখা গেল। "আহারে কি আফসোস......উহু কি করলেন ভাই ফাস্টক্লাস চলে যাচ্ছে রে...." ইত্যাদি নানা রকম সহমর্মীতা ও টিটকারী উভবিধ মন্তব্যে ভরে গেল বগি। ওটা যাবার পর আমাদের ট্রেনটা ছাড়লো।
পরামর্শক দল যার যার আসনে ফিরে গেছে। আমরা দাড়িয়ে আছি। কিছুক্ষন চুপচাপ সব। তারপর তৃতীয় এক ব্যক্তির আবির্ভাব ঘটলো আমাদের সামনে। বগির কোনার দিকে আঙুলের ইশারা দিয়ে কানের কাছে ফিস ফিস করে বললো, "আপনাদেরকে ডাকতেছে"।
বিস্মিত হয়ে ওদিকে এগিয়ে গেলাম। মাঝবয়েসী স্বাস্থ্যবান একটা লোক। চেহারায় কেমন একটা কতৃত্বের ছাপ। সুবিধার লাগলো না প্রথম দৃষ্টিতেই। কিন্তু লোকজনের সমীহ দেখে মনে হলো ইনি এই ট্রেনের "বিশেষ কেউ"। রেলের মালিক সরকার, এই জিনিসটা জানা না থাকলে ওনাকেই ট্রেনের মালিক ভেবে বসতাম। আমাদের টিকেটটা হাতে নিয়ে পরখ করলো। তারপর আপাদমস্তক দেখলো। সহমর্মী হয়ে বললো, "বিপদে পড়েছেন। উপায় নাই। কিছুক্ষন অপেক্ষা করেন। ঘন্টাখানেক পরে সিট পাবেন।"
ওরেবাপস। এটা কে? ভীষন ক্ষমতাধর মানুষ মনে হচ্ছে। গডফাদার টাইপ সুর পেলাম যেন। থাক, উপায় তো নাই। ঘন্টাখানেক পরে কি যাদুতে সিট দেবে খোদা জানে। আমরা ফিরে গিয়ে ওপাশের একটা সীটে হেলান দিয়ে রইলাম। উদাস হয়ে জানালার বাইরে অন্ধকার দেখার চেষ্টা করছি। জানালা বন্ধ, তবু ছুটে চলা অন্ধকার আর ট্রেনের প্রবল ঝিক ঝিক শব্দের মধ্যে ছন্দ খুঁজে সময় কাটানোর চেষ্টা করছি।
খানিক পর অদ্ভুত একটা ব্যাপার নজরে এল। ট্রেনের যাত্রীরা সবাই ওনার কাছে যাচ্ছে আর ফিরে আসছে। সবার সাথে ঠাট্টার সুরে কথা বলছেন। সবার খুব পরিচিত মনে হলো ভদ্রলোককে। ফাস্ট ক্লাসের সব যাত্রী যেন ওনার নিয়ন্ত্রনে। অবাক হলাম ব্যাপার দেখে। কৌতুহল দমাতে না পেরে একজনকে জিজ্ঞেস করেই ফেললাম, ওনার কাছে কেন যাচ্ছে সবাই।
জবাব শুনে চোখ কপালে আমার। এই বগির টিকেটের দায়িত্ব নাকি ওনার। যেসব মানুষ বসে আছে তারা সবাই ওনার কাছে মাথাপিছু পঞ্চাশ টাকা দিয়ে ফাস্টক্লাসের সীট পেয়েছে। যাত্রীদের প্রায় সবাই ব্রাম্মনবাড়িয়া নেমে যাবে ঘন্টাখানেক পর। এই ট্রেনের নিয়মিত ব্যাপার এটা। জিজ্ঞেস করলাম, "উনি কি রেলওয়ের কর্তা?" বললো, "না, উনি এই বগির কর্তা। রেলের লোক ওনাকে ঘাঁটায় না।" কেন ঘাটায় না জিজ্ঞেস করার সাহস হলো না।
এতক্ষনে ওনার সীট পাইয়ে দেবার ক্ষমতার উৎস বুঝলাম। অক্ষম একটা নিঃশ্বাস বেরিয়ে গেল ভেতর থেকে। ভাবলাম আমাদের কাছেও টাকা চাইবে না তো আবার? নাহ, আমাদের কাছে টাকা চেয়ে বিব্রত করেনি গডফাদার।
মজার ব্যাপার হলো ব্রাম্মনবাড়িয়া আসে। ট্রেনটা থামার আগেই সব ফার্স্টক্লাস প্যাসেঞ্জার গাট্টিবোচকা সহকারে দরোজায় ভীড় করলো। ট্রেন থামতে না থামতেই দরোজা খুলে হুড়মুড় করে পুরো বগি খালি করে নেমে গেল সবাই। গডফাদারকে দেখা গেল না ওই কোনায় আর।
তারপর আমাদের জনা সাতেক লোককে নিয়ে প্রায় খালি বগিটা চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে হুইসেল বাজালো।
[আপাততঃ শেষ। অন্য কোন যাত্রাকালের ভ্রমন খন্ড পরে আসতে পারে]
না থামলেও কি করে চলন্ত ট্রেনে উঠতে হবে সেটার প্রশিক্ষন ও পরামর্শের জন্য আমাদের চারপাশে মোটামুটি একটা ভীড় জমে গেল। বাংলাদেশে জ্ঞানী ও পরামর্শকের অভাব কোনকালেই ছিল না। সুতরাং চারপাশ থেকে উপদেশের বন্যা এমন প্লাবিত করতে থাকলো, আমরা দুজনই পরামর্শসাগরে নিমজ্জিত হয়ে বুদ্ধিশুদ্ধি হারিয়ে ফেলবার পথে। কিছুক্ষন হৈচৈএর পর উপদেষ্টা মন্ডলীর মধ্যেও দুটি দল হয়ে গেল।
এক দল বললো-
ক) এই ট্রেন থেকে নেমে সুবর্ন এক্সপ্রেস যে পাশ দিয়ে যাবে সেদিককার রেললাইনের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা এবং হাত উঁচিয়ে টিকেট নাড়াতে থাকা যদি গার্ড বা ড্রাইভারের চোখে পড়ে যায়, তাহলে ঘ্যাচাং করে ব্রেক কষে দাঁড়াবে ট্রেন।
অন্য দল এই পরামর্শকে হেসে উড়িয়ে দিল, বললো সুবর্ন এক্সপ্রেস জীবনেও থামে নাই এখানে। তারচে বরং এরকম করা যাক-
খ) ট্রেনটা এখানে না থামলেও গতি কমায়। সেই গতিতে ট্রেনের হ্যান্ডেল ধরে ঝুলে পড়া সহজ। তারপর দরজার ফাঁক দিয়ে চীৎকার করলে লোকজন দরজা খুলে ঢুকিয়ে নেবে ভেতরে।
দুইটা পদ্ধতিই গায়ে কাঁটা দিল। এরা বোধহয় আমাদের জেমস বন্ড মনে করেছে পোষাক আষাক দেখে। দুই দলই উৎসাহ যোগাচ্ছে তাদের পছন্দের পদ্ধতি বেছে নিতে। কিন্তু আমরা সিদ্ধান্ত নিতে পারছি না। কারন ক-পদ্ধতিতে ট্রেন না থামলে এই বেজাগায় রাত কাটাবো কোথায় ভাবতে শিউরে উঠলাম। আবার খ-পদ্ধতিতে যদি ওরা দরোজা না খোলে, তাহলে চট্টগ্রাম পর্যন্ত হাতলে ঝুলে শীতে জমে মরার চেয়ে লাফ দিয়ে ট্রেনের নীচে পড়ে আত্মহত্যা করা বরং সহজ।
সুতরাং দুই দলকে নিরুৎসাহিত করে সীটের পাশে হেলান দিয়ে সাতঘন্টা কাটিয়ে দেবো বলে সিদ্ধান্ত নিলাম দুজনে।
ট্রেনটা পরের ষ্টেশানে থামলেও আমরা নামলাম না। খানিক পর ঝমঝম শব্দ করে সুবর্ন এক্সপ্রেস চলে গেল আমাদের কাঁচকলা দেখিয়ে। ট্রেনটা আমাদেরকে অতিক্রম করার সময় আমার পরামর্শক মন্ডলীর মধ্যে চিত্তচাঞ্চল্য দেখা গেল। "আহারে কি আফসোস......উহু কি করলেন ভাই ফাস্টক্লাস চলে যাচ্ছে রে...." ইত্যাদি নানা রকম সহমর্মীতা ও টিটকারী উভবিধ মন্তব্যে ভরে গেল বগি। ওটা যাবার পর আমাদের ট্রেনটা ছাড়লো।
পরামর্শক দল যার যার আসনে ফিরে গেছে। আমরা দাড়িয়ে আছি। কিছুক্ষন চুপচাপ সব। তারপর তৃতীয় এক ব্যক্তির আবির্ভাব ঘটলো আমাদের সামনে। বগির কোনার দিকে আঙুলের ইশারা দিয়ে কানের কাছে ফিস ফিস করে বললো, "আপনাদেরকে ডাকতেছে"।
বিস্মিত হয়ে ওদিকে এগিয়ে গেলাম। মাঝবয়েসী স্বাস্থ্যবান একটা লোক। চেহারায় কেমন একটা কতৃত্বের ছাপ। সুবিধার লাগলো না প্রথম দৃষ্টিতেই। কিন্তু লোকজনের সমীহ দেখে মনে হলো ইনি এই ট্রেনের "বিশেষ কেউ"। রেলের মালিক সরকার, এই জিনিসটা জানা না থাকলে ওনাকেই ট্রেনের মালিক ভেবে বসতাম। আমাদের টিকেটটা হাতে নিয়ে পরখ করলো। তারপর আপাদমস্তক দেখলো। সহমর্মী হয়ে বললো, "বিপদে পড়েছেন। উপায় নাই। কিছুক্ষন অপেক্ষা করেন। ঘন্টাখানেক পরে সিট পাবেন।"
ওরেবাপস। এটা কে? ভীষন ক্ষমতাধর মানুষ মনে হচ্ছে। গডফাদার টাইপ সুর পেলাম যেন। থাক, উপায় তো নাই। ঘন্টাখানেক পরে কি যাদুতে সিট দেবে খোদা জানে। আমরা ফিরে গিয়ে ওপাশের একটা সীটে হেলান দিয়ে রইলাম। উদাস হয়ে জানালার বাইরে অন্ধকার দেখার চেষ্টা করছি। জানালা বন্ধ, তবু ছুটে চলা অন্ধকার আর ট্রেনের প্রবল ঝিক ঝিক শব্দের মধ্যে ছন্দ খুঁজে সময় কাটানোর চেষ্টা করছি।
খানিক পর অদ্ভুত একটা ব্যাপার নজরে এল। ট্রেনের যাত্রীরা সবাই ওনার কাছে যাচ্ছে আর ফিরে আসছে। সবার সাথে ঠাট্টার সুরে কথা বলছেন। সবার খুব পরিচিত মনে হলো ভদ্রলোককে। ফাস্ট ক্লাসের সব যাত্রী যেন ওনার নিয়ন্ত্রনে। অবাক হলাম ব্যাপার দেখে। কৌতুহল দমাতে না পেরে একজনকে জিজ্ঞেস করেই ফেললাম, ওনার কাছে কেন যাচ্ছে সবাই।
জবাব শুনে চোখ কপালে আমার। এই বগির টিকেটের দায়িত্ব নাকি ওনার। যেসব মানুষ বসে আছে তারা সবাই ওনার কাছে মাথাপিছু পঞ্চাশ টাকা দিয়ে ফাস্টক্লাসের সীট পেয়েছে। যাত্রীদের প্রায় সবাই ব্রাম্মনবাড়িয়া নেমে যাবে ঘন্টাখানেক পর। এই ট্রেনের নিয়মিত ব্যাপার এটা। জিজ্ঞেস করলাম, "উনি কি রেলওয়ের কর্তা?" বললো, "না, উনি এই বগির কর্তা। রেলের লোক ওনাকে ঘাঁটায় না।" কেন ঘাটায় না জিজ্ঞেস করার সাহস হলো না।
এতক্ষনে ওনার সীট পাইয়ে দেবার ক্ষমতার উৎস বুঝলাম। অক্ষম একটা নিঃশ্বাস বেরিয়ে গেল ভেতর থেকে। ভাবলাম আমাদের কাছেও টাকা চাইবে না তো আবার? নাহ, আমাদের কাছে টাকা চেয়ে বিব্রত করেনি গডফাদার।
মজার ব্যাপার হলো ব্রাম্মনবাড়িয়া আসে। ট্রেনটা থামার আগেই সব ফার্স্টক্লাস প্যাসেঞ্জার গাট্টিবোচকা সহকারে দরোজায় ভীড় করলো। ট্রেন থামতে না থামতেই দরোজা খুলে হুড়মুড় করে পুরো বগি খালি করে নেমে গেল সবাই। গডফাদারকে দেখা গেল না ওই কোনায় আর।
তারপর আমাদের জনা সাতেক লোককে নিয়ে প্রায় খালি বগিটা চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে হুইসেল বাজালো।
[আপাততঃ শেষ। অন্য কোন যাত্রাকালের ভ্রমন খন্ড পরে আসতে পারে]
দুর্বিসহ ভ্রমন কান্ড (এক)
এয়ারপোর্ট স্টেশানে পৌঁছাতে না পৌঁছাতেই ট্রেনের হুইসেল শুনলাম যেন। জানুয়ারীর তীব্র শীতের বিকেল। সেবার সত্যি খুব শীত পড়েছিল, কয়েক বছর আগে। জোব্বা জ্যাকেটে শীত মানছিল না। টেক্সী থেকে নেমেই হাতের ব্যাগ আর কাঁধের ব্যাগ শক্ত করে ধরে ছুট দিলাম প্ল্যাটফর্মের উপর দিয়ে। ট্রেন ছেড়েই দিচ্ছিল।
কোনদিকে না তাকিয়ে হাতল ধরে ঢুকে পড়লাম সামনে যে বগির দরোজা পেলাম সেখানে। আমরা দুজন। দিদার আর আমি। উঠেই হাঁপ ছাড়লাম, যাক একটুর জন্য মিস করলাম না। এবার ধীরে সুস্থে সীট খুঁজে বের করা যাবে। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত প্রথম শ্রেনীর কেবিন খুঁজে পেতে অত কষ্ট হবে না। সুবর্ন এক্সপ্রেসে এই প্রথম যাত্রা। প্রচুর সুনাম শুনেছি এর। চড়লাম এই প্রথম। কিন্তু ট্রেন ছাড়তেই খেয়াল হলো আজকে লোকজন বড় বেশী। কি বার আজকে? রোববার হবে। সপ্তাহের প্রথম দিন।
শুরু করলাম বগিতে বগিতে হেঁটে আসন খোঁজা। ট্রেনটা লম্বায় মাইলখানেক হবে। এমাথা ওমাথা দুবার আসা যাওয়া করে পৌষের কঠিন শীতগুলো শরীরের ঘাম হয়ে আগুন ঝরাতে শুরু করলো। ব্যাপার কি। কোথাও আমাদের কাংখিত বগিটা পাচ্ছি না।
ভিআইপি কেবিনগুলো ইঞ্জিনের কাছাকাছি হয়। যাই ওদিকে। প্রথম শ্রেনীর আরামদায়ক সীটগুলো যেন ডাকছে। রাতের বাসে এসে সকালে নেমেছি ঢাকায়। সারাদিনের প্রচন্ড হাটাহাটিতে পা টনটন করছে। একটু শোবার অবসর। একটু খানি আরামের দরকার। আরাম তো এক্ষুনি পাবো। ওই তো শীততাপ নিয়ন্ত্রিত ঘরের বিছানা আসছে আমার কাছে। এই ট্রেনের মধ্যেই কোথাও আছে। আশাবাদী দুজন মানুষ আমরা।
অবশেষে প্রথম শ্রেনী লেখা একটা বগি পাওয়া গেল। বাপরে, প্রথম শ্রেনীতেও এত ভীড়। বগিটার ভিআইপি লোকজনের চেহারা দেখে ভিড়মি খেলাম। সীটে পা তুলে বসে আছে লুঙ্গিপরা অনেক মানুষ। এদেশে নানান শ্রেনীর হাতে পয়সা চলে গেছে। দেশ তো ভালোই উন্নতি করেছে।
ট্রেনের সীট নাম্বার খুঁজতে গিয়ে টিটির দেখা পেলাম একজন। টিকেট হাতে নিয়ে উনি একবার আমাদের চেহারা আরেকবার টিকেটের দিকে পরখ করতে লাগলেন। বললেন, "আপনারা তো ভুল ট্রেনে উঠে পড়েছেন!!"
"এ্যাঁ?" মুখ হা হয়ে গেল আমাদের। কোন ট্রেনে উঠে পড়লাম? কোথায় যাচ্ছে ট্রেনটা?
কাধের বোঁচকা ছুড়ে ফেলে মেঝেতে পা ছড়িয়ে বসে কাঁদতে ইচ্ছে হলো।
কোনদিকে না তাকিয়ে হাতল ধরে ঢুকে পড়লাম সামনে যে বগির দরোজা পেলাম সেখানে। আমরা দুজন। দিদার আর আমি। উঠেই হাঁপ ছাড়লাম, যাক একটুর জন্য মিস করলাম না। এবার ধীরে সুস্থে সীট খুঁজে বের করা যাবে। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত প্রথম শ্রেনীর কেবিন খুঁজে পেতে অত কষ্ট হবে না। সুবর্ন এক্সপ্রেসে এই প্রথম যাত্রা। প্রচুর সুনাম শুনেছি এর। চড়লাম এই প্রথম। কিন্তু ট্রেন ছাড়তেই খেয়াল হলো আজকে লোকজন বড় বেশী। কি বার আজকে? রোববার হবে। সপ্তাহের প্রথম দিন।
শুরু করলাম বগিতে বগিতে হেঁটে আসন খোঁজা। ট্রেনটা লম্বায় মাইলখানেক হবে। এমাথা ওমাথা দুবার আসা যাওয়া করে পৌষের কঠিন শীতগুলো শরীরের ঘাম হয়ে আগুন ঝরাতে শুরু করলো। ব্যাপার কি। কোথাও আমাদের কাংখিত বগিটা পাচ্ছি না।
ভিআইপি কেবিনগুলো ইঞ্জিনের কাছাকাছি হয়। যাই ওদিকে। প্রথম শ্রেনীর আরামদায়ক সীটগুলো যেন ডাকছে। রাতের বাসে এসে সকালে নেমেছি ঢাকায়। সারাদিনের প্রচন্ড হাটাহাটিতে পা টনটন করছে। একটু শোবার অবসর। একটু খানি আরামের দরকার। আরাম তো এক্ষুনি পাবো। ওই তো শীততাপ নিয়ন্ত্রিত ঘরের বিছানা আসছে আমার কাছে। এই ট্রেনের মধ্যেই কোথাও আছে। আশাবাদী দুজন মানুষ আমরা।
অবশেষে প্রথম শ্রেনী লেখা একটা বগি পাওয়া গেল। বাপরে, প্রথম শ্রেনীতেও এত ভীড়। বগিটার ভিআইপি লোকজনের চেহারা দেখে ভিড়মি খেলাম। সীটে পা তুলে বসে আছে লুঙ্গিপরা অনেক মানুষ। এদেশে নানান শ্রেনীর হাতে পয়সা চলে গেছে। দেশ তো ভালোই উন্নতি করেছে।
ট্রেনের সীট নাম্বার খুঁজতে গিয়ে টিটির দেখা পেলাম একজন। টিকেট হাতে নিয়ে উনি একবার আমাদের চেহারা আরেকবার টিকেটের দিকে পরখ করতে লাগলেন। বললেন, "আপনারা তো ভুল ট্রেনে উঠে পড়েছেন!!"
"এ্যাঁ?" মুখ হা হয়ে গেল আমাদের। কোন ট্রেনে উঠে পড়লাম? কোথায় যাচ্ছে ট্রেনটা?
কাধের বোঁচকা ছুড়ে ফেলে মেঝেতে পা ছড়িয়ে বসে কাঁদতে ইচ্ছে হলো।
জগতের সেরা জীব মানুষ, একটা অতীব ভ্রান্ত ধারমা!!
বলা হয় মানুষ নাকি জগতের সেরা জীব। আমি অনেক ভাবিয়া চিন্তিয়াও একমত হইতে পারলাম না। মানুষের মতো অবলা অথর্ব প্রানী একটাও নাই। পোষাক আশাক, যন্ত্রপাতি বাদ দিয়ে একটা আদিম মানুষকে কল্পনা করুন তো! শারীরিকভাবে মানুষের মতো অক্ষম প্রানী দ্বিতীয়টি নেই। ক্ষুদে পিঁপড়ে থেকে শুরু করে আতিকায় হাতি পর্যন্ত সবগুলো প্রাণী মানুষের চেয়ে সবল সক্ষম স্বাবলম্বী। আদিম মানুষ যাও কিছুটা স্বাবলম্বী ছিল, সভ্যতর মানুষ হয়ে গেছে যন্ত্রনির্ভর অথর্ব। যন্ত্রপাতি বাদ দিলে খালি হাতে খালি গায়ে মানুষের মতো অসহায় প্রানী আর আছে নাকি? শীতকালে মানুষ বাদে আর কারো গরম কাপড় কিনতে হয়?
অন্যদিকে যাই। ধরা যাক আপনার আদরের পোষা বেড়ালনীটা গর্ভবতী হলো। তাকে কে সেবাযত্ন করবে? বিড়ালের মা, বাবা, ভাই, বোন, স্বামী, নাকি যারা বিড়ালটি পুষছেন তারা?
কেউ না। এক্কেবারে কেউ কোন খবর নেয় না তার।
কেউ বলে না তুমি সাবধানে থাকবা, ভারী কাজ করবা না, আয়রন ট্যাবলেট খাবা, ক্যালসিয়াম খাবা, ব্লাডপ্রেসার নিয়ন্ত্রনে রাখবা, রুটিন চেক আপ করাবা, আলট্রাসনোগ্রাফী করাবা, ভিটামিন খাবা, শাকসব্জী বেশী করে খাবা, টিকা দিবা এবং ব্যাথা উঠলে নিকটস্থ হাসপাতালে কিংবা সবুজ ছাতা দেখে ঢুকে পড়বা।
তাকে কেউ বলে না এসব। এমনকি তাদের কোন দাইমা সিষ্টেমও নাই। আপনাআপনিই বাচ্চা হয়ে যায়। বাচ্চা হবার পর সেদিন কিংবা দুদিন বাদেই বাচ্চাটা নিজে নিজে গুটি গুটি পায়ে চলাফেরা করে। মায়ের দুধ খায়, ঘুমায় মায়ের কোলে। ব্যাস।
কেউ তার ন্যাপি পরিষ্কার করে দেয় না, কেউ তাকে রোগপ্রতিষেধক টীকা দেয় না, কেউ কখনো তার জন্য আলগা খাবারের ব্যবস্থা করে না, এমনকি তাকে কোলে নিয়ে রাতভর মা বাবাকে গুনগুন করে ঘুম পাড়ানি গান গাইতে হয় না। বাচ্চাকে রেখে মা দিব্যি ঘুরে বেড়ায়। বাচ্চাকে পদে পদে চোখে চোখে রাখে না। কখন ব্যাথা পায়, কখন সর্দি লাগে, কখন ঘাম দেয়, কখন পেশাব করে এসব নিয়ে বিব্রত থাকতে হয় না। এমনকি হাগুপিসু করে প্রতিদিন এক গাদা কাঁথাবালিশ নষ্ট করে না বিড়ালছানা।
শুধু বেড়ালছানা নয়। তাবৎ প্রানীকুলের বাচ্চারা ডাক্তার, হাসপাতাল, টীকা, ভিটামিন, ক্যালরিফুড, ন্যাপি, প্যাম্পার্স ছাড়া দিব্যি সুন্দর জীবন পার করে দিচ্ছে। মানুষের মতো বিশৃংখল জীবন নয় তাদের কারো। মানুষের বাচ্চাদের দুপায়ে সোজা হয়ে দাঁড়াতেও দীর্ঘ এক বছর অপেক্ষা করতে হয়। অথচ বিড়াল ছানা কিংবা গরু ছাগলের বাচ্চা জন্মমাত্রেই দাঁড়িয়ে যায়। পরদিন থেকে হাঁটতে থাকে।
এত সব অযোগ্যতা নিয়ে মানুষ হলো সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব আর দুনিয়ার তাবৎ প্রানী সেকেন্ড ক্লাস সিটিজেন? কত বড় প্রহসন এটা, ভাবা যায়?
মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব - এটি নিতান্তই একটি ভ্রান্ত ধারমা!
অন্যদিকে যাই। ধরা যাক আপনার আদরের পোষা বেড়ালনীটা গর্ভবতী হলো। তাকে কে সেবাযত্ন করবে? বিড়ালের মা, বাবা, ভাই, বোন, স্বামী, নাকি যারা বিড়ালটি পুষছেন তারা?
কেউ না। এক্কেবারে কেউ কোন খবর নেয় না তার।
কেউ বলে না তুমি সাবধানে থাকবা, ভারী কাজ করবা না, আয়রন ট্যাবলেট খাবা, ক্যালসিয়াম খাবা, ব্লাডপ্রেসার নিয়ন্ত্রনে রাখবা, রুটিন চেক আপ করাবা, আলট্রাসনোগ্রাফী করাবা, ভিটামিন খাবা, শাকসব্জী বেশী করে খাবা, টিকা দিবা এবং ব্যাথা উঠলে নিকটস্থ হাসপাতালে কিংবা সবুজ ছাতা দেখে ঢুকে পড়বা।
তাকে কেউ বলে না এসব। এমনকি তাদের কোন দাইমা সিষ্টেমও নাই। আপনাআপনিই বাচ্চা হয়ে যায়। বাচ্চা হবার পর সেদিন কিংবা দুদিন বাদেই বাচ্চাটা নিজে নিজে গুটি গুটি পায়ে চলাফেরা করে। মায়ের দুধ খায়, ঘুমায় মায়ের কোলে। ব্যাস।
কেউ তার ন্যাপি পরিষ্কার করে দেয় না, কেউ তাকে রোগপ্রতিষেধক টীকা দেয় না, কেউ কখনো তার জন্য আলগা খাবারের ব্যবস্থা করে না, এমনকি তাকে কোলে নিয়ে রাতভর মা বাবাকে গুনগুন করে ঘুম পাড়ানি গান গাইতে হয় না। বাচ্চাকে রেখে মা দিব্যি ঘুরে বেড়ায়। বাচ্চাকে পদে পদে চোখে চোখে রাখে না। কখন ব্যাথা পায়, কখন সর্দি লাগে, কখন ঘাম দেয়, কখন পেশাব করে এসব নিয়ে বিব্রত থাকতে হয় না। এমনকি হাগুপিসু করে প্রতিদিন এক গাদা কাঁথাবালিশ নষ্ট করে না বিড়ালছানা।
শুধু বেড়ালছানা নয়। তাবৎ প্রানীকুলের বাচ্চারা ডাক্তার, হাসপাতাল, টীকা, ভিটামিন, ক্যালরিফুড, ন্যাপি, প্যাম্পার্স ছাড়া দিব্যি সুন্দর জীবন পার করে দিচ্ছে। মানুষের মতো বিশৃংখল জীবন নয় তাদের কারো। মানুষের বাচ্চাদের দুপায়ে সোজা হয়ে দাঁড়াতেও দীর্ঘ এক বছর অপেক্ষা করতে হয়। অথচ বিড়াল ছানা কিংবা গরু ছাগলের বাচ্চা জন্মমাত্রেই দাঁড়িয়ে যায়। পরদিন থেকে হাঁটতে থাকে।
এত সব অযোগ্যতা নিয়ে মানুষ হলো সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব আর দুনিয়ার তাবৎ প্রানী সেকেন্ড ক্লাস সিটিজেন? কত বড় প্রহসন এটা, ভাবা যায়?
মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব - এটি নিতান্তই একটি ভ্রান্ত ধারমা!
আমি সেই না হওয়া গান...আমার কোন নাম দিও না
লাঞ্চ থেকে ফিরে ব্রাউজার অন করে জিমেইলে চোখ বুলায় মারুফ।
প্রতিদিনের মতো ওর পুরোনো চিঠিগুলো খুলে খানিকটা পড়ে। তারপর ইন্টারনেটে চোখ বুলায়, আড্ডার জায়গাগুলোতে ক্লিক করে। এখানে সেখানে কত মানুষের আড্ডামেলা - ব্লগে, ফোরামে, ফেসবুকে। কখনো কখনো ওইসব আড্ডায় যোগ দেয় মারুফ। আজ যেন সবকিছু পানসে।
এত মানুষের ভীড়েও তার ভীষণ একলা লাগে। মাউসটা ক্লিক করেও যেন যুত পাচ্ছে না। এলোমেলো ক্লিক করে দুম করে বন্ধই করে দেয় ব্রাউজারটা। টেবিলে পড়ে থাকা অনেকগুলো জবাব না দেয়া মেইলের দিকে তাকায়। নিদারুণ নীরস কাজ। প্রিন্টআউটগুলোতে চোখ বুলায় বিরক্তি নিয়ে। আজকের মধ্যে এগুলোর জবাব দেয়া উচিত। কিন্তু আজ ভীষণ একটা অবসন্নতা আজ কর্মঠ হাত দুটোতে।
আজকের দুপুরটাও নিদারুণ নির্জন, ভীষণ নিঃসঙ্গ! গতকাল দুপুরটাও ছিল তেমন। পরশুরটাও। পরপর তিনদিন নিঃসঙ্গ সে।
সকালে অফিসে আসার পথে প্রতিদিন মনে মনে যার প্রতীক্ষা করে সে হলো একটা চিঠি। আজ তিনদিন কোন চিঠি নেই। থাকার কথাও ছিল না। তবু গত চার বছর ধরে ভোরে অফিসে ঢুকে অফিস মেইল চেক দিয়েই ফায়ারফক্স ওপেন করে সরাসরি জিমেইলে লগইন করে। ওখানে একটা চিঠি এসে অপেক্ষা করে প্রতিদিন ভোরে। ওই চিঠির প্রতীক্ষার অভ্যেস তার প্রতিটা দিন।
চার বছর আগে এমন কিছু ছিল না। তার ইমেইল ব্যবহারের বয়স এক যুগেরও বেশী। কিন্তু কখনো কারো চিঠির জন্য প্রতীক্ষা ছিল না। এই যুগে কেউ কাউকে চিঠি লেখে না। ইমেইলে কেবল দরকারী কথা থাকে, থাকে কাজের কথা। ইমেইলের জন্য কখনো ডাকপিয়নের প্রতীক্ষা যোগ হবে তা কখনো ভাবেনি মারুফ।
চিঠির অভ্যেসটা হঠাৎ হলো একদম অপ্রত্যাশিতভাবে। একবার একটা বিশেষ দিবসে ছোট্ট একটা কৌতূহলী চিঠি এল। প্রেরক অচেনা। যে নাম থেকে চিঠি এসেছে সেই নামটা একটা নদীর নাম। ওরকম অচেনা কারো কাছ থেকে চিঠি আসা অস্বাভাবিক। তবু ওই চিঠিটা যেন কোনো গ্রহ নক্ষত্রের যোগাযোগের ফসল হিসেবে চলে এসেছিল।
চিঠিটার জবাব দিয়েছিল মারুফ। আবারো চিঠি এলো কদিন পর। আবারও জবাব গেল। চিঠিতে চিঠিতে আলাপের একদিন জানা গেল পত্র লেখক একজন নারী। নাম অনামিকা। এই নামটা শুনেও ছদ্মনামই মনে হলো। তবু কৌতুহলকে সীমা লংঘন করতে দিল না মারুফ।
নারীত্বের পরিচয় পেয়েই বোধহয় মারুফের কৌতূহলের সাথে যোগ হলো আগ্রহও। অর্ধযুগের প্রবাসী জীবনে একটাও নারীবন্ধু যোগ হয়নি তার। হয়নি তার নিজের কারনেই। কারন একদা তার 'কেউ একজন' ছিল বাংলাদেশে। ওই সম্পর্ককে বিসর্জন দিতে হয়েছিল বলে পরিবার দেশ সব ছেড়ে পালিয়ে এসে এই দক্ষিন গোলার্ধে ঢেরা বেঁধেছিল সে। আর দেশে ফেরা হয়নি তার। সব পিছুটান কেটে ফেলে দিয়েছিল। কিন্তু সেই চিঠিটা এসে একটা নতুন যোগাযোগ অধ্যায়ের সূচনা করলো।
অনামিকার সাথে বন্ধুত্বের মাত্রাটা গভীরে পৌঁছালো বছর না পেরোতেই। প্রতিটি নতুন চিঠিতে বন্ধনটা গাঢ় হতে থাকে। চিঠি লেখার, চিঠি পাবার এক অভিনব নেশার জন্ম হয় দুজনের। বছর গড়াতেই দেখা গেল দৈনিক একাধিক চিঠি আসা যাওয়া করছে। চিঠির সংখ্যাধিক্য এক পর্যায়ে চিঠিকে সংকুচিত করে চিরকুটে পরিনত করলো। ই-চিরকুট। ই-চিরকুটের সংখ্যাও বাড়তে বাড়তে দৈনিক সেঞ্চুরী করে ফেলার রেকর্ড হয়ে যায় ওদের। তবু অতৃপ্তি...।
গত চার বছরে চার দিনের বিরতিও ছিল না কখনো। এত চিঠি লিখেছে তবু ওরা কেউ কাউকে দেখেনি কখনো। কন্ঠও শোনেনি। দুজনেই ওই কৌতূহলের গলাটা যেন টিপে রেখেছিল। কেবল শব্দে শব্দেই চেনা। এই চেনাটাই বা কতটুকু? দুজনের কেউ কারো ঠিকানা জানে না। জানে কেবল ভৌগোলিক অবস্থান বা দেশের নাম। আর ফোন নাম্বার। উত্তর গোলার্ধের একটা শীতপ্রধান দেশে অনামিকার বসবাস। আর দক্ষিন গোলার্ধে মারুফ।
উত্তর আর দক্ষিন গোলার্ধের এই সম্পর্কটা কখনো সংজ্ঞায়িত করা হয় না। একাকীত্ব প্রিয় দুজন মানুষের বন্ধনটা কি ছিল সেটা অজানাই থেকে যায়।
মারুফ ভাবে, এটা কি প্রেম? কি করে হয়? ওরা তো সেরকম কিছ বলেনি কখনো। অনামিকা ভাবে, আমার তো এক জীবনের প্রেম শেষ হয়ে গেছে। এ আবার কোন অনুভুতি? প্রতিদিন এত রাত জেগে কেন বসে থাকা ওর জন্য? মাঝে মাঝে একটু অপরাধবোধেও ভোগে অনামিকা। প্রাক সম্পর্কের প্রতি অবিশ্বস্ততা হয়ে যাচ্ছে কিনা ভেবে অস্থির হয়। মারুফেরও তো আরেকটা পূর্ব জীবন ছিল। সেদিন মারুফের কাছ থেকে সম্পর্কের সংজ্ঞা সম্পর্কিত একটা প্রশ্নের উত্তর শুনে অনামিকা দারুন কষ্ট পায়। মারুফও অন্যরকম অস্থিরতায় ভোগে।
শুরুটা বন্ধুত্বই ছিল, কিন্তু বন্ধুত্বের গন্ডীটা আরেকটু গভীরতায় পৌঁছালে সম্পর্কটা ঠিক কি বুঝতে পারে না মারুফ। অনুভুতিকে নিয়ন্ত্রন করার কোন চেষ্টাই করেনি সে। চোখ বুঝে ভালোলাগায় ডুবে ছিল। সেদিন অনামিকার মুখ থেকে ন্যায় অন্যায় প্রশ্ন উঠে আসায় মারুফ দ্বিধান্বিত হয়। ভাবে, অনামিকা হয়তো ভুল থেকে বেরিয়ে আসতে চায়। অনামিকার আক্ষেপ অস্থিরতার কারন অনুমান করে মারুফ আরো বিব্রত হয়। কথায় কথায় কোথায় যেন খোঁচা লেগে যায় অনামিকার। চার বছরে এই প্রথমবারের মতো সেদিন অনামিকা ঘোষনা দিল, কাল থেকে সে আর কোন চিঠি লিখবে না। অবসান হোক সকল ভুল বোঝাবুঝির। মারুফও প্রবল তেজে জবাব দিয়েছিল- চাইনা আর চিঠি যন্ত্রনা। নিয়ন্ত্রনহীন মুখ দিয়ে কীসব অস্থির শব্দমালা নির্গত হয়েছিল।
মারুফ বারবার স্ক্রীনের দিকে তাকায়। সত্যি সত্যি কোন চিঠি লেখেনি অনামিকা গত তিনদিন। সেও লেখেনি অভিমানে।
খুব অস্থির এবং শূন্য শূন্য লাগছে। কি করবে? আর কখনো যোগাযোগ হবে না ওদের? তা কি করে হয়। আজীবন বন্ধুতার বাঁধন কি একদিনের তর্কেই ছিঁড়ে যায়? অনামিকার ফোন নাম্বার আছে ওর কাছে। ফোন করবে? কখনো ফোন করেনি। ফোন করলে যদি না ধরে, যদি কঠিন কথা বলে, অপমান করে যদি?
এইসব নানান 'যদি'র আশংকায় ফোন করতে দ্বিধাবোধ করে। কিন্তু অনামিকাকে ফেরাতে হলে ফোন করা ছাড়া উপায় নাই। জীবনে প্রথমবারের মতো তাই ডায়াল করে অনামিকাকে। গলাটা শুনতে কেমন লাগবে ওর? মিষ্টি গলার মেয়ে নিশ্চয়ই, এত সুন্দর চিঠি লিখে, গলাটাও তেমন হবে। রিং হয়। কিন্তু ফোন ধরছে না কেউ ওই প্রান্তে।
বাজতে বাজতে কেটে যায় লাইন। দশবারের মতো ফোন করে মারুফ হতাশ হয় খুব। ইচ্ছে করে ফোন ধরছে না অনামিকা? তা তো হতে পারে না। নিশ্চয়ই ফোন থেকে দুরে আছে অনামিকা। গাড়ীর চাবিটা নিয়ে অফিস লক করে বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দেয় মারুফ। বাসায় পৌঁছে আবার চেষ্টা করবে। দেড় ঘন্টার ড্রাইভ। আজকে রাস্তায় একদম ট্রাফিক নেই। ড্রাইভ করে আরাম হবে।
হাইওয়েতে উঠে স্পীডটা একটু বেশীই তুলেছিল বোধহয়। অনামিকাকে ফোনে না পাবার হতাশার জেদটা পায়ের নীচে চেপে রাখা এক্সিলেটরের উপরই গিয়ে পড়ে অনেকটা। ফলে পাশের রাস্তা থেকে একটা লাল রঙের পিকআপ যখন আচম্বিতে উদয় হলো তখন ব্রেকে পা দেয়া হলেও খুব দেরী হয়ে গেছে। মারুফের গাড়ীটা শূন্যে তিনটা ডিগবাজি খেল এবং সশব্দ পতন ঘটলো কংক্রিটের হাইওয়েতে। তার কিছুক্ষন পর এম্বুলেন্স পুলিশের গাড়ী এসে হৈ চৈ শুরু করে। ঘন্টাখানেক পর একটা লাশ আর দুমড়ানো গাড়ী নিয়ে রাস্তাটা পরিষ্কার করে চলে গেল সবাই। আবারো নিস্তব্ধ হয়ে পড়ে আদিগন্ত বিস্তৃত হাইওয়েটা।
রাতের গভীরে ঠিক ওই জায়গাটায় প্রান্তরের নিস্তব্ধতা চিরে ক্ষুদে একটা পাখির ডাক শোনা গেল হঠাৎ। দিনের পাখি, রাতে ডাকার কথা নয়। ডাকটা আসছে রাস্তার পাশের একটা কাঁটাঝোপ থেকে। কোন সুখপাখির ডাক নয়, একটা পরিত্যক্ত মোবাইলের রিং টোন ওটা। পাখির ডাকের সাথে স্ক্রীনে ভেসে উঠেছে উত্তর গোলার্ধের একটা দেশের ডায়ালিং কোড। কিছুক্ষন পরপর পাখিটা অস্থির ডেকে উঠছিল। ফোনটা অসংখ্যবার বাজলো সেই রাতে। ব্যাটারির চার্জ শেষ না হওয়া পর্যন্ত বেজেই গেছে সেটি।
তারপর আর কখনোই ডাকেনি পাখিটা।
প্রতিদিনের মতো ওর পুরোনো চিঠিগুলো খুলে খানিকটা পড়ে। তারপর ইন্টারনেটে চোখ বুলায়, আড্ডার জায়গাগুলোতে ক্লিক করে। এখানে সেখানে কত মানুষের আড্ডামেলা - ব্লগে, ফোরামে, ফেসবুকে। কখনো কখনো ওইসব আড্ডায় যোগ দেয় মারুফ। আজ যেন সবকিছু পানসে।
এত মানুষের ভীড়েও তার ভীষণ একলা লাগে। মাউসটা ক্লিক করেও যেন যুত পাচ্ছে না। এলোমেলো ক্লিক করে দুম করে বন্ধই করে দেয় ব্রাউজারটা। টেবিলে পড়ে থাকা অনেকগুলো জবাব না দেয়া মেইলের দিকে তাকায়। নিদারুণ নীরস কাজ। প্রিন্টআউটগুলোতে চোখ বুলায় বিরক্তি নিয়ে। আজকের মধ্যে এগুলোর জবাব দেয়া উচিত। কিন্তু আজ ভীষণ একটা অবসন্নতা আজ কর্মঠ হাত দুটোতে।
আজকের দুপুরটাও নিদারুণ নির্জন, ভীষণ নিঃসঙ্গ! গতকাল দুপুরটাও ছিল তেমন। পরশুরটাও। পরপর তিনদিন নিঃসঙ্গ সে।
সকালে অফিসে আসার পথে প্রতিদিন মনে মনে যার প্রতীক্ষা করে সে হলো একটা চিঠি। আজ তিনদিন কোন চিঠি নেই। থাকার কথাও ছিল না। তবু গত চার বছর ধরে ভোরে অফিসে ঢুকে অফিস মেইল চেক দিয়েই ফায়ারফক্স ওপেন করে সরাসরি জিমেইলে লগইন করে। ওখানে একটা চিঠি এসে অপেক্ষা করে প্রতিদিন ভোরে। ওই চিঠির প্রতীক্ষার অভ্যেস তার প্রতিটা দিন।
চার বছর আগে এমন কিছু ছিল না। তার ইমেইল ব্যবহারের বয়স এক যুগেরও বেশী। কিন্তু কখনো কারো চিঠির জন্য প্রতীক্ষা ছিল না। এই যুগে কেউ কাউকে চিঠি লেখে না। ইমেইলে কেবল দরকারী কথা থাকে, থাকে কাজের কথা। ইমেইলের জন্য কখনো ডাকপিয়নের প্রতীক্ষা যোগ হবে তা কখনো ভাবেনি মারুফ।
চিঠির অভ্যেসটা হঠাৎ হলো একদম অপ্রত্যাশিতভাবে। একবার একটা বিশেষ দিবসে ছোট্ট একটা কৌতূহলী চিঠি এল। প্রেরক অচেনা। যে নাম থেকে চিঠি এসেছে সেই নামটা একটা নদীর নাম। ওরকম অচেনা কারো কাছ থেকে চিঠি আসা অস্বাভাবিক। তবু ওই চিঠিটা যেন কোনো গ্রহ নক্ষত্রের যোগাযোগের ফসল হিসেবে চলে এসেছিল।
চিঠিটার জবাব দিয়েছিল মারুফ। আবারো চিঠি এলো কদিন পর। আবারও জবাব গেল। চিঠিতে চিঠিতে আলাপের একদিন জানা গেল পত্র লেখক একজন নারী। নাম অনামিকা। এই নামটা শুনেও ছদ্মনামই মনে হলো। তবু কৌতুহলকে সীমা লংঘন করতে দিল না মারুফ।
নারীত্বের পরিচয় পেয়েই বোধহয় মারুফের কৌতূহলের সাথে যোগ হলো আগ্রহও। অর্ধযুগের প্রবাসী জীবনে একটাও নারীবন্ধু যোগ হয়নি তার। হয়নি তার নিজের কারনেই। কারন একদা তার 'কেউ একজন' ছিল বাংলাদেশে। ওই সম্পর্ককে বিসর্জন দিতে হয়েছিল বলে পরিবার দেশ সব ছেড়ে পালিয়ে এসে এই দক্ষিন গোলার্ধে ঢেরা বেঁধেছিল সে। আর দেশে ফেরা হয়নি তার। সব পিছুটান কেটে ফেলে দিয়েছিল। কিন্তু সেই চিঠিটা এসে একটা নতুন যোগাযোগ অধ্যায়ের সূচনা করলো।
অনামিকার সাথে বন্ধুত্বের মাত্রাটা গভীরে পৌঁছালো বছর না পেরোতেই। প্রতিটি নতুন চিঠিতে বন্ধনটা গাঢ় হতে থাকে। চিঠি লেখার, চিঠি পাবার এক অভিনব নেশার জন্ম হয় দুজনের। বছর গড়াতেই দেখা গেল দৈনিক একাধিক চিঠি আসা যাওয়া করছে। চিঠির সংখ্যাধিক্য এক পর্যায়ে চিঠিকে সংকুচিত করে চিরকুটে পরিনত করলো। ই-চিরকুট। ই-চিরকুটের সংখ্যাও বাড়তে বাড়তে দৈনিক সেঞ্চুরী করে ফেলার রেকর্ড হয়ে যায় ওদের। তবু অতৃপ্তি...।
গত চার বছরে চার দিনের বিরতিও ছিল না কখনো। এত চিঠি লিখেছে তবু ওরা কেউ কাউকে দেখেনি কখনো। কন্ঠও শোনেনি। দুজনেই ওই কৌতূহলের গলাটা যেন টিপে রেখেছিল। কেবল শব্দে শব্দেই চেনা। এই চেনাটাই বা কতটুকু? দুজনের কেউ কারো ঠিকানা জানে না। জানে কেবল ভৌগোলিক অবস্থান বা দেশের নাম। আর ফোন নাম্বার। উত্তর গোলার্ধের একটা শীতপ্রধান দেশে অনামিকার বসবাস। আর দক্ষিন গোলার্ধে মারুফ।
উত্তর আর দক্ষিন গোলার্ধের এই সম্পর্কটা কখনো সংজ্ঞায়িত করা হয় না। একাকীত্ব প্রিয় দুজন মানুষের বন্ধনটা কি ছিল সেটা অজানাই থেকে যায়।
মারুফ ভাবে, এটা কি প্রেম? কি করে হয়? ওরা তো সেরকম কিছ বলেনি কখনো। অনামিকা ভাবে, আমার তো এক জীবনের প্রেম শেষ হয়ে গেছে। এ আবার কোন অনুভুতি? প্রতিদিন এত রাত জেগে কেন বসে থাকা ওর জন্য? মাঝে মাঝে একটু অপরাধবোধেও ভোগে অনামিকা। প্রাক সম্পর্কের প্রতি অবিশ্বস্ততা হয়ে যাচ্ছে কিনা ভেবে অস্থির হয়। মারুফেরও তো আরেকটা পূর্ব জীবন ছিল। সেদিন মারুফের কাছ থেকে সম্পর্কের সংজ্ঞা সম্পর্কিত একটা প্রশ্নের উত্তর শুনে অনামিকা দারুন কষ্ট পায়। মারুফও অন্যরকম অস্থিরতায় ভোগে।
শুরুটা বন্ধুত্বই ছিল, কিন্তু বন্ধুত্বের গন্ডীটা আরেকটু গভীরতায় পৌঁছালে সম্পর্কটা ঠিক কি বুঝতে পারে না মারুফ। অনুভুতিকে নিয়ন্ত্রন করার কোন চেষ্টাই করেনি সে। চোখ বুঝে ভালোলাগায় ডুবে ছিল। সেদিন অনামিকার মুখ থেকে ন্যায় অন্যায় প্রশ্ন উঠে আসায় মারুফ দ্বিধান্বিত হয়। ভাবে, অনামিকা হয়তো ভুল থেকে বেরিয়ে আসতে চায়। অনামিকার আক্ষেপ অস্থিরতার কারন অনুমান করে মারুফ আরো বিব্রত হয়। কথায় কথায় কোথায় যেন খোঁচা লেগে যায় অনামিকার। চার বছরে এই প্রথমবারের মতো সেদিন অনামিকা ঘোষনা দিল, কাল থেকে সে আর কোন চিঠি লিখবে না। অবসান হোক সকল ভুল বোঝাবুঝির। মারুফও প্রবল তেজে জবাব দিয়েছিল- চাইনা আর চিঠি যন্ত্রনা। নিয়ন্ত্রনহীন মুখ দিয়ে কীসব অস্থির শব্দমালা নির্গত হয়েছিল।
মারুফ বারবার স্ক্রীনের দিকে তাকায়। সত্যি সত্যি কোন চিঠি লেখেনি অনামিকা গত তিনদিন। সেও লেখেনি অভিমানে।
খুব অস্থির এবং শূন্য শূন্য লাগছে। কি করবে? আর কখনো যোগাযোগ হবে না ওদের? তা কি করে হয়। আজীবন বন্ধুতার বাঁধন কি একদিনের তর্কেই ছিঁড়ে যায়? অনামিকার ফোন নাম্বার আছে ওর কাছে। ফোন করবে? কখনো ফোন করেনি। ফোন করলে যদি না ধরে, যদি কঠিন কথা বলে, অপমান করে যদি?
এইসব নানান 'যদি'র আশংকায় ফোন করতে দ্বিধাবোধ করে। কিন্তু অনামিকাকে ফেরাতে হলে ফোন করা ছাড়া উপায় নাই। জীবনে প্রথমবারের মতো তাই ডায়াল করে অনামিকাকে। গলাটা শুনতে কেমন লাগবে ওর? মিষ্টি গলার মেয়ে নিশ্চয়ই, এত সুন্দর চিঠি লিখে, গলাটাও তেমন হবে। রিং হয়। কিন্তু ফোন ধরছে না কেউ ওই প্রান্তে।
বাজতে বাজতে কেটে যায় লাইন। দশবারের মতো ফোন করে মারুফ হতাশ হয় খুব। ইচ্ছে করে ফোন ধরছে না অনামিকা? তা তো হতে পারে না। নিশ্চয়ই ফোন থেকে দুরে আছে অনামিকা। গাড়ীর চাবিটা নিয়ে অফিস লক করে বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দেয় মারুফ। বাসায় পৌঁছে আবার চেষ্টা করবে। দেড় ঘন্টার ড্রাইভ। আজকে রাস্তায় একদম ট্রাফিক নেই। ড্রাইভ করে আরাম হবে।
হাইওয়েতে উঠে স্পীডটা একটু বেশীই তুলেছিল বোধহয়। অনামিকাকে ফোনে না পাবার হতাশার জেদটা পায়ের নীচে চেপে রাখা এক্সিলেটরের উপরই গিয়ে পড়ে অনেকটা। ফলে পাশের রাস্তা থেকে একটা লাল রঙের পিকআপ যখন আচম্বিতে উদয় হলো তখন ব্রেকে পা দেয়া হলেও খুব দেরী হয়ে গেছে। মারুফের গাড়ীটা শূন্যে তিনটা ডিগবাজি খেল এবং সশব্দ পতন ঘটলো কংক্রিটের হাইওয়েতে। তার কিছুক্ষন পর এম্বুলেন্স পুলিশের গাড়ী এসে হৈ চৈ শুরু করে। ঘন্টাখানেক পর একটা লাশ আর দুমড়ানো গাড়ী নিয়ে রাস্তাটা পরিষ্কার করে চলে গেল সবাই। আবারো নিস্তব্ধ হয়ে পড়ে আদিগন্ত বিস্তৃত হাইওয়েটা।
রাতের গভীরে ঠিক ওই জায়গাটায় প্রান্তরের নিস্তব্ধতা চিরে ক্ষুদে একটা পাখির ডাক শোনা গেল হঠাৎ। দিনের পাখি, রাতে ডাকার কথা নয়। ডাকটা আসছে রাস্তার পাশের একটা কাঁটাঝোপ থেকে। কোন সুখপাখির ডাক নয়, একটা পরিত্যক্ত মোবাইলের রিং টোন ওটা। পাখির ডাকের সাথে স্ক্রীনে ভেসে উঠেছে উত্তর গোলার্ধের একটা দেশের ডায়ালিং কোড। কিছুক্ষন পরপর পাখিটা অস্থির ডেকে উঠছিল। ফোনটা অসংখ্যবার বাজলো সেই রাতে। ব্যাটারির চার্জ শেষ না হওয়া পর্যন্ত বেজেই গেছে সেটি।
তারপর আর কখনোই ডাকেনি পাখিটা।
ভাড়া কিংবা বিক্রি হইতে চাই
আমি একজন লেখক। ভালো বাংলা টাইপ করতে পারি। মাঝে মাঝে ইংরেজী কোটেশানও দিতে পারি। আমার কয়েকশো লেখা বাংলাদেশের নানান মিডিয়ায় প্রকাশিত। এবারের বইমেলায় আমার দুইখানা বই প্রকাশিত। মাঝরাতের টক শো'তে মাসিক ২/৩ বার হাজিরা থাকে। আমি একজন নিরপেক্ষ সহনশীল প্রগতিশীল ব্যক্তি। মুক্তিযুদ্ধে চেতন অচেতন জাতীয় ঐক্যে বিশ্বাসী। আগামী তিনমাস ফ্রী আছি। ভাড়া কিংবা বিক্রি হতে চাই। যে কেউ চাইলে অগ্রিম বুকিং দিতে পারেন বিশেষ গ্রীষ্মকালীন ডিসকাউন্টে। আগে আসলে আগে পাবেন ভিত্তিতে.......
*******************************************************
'কেয়ামতের দেরী নাই, সব লক্ষন পরিষ্কার, ১৪০০ বছর আগেই বলে দেয়া হয়েছিল, এই বছরই শেষ, তারপর কেয়ামত'- ছেলেবেলা থেকেই শুনে আসছিলাম। হাইস্কুলে ওঠার পর স্কুলে বসে ভাবতাম, আর যাই হোক, বাসায় ফেরার আগে যেন কেয়ামত শুরু না হয়। কিন্তু একবার কেয়ামত শুরু হলো মাঝপথে থাকতেই, প্রচন্ড ঝড় তুফানে উড়িয়ে নেয় নেয় অবস্থা। ওরকম কালো কুচকুচে মেঘ জীবনেও দেখিনি আগে। বই-খাতা-পোষাকআশাক ভিজে গেলেও নিরাপদ আশ্রয়ে গেলাম না কারন কেয়ামতের ময়দানে পাহাড় পর্বত সব তুলার মতো উড়িয়ে নিয়ে যাবে। সামান্য দালানে আশ্রয় নিয়ে কি হবে। কিন্তু কি করে যেন বাসায় পৌছে গেলাম এবং কেয়ামতও ক্ষান্ত দিল। কেয়ামত আরো অনেক দেখেছি পরে, কিন্তু ৩০ বছর আগের সেই কেয়ামতের কথাটা আজো ভুলতে পারিনা।
কেয়ামতের আরেকটি লক্ষন নাকি লোকজন ধার্মিক হয়ে যাবে। ভন্ড মাতাল পাগল সকলেই ধর্মের গীত গাইবে। চারদিকে এখন ইসলামী জোশ এবং জুশ। সরবত থেকে ব্যাংকিং সর্বক্ষেত্রে ইসলামের ছোঁয়া। বাংলাদেশে তার সোল এজেন্সী দাবী করে জামাতে ইসলামী। একটা ভ্রুন প্রস্ফুটিত হবার পর থেকে দাড়ি গজানোর সময় পর্যন্ত এরা সেবা যত্ন দিয়ে ধর্মের পাল্লা ভারী করার মানসে হাসপাতাল স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে এনজিও ব্যাংক ইন্সুরেন্স পর্যন্ত প্রতিষ্ঠা করে রেখেছে। মওদুদীর ইসলামকে মানুষের মগজে ঢুকিয়ে সেটাকেই ধর্ম হিসেবে চালাতে চেয়েছে।
কিন্তু একাত্তর তাদেরকে ছাড়েনি বলে সফলতা আসেনি। জামাতের যতটা ধার্মিক সুনাম, তারচেয়ে অনেক বেশী রাজাকার দুর্নাম। যদিও ক্যাডার পুষেছে হাজার হাজার, মানুষের মনে ঢুকতে পারেনি আদিপাপে। তাই আদিপাপ সারাতে নতুন পথে নেমেছে জামাত। সেলিব্রেটি লেখকের অভাবে তাদের পত্রিকা জনপ্রিয়তা পায় না। ফুটবল ক্রিকেটে বিদেশী খেলোয়াড় হায়ার করার প্রচলন থাকলেও পত্রিকাগুলোতে ভিন্নমতের লেখক বুদ্ধিজীবি হায়ার প্রচেষ্টার জনক নয়া দিগন্ত এবং দিগন্ত টিভি। কাতারে কাতারে প্রগতিশীল চামড়া হায়ার করে গ্রহনযোগ্যতার সীমাকে উর্ধ্বগামী করছে দিনের পর দিন।
ব্রাভো প্রগতিশীল ভাড়াটে লেখকদল!!! অর্থের চেয়ে নীতি কোনকালে বড় ছিল না, কি বলেন? একসময় জামাতীরাই তো বিএনপির ঘাড়ে চড়ে ক্ষমতার মসনদে আরোহন করবেন, তখন তো তাদের ছাড়া চলবে না।। সবাইকে হাত না রাখতে পারলে এদেশে বাস করা মুশকিল। চোর পুলিশ হাকিম উকিল সকলকে সন্তুষ্ট রাখতে পারলেই নিরাপদ রাত্রিযাপন।
ওহে ভাড়াটে লেখকগন। বালবাচ্চা নিয়ে ভালো থাকুন, নিরাপদ রাত্রিযাপন করুন।
*******************************************************
'কেয়ামতের দেরী নাই, সব লক্ষন পরিষ্কার, ১৪০০ বছর আগেই বলে দেয়া হয়েছিল, এই বছরই শেষ, তারপর কেয়ামত'- ছেলেবেলা থেকেই শুনে আসছিলাম। হাইস্কুলে ওঠার পর স্কুলে বসে ভাবতাম, আর যাই হোক, বাসায় ফেরার আগে যেন কেয়ামত শুরু না হয়। কিন্তু একবার কেয়ামত শুরু হলো মাঝপথে থাকতেই, প্রচন্ড ঝড় তুফানে উড়িয়ে নেয় নেয় অবস্থা। ওরকম কালো কুচকুচে মেঘ জীবনেও দেখিনি আগে। বই-খাতা-পোষাকআশাক ভিজে গেলেও নিরাপদ আশ্রয়ে গেলাম না কারন কেয়ামতের ময়দানে পাহাড় পর্বত সব তুলার মতো উড়িয়ে নিয়ে যাবে। সামান্য দালানে আশ্রয় নিয়ে কি হবে। কিন্তু কি করে যেন বাসায় পৌছে গেলাম এবং কেয়ামতও ক্ষান্ত দিল। কেয়ামত আরো অনেক দেখেছি পরে, কিন্তু ৩০ বছর আগের সেই কেয়ামতের কথাটা আজো ভুলতে পারিনা।
কেয়ামতের আরেকটি লক্ষন নাকি লোকজন ধার্মিক হয়ে যাবে। ভন্ড মাতাল পাগল সকলেই ধর্মের গীত গাইবে। চারদিকে এখন ইসলামী জোশ এবং জুশ। সরবত থেকে ব্যাংকিং সর্বক্ষেত্রে ইসলামের ছোঁয়া। বাংলাদেশে তার সোল এজেন্সী দাবী করে জামাতে ইসলামী। একটা ভ্রুন প্রস্ফুটিত হবার পর থেকে দাড়ি গজানোর সময় পর্যন্ত এরা সেবা যত্ন দিয়ে ধর্মের পাল্লা ভারী করার মানসে হাসপাতাল স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে এনজিও ব্যাংক ইন্সুরেন্স পর্যন্ত প্রতিষ্ঠা করে রেখেছে। মওদুদীর ইসলামকে মানুষের মগজে ঢুকিয়ে সেটাকেই ধর্ম হিসেবে চালাতে চেয়েছে।
কিন্তু একাত্তর তাদেরকে ছাড়েনি বলে সফলতা আসেনি। জামাতের যতটা ধার্মিক সুনাম, তারচেয়ে অনেক বেশী রাজাকার দুর্নাম। যদিও ক্যাডার পুষেছে হাজার হাজার, মানুষের মনে ঢুকতে পারেনি আদিপাপে। তাই আদিপাপ সারাতে নতুন পথে নেমেছে জামাত। সেলিব্রেটি লেখকের অভাবে তাদের পত্রিকা জনপ্রিয়তা পায় না। ফুটবল ক্রিকেটে বিদেশী খেলোয়াড় হায়ার করার প্রচলন থাকলেও পত্রিকাগুলোতে ভিন্নমতের লেখক বুদ্ধিজীবি হায়ার প্রচেষ্টার জনক নয়া দিগন্ত এবং দিগন্ত টিভি। কাতারে কাতারে প্রগতিশীল চামড়া হায়ার করে গ্রহনযোগ্যতার সীমাকে উর্ধ্বগামী করছে দিনের পর দিন।
ব্রাভো প্রগতিশীল ভাড়াটে লেখকদল!!! অর্থের চেয়ে নীতি কোনকালে বড় ছিল না, কি বলেন? একসময় জামাতীরাই তো বিএনপির ঘাড়ে চড়ে ক্ষমতার মসনদে আরোহন করবেন, তখন তো তাদের ছাড়া চলবে না।। সবাইকে হাত না রাখতে পারলে এদেশে বাস করা মুশকিল। চোর পুলিশ হাকিম উকিল সকলকে সন্তুষ্ট রাখতে পারলেই নিরাপদ রাত্রিযাপন।
ওহে ভাড়াটে লেখকগন। বালবাচ্চা নিয়ে ভালো থাকুন, নিরাপদ রাত্রিযাপন করুন।
অতিপ্রিয় অশুদ্ধ উচ্চারনগুলো
কন্যাকে স্কুলে পাঠানোর উপযোগী করতে আমার স্ত্রী বছরখানেক ধরে গলদঘর্ম হচ্ছে 'অ আ ই' '১ ২ ৩' কিংবা 'A B C' ইত্যাদি শেখাতে। বিদ্যাশিক্ষার ব্যাপারে আমার অপটুতা ও অমনোযোগিতার কারনে আমার উপর বিস্তর অভিযোগ তার। কারন আমি বাসায় ফেরামাত্র কন্যার অনুসন্ধিৎসু চোখটা বই-খাতা-পেন্সিল ছেড়ে আমার হাতের মুঠোয়-পকেটে-ব্যাগে লুকানো কিছু আছে কিনা সেদিকেই ঘুরতে থাকে। প্রতিদিন কলিংবেল বাজা মাত্র ভেতর থেকে প্রথম যে তীব্র ধ্বনিটা শোনা যাবে সেটা হলো 'বাবা এসেছেএএএএএএএ' এবং প্রবেশমাত্র দ্বিতীয় বাক্যটা হবে, 'আমা-জন্ন কী এনেছো?'
তুচ্ছ কিছু হলেও আনবো ওর সেই বিশ্বাসটা এত গভীর যে কখনো কিছু আনতে ভুলে গেলেও সে আঁতিপাঁতি করে সবগুলো পকেট তল্লাশী করে কিছু না পেয়ে একটা গোল পয়সাও যদি খুঁজে পায় বলবে, 'বাবা এটা এনেছো আমার জন্ন'? আমি মিথ্যে হলেও বলি, 'হ্যাঁ। আমার যা আছে সব তোমার।' ওর মিষ্টি অশুদ্ধ উচ্চারনে 'জন্ন' শব্দটা আমার ভীষন প্রিয়। ওটা শোনার জন্য আমি নানান বাহানা করি। কেবল এটাই নয় ওর আধো বোলের ভুল উচ্চারনগুলো এত প্রিয় হয়ে গেছে যে ওর সাথে কথা বলার সময় নিজেও ওর মতো করে বলার চেষ্টা করি।
প্রত্যেক বাচ্চার নিজস্ব কতগুলো উচ্চারন থাকে। যা সে নিজ থেকেই আবিষ্কার করে এবং বেশ কিছুদিন মেতে থাকে ওই উচ্চারনে, একসময় আমরাও অভ্যস্ত হয়ে যাই সেই উল্টাপাল্টা উচ্চারনে, ভালোবাসতে শুরু করি সেগুলো। তবে আমরা অভ্যস্ত হতে হতে বাচ্চাটা একসময় সঠিক উচ্চারন শিখে ফেলে যা এতদিন গলদঘর্ম হয়েও শেখাতে পারানি। সঠিক উচ্চারন শিখে ফেলার পর পুরোনো ভুল উচ্চারনগুলো আর পারে না এবং মজার ব্যাপার হলো তখন ভুল উচ্চারনগুলো শোনার জন্যই মন কেমন করে।
দু বছর বয়স থেকেই কন্যা আমার কিছু কিছু শব্দ উল্টো করে উচ্চারন করতো। যে কোন শব্দের মাঝের অক্ষরটাকে নিপুনভাবে শেষে নিয়ে যেতো, শেষের অক্ষরটাকে মাঝখানে আনতো। নির্দিষ্ট কিছু বস্তুর উচ্চারন সেভাবেই করতো। যেমন ওর প্রথম রং চেনা হলো - গোলাপী কিন্তু উচ্চারন করতো 'গোপালী'। আমরা ওটা শুনতে শুনতে ওর সাথে বলতে বলতে এত অভ্যস্ত হয়ে পড়ি যে দোকানে কিছু কিনতে গেলে বলে বসতাম - ভাই ওই গোপালী জামাটা দেন তো? সেরকম আরো কটি শব্দ 'পটেক(পকেট)', 'জিবালা/ জিপালী(জিলাপী)', 'কলমা(কমলা)', আরো কত হাবিজাবি শব্দ।
গুটি গুটি পায়ে বড় হচ্ছে আমার মেয়ে, শুদ্ধ হচ্ছে উচ্চারন। গোপালী না বলে এখন শুদ্ধস্বরে বলে গোলাপী। আগামী বছর থেকে স্কুলেও যাবে হয়তো। আমার খুশী হবার কথা। কিন্তু আমার কানটা তৃষ্ণার্ত হয়ে থাকে ওর আধোবোলের অশুদ্ধ উচ্চারনগুলোর জন্য। বারবার শুনতে ইচ্ছে করে সেই উচ্চারন যা প্রতিদিন দ্রুততার সাথে ভুলিয়ে দিচ্ছে ওর মা দাদী ফুপুরা। কিরকম অদ্ভুত চাওয়া মানুষের!
তুচ্ছ কিছু হলেও আনবো ওর সেই বিশ্বাসটা এত গভীর যে কখনো কিছু আনতে ভুলে গেলেও সে আঁতিপাঁতি করে সবগুলো পকেট তল্লাশী করে কিছু না পেয়ে একটা গোল পয়সাও যদি খুঁজে পায় বলবে, 'বাবা এটা এনেছো আমার জন্ন'? আমি মিথ্যে হলেও বলি, 'হ্যাঁ। আমার যা আছে সব তোমার।' ওর মিষ্টি অশুদ্ধ উচ্চারনে 'জন্ন' শব্দটা আমার ভীষন প্রিয়। ওটা শোনার জন্য আমি নানান বাহানা করি। কেবল এটাই নয় ওর আধো বোলের ভুল উচ্চারনগুলো এত প্রিয় হয়ে গেছে যে ওর সাথে কথা বলার সময় নিজেও ওর মতো করে বলার চেষ্টা করি।
প্রত্যেক বাচ্চার নিজস্ব কতগুলো উচ্চারন থাকে। যা সে নিজ থেকেই আবিষ্কার করে এবং বেশ কিছুদিন মেতে থাকে ওই উচ্চারনে, একসময় আমরাও অভ্যস্ত হয়ে যাই সেই উল্টাপাল্টা উচ্চারনে, ভালোবাসতে শুরু করি সেগুলো। তবে আমরা অভ্যস্ত হতে হতে বাচ্চাটা একসময় সঠিক উচ্চারন শিখে ফেলে যা এতদিন গলদঘর্ম হয়েও শেখাতে পারানি। সঠিক উচ্চারন শিখে ফেলার পর পুরোনো ভুল উচ্চারনগুলো আর পারে না এবং মজার ব্যাপার হলো তখন ভুল উচ্চারনগুলো শোনার জন্যই মন কেমন করে।
দু বছর বয়স থেকেই কন্যা আমার কিছু কিছু শব্দ উল্টো করে উচ্চারন করতো। যে কোন শব্দের মাঝের অক্ষরটাকে নিপুনভাবে শেষে নিয়ে যেতো, শেষের অক্ষরটাকে মাঝখানে আনতো। নির্দিষ্ট কিছু বস্তুর উচ্চারন সেভাবেই করতো। যেমন ওর প্রথম রং চেনা হলো - গোলাপী কিন্তু উচ্চারন করতো 'গোপালী'। আমরা ওটা শুনতে শুনতে ওর সাথে বলতে বলতে এত অভ্যস্ত হয়ে পড়ি যে দোকানে কিছু কিনতে গেলে বলে বসতাম - ভাই ওই গোপালী জামাটা দেন তো? সেরকম আরো কটি শব্দ 'পটেক(পকেট)', 'জিবালা/ জিপালী(জিলাপী)', 'কলমা(কমলা)', আরো কত হাবিজাবি শব্দ।
গুটি গুটি পায়ে বড় হচ্ছে আমার মেয়ে, শুদ্ধ হচ্ছে উচ্চারন। গোপালী না বলে এখন শুদ্ধস্বরে বলে গোলাপী। আগামী বছর থেকে স্কুলেও যাবে হয়তো। আমার খুশী হবার কথা। কিন্তু আমার কানটা তৃষ্ণার্ত হয়ে থাকে ওর আধোবোলের অশুদ্ধ উচ্চারনগুলোর জন্য। বারবার শুনতে ইচ্ছে করে সেই উচ্চারন যা প্রতিদিন দ্রুততার সাথে ভুলিয়ে দিচ্ছে ওর মা দাদী ফুপুরা। কিরকম অদ্ভুত চাওয়া মানুষের!
সফল অযাত্রা
-চলেন যাই। ভুটান যাই। এবার যেতেই হবে।
-হ্যাঁ যেতেই হবে। সিদ্ধান্ত যখন নিয়েছি এবার যেতেই হবে।
-আর তেড়িবেড়ি চলবে না। এক্ষুনি বেরোন।
-হ্যাঁ এক্ষুনি বেরুতে হবে। নইলে দেরী হয়ে যাবে।
-দাঁড়ান আমি জুতোটা পরে নেই।
-আচ্ছা পরেন, আমি কাগজপত্র গুছিয়ে নেই।
-আচ্ছা গোছান।
গোছানো হলে বেরিয়ে পড়লাম। আমি আর আশরাফ সাহেব। পথে সাইদুল সাহেব ফোনে বললেন তিনিও যাবেন। তাকেও নিলাম তুলে গাড়ীতে। আমরা তিনজন। সাইদুল সাহেব, আশরাফ সাহেব, আমি। ষাট, পঞ্চাশ, চল্লিশ, এই তিন বয়সের তিনজন। চরম ও পরম উৎসাহী ভ্রমন পিয়াসী। তিনজনের কমে ভ্রমন আনন্দ নেই। ভুটান যাবার স্বপ্নটা দুই বুড়োর ভেতর সঞ্চারিত করতে পেরে আমি পুলকিত। খরচ নির্ঘাত অর্ধেক কমে যাবে আমার।
পথে ঠান্ডা পানীয় কিনলাম রাস্তার পাশের দোকান থেকে। একটাই কিনতে চাইছিলাম, কিন্তু বাকী দুজন ডাক্তারের বারন ভুলে হা করে তাকিয়ে আছে। কি করি, তিনটাই কিনতে হলো। গাড়ীতে বসে ভুস ভুস করে শেষ করে ফেললাম। আশরাফ সাহেবের গাড়ীটায় চড়ে আরাম। ভুটান যেতে গাড়ীটা তেঁতুলিয়া সীমান্ত পর্যন্ত যাতে যায় সে ব্যবস্থা নিতে হবে। আরামের যাত্রা হোক। সবকিছু ঠিক ঠাক। যাত্রার শুরুটা ভালো হলে সব ঠিক।
গন্তব্যে গিয়ে দেখি বিশাল লাইন। রোদে পুড়ছে লাইন। লাইনে দাঁড়ানো শিশু বৃদ্ধ যুবক নারী এমনকি অসুস্থ মানুষও। লাইনে দাঁড়াতেই হবে। একেকজনের ডাক আসছে, ফিরে আসছে অনেক পর। আমাদের লাইন রাস্তার উপর চলে এসেছে। রোদের নীচে। তবু ভুটান যাবার স্বপ্নের ছাতাটা মাথার উপরে গনগনে সূর্যের উত্তাপটা উপেক্ষা করলো। হিমালয় মাথায় নিয়ে আমরা লাইনে দাড়াই। আরেকটু সময়। ক্লিয়ারেন্সটা পেলেই হবে। আহ্। ভ্রমন কি তৃপ্তিদায়ক ব্যাপার!
সাইদুল সাহেব একটু অধৈর্য মানুষ। একঘন্টায় লাইন দুই গজও এগোয়নি। কি করছে লোকজন ভেতরে। একটা কাগজ দেখতে এত সময় নিলে কেমনে কী। ভুটান পৌঁছাতে তো রাত বারোটা পেরিয়ে যাবে।
যাবো ভুটান কিন্তু পেরোতে হবে ভারত। ভারতে ঢুকে আবার ভারত পেরোতে হবে। হ্যাপা কম না তাই। ভারতের কাছে জবাবদিহি করতে করতে কাহিল সবাই। কেনু ভুটান যাবে, কেনু কেনু কেনু? ভারতে কী ওই সৌন্দর্যের কমতি আছে? ছাড়ো ডলার কিছু ভারতে ছড়ায়ে যাও। এই কারবার।
সূর্যের তাপের সাথে পাল্লা দিয়ে হতাশা বাড়তে থাকে। পাকস্থলীতে কোল্ডডিংক্সগুলো গড়বড় শুরু করেছে খালি জায়গা পেয়ে। সাঈদুল সাহেব হার্টের রোগী। মাথার টেপমার খারাপ হয়ে যাচ্ছে। আশরাফ সাহেব উৎসাহী মানুষ। মালয়েশিয়া ব্যাংককে হরদম যাতয়াত থাকলেও দরিদ্র ভুটান যাবার কথা ভাবেনি কখনো। আমার কাছ থেকে অভিনব ভ্রমনের প্রস্তাব পেয়ে উৎসাহী হয়েছিলেন। দেখা গেল বেলা বাড়ার পর থেকে আমাদের দুজনের হতাশার মিটারের উর্ধ্বগতি তার মধ্যেও সঞ্চারিত হচ্ছে।
লাইনে দাঁড়ানোর অনভ্যাসে তিনজনের মাথাই দুঘন্টার মধ্যে নড়বড় হয়ে গেল। অধৈর্যের মিটারটা যখন চরম শিখরে সাইদুল সাহেব তখন উঁকি দিলেন কাউন্টারের ভেতরে। দরজাটা ভেজানো ছিল বলে মৃদু ঠেলা দিয়ে রাগ চেপে মাখন গলায় ভেতরের কেরানীকে জিজ্ঞেস করে, "দাদা আর কতক্ষন লাগপে?"
কিন্তু জবাবে ভেতর থেকে যে হুংকার আসে তা ছিল অপ্রত্যাশিত। সবাই চমকে উঠে। আমরা ভয় পেয়ে যাই -"গেট আউট" শব্দটা শুনে। আমি সাইদুল সাহেবের রগ চিনি। বুড়ো মারাত্মক ক্ষ্যাপাটে। সহজে সহজ, কঠিনে কঠিন। জীবনে কারো কাছ থেকে এই শব্দটা শোনেনি। পাল্টা আক্রমন হবে নিশ্চিত।
সাইদুল সাহেব দুই সেকেন্ডেরও কম সময়ে তার মোলায়েম কন্ঠকে 'তোর গেট আউটের গুষ্টি কিলাই ইউ বাস্টার্ড'-এ রূপান্তর করে ভেতরে ঢুকে যে ভাষায় পাল্টা হুংকার শুরু করলো, তা মাথার উপরে ছাদ না থাকলে আকাশের জমাট মেঘের সাথে ধাক্কা খেয়ে বজ্রবৃষ্টির তুফান সৃষ্টি করতো খুলশীর পাহাড়ে। যেমন মাল্টি ল্যাংগুয়েজ তেমনি স্পীকারের ভোল্টেজ। আমরা কানে আঙ্গুল দিলাম আর লাইনে দাঁড়ানো লোকজন ডিনামাইট ফাটার প্রতিক্রিয়ায় ছুটোছুটি শুরু করেছে যেন হাইড্রোজেন বোমা মারা হয়েছে। প্রধান ফটক বন্ধ করা হলো দ্রুত।
কিছুক্ষন পর সাঈদুল সাহেবকে পুলিশের দুজন সেপাই দুই বগলে আলগে ধরে 'আয় ব্যাটা আজ তোরে মজা দেখাই', বলে গেটের বাইরে নিয়ে যেতে দেখে আশরাফ সাহেব আর আমি বোবা এবং অন্যমনস্ক হয়ে গেলাম তড়িৎ। এখন আমাদের চিত্ত চঞ্চল হলেই ধরা পড়ার সম্ভাবনা। নিশ্চিত বুঝলাম গ্রেফতার করা হলো সাঈদুল সাহেবকে। তাতে আমাদের করার কিছু নাই। বাঘে ছুঁলে আঠারো ঘা, পুলিশে ছুলে ছত্রিশ ঘা। এখন আমাদের উত্তম কর্তব্য হলো নিরাপদ জায়গায় গিয়ে সাঈদুল সাহেবকে রক্ষা করার চেষ্টা করা। নিজে বাঁচো অন্যকে বাঁচাও। লিভ এন্ড লেট লিভ।
তাছাড়া এই মুহুর্তে সাঈদুল সাহেবকে বাংলাদেশ সরকারের আতিথ্যে না পাঠালে অন্যায় হবে, কারন হুংকারটা উনিই দিয়েছিলেন। কিন্তু মুশকিল হলো পুলিশ যে কোন গ্রেফতারের পর সঙ্গীসাথীর খোঁজ করে। যেন দলবদ্ধভাবেই পরিকল্পনা ছাড়া এদেশে কোন কাজ হয় না। সেক্ষেত্রে আমাদেরও রাজ অতিথি হবার হুমকি থেকে যায়।
সুতরাং আমরা 'তার সাথের লোক না' মনোভাব নিয়ে সটকে গেলাম দুতাবাসের ভেতর থেকে। কিন্তু গাড়ীর কাছে গিয়ে পৌঁছাতে না পৌঁছাতেই পেছন দিয়ে সাঈদুল সাহেবের গলা শুনে রাস্তার আলকাতরায় পা আটকে গেল আমাদের-
-কই যান?
-যাই না তো
-গাড়ীতে কেন?
-আপনার সাথে যাবার জন্য
-আমি কোথায় যাই
-পুলিশের সাথে
-পুলিশ কোথায় নেবে
-থানায় বা হাজতে
-আপনারা কোথায় যাবেন
-আপনার সাথে সাথে
-সাথে কই? গাড়ীতে উঠছেন যেন
-উঠছি না, আপনাকে এগিয়ে দিতে যাচ্ছি
-আমাকে এগিয়ে দিতে হবে না, আমিই আপনাদের এগিয়ে নিয়ে যেতে আসছি। আসেন, আমার সাথেই যাবেন। পুলিশ ডাকে আপনাদেরকেও
-আমাদেরও? (দুজন একসাথে কঁকিয়ে উঠলাম)
বুড়ো সাঈদুল সাহেব ফাঁসিয়ে দিল আমাদের। ভুটান না গিয়ে সেবার গেলাম হাজতে। ভারতীয় দুতাবাসের কাগজপত্র তছনছ করে মূল্যবান দলিলপত্র লুট করার গভীর ষড়যন্ত্রের অপরাধে তিন বছর তিন মাসের জেল হয়ে গেল তিন জনের।
-হ্যাঁ যেতেই হবে। সিদ্ধান্ত যখন নিয়েছি এবার যেতেই হবে।
-আর তেড়িবেড়ি চলবে না। এক্ষুনি বেরোন।
-হ্যাঁ এক্ষুনি বেরুতে হবে। নইলে দেরী হয়ে যাবে।
-দাঁড়ান আমি জুতোটা পরে নেই।
-আচ্ছা পরেন, আমি কাগজপত্র গুছিয়ে নেই।
-আচ্ছা গোছান।
গোছানো হলে বেরিয়ে পড়লাম। আমি আর আশরাফ সাহেব। পথে সাইদুল সাহেব ফোনে বললেন তিনিও যাবেন। তাকেও নিলাম তুলে গাড়ীতে। আমরা তিনজন। সাইদুল সাহেব, আশরাফ সাহেব, আমি। ষাট, পঞ্চাশ, চল্লিশ, এই তিন বয়সের তিনজন। চরম ও পরম উৎসাহী ভ্রমন পিয়াসী। তিনজনের কমে ভ্রমন আনন্দ নেই। ভুটান যাবার স্বপ্নটা দুই বুড়োর ভেতর সঞ্চারিত করতে পেরে আমি পুলকিত। খরচ নির্ঘাত অর্ধেক কমে যাবে আমার।
পথে ঠান্ডা পানীয় কিনলাম রাস্তার পাশের দোকান থেকে। একটাই কিনতে চাইছিলাম, কিন্তু বাকী দুজন ডাক্তারের বারন ভুলে হা করে তাকিয়ে আছে। কি করি, তিনটাই কিনতে হলো। গাড়ীতে বসে ভুস ভুস করে শেষ করে ফেললাম। আশরাফ সাহেবের গাড়ীটায় চড়ে আরাম। ভুটান যেতে গাড়ীটা তেঁতুলিয়া সীমান্ত পর্যন্ত যাতে যায় সে ব্যবস্থা নিতে হবে। আরামের যাত্রা হোক। সবকিছু ঠিক ঠাক। যাত্রার শুরুটা ভালো হলে সব ঠিক।
গন্তব্যে গিয়ে দেখি বিশাল লাইন। রোদে পুড়ছে লাইন। লাইনে দাঁড়ানো শিশু বৃদ্ধ যুবক নারী এমনকি অসুস্থ মানুষও। লাইনে দাঁড়াতেই হবে। একেকজনের ডাক আসছে, ফিরে আসছে অনেক পর। আমাদের লাইন রাস্তার উপর চলে এসেছে। রোদের নীচে। তবু ভুটান যাবার স্বপ্নের ছাতাটা মাথার উপরে গনগনে সূর্যের উত্তাপটা উপেক্ষা করলো। হিমালয় মাথায় নিয়ে আমরা লাইনে দাড়াই। আরেকটু সময়। ক্লিয়ারেন্সটা পেলেই হবে। আহ্। ভ্রমন কি তৃপ্তিদায়ক ব্যাপার!
সাইদুল সাহেব একটু অধৈর্য মানুষ। একঘন্টায় লাইন দুই গজও এগোয়নি। কি করছে লোকজন ভেতরে। একটা কাগজ দেখতে এত সময় নিলে কেমনে কী। ভুটান পৌঁছাতে তো রাত বারোটা পেরিয়ে যাবে।
যাবো ভুটান কিন্তু পেরোতে হবে ভারত। ভারতে ঢুকে আবার ভারত পেরোতে হবে। হ্যাপা কম না তাই। ভারতের কাছে জবাবদিহি করতে করতে কাহিল সবাই। কেনু ভুটান যাবে, কেনু কেনু কেনু? ভারতে কী ওই সৌন্দর্যের কমতি আছে? ছাড়ো ডলার কিছু ভারতে ছড়ায়ে যাও। এই কারবার।
সূর্যের তাপের সাথে পাল্লা দিয়ে হতাশা বাড়তে থাকে। পাকস্থলীতে কোল্ডডিংক্সগুলো গড়বড় শুরু করেছে খালি জায়গা পেয়ে। সাঈদুল সাহেব হার্টের রোগী। মাথার টেপমার খারাপ হয়ে যাচ্ছে। আশরাফ সাহেব উৎসাহী মানুষ। মালয়েশিয়া ব্যাংককে হরদম যাতয়াত থাকলেও দরিদ্র ভুটান যাবার কথা ভাবেনি কখনো। আমার কাছ থেকে অভিনব ভ্রমনের প্রস্তাব পেয়ে উৎসাহী হয়েছিলেন। দেখা গেল বেলা বাড়ার পর থেকে আমাদের দুজনের হতাশার মিটারের উর্ধ্বগতি তার মধ্যেও সঞ্চারিত হচ্ছে।
লাইনে দাঁড়ানোর অনভ্যাসে তিনজনের মাথাই দুঘন্টার মধ্যে নড়বড় হয়ে গেল। অধৈর্যের মিটারটা যখন চরম শিখরে সাইদুল সাহেব তখন উঁকি দিলেন কাউন্টারের ভেতরে। দরজাটা ভেজানো ছিল বলে মৃদু ঠেলা দিয়ে রাগ চেপে মাখন গলায় ভেতরের কেরানীকে জিজ্ঞেস করে, "দাদা আর কতক্ষন লাগপে?"
কিন্তু জবাবে ভেতর থেকে যে হুংকার আসে তা ছিল অপ্রত্যাশিত। সবাই চমকে উঠে। আমরা ভয় পেয়ে যাই -"গেট আউট" শব্দটা শুনে। আমি সাইদুল সাহেবের রগ চিনি। বুড়ো মারাত্মক ক্ষ্যাপাটে। সহজে সহজ, কঠিনে কঠিন। জীবনে কারো কাছ থেকে এই শব্দটা শোনেনি। পাল্টা আক্রমন হবে নিশ্চিত।
সাইদুল সাহেব দুই সেকেন্ডেরও কম সময়ে তার মোলায়েম কন্ঠকে 'তোর গেট আউটের গুষ্টি কিলাই ইউ বাস্টার্ড'-এ রূপান্তর করে ভেতরে ঢুকে যে ভাষায় পাল্টা হুংকার শুরু করলো, তা মাথার উপরে ছাদ না থাকলে আকাশের জমাট মেঘের সাথে ধাক্কা খেয়ে বজ্রবৃষ্টির তুফান সৃষ্টি করতো খুলশীর পাহাড়ে। যেমন মাল্টি ল্যাংগুয়েজ তেমনি স্পীকারের ভোল্টেজ। আমরা কানে আঙ্গুল দিলাম আর লাইনে দাঁড়ানো লোকজন ডিনামাইট ফাটার প্রতিক্রিয়ায় ছুটোছুটি শুরু করেছে যেন হাইড্রোজেন বোমা মারা হয়েছে। প্রধান ফটক বন্ধ করা হলো দ্রুত।
কিছুক্ষন পর সাঈদুল সাহেবকে পুলিশের দুজন সেপাই দুই বগলে আলগে ধরে 'আয় ব্যাটা আজ তোরে মজা দেখাই', বলে গেটের বাইরে নিয়ে যেতে দেখে আশরাফ সাহেব আর আমি বোবা এবং অন্যমনস্ক হয়ে গেলাম তড়িৎ। এখন আমাদের চিত্ত চঞ্চল হলেই ধরা পড়ার সম্ভাবনা। নিশ্চিত বুঝলাম গ্রেফতার করা হলো সাঈদুল সাহেবকে। তাতে আমাদের করার কিছু নাই। বাঘে ছুঁলে আঠারো ঘা, পুলিশে ছুলে ছত্রিশ ঘা। এখন আমাদের উত্তম কর্তব্য হলো নিরাপদ জায়গায় গিয়ে সাঈদুল সাহেবকে রক্ষা করার চেষ্টা করা। নিজে বাঁচো অন্যকে বাঁচাও। লিভ এন্ড লেট লিভ।
তাছাড়া এই মুহুর্তে সাঈদুল সাহেবকে বাংলাদেশ সরকারের আতিথ্যে না পাঠালে অন্যায় হবে, কারন হুংকারটা উনিই দিয়েছিলেন। কিন্তু মুশকিল হলো পুলিশ যে কোন গ্রেফতারের পর সঙ্গীসাথীর খোঁজ করে। যেন দলবদ্ধভাবেই পরিকল্পনা ছাড়া এদেশে কোন কাজ হয় না। সেক্ষেত্রে আমাদেরও রাজ অতিথি হবার হুমকি থেকে যায়।
সুতরাং আমরা 'তার সাথের লোক না' মনোভাব নিয়ে সটকে গেলাম দুতাবাসের ভেতর থেকে। কিন্তু গাড়ীর কাছে গিয়ে পৌঁছাতে না পৌঁছাতেই পেছন দিয়ে সাঈদুল সাহেবের গলা শুনে রাস্তার আলকাতরায় পা আটকে গেল আমাদের-
-কই যান?
-যাই না তো
-গাড়ীতে কেন?
-আপনার সাথে যাবার জন্য
-আমি কোথায় যাই
-পুলিশের সাথে
-পুলিশ কোথায় নেবে
-থানায় বা হাজতে
-আপনারা কোথায় যাবেন
-আপনার সাথে সাথে
-সাথে কই? গাড়ীতে উঠছেন যেন
-উঠছি না, আপনাকে এগিয়ে দিতে যাচ্ছি
-আমাকে এগিয়ে দিতে হবে না, আমিই আপনাদের এগিয়ে নিয়ে যেতে আসছি। আসেন, আমার সাথেই যাবেন। পুলিশ ডাকে আপনাদেরকেও
-আমাদেরও? (দুজন একসাথে কঁকিয়ে উঠলাম)
বুড়ো সাঈদুল সাহেব ফাঁসিয়ে দিল আমাদের। ভুটান না গিয়ে সেবার গেলাম হাজতে। ভারতীয় দুতাবাসের কাগজপত্র তছনছ করে মূল্যবান দলিলপত্র লুট করার গভীর ষড়যন্ত্রের অপরাধে তিন বছর তিন মাসের জেল হয়ে গেল তিন জনের।
যে গল্পটি লেখার কোন মানে হয় না
এ এক না হওয়া ভ্রমনের গল্প।
সে একই গল্প বারবার বলে। সেও একই গল্প বারবার শোনে। সে একই ঝগড়া বারবার করে, সেও একই তর্কে লিপ্ত হয় বারবার। পুরোনো গল্পগুলিই ফিরে আসে বারবার। উল্টে পাল্টে একই গল্পকে নানান ভঙ্গীতে বলে। চর্বিত চর্বন যেন। তবু এই চর্বনে অসীম তৃপ্তি। কারন গল্পগুলো কখনো পুরোনো হয় না। যতবার শোনে ততবার মনে হয় নতুন একটি গল্প। সেই গল্পটা যাতে মানুষ কেবল দুজন। সেই চিরচেনা প্লট। আদি সময় থেকে যা হয়ে এসেছে। তার সাথে একশো কিংবা এক হাজার বছর আগে দেখা হলেও একই ঘটনা ঘটতো হয়তো।
আজ সোমবার। বহুচর্বিত গল্পটি আবারো সে বলে, ও শোনে। শনিবারও এই গল্পটা বলেছে, বিষুদবারেও বলেছে। প্রতিবারই মনে হয়েছে গল্পটা নতুন। এখনো মনে হচ্ছে প্রথম শুনলো গল্পটি। বিভ্রান্তিময় কথোপকথনটা শোনা যাক এবার।
*******************************************************
কিছু মানুষের সাথে দেখা হয়ে যায় প্রতীক্ষা ছাড়াই। ওর জন্য তার কোন প্রতীক্ষা ছিল না। ওর আসার কোন কথা ছিল না। ও উঠে পড়েছিল অন্য একটা ট্রেনে। সেই ট্রেনটি তার ষ্টেশানে থামার কথা ছিল না। তবু একটা অনির্ধারিত সিগন্যালে ট্রেনটা আটকে গেলে তার সাথে চোখাচোখি হয়। সে প্ল্যাটফর্মের এক পাশে দাড়িয়ে আছে নিঃসঙ্গ। তার দাঁড়িয়ে থাকাটা ঠিক কোথাও যাবার জন্য না। আবার কারো জন্য প্রতীক্ষাও ঠিক না। সে দাড়িয়ে আছে নিঃসঙ্গ। ও যখন জানালা দিয়ে দেখলো, তখনো জানতো না সে কেন দাঁড়িয়ে আছে। ভেবেছে দাঁড়ানোর উদ্দেশ্য কোন একটা ট্রেনে চড়া। কিংবা কাউকে স্বাগত জানানো। কিন্তু তার তাকানোর ভঙ্গীতে কাউকে স্বাগত জানাবার কোন লক্ষন নেই। সে কাউকে খুঁজছে না। দৃষ্টি তার নির্মোহ স্বচ্ছ। তার নিটোল দৃষ্টি দেখে কিছু বোঝার উপায় নেই।
তবু জানালা দিয়ে তার সাথে চোখাচোখি হয়ে গেলে একটা চেনা হাসি দেখা দেবে প্ল্যাটফর্মে দাঁড়ানো মেয়েটির চোখে। লোকটা অবাক হবে অচেনা মেয়ের মুখে চেনা হাসি দেখে। ট্রেনটা ওখানে দাঁড়াবার কথা ছিল না। লোকটার ওই ষ্টেশানে নামার দরকার ছিল না। কিন্তু ওই হাসিতে কি ছিল। লোকটা দুম করে নেমে পড়লো ষ্টেশানে। অনির্ধারিত যাত্রাবিরতি যেন। কেন নামলো? মেয়েটা তো ডাকেনি তাকে। কেবল একটু হেসেছে। সেই হাসির কারন জানে না সে, তবু সে মুগ্ধ হয়ে নেমে পড়েছে। মেয়েটা কি ভাবছে ছেলেটা জানে না। এমনকি সে আদৌ জানে না ঐ হাসিটা তার উদ্দেশ্যে ছিল কিনা। নাকি শ্রেফ আনমনা একটা হাসি ছিল। তবু হাসিটা তার কোথাও লেগেছে, বেজেছে কোনখানে।
ওই হাসিটা দেড়যুগ আগে আরো একজন হেসেছিল। কেন হেসেছিল তা জানতে চেয়ে বিব্রত হয়েছিল তখন সে। কারন আগের সেই মেয়েটি অস্বীকার করেছিল হাসিটা। বলেছিল ওই হাসিটা তাকে উদ্দেশ্য করে হাসেনি। হাসি এসেছিল তাই হেসেছে। অন্য কোন অর্থ নেই। বিভ্রান্ত হয়ে ফিরে এসেছিল যুবক। ভুল দরোজায় নক করেছিল। আজো সেরকম উদ্দেশ্যহীন হাসি। অনেক বছর পেরিয়ে গেলেও সেই পুরোনো শূন্যতাটা তাকে উদাস করলো হঠাৎ। তাই তাকে নামতেই হলো অনির্ধারিত গন্তব্যে। জানতেই হবে কেন তার দিকে চেয়ে হাসলো ওই তরুনী।
তরুনীর বুকে তখন খাঁ খাঁ শূন্যতা। কোথাও হাহাকার করছে এক হারানোর বেদনা। তার কোথাও যাবার ছিল, কিন্তু তার ট্রেনটা আসেনি, কিংবা ট্রেনটি তার যাত্রা বাতিল করেছে অথবা সেই ট্রেনের পথসঙ্গী অন্য কোথাও নেমে গেছে। সব মিলিয়ে বিষাদক্লিষ্ট তরুনী। কিন্তু এই ট্রেনটি থামতেই এত মানুষের মধ্যে এই মুখটা দেখে তার খুব মায়া হলো। এই ট্রেনটি এখানে থামার কথা না। তবু থেমে গেছে কোন কারনে। যেখানে সে দাঁড়িয়েছে সেখানে ট্রেনটার ওই জানালার খোপটিতে সেই অদ্ভুত মানুষটাকে দেখলো। শ্রদ্ধাবোধ জাগলো, ভরসা দেখলো চোখটাতে, কোন ফাঁকে একটা মায়াবী হাসি বেরিয়ে গেল তার নিজের অজান্তেই। কেন এত আপন মনে হলো অচেনা মানুষটাকে?
কাজটি ঠিক হলো কিনা বুঝলো না। কিন্তু লোকটাও আজব। হুট নেমে পড়ছে ট্রেন থেকে। তবুও তরুনী অবাক হলো না, ভয় পেলো না লোকটার আগমনে। কী যেন আছে, কেমন অদ্ভুত এক নির্ভরতার সন্ধান করল মানুষটার ভেতর। এই নির্জন ষ্টেশানে অচেনা মানুষকে কতটা ভরসা করা যায়। কিন্তু মানুষটা কাছে আসা মাত্র সে কথা বলতে শুরু করলো যেন অনেক দিনের চেনা। ভুলে গেল মাত্র এখুনি ট্রেন থেকে নেমেছে লোকটি। পরিচয় উদ্দেশ্য কোন কিছু না জেনেই ওরা কথার বৃষ্টি ঝরায়। অঝোর ধারার কথাবৃষ্টি চলে। এত বৃষ্টি কেউ কখনো দেখেনি।
কথায় কথায় লোকটার জানা হয়ে যায় তরুনীর কাহিনী। একেকটা পর্ব তার ভীষন বিস্ময়কর। কিন্তু বিস্মিত হবার বদলে অশ্রুসিক্ত হয় লোকটা। এই প্রথম কোন এক নারী তার চোখে জল এনেছে। লোকটি তার নিজের কাহিনীও ব্যক্ত করে। তরুনী তার কাহিনী শুনেও বেদনার্ত সহমর্মী হয়। দুজনে প্রবল উৎসাহে কথাবিনিময় করতে থাকে যেন ট্রেনটা ছেড়ে দেবার আগেই সবকিছু বলা হয়ে যায়। তবে তরুনী মাঝে মাঝেই আনমনা হয়ে যায় তার না আসা ট্রেনটার জন্য, গন্তব্যের জন্য।
তরুনীর ইচ্ছে হয় লোকটাকে বলে, 'নেমে পড়ো এই ষ্টেশানে। আমাদের গল্প অনেক বাকী আরো।' লোকটার ইচ্ছে হয় বলে, 'উঠে পড়ো আমার ট্রেনে, এখনো অনেক গল্প বাকী। যেতে যেতে বলি।' কিন্তু দুজনেই জানে ট্রেনে আর কোন আসন খালি নেই। তাই মুখফুটে বলা হয় না কিছু।
গল্প করা ছাড়া ওদের আর কোন কাজ নেই। কেবল গল্প, কেবল কথা। এত কথা। তবু শেষ হয় না কথা। আনমনা মেয়েটা ভাবে, এরকম কথা তো আগেও বলেছি ওর সাথে, যে নেমে গেছে অন্য ষ্টেশানে। একে বিশ্বাস করি কি করে, এও তো চলে যাবে একটু পরেই। হতাশায় কেঁদে ফেলে মেয়েটি। ঝগড়া করে লোকটার সাথে। লোকটাও অবুঝ, তরুনীর আনমনা মুখ দেখে কখনো কখনো কষ্ট পায়, হাত ছেড়ে উঠে যেতে চায় ট্রেনে। কিন্তু আবার তরুনীর চোখে ফিরে তাকিয়ে খুঁজে পায় আশ্রয়, সেই আশ্রয়কে হাতছাড়া করতে পারে না সে। আবারো হাত ধরে এসে তরুনীর। লোকটার এই 'ফিরে আসা' ভীষন ভরসা দেয় তরুনীকে। এই 'ফিরে আসা'য় ভালোবাসার আভাস পায় সে। ভালোবাসার জন্যই তো তার সকল কান্না। যদিও সে লোকটার ভালোবাসা চায় না, সে চায় তার 'না আসা' ট্রেনের ভালোবাসা। তবু ইচ্ছে করে এর হাত ধরে কিছু সময় বসে থাকি। শান্তি খুঁজি।
এইখানে এসে একটা দ্বিধাদ্বন্দ ভুলবোঝাবুঝি বিভ্রান্তির সময় কাটে। মানুষটা ভুল ষ্টেশানে নেমে পড়লেও তার প্রতি মায়াজালে আবদ্ধ হয় তরুনী অজ্ঞাত কারনে। সেই মায়াকে কৃতজ্ঞতা হিসেবে নিয়েও কোন এক মুহুর্তে ভালোবাসা ভেবে ভুল করে লোকটা। ভাবে তরুনীটি বুঝি তার প্রতি দুর্বল। তরুনী অনুমান করে লোকটার মনোভাব। বুঝেও স্পষ্ট নিষেধ করতে পারে না। কারন লোকটা তার নিঃসঙ্গ সময়ে সঙ্গ দিয়েছে, বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়েছে, ভরসা দিয়েছে।
লোকটার প্রতি তার অনেক কৃতজ্ঞতা। লোকটাকে বিমুখ করে বলতে ইচ্ছে হয় না "ভাই, আপনার প্রতি আমার প্রচুর কৃতজ্ঞতা। কিন্তু আপনাকে ভালোবাসা সম্ভব নয় আমার। আপনার গন্তব্য আলাদা, আপনার বাহন আলাদা, আমি আপনার সাথে যাচ্ছি না, আপনি আমার সাথে থাকছেন না। সুতরাং ভুলে যান সব কিছু"
কিন্তু লোকটাকে তার কিছুই বলা হয় না। কারন তার ভেতরেও "কোন এক বোধ কাজ করে। স্বপ্ন নয়, প্রেম নয়, আরো এক বিপন্ন বিস্ময়........"
গল্পটা এখানে শেষ হবে না। কারন লোকটা ট্রেনে উঠে বসলেও তার মন পড়ে থাকবে এই ষ্টেশানে। গন্তব্যে নেমে হাঁটতে হাঁটতেও ভাবতে থাকবে এই ষ্টেশানের কথা। এই তরুনীর কথা। যে ভ্রমনের স্বপ্ন সে দেখেছে সেই স্বপ্নটা জাগিয়ে রেখে লোকটা এক অনন্ত পথে হাঁটতে থাকবে। হাঁটতে হাঁটতে.........প্রবল জনারণ্যেও তার হৃদয় তৃষ্ণার্ত হয়ে থাকবে না হওয়া এক ভ্রমনের জন্য।
অতঃপর সে নিজের জন্য একটা শান্ত্বনার সমীকরন দাঁড় করাবে- কোন মানুষের জীবনেই সফল ভ্রমনের গল্প নেই।
সে একই গল্প বারবার বলে। সেও একই গল্প বারবার শোনে। সে একই ঝগড়া বারবার করে, সেও একই তর্কে লিপ্ত হয় বারবার। পুরোনো গল্পগুলিই ফিরে আসে বারবার। উল্টে পাল্টে একই গল্পকে নানান ভঙ্গীতে বলে। চর্বিত চর্বন যেন। তবু এই চর্বনে অসীম তৃপ্তি। কারন গল্পগুলো কখনো পুরোনো হয় না। যতবার শোনে ততবার মনে হয় নতুন একটি গল্প। সেই গল্পটা যাতে মানুষ কেবল দুজন। সেই চিরচেনা প্লট। আদি সময় থেকে যা হয়ে এসেছে। তার সাথে একশো কিংবা এক হাজার বছর আগে দেখা হলেও একই ঘটনা ঘটতো হয়তো।
আজ সোমবার। বহুচর্বিত গল্পটি আবারো সে বলে, ও শোনে। শনিবারও এই গল্পটা বলেছে, বিষুদবারেও বলেছে। প্রতিবারই মনে হয়েছে গল্পটা নতুন। এখনো মনে হচ্ছে প্রথম শুনলো গল্পটি। বিভ্রান্তিময় কথোপকথনটা শোনা যাক এবার।
*******************************************************
কিছু মানুষের সাথে দেখা হয়ে যায় প্রতীক্ষা ছাড়াই। ওর জন্য তার কোন প্রতীক্ষা ছিল না। ওর আসার কোন কথা ছিল না। ও উঠে পড়েছিল অন্য একটা ট্রেনে। সেই ট্রেনটি তার ষ্টেশানে থামার কথা ছিল না। তবু একটা অনির্ধারিত সিগন্যালে ট্রেনটা আটকে গেলে তার সাথে চোখাচোখি হয়। সে প্ল্যাটফর্মের এক পাশে দাড়িয়ে আছে নিঃসঙ্গ। তার দাঁড়িয়ে থাকাটা ঠিক কোথাও যাবার জন্য না। আবার কারো জন্য প্রতীক্ষাও ঠিক না। সে দাড়িয়ে আছে নিঃসঙ্গ। ও যখন জানালা দিয়ে দেখলো, তখনো জানতো না সে কেন দাঁড়িয়ে আছে। ভেবেছে দাঁড়ানোর উদ্দেশ্য কোন একটা ট্রেনে চড়া। কিংবা কাউকে স্বাগত জানানো। কিন্তু তার তাকানোর ভঙ্গীতে কাউকে স্বাগত জানাবার কোন লক্ষন নেই। সে কাউকে খুঁজছে না। দৃষ্টি তার নির্মোহ স্বচ্ছ। তার নিটোল দৃষ্টি দেখে কিছু বোঝার উপায় নেই।
তবু জানালা দিয়ে তার সাথে চোখাচোখি হয়ে গেলে একটা চেনা হাসি দেখা দেবে প্ল্যাটফর্মে দাঁড়ানো মেয়েটির চোখে। লোকটা অবাক হবে অচেনা মেয়ের মুখে চেনা হাসি দেখে। ট্রেনটা ওখানে দাঁড়াবার কথা ছিল না। লোকটার ওই ষ্টেশানে নামার দরকার ছিল না। কিন্তু ওই হাসিতে কি ছিল। লোকটা দুম করে নেমে পড়লো ষ্টেশানে। অনির্ধারিত যাত্রাবিরতি যেন। কেন নামলো? মেয়েটা তো ডাকেনি তাকে। কেবল একটু হেসেছে। সেই হাসির কারন জানে না সে, তবু সে মুগ্ধ হয়ে নেমে পড়েছে। মেয়েটা কি ভাবছে ছেলেটা জানে না। এমনকি সে আদৌ জানে না ঐ হাসিটা তার উদ্দেশ্যে ছিল কিনা। নাকি শ্রেফ আনমনা একটা হাসি ছিল। তবু হাসিটা তার কোথাও লেগেছে, বেজেছে কোনখানে।
ওই হাসিটা দেড়যুগ আগে আরো একজন হেসেছিল। কেন হেসেছিল তা জানতে চেয়ে বিব্রত হয়েছিল তখন সে। কারন আগের সেই মেয়েটি অস্বীকার করেছিল হাসিটা। বলেছিল ওই হাসিটা তাকে উদ্দেশ্য করে হাসেনি। হাসি এসেছিল তাই হেসেছে। অন্য কোন অর্থ নেই। বিভ্রান্ত হয়ে ফিরে এসেছিল যুবক। ভুল দরোজায় নক করেছিল। আজো সেরকম উদ্দেশ্যহীন হাসি। অনেক বছর পেরিয়ে গেলেও সেই পুরোনো শূন্যতাটা তাকে উদাস করলো হঠাৎ। তাই তাকে নামতেই হলো অনির্ধারিত গন্তব্যে। জানতেই হবে কেন তার দিকে চেয়ে হাসলো ওই তরুনী।
তরুনীর বুকে তখন খাঁ খাঁ শূন্যতা। কোথাও হাহাকার করছে এক হারানোর বেদনা। তার কোথাও যাবার ছিল, কিন্তু তার ট্রেনটা আসেনি, কিংবা ট্রেনটি তার যাত্রা বাতিল করেছে অথবা সেই ট্রেনের পথসঙ্গী অন্য কোথাও নেমে গেছে। সব মিলিয়ে বিষাদক্লিষ্ট তরুনী। কিন্তু এই ট্রেনটি থামতেই এত মানুষের মধ্যে এই মুখটা দেখে তার খুব মায়া হলো। এই ট্রেনটি এখানে থামার কথা না। তবু থেমে গেছে কোন কারনে। যেখানে সে দাঁড়িয়েছে সেখানে ট্রেনটার ওই জানালার খোপটিতে সেই অদ্ভুত মানুষটাকে দেখলো। শ্রদ্ধাবোধ জাগলো, ভরসা দেখলো চোখটাতে, কোন ফাঁকে একটা মায়াবী হাসি বেরিয়ে গেল তার নিজের অজান্তেই। কেন এত আপন মনে হলো অচেনা মানুষটাকে?
কাজটি ঠিক হলো কিনা বুঝলো না। কিন্তু লোকটাও আজব। হুট নেমে পড়ছে ট্রেন থেকে। তবুও তরুনী অবাক হলো না, ভয় পেলো না লোকটার আগমনে। কী যেন আছে, কেমন অদ্ভুত এক নির্ভরতার সন্ধান করল মানুষটার ভেতর। এই নির্জন ষ্টেশানে অচেনা মানুষকে কতটা ভরসা করা যায়। কিন্তু মানুষটা কাছে আসা মাত্র সে কথা বলতে শুরু করলো যেন অনেক দিনের চেনা। ভুলে গেল মাত্র এখুনি ট্রেন থেকে নেমেছে লোকটি। পরিচয় উদ্দেশ্য কোন কিছু না জেনেই ওরা কথার বৃষ্টি ঝরায়। অঝোর ধারার কথাবৃষ্টি চলে। এত বৃষ্টি কেউ কখনো দেখেনি।
কথায় কথায় লোকটার জানা হয়ে যায় তরুনীর কাহিনী। একেকটা পর্ব তার ভীষন বিস্ময়কর। কিন্তু বিস্মিত হবার বদলে অশ্রুসিক্ত হয় লোকটা। এই প্রথম কোন এক নারী তার চোখে জল এনেছে। লোকটি তার নিজের কাহিনীও ব্যক্ত করে। তরুনী তার কাহিনী শুনেও বেদনার্ত সহমর্মী হয়। দুজনে প্রবল উৎসাহে কথাবিনিময় করতে থাকে যেন ট্রেনটা ছেড়ে দেবার আগেই সবকিছু বলা হয়ে যায়। তবে তরুনী মাঝে মাঝেই আনমনা হয়ে যায় তার না আসা ট্রেনটার জন্য, গন্তব্যের জন্য।
তরুনীর ইচ্ছে হয় লোকটাকে বলে, 'নেমে পড়ো এই ষ্টেশানে। আমাদের গল্প অনেক বাকী আরো।' লোকটার ইচ্ছে হয় বলে, 'উঠে পড়ো আমার ট্রেনে, এখনো অনেক গল্প বাকী। যেতে যেতে বলি।' কিন্তু দুজনেই জানে ট্রেনে আর কোন আসন খালি নেই। তাই মুখফুটে বলা হয় না কিছু।
গল্প করা ছাড়া ওদের আর কোন কাজ নেই। কেবল গল্প, কেবল কথা। এত কথা। তবু শেষ হয় না কথা। আনমনা মেয়েটা ভাবে, এরকম কথা তো আগেও বলেছি ওর সাথে, যে নেমে গেছে অন্য ষ্টেশানে। একে বিশ্বাস করি কি করে, এও তো চলে যাবে একটু পরেই। হতাশায় কেঁদে ফেলে মেয়েটি। ঝগড়া করে লোকটার সাথে। লোকটাও অবুঝ, তরুনীর আনমনা মুখ দেখে কখনো কখনো কষ্ট পায়, হাত ছেড়ে উঠে যেতে চায় ট্রেনে। কিন্তু আবার তরুনীর চোখে ফিরে তাকিয়ে খুঁজে পায় আশ্রয়, সেই আশ্রয়কে হাতছাড়া করতে পারে না সে। আবারো হাত ধরে এসে তরুনীর। লোকটার এই 'ফিরে আসা' ভীষন ভরসা দেয় তরুনীকে। এই 'ফিরে আসা'য় ভালোবাসার আভাস পায় সে। ভালোবাসার জন্যই তো তার সকল কান্না। যদিও সে লোকটার ভালোবাসা চায় না, সে চায় তার 'না আসা' ট্রেনের ভালোবাসা। তবু ইচ্ছে করে এর হাত ধরে কিছু সময় বসে থাকি। শান্তি খুঁজি।
এইখানে এসে একটা দ্বিধাদ্বন্দ ভুলবোঝাবুঝি বিভ্রান্তির সময় কাটে। মানুষটা ভুল ষ্টেশানে নেমে পড়লেও তার প্রতি মায়াজালে আবদ্ধ হয় তরুনী অজ্ঞাত কারনে। সেই মায়াকে কৃতজ্ঞতা হিসেবে নিয়েও কোন এক মুহুর্তে ভালোবাসা ভেবে ভুল করে লোকটা। ভাবে তরুনীটি বুঝি তার প্রতি দুর্বল। তরুনী অনুমান করে লোকটার মনোভাব। বুঝেও স্পষ্ট নিষেধ করতে পারে না। কারন লোকটা তার নিঃসঙ্গ সময়ে সঙ্গ দিয়েছে, বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়েছে, ভরসা দিয়েছে।
লোকটার প্রতি তার অনেক কৃতজ্ঞতা। লোকটাকে বিমুখ করে বলতে ইচ্ছে হয় না "ভাই, আপনার প্রতি আমার প্রচুর কৃতজ্ঞতা। কিন্তু আপনাকে ভালোবাসা সম্ভব নয় আমার। আপনার গন্তব্য আলাদা, আপনার বাহন আলাদা, আমি আপনার সাথে যাচ্ছি না, আপনি আমার সাথে থাকছেন না। সুতরাং ভুলে যান সব কিছু"
কিন্তু লোকটাকে তার কিছুই বলা হয় না। কারন তার ভেতরেও "কোন এক বোধ কাজ করে। স্বপ্ন নয়, প্রেম নয়, আরো এক বিপন্ন বিস্ময়........"
গল্পটা এখানে শেষ হবে না। কারন লোকটা ট্রেনে উঠে বসলেও তার মন পড়ে থাকবে এই ষ্টেশানে। গন্তব্যে নেমে হাঁটতে হাঁটতেও ভাবতে থাকবে এই ষ্টেশানের কথা। এই তরুনীর কথা। যে ভ্রমনের স্বপ্ন সে দেখেছে সেই স্বপ্নটা জাগিয়ে রেখে লোকটা এক অনন্ত পথে হাঁটতে থাকবে। হাঁটতে হাঁটতে.........প্রবল জনারণ্যেও তার হৃদয় তৃষ্ণার্ত হয়ে থাকবে না হওয়া এক ভ্রমনের জন্য।
অতঃপর সে নিজের জন্য একটা শান্ত্বনার সমীকরন দাঁড় করাবে- কোন মানুষের জীবনেই সফল ভ্রমনের গল্প নেই।
Wednesday, April 7, 2010
জীবন বই
জীবনকে যদি আস্ত একটা বই বলি, তার প্রতিটা পাতাকে যদি একেকটি বছর ধরি তাহলে কয়েকটা পাতা মিলে একেকটা অধ্যায় হবে। একেকটা অধ্যায়ে মানুষ একেক রকম জীবনযাপন করে। জীবনের গতিপথ যতই এগোতে থাকে, বইটা ততই লেখা হতে থাকে। বইটা একবারই লেখা হয়, কোথাও কোন ভুল হয়ে গেলে সংশোধনী দেয়ার সুযোগ থাকলেও আগের লেখাগুলো থেকেই যায়। জীবনের সব লেখাই অমোছনীয়। উইকিপিডিয়া যেমন প্রতি মূহুর্তে আপডেট হয়, কিন্তু আগের ইতিহাসও থেকে যায়, জীবনও তেমনি। মাঝে মাঝে আমরা যে স্মৃতির জাবর কাটি সেটা হলো বইয়ের পেছনের পাতাগুলো উল্টেপাল্টে দেখা। কোন কোন পাতা বারবার উল্টানো হয়, কোন পাতা হয়তো জীবনে আর কখনো উল্টানোই হয় না। ওরকম ভুলে যাওয়া পাতার সংখ্যাই বেশী জীবন বইতে। সেরকম ভুলে যাওয়া একটা পাতায় তোমার কথা লেখা আছে। চোখে পড়েনি কখনো। সেদিন আরেকটা অধ্যায় খুজতে গিয়ে তোমার পাতাটা খুলে গেল। চোখের সামনে ভেসে উঠলো সেইকাল আর এইকালের অযুত নিযুত দুরত্বের পার্থক্য। আমি চাইলেও সেই কাল কে ছুঁতে পারবো না আর। তুমিও পারবে না। আমরা বহুদুরের যুগান্তরে হারিয়ে গেছি।
Thursday, April 1, 2010
তবু বিস্ময় জেগে থাকে
চলেই যাবার কথা ছিল। যাওয়া হলো না। সবাই চলে গেছে। কাজ নেই তেমন। তবু বসে আছি। কেন বসে আছি জানি না। কিছুটা বেদিশা হয়ে বসে আছি। দক্ষিনের লাইব্রেরী ঘরে গিয়ে ধোঁয়া উড়িয়ে এলাম দুরবর্তী জাহাজের মাস্তুল দেখতে দেখতে। কিছুই করতে ইচ্ছে করছে না আর।
সবগুলো চিঠির জবাব দেয়া শেষ। সবগুলো ফরমায়েশ পালন করা শেষ। তবু যাওয়া হয়নি আমার। কেন যাওয়া হলো না? শেষ গাড়ীটা বাঁশি বাজিয়ে চলে গেছে সব যাত্রীদের নিয়ে। আমিই বসে রইলাম একা। আমি জানি কেউ নেই। তবু কার জন্য বসে থাকা? মাথার উপরে শীতল পরশ। মনের ভেতর একটা ছায়া। কার ছায়া? আমি কাকে খুঁজি? কার জন্য অন্তহীন অপেক্ষা। আমার কোথাও যাওয়া হয় না। আমার কোথাও যাবার নেই। আমি এক অর্থহীন অন্তহীন প্রতীক্ষায়।
আমি একবার কোথাও থেমেছিলাম। পথের মাঝখানে। অনির্ধারিত গন্তব্যে। আমার কোথাও যাবার ছিল না বলেই কি থেমেছিলাম? আমি জানি না। বিকেলের রোদগুলো যখন সব রং হারিয়ে মিলিয়ে যেতে থাকে সন্ধ্যার আকাশে, আমি বসে থাকি অনিবার্য এক অমাবস্যার আকর্ষনে। আমাদের যাত্রা অনিশ্চিত, আমাদের গন্তব্য অনিশ্চিত, আমাদের নিয়তি অনিশ্চিত।
কোথাও যাইনি বহুবছর। আমি পাহাড় দেখিনি, সমুদ্র দেখিনি, লেকের টলটলে পানিতে মেঘের ছায়া দেখিনি বহুকাল। আমার কোথাও চলে যাবার সাধ ছিল। দুরে কোথাও। অন্য কোথাও। আমি পর্বত চুড়া স্পর্শ করতে পারবো না জেনেও পর্বতের কাছাকাছি যেতে চেয়েছিলাম। আমি নদীর গতিপথ বুঝি না, তবু নদীর সাথে চলতে চেয়েছিলাম। আমি অনাগত ভোরে একটা স্বপ্ন দেখতে চেয়েছিলাম। আমার ভোর কখনো আসেনি, স্বপ্নও দেখা হয়নি।
অনেক বছর আগে একবার দুর নিঃসঙ্গ দ্বীপে গিয়ে মাঝরাতের গভীর অন্ধকারে সমুদ্র জোনাকী দেখেছিলাম বালুকাবেলায়। অযুত নিযুত জোনাকিরা ঢেউয়ের মাথায় নেচে নেচে ভেঙে পড়ছিল আমার পায়ের কাছে। বিস্মিত শিহরিত হৃদয়ে আমি তাদের আলতো করে ছুঁয়ে দিয়েছিলাম। বিনিময়ে তারা আমায় দিয়েছিল উষ্ণতা। সেই উষ্ণতায় ভালোবাসা ছিল না ক্রোধ ছিল আমি জানি না।
তবু আমি সেই বিমুগ্ধ রাতের কথা কখনো ভুলতে পারি না। সেই সমুদ্র জোনাকীরাও আজ কোথায় হারিয়ে গেছে। আমি আর কখনো তাদের খুঁজে পাইনি। সবকিছুই একদিন হারিয়ে যায়, সবকিছু নিঃশেষ হয়, সব মেলা ভেঙে গিয়ে বসে নতুন আসর। নতুন গল্পের আসরে থাকে নতুন শ্রোতা, নতুন বক্তা। পুরোনোরা আর কখনো ফিরে আসে না, যেমন ফিরে না হারিয়ে যাওয়া ধূসর বিকেলগুলো।
যে গল্পের কোন উপসংহার নেই, সেই গল্পের মতো, অই জোনাকীরাও চলে গেছে অন্য কোথাও, অন্য কোন গন্তব্যে। কেবল বিস্ময়টা বেঁচে থাকে আজীবন।।
সবগুলো চিঠির জবাব দেয়া শেষ। সবগুলো ফরমায়েশ পালন করা শেষ। তবু যাওয়া হয়নি আমার। কেন যাওয়া হলো না? শেষ গাড়ীটা বাঁশি বাজিয়ে চলে গেছে সব যাত্রীদের নিয়ে। আমিই বসে রইলাম একা। আমি জানি কেউ নেই। তবু কার জন্য বসে থাকা? মাথার উপরে শীতল পরশ। মনের ভেতর একটা ছায়া। কার ছায়া? আমি কাকে খুঁজি? কার জন্য অন্তহীন অপেক্ষা। আমার কোথাও যাওয়া হয় না। আমার কোথাও যাবার নেই। আমি এক অর্থহীন অন্তহীন প্রতীক্ষায়।
আমি একবার কোথাও থেমেছিলাম। পথের মাঝখানে। অনির্ধারিত গন্তব্যে। আমার কোথাও যাবার ছিল না বলেই কি থেমেছিলাম? আমি জানি না। বিকেলের রোদগুলো যখন সব রং হারিয়ে মিলিয়ে যেতে থাকে সন্ধ্যার আকাশে, আমি বসে থাকি অনিবার্য এক অমাবস্যার আকর্ষনে। আমাদের যাত্রা অনিশ্চিত, আমাদের গন্তব্য অনিশ্চিত, আমাদের নিয়তি অনিশ্চিত।
কোথাও যাইনি বহুবছর। আমি পাহাড় দেখিনি, সমুদ্র দেখিনি, লেকের টলটলে পানিতে মেঘের ছায়া দেখিনি বহুকাল। আমার কোথাও চলে যাবার সাধ ছিল। দুরে কোথাও। অন্য কোথাও। আমি পর্বত চুড়া স্পর্শ করতে পারবো না জেনেও পর্বতের কাছাকাছি যেতে চেয়েছিলাম। আমি নদীর গতিপথ বুঝি না, তবু নদীর সাথে চলতে চেয়েছিলাম। আমি অনাগত ভোরে একটা স্বপ্ন দেখতে চেয়েছিলাম। আমার ভোর কখনো আসেনি, স্বপ্নও দেখা হয়নি।
অনেক বছর আগে একবার দুর নিঃসঙ্গ দ্বীপে গিয়ে মাঝরাতের গভীর অন্ধকারে সমুদ্র জোনাকী দেখেছিলাম বালুকাবেলায়। অযুত নিযুত জোনাকিরা ঢেউয়ের মাথায় নেচে নেচে ভেঙে পড়ছিল আমার পায়ের কাছে। বিস্মিত শিহরিত হৃদয়ে আমি তাদের আলতো করে ছুঁয়ে দিয়েছিলাম। বিনিময়ে তারা আমায় দিয়েছিল উষ্ণতা। সেই উষ্ণতায় ভালোবাসা ছিল না ক্রোধ ছিল আমি জানি না।
তবু আমি সেই বিমুগ্ধ রাতের কথা কখনো ভুলতে পারি না। সেই সমুদ্র জোনাকীরাও আজ কোথায় হারিয়ে গেছে। আমি আর কখনো তাদের খুঁজে পাইনি। সবকিছুই একদিন হারিয়ে যায়, সবকিছু নিঃশেষ হয়, সব মেলা ভেঙে গিয়ে বসে নতুন আসর। নতুন গল্পের আসরে থাকে নতুন শ্রোতা, নতুন বক্তা। পুরোনোরা আর কখনো ফিরে আসে না, যেমন ফিরে না হারিয়ে যাওয়া ধূসর বিকেলগুলো।
যে গল্পের কোন উপসংহার নেই, সেই গল্পের মতো, অই জোনাকীরাও চলে গেছে অন্য কোথাও, অন্য কোন গন্তব্যে। কেবল বিস্ময়টা বেঁচে থাকে আজীবন।।
Subscribe to:
Posts (Atom)