Monday, April 27, 2009

ক্যামেরাবাজির চাপাবাজি

ছেলেবেলা থেকেই ক্যামেরাবাজির খুব শখ ছিল। ক্লাস এইটে পড়ার সময় বাবা একবার বিদেশ থেকে আসার সময় একটা ক্যামেরা নিয়ে আসে। জীবনে প্রথম হাতে নেয়া সেই ক্যামেরাটা ছিল একটা Yashica Electro35. সেই বয়সেই তাক লাগিয়ে দিয়েছিলাম বেশ কিছু চমকদার শট তুলে। বাবা তার ছেলের প্রতিভায় মুগ্ধ হলেও ক্যামেরাবাজির কারনে পড়াশোনা গোল্লায় যাবার অজুহাতে ক্যামেরাটা বিক্রি করে দিয়েছিলেন নিউমার্কেটের চারতলার ইলেক্ট্রনিকস দোকানে। আমাকে বোঝালেন- এই ক্যামেরাটা ম্যানুয়াল, সামনে আধুনিক-অটোমেটিক ক্যামেরার যুগ আসছে, সেখান থেকে একটা কিনে দেবো। ছেলে ভোলানো কথা, জীবনেও দেবে না জানি। তা বুঝেও জি আচ্ছা করলাম নিরুপায় হয়ে।

কয়েক বছর পর একদিন সত্যি সত্যি আরেকটা ক্যামেরা কিনে দেয়া হলো আমাকে। আমি তো রীতিমত অবাক। কেউ কেউ তাহলে কথা রাখে? এবারের মডেল RICOH AF-5 । আধুনিক, অটোমেটিক, অটো ফোকাস। সবকিছু অটো। কিচ্ছু করার দরকার নাই। এক ক্লিকেই খেল খতম। তাকাও আর ক্লিক মারো। ফোকাস এডজাষ্টের কোন ফ্যাকড়া নাই। এরকমই তো চাচ্ছিলাম। এটা পেয়েই আমি খুশীতে বাগ বাগ। সহজ একটা ক্যামেরা। তবে একটা সমস্যা হলো ক্যামেরাটা অ্যালকালাইন ব্যাটারী দিয়ে চালাতে হয় যার দাম অনেক বেশী।

অনেক পরে বুঝেছি প্রথম Yashica ক্যামেরাটা কি জিনিস ছিল। কিন্তু কী উপায়। যতটুকু পারি আবজাব ফটো তুলে চালাতে থাকি RICOH দিয়ে। খারাপ না, তবে জুম নেই বলে একটু আফসোস লাগতো। সাদাকালোর প্রতি একটা অবসেশান ছিল, শুনেছিলাম বড় ফটোগ্রাফার হতে হলে সাদাকালো ছবি তুলতে হবে। ২০-৩০ টাকায় সাদাকালো ফিল্ম কিনে দেদারসে তুলতে লাগলাম। তারপর এলো ১৯৯১ সালের ২৯শে এপ্রিলের ভয়াবহ হারিকেনের আঘাত। আমাদের বাড়ীর টিনের চাল উড়িয়ে নিয়ে আরো অনেক আসবাবের সাথে ক্যামেরা এবং ফিল্মগুলোর বারোটা বাজিয়ে দিল নিমেষে। শত শত ছবি নষ্ট হয়ে গেল, ডজনে ডজনে ফিল্মের ফিতা। ক্যামেরা গেছে সেজন্য আফসোস নেই। কিন্তু ফিল্মগুলোর জন্য মনটা খারাপ হয়ে গেল। এরপর ছেড়েই দিলাম ক্যামেরাবাজি। বছর দশেক আগে অফিসের কাজে কোরিয়া গিয়ে স্যামসাং এর ক্যামেরা কিনেছিলাম একটা। সেটা শুধুই পারিবারিক ছবি তোলার জন্য। ফটোগ্রাফির স্বপ্নটা আর জাগতে দেই নি। ছবি তোলার সময় নেই, ক্যামেরা কিনে কী লাভ? পেশাগত ব্যস্ততায় সৌখিনতা ঢাকা পড়লো।

ক্যামেরা কেনার সৌখিনতা ঢাকা পড়লেও ইন্টারনেটে বসলে ঘুরে ঘুরে ক্যামেরাবাজ ও ক্যামেরাবাজীর আলোচনা পড়তে ভালো লাগতো। একদিন ব্লগবাজি করতে গিয়ে সচলে ক্যামেরাবাজির গন্ধ পেলাম। দুধের সাধ ঘোলে মেটানোর সুযোগ পেয়ে সুড়ুৎ করে ঢুকে পড়লাম। মাহবুব ভাইয়ের লেখাগুলো আবার শিখতে ডাকলো। মোতাহার ভাইয়ের ক্যামেরাবাজি ক্লাসে প্রথম ডাকেই বসে গেলাম।

শেখার তো কোন বয়স নেই। যখন ক্যামেরা ছিল তখন ক্যামেরাবাজি শেখার সুযোগ ছিল না, কেবল তাক করেছি আর ক্লিক মেরেছি। এখন ক্লিক মারার সুযোগ কম তত্ত্ব শেখার সুযোগ বেশী। তবু সুযোগ পেলেই ক্লিকাবো এই ধান্ধায় পরিচিত ক্যামেরার দোকানে গিয়ে বললাম, আমার বয়সে সহনীয় একটা ক্যামেরা দিতে যাতে অনেক দুরে দুরে তাক করা যায়। ছোটাছুটি কম করে বেশী ক্লিকানোর ফন্দী।

ইন্টারনেটে NIKON D60 সম্পর্কে পড়ে ধারনা করেছিলাম ওটাই কিনবো। DSLR ছাড়া ক্যামেরাবাজী পোষাবে না। কিন্তু পরিচিত দোকানী আমার পেশা-লাইন-ঘাট-অভিজ্ঞতার আদম সুরত সম্পর্কে ধারনা রাখে। সে বললো NIKON D60 আপনারে মানাবে না। আপনার দরকার 'সহজ-অটোমেটিক-আধুনিক-ডিজিটাল'। সেই পুরোনো কাহিনী যা আমার বাবা ২৮ বছর আগে শুনিয়েছিল। এখন শুধু বাড়তি যোগ হয়েছে 'ডিজিটাল'।

SONY H5Oটা আমার হাতে তুলে দেয়া হলো। বোঝানো হলো এর গুনগান। কেনাকাটার ক্ষেত্রে আমাকে কনভিন্স করা খুব সহজ। সুন্দর করে গুছিয়ে বলতে পারলে যে কোন চাপাবাজি দিয়ে আমাকে সহজেই কুপোকাত করা যায়। দোকানীর সাথে তর্ক করার সাহস পেলাম না। বাবার 'অটোমেটিক' বানী যেমন মেনে নিয়েছিলাম, সেরকম দোকানীর 'ডিজিটাল' বানী মেনে নিয়ে SONY H5O নিয়ে বাসায় চলে এলাম।

বউকে গম্ভীর সুরে বললাম, "মেয়ে বড় হচ্ছে, আগামী বছর স্কুলে দিতে হবে। ফটোগ্রাফার বানাবো ওকে, তাই এখন থেকে ক্যামেরা সম্পর্কে আইডিয়া.................।" কথা শেষ করার আগেই বউ উঠে রান্নাঘরে চলে গেল। আশ্চর্য মহিলা, আমি কি চাপা মারছি নাকি!

সচলের ক্লাসরুমে এসে ভাবছি কাজটা কি ঠিক করলাম?

নববর্ষ যদি শুরু হতো ফাল্গুনে বা অঘ্রানে?

একটা আজগুবি চিন্তা মাথায় এলো। বাংলা মাসের সিরিয়ালে পরিবর্তনের চিন্তা। গতকাল মধ্য এপ্রিলের প্রচন্ড দাবদাহ উপেক্ষা করে রোদে জ্বলে পুড়ে নারী-পুরুষ- শিশু-বৃদ্ধ সবাই মিলে যেভাবে পহেলা বৈশাখ উৎসবে ঝাঁপিয়ে পড়তে দেখলাম, তাতে মাথার ভেতরে চিন্তাপোকাটা বললো সময়টা যদি একটু শীতময় হতো, আহা- কতো মজা করে এই উৎসবটা পালন করতে পারতো এরা। বাঙালী মধ্যবিত্তের সবচেয়ে বড় উৎসব এই পহেলা বৈশাখ। কিন্তু এই উৎসব পালন করতে গিয়ে গরমে ঘেমে নেয়ে বিশ্রী অবস্থা। মেয়েদের অবস্থা বেশী শোচনীয়। এই উৎসবকে আরেকটু আনন্দময় করতে, আরামদায়ক করতে আমরা কী করতে পারি?

বিধাতার কাছে হাত তুলে প্রার্থনা করতে পারি, “হে খোদা আমাদের সবাইকে এসি গাড়ীর মালিক করে দাও তাহলে আমরা আরামে সারাদিন ঘুরে বেড়াতে পারবো।” আচ্ছা, বিধাতা নাহয় দিলোই এসি গাড়ী দিয়ে বড়লোক বানিয়ে। কিন্তু উৎসবে-মিছিলে-নাচে-গানে যোগ দিতে হলে তো এসি গাড়ীতে বসে থাকলে চলবে না। বাইরের গরমের আগুনে হলকা হজম করতেই হবে। আবারো বিধাতার কাছে আবেদন করতে হবে- “হে খোদা আমাদের হাটে মাঠে ঘাটে শীতল পরশ ঢেলে দাও। কিন্তু বিধাতার এই প্রস্তাবে রাজী হবার সম্ভাবনা কম। কারন আশেপাশের অন্য দেশ এতে আপত্তি জানাতে পারে।

তবে নববর্ষ পালনের সময়টা যদি একটু শীতের দিকে হয়, পহেলা ফাল্গুনে বা অগ্রানে যেরকম হালকা শীতের পরশ থাকে, তেমন চমৎকার দিনে যদি নববর্ষের উৎসব হয়, ভাবুন তো কেমন জমতো? বিধাতার কাছে একটু ঠান্ডা পরশের জন্য কেঁদে মরতে হতো না। বিধাতা তো নানান রকম ঋতু আমাদের দিয়েই রেখেছে, আমাদের দরকার সুবিধামতন বেছে নেয়া। যদি বৈশাখ মাসকে একটু শীতের দিকে এগিয়ে নেয়া যেত কিংবা শীতের দিকের কোন মাস দিয়ে বছর শুরু করা যেত, তাহলে? ফাল্গুন কিংবা অগ্রহায়নে যদি শুরু হয় বাংলা বছর, কেমন হয়? প্রস্তাবটা বেশী আজগুবি লাগে? লাগলে লাগুক। তবু গরমে হাসফাস করা নববর্ষকে আরেকটু আরামদায়ক করার জন্য বর্ষশুরু মাস পরিবর্তনের এই সুবিধাজনক আফাইট্টা প্রস্তাব করছি আমি। পোকাটা মাথার ভেতরে ঢুকেছে বাংলা সনের উৎপত্তির ইতিহাস পড়তে গিয়ে। নীচে খানিকটা দিলাম-

“আকবর নতুন সনপদ্ধতি চালু করার আগে বঙ্গে শক বর্ষপঞ্জি ব্যবহৃত হতো। অনুমান করা হয়, শক রাজবংশকে স্মরণীয় করে রাখতেই ৭৮ খ্রীষ্টাব্দে প্রবর্তিত শকাব্দ (শক বর্ষপঞ্জির) থেকে বাংলা সনের নামগুলি এসেছে। বিভিন্ন তারকারাজির নামে বাংলা মাসগুলির নামকরণ করা হয় সেগুলো হলো: বিশাখা থেকে বৈশাখ, জ্যেষ্ঠা থেকে জৈষ্ঠ্য, আষাঢ়া থেকে আষাঢ়, শ্রবণা থেকে শ্রাবণ, ভাদ্রপদ থেকে ভাদ্র, কৃত্তিকা থেকে কার্তিক, অগ্রাইহনী থেকে অগ্রহায়ণ, পুষ্যা থেকে পৌষ, মঘা থেকে মাঘ, ফল্গুনি থেকে ফাল্পুন, এবং চিত্রা থেকে চৈত্র। অগ্রহায়ন মাসের নামের আরেকটি ব্যাখ্যা হলো: অগ্র অর্থ প্রথম, হায়ন অর্থ বর্ষ বা ধান। আগে এই মাস থেকেই বছর গণনা আরম্ভ হতো কিম্বা এই সময়ে প্রধান ফসল ধান কাটা হতো। তাই এই মাসের নাম হয় অগ্রহায়ণ।”

এ থেকে অনুমান করা যায় কোন না কোন এক সময়ে বাংলা বছর শুরু হতো অগ্রহায়ন মাস থেকে। অগ্রহায়ন মাসের উৎপত্তির দ্বিতীয় ব্যাখ্যাটা তাই বলে। যদি অগ্রহায়ন মাস থেকে বাংলা নববর্ষ গননা শুরু হয় ব্যাপারটা দারুন হবে। চাইলেই করতে পারি আমরা। বাংলা তো আমাদের ক্যালেন্ডার। আমরা আমাদের পছন্দমত আরামদায়ক একটা মাসকে দিয়ে বছর শুরু করাতে পারি। এরজন্য জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে কোন বিল পাশ করাতে হবে না কিংবা সৃষ্টিকর্তার কোন অনুমোদন লাগবে না। এতে জাত ধর্ম সংস্কৃতির ক্ষতি হবারও কোন সম্ভাবনা নেই। বাংলাদেশ সরকার চাইলে সংসদে বিল পাশ করিয়ে এটা করতে পারে। কত আজেবাজে বিল পাশ হয় সংসদে। এই বিল পাশ করা কী খুব কঠিন হবে?

সংসদে এই প্রস্তাবটা উত্থাপন করার জন্য পাঠাতে চাই আমি। কিন্তু আমজনতা কী সংসদে কোন প্রস্তাব পাঠাতে পারে? পরিবর্তনের অঙ্গীকার নিয়ে ক্ষমতায় আসীন সরকার কি এই পরিবর্তনের ডাকে সাড়া দেবে?

[পুনশ্চ- যারা এই প্রস্তাবকে হাজার বছরের বাঙালী সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র মনে করবেন, তাদের এই পোস্ট থেকে দুরে থাকার অনুরোধ করছি]

বিদ্যুত সমস্যার সমাধানে একটা ফ্রী পরামর্শ, কিন্তু টেরাই করার দরকার নাই

১. (পুরোনো দিনের কথা) সারাদিনের অফিসের খাটাখাটুনি সেরে সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে কর্মক্লান্ত শরীরটা বিছানায় এলিয়ে দিলাম। সিলিং ফ্যানের হু হু হাওয়ার প্রানটা জুড়িয়ে গেল। বাসায় আসার জন্য বিকেল থেকেই মনটা উড়ু উড়ু করছিল। বউ বাচ্চাকে নিয়ে বাইরে স্পেশাল খেতে যাবো। কী সুখী জীবন!
.
২. (এসেছে নতুন দিন) অফিসের কাজকাম সেরে সন্ধ্যায় বাসায় যাবার সময় হতেই মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে উঠতে থাকে। এত তাড়াতাড়ি সাতটা বেজে গেল! আরামের অফিসে থাকতেই তো ভালো লাগছিল। বাসায় গিয়ে করবো কি, আলো, বাতাস, বিদ্যুত, পানি কিছুই নাই। তবু বাসায় যেতে হয়। মোম জ্বালিয়ে বসে থাকি। বউ খেতে ডাকলো। দুর করে তাড়িয়ে দিলাম। কারেন্ট না এলে খাবো না। বারোটার দিকে কারেন্ট এলে মেজাজটা নিয়ন্ত্রনে আসে। তারপর খেয়ে শুয়ে পড়লাম। রাত সোয়া একটার দিকে ঘুমটা লেগে এসেছে অমনি ফ্যানের আওয়াজ থেমে গেল। গেছে!! শালার চুতমারানি এসেই চলে গেছে আবার!! এক সেকেন্ডে যেন আগুন লেগে গেল শরীরে। ঘাম ঝরছে বন্যার মতো। বিছানা ভিজে যাচ্ছে। উঠে বসলাম। দমবন্ধ লাগছে। জানালাটা হা করে খোলা, কিন্তু একফোঁটা বাতাস নেই বাইরে। রুমের মধ্যে যেন অক্সিজেনের অভাব পড়েছে। হাঁসফাস লাগছে।
.
৩. দুই নম্বরের বিদ্যুতহীনতার বাস্তবতা এখন সারাদেশে। আমিও সেই বাস্তবতায় ছিলাম দুবছর আগে। এখন বাধ্য হয়ে স্বার্থপরের মতো ফ্ল্যাটে উঠেছি একটু আরাম আয়েশে থাকার জন্য। যেখানে ২৪ ঘন্টা বিদ্যুত পানির নিরবিচ্ছিন্ন সরবরাহ নিশ্চয়তা। এরকম আরামীয় পরিবেশে যারা থাকেন তারা বাইরের দুঃসহ বিদ্যুতহীন পরিবেশ যে সেভাবে অনুভব করতে পারেন না সেটা নিজেকে দিয়ে বুঝতে পারলাম। তাই অভিজ্ঞতার আলোকে বিদ্যুত সমস্যার আশু সমাধানে একটা গ্যারান্টেড প্রস্তাব দিতে ইচ্ছে হলো। বিফলে মূল্য ফেরত।
.
৪. বাংলাদেশের বিদ্যুত সমস্যার সমাধানে যাদের কঠিন হস্তক্ষেপ প্রয়োজন তারা সবাই লোডশেডিং বিহীন জীবন যাপন করেন। যারা এরকম আরামীয় পরিবেশে থাকেন তাদের দেশের মানুষের বিদ্যুতহীনতার অবর্ননীয় কষ্ট অনুভব করতে পারার কথা না। সুতরাং ৫ নম্বর দফায় আমার প্রস্তাবটা পড়ুন।
.
৫ .সংসদ, সচিবালয়, প্রধানমন্ত্রীসহ সাংসদ মন্ত্রীদের বাসভবন, বঙ্গভবন, ক্যান্টনমেন্ট সহ দেশের শীর্ষস্থানীয় মাথারা যেখানে যেখানে রাতে ঘুমায় সেগুলোকে বৈশাখ জ্যৈষ্ঠ দু’মাসের জন্য রেগুলার বিদ্যুত সরবরাহ ব্যবস্থায় আনা হোক। মানে লোড শেডিং এর আওতা সম্প্রসারিত করা হোক সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় অবধি। ওখানেও সাধারন নগরবাসীর মতো বিদ্যুত আসবে-যাবে খেয়ালখুশী মতো এবং কোন জেনারেটর সংযোগ থাকবে না। ফলে বিদ্যুত চলে গেলে এসি লাইট ফ্যান কিছুই চলবে না।
.
৬. ইনশাল্লাহ, বিদ্যুত সমস্যার সমাধান জ্যৈষ্ঠ মাস ফুরানোর আগেই হয়ে যাবে!
.
৭. এই পরামর্শ ওপেন সোর্সকোড দ্বারা নির্মিত এবং এবসলিউটলি ফ্রী! তাই এর জন্য কোন রকম চার্জ দিতে হবে না। তবে এটা টেরাই করতে গিয়ে কেউ বিপাকে পড়লে লেখককে খুঁজবেন না।

পহেলা বৈশাখ ও পান্তা-ইলিশ

যদিও এটা খুবই জনপ্রিয় শহুরে মধ্যবিত্ত সংস্কৃতি কিন্তু পহেলা বৈশাখে পার্কে গিয়ে পান্তা-ইলিশ খাইনি কখনো। আমার কাছে এই ব্যাপারটা কেন যেন একটু মেকী মনে হয়। আমি জানিনা পার্কে পান্তা-ইলিশ খাওয়ার মেকী সংস্কৃতি কখন থেকে শুরু, কিন্তু পান্তা খাওয়ার সামর্থ থাকলেও ইলিশ খাওয়ার সামর্থ্য যে দেশের ৯০ শতাংশ মানুষের নেই সেটা বুঝতে অর্থনীতিবিদ হতে হয় না। ইলিশ মাছের দাম এমনকি মধ্যবিত্তেরও ধরাছোঁয়ার বাইরে। তবু পহেলা বৈশাখে পান্তা ইলিশ খাওয়াকে যেভাবে দেশীয় সংস্কৃতির ফরজ হিসেবে দেখানো হয় মিডিয়াতে, আমার কাছে বাড়াবাড়ি মনে হয়। দেশের বেশীরভাগ মানুষ যে খাবার খেতে পারে না সেটাকে জাতীয় ঐতিহ্য হিসেবে পালন করতে আমার একটু আপত্তি আছে।

এমনিতে নিন্মবিত্ত মানুষকে অভাবের কারনে সকালে পান্তা খেতে হয়। কিন্তু সেটা ইলিশ দিয়ে নয়, পেঁয়াজ, মরিচ বা আগের রাতের বাসী তরকারী দিয়ে। আর্থিক দুরাবস্থায় আছেন তেমন মানুষ মাত্রেই জানেন সকালে পান্তাভাত আর বাসী তরকারী খাওয়াটা কোন উৎসবের অংশ নয়, নিত্যদিনের দুঃখদৃশ্য। আমি সেই কঠিন মধ্যবিত্ত জীবন দেখে এসেছি বলে পান্তা ইলিশ উৎসবে কখনো যোগ দিতে পারিনি।

পহেলা বৈশাখ বা এরকম যে কোন উৎসব শ্রেফ শহুরে বাবুয়ানা যাতে আপামর দরিদ্র মানুষের অংশগ্রহন নেই। আমি শহর কিংবা গ্রামে খেটে খাওয়া মানুষদের এই উৎসবের বিষয়গুলির প্রতি প্রবল অনাগ্রহ দেখেছি। আসলেই দরিদ্র মানুষের কী কোন উৎসব আছে? সকল উৎসব পালা পর্বন শহুরে মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তের অধিকারে। তার মানে এই নয় যে আমরা এসব পালন করবো না। নিশ্চয়ই পালন করবো। তবে পালন করতে গিয়ে যেন ঐতিহ্যকে বিলাসিতা বানিয়ে না ফেলি। আমাদের সকল উৎসব ঐতিহ্য যেন আপামর জনগনের সামর্থ্যের মধ্যে থাকে। উৎসব থেকে যারা আর্থিক সামর্থ্যের কারনে বাদ পড়ছে তাদের কথা যেন ভুলে না যাই।

Sunday, April 19, 2009

যামু না

প্রায়ই মেজাজ খারাপ থাকে বলে আমার এক মামা মেডিটেশান কোর্স করেছিল। কিন্তু কিছুদিন বাদে মেজাজ আবারো খটখটে। দোষ মামার না, রাস্তার। রাস্তায় নামলেই মামার মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। সকালে অফিস যেতে বাসা থেকে বেরিয়ে রাস্তার মোড়ে সীটের উপর পা তুলে বসে থাকা ঔদ্ধত্য রিকশাওয়ালাদের সারিবদ্ধ বসে থাকতে দেখে ভেতরটা চিড়বিড় করে ওঠে।

মামা প্রতিদিনকার মতো জিজ্ঞেস করে -'এই রিকশা যাইবা?'
প্রথমজন বলে 'না, যামু না'।
দ্বিতীয়জন বলে, 'না'।
তৃতীয়জন প্রশ্ন শোনার আগেই না-সূচক মাথা নাড়ে।
চতুর্থজন মামার প্রশ্ন শোনারই প্রয়োজনীয়তা বোধ করলো না। অন্যদিকে তাকিয়ে থাকে।

প্রায় প্রতিদিন এ জাতীয় ঘটনা ঘটে। রিকশাগুলো খালি খালি দাড়িয়ে থাকে, কিন্তু যাবে না। কদাচিৎ দয়ালু রিকশাওয়ালা ভাগ্য জোটে। এরকম দশ বিশটা রিকশা 'যামু না' রিকশার পর একটা 'যাবো' রিকশা মেলে। একই দশা কিছু কিছু সিএনজি টেক্সীরও। আল্লাই মালুম কষ্ট করে এরা রাস্তায় আসে কেন 'যামু না' বলার জন্য।

মেজাজ ঠিক থাকার উপায় আছে? অফিসে নিত্যদিন লেট। বসের বকা চুপ করে হজম করে রাতে মামীর উপর এসে ঝাড়ে। মামীরও পাল্টা ঝাড়ি। সংসারে অশান্তি। মাথা কারো ঠিক থাকে না?

অথচ রিকশাওয়ালারা যদি 'যাবো' বলে এক কথায় রাজী হয়ে যেত, মামা ঠিক সময়ে অফিসে পৌছে যেতো, বসের সুনজরে থাকতো, বাড়ি ফিরে মামীর সাথে ঝাড়াঝাড়ি করতে হতো না, সংসারে সুখের ফল্গুধারা বইতো। ওই রিকশাওয়ালাগুলো যত নস্টের মূল। ওরা কেন যেন মামাকে দেখলেই বলে, 'যামু না'।

আমি অনেকদিন রিক্সায় চড়িনা। টেম্পুতে বাসে চড়ে ভার্সিটিতে যাতায়াত করি। মামীর কাছ থেকে ঘটনা শুনে ভাবলাম একদিন রিকশায় যাওয়া যাক।

বেরিয়ে প্রথম রিকশাওয়ালার কাছে যাবার সাথে সাথে রাজী। আমি তো খুশী, মামা আসলেই খিটখিটে বুড়ো হয়ে গেছে। কিন্তু আমি রিকশায় উঠে চালাতে বলতেই রিকশাওয়ালা বললো, 'আপা উঠবে না?'

'কোন আপা?'

বলে পাশে তাকিয়ে দেখি স্কুলের ড্রেস পড়া পনের ষোল বছরের এক কিশোরী দাঁড়িয়ে। আমার পেছন পেছন আসছিল আমি খেয়াল করিনি। রিকশাওয়ালা ভেবেছে আমি ওর সাথের। এই সময়ে বালিকা স্কুলের মেয়েরা বেরোয়। রিকশাওয়ালারা স্কুল বালিকাদের প্রতি আকৃষ্ট। সেকারনেই মামাকে অফিসে যাবার সময় প্রতিদিন শুনতে হয় - যামু না!!

একখান ঝাড়ি এবং একটি শিক্ষামূলক প্রেম

"তুমি একটা বেয়াক্কেল, এই সাত সকালে এতগুলো ছেলেমেয়ের সামনে আমাকে বেইজ্জত করলে, তোমার জন্য সেই সাতটা থেকে আমি দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে প্রথম ট্রেনটা চলে গিয়ে দ্বিতীয় ট্রেনও চলে গেছে। একটু পর দশটার ট্রেন ছাড়ার সময় হবে, আর তুমি এতক্ষনে আসছো, তোমার কোন কান্ডজ্ঞান নাই, সময়জ্ঞান নাই, তুমি একটা অপদার্থ, একটা মেয়েকে কিভাবে সম্মান দেখাতে হয় তার কিছুই জানো না তুমি, আমি আজ আর ভার্সিটি যাবো না যাবো না যাবো না, তুমি যতই বল আমি যাবো না, আমার সারাটা দিন তুমি মাটি করে দিলা, তোমাকে আমি ক্ষমা করবো না, কিছুতেই না। কী করে পারলে তুমি... অ্যাঁ, কী করে? এমন একটা সুন্দর সকাল কী করে মাটি করে দিলে তুমি? কাল রাতে পইপই করে বলার পরও তোমার কানে ঢোকেনি আমরা সাতটার ট্রেনে ভার্সিটি যাবো, তোমার জন্য আগে এসে সিট রাখবো, তারপর দুজনে সারাদিন ক্লাস বাদ দিয়ে ক্যাম্পাসের আশপাশে হেঁটে বেড়াবো, গল্প করবো, কবিতা শোনাবো, দুপুরে শহরে ফিরে চাইনিজ খাবো, তারপর বিকেলটা ফয়েজলেকে কাটিয়ে সন্ধ্যায় বাসায় ফিরবো। মাকে বলে এসেছি আজ অনেক পরীক্ষা আছে ফিরতে দেরী হবে, কত কী পরিকল্পনা ছিল সব নষ্ট করে দিলে তুমি! তোমার মতো বেরসিক লোককে বলাটাই ভুল হয়েছে আজ ১৪ ফেব্রুয়ারী, ভালোবাসা দিবস।"

তিন মিনিটের বিরতিহীন মুখবর্ষনের পর সুরঞ্জনা থামলো, ঘুরলো এবং চলে গেল। এই ছিল আমার সাথে সুরঞ্জনার শেষ কথা। তাকে আর ফেরাতে পারিনি। মাত্র দুই ঘন্টার লেট কামিং একটা প্রেমকে সারা জনমের জন্য ঠান্ডা মেরে দিল।

অকুস্থলঃ চট্টগ্রাম রেলষ্টেশান। সময়ঃ সকাল ৯.১৫। তারিখঃ ১৪ফেব্রুয়ারী ১৯৯৩ খ্রীষ্টাব্দ।

ঘটনা থেকে শিক্ষনীয় কিছু পেলেন?

বাংলা স্কুল বনাম ইংরেজি স্কুল বনাম আরবি স্কুল

স্কুল পর্যায়ে বাংলাদেশে কত রকম শিক্ষাপদ্ধতি চালু আছে? আমার জানা মতে সাধারণ বাংলা স্কুল, সাধারণ মাদ্রাসা, কওমি মাদ্রাসা, সাধারণ কিন্ডারগার্টেন, গ্রামার স্কুল ইত্যাদি নানান রকম শিক্ষাপদ্ধতি বিদ্যমান। শিশুর প্রথম বিদ্যাপীঠ হিসেবে শ্রেণীভেদে এর মাঝ থেকে যে-কোনো একটাকে বেছে নিতে হয় অভিভাবককে।

স্কুল পছন্দ করতে গিয়ে অভিভাবকদের মধ্যে আর্থিক কারণ ছাড়াও পছন্দ অপছন্দের বিভিন্ন কারণ কাজ করে থাকে। অনেকে ব্যাপক ভুল ধারণার দ্বারা পরিচালিত হয়। ইংরেজি-স্কুল-পছন্দ অভিভাবক চায় বাচ্চাকে দ্রুত ইংরেজিবিদ্যায় পারদর্শী করে তুলতে, যাতে সহজে তার লন্ডন-আমেরিকা গমন ঘটে। মাদ্রাসা-পছন্দ অভিভাবক চায় বাচ্চাকে বেহেশতের চাবি হিসেবে তৈরি করতে, যাতে বাবা-মাকে সঙ্গে নিয়ে সে বেহেশত দর্শনে যেতে পারে।

ইত্যাকার কারণে আমাদের পুরো শিক্ষাব্যবস্থায় একটা তোগলকি অবস্থা বিরাজ করছে। একেক স্কুল একেক পদ্ধতিতে শিক্ষাদান করছে পূর্ণ গণতান্ত্রিক সুযোগ নিয়ে। কিন্তু একটা দেশের মূল শিক্ষাব্যবস্থায় এতটা ‘গনতন্ত্র’ কি সহনীয়?

ইংরেজি শিক্ষার নামে ৪ বছর বয়সি একটা বাচ্চার হাতে ৫ কেজি ওজনের বই তুলে দেবার যুক্তিটা কী? ৪ বছরের একটা বাচ্চাকে বিদ্যাসাগর বানিয়ে ফেলার প্রচেষ্টা কতটুকু যুক্তিযুক্ত?

মাদ্রাসা শিক্ষায় ধর্মের নামে একটা বাচ্চা ছেলেকে পৃথিবী যাবতীয় জ্ঞান থেকে বঞ্চিত করার মানে কী?

শিক্ষাকেই জাতির মেরুদণ্ড বলা হয়। অথচ সেই মেরুদণ্ডের যত্নের জন্য যা যা করা দরকার তা কি করেছে আমাদের কোনো সরকার? এদেশে ইংরেজি বা আরবি স্কুলের প্রয়োজনীয়তা কতটুকু? বিদ্যমান সরকারি প্রাইমারি বিদ্যালয়গুলোকে কতকাল অবহেলিত ফেলে রাখা হবে? যে-অঙ্কের টাকা ইংরেজি বা মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার জন্য ব্যয় করা হয় তা দিয়ে সাধারণ বাংলা স্কুলগুলোর মান উন্নয়ন করা যায় না কি? সাধারণ বাংলা স্কুলে পড়লে সন্তান মানুষ হবে না, এই কুসংস্কার থেকে বেরিয়ে আসার উপায়ই-বা কী?

বাংলাদেশের মানুষের জন্য আসলে কী রকম শিক্ষাপদ্ধিত প্রয়োজন?

একজন রাখাল শিক্ষকের জীবনযাপন

বছর বিশেক আগের কথা। সকাল সাতটা সাড়ে সাতটা হবে। আমি তাড়াহুড়ো করে বেরুচ্ছিলাম ভার্সিটিতে যাবার জন্য। ট্রেন ৮.১০মিনিটে। আগে বেরুলে সিট পাওয়া সহজ হবে। প্রতিদিনকার চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ভ্রমনযুদ্ধ। সিট দখল হল দখলের মতো মারাত্বক আকার ধারন না করলেও, মৃদু হাতাহাতি নিয়মিত দৃশ্য হয়ে উঠছিল। তাই সকালটা তাড়াহুড়ো করে বেরুই।

হঠাৎ বাইরে কচ্ কচ্ শব্দ শুনে জানলা দিয়ে উঁকি দিলাম সামনের বাগানে। আমাদের টিনশেড বাড়ীর সামনে একফালি খোলা জায়গা, কিছু ফুল আর অন্যান্য গাছপালা অযত্নে লাগানো। ঘন লম্বা লম্বা ঘাস কোমর পর্যন্ত লম্বা হয়ে বেড়ে উঠেছে। জংলা টাইপ জায়গা। ওই ঘাসের জঙ্গলে কিছু একটা নড়ছে। শব্দটা ওখান থেকেই আসছে। ভাবলাম কোন দুষ্টু বাচ্চা বেড়ার দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকেছে। ‘কে–রে’ বলে ডাক দিতে যাবো, এমন সময় ওখান থেকে যে মাথাটা উঠে দাড়ালো, তাকে দেখে ডাক দেয়ার বদলে লুকিয়ে পড়লাম পর্দার আড়ালে। খালি গা, লুংগিতে মালকোচা মারা, মাথায় গামছার পট্টি, তার উপর বসানো ঘাস ভর্তি টুকরি। কাঁচিটা কোমরে গুঁজে যে মানুষটা বেড়ার ঝাঁপি দরজা গলে বেরিয়ে গেল, সেই মানুষটার নাম আবদুল খালেক। একজন প্রাইমারী স্কুল শিক্ষক। থাকেন আমাদের বাসার উত্তর-পশ্চিম কোনে। উনাকে দেখে লুকিয়ে পড়ার কারন হচ্ছে উনাকে যতবার দেখি এভাবে ঘাস কাটতে আমার ভেতর একটা অপরাধবোধ জাগে। মনে হতো আমাকে দেখে উনি বিব্রতবোধ করতে পারেন। একজন শিক্ষক গরুর জন্য ঘাস কাটছেন রাখালের মতো, ব্যাপারটা আমার কাছে অবিশ্বাস্য লাগতো। গ্রামে হলে তাও হতো। এই মেট্রোপলিটন শহরে একজন স্কুল শিক্ষক পরিবার নিয়ে বেঁচে থাকার জন্য যা করছেন তা আমার মাথা নীচু করে দিতো। কিন্তু ওনার নিজের মধ্যে কোন সংকোচ দেখিনি এ ব্যাপারে।

আমাদের পাড়াটা তখনো গড়ে ওঠেনি ভালমত। রাস্তাটা ছিল মাটির। শহরের মধ্যে হলেও রাস্তা ভালো ছিলনা বলে জায়গাটা তখনো আবাসিক এলাকার মর্যাদা পায়নি। আমাদেরও প্রায় নতুন বাড়ী। পেছনে ধূ ধূ প্রান্তর । সেই প্রান্তরের মাঝখানে একটুকরো জায়গায় ছোট্ট একটা বেড়ার ঘর। ঘরের পাশে একচালা বেড়ার নীচে দুটি গরু আর বাছুর বাঁধা আছে। চারপাশে সবুজ ধানের জমিবেষ্টিত সেই ঘরটা খালেক স্যারের। স্ত্রী আর ৫ ছেলেমেয়ে নিয়ে বসবাস করছেন অনেক দিন ধরে। ঘরের লাগোয়া একটা বেড়ার চালাতে গরু-বাছুরের সংসার। শহরের মাঝখানে যেন ছোট্ট একটা গ্রাম্য পরিবেশ। আমি যে স্কুলে পড়তাম উনি সে স্কুলের প্রাইমারী সেকশানে পড়ান। ফজরের নামাজের পর পরই উনি গরুর পরিচর্যা করা, গরুর জন্য ঘাস কাটা ইত্যাদিতে লেগে যেতেন। বাইরের মাঠে ঘাসের ষ্টক শেষ হলে আমাদের বাসার সামনের অংশে চলে আসতেন ঘাস কাটতে। সত্যি কথা বলতে কী, উনি যখন রাখালের কাজ করতেন, উনাকে দেখে রাখালই মনে হতো। অচেনা কেউ উনাকে এ অবস্থায় দেখলে বিশ্বাসই করবে না, এই মানুষটিই ঘন্টা দুই পরে বেত নিয়ে ক্লাসে ঢুকবেন মানুষ গড়ার কারিগর হয়ে।

হায়, উপলব্ধির বয়ঃসন্ধিতে পৌঁছার আগে আমরা বোধ হয় সম্মানের বদলে উনাকে করুনাই করতাম। এরকম একজন মানুষ আমাদের সমাজে ভদ্রভাবে ঠিকে থাকতে পারে না। আর যাই হোক, কেবল মাষ্টারী করে আর দুধ বেচে এ যুগে কেউ ঠিকে থাকতে পারেনা। উনিও ঠিকবেন বলে আমাদের কারো বিশ্বাস ছিলনা। তাছাড়া এতগুলো ছেলেমেয়ে উনার সংসারে। কাউকেই মানুষ করতে পারবেননা হয়তো। বড়জোর স্কুল পাশ। মনে মনে বোধহয় তিরষ্কারই করতাম স্যারের জন্মনিয়ন্ত্রন সংক্রান্ত অসচতেনতার জন্য। বাংলাদেশের বেশীরভাগ দরিদ্র মানুষ অধিক সন্তানের বোঝায় বিপর্যস্ত, কিন্তু সামর্থ্যবান মানু্ষের সন্তান-সন্ততি একেবারেই কম। সংসারে টিকে থাকার জন্য খালেক স্যার স্কুলের চাকরীর পাশাপাশি, টিউশানি করতেন, তাতেও না কুলালে গরু পালতে শুরু করেন, কিন্তু হাল ছাড়েন নি। পাড়া-পড়শিদের কাছে উনি ছিলেন কোনমতে টিকে থাকার কারিগর। এর বেশী কেউ আশাও করে না।

কিন্তু সবার ভবিষ্যতবানী সম্পুর্ন ভুল প্রমান করতে এই মানুষটার মাত্র কয়েক বছর লেগেছিল। ৭/৮ বছরের ব্যবধানে আমরাতাঁর এক ছেলেকে ডাক্তারী, আরেক ছেলে ইন্জিনিয়ারিং পাশ করতে দেখলাম বিষ্ময়ের সাথে । বাকীগুলোও বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রী নিয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে গিয়েছে ততদিনে। ছেলেমেয়েদের এরকম সাফল্যের কোন ছাপ ওনার জীবন যাত্রায় পড়েনি। রয়ে গিয়েছিলেন আগের মতোই। যেন - ওরা ওদের কাজ করেছে, আমি আমারটা করি।

কিন্তু ছেলেমেয়েদের মানুষ করার নিজস্ব চমকপ্রদ একটা পদ্ধতি ছিল। উনি অষ্টম শ্রেনী পর্যন্ত পড়াশোনার ব্যাপারে ছেলেমেয়েদের কোন চাপাচাপি করতেন না। কোনমতে পাশ করতে পারলেই হলো। কিন্তু নবম শ্রেনী থেকে উপরের দিককার পড়াশোনার ব্যাপারে খুব সিরিয়াস ছিলেন। রীতিমতো খোঁজখবর নিয়ে খুব যত্ন নিয়ে তাদের পড়াতেন। যার ফল তিনি হাতে নাতে পেয়েছেন পরবর্তীকালে।

খালেক স্যারের বয়স হয়েছে এখন, ছেলেমেয়েরাও প্রতিষ্ঠিত। তবু স্কুলে যান এখনো প্রতিদিন। গরুগুলো বেচে দিয়েছেন। গরু চরার জায়গাগুলোতে আশে পাশের মানুষের বিশাল বিশাল দালান উঠেছে। মাঝখানে ছোট্ট ঘরটাতে উনি এখনও বাস করেন। পরের প্রজন্ম জানবেও না এই মাটির উপর একজন মানুষ কীভাবে টিকে থাকার সংগ্রামে লিপ্ত ছিলেন তিন যুগের বেশী সময়।

টিভি চ্যানেলগুলোর বিজ্ঞাপন বাণিজ্য ও নাট্য প্রতারণা

টিভি তেমন দেখা হয় না। আন্দোলন, নির্বাচন, ঘটনা-দুর্ঘটনার গরম থাকলে টিভির সামনে বসি, নয়তো বসা হয় না। একই রকম খবর, একই রকম চিত্র, একই রকম সাক্ষাৎকার ভিন্ন ভিন্ন মানুষের মুখ দিয়ে নির্গত হয় নানান নামে প্রতিটি চ্যানেলে। সবগুলো চ্যানেলকে জীবন্ত কপি-পেষ্ট মনে হয়, কপি-পেষ্টে আমার চির অরুচি। তবে হালকা বিনোদনের জন্য মাঝে মধ্যে দুটি সিরিজ দেখতাম একসময়। এনটিভির ‘হাউসফুল’ আর চ্যানেল আইয়ের ‘দৈনিক তোলপাড়’। এখন বিরক্ত হয়ে এগুলোও দেখি না। বিরক্ত হবার কারন নির্বিচার বিজ্ঞাপন অত্যাচার। আমি কোন সিরিয়াস দর্শক না। খুব সামান্য সুড়সুড়ি দিয়েই আমাকে আনন্দিত করা যায়। তোলপাড় বা হাউসফুলে যা দেখানো হয় তাতে সিরিয়াস কিছু থাকেও না। আমার দরকারও নাই। আমি সামান্যতেই তৃপ্ত ছিলাম। কিন্তু দিনের পর দিন বিজ্ঞাপনের বাড়ন্ত উৎপাতে আমার নাটক দেখার রুচিই চলে গেছে। প্রথম প্রথম সহ্য করেছি, তারপর পালাতে হয়েছে টিভির সামনে থেকে।

এক সময় বিটিভি ছাড়া আর কোন চ্যানেল ছিল না বাংলাদেশে। একটা নাটক শুরু হবার আগে বিটিভি আমাদের কমপক্ষে পনেরো মিনিট বিজ্ঞাপন গিলিয়ে তারপর এক ঘন্টার নাটক দেখাতো। আটটার খবর শেষ হতো সাড়ে আটটায়। তারপর পনের মিনিটে বিজ্ঞাপন। পৌনে নটায় নাটক শুরু হতো - পৌনে দশটায় শেষ হতো। মাঝখানে একবার দুবার বিজ্ঞাপন থাকতো যদি স্পনসরড নাটক হতো। সেই বিজ্ঞাপনের দৈর্ঘ্য দুই মিনিটের মতো। তাতেই আমরা কত বিরক্ত ছিলাম। একুশে টিভি চালু হবার পর বিজ্ঞাপনের একটু মার্জিত ধারা দেখতে পেয়েছিলাম। একুশে যখন জোট সরকারের হাতে খুন হলো, তারপর বাংলাদেশে চ্যানেলের বন্যা বয়ে গেল। কিন্তু আর কেউ একুশকে ছুতে পারেনি। এখন আবার একুশে ফিরে এসেছে, খোলসটাই আছে কেবল, সেই একুশে আর নেই।

আজকাল অনেক চ্যানেল। অনেক বিজ্ঞাপন। অনেক নাটক। নাটকের বন্যা। নাট্যশিল্পীরা এখন পেশাজীবী। ভালো, খুব ভালো। কিন্তু সেই নাটকগুলো আমাদের কিভাবে গেলানো হয়। একটা নাটক কিভাবে গেলাতে হবে তার কোন নীতিমালা কি সরকারের আছে? নামী নাট্যকার নামী পরিচালক হলে ঠাসা ঠাসা বিজ্ঞাপন, কমদামী নাট্যকার হলে কম কম বিজ্ঞাপন। এরকম একটা অলিখিত নিজস্ব নিয়ম বোধহয় আছে চ্যানেলগুলোর। বিজ্ঞাপন ছাড়া ফ্রী কোন অনুষ্ঠান কী আছে? এমনকি সংবাদও তো বিজ্ঞাপন ছাড়া হয় না। তাও একজন নয়। কয়েকজন মিলে একটা সংবাদকে ভাগ করে নেয়। কোরবানীর ভাগা কিংবা সিগারেট-গাঁজা-বেশ্যা ভাগের মতো। কে আগা খাবে কে গোড়া খাবে এভাবে ভাগ হয়। কেউ প্রধান শিরোনাম, কেউ মাঝখানের অংশ, কেউবা নীচের হেড লাইন, কেউ শেষের শিরোনাম, কেউ বিরতি। আবার কোথাও কোথাও দুটো হেডলাইনও চালু থাকতে দেখেছি নীচের অংশে। ‘আমরা এখন একটা ইষ্টার্ন ব্যাংক বিরতি নিচ্ছি, তার আগে জানিয়ে দিচ্ছি প্রাইম ব্যাংক সংবাদ শিরোনাম’ এরকম ডায়লগ অহরহ। বিজ্ঞাপন বানিজ্য এমন পর্যায়ে পৌছেছে তাকে বেশ্যাবৃত্তি বলতে ইচ্ছে হয় মাঝে মাঝে। এত এত বিজ্ঞাপন তারপরও নাকি কর্মীদের বেতন বাকী থাকে, কী অবিশ্বাস্য!

বিজ্ঞাপনের যন্ত্রণায় টিভি দেখা ছেড়ে দিয়েছি, বাচ্চাদের ভাত খাওয়াতেই টিভিটা ব্যবহার হয়। তবু সেদিন এনটিভিতে ‘হাউসফুল’ শুরু হচ্ছে দেখে কৌতুহল বশত ছোট্ট একটা গবেষনা চালালাম নাটক ও বিজ্ঞাপনের উপর। আসলেই কী বিজ্ঞাপন অতিমাত্রায় অসহনীয় হয়েছে? নাকি আমিই অসহিষ্ণু হয়ে গেছি। দেখা যাক আমার পর্যবেক্ষণে কী দেখা গেল।

১২ মিনিট বিজ্ঞাপন (৮.২৩-৮.৩৪) শুরু
৬ মিনিট নাটক(৮.৩৫-৮.৪০)
১২ মিনিট বিজ্ঞাপন (৮.৪১-৮.৫২)
৬ মিনিট নাটক (৮.৫৩-৮.৫৯)
১২ মিনিট বিজ্ঞাপন (৯.০০-৯.১২)
৬ মিনিট নাটক (৯.১৩-৯.১৮) শেষ

বিজ্ঞাপন এবং নাটক মিলিয়ে মোট সময় লেগেছে ৫৪ মিনিট। তার মধ্যে নাটক ১৮ মিনিট, বিজ্ঞাপন ৩৬ মিনিট। মানে কী দাড়ালো? আমরা কী নাটকের সৌজন্যে বিজ্ঞাপন দেখলাম, নাকি বিজ্ঞাপনের সৌজন্যে নাটক? এটাকে নাট্য প্রতারনা বললে খুব দোষের হবে? প্রতারনা কে করলো, নাট্যকার নাকি চ্যানেল? ব্যাপারটা এমন দাঁড়িয়েছে দয়া করে ওনারা নাটক বানাচ্ছেন, দয়া করে চ্যানেলওয়ালারা দেখাচ্ছেন, তাতেই যেন আমরা ধন্য হয়ে যাই। আমাদের কোন রা নেই। তাই কী? এটা একটা মাত্র উদাহরন। জনপ্রিয় নাট্যকারদের দিয়েই এ ধরনের প্রতারনা করানো হয় বেশী। এক ঘন্টার একটা নাটককে টেনে ছয় পর্বের সিরিজ বানানো হয়। সংশপ্তকের কথা মনে আছে? ওটা এই যুগে তৈরী হলে নিশ্চয় ৫০০ পর্বের মেগা সিরিয়াল হতো। মেগা সিরিয়াল কী?

উপরে যে নাট্যদর্শনের পরিসংখ্যান দিয়েছি সেই নাটকে ৫৪ মিনিট বসে থেকে কী দেখেছি সেটা বলি। নাটকে একটা মেয়ের শরীর খারাপ, ডাক্তার টেষ্ট দিল, টেষ্টের রিপোর্ট নিল, তার মা তাকে ভাত খাইয়ে দিল, তার ভাইও এক লোকমা খেল, মেয়েটার মামা ফোন করে অসুখের খোঁজ নিল, তাদের পাশের ফ্ল্যাটের প্রতিবেশী দাড়ি শেভ করলো, একটা বাচ্চা তাকে পেছন থেকে ভেঙালো। ব্যস এক পর্ব শেষ। চুয়ান্ন মিনিট বসে যদি আপনি কোন নাটকের এইটুকু ঘটনা দেখেন, তখন সেই নাট্যকার বা নাট্যপ্রদর্শক সংস্থাকে সারমেয় কা বাচ্চা বলতে ইচ্ছে হবে না?

এই সব টিভি প্রতারনা/ নাট্য প্রতারনা/বিজ্ঞাপন প্রতারনা দমনের জন্য সরকারের কোন আইন আছে কি? আমি যদি এইসব প্রতারনার বিরূদ্ধে নাগরিক হিসেবে মামলা করতে চাই, আমার পক্ষে কোন উকিল পাওয়া যাবে কী? সদাশয় সরকারের কাছে প্রশ্ন, আপনার কী টিভি চ্যানেলগুলোকে ‘যেমন খুশী তেমন সাজো’র লাইসেন্স দিয়ে দিয়েছেন নাকি নির্দিষ্ট নীতিমালা আছে? যদি কোন নীতিমালা থাকে তাহলে নীতিমালাগুলো মানা হচ্ছে কী না সেটা দেখার টাইম কি আছে মন্ত্রনালয়ের? আপনাদের টাইম না থাকলে নীতিমালাগুলো আমাদেরকে দিন, আমরা স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে সরকারকে রিপোর্ট দেবো এক মাসের মধ্যে।

টিভি চ্যানেলগুলোকে বলছি - আপনারা দয়া করে ডিজিটাল প্রতারনা থেকে বিরত থাকুন। অর্থলোভী কর্পোরেট বানিজ্যের মধ্যে ডুব দিয়ে আমাদের ভুলে যাবেন না। আমরা দর্শক, আমরা কিন্তু জেগে আছি।

কাটা ঘুড়ি

‘বাল্যখেলা’ - মানে বাল্যকালের প্রিয় খেলা। দাবা, লুডু, তাস, কেরাম, ফুটবল, ক্রিকেট, ব্যাডমিন্টনের মতো ভদ্রলোকের খেলার প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি হওয়ার আগে যে খেলাগুলোর প্রতি প্রবল ভালোবাসা ছিল সেগুলোকে বাল্যখেলা বলে ডাকতে চাই আমি। বাল্যখেলার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল ঘুড়ি, ডাংগুলি, মার্বেল, লাটিম, সাত চাড়া, বোমফাইট ইত্যাদি। হাডুডু, দাড়িয়াবান্দাও খেলেছি কখনো কখনো। প্রতিটা খেলার অনেকগুলো প্রকার ছিল, সে লাটিম হোক, কিংবা মার্বেল। সবগুলো আজ মনেও নেই। তবু ভালো লাগার অনুভুতিটা এখনো পুরোনো দিনের শিহরণ জাগায়।

আমার খেলোয়াড় জীবন হলো ব্যর্থতার ইতিকথা। জিতেছি কদাচিত। তবু নেশা হলো নেশা। হেরে যাওয়াও নেশাকে ঠেকাতে পারেনি। আজ বলবো ঘুড়ি নিয়ে নেশার গল্প। ঘুড়ি উড়াতে গিয়ে বহু লাল নীল ঘুড়ি মহাশূন্যে হারিয়েছি। সুতো মান্জা দেয়ার অদক্ষতার কারনে কাটাকাটি খেলায় কখনোই জিততে পারতাম না। তবু ঘুড়ি ওড়ানোর আগ্রহ এতটুকুও কমেনি। কাটাকাটিতে আমার বিন্দুমাত্র আগ্রহ ছিল না। আমার একমাত্র নেশা ঘুড়িটাকে আকাশের সবচেয়ে উঁচু জায়গায় পৌছানো। কাটাকাটিতে আমার আগ্রহ না থাকলেও আগ্রাসন থামানোর কোন উপায় ছিল না। প্রায়ই দেখতাম ঘুড়িটা আকাশে ওড়ার সাথে সাথে কোথা থেকে এক দস্যি ঘুড়ি এসে হাজির। শুরু হতো আকাশ সন্ত্রাস। পায়ে পা লাগিয়ে ঝগড়া শুরুর মতো গোত্তা খেতে খেতে এগিয়ে আসতো আমার নিরীহ ভাসমান ঘুড়িটার দিকে। পালানোর উপায় নেই। নামিয়ে আনার আগেই সন্ত্রাসী ঘুড়ি হুশশ করে নেমে আসতো আমার সুতোর উপরে। মুহুর্তে ঘ্যাচ করে কেটে দিয়ে সরে পড়তো অজানায়। আশে পাশে বেশ কয়েকটা কলোনী থাকাতে সব কলোনী থেকে ঘুড়ি উড়তো। অত উপরে কে গোত্তা দিয়েছে বলাও মুশকিল ছিল। এই অদৃশ্য আততায়ীর কাছে লাল-নীল-সবুজ কত ঘুড়ি যে হারিয়েছি আর বাবার কত বকা খেয়েছি তার ইয়ত্তা নাই।

ঘুড়ি ওড়ানোর মধ্যে আরেক নেশা হলো সুতো কাটা ঘুড়ির পেছনে ছোটা। কতযে কাড়াকাড়ি জাপটাজাপটি হতো এই কাটা ঘুড়ি নিয়ে এখন অবাক হই ভেবে। কারো কারো নিজেদের বাগান ছিল কলোনীতে। প্রায়ই শুনতাম অমুকদের বাগানের আমগাছে একটা ঘুড়ি আপনাআপনি এসে আটকে গেছে, তমুকদের নারকেল পাতায় পাংকি ঘুড়ি দেখা যাচ্ছে। কী যে হিংসে হতো। আফসোস হতো ইশ্ আমাদেরও যদি একটা বাগান থাকতো!! লম্বা সুতো নিয়ে কাটা ঘুড়ি খুজে পাওয়া একটা ভাগ্যের ব্যাপার ছিল। বড়দের মুখে, মানে নাইন-টেনের বড় ভাইদের মুখে প্রায়ই ওসব গল্প শুনতাম। আমরা ফাইভ-সিক্সের পোলাপান ওদের সাথে দৌড়ে পেরে উঠতাম না বলে কখনো অত বড় সুযোগ পাইনি। তাছাড়া কোন ঘুড়ি অলক্ষ্যে কাটা পড়তো না বললেই চলে। একবার ব্যতিক্রম হলো। দুপুর বেলা মাকে ফাঁকি দিয়ে চুপি চুপি দরজা খুলে পেছনের মাঠে যাচ্ছিলাম। হটাৎ সামনের আকাশের দিকে নজর পড়লো। লাল রঙের একটা ঘুড়ি স্থির ভাসছে। একা। কে ওড়াচ্ছে সুন্দর ঘুড়িটা। সুতোর গোড়া খুঁজতে খুঁজতে শেষ মাথাটা যেখানে দেখলাম, সেটা একটা কাঁটাঝোপ। আমার বুকটা ধক ফক করে উঠলো। ঝোপের সাথে আটকে আছে কাটা মাথাটা। এটা একটা কাটা ঘুড়ি। দুর কোথাও থেকে ভাসতে ভাসতে এখানে এসে পড়েছে। দুপুর বেলা বলে কেউ খেয়াল করেনি। এতবড় সুযোগ আর কখনো আসেনি আমার জীবনে। আমি তাই কিংকর্তব্যবিমুঢ়। বেশী দেরী না করে দৌড়ে গিয়ে সুতোটা ধরলাম। অনেক লম্বা। টেনে নামাতে সময় লাগবে। তবু প্রানপনে টানছি আর সুতোগুলো হাতে পেঁচিয়ে নিচ্ছি।

বেশিক্ষন পারলাম না। পাশের তিনতলা দালানের ছাদ থেকে হুংকার এলো। ”ওওওই…ও…ই…ওওওওই…….ওটা ধরবি না, আমরা আগে দেখছি, ছাড় এখনি…., খবরদার ছাইড়া দে, নাইলে মাইর খাবি” ছাদের কিনারায় দাড়িয়ে এসব বকে যাচ্ছে কলোনীর দুই শক্তিমান বড় ভাই। একটা অলিখিত নিয়ম ছিল কাটা ঘুড়ি ধরার ক্ষেত্রে। যার চোখ আগে পড়বে সেই ওটার মালিক। কিন্তু প্রায়ই নিয়মটা লংঘিত হতো যখন ঘুড়িটা আমার মতো পিচ্চিদের চোখে আগে পড়তো। নিয়মের চেয়ে শক্তির জয়ই বেশী হতো। এবারও তাই ঘটতে যাচ্ছে বলে আমি পুরা হতাশ। আমি শিওর যে ওরা আগে দেখেনি এই ঘুড়িটা, আমিই আগে দেখেছি। কিন্তু গায়ের জোরে ছিনিয়ে নিবে এখন। তবে ছাদ থেকে নামতে সময় লাগবে, ঘুরে আসতে হবে চান্দুদের। ছাদের সিঁড়ি বিল্ডিংয়ের ভেতর দিয়ে এবং পথ হলো সামনে দিয়ে। এটা পেছন দিক। আমি তাই নির্ভয়ে হাত চালিয়ে যাই। ওরা আসার আগেই যতটুকু পারা যায়। হঠাৎ দেখি ছাদের কার্নিশ থেকে যে দুইটা পাইপ নীচে নেমেছে, তাতে হাত পা লাগিয়ে বানর দুটো নেমে আসছে তর তর করে। অবিশ্বাস্য! এখুনি ধরে ফেলবে আমাকে। একেই বলে বাড়া ভাতে ছাই। ঘুড়ির বাকী অংশ ছিড়ে রেখে হাতের নগদ পেঁচানো সুতোগুলো নিয়েই দিলাম ভোঁ দৌড়। এক্কেবারে পগার পার। এই ব্যর্থতার জ্বালা অনেকদিন আমাকে তাড়িয়েছে। এখনও চোখে ভাসে লম্বা মান্জা সুতো নিয়ে দুর আকাশে ভেসে থাকা নিঃসঙ্গ সেই কাটা ঘুড়িটা।

আকাশী ভাবনা

সেই আট বছর বয়সে আবদুল্লাহ-আল-মুতির বই থেকে আকাশ নিয়ে কৌতুহলের যে অভিযাত্রা, আজও তা অব্যাহত আছে। ৪০ হাজার কিলোমিটার ব্যাসের কমলালেবুটা লক্ষকোটি জীবজড়প্রানসমেত সেকেন্ডে ২৯ কিলোমিটার গতি নিয়ে সুয্যিমামার চারপাশে যে ঘুরে মরছে তার মায়া ছাড়িয়ে মহাশুন্যে উড়াল দিতে সেকেন্ডে ১১কিমি শক্তি লাগে, কী নিদারুন ভালোবাসা বুকে তার!

বিশ্বের আর কোথাও এমন সুন্দর গ্রহ আছে কি না জানি না, কিন্তু আশেপাশের গ্রহগুলোর চেয়ে পৃথিবীর রূপ যে অনেক বেশী মোহনীয়, লোভনীয় কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু সে রূপের রহস্য কী। সে রূপের কথা কী আমরা মনে রাখি? পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্য কী?

আকাশ। হ্যাঁ আকাশের চেয়ে সুন্দর, আকাশের চেয়ে বড় বন্ধু আমাদের আর কেউ নেই।

এমন সুন্দর নীল আকাশ ত্রিভুবনে কোথাও আছে কি না জানি না। তবে সৌরজগতের অন্য কোন গ্রহে যদি আমাদের জন্ম হতো, তাহলে সারাজীবন বঞ্চিত থেকে যেতাম এমন সুন্দর একটা আকাশ থেকে। চাঁদের আকাশ দেখেছেন? কী কদাকার লাগে কালো আকাশে খরখরে তপ্ত সুর্যের আলো দেখতে। আকাশে মেঘের ভেলা নেই, বাতাসে ফুলের গন্ধ নেই। কী নিদারুন বেরসিক বৈচিত্রহীন জায়গা। ভাবা যায়?

কিন্তু এই নীল আকাশটা এত মূল্যবান তা কি আমরা উপলব্ধি করি কখনো? আকাশ দেখতে পয়সা লাগেনা। রাজপুত্র থেকে ভিখিরি পর্যন্ত সবার জন্য ফ্রী। এত সহজলভ্য বলেই হয়তো আমরা ভুলে থাকি কত মূল্যবান একটা জিনিস আমাদের আছে। আমরা প্রত্যেকেই এটার মালিক। কেউ এককভাবে আকাশ দখল করে বলতে পারবে না, “যাও ভাগো আমার আকাশ থেকে, তৃতীয় বিশ্বের নাদান বালক তুমি, ভিসা দেবো না তোমাকে আমি।”

এমনকি যদি এমনও হতো যে আমাকে ঠিকেট দিয়ে আকাশে মেঘের খেলা দেখতে হবে। তাহলে আমি বোধহয় প্রতি সপ্তাহে টাকা জমাতাম আকাশ দেখার ঠিকেটের জন্য। পৃথিবী আমার প্রিয় বাসভুমি এই নীল আকাশটার জন্যই।

আমাদের এই নীল আকাশটা অনেকগুলো চাদরের সমষ্টি। একটার পর একটা বিছানো। আমাদের নিরাপত্তা বিধানের জন্য। এই চাদরগুলো না থাকলে পৃথিবীটা একদিনেই ধ্বংস হয়ে যেতে পারতো। প্রতিনিয়ত আমাদের উল্কাপাত থেকে রক্ষা করছে এই চাদর। আবার এই আকাশ আমাদের সূর্যের প্রচন্ড তাপের হাত থেকেও রক্ষা করছে, অতিবেগুনী রশ্মিকে পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে ঢুকতে বাধা দিচ্ছে।

কিন্তু এই নীল চাদর বা বায়ুমন্ডলের গঠনটা আমার কাছে খুব রহস্যময়। দেখা যাক কেন।

যাকে আমরা আকাশ কিংবা বায়ুমন্ডল বলছি তা সমুদ্রপৃষ্ট থেকে ১০০০০কিমি পর্যন্ত বিস্তৃত এবং কয়েক ভাগে বিভক্ত। সবচেয়ে উপরের অংশকে বলে Exosphere সবচেয়ে বেশী পুরু ৬৯০ থেকে ১০০০০কিমি পর্যন্ত বিস্তৃত। এখানে বস্তুর উপস্থিতি খুব নগন্য। সুর্যের আলো প্রবেশের প্রথম ধাপ। স্বভাবতই বায়ুমন্ডলের সবচেয়ে বেশী উত্তপ্ত জায়গা। মধ্যাকর্ষনের জোরাজোরি তেমন নেই। বস্তুকনারা স্বাধীন আসা যাওয়া করতে পারে।

আরেকটু নীচে নামলে পাই Thermosphere অঞ্চল। বিশাল জায়গা। ১০০কিমি থেকে ৬৯০কিমি পর্যন্ত বিস্তৃত। এই অংশে তাপমাত্রা কিছুটা কম। অবস্থাভেদে ১৫০০ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড থেকে ২৫০০ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড পর্যন্ত হতে পারে। এই কম(!) তাপেও লোহা গলে যাবে। এই লেভেলটা সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ন অঞ্চল আমাদের জন্য। পৃথিবীর তথ্য প্রবাহের প্রধান সড়ক এটি। সমস্ত যোগাযোগ উপগ্রহের বাসস্থান এখানে। এই লেখাটাও হয়তো ওই সড়ক ধরে আপনাদের কাছে পৌছাবে।

পরের লেভেলে নামা যাক। এটার নাম Mesosphere এটি প্রায় ৩৫ কিমি পুরু। তাপমাত্রা এখানে হঠাৎ করে মাইনাস ১০০-তে নেমে গেছে। এটা একটা আশ্চর্য ব্যাপার। মুলতঃ এই চাদরটার কারনেই আমরা বেঁচে আছি এখনও। বহিঃজগতের উল্কা-টুল্কাগুলো এই ঠান্ডা চাদরের কবলে পড়েই খাবি খেতে খেতে নিভে যায়। রাতের আকাশে তাকালে মাঝে মাঝেই এসব জ্বলতে জ্বলতে পড়া আতশবাজি চোখে পড়বে।

পরের চাদরটার নাম Stratosphere, এটা ৩০কিমি ঘনত্ব বিশিষ্ট। ২০ থেকে ৫০কিমি অঞ্চলে অবস্থিত। এখানে তাপ বাড়তে শুরু করেছে আবার। মাইনাস ৩ ডিগ্রী। এই লেভেলটার সবচেয়ে উপকারী কাজ হলো পৃথিবীকে সূর্যের অতিবেগুনী রশ্মি থেকে আমাদের রক্ষা করা। হ্যাঁ, বহুল কথিত ওজোন স্তর এখানেই অবস্থিত।

সর্বনিন্ম অর্থাৎ পৃথিবীর সবচেয়ে নিকটতম চাদর হলো Trophosphere সমুদ্রপৃষ্ট থেকে ৭কিমি থেকে ২০কিমি উচ্চতার মধ্যে এর অবস্থান। আকাশের দৃশ্যমান সকল সৌন্দর্য এই অঞ্চলেই অবস্থিত। সকল কবিতা-গান-বিরহ-প্রেম, রাশি রাশি মেঘমালা, সবকিছু। এই আকাশের প্রেমেই মশগুল আমরা। সবচেয়ে বৈচিত্রময় অঞ্চল এবং বায়ুমন্ডলের তিন-চতুর্থাংশ বস্তুর অবস্থানও এখানে। Trophosphere এলাকায় মজার ব্যাপার হলো তাপমাত্রা এখানে উচ্চতার সাথে সাথে পরিবর্তিত হয়। ৬-১১কিমি লেভেলে নীচ থেকে যত উপরে উঠবেন প্রতি কিলোমিটারে ৬.৫ডিগ্রী করে তাপ কমতে থাকে। আবার ১১-২০কিমি লেভেলে তাপ স্থির মাইনাস ৫৬.৫ ডিগ্রীতে।

আমার সবচেয়ে অবাক লাগে বায়ুমন্ডলের চাদরে চাদরে তাপের ওঠানামা। একদম সমুদ্রপৃষ্ট থেকে যদি ধরি, তাহলে পৃথিবীপৃষ্ঠে গড় ১৫ডিগ্রী থেকে শুরু। তারপরঃ
১১-২০কিমি = - ৫৬.৫ ডিগ্রী
২০-৫০কিমি = -৩ ডিগ্রী
৫০-৮৫কিমি = -১০০ডিগ্রী
৮৫-৬৪০কিমি = +১৫০০ ডিগ্রী

বিস্ময়ের ব্যাপার না? সুর্যের আলো ছাড়া পৃথিবীর সবকিছু অচল। আবার সেই সুর্যের তাপে যেন আমরা ঝলসে না যাই সেজন্য কী চমৎকার ব্যবস্থাপনায় ঠান্ডা গরমের চাদর দিয়ে সহনশীল তাপমাত্রা সৃষ্টি করা হয়েছে পৃথিবীতে। এখানেই নীড় সন্ধান করি তাই চিরকাল। ফিরে ফিরে আসতে চাই এই নীলাকাশ শোভিত পৃথিবীতে। আকাশের কাছে আমরা কৃতজ্ঞ।

আদার বেপারীর পাট চিন্তা

আমি আদার বেপারীও না জাহাজের কারবারীও না। যদিও রপ্তানী বানিজ্যের সাথে সরাসরি কাজ করছি দীর্ঘদিন ধরে, পাটের কারবার করার সুযোগ হয়নি কখনো। আমার রপ্তানী চাপাবাজি শুনে এক বন্ধুর ধারনা হয়ে গেছে আমি বাংলাদেশের রপ্তানী বিষয়ে একজন দিকপাল। তাই সে কোনরকম রপ্তানীর সংবাদ পেলেই আমাকে ফোন দেয় সবার আগে। তৎমাফিক কয়েক বছর আগে একটা ইউরোপীয়ান কোম্পানী বাংলাদেশ থেকে পাটজাত পন্য আমদানীতে আগ্রহের কথা শুনে বন্ধু খবরটা দিল জরুরী বার্তায়। পাট বানিজ্য সম্পর্কে আমার তেমন জানাশোনা নাই। তবু বন্ধুর গুতানিতে তাৎক্ষনিক ভাবে সুযোগ নেয়া যায় কিনা দেখার জন্য আমি খোঁজ নেয়া শুরু করি। আমার লাইনের কারো কাছে পাট বানিজ্যের কোন খবর নেই দেখে গুগল সার্চ দিলাম। কিন্তু অনুসন্ধানের ফলাফল দেখে আমি হতাশ। বাংলাদেশ নামক একটা দেশে যে বিপুল পরিমান পাট উৎপাদিত হয় ও রপ্তানী হয় তার কোন চিহ্ন দেখলাম না গুগল অনুসন্ধানে। ওখানে পাট নিয়ে যত ওয়েব সাইট দেখা গেল সব ভারতীয়। বাংলাদেশের কোন নাম নিশানা নেই পাটজাত পন্য সম্পর্কিত অনুসন্ধান তালিকায়। আশ্চর্য ব্যাপার তাই না? একমাত্র বিজেএমসি ছাড়া আর কোথাও কোন তথ্য পাওয়া যায় না পাট সম্পর্কে। আঁতিপাতি খুঁজে যত তথ্য পাওয়া গেল সব হলো কাঁচামাল পাটের খবর। পাটজাত পন্যের কোন এমন কোন কোম্পানী পাইনি যেখান থেকে পাটের তৈরী পন্য ক্রয় করে রপ্তানী করতে পারি। পাটজাত পন্য রপ্তানী করার মতো উল্লেখযোগ্য একটা প্রতিষ্ঠানও কী বাংলাদেশে নেই?

পাট নিয়ে মনজুরুল হকের সাম্প্রতিক একটা লেখা পড়ে নিজের অভিজ্ঞতাটুকু শেয়ার করলাম। ভেবে কষ্ট লাগে আমরা বছর বছর পাট রপ্তানী করেছি ঠিকই, কিন্তু পাটের উন্নয়নে বৃটিশদের রেখে যাওয়া প্রযুক্তির বাইরে কিছুই করিনি। গত বিশ বছরে কতগুলো পাটকল বন্ধ করে দেয়া হয়েছে তার হিসেব করলে মাথা ঘুরে ওঠে। আমাদের পাটকলগুলো বন্ধ হয়ে যায়, আর ভারতে নতুন নতুন পাটকল গড়ে উঠে। পাটশিল্প টিকিয়ে রাখার দায়টা কার? পাটশিল্পের ব্যর্থতার দায়ভার কার- কৃষকের, শ্রমিকের, প্রযুক্তির নাকি ব্যবস্থাপনার? গভীর ভাবে ভেবে দেখা উচিত এই বিষয়টা।

পাটশিল্প উন্নয়নে ভারত যা করেছে আমরা কী তা করেছি? এমনকি করার চেষ্টা ছিল কিনা সেটার উত্তরেও বিরাট প্রশ্নবোধক চিহ্ন। সারা বিশ্বের পাট উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান বরাবর এক নম্বরে ছিল । অথচ বিগত কয়েক বছরে ভারত বাংলাদেশের জায়গা দখল করেছে। ২০০৮ সালে বাংলাদেশ পাট উৎপাদন করেছে ৮ লাখ টন, আর ভারত করেছে ২১ লাখ টন। পাটশিল্পে পিছানোর প্রতিযোগিতায় আমরা এগিয়ে আছি।

জাতিসংঘ ২০০৯ সালকে International Year of Natural Fibres ঘোষনা করেছে। পাট অন্যতম একটি Natural Fibre। বাংলাদেশে পাট মন্ত্রনালয়ের কী কোন ভুমিকা আছে? পাট মন্ত্রনালয়ের যে ওয়েবসাইট আছে তা অপ্রবেশ্য। পাট গবেষনা কেন্দ্রের ওয়েবসাইটেরও একই অবস্থা। এতেই বোঝা যায় পাট বিষয়ে আমাদের মনযোগ কতটুকু।

পাট মন্ত্রনালয়ের ওয়েবসাইট http://www.motj.gov.bd/jute/index.html
পাট গবেষনা কেন্দ্র http://www.bangladesh.gov.bd/bjri/

অদুর ভবিষ্যতে বাংলাদেশে পাটের অবস্থা নিয়ে নীচের ভবিষ্যতবানী করা যায় কিনাঃ

১) পাট খুব শীঘ্রই ইতিহাস হয়ে যাবে
২) আমরা পাটজাত পন্য আমদানী শুরু করবো

গ্রামীন ব্যাংক ও ডঃ ইউনুস

ব্লগে সম্প্রতি ডঃ ইউনুস এবং গ্রামীন ব্যাংক নিয়ে কয়েকটা লেখা পড়ার পর আমাদের গ্রামে গ্রামীন ব্যাংকের দুজন গ্রাহকের অভিজ্ঞতা শেয়ার করার লোভ সামলাতে পারলাম না।

১. মর্জিয়া বেগম গৃহবধু। গ্রামীন ব্যাংক থেকে সেলাই মেশিন কেনার জন্য ৩ হাজার টাকা ঋন নিয়ে শখের টিভি কিনে ফেলেছিল বলে কিস্তির টাকা পরিশোধে সমস্যায় পড়ে। কারন টিভি থেকে কোন আয় বের হয় না। গ্রামীন ব্যাংক কিস্তি পরিশোধে ক্রমাগত চাপ দিলে দলের অন্যন্য সদস্যদের সহায়তায় তার বড় ভাই বাড়তি সময় নিয়ে কিস্তির টাকা পরিশোধ করে। টাকা না পেয়ে টিনের চালা বা গরু বাছুর নিয়ে যাবার মতো পরিস্থিতি হয়নি। হয়তো ব্যাপারটা আপোষে সমাধা হয় বলে তেমন সমস্যা দেখা দেয়নি। কিন্তু যদি না হতো? টাকা পরিশোধ না করলে গ্রামীনব্যাংক কর্মী কী করবে? আমরা বাড়ী করার জন্য ঋন নিয়ে সময়মতো ঋনের টাকা পরিশোধ না করলে তফসিলী ব্যাংক বা হাউস বিল্ডিং ফাইনান্স কী করে? বাড়ী দখল করে বা নিলামে তোলে। গ্রামীন ব্যাংকের ঋন পরিশোধ না হলে ব্যাংক কর্মী কী করবে? গরীব মানুষের সামান্য টাকা, তাই সেই টাকা মওকুফ করে দেবে? করা যায়? বলতে পারেন কিছু কিছু মওকুফ করে দেয়া যায়। কিন্তু কয় জনকে মওকুফ করবে? মওকুফ করার নিয়ম থাকলে টাকা নিয়ে কেউ কি ফেরত দেবে? আপনি দেবেন? আমি দেবো?

২. নুর মোহাম্মদ রিকশা চালায় আর বউ গেরস্থালি কাজ করে। তারা দুজন গ্রামীন ব্যাংক ও আরো কয়েকটা এনজিও থেকে ঋন নিয়ে বাড়তি আয়ের জন্য এটা সেটা করে। তাদের দুই সন্তান। ছেলেটা এসএসসি পাশ করেছে, মেয়েটা প্রাইমারীতে। ছেলের মামা দুবাইতে চাকরী করে, সে জানিয়েছে দুবাইতে অটোমোবাইল ইন্জিনিয়ারের খুব দাম। তাই নুর মোহাম্মদ ছেলেকে অটোমোবাইল ইন্জিনিয়ার বানাবার স্বপ্ন দেখে। গত বছর সে গ্রামীন ব্যাংক থেকে বিশ হাজার টাকার ঋন নিয়ে তার ছেলেকে চট্টগ্রাম শহরের মুরাদপুরে একটা প্রাইভেট টেকনিক্যাল কলেজে ভর্তি করিয়েছে দুবছরের অটোমোবাইল কোর্সে। ছেলে পাশ করে দুবাই গেলে তার কষ্ট লাঘব করবে। ছেলে এবছরের শেষে বের হবে। হয়তো তাঁর স্বপ্নপূরন হবে। এদিকে গ্রামীন ব্যাংকের ঋন পরিশোধ না করলে মুশকিল। কিভাবে পরিশোধ করবে? তার উপায়ও সে ভেবে রেখেছে। রিকশা চালিয়ে সে কিছু টাকা জমিয়েছে, বাকী টাকা আরেকটা এনজিও থেকে নিয়ে পরিশোধ করবে। এভাবেই এদিকের মাল ওদিকে দিয়ে সে ম্যানেজ করে। কিন্তু গ্রামীন বা সেরকম প্রতিষ্ঠান যদি না থাকতো, তাহলে সে কীভাবে ছেলেকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতো। তার ছেলেও হয়তো রিকশা চালাতো।

উপরে ঋন বিষয়ে দুজনের ক্রিয়া ভিন্ন কিন্তু প্রতিক্রিয়া এক। মর্জিয়া বেগম এবং নুর মোহাম্মদ দুজনকেই জিজ্ঞেস করেছিলাম গ্রামীন ব্যাংক নাকি টাকা ফেরত না দিলে অত্যাচার করে। দুজনেই হাসলো। ওদের বক্তব্যটা মোটামুটি এরকম, ‘শুধু গ্রামীন ব্যাংক না, যে কোন এনজিওর টাকা ফেরত না দিয়ে উপায় আছে? ঋন নিবেন কিন্তু ফেরত দিবেন না তাইলে কী আপনেরে আদর করবো? কেউ করে? বরং মহাজনের অত্যাচারের চেয়ে এরা হাজারগুন ভালো।’ ওরাও মনে করে না গ্রামীন ব্যাংক অযৌক্তিক কাজ করছে। বরং একটা উসিলা করে আপদে বিপদে টাকা পাওয়া যায় সেটাই বড় কথা। এই দুজনের কথা শুনে গ্রামীন ব্যাংকের নির্যাতন নিয়ে যারা হৈচৈ করে তাদের গ্রামীন ব্যাংক সম্পর্কে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা নেই বলে মনে হয়।

তবে অবিচারের ভিন্নচিত্রও থাকতে পারে, আছেও। কিন্তু সেটা তো সামগ্রীক চিত্র নয়। বিচ্ছিন্ন কিছু চিত্র দিয়ে এতবড় একটা প্রতিষ্ঠানের বিচার করা যায় না। গ্রামীন ব্যাংক এত জনপ্রিয় হলো কেন, তারা কী মানুষকে জোর করে ঋন গেলাচ্ছে? এতটা খারাপ দৃষ্টান্ত থাকলে মানুষতো গ্রামীন ব্যাংক থেকে ১০০ হাত দুরে থাকার কথা। বাস্তবতা কী তা বলে? আসলে পেশাদারী দৃষ্টিতে দেখলে জামানতবিহীন ঋন কখনো ৯৯ ভাগ আদায় হবে না যদি ঋন পরিশোধ করার একটা চাপ না থাকে। গ্রামীন ব্যাংক কি একটা দাতব্য প্রতিষ্ঠান না পেশাদারী ঋনদাতা সংস্থা? তবে টিনের চালা খুলে ফেলার ঘটনাকে যারা উদাহরন হিসেবে নেয়, তাদের বলি সেই নির্দেশ নিশ্চয়ই ইউনুস দেননি, সেটা কোন রগচটা মাঠকর্মীর তাৎক্ষনিক প্রতিক্রিয়া। মানুষ কত রকমই হতে পারে। সেটার দায় প্রতিষ্ঠানের উপর পড়ে ঠিকই, কিন্তু সেটা দিয়ে একজন ডঃ ইউনুসের বিশাল কর্মযজ্ঞকে বিচার করা যায় না।

ডঃ ইউনুসের বিরুদ্ধে বেশ কিছু অভিযোগ আমারও আছে, নোবেল পাওয়ার পর তাঁর অনেকগুলো আচরন আমার বেখাপ্পা লেগেছিল। নিজের ওজন হালকা করার মতো বেশ কিছু হুজুগে বক্তব্য দিয়েছিলেন। তার উপর বিতর্কিত ইয়াজউদ্দিন সরকারকে একরকম স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। দেশের প্রবল সংকট তিনি নোবেল উচ্ছ্বাসে ভুলতে বসেছিলেন। দেশ তাকে অভিভাবক মনে করতো, সেই ভুমিকা তিনি রাখতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। ২০০৬ সালে আমি তার কঠোর সমালোচনা করে বেশ কিছু লেখা লিখেছিলাম। কিন্তু তার মানে এই নয় তার সব কীর্তিকে অস্বীকার করতে হবে সমালোচনাকে জায়েজ করার জন্য। যার যা প্রাপ্য তা দেয়াটাই ন্যায়পরায়নতা।

কন্যার সাথে শহীদ মিনারে

২০-২১ ছুটির দুদিন কক্সবাজার থাকার কথা থাকলেও প্রচন্ড ভীড় হবার আশংকায় শেষ পর্যন্ত মত পরিবর্তন করে বাসায় পরিবারের সাথেই ছুটিটা কাটানোর পরিকল্পনা করি। দুদিন পুরোপুরি আমার কন্যার জন্য বরাদ্দ করলাম, বাইরে কোথাও যাবো না। আড়াই বছরে পড়েছে এখন ওশিন। বয়স বাড়ার সাথে সাথে কন্যা নাকি অধিক পিতৃভক্ত হয়ে উঠছে, অভিযোগ আমার গিন্নীর। যদিও একমাত্র কন্যা হিসেবে যতটুকু আদর প্রাপ্য তার সাথে শাসন চড় চাপড়ও সমান তালে চলে। কন্যার হাতও থেমে থাকে না বরং গুনিতক হারে ফিরে আসে, কখনো দ্বিগুনিতক, কখনো ত্রিগুনিতক। আমার মুখমন্ডলে মাঝে মাঝেই তার ক্ষত বিক্ষত চিহ্ন দেখা যায়। কিন্তু আমাদের এই প্রাইভেট যুদ্ধদৃশ্য বাইরের কেউ দেখে না বলে বিশ্বাস করে না একটা শিশু কতটা হিংস্র হতে পারে আদর করতে গিয়ে। চুমুর সাথে কামড় বোনাস, চুলটানার সাথে খামচি এসব নিত্য ঘটনা। বিনিময়ে আমি দুচারটা চড় চাপড় দিলে আমার দোষ হয়ে যায়। আমার অভিযোগ কেউ নেয় না আমাকেই উল্টো অধিক শাসনের অভিযোগে অভিযুক্ত করে। সুতরাং যুদ্ধ এবং বিচার দুটোতেই কন্যা আমার অপরাজিতা।

প্রতিদিন সন্ধ্যায় অফিস থেকে ফিরে চা খেয়ে ৪ কিমি পদব্রজে সান্ধ্যভ্রমনে বেরুতে হয় ডাক্তারী নির্দেশে। ইদানীং সেখানেও হাত পড়েছে কন্যার। কোন কোনদিন টি-শার্টের কোনাটা খামচে ধরে আদুরে হুকুম জারি করে - “থাকোওওও… নাআআআ…… আমার সাথে!!” এই থাকা মানে ওর সাথে সাথে থেকে মারামারি-খামচাখামচি করা, অতঃপর কান্নাকাটি, বিচার এবং সেই বিচারে আমার হেরে যাওয়া, এসব আমার কন্যার বিশেষ প্রিয়।

একুশের সকালে নটায় ঘুম থেকে উঠে নাস্তা করে টিভিতে শহীদ মিনারের লাইভ দেখাছিলাম। অনেক বাচ্চারাও শহীদ মিনারে ফুল দিচ্ছিল ভীড় ঠেলে ঠেলে। ওশিন চুপচাপ দেখলো কিছুক্ষন, তারপর সেই বিষয়ে প্রশ্নমালা শুরু। যেই বিষয়ে প্রশ্ন শুরু করবে সেই বিষয়ে আপনার সম্পূর্ন জ্ঞান নিষ্কাষিত না হওয়া পর্যন্ত থামবে না মেয়েটি। এত বাচাল। শহীদ মিনারে ফুল নিয়ে প্রশ্নোত্তর পর্ব শেষ হবার পর আমার কন্যা ঘোষনা করলো সেও যাবে “শহী-মিনায়ে” এবং ফুল দেবে ওখানে। খাইছে, আমি ভাবছিলাম এবছর শহীদ মিনার এলাকা এড়িয়ে চলবো, আগের দিন যে বোমাবাজি দেখলাম টঙ্গীর পুলিশ সুপারের অফিসে, ভীড় এলাকা নিরাপদ না। জঙ্গী উৎপাত আবারো। এখন মেয়ে বলে কিনা শহীদ মিনারে যাবে। একবার বলেছে যখন না করলে আমার জান খেয়ে ফেলবে সারাদিন। সময় নষ্ট না করে চট করে রেডী হয়ে গেলাম। বললাম - চল যাই। বেরুবার আগে সে তার মা আর দাদীকে মুরব্বীসুলভ স্বরে শান্ত্বনা দিয়ে বললো- ‘তোমাদেরকে পরে নিয়ে যাবো, আরেকদিন, ঠিক আছে?’। মা দাদী দুজনে হাসি চেপে বললো - ঠিক আছে।

রিকশা নিলাম একটা। পথে পথে সব দালানে জাতীয় পতাকা উড়ছিল। ওশিন চিৎকার দিল - বাবা দেখো, পতাকা। আমি বললাম হ্যাঁ পতাকা। আরেকটু গেলে আরো পতাকা দেখা গেল। ও প্রতিবার চেঁচিয়ে বলে -পতাকা। আমার খুব ভালো লাগলো মেয়ের জাতীয় চেতনা দেখে। মিনিট পাঁচেক পর নতুন দাবী। ‘বাবা আমি পতাকা নেবো।’ আমি এখন পতাকা কোথায় পাই?

শহীদ মিনারের কাছাকাছি গিয়ে রিকশা থেকে নেমে যেতে হলো। হাঁটতে হাঁটতে দেখলাম ফেরীওয়ালা ছোট ছোট পতাকা বিক্রি করছে। একটা কিনে মেয়ের হাতে দিলাম। খুব খুশী আমার মেয়ে। শহীদ মিনারে প্রচন্ড ভীড় ঠেলাঠেলি বলে আমরা পাশেই থিয়েটার ইনষ্টিটিউটের চত্বরে ঢুকে গেলাম। এখানটা নিরিবিলি এবং শহীদ মিনারটা দেখা যায়। আমি কোলে করে দেখালাম শহীদ মিনার ও ফুলের স্তুপ। পেছনে খাড়া পাহাড় উঠে গেছে। সামনে বিশাল বাগান। সবুজের ছায়া। খুব ভালো লাগলো। ওশিন পতাকা নিয়ে ছুটোছুটি করছে চত্বরে।

একটু পর ফিরে এসে পাশে বসা তিন তরুনীর দিকে ইশারা দিয়ে বলে, ‘বাবা ওরা কী খায়?’
আমি তাকিয়ে দেখি, ওরা আচারজাতীয় টক ঝাল কিছু খাচ্ছে। আমি বললাম, ‘ওরা পঁচা খায়’। দমাতে চাইলাম ওকে।
কন্যা আমার সহজে দমার নয় - ‘আমিও পচা খাবো’ বলে চিৎকার জুড়ে দেয়ার উপক্রম।

এমন সময় সামনের রাস্তা দিয়ে একটা মিছিল এলো শ্লোগান সহকারে। টিফা চুক্তি মানি না, মানবো না। এক হও এক হও ইত্যাদি ইত্যাদি। আমি বললাম, ‘ওই যে দেখো মিছিল, চলো আমরা মিছিল করবো।’ ওকে কোলে নিয়ে চট করে মিছিলের লাইনে ঢুকে গেলাম। ওশিন পতাকা নেড়ে নেড়ে মিছিলের সাথে সায় দিল। আপাততঃ ভুলে থাকলো আচারের কথা। সাময়িক হলেও আচারের চেয়ে মিছিল যে ওর ভালো লাগলো সেটাই বা কম কী।

পিলখানা হত্যাকান্ড নিয়ে একটা সংক্ষিপ্ত বিশ্লেষন

পিলখানা হত্যাকান্ড নিয়ে একটা সংক্ষিপ্ত এবং আনুমানিক বিশ্লেষন।

প্রধানতঃ দুটো দল ঘটনার সাথে যুক্ত থাকতে পারে। প্রথম দলটা ‘কাভার’, দ্বিতীয় দলটা ‘ষ্ট্রাইকিং ফোর্স’। প্রথম দলটা বৈষম্য বঞ্চনা ইত্যাদিতে দীর্ঘদিন ক্ষুব্ধ ছিল। দ্বিতীয় দলটা একটা উদ্দেশ্য সাধনে সুযোগের সন্ধানে ছিল। প্রথম দল দ্বিতীয় দলের আসল পরিচয় উদ্দেশ্য সম্পর্কে কিছু জানে না। দ্বিতীয় দলটা আসল উদ্দেশ্য গোপন রেখে প্রথম দলের ক্ষোভের সাথে তাল মেলালো। দাবী আদায়ের নামে প্রথম দলকে ফ্রন্টলাইনে পাঠিয়ে ঘটনার সুত্রপাত করলো এবং পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী দ্বিতীয় দল গিয়ে ডিজিসহ প্রথম ধাক্কায় ১১ জন অফিসারকে হত্যা করলো।তারপর বাকীদেরকে খুজে খুজে হত্যা করলো।

কিন্তু দেশবাসীকে কৌশলে জানানো হলো বৈষম্য, বঞ্চনা, অবিচারের বিরুদ্ধে জমে থাকা ক্ষোভ বিষ্ফোরিত হয়ে বিডিআর সেনারা বিদ্রোহ করেছে, সেনাবাহিনীর দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষনা করেছে, দরবার হলে ডিজিসহ বেশ কয়েকজন অফিসারকে জিম্মি করেছে দাবী আদায়ের জন্য। টিভিতে বিদ্রোহী সৈন্যদের বক্তব্য প্রচারের পর জনসহানুভুতিও বাড়তে লাগলো বিদ্রোহের প্রতি। সরকারের প্রতিনিধি ভেতরে গেল আলোচনা করে ফিরে এল। আবার বিদ্রোহীদের ১৪ জন প্রতিনিধি প্রধানমন্ত্রীর সাথে দেখা করে দাবি দাওয়া দিল। সরকার দাবি মেনে সহানুভুতির সাথে সাধারন ক্ষমা ঘোষনা করলো বিদ্রোহীদের প্রতি। কিন্তু অস্ত্র সমর্পনে গড়িমসি করতে দেখা গেল। রাত কেটে গেল প্রহসনে। পরের দিনও যেতে লাগলো সমাধান ছাড়া। সেনাবাহিনীর ট্যাংক বহর রওনা দেবার খবর পেয়ে সাদা পতাকা উড়িয়ে দিল বিডিআর।

ততক্ষনে দ্বিতীয়পক্ষ উদ্দেশ্য হাসিল করে ফেলেছে। তারা শ খানেক মেধাবী অফিসারকে খুজে খুজে হত্যা করে ফেলেছে। হয়তো সে সময় প্রথম দলকে লুটপাটের দিকে লেলিয়ে দিয়ে দ্বিতীয় দল লাশগুলো কিছু নর্দমায় কিছু গনকবরে ঢুকিয়ে দেয়। হয়তো প্রথম দল জানেও না কতজনকে হত্যা করা হয়েছে। হয়তো যখন জেনেছে তখন দেরী হয়ে গেছে। মুখে রুমাল দিয়ে টিভিতে বিক্ষোভ দেখানো মুখগুলো মনে হয় প্রথম দলের বোকা বিপ্লবীদের। দ্বিতীয় দলের চেহারা বোধহয় মিডিয়ার কোথাও দেখা যায় নি, যার ঘটনা ঘটায় তারা সবসময় আড়ালেই থাকে। এটা বাংলাদেশের ইতিহাসে অন্যতম বৃহত্তম দুঃসাহসী হত্যাকান্ড। হত্যাকান্ড শেষে তারা সামরিক পোষাক খুলে তৈরী ছিল পালিয়ে যাবার জন্য। সংলাপের দরকষাকষির প্রহসনের অবকাশে প্রথম দলের হাতে সাদা পতাকা দিয়ে দ্বিতীয় দল পগার পার, এবং এরপর প্রথম দলের বিচক্ষনেরাও পালিয়ে যায়। যে দুইশজনকে শেষ পর্যন্ত ওখানে পাওয়া গেছে ওরা প্রথম দলের সর্বোচ্চ বোকারা যাদের পালানোর মতো বুদ্ধিও অবশিষ্ট ছিলনা। প্রথম দল ছিল বোকা বিপ্লবী, যাদের মাথায় নুন রেখে বরই খেয়ে চলে গেছে অন্য একটা ভিন্ন মিশনে থাকা দ্বিতীয় দলটি। সেটির অস্তিত্ব খুজে বের করা দুষ্কর হবে।

কারা কারা এই ঘটনার সাথে জড়িত? শুধুই বিডিআর জওয়ান? সেনা অফিসারদের কেউ কী জড়িত থাকতে পারে না যারা ভিন্ন বিশ্বাসে লালিত? বাংলাদেশের জন্মে যারা অবিশ্বাস করে, তেমন মোনাফেক সেনা অফিসার কী নেই? কতজন তারা? কারা সেই অফিসার যাদের জন্য বাংলাদেশের কোন সেনানিবাসে সকল প্রগতিশীল প্রত্রিকার প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল? এই চক্রান্তের শিকড় আরো কত গভীরে লুকিয়ে আছে। নাট্যচিত্রের আংশিক বাস্তবায়নেই বাংলাদেশ বিপর্যস্ত, বাকীটা কোন মঞ্চে বাস্তবায়িত হবে? সেনাকুন্ঞ্জে না সংসদ ভবনে? মোনাফেক মীরজাফর পরিবেষ্টিত বাংলাদেশে কোন স্থান নিরাপদ নয়, সেটা বুঝতে বাকী নেই আর। এই ঘটনা ভেতরের কেউ না কেউ পূর্বেই জানতো, হয়তো কোন কোন অফিসারও অবগত ছিল। সেদিনের অনুষ্ঠানে অনুপস্থিত ছিল কোন কোন অফিসার? তাদের চিহ্নিত করা সম্ভব? সম্ভব হলে কিছু তথ্যসুত্র সেখান থেকেই বেরুতে পারে।

পিলখানা হত্যাকান্ডের সেই শকুনদের, তার পেছনে থাকা শকুন চালকদের, তার পেছনের পরিকল্পকদের খুজে বের করে নিকেশ করতেই হবে, নাহলে বাংলার মাটি এভাবে রক্তে লাল হতেই থাকবে বারংবার। বাংলাদেশের সবচেয়ে শক্তিশালী অংশে ছোবল মেরেছে শকুনের দলটি। তবে পাল্টা ছোবল মারতে হুশিয়ার হতে হবে সেনা বাহিনীকে। এমনিতেই ক্ষতি যথেষ্ট হয়েছে, পাল্টা ছোবল ভুল মানুষের উপর পড়লে, মজা লুটবে ৩য় পক্ষ। ৭৫ থেকে এ পর্যন্ত বাংলাদেশের সবগুলো সামরিক ঘটনায় লাভবান হয়েছে ৩য় কোন একটা পক্ষ। এবারও যেন তার পুনরাবৃত্তি না হয়।

নববর্ষ যদি শুরু হতো ফাল্গুনে বা অঘ্রানে?

একটা আজগুবি চিন্তা মাথায় এলো। বাংলা মাসের সিরিয়ালে পরিবর্তনের চিন্তা। গতকাল মধ্য এপ্রিলের প্রচন্ড দাবদাহ উপেক্ষা করে রোদে জ্বলে পুড়ে নারী-পুরুষ- শিশু-বৃদ্ধ সবাই মিলে যেভাবে পহেলা বৈশাখ উৎসবে ঝাঁপিয়ে পড়তে দেখলাম, তাতে মাথার ভেতরে চিন্তাপোকাটা বললো সময়টা যদি একটু শীতময় হতো, আহা- কতো মজা করে এই উৎসবটা পালন করতে পারতো এরা। বাঙালী মধ্যবিত্তের সবচেয়ে বড় উৎসব এই পহেলা বৈশাখ। কিন্তু এই উৎসব পালন করতে গিয়ে গরমে ঘেমে নেয়ে বিশ্রী অবস্থা। মেয়েদের অবস্থা বেশী শোচনীয়। এই উৎসবকে আরেকটু আনন্দময় করতে, আরামদায়ক করতে আমরা কী করতে পারি?

বিধাতার কাছে হাত তুলে প্রার্থনা করতে পারি, “হে খোদা আমাদের সবাইকে এসি গাড়ীর মালিক করে দাও তাহলে আমরা আরামে সারাদিন ঘুরে বেড়াতে পারবো।” আচ্ছা, বিধাতা নাহয় দিলোই এসি গাড়ী দিয়ে বড়লোক বানিয়ে। কিন্তু উৎসবে-মিছিলে-নাচে-গানে যোগ দিতে হলে তো এসি গাড়ীতে বসে থাকলে চলবে না। বাইরের গরমের আগুনে হলকা হজম করতেই হবে। আবারো বিধাতার কাছে আবেদন করতে হবে- “হে খোদা আমাদের হাটে মাঠে ঘাটে শীতল পরশ ঢেলে দাও। কিন্তু বিধাতার এই প্রস্তাবে রাজী হবার সম্ভাবনা কম। কারন আশেপাশের অন্য দেশ এতে আপত্তি জানাতে পারে।

তবে নববর্ষ পালনের সময়টা যদি একটু শীতের দিকে হয়, পহেলা ফাল্গুনে বা অগ্রানে যেরকম হালকা শীতের পরশ থাকে, তেমন চমৎকার দিনে যদি নববর্ষের উৎসব হয়, ভাবুন তো কেমন জমতো? বিধাতার কাছে একটু ঠান্ডা পরশের জন্য কেঁদে মরতে হতো না। বিধাতা তো নানান রকম ঋতু আমাদের দিয়েই রেখেছে, আমাদের দরকার সুবিধামতন বেছে নেয়া। যদি বৈশাখ মাসকে একটু শীতের দিকে এগিয়ে নেয়া যেত কিংবা শীতের দিকের কোন মাস দিয়ে বছর শুরু করা যেত, তাহলে? ফাল্গুন কিংবা অগ্রহায়নে যদি শুরু হয় বাংলা বছর, কেমন হয়? প্রস্তাবটা বেশী আজগুবি লাগে? লাগলে লাগুক। তবু গরমে হাসফাস করা নববর্ষকে আরেকটু আরামদায়ক করার জন্য বর্ষশুরু মাস পরিবর্তনের এই সুবিধাজনক আফাইট্টা প্রস্তাব করছি আমি। পোকাটা মাথার ভেতরে ঢুকেছে বাংলা সনের উৎপত্তির ইতিহাস পড়তে গিয়ে। নীচে খানিকটা দিলাম-

“আকবর নতুন সনপদ্ধতি চালু করার আগে বঙ্গে শক বর্ষপঞ্জি ব্যবহৃত হতো। অনুমান করা হয়, শক রাজবংশকে স্মরণীয় করে রাখতেই ৭৮ খ্রীষ্টাব্দে প্রবর্তিত শকাব্দ (শক বর্ষপঞ্জির) থেকে বাংলা সনের নামগুলি এসেছে। বিভিন্ন তারকারাজির নামে বাংলা মাসগুলির নামকরণ করা হয় সেগুলো হলো: বিশাখা থেকে বৈশাখ, জ্যেষ্ঠা থেকে জৈষ্ঠ্য, আষাঢ়া থেকে আষাঢ়, শ্রবণা থেকে শ্রাবণ, ভাদ্রপদ থেকে ভাদ্র, কৃত্তিকা থেকে কার্তিক, অগ্রাইহনী থেকে অগ্রহায়ণ, পুষ্যা থেকে পৌষ, মঘা থেকে মাঘ, ফল্গুনি থেকে ফাল্পুন, এবং চিত্রা থেকে চৈত্র। অগ্রহায়ন মাসের নামের আরেকটি ব্যাখ্যা হলো: অগ্র অর্থ প্রথম, হায়ন অর্থ বর্ষ বা ধান। আগে এই মাস থেকেই বছর গণনা আরম্ভ হতো কিম্বা এই সময়ে প্রধান ফসল ধান কাটা হতো। তাই এই মাসের নাম হয় অগ্রহায়ণ।”

এ থেকে অনুমান করা যায় কোন না কোন এক সময়ে বাংলা বছর শুরু হতো অগ্রহায়ন মাস থেকে। অগ্রহায়ন মাসের উৎপত্তির দ্বিতীয় ব্যাখ্যাটা তাই বলে। যদি অগ্রহায়ন মাস থেকে বাংলা নববর্ষ গননা শুরু হয় ব্যাপারটা দারুন হবে। চাইলেই করতে পারি আমরা। বাংলা তো আমাদের ক্যালেন্ডার। আমরা আমাদের পছন্দমত আরামদায়ক একটা মাসকে দিয়ে বছর শুরু করাতে পারি। এরজন্য জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে কোন বিল পাশ করাতে হবে না কিংবা সৃষ্টিকর্তার কোন অনুমোদন লাগবে না। এতে জাত ধর্ম সংস্কৃতির ক্ষতি হবারও কোন সম্ভাবনা নেই। বাংলাদেশ সরকার চাইলে সংসদে বিল পাশ করিয়ে এটা করতে পারে। কত আজেবাজে বিল পাশ হয় সংসদে। এই বিল পাশ করা কী খুব কঠিন হবে?

সংসদে এই প্রস্তাবটা উত্থাপন করার জন্য পাঠাতে চাই আমি। কিন্তু আমজনতা কী সংসদে কোন প্রস্তাব পাঠাতে পারে? পরিবর্তনের অঙ্গীকার নিয়ে ক্ষমতায় আসীন সরকার কি এই পরিবর্তনের ডাকে সাড়া দেবে?

[পুনশ্চ- যারা এই প্রস্তাবকে হাজার বছরের বাঙালী সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র মনে করবেন, তাদের এই পোস্ট থেকে দুরে থাকার অনুরোধ করছি]

পহেলা বৈশাখ ও পান্তা-ইলিশ

যদিও এটা খুবই জনপ্রিয় শহুরে মধ্যবিত্ত সংস্কৃতি কিন্তু পহেলা বৈশাখে পার্কে গিয়ে পান্তা-ইলিশ খাইনি কখনো। আমার কাছে এই ব্যাপারটা কেন যেন একটু মেকী মনে হয়। আমি জানিনা পার্কে পান্তা-ইলিশ খাওয়ার মেকী সংস্কৃতি কখন থেকে শুরু, কিন্তু পান্তা খাওয়ার সামর্থ থাকলেও ইলিশ খাওয়ার সামর্থ্য যে দেশের ৯০ শতাংশ মানুষের নেই সেটা বুঝতে অর্থনীতিবিদ হতে হয় না। ইলিশ মাছের দাম এমনকি মধ্যবিত্তেরও ধরাছোঁয়ার বাইরে। তবু পহেলা বৈশাখে পান্তা ইলিশ খাওয়াকে যেভাবে দেশীয় সংস্কৃতির ফরজ হিসেবে দেখানো হয় মিডিয়াতে, আমার কাছে বাড়াবাড়ি মনে হয়। দেশের বেশীরভাগ মানুষ যে খাবার খেতে পারে না সেটাকে জাতীয় ঐতিহ্য হিসেবে পালন করতে আমার একটু আপত্তি আছে।

এমনিতে নিন্মবিত্ত মানুষকে অভাবের কারনে সকালে পান্তা খেতে হয়। কিন্তু সেটা ইলিশ দিয়ে নয়, পেঁয়াজ, মরিচ বা আগের রাতের বাসী তরকারী দিয়ে। আর্থিক দুরাবস্থায় আছেন তেমন মানুষ মাত্রেই জানেন সকালে পান্তাভাত আর বাসী তরকারী খাওয়াটা কোন উৎসবের অংশ নয়, নিত্যদিনের দুঃখদৃশ্য। আমি সেই কঠিন মধ্যবিত্ত জীবন দেখে এসেছি বলে পান্তা ইলিশ উৎসবে কখনো যোগ দিতে পারিনি।

পহেলা বৈশাখ বা এরকম যে কোন উৎসব শ্রেফ শহুরে বাবুয়ানা যাতে আপামর দরিদ্র মানুষের অংশগ্রহন নেই। আমি শহর কিংবা গ্রামে খেটে খাওয়া মানুষদের এই উৎসবের বিষয়গুলির প্রতি প্রবল অনাগ্রহ দেখেছি। আসলেই দরিদ্র মানুষের কী কোন উৎসব আছে? সকল উৎসব পালা পর্বন শহুরে মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তের অধিকারে। তার মানে এই নয় যে আমরা এসব পালন করবো না। নিশ্চয়ই পালন করবো। তবে পালন করতে গিয়ে যেন ঐতিহ্যকে বিলাসিতা বানিয়ে না ফেলি। আমাদের সকল উৎসব ঐতিহ্য যেন আপামর জনগনের সামর্থ্যের মধ্যে থাকে। উৎসব থেকে যারা আর্থিক সামর্থ্যের কারনে বাদ পড়ছে তাদের কথা যেন ভুলে না যাই।

সেন্টমার্টিন ভ্রমন ১৯৯৪, ৬ তরুনের এক স্বপ্নীল অভিযাত্রা

সেন্টমার্টিন ভ্রমনঃ ১৯৯৪ সংস্করন


ভনিতা


পাঠকঃ সেন্টমার্টিনের গল্প শুনাইবেন? দুরো মিয়া, মার কাছে মাসীর গল্প করেন! কত কত বার গেছি। কোন ব্যাপারস হইলো? টেকনাফ গিয়া 'কেয়ারী সিন্দবাদ' বা 'কুতুবদিয়া' জাহাজে চইড়া বসেন, এক ঘন্টার যাত্রায় ঝাঁ কইরা পৌঁছায়া যাইবেন প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন। তীরে নাইমা হাত বাড়াইলেই নাওয়া-খাওয়া-শোয়ার জায়গা। সেন্টমার্টিনে এখন ভুরি ভুরি হোটেল রেষ্টুরেন্ট। বুকিং তো ঢাকায় বইসাই দেয়া যায়।

লেখকঃ ওক্কে, আপনে গেছেন আপনার কাছে মাফ চাই, কিন্তু এখনো তো বহুত মানুষ যায় নাই, তাদের সাথে একটু গপ্পো মারতে চাই। ২০০৯ সালে বইসা ১৯৯৪ সালের সেন্টমার্টিনের গপ্পো মারতে ইচ্ছা হয়। খুব কি খারাপ হইবো?

পাঠকঃ নাহ, তা খারাপ হইবো না, তয় আপনের কাম আপনি করেন, আমি চা খাইয়া আসি।

[বিঃদ্রঃ বেশীরভাগ চা খেতে চইলা গেলে কিন্তুক লেখা বন কইরা দিতে হবে ]


ছয় মজারু অভিযাত্রী

ছেলেবেলায় রবিনসন ক্রুসো পড়ার পর থেকে দ্বীপ ভ্রমনের স্বপ্নটা মাথার ভিতরে ঘুরপাক খেতে থাকে। ঘুরপাক খায় কিন্তু উপায় হয় না। কারন সাগর-মহাসাগরে গিয়ে দ্বীপ খোঁজার সুযোগ কই। একদিন কোথায় জানি সেন্টমার্টিনের সরস গল্প পড়ে মাথা গরম হয়ে গেল। খাইছে, এই দেশেও তো মজারু দ্বীপ আছে! তবে সেখানে পাহাড়-টাহাড় নাই। কেবল প্রবাল পাথরের রঙিন বাগান আছে লেগুনের তলদেশে। সেখানে নানা বর্নের মাছেরা ঘুরে বেড়ায় যা কূলে বসেও দেখা যায়। এরকম দৃশ্য ডিসকভারী বা জিওগ্রাফিক চ্যানেল ছাড়া আর কোথাও দেখিনি। তবে আমার কাছে এর মূল আকর্ষন হলো সভ্য জগত থেকে তার দুরবর্তী অবস্থান। একেবারে জনমানবহীন না হলেও সভ্য জগত থেকে প্রায়-বিচ্ছিন্নতাই দ্বীপটাকে অনন্য করলো আমার কাছে। কিন্তু জানা শোনার মধ্যে কেউ যায়নি বলে কিভাবে যেতে হবে তার কোন দিশামিশা পাচ্ছিলাম না। তাই সেন্টমার্টিন নিয়ে যেখানে যত লেখা পেতাম গোগ্রাসে গিলে দুধের সাধ ঘোলে মেটাতে লাগলাম।

স্বপ্ন দেখতে দেখতেই বছর কয়েক কেটে গেল, সুযোগ মিললো না। মিলবে ক্যামনে, লোকজন বলে সাগর পাড়ি দিয়ে এরকম অজ দ্বীপে বেড়াতে যাওয়া একটা আকাম। বইয়ের অ্যাডভেঞ্চারে অনেকের প্রানে বান ডাকে, কিন্তু বাস্তব অ্যাডভেঞ্চারে কেউ নেই। নানান আক্কেলীয় অজুহাতে এড়িয়ে গেল। আবার আমিও এরকম একটা জায়গায় একা একা যাবার ভরসা পাচ্ছিলাম না।

একদিন হঠাৎই উপায়টা বেরিয়ে এল। ১৯৯৪ সালের ফেব্রুয়ারীর শেষ দিক তখন। আমার সবচেয়ে ভ্রমনপিয়াসী বন্ধু সমীরের সাথে দেখা, তাকে বলামাত্র এক লাফে রাজী সে। যদিও সেন্টমার্টিন ভ্রমনের সবচেয়ে নিরাপদ সময় পেরিয়ে গেছে তখন (মাঝ ডিসেম্বর থেকে মাঝ জানুয়ারী সবচেয়ে উত্তম সময়)। তবু সমীরকে জোটাতে পেরে আমি বুকে সাহস পেলাম। লোক বাড়লে এরকম ভ্রমন রসময় হয়। আর কেউ রাজী হয় নি শুনে সে বললো 'চিন্তা করিস না, আমি কি করি দেখ'।

সমীরের তাজ্জব কেরামতিতে দুই দিনের মাথায় আমাদের অভিযাত্রী ৬ জনে দাঁড়ালো। এর মধ্যে আমার এক খালাতো ভাইও ম্যানেজড হয়ে দলে যুক্ত হয়েছে। দ্রুত মাষ্টার প্ল্যান করা হলো। সমীর দলনেতা হিসেবে রুট-বাজেট-টিকেট ইত্যাদি কাজ ভাগ করে দিল সবার মধ্যে। মাথাপিছু ৫০০ টাকা বাজেট। কম লাগে? কিন্তু এই টেকা জোগাড় করতেই অনেকের বাবার পকেট কাটার কাছাকাছি হলো। বাট হু কেয়ারস।

সেন্টমার্টিন অভিযানে সমীরের এত আত্মবিশ্বাসের মূল উৎস তার এক দুর সম্পর্কিত আত্মীয় 'বাবলু ভাই'। বাবলু ভাই টেকনাফে এক ফিশিং কোম্পানীর কর্মকর্তা। সমীরের মতে টেকনাফ পর্যন্ত যেতে পারলেই আমাদের কাজ শেষ। বাকী রাস্তা বাবলু ভাইই ঠিক করে দেবেন। শুধু সেন্টমার্টিন না চাইলে নাকি তিনি আকিয়াব রেঙ্গুনেও পাঠাতে পারেন আমাদের। নাসাকা বাহিনীর সাথেও তার খায়-খাতির আছে। আমরা সেই অজানা শক্তিধর বাবলু ভাইয়ের উপর ভরসা করে প্রস্তুতি চুড়ান্ত করলাম। মার্চের প্রথম সপ্তাহেই যাত্রা। সমীর বাবলু ভাইকে বলেছিল আমরা যাবো, তবে সঠিক দিন তারিখ দিতে পারেনি।

মুরব্বীদের অযাচিত হস্তক্ষেপ এড়াতে ছয়জনের কেউই বাসায় বলিনি যে আমরা সেন্টমার্টিন যাচ্ছি। বলেছি কক্সবাজার যাচ্ছি - বড়জোর টেকনাফ পর্যন্ত যেতে পারি। যাত্রার আগের দিন মাসুমের বাবা বাধ সাধলো টেকনাফের কথা জেনে। বড়লোক বাবার আদরের সন্তান মাসুম। টেকনাফ গিয়ে কোথায় থাকবে, কী খাবে, অজানা অচেনা জায়গা। ওদিকে টিকেট করা হয়ে গেছে সবার জন্য। মাসুমকে ফেলে যেতে চায় না কেউ। শেষমেষ রাতে ওর বাসায় গিয়ে চাচাজানকে অনেক বুঝিয়ে আমি ওর জীবনের উপর যত হুমকি আছে তার দায় দায়িত্ব ঘাড় পেতে নিয়ে রাজী করালাম। ওরে বাপস্!! হাঁপ ছেড়ে বাঁচলো সবাই।

পরদিন সকালে আগ্রাবাদের বাসা থেকে রওনা দিয়ে বহদ্দারহাট পৌছালাম নটার দিকে। সৌদিয়ার ঝকঝকে নতুন চেয়ারকোচ। আসন ব্যবস্থা খুবই চমৎকার। আমাদের মনটা ফুরফুরা। শখের পর্যটকগন আসছেন কাঁধে ব্যাগ ঝোলা ঝুলিয়ে। খুশীতে বত্রিশ দাঁতের অন্ততঃ গোটা তিরিশেক বেরিয়ে আছে একেকজনের। গুনে দেখলাম পাঁচজন পৌঁছেছে। ছয়জন হবার কথা। কে আসে নাই? ইকবাল। বাস ছাড়ার মাত্র পাঁচ মিনিট বাকী। কাট মারলো নাকি শালা? দুশ্চিন্তায় পড়লাম। শেষকালে বিশ্বাসঘাতকতা করলো!

আমরা খচ খচ মনে বাসে উঠে বসলাম। একটা সিট খালি। বাসটা হর্ন দিচ্ছে, ছেড়ে দেবে। তখুনি বাসের পাশে একটা টেক্সী এসে দাঁড়ালো। টেক্সী থেকে নামলেন মান্যবর ইকবাল হোসেন। কাঁধে ট্রাভেল ব্যাগ, কিন্তু হাতে ওটা কী? কমলা রঙের চৌকোনা খন্ড খন্ড মালার মতো গাঁথা। চেনা চেনাও লাগলো। কাছে আসতেই চিনতে পারলাম। আরে! এ তো লাইফ জ্যাকেট। ব্যাটা বিরাট বুদ্ধিমান তো? সমুদ্র পাড়ি দিয়ে দ্বীপে যাবো জীবন থাকবে হুমকির মুখে। সেখানে জীবন বাঁচাবে লাইফ জ্যাকেট। পুলকিত হলাম ওর বুদ্ধির বহর দেখে। সে দাঁত কেলিয়ে জানালো - ''আরে ওটা জোগাড় করতে করতেই তো দেরী হয়ে গেল।'

"ওই ব্যাটা, একটা লাইফ জ্যাকেট আনলি ক্যান, মানুষ কয়জন আমরা, সবাই ডুইবা মরবো আর তুই বাঁইচা থাকবি? ফাজিল কোথাকার!" সমীর খোঁচানো শুরু করলো।

"অসুবিধা নাই, ডুইবা যাওনের সুময় আমরা ওরে জড়াইয়া ধইরা মরবো।" জুনায়েদ নির্বিকার জানালো।

হাসির হল্লা উঠলো বাসে। ইকবাল লাইফ জ্যাকেটটা মাথার উপরের র‌্যাকে ঝুলিয়ে বসে পড়লো মাসুমের পাশে। গাড়ীর সকল যাত্রীদের চোখে দর্শনীয় কমলা বস্তু হয়ে উজ্জলতা ছড়াতে লাগলো জিনিসটা। পরবর্তীতে এই বস্তুটাই আমাদের প্রচুর আনন্দের খোরাক জুগিয়েছে পুরো ভ্রমনে।

কক্সবাজারে পৌঁছাতেই দুপুর গড়িয়ে গেল। খিদের চোটে পেটের ভেতর পিঁপড়ে ডাকছিল। বাস ষ্ট্যান্ডের লাগোয়া রেষ্টুরেন্টে লাল ঝোলের গরু মাংস দিয়ে হুপহাপ খেয়ে নিলাম সবাই। তারপর? টেকনাফ কী আজকে যাবো না কালকে? তর্কবিতর্কে 'আজকে যাবো' জিতে গেল। তবে তার আগে বীচে ঘুরে আসি। টেকনাফের শেষ বাস পাঁচটায়। আমরা ব্যাগগুলো বাস কাউন্টারে রেখে বীচে গেলাম। ঘন্টা খানেক ঘুরে পাঁচটার আগে ফিরে টেকনাফ বাস ষ্ট্যান্ডে গিয়ে সবচেয়ে আরামদায়ক বাস পছন্দ করতে লেগে গেল সবাই। টেকনাফ যাবার সবচেয়ে ভালো বাসগুলোকে বলা হয় লালবোর্ড সার্ভিস।

টিকেট করে স্পেশাল লালবোর্ডে উঠলাম সবাই। গুলিস্তান রুটের মিনিবাসের চেয়ে একটু বড় হবে। তবে বাসের ভেতরে সোজা হওয়া নিষেধ। দাঁড়াতে হয় ঘাঁড় গুজে- কোমর বাঁকিয়ে, বসতে হয় হাঁটুযুগল পেটের ভেতর সেঁদিয়ে। সবাই একসাথে বসার জন্য শেষের দিকের খালি সীটগুলো বেছে নিলাম। বসতে গিয়ে টের পেলাম লালবোর্ডের ঠেলা। সিট ক্যাপাসিটির বাস, কিন্তু 'সিট ক্যাপাসিটি' ঘোষনাটা আজকালকার মোবাইল কোম্পানীদের মতো -'শর্ত প্রযোজ্য'। মানে সিট পূর্ন হবার আগ পর্যন্তই এই ঘোষনা প্রযোজ্য। সিট পুরা হওয়ামাত্র গনতান্ত্রিক হুড়াহুড়ি লেগে গেল বাসে। 'জোর যার বাস তার' পদ্ধতিতে তিন মিনিটের মধ্যে জনতা লালবোর্ডকে মুড়ির টিন বানিয়ে দিল। ছাড়ার আগে এমন কমপ্যাক্ট হলো যে এই বাস খাদে টাদে পড়ে গেলেও আমরা জানটা নিয়ে আটকে থাকবো সিটের চিপায়।

বাসের সিটগুলো সম্ভবত হাঁটুবিহীন মানবদের জন্য বানানো। এটার সিট নির্মাতা শুধু পাছা রাখার জায়গার কথা ভেবেছে। পাছা থেকে উরু হয়ে হাটু পর্যন্ত দেড়ফুট দৈর্ঘ্যের একটা হাড় বয়ে গেছে সেটার কথা নির্মাতার মনে ছিল না। যাই হোক হাঁটুযুগল ভাঁজ করে উরুটা যথাসম্ভব পেটের ভেতর সেঁদিয়ে পাঁচজন বসলাম ঠেসেঠুসে। সমীর তো বসতেই পারলো না। কারন সৃষ্টিকর্তা ওর উরু পেট আমাদের চেয়ে এক সাইজ করে বড় বানিয়েছিল।

বসেই মনে পড়ে গেল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইটালী সরকার সিসিলিতে মাফিয়াদের উপদ্রপ কমানোর জন্য একটা অদ্ভুত কঠোর শাস্তি প্রচলন করেছিল। কেসাট্টা নামের ওই শাস্তিটা ছিল অপরাধীকে দেড়ফুট বাই দুইফুট একটা লোহার বাক্সে যে কোনভাবে ঠেসে ঢুকিয়ে দেয়া। ওই বাক্সে ঢোকাতে গিয়ে কয়টা হাড়গোড় ভাঙবে সেটা বিবেচনায় আসবে না। যারা ওই শাস্তি একবার পেয়েছে তাদের হাড়গোড় যে একটাও আস্ত থাকেনি সেটা বলাই বাহুল্য। সেই শাস্তিটা মুর্তিমান আতংক ছিল মাফিয়াদের জন্য। সেই কারনেই বোধহয় অনেক মাফিয়া ডন আটলান্টিক পেরিয়ে আমেরিকায় পাড়ি জমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। লালবোর্ড সার্ভিস আজকে আমাদেরকেও কেসাট্টা সেবা দিয়ে টেকনাফের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছে।

তবে অল্পক্ষন পরেই ভুলে গেলাম হাঁটুযন্ত্রনা যখন দন্ডায়মান জনতার মনোযোগ ইকবালের কমলা রঙের লাইফ জ্যাকেটের প্রতি আকৃষ্ট হলো। শুরু হলো জনতার প্রশ্নমালা। উত্তরদাতা কিন্তু ইকবাল নয়, সমীর। লাইফ জ্যাকেটের দিকে আঙুল দিয়ে জনতার প্রশ্ন শুরুঃ

-ইবা কি( এইটা কী?)
-ইবা লাইফ জ্যাকেট (এটা লাইফ জ্যাকেট)
-বুঝজি ত, ইবা দিয়েরে কী গরিবান (জানি, এটা দিয়ে কী করবেন)
-ইবা ফরিয়েনে সাগরত মিদ্দি হাবুডুবু কেইল্লুম( এটা পরে সাগরে হাবুডুবু খেলবো)
-অনেরা হন্ডে যাইবেন (আপনারা কোথায় যাবেন)
-টেকনাফ
-এন্ডে কী (ওখানে কী)
-বেড়াইতাম যাইদ্দি
-টেকনাফত বেড়াইবার কী আছে? (টেকনাফে দেখার কী আছে)
-এন্ডেততুন আঁরা সেন্টমার্টিন যাইয়ুম (ওখান থেকে আমরা সেন্টমার্টিন যাবো)
-অবুক সেনমাটিন? এন্ডে কিল্লাই, মাতা ফল অই গেইউগুই নি? (সেন্টমার্টিন কেন? মাথা খারাপ হয়নি তো)
-ক্যায়া? অসুবিধা কী (কেন অসুবিধা কী)
-অমা, তোঁয়ারা ন জানো? এন্ডে তে বেয়াক ডাহাইত জাইল্যা (ওমা, তোমরা জানো না? ওখানে সব ডাকাত আর জেলে)
-ডাহাইত আঁরারে কিছু গইরতু ন, আঁরার লগে খান বাহাদুরর নাতি আছে (ডাকাত আমাদের কিছু করবে না, আমাদের সাথে খান বাহাদুরের নাতি আছে)
-তেঁই হন (উনি কে?)
-ওই যে উইবা খানবাদুরর ১৭ তম নাতি (ওইতো ওটা খানবাহাদুরের ১৭তম বংশধর)

সমীর মাসুমের দিকে আঙুল তুলে দেখালো। ইকবাল, জুনায়েদ আর আমি পেট চেপে হেসে উঠলাম। মাসুম খানবাহাদুর শুনে রাগে কটমট করছে। খান বাহাদুরের একটা ঘটনা আছে। একদিন জুনায়েদ আর মাসুম বসে গল্প করছিল। এক পর্যায়ে দুজনের বংশ মর্যাদার কথা এসে যায়। দুজনেই দাবী করে তারা খান্দানে উঁচু। জুনায়েদ বললো তাদের বংশের কোন পুরুষ খানবাহাদুর উপাধি পেয়েছিল। অমনি মাসুম বললো তার বাবা খানবাহাদুরের সরাসরি ১৭তম বংশধর। জুনায়েদ এই তথ্যটা বন্ধুমহলে প্রচার করে এবং মাসুম খান বাহাদুর ১৭ হিসেবে খ্যাতি অর্জন করে। কেউ কেউ খান-সেভেনটিনও বলে। মাসুমকে ক্ষেপানোর মোক্ষম অস্ত্র এটি। এখন লোক ভর্তি বাসের ভেতর সবাই যখন হেসে উঠলো তখন মাসুমের চেহারাটা দেখার মতো হলো।

বাস ছেড়েছে বেশ আগেই। সন্ধ্যা নেমে গেছে। অন্ধকার চিরে টেকনাফের সরু রাস্তায় চলছে লালবোর্ড। সমীর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ক্লান্ত হয়ে জুনায়েদের কোলে বসে পড়লো। জুনায়েদ বসেছি বাসের মাঝখানের আইলের সোজা শেষ সিটে। পুরো বাসে সমীরের বসার একমাত্র সিট।জুনায়েদ ওজন সইতে না পেরে খিস্তি করে সিট ছেড়ে দাঁড়িয়ে গেল। সিট বেদখল। আমরা যখন গল্পে মশগুল তখন ইকবাল হঠাৎ যেন কার উদ্দেশ্য হাঁক দিয়ে উঠলো। তাকিয়ে দেখি এক লোক উপরে ঝোলানো লাইফ জ্যাকেটের ফোমগুলো টিপছে-

-কী রে ভাই টিবাটিবি গইত্তা লাইগ্গু ক্যা(কিরে ভাই টিপাটিপি করেন কেন?)
-বিতুরে ফানি আছেনি ছাইদ্দি (ভেতরে পানি আছে কিনা দেখছি)
-ফানি ক্যানে তাইবু (পানি কেন থাকবে)
-ফানির জিনিসত ফানি ন থাইবু না? (পানির জিনিসে পানি থাকবে না?)
-ইবা আইজু ফানিত ন নামে(এটা এখনো পানিতে নামেনি)
-অ তইলে ইবা বাসল্লাই বানাইয়েদে (তাইলে এটা বাসের জন্য বানানো)

বাসের জনতার মধ্যে একচোট হাসির ছররা বয়ে গেল, আমরাও মজা পেলাম। ইকবাল চুপ মেরে গেল। জুনায়েদ ইকবালকে বললো, "তুই লাইফজ্যাকেটটা পরে ফেল। বাসটা যদি নাফ নদীতে পড়ে যায়, কাজে দেবে, নইলে পরে পস্তাবি" শুনে ইকবাল মারমুখী হয়ে ঘুষি পাকালো।

বাস চলছে। যাত্রীদের কোলাহল আস্তে আস্তে কমে আসছে। বাইরে তাকিয়ে দেখি নিকষ কালো অন্ধকার। কোন জায়গায় আছি বোঝার উপায় নেই। পাহাড় জঙ্গলের মাঝ দিয়ে বাস এগিয়ে যাচ্ছে। এই পথে নাকি সন্ধ্যের পর ডাকাত নামে। সরু রাস্তায় গাছ ফেলে লাইন ধরে দশ পনেরটা গাড়ী একসাথে গনডাকাতি করে। গা শির শির করে উঠলো একটু। কোথাও বাস থামলে কিংবা গতি কমালে আঁতকে উঠছে সবাই। যাত্রীরা কেউ কেউ এখন আমাদের সন্দেহের চোখে দেখছে। কারন এই মুহুর্তে সবাই চুপ মেরে আছে। আবার আমরাও ভয় পাচ্ছি যাত্রীদের মধ্যে কেউ ডাকাত আছে কি না। দাঁড়ানো যাত্রীদের মধ্যে খালি গা এবং মলিন জামাচোপড় পরা যাত্রীই বেশী এখানে। তাদের কেউ কী ডাকাত দলের সদস্য হতে পারে?

এরকম বিশ্বাস অবিশ্বাসের দোলা চলতে চলতে বাসটা একটা বাজার ধরনের জায়গায় পৌছে গেল। লোকজন দোকানপাট দেখা যাচ্ছে। কলকোলাহলময় জায়গা। এটাই টেকনাফের প্রানকেন্দ্র। আলো ছায়াময় বাজারটিতে আমাদের যাত্রার আপাতঃ সমাপ্তি ঘটলো। এই প্রথম এসেছি বাংলাদেশের সবচেয়ে দক্ষিনের নগর টেকনাফে। রাস্তাঘাট কিছু চিনিনা। বাস থেকে নেমে অনিশ্চিত গন্তব্যের উদ্দেশ্যে হাঁটা শুরু করলাম।




টেকনাফে বেপথু হাঁটা

টেকনাফ তো নামলাম। এবার? বাবলু ভাইরে কই পাই? শুরু হলো খোঁজ। অত সোজা না। মোবাইল যুগ হলে মাঝপথেই ফট করে মোবাইল করে দিতাম- "আমরা পেরায় আইসা পড়ছি ভাইজান, আপনে অ্যাটাচ বাথের তিনটা ডাবল রুম, ডিনারে সামান্য চিংড়ি ভুনার সাথে বেগুন ভর্তা আর কলিজার সাথে অল্প মগজের ঘুনঘুনি অর্ডার দিয়া দেন, রূপচান্দা মাছের ঝামেলায় যাবার দরকার নাই, আজ রুচি নাই, বেশী খেতে পারবো না। আইসা জাষ্ট বইসা পড়বো টেবিলে।"

কিন্তু সেই যুগে মোবাইল ছিল না। টিএন্ডটির ফোনও মেলা ভার। মোটকথা বাবলু ভাই জানেই না আমরা এসে পড়েছি। তাকে খুঁজতে একমাত্র ভরসা তাঁর ও তাঁর কোম্পানীর নাম। সমীর বলেছিল- টেকনাফ ছোট জায়গা, বাবলু ভাইকে এক নামে চেনে সবাই। জিজ্ঞেস করতে করতে এগিয়ে যাচ্ছি। এ পথ, সে পথ ঘুরতে ঘুরতে গ্রাম্য মেঠো পথে চলে এলাম। তবু বাবলু ভাইয়ের মৎস্য খামারের দেখা নেই। পরে জেনেছি এখানকার লোকজনের দুরত্বজ্ঞান আমাদের চেয়ে ভিন্ন। কেউ যদি বলে 'এই একটু সামনে', তাইলে বুঝতে হবে মাইলখানেক। কেউ যদি বলে - 'মাইলখানেক', তাহলে বুঝতে হবে মাইল পাঁচেকের কম না।

ইটের রাস্তাটা যেখানে শেষ সেখানে পৌছে সেখানে একজনকে জিজ্ঞেস করতে সে নির্দেশক আঙুলটা অসীমের দিকে তুলে ইঙ্গিত করলো দুর প্রান্তরের মাঝখানে টিমটিম করে জ্বলতে থাকা একটা বাতির দিকে। 'উই দেহা যাদ্দে ওন্ডে'(ওই দেখা যাচ্ছে ওখানে)। খোলা প্রান্তরে নেমে গেলাম সবাই। উপরে এক আকাশ ভর্তি তারার মেলা। কী স্পষ্ট একেকটা তারা। বিপুল এই মহাবিশ্বে যেন আমরা কজন ছাড়া আর কেউ যেন নেই। জনমানবহীন খোলা ময়দান। ঠান্ডা গা শির শির করা বাতাস। অদ্ভুত অনুভুতির দোলা দেহে মনে। কোথায় যাচ্ছি জানি না। এখানে কী বাবলু ভাই আছে? অচেনা একটা জায়গায় অনিশ্চিত গন্তব্যে হাঁটছি অথচ এটা নিয়ে কারো দুশ্চিন্তা নেই। জুনায়েদ তো রীতিমতো গান ধরেছে। ইকবাল এক কাঁধে ব্যাগ আরেক কাঁধে লাইফ জ্যাকেট নিয়ে হাঁটছে।

বাতিটা অত কাছে ছিল না। যেতে প্রায় দশ মিনিট লাগলো। অসমতল প্রান্তরে হোঁচট খেতে খেতে যখন বাতির কাছাকাছি পৌঁছালাম দেখলাম লাইন ধরে বেশ কয়েকটা বাঁশের তৈরী ঘর ওখানে। কোন সাইনবোর্ড নেই। এই কী সেই বাবলু ভাইয়ের আস্তানা? অবশেষে খুঁজে পেলাম? মনটা ফুরফুরা হয়ে উঠছিল। এক ঘন্টার মতো এলোপাথাড়ি হাঁটা হয়েছে। এবার বিশ্রাম নেয়া যাবে। যে ঘরটার সামনে বাতি জ্বলছিল তার কাছে গিয়ে সমীর 'বাবলু ভাই' বলে হাঁক দিল। ভেতর থেকে কোন সাড়াশব্দ নেই। আবারও ডাক। নাহ, কেউ সাড়া দিল না। দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। মানে ভেতরে লোক আছে, কিন্তু আওয়াজ দিচ্ছে না। আজব! হঠাৎ করে ভেতরে লাইট বন্ধ হয়ে গেল, ধুপধাপ শব্দ হলো, সম্ভবত পেছনের দরজা খুলে কেউ ছুটে বেরিয়ে গেল। আমরা ঘটনাটা বুঝলাম না। সবাই মুখ চাওয়া চাওয়ি করলাম। সমীরের পোষাক এবং চুলের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ সন্দেহ হলো, ভেতরের লোকটা ওকে বিডিআর মনে করেনি তো? সমীরের গায়ের খাকি জ্যাকেটটা দেখতে বিডিআরের পোষাকের মতো। ওর মাথার ছোট করে ছাঁটা চুল, লম্বা চওড়া শরীর দেখে সন্দেহ করতেই পারে। টেকনাফের নানা জায়গায় চোরাচালানী ভর্তি। ওই ব্যাটাও নিশ্চয়ই চোরাচালানী ছিল। ভেবেছে বিডিআর রেইড দিছে, সাথে সাথে ভেগেছে। চারপাশ ঘুরে বুঝলাম এটা মৎস্য খামার নয়। ভুল তথ্য ছিল।

এইবার আমরা পুরোপুরি দিশাহীন। ক্লান্ততে বসে পড়লাম একটা আলের উপর। এখানে তো আর আশা নেই। বাবলুভাইকে সারারাত খুঁজলেও পাওয়া যাবে না এভাবে। ভীষন বোকামি হয়ে গেছে। কলোনীতে একবার বাসা খুঁজতে এসে এক লোক ঠিকানা বলতে পারছিল না। শুধু নামটাই জানে। আমরা জিজ্ঞেস করলাম লোকটার অন্ততঃ একটা বৈশিষ্ট্য বলে যাতে চিনতে পারি। সে বললো, 'আগে লুঙ্গি পরতো, এখন প্যান্ট পরে।' দীর্ঘদিন ঘটনাটা কৌতুক হিসেবে ব্যবহার করেছি কলোনীর লোকজন। আজকে বাবলু ভাই অনুসন্ধানটা প্রায় সেরকমই হলো। আবার ফিরে যেতে হবে শহরে যেখান থেকে শুরু করেছি। তবে শেষবার চেষ্টা করে দেখা যাক।

আবারো বেপথু হাঁটা। এই বিশাল মাঠের কোথাও নিশ্চয়ই বাবলু ভাই থাকে। আশায় বুক বেধে কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে চারপাশে চোখ বুলাতে বুলাতে এগিয়ে চললাম ছয়জন। কিছুদুর গিয়ে আরেকটা খুপড়ি ঘর দেখা গেল। কেরোসিন কুপি জ্বলছে ভেতরে। বয়স্ক একজন ভাত রাঁধছিল, ফেন উঠা ভাতের সুবাসে আমাদের খিদেটা চাড়া দিল যেন। সমীরকে বললাম একটু দুরে থাকতে। নইলে এইলোকও ভেগে যেতে পারে। আমি এগিয়ে যথাসম্ভব এলাকাবান্ধব স্বরে খুবই ভদ্র ভাষায় জিজ্ঞেস করলাম বাবলু ভাইয়ের কথা। বুড়ো আমাদের সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখলো একনজর। আমি অভয় দিয়ে বোঝালাম আমরা কত বিপদগ্রস্থ। বাবলুভাই আমাদের কত আত্মীয়। তারপর বুড়ো বিড়বিড় করে যা বললো তার সারমর্ম হলো- সে বাবলু ভাইকে ভালো করেই চেনে। ডানপাশের খানিক দুরের খামারটায় বাবলু ভাই কাজ করে। তবে আজ সকালে বাবলু ভাইকে দেখেছে বার্মা যাওয়ার উদ্দেশ্যে নৌকায় উঠতে। তিনি কখনো দিনে দিনেও চলে আসে, কখনো আবার দু-তিনদিন থেকে আসে।

তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন তথ্য যেটা দিল সেটাই আমাদের এই নিশীথ রাতে বেপথু চলার হাত থেকে রক্ষা করলো। বাবলু ভাই রাতে এখানে থাকেন না। রাতে থাকেন টেকনাফ শহরের হোটেল নিরিবিলিতে।


হোটেল নিরিবিলি

মোটামুটি খোশ দিলে ফেরার পথ ধরলাম। পথে একটা ঝুপড়ি দোকান থেকে কলা-বিস্কুট-চা খেয়ে খিদেটা চাপা দিলাম। টেকনাফ শহরে ফিরে হোটেল নিরিবিলি খোঁজ শুরু করলাম। হোটেলটা নামকরন সার্থক করে শহরের একটু বাইরে চমৎকার নিরিবিলি জায়গায় বানানো হয়েছে। তখনকার দিনে টেকনাফের সবচেয়ে ভালো হোটেল। সামনে জাতিসংঘের গাড়ী দাঁড়ানো দেখে এর গুরুত্ব বুঝলাম। হোটেল ম্যানেজারের সাথে পরিচয় ও উদ্দেশ্য জানিয়ে আলাপ করলাম। জানা গেল বাবলু ভাই এখানেই থাকেন, তবে আজকে ফিরবেন কিনা জানেন না। আমরা ফিরে যাচ্ছিলাম। সমীর প্রস্তাব দিল এই হোটেলে রাত কাটাতে। কিন্তু কেউ রাজী না, জাতিসংঘের জীপ যে হোটেলের সামনে থাকে সেটা আমাদের মতো বান্দার জায়গা না। ভাড়া জিজ্ঞেস করে লজ্জা পাবার দরকার নেই। একটা চিৎকাত বোডিং হলেই আমাদের চলবে। হোটেলের ম্যানেজার আমাদের দেখে কিছু একটা আঁচ করলেন। ফিরে যাচ্ছি দেখে তিনি ডাক দিলেন ইশারায়। বাকীদের হোটেলের বাইরে দাঁড় করিয়ে আমি আর সমীর গেলাম।

-আপনারা হোটেলে উঠবেন না?
-জী উঠবো,
-কোন হোটেল
-এখনো ঠিক করি নাই
-আমার এখানেই উঠেন
-না, ঠিক আছে, আমরা অন্য হোটেলে যাবো
-কেন এখানে অসুবিধা কী। এরচেয়ে ভালো হোটেল টেকনাফে পাবেন না
-জানি,
-জানেন, তবু উঠবেন না?
-জী ভাইজান জানি বলেই তো উঠবো না, সামনের গাড়ীগুলো দেখেই বুঝতে পারছি এটা আমাদের জায়গা না (চুপ থেকে মনে মনে বললাম)

আমাকে চুপ থাকতে দেখে ম্যানেজার বললো-
-ভাই, খোলামেলা বলি। আপনার হয়তো ভাবছেন এটা খুব দামী হোটেল। আসলে এখানে দামী লোকেরা থাকেন ঠিকই, কিন্তু ভাড়া একদম কম।
-(তোমার কম মানে তো তিন-চারশো টাকা মনে মনে গজগজ করছি) মুখে বললাম - কম কত?
-আরে ভাই, উঠেন না আগে। ভাড়া অসুবিধা হবে না।
-তবু বলেন একটু শুনি
-আশি।
-কী?
-আশি টাকা
-আশি টাকা কী? (আমি কানটাকে একটু ঝাঁকি দিলাম। ভুল শুনছি না তো?)
-প্রতি রুমের ভাড়া আশি টাকা। এক রুমে দুজন থাকার ব্যবস্থা।

এইটারে কী আসমানী উপহার বলে? রাত প্রায় দশটা বাজে। নিরাশ্রয় ছয় পথহারা অভিযাত্রীকে টেকনাফের অচেনা জগতে ঠাঁই দেবার জন্য এই দেবদুত সম মানুষটা এসে দাঁড়িয়েছে। রুমপিছু আশি টাকা দিয়ে এই চমৎকার হোটেলে আমাদের রাতে ঘুমানোর ব্যবস্থা করে দিচ্ছে। মোট তিনটা রুম লাগবে আমাদের। দুজন করে এক রুমে। ছজনের রাত্রিযাপন খরচ ২৪০ টাকা। ক্যালকুলেশান করে নেচে উঠলাম মনে মনে। স্বপ্ন দেখছি না তো? ওদিকে বাকী চারজন বাইরে থেকে আমাদের ইশারায় ডাকছে অন্য হোটেল খুঁজতে যাবার জন্য, এখানে আমাদের পোষাবে না। কাছে গিয়ে হোটেলের ভাড়াটা শুনেই লাফ দিল প্রায়। হোটেলের রুমগুলো বেশ বড় বড়। ফার্নিচারগুলোও মোটামুটি ভাল। প্রতিরুমেই এটাচড বাথ। সার্বক্ষনিক পানি। চমৎকার ব্যবস্থা। শুধু খাবারটা বাইরে খেতে হবে।

গোসল টোসল সেরে ফ্রেশ হয়ে সাড়ে দশটার দিকে খাবার হোটেলের সন্ধানে বেরুলাম। বেরুবার আগে হোটেল ম্যানেজারকে বলে এসেছিলাম পারলে সেন্টমার্টিন যাবার একটা নৌকা ঠিক করে দিতে। বাবলু ভাই রাতে না ফিরলে এটাই একমাত্র উপায়। হোটেল ম্যানেজার খুবই মাই ডিয়ার টাইপ। আশ্বাস দিলেন। খাবার হোটেল খুঁজতে গিয়ে 'আল্লার দান' নামের একটা বাঁশের তৈরী ঝুপড়ি টাইপ হোটেল দেখে ঢুকে পড়লাম, কপালে যা থাকে তাই খাবো। এই অঞ্চলে এর চেয়ে উন্নত হোটেল আশা করা বৃথা। তাছাড়া রাতও অনেক। কিন্তু খেতে গিয়ে পরিবেশনা ও রান্নার মান দেখে রীতিমত মুগ্ধ হলাম। বাংলাদেশের কোথাও এত চমৎকার আতিথেয়তা পাইনি কোন রেষ্টুরেন্টে। টেবিলে টেবিলে গিয়ে বাটিতে করে হাত ধুইয়ে দেয়ার ঘরোয়া আতিথ্য কোথায় পাবো? খাওয়ার শুরুতে প্রত্যেক প্লেটে শাক আর ভর্তা দেয়া হলো, ডাল আর সালাদ তো আছেই। শুনে অবাক হয়ে যাই ওই শাক-ডাল-সালাদ-ভর্তা ফ্রী! তারপর মুল আইটেম আসলো। কেউ ছোট চিংড়ী, কেউ রূপচাঁদা, কেউবা মাংস নিল। পরিমানে বানিজ্যিক কৃপনতা দুরে থাক বাটি ভর্তি করে এত বেহিসাবি তরকারী দিল ঢাকা চট্টগ্রাম শহরে কল্পনাও করা যায় না। পেট পুজোটা খাসাই হলো।

খাওয়া সেরে টিমটিমে অন্ধকারে টেকনাফ শহর ঘুরতে বেরুলাম। বেশীরভাগ দোকানপাট বন্ধ হয়ে গেছে। সেন্টমার্টিন যাবার জন্য প্রয়োজনীয় যা যা লাগবে কিনে ফেলতে হবে রাতেই। বিস্কুট কলা চিড়া, মোমবাতি, টর্চলাইট, ব্যাটারী, মশার কয়েল ইত্যাদি অনেক হাবিজাবি। সভ্যতা বিবর্জিত কোন জায়গায় সভ্য মানুষদের যেন কোন অসুবিধা না হয়। কেনাকাটা করে ফেরার পথে জুনায়েদ আর মাসুম বললো - আমরা একটু বার্মিজ মার্কেট ঘুরে আসি। এত রাতেও শালাদের মার্কেটিং খায়েশ দেখে গা জ্বলে গেল।

ঘুরতে ঘুরতে আমাদের মতো আরেকটা বাউন্ডুলে দলের দেখা পেলাম। কথা বললাম উৎসাহী হয়ে। দলটা ভারী হবে এদেরকে সাথে পেলে। জানলাম ওরা ঢাকা থেকে এসেছে। প্রস্তাব দিলাম চলেন একসাথে যাই। কিন্তু ছেলেগুলো উচ্চমার্গীয় আঁতেল। প্রায় নাক সিটকে আমাদের ঝেড়ে ফেললো। তাদের নাকি বিশেষ ব্যবস্থা আছে ওখানে যাবার। তারা নিজেরাই যাবে সেই ব্যবস্থায়। ওদের কাছে পাত্তা না পেয়ে খানিকটা নিরাশ হলাম। যতদুর খবর পেয়েছি, সেন্টমার্টিনে যাবার একমাত্র বাহন ইঞ্জিন চালিত সাধারন মালবাহী নৌকা কিংবা ট্রলার। কেউ কেউ ডিঙি নৌকা নিয়েও আসা যাওয়া করে। থাকার ব্যবস্থা সম্পর্কে শুনেছি, গ্রামের কারো বাড়ীতে আতিথ্য নিয়ে থাকা যায়, চেয়ারম্যানের বাড়ীতে বাঁশের ঘর আছে কয়েকটা, সেখানেও থাকা যায়। আরেকটা সুখবর হলো, ওখানে একটা প্রাইমারী স্কুল আছে সাইক্লোন শেল্টার হিসেবে বানানো। ওখানেও থাকা যাবে। কিন্তু আমাদের ইচ্ছা সমুদ্রের ঢেউয়ের শব্দ শুনে শুনে রাত পার করা। সুতরাং ঘরবাড়ী না হলেও চলবে। সমুদ্রের বালুকাবেলাই আমাদের আশ্রয়।

হোটেলে ফিরে শুতে যাবার আগে ম্যানেজার ডেকে পাঠালেন আমাদের। রিসেপশানে গিয়ে দেখি লুঙ্গির ভেতর শার্ট ইন করা তীক্ষ্ণ চোখের খাটো মতো গাট্টাগোট্টা শরীরের কালো কুচকুচে এক লোক দাঁড়িয়ে। নাম আবদুল্লাহ। আমাদের সেন্টমার্টিন ভ্রমনের কান্ডারী। তার নৌকাতেই আমাদের আগামীকালের দ্বীপযাত্রা। সকালে আমাদেরকে ডেকে নিয়ে যাবে হোটেল থেকে। দারুন ব্যবস্থা। ম্যানেজারকে ধন্যবাদ দিয়ে খোশ দিলে শুতে যাচ্ছি তখন মাসুম আর জুনায়েদ ফিরে এল বার্মিজ মার্কেট থেকে। দুজনের হাতে পত্রিকা মোড়ানো দুটো বোতল। এগুলা নাকি পিত্তশুল দমনকারক বার্মিজ সিরাপ। যা বোঝার বুঝে গেলাম। চেঙিজ খানের দুই বংশধর মাঝরাতে এই স্বাস্থ্যসেবার খোঁজে গিয়েছিল। শালারা, ঢেকি যেখানে যায় সেখানেই........!

যাত্রায় অনিশ্চয়তা

রাত প্রায় একটা তখন। ঘুমটা মাত্র লেগে এসেছে এমন সময় দরজায় খটখট। সমীর দাড়িয়ে আছে, বললো -সুসংবাদ এবং দুঃসংবাদ দুটোই এসেছে। সুসংবাদ- বাবলু ভাই বার্মা থেকে ফিরে এসেছে কিছুক্ষন আগে। দুঃসংবাদ- বাবলু ভাই খবর এনেছেন সমু্দ্রে ৩ নম্বর সিগন্যাল। এখন সেন্টমার্টিন যাওয়া নিরাপদ নয়। সকালে কোন নৌকা ছাড়বে না এখান থেকে, এমনকি খোদ সেন্টমার্টিনের চেয়ারম্যানও তার যাত্রা বাতিল করে টেকনাফ থেকে যাচ্ছেন।

ধুত্তারি! মেজাজটাই খারাপ হয়ে গেল। দমে গেলাম ভেতরে ভেতরে। তীরে এসে তরী ডোবা! কিন্তু করার কিছু নেই। আবহাওয়ার উপর কারো হাত নেই। হতাশা নিয়ে ঘুমোতে গেলাম।

সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি আকাশের মন মেঘলা। আমাদেরও। সারাদিন কী করবো ভেবে পেলাম না। তবে আমি আর সমীর ঠেঁটা সিদ্ধান্ত নিলাম টেকনাফেই থেকে যাবো সমুদ্র শান্ত না হওয়া এবং শেষ টাকাটা ফুরিয়ে না যাওয়া পর্যন্ত। অন্যরা মৌন সম্মতি দিল।

হোটেলের চারপাশটা আবাসিক এলাকা। স্বচ্ছল স্থানীয়দের ঘরবাড়ী। পেছনে একটা বাড়ীতে কুয়ো থেকে পানি তুলতে দেখে মনে পড়ে গেল, মাথিনের কুপ এখানেই কোথাও আছে। নাস্তা করে মাথিনের কুপ দেখতে যাবো ভাবলাম। আল্লার দান হোটেলে ডাল ভাজি আর চাপাতি দিয়ে উত্তম ব্রেকফাষ্ট হলো।

খাওয়া সেরে নিরিবিলির সামনে আসতেই দেখি কাল রাতে দেখা গাট্টা শরীরের লুঙির ভেতরে শার্ট ইন করা কালো কুচকুচে বেঁটে লোকটা বৈঠা হাতে দাঁড়িয়ে সাদা দুপাটি দাঁত বের করে হাসছে- আবদুল্লাহ।

-ওবা ইয়া অনেরা ন যাইবেন? দেরী অই যাইবুগুই তো! (কী ভাই আপনারা যাবেন না? দেরী হয়ে যাবে তো)
-আজিয়া তো নৌকা ন যাইবু, সাগরত ঝড় উইট্টি বলে (আজ তো নৌকা ছাড়বে না, সাগরে নাকি ঝড় উঠছে)
-ঝড় উডিলি কী অইয়ি, হত ঝড় দেখখি, আবদুল্লা এই লেল্লেইট্টা ঝররে ন ডরায় ( ঝড় উঠছে তো কী হয়েছে, কত ঝড় দেখছি, আবদুল্লাহ এইরকম হালকা ঝড়কে ভয় পায় না)
-চেয়ারম্যান সাব ও ন যাইবু, আঁরা যন ঠিক অইবু না? (এমনকি চেয়ারম্যান সাহেবও যাবেন না, আমাদের যাওয়া কী ঠিক হবে?)
-চেয়ারম্যান ন গেইলে আবদুল্লার কী, আবদুল্লাহ যাইবু, অনেরা গেইলে চলন, আঁই পৌঁছাই দিয়ুম দে (চেয়ারম্যান না গেলে তাতে আবদুল্লার কী, আবদুল্লাহ যাবে, আপনারা গেলে চলে, আমি পৌছে দেবো)

আবদুল্লাহর কথা শুনে আশ্বস্ত হতে ইচ্ছে হলো। আমরা আলোচনায় বসলাম। সিদ্ধান্ত হলো- কপালে যা-ই থাকে, আমরা যাবো। দশ মিনিটের মধ্যে গুছিয়ে বেরিয়ে এলাম হোটেল থেকে। নৌকার ঘাট হোটেলের কাছেই। হেঁটেই গেলাম। নৌকায় আরো অনেক যাত্রী উঠছে। টেকনাফ থেকে একমাত্র নৌকা আজকে। এরকম দিনে নাকি একমাত্র আবদুল্লাহর নৌকাই সমুদ্র পাড়ি দিতে পারে। কেন? কিছুক্ষন পরই টের পেয়েছি আবদুল্লাহ কী জিনিস। নৌকাটা বড়সড়ই। সব মিলিয়ে ত্রিশ-চল্লিশজন যেতে পারে। তবে নৌকার অর্ধেকটাই ভর্তি হয়ে আছে ইট, কাঠ আর বাঁশে। এতো এখনই অর্ধেক ডুবে আছে মালপত্রের ভারে। সমুদ্রে গেলে না জানি কী অবস্থা হবে। এ নিয়ে আমরা আবদুল্লাহর কাছে মৃদু আপত্তি জানালাম। সে বললো, এই মালের ওজনেই নৌকাটা আরো নিরাপদ হলো। সমুদ্রে নৌযান যত হালকা তত বিপদজনক। আমাদের তত বোঝার ক্ষমতা নাই। তাই বুঝলাম না। কিন্তু না গিয়েও উপায় নাই। নৌকা বোঝাই মালপত্তরগুলো নাকি হুমায়ুন আহমেদের বাড়ীর জন্য। শুনেছিলাম হুমায়ুন আহমেদও সেন্টমার্টিনের প্রেমে পড়ে গিয়েছিলেন এবং সেখানে একটা বাড়ী বানাবেন। এই তাহলে সেই বাড়ীর মাল মশলা। সমুদ্রবিলাস তৈরী হচ্ছিল। সবাই বসে গেলাম সেই মালপত্তরের ফাঁকে ফোকরে।


উত্তাল সমুদ্র পেরিয়ে

নৌকা ছাড়ার আগ মুহুর্তে কাধে ক্যামেরা ব্যাগ ইত্যাদি ঝুলিয়ে এক ভদ্রলোককে উঠে আসতে দেখলাম। আরে, ইনি তো রুমী ভাই। এলাকার বড় ভাই। টেকনাফে কী একটা মেরিন প্রতিষ্টানে চাকরী করেন। তিনি আমাদের দেখে অবাক। রুমী ভাই সেন্টমার্টিন যাচ্ছেন অফিসিয়াল কাজে সামুদ্রিক উদ্ভিদ ও প্রানীর ছবি তুলতে। ইকবাল সমুদ্রে বিপদের আশংকার কথা বলতেই 'দুর বোকা' বলে হেসে উড়িয়ে দিলেন। 'দুই তিন ঘন্টার যাত্রা। এটা কোন ব্যাপার হলো? কতবার গেছি। ডালভাত হয়ে গেছে।' আমি আর ইকবাল সাঁতার জানি না। নৌকার মাঝামাঝি বসলাম সবচেয়ে নিরাপদ জায়গা দেখে। রুমী ভাই আমাদের সামনা সামনি বসলো। আমাদের বাকী চারজনের দুজন বসেছে মাঝি আবদুল্লাহর পাশে সবচেয়ে উচু জায়গায়, আর দুজন আরেকটু নীচে।

নৌকা নাফ নদীতে পড়ার কিছুক্ষনের মধ্যেই ঝলমলে সূর্য হেসে উঠলো আকাশে। আলোর পরশে ভয় কেটে ভ্রমনের আনন্দ জেগে উঠলো। এত সুন্দর একটা নদী আছে বাংলাদেশে!! আশ্চর্য। পানিটা এত সুন্দর কেন? টলটলে নীল। যেন বিশাল একটা সুইমিং পুল। নদীর একপাশে বাংলাদেশ ম্যানগ্রোভ ফরেষ্টে ঘেরা। অন্যপাড়ে বার্মার উঁচু উঁচু পাহাড়। দারুন মনকাড়া সৌন্দর্য। রুমী ভাইয়ের হাতে লম্বা জুমলেন্সের ক্যামেরা। তিনি ক্যামেরা নিয়ে ছবি তোলায় ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। নৌকাটা ছন্দে ছন্দে দুলছে। এই নদীটা অন্য যে কোন নদীর চেয়ে ভিন্ন। এটার সাধারন স্রোতেই অনেক বড় বড় ঢেউ। সমুদ্রের আদলে নদী। শুনেছি এটা নাকি আসলে সমুদ্রেরই সম্প্রসারিত অংশ বিশেষ। তাই প্রকৃতিটা অন্যরকম। পানির রং আকাশী নীল এখানে।

আধাঘন্টা পর আমরা সমুদ্রে পড়লাম। ঢেউয়ের সাইজ বড় হতে লাগলো। নৌকার দুলুনিতে পার্থক্যটা টের পাচ্ছিলাম। আগের ঢেউগুলি রেলগাড়ী ঝমঝম টাইপের ছিল। এখনকার ঢেউগুলি ছন্দ বিহীন। 'তুলে তুলে আছাড় মার' টাইপের। পানির রংটাও বদলে গেছে হঠাৎ করে। সবুজাভ নীল। এটাকে বোধহয় 'ওশান গ্রীন' বলে। অপূর্ব সুন্দর। আগে বিদেশী সিনেমায় এই রঙের পানি দেখে কত আহা উহু করতাম। অথচ নিজের দেশেই এই ঐশ্বর্য পড়ে আছে। দিগন্তে মিলিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। শেষ প্রান্ত যেটা দেখা যাচ্ছে সেটার নাম শাহপরী দ্বীপ। সামনে অফুরান সমুদ্র। বঙ্গোপসাগরে প্রবেশ করলো আমাদের নৌকা।

প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে বিমোহিত হয়ে আছি। কারো মুখে কথা নেই। তবে ঢেউগুলি আস্তে আস্তে বাড়ছিল অবচেতনে সুক্ষ্ণ একটা ভয়ের রেখা জাগিয়ে। সামনে কোন দ্বীপের চিহ্ন নেই। নাকি আছে। ওটা কী? ওই যে দুর দিগন্তে কালো সুতোর মতো দেখা যাচ্ছে। ওটাই কী সেন্টমার্টিন? রুমী ভাই অভয় দিয়ে বললো, 'ঘাবড়াচ্ছো নাকি। আরে এতো সামান্য ঢেউ, ভয়ের কিছু নেই। আমি আছি। সমস্যা হলে বলবো।' রুমী ভাই পাশে থাকাতে ভরসা পেলাম। উনি অভিজ্ঞ মানুষ বিপদের আভাস আগে ভাগেই টের পাবেন। এখনো তেমন বিপদ নাই।

সমুদ্রের ঢেউয়ের প্রকৃতি দেখতে দেখতে আকাশের দিকে খেয়াল করা হয়নি। হঠাৎ খেয়াল করলাম আকাশের প্রকৃতিও বদলে গেছে। সূর্য মুখ লুকিয়েছে কালো মেঘের অন্তরালে। নৌকা যতই সেন্টমার্টিনের কাছাকাছি যাচ্ছে ঢেউয়ের আকারও বাড়ছিল। টেকনাফ ও সেন্টমার্টিন সমুদ্রের তলদেশ দিয়ে একটা রীফ দ্বারা সংযুক্ত। ফলে এই জায়গায় সমুদ্র সাধারনের চেয়ে একটু উত্তাল থাকে। নৌকাগুলো সরাসরি সেন্টমার্টিনে ভিড়ে না তাই। ঢেউ এড়িয়ে একটু ঘুরে গিয়ে কূলে ভেড়ে। ঢেউয়ের দোলা আশংকাজনক ভাবে বৃদ্ধি পেল। এখন যেটা হচ্ছে সেটা নিছক দোলা নয়। চতুর্মূখী ঝাঁকুনি, সামনে পেছনে, ডাইনে বায়ে। মাঝি আবদুল্লাহর দিকে তাকালাম, সে হাল ধরে নির্বিকার বসে আছে। ঢেউয়ের ঝাপটে নৌকায় পানি পড়ছে। ভিজিয়ে দিচ্ছে যাত্রীদের। ভয়টা এখন স্পষ্ট শির শির করছে। নৌকা কখনো ঢেউয়ের মাথায়, কখনো ঢেউ নৌকার মাথায়। ডাইনে বাইয়ে দুলুনির কারনে নৌকা মাঝে মাঝে ৬০-৭০ ডিগ্রীও কাত হয়ে যাচ্ছে। ভয় পেতে শুরু করেছে যাত্রীদের কেউ কেউ। মাঝির উদ্দেশ্যে চিৎকার করছে। আমার পাশে ইকবাল। সে লাইফজ্যাকেট পরে ফেলেছে। রুমীভাইয়ের চেহারা ভালো ঠেকলো না। ইকবাল বললো তার লাইফজ্যাকেটের ফিতাটা শক্ত করে লাগিয়ে দিতে। আমি জীবনে এই জিনিস লাগাই নি। কোনমতে লাগালাম। সে নীচের খোলের তক্তায় বসলো রুমীভাইয়ের পাশে। রুমী ভাই মুখে কিছু বলছে না। কিন্তু খেয়াল করলাম তাঁর একটা হাত আমার হাটুর উপরটা আকড়ে ধরেছে এবং সেটার চাপ ক্রমশঃ বাড়ছে। আমি আর ভরসা করতে পারলাম না ওনার উপর। বিপদ এত কাছাকাছি এখন কিছু জিজ্ঞেস করে বিব্রত করার মানে হয় না। উনি নিজেই প্রান বাঁচাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন।

ত্রিশ চল্লিশজন দুলছি জীবন মরনের দোলায়। পুরো নৌকায় চিৎকার চেঁচামেচি শুরু হয়ে গেছে। কেউ বলে যাত্রীদের সামনের দিকে সরে যেতে, কেউ বললো ওজন কমাতে। কেউ বলছে ইট বাঁশ এগুলো ফেলে দিতে। এত কোলাহলের মধ্যেও দেখি আবদুল্লাহ নির্বিকার। বরং সে দুর দিয়ে যাওয়া অন্য নৌকার মাঝিদের 'তোম্মারেচুদিইয়া' বলে খিস্তি করছে। এইটা একটা সেন্টমার্টিনের আদিম জনপ্রিয় গালি। ফিরে এসে অনেকদিন চর্চা করেছি আমরা। আবদুল্লাহর দিকে চেয়ে আমি একটু ভরসা পেলাম। তবু নানান চিন্তা ভর করলো। যদি নৌকা ডুবে যায়, কেউ বাঁচবো না। কেউ জানবেও না আমাদের সলিল সমাধি হয়ে গেছে এই মাঝ সমুদ্রে। এই জীবনে তো অনেক কিছু করার বাকী রয়ে গেল।

ইকবালের চোখ মুখ ফ্যাকাসে। সে ঢেউয়ের ভয়ংকর রূপ না দেখার জন্য নীচের খোলে নেমে গেছে। আমি ওকে ভরসা দেবার জন্য ইংরেজী সিনেমার কায়দায় 'ওয়াও' করে চিৎকার করছি কিছু পর পর যেন খুব উপভোগ করছি পাগলা ঢেউয়ের দোলা। হঠাৎ একটা শয়তানি বুদ্ধি আসলো। ইকবালকে বললাম, 'দেখ দেখ ওইতো সেন্টমার্টিন দেখা যায়'। ইকবাল যেখানে বসেছে সেখান থেকে সমুদ্র কিংবা দ্বীপ কিছুই দেখা যাচ্ছে না। যদিও সেন্টমার্টিন বেশ স্পষ্টই দেখা যাচ্ছিল কিন্তু দুরত্ব বেশ কয়েক মাইল হবে। ইকবাল আমার কথায় মাথাটা উচু করতেই ভয়াবহ একটা ঢেউ নৌকার ডানদিকে উদয় হলো। দ্বীপের বদলে এত্তবড় ঢেউ দেখে ভয়ে ইকবাল নীচে বসে পড়লো। তবে মাঝি আবদুল্লাহ কীভাবে যেন ঢেউটা কাটিয়ে নৌকাটাকে বাঁচালো। নৌকাটা বিপরীত ঢেউয়ের আঘাতে আঘাতে এগোতে পারছে না। একপা এগোয় তো, দুই পা পিছোয়। যে ঢেউগুলি আঘাত করছে সেগুলো ডানদিক থেকে ছুটে আসছিল। আমরা দুর থেকেই দেখতে পাচ্ছিলাম ফেনায়িত ঢেউয়ের চুড়াগুলো ছুটে আসতে। প্রতিটা ঢেউ গড়ে আট দশফুট হবে উচ্চতায়। আবদুল্লাহ যেভাবে ঢেউগুলোর মোকাবেলা করছিল, সেই শারিরীক কসরত দেখার মতো। ঢেউটা নৌকার উপর আছড়ে পড়লে নিমেষে তলিয়ে যাবো আমরা। কিন্তু সে ঢেউ কাছে আসা মাত্র কীভাবে যেন নৌকার গলুইটা ঘুরিয়ে দিয়ে আঘাতটা পাশ কাটিয়ে যাচ্ছে। অদ্ভুত সেই ক্যারিকেচার। আবদুল্লাহর ক্ষমতার উপর আমাদের অবাক শ্রদ্ধা চলে আসলো। ওই একজনের হাতের দক্ষতার উপর এতগুলো মানুষের জীবন মরন। 'আমরা গ্রেট আবদুল্লাহ' নামে ভুষিত করেছিলাম তাকে।

পাগলা ঢেউয়ের তান্ডব দেখতে দেখতে শ্রীকান্তের সমুদ্রে সাইক্লোন ঘটনাটা মনে করলাম। এরকম একটা দুর্লভদৃশ্য প্রানের ভয়ে উপভোগ করা থেকে বিরত থাকবো? শ্রীকান্তের ষ্টাইলে ভাবলাম, মরন তো একদিন না একদিন হবেই, আজকে মরলেও যাবার আগে উপভোগ করেই যাই এই ভয়ংকর সৌন্দর্য। দার্শনিক ভাবালুতায় ভয়কে জয় করার ব্যর্থ চেষ্টা করে যাচ্ছি। ক্ষীন আশা আছে হয়তো টিকে যাবো এ যাত্রা। পাঞ্জাবী-সানগ্লাস পরা সেন্টমার্টিনের আরেক ছেলে আমাদের সামনে বসা ছিল তার হাতেও ইকবালের মতো লাইফ জ্যাকেট। তাকে পরিস্থিতির মিটার বানিয়ে নজর রাখছি, সে যদি লাইফ জ্যাকেট পরে ফেলে বুঝতে হবে, রক্ষা নাই আর। কিন্তু সে এখনো লাইফজ্যাকেট পরে নি। সেই ভরসায় আমি সাহসে খানিক উজ্জীবিত ছিলাম অন্যদের চেয়ে।

ঢেউয়ের সাথে ঘন্টাখানেক যুদ্ধ চলার পর নৌকা সেন্টমার্টিনের কাছাকাছি চলে এল। ইকবালকে বললাম তীরের কাছে চলে এসেছি। কিন্তু ইকবাল তখনো আমাকে মিথ্যেবাদী রাখাল মনে করে উপেক্ষা করলো। কারন একটু আগে ওকে সেন্টমার্টিন এসেছে বলে ডেকে বিশাল এক ঢেউ দেখিয়েছি। সে লাইফ জ্যাকেট পড়ে জুবুথুবু হয়ে বসে রইল নীচে। নৌকা বালির চড়ায় ধাক্কা খেয়ে থামলে তারপর সে উঠে দাঁড়ালো।

জুনায়েদ আমাদের দুজনের কাছে এসে ইকবালের লাইফ জ্যাকেটের দিকে তাকিয়ে বললো, "কিরে তোর এটা কে বাঁধছে, ফিতা খোলা, বাধা কিচ্ছু হয় নাই, পুরা ঢিলা রয়ে গেছে, জীবনে লাইফ জ্যাকেট বাঁধস নাই?" ইকবাল বিষ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালো যেন আমি ষড়যন্ত্রমূলকভাবে ফিতাটা বাধি নাই ঠিক মতো।
বললাম- "আরে আমি কী জীবনে এই জিনিস বাধছি নাকি। আর ওই ঢেউয়ের বাড়িতে ফিতা টাইট দিতে পারি নাই। মরলে তো মরতিই, এখন তো বাইচা আছস, এত চেতস ক্যা?"

নৌকা থেকে নামার আগে প্যান্ট গুটাতে হলো। হাঁটু পানিতে নেমে তীরে যেতে হবে। এই আমাদের স্বপ্নের সেন্টমার্টিন? তীরে বেশ কিছু মানুষ উৎসুক দাঁড়ানো। এতক্ষন দুর থেকে দেখছিল আমাদের নৌকার পাগলা নাচন। তিন ঘন্টা সমুদ্রে কাটিয়ে প্রিয় সেন্টমার্টিনের বালিতে পদস্পর্শ করলাম। প্রথম যে বিষয় দৃষ্টি আকর্ষন করলো তা হলো এর স্বচ্ছ টলটলে নীলাভ সবুজ জল। পায়ের তলার বালিও দেখা যাচ্ছে।


অবশেষে সেন্টমার্টিন


নৌকা থেকে নেমেই প্রথম সংলাপটা ছিল ইকবালের। প্রচন্ড তিক্ত, বিরক্ত, বিধ্বস্ত, লাইফ জ্যাকেটের ফিতাবদ্ধ ইকবালের মুখ দিয়ে যেটা বেরুলো-
'দুশশালা! এ কী জায়গা? এই বালি দেখতে এত ফাইটিং করে এখানে আসতে হইছে? কী আছে এখানে ঘোড়ার ডিম! আগে জানলে আমি আসতামই না। তবে আগামী এক সপ্তাহেও ফিরতেছি না আমি। সমুদ্র শান্ত না হওয়া পর্যন্ত ফিরে যাওয়ার কোন ইচ্ছে নেই আমার'।

"সমুদ্র শান্ত না হওয়া পর্যন্ত ফিরে যাচ্ছি না"- এই অংশের সাথে আমি মনে মনে একমত পোষন করেও মুখে বললাম, 'দুর ব্যাটা এত ভয়ের কী আছে, এরুম একটু আধটু ঢেউ না থাকলে জমে নাকি।' যদিও আমার কলিজার ভেতরে ভয়শীতের কাঁপুনিটা তখনো তির তির করছিল।

পানি ডিঙিয়ে বালিতে পা রাখার সাথে সাথে ভয় ডর সব উবে গেল। সুন্দর, তুমি এত সুন্দর। এত সুন্দর একটা দ্বীপ আমাদের আছে। এত দেরী করে তোমার কাছে এসেছি! প্রথম অনুভুতি প্রকাশের কোন ভাষা নেই। আমি যেন আসলেই রবিনসন ক্রুসোর সেই দ্বীপে পদার্পন করেছি। ডাইনে বাঁয়ে বিস্তৃত বালিয়াড়ি। সাদা সাদা বালি। বেশ কিছু জেলে নৌকাকে বালিতে লোহার শিক গেড়ে আটকে রাখা হয়েছে। সামনে নারকেল আর কেয়াগাছের সবুজ বনানী। তার ভেতরে গ্রাম। বালির মধ্যে হেঁটে গ্রামের দিকে এগোলাম। সম্পূর্ন অচেনা একটা জগতে চলে এসেছি। পেছনে তাকিয়ে দেখলাম অনেক দুরে নীলাভ পাহাড়শ্রেনী দেখা যাচ্ছে। এটা দ্বীপের পূর্বদিক। তারমানে পাহাড়গুলো বার্মায়। বাংলাদেশ দেখা যায় না এখান থেকে। ব্রজেন দাস হলে সাঁতরে বার্মা চলে যেতে পারতো অনায়াসে।

দুপুর দেড়টা বাজে তখন। ছয়জন নবীন পর্যটক মাসুম, সমীর, ইকবাল, আমির, জুনায়েদ ও আমি বালিয়াড়ি পার হয়ে সদ্য তৈরী একটা কংক্রীটের বাধানো রাস্তায় উঠলাম। রাস্তাটা দশ ফুট প্রশস্ত। বড়জোর দুটো রিকশা পাশাপাশি যেতে পারবে। সেন্টমার্টিনের একমাত্র হাইওয়ে। রাস্তায় উঠতেই একটা ঠেলাগাড়ী দেখতে পেলাম। সেন্টমার্টিনের একমাত্র বাহন। ঠেলাগাড়ীর লাল রঙের এলোমেলো আঁচরে এমাথা ওমাথা পর্যন্ত বড় অক্ষরে লেখা - 'লালবোর্ড'। আমরা হাসি ধরে রাখতে পারলাম না। এখানেও এসে ঠেকেছে লালবোর্ডের ধাক্কা। পায়ে হাঁটতে ইচ্ছে না হলে এই লালবোর্ড ভাড়া নিতে পারবে।

কনক্রীট রাস্তায় আরেকটু এগিয়ে ছন বেড়ার একটা ঝুপড়ি দেখা গেল। সেন্টমার্টিনের একমাত্র রেষ্টুরেন্ট। বালিতে বাঁশের খুটি গেড়ে ছনের ছাউনি দিয়ে বানানো হয়েছে। চতুর্দিকে তিন ফুট বেড়া দিয়ে ঘেরা। একদিকে প্রবেশ করার জায়গা রাখা হয়েছে। প্রবেশ পথে একটা চুলায় তরকারী রান্না হচ্ছে। কয়েক কেজি শসার টুকরা কড়াইয়ের মধ্যে ডালের পানির ভেতর হাবুডুবু খাচ্ছে। চুলা পেরিয়ে ভেতরে ঢুকলাম। একটা টুলে ক্যাশবাক্স নিয়ে একজন বসা। সারিবদ্ধ বেঞ্চ পাতা। স্কুলের মতো অনেকটা। বেঞ্চগুলো কুড়োল কাটা টাইপ এবড়ো থেবড়ো। মোটেও সুনির্মিত নয়। কতগুলো তক্তাকে বালিতে বাশ গেড়ে তার উপর বসিয়ে দেয়া হয়েছে। হোটেলে মেঝে বলতে কিছু নেই। সরাসরি সৈকত বালি। আদিম বালিয়াড়িতে হোটেলের ভেতর বাহির সমান। রেষ্টুরেন্টের ভেতরেও জুতো সবার হাতে হাতে। এই দ্বীপে কেউ জুতো স্যান্ডেল পায়ে হাঁটে না, হাঁটার উপায় নেই।

আমরা ক্লান্ত হয়ে তক্তা বেঞ্চগুলোতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে পড়লাম। খিদে পেয়েছিল খুব। হোটেলে তেমন কাস্টমার নেই। হোটেল ম্যানেজার বা মালিককে জিজ্ঞেস করলাম কী আছে। মালিক জানালো ওই শসা- ডাল ওটাই আজকের তরকারী। আর কিছু নেই? না। মাছ মাংস কিছু নেই? না। জানলাম এখানে একটা আইটেমই রান্না হয়। মাছ থাকতো, কিন্তু আবহাওয়া খারাপ থাকাতে সাগরে নৌকা নামেনি, তাই শসা তরকারীই আজকের একমাত্র আইটেম। আমরা তাতেই রাজী। মোটাচালের ভাত দিয়ে গপাগপ খেয়ে নিলাম। খারাপ না। খাওয়া সেরে রাতের আশ্রয় খুজতে বেরুলো সমীর আর জুনায়েদ। সমীর আস্বস্ত করলো, সে আসার পথে এখানকার একজনের সাথে খাতির জমিয়ে ফেলেছিল। সে থাকার জায়গার ব্যাপারে সাহায্য করবে বলেছিল। এখন তাকেই খুঁজতে যাচ্ছে। বাকীরা বসে থাকলাম সেই ঝুপড়িতে। আকাশ মেঘলা, বৃষ্টি নামতে পারে যে কোন সময়। তার আগেই একটা ব্যবস্থা করতে পারলে হয়।

আধাঘন্টার মধ্যে সমীর জুনায়েদ ফিরে এলো। ব্যবস্থা হয়েছে। সমুদ্রের পাড় দিয়ে দক্ষিনে হাঁটা দিলাম সবাই। সমুদ্র পাড়ে শুটকির আড়ত দেখা গেল বেশ বড় বড়। এগুলো পেরিয়ে আরো কয়েকশো গজ যাবার পর সমীর অদুরে সমুদ্রপাড়ে দোতলা একটা বাংলোটাইপ দালান দেখিয়ে বললো ওটাই আমাদের আশ্রয়। বলে কী? এ যে মেঘ না চাইতে জল। যেখানে বেড়ার ঘর পাবো কি না সন্দেহ ছিল সেখানে সৈকতে দাঁড়ানো ইট সিমেন্টে বাধানো দোতলা বাংলো?

সমীর তখন জানালো, বাংলোটা একটা এনজিও'র রেষ্টহাউস। আসার পথে নৌকায় যার সাথে খাতির করেছে সে ওই এনজিওতে চাকরী করে বাংলোটার কেয়ারটেকার হিসেবে। পাশেই তার বাড়ী। এক রাতের জন্য তাকে শ খানেক টাকা দিলেই চলবে বলেছে। বাংলোটা ছোটখাট কয়েকটা পিলারের উপর দাড়িয়ে আছে উপজাতীয়দের বাড়ীর মতো। নীচতলায় কিছু নেই। উপরে দুটো রুম আছে, যে কোন একটা আমরা নিতে পারি। একটা কমন বাথরুম। পানি নেই, পানি নীচের টিউবওয়েল থেকে সংগ্রহ করতে হবে। রুম দুটোর মধ্যে একটা ফার্নিচার দেখলাম, অন্যটা একদম খালি। আমরা ফার্নিচারসহ রুমটা নিলাম। খাটে তিনজন, নীচে তিনজন থাকা যাবে। আমরা রুমে ঢুকে আয়েশ করে বসলাম। জানালা দিয়ে তাকালে দেখা যাচ্ছে সমুদ্রের ঢেউ আছড়ে পড়ছে সৈকতের উপরে মাত্র কয়েকশ ফুট দুরে। কী অপূর্ব এক দৃশ্য। দিগন্তজোড়া নীলাভ সবুজ জলের উথালপাথাল ঢেউ। বাংলাদেশে বসে কখনো এরকম একটা দৃশ্য দেখা যাবে স্বপ্নেও ভাবিনি। আমাদের চিরচেনা সমুদ্র এতটা রূপবতী ছিল না। এই সৌন্দর্যের সাথে কক্সবাজারের সমুদ্র ভীষন ভীষন ম্লান। এত সুন্দর জায়গায় এমন একটা আশ্রয় পাবো স্বপ্নেও ভাবিনি। তাও প্রায় বিনামূল্যে। পোষাক বদলে আয়েশ করে বসলো সবাই। ঘুরতে যাবার প্ল্যান হচ্ছে। এমন সময় দরজার বাইরে কিছু উত্তেজিত কন্ঠস্বর শোনা গেল। এই বিরানভূমিতে সভ্যমানুষের চিৎকার হল্লা বড় বেমানান লাগলো। জুনায়েদ দরজা খুলে বাইরে গিয়ে দেখে আসলো ব্যাপারটা। এসেই খিক খিক করে হাসতে থাকলো।

এই ব্যাটা ঘটনা কী বল- সমীর ধমকে উঠলো। ব্যাপার হচ্ছে, টেকনাফে দেখা হওয়া সেই নবীনবাবু টাইপ ছেলেগুলো একটু আগে এসে পৌছেছে বিশেষ ব্যবস্থায়। বিশেষ ব্যবস্থা হচ্ছে ছোট জেলে নৌকা ওরা পাঁচ জনে রিজার্ভ করে এসেছে। আসার পথে ছোট নৌকাটার ঝাঁকুনি নাকি জীবনে ভোলার মতো না। আমরা কল্পনা করে শিউরে উঠলাম। আমাদের বড় নৌকার যে অবস্থা দেখেছি, ওদের ছোট জেলে নৌকার ডিসকো নাচন যে তার দশগুন বেশী ছিল তাতে কোন সন্দেহ নেই। তারা দ্বীপে নেমেই আয়েশী জায়গা খুঁজতে লেগেছে। কারো কাছে এই বাংলোর খবর পেয়ে ছুটে এসে দেখলো ভালো রুমটা দখল হয়ে গেছে এবং দখল করেছি সেই দল যাদেরকে গত রাতে ফুঁ পাত্তাও দেয়নি টেকনাফে। কেয়ারটেকার তাদেরকে আমাদের উল্টোদিকের ফার্নিচার বিহীন ঘরটায় থাকতে বলাতেই তীব্র আপত্তি, চেঁচামেচি এবং ওয়াকআউট। ভাগ্যিস আমরা বিশেষ ব্যবস্থায় আসিনি।

এখানে সবকিছু অন্যরকম। পরিচিত সভ্যজগত থেকে অনেকটা ভিন্ন। দুপুরে হোটেল থেকে খেয়ে ফেরার আগে আমাদের জানিয়ে দেয়া হয়েছিল রাতে আমরা ওখানে খাবো কি না বিকেলের মধ্যে জানিয়ে দিতে। তাহলে আমাদের জন্য রান্না করবে। নইলে রাতে তেমন রান্না হয় না। আমরা তখুনি জানিয়ে এসেছিলাম রাতে খাবো। মাছ তো নেই তাই হোটেল মালিক জানিয়েছে রাতে মুরগী রান্না করার চেষ্টা হবে যদি কোন বাড়ী থেকে একটা ধরে আনা যায়। এখানে বাজার নেই। সাগরে নৌকা নামলে মাছ পাওয়া যায়। আর মুরগী খেতে হলে গ্রামের কোন বাড়ী থেকে ছুটন্ত মুরগীকে কব্জা করে আনতে হয়। এরকম আদিম অবস্থা দেখে আমরা চমৎকৃত হলাম।

বাইরে বেরুতে চেয়েছিলাম কিন্তুএকটু পরই ঝির ঝির বৃষ্টি পড়তে শুরু করলো এবং আমরা আটকে গেলাম এই বীচ কটেজে। নিরাপদ জায়গায় বসে ভাবছি সেই নবীনবাবুদের কি দুর্দশা চলছে এই বৃষ্টিতে। বাইরে যাওয়া হলো না বলে চারজনে তাসের প্যাকেট খুলে বসে গেলাম। চারজন খেলছি, দুজন দর্শক। জুনায়েদ আর আমির ভাই। আমির ভাই আমার খালাতো ভাই, কয়েক বছরের বড়, কিন্তু বন্ধুর মতো। উনি তাস খেলার কিছু বোঝেন না। তাই কিছুক্ষন খেলা দেখার পর বিরক্ত হয়ে জুনায়েদকে পটিয়ে বৃষ্টি মাথায় নিয়ে বেরিয়ে গেলেন গ্রাম দেখতে। আমরা বললাম, সাবধান এখানে কেসাট্টা দিলে বাড়ীতে ফেরা যাবে না আর। আমরা খেললাম ঘন্টাখানেকের মতো। ওরা গেছে তো গেছে আর ফিরে না। আমরা সত্যি টেনশানে পড়লাম। খেলা শেষ হয়ে গেছে বেশ আগে। সবাই একসাথে ঘুরতে বেরুবো বলে বসে আছি। ওই দুইজনের পাত্তা নেই। এদিকে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয় হয়। কোন আপদ বিপদে পড়লো না তো? খবর নেবারও উপায় নেই। কোথাও বেফাঁস কৌতুহল দেখাতে গিয়ে সত্যি সত্যি কেসাট্টা মার খাচ্ছে না তো? এখানকার লোকজন যেরকম কালো কালো দৈত্যটাইপ, ধরলে রক্ষা নাই।

অবশেষে আমরা গ্রামের উদ্দেশ্য বেরিয়ে পড়তে দেখা গেল ওরা দুজন আধভেজা হয়ে বালি ভেঙে ফিরছে অভিজ্ঞতার ঝুলি নিয়ে। বৃষ্টি মাথায় নিয়ে সারা গ্রাম চষে ফেলেছে। কোথায় কি আছে সব মুখস্ত হয়ে গেছে। হুমায়ুন আহমেদের বাড়ীর অসমাপ্ত কাজও পরিদর্শন করে এসেছে।

জুনায়েদ আফসোসের সাথে জানালো - তবে এই দ্বীপে একজন জেনানাও দেখা যায়নি কোথাও। বোধহয় তেনারা এই নির্জন দ্বীপে বসবাস পছন্দ করেন না।'
সমীর খিস্তি করে উঠলো - 'শালা লুইচ্যা যেখানে যাও সেখানেই মাইয়া মানুষ খোঁজো, খাসলত আর গেল না।'
ইকবাল বললো,- 'মেয়ে নিশ্চয়ই আছে, পথে আসতে বেশ কয়েকটা বাচ্চা দেখলাম, ওগুলো হইলো কী করে?'
ইকবালের উচ্চবুদ্ধি পরিমাপ করে আমরা হেসে খুন।


দ্বীপ পরিভ্রমন

বৃষ্টি থেমে গেছে। আঁধার নামেনি তখনো। আমরা কটেজ থেকে বেরিয়ে ভেজা বালির উপর দিয়ে খালি পায়ে হেঁটে দ্বীপের পশ্চিম প্রান্তের দিকে রওনা দিলাম। সামনে তাকালে সোজা ধূধূ ভারত মহাসাগর। বঙ্গোপসাগর তো ভারত মহাসাগরেরই অংশ। তবে একটা মহাসাগরের পাড়ে দাঁড়িয়ে আছি ভাবতেই বেশী ভালো লাগলো। সাগরপাড়ে অসংখ্য ঝিনুক শামুক প্রবাল পাথরের ছড়াছড়ি। দুহাতে কুড়াতে কুড়াতে ক্লান্ত হয়ে পড়লাম। এত কিছু নেব কী করে। এক জায়গায় গিয়ে দেখলাম ঝিনুকের বিশাল পাহাড়। এত বিশাল স্তুপ যে এতক্ষন যা কুড়িয়েছি তা নস্যি মনে হলো। এতক্ষনের কুড়োনোগুলো ফেলে দিলাম এরকম সহজলভ্য ঝিনুকের খনি পেয়ে। পুরো উপকুল জুড়ে বিশাল বিশাল কেয়া গাছ। আনারসের মতো ফল ধরে ধরে ঝুলে আছে আছে। এই গাছগুলো কে লাগিয়েছে খোদা মালুম। এত্তবড় দৈত্যাকার কেয়াগাছ কোথাও দেখিনি। ঘুরে ঘুরে ছবি তোলা হলো বেশ অনেকগুলো। ঘোরাঘুরি করতে করতে সন্ধ্যা হয়ে এল। আবার নৌকাঘাটের এলাকায় এলাম। এই হাইওয়ে দিয়ে নাকি পুরো গ্রামে যাওয়া যায়। তবে লালবোর্ডকে দেখা গেল না আগের জায়গায়। প্রথমে সেই হোটেলে গিয়ে রাতের খাবারের অর্ডার নিশ্চিত করলাম। পাশের কার বাড়ী থেকে একটা মোরগ ধরা হয়েছে। সেটা রান্না হচ্ছে এখন আমাদের জন্য। আরেক বাড়ীতে কয়েকটা ডিমের সন্ধানও পাওয়া গেছে। চাইলে এনে ভেজে দিতে পারবে। বাহ্ রাতে তো শাহী ভোজন হবে। ডিম ভাজি আর দেশী মুরগীর ঝোল দিয়ে দারুন খাওয়া হবে। মাছ খেতে না পারার শোকটা মোটামুটি ভুলে থাকা যাবে।

হোটেলে চা খাওয়া হলো বিস্কুট দিয়ে। সিগারেট শেষ। জিজ্ঞেস করে জানা গেল সামনে একটা মুদি দোকান আছে। সেখানে সিগারেট মিলবে। কিছুদুর এগিয়ে দেখি সত্যি একটা মুদির দোকান আছে এবং বাঁশের বেড়ার তৈরী দোকান হলেও এখানে মোটামুটি গিরস্থালি প্রয়োজন মেটানোর সব জিনিসই পাওয়া যায়। এরকম একটা দোকান সেন্টমার্টিনে আছে জানলে আমরা টেকনাফে অযথা এত জিনিস কিনতাম না। অনেক কিছু থাকলেও বেনসন, গোল্ডলীফ, ট্রিপল ফাইভ এসব সিগারেট নেই কিছুই নেই। এখানে সাধারন ধূমপায়ীরা বিড়ি খায়, খান্দানীরা নেভী সিগারেট। শেষে নেভীতেই গেলাম। রোমে গেলে রোমান হওয়াই উচিত।

গ্রামটা বাংলাদেশের অন্যন্য গ্রামের মতোই। তবে প্রতিটা ঘর সামনে বেড়া দিয়ে আড়াল করা। রাস্তা থেকে দেখা যায় না উঠোন। একারনেই জুনায়েদ এখানে কোন জেনানার দেখা পায়নি। তাছাড়া এলাকার লোক খুবই ধর্মভীরু। মেয়েরা অন্তঃপুরেই থাকে। কিছুদুর এগিয়ে সাইক্লোন শেল্টার পড়লো। এটা নাকি পুরোনোটা। আরেকটা নতুন উঠেছে। পুলিশ ফাঁড়িও আছে একটা। যতটা অজ ভেবেছি ততটা নয়। অন্য কোথাও জায়গা না মিললে পুলিশ ভাইদের সাথে একরাত কাটানো কোন ব্যাপার না। হাজত নাকি সারা বছরই খালি। কারন এটা বাংলাদেশের একমাত্র অপরাধবিহীন দ্বীপ। আর কিছুদুর এগিয়ে প্রাইমারী স্কুল পড়লো একটা। টিনের চালা, বেড়া দিয়ে তৈরী। অন্ধকার হয়ে গিয়েছিল ততক্ষনে। টর্চ মেরে মেরে দেখতে হচ্ছিল চারপাশ। স্কুল পেরিয়ে আরেকটু সামনে এগোতে আবারো ঝিরঝির বৃষ্টি নামলো। দৌড়ে স্কুলের দিকে ফিরে এলাম। ভাগ্য ভালো ক্লাস রুমের দরজাগুলো খোলা ছিল। স্কুলের মেঝেটা বেশ উঁচু। মাথার উপর টিনের চালে ঝম ঝম বৃষ্টির বাজনা দারুন লাগলো। ছ'জন অন্ধকারে বসে আছি। কাজ না থাকলে যা হয় - সমীর ঘোষনা করলো, এখন বক্তৃতা প্রতিযোগিতা হবে। একজন একজন মাষ্টারের চেয়ারে বসবে, সে যখন ভাষন দেবে বাকীরা চুপ করে শুনবে। শ্রেষ্ট বক্তাকে রাতে বিশেষ পুরষ্কারে ভুষিত করা হবে। শুরু হলো বক্তৃতা মালা। প্রথমে আমি উঠলাম। ঘুটঘুটে অন্ধকার বলে বক্তার মুখে টর্চ লাইট দিয়ে আলোকিত করা হলো। শুরু করলাম :

-"সেন্টমার্টিনের জন্য আজ এক ঐতিহাসিক দিন। যদিও দ্বীববাসী এখনো জানে না তাদের সৌভাগ্যের কথা। বাংলাদেশের সর্বদক্ষিনের এই দ্বীপে পদার্পন ঘটেছে চেঙ্গিজ খানের দুই মহান বংশধর চ্যাট বাহাদুর জুনায়েদ ও খান বাহাদুর মাসুম। যুগে যুগে বিশেষ শারিরীক বৈশিষ্টের কারনে চেঙিজ খানের মতো বিশ্বজয়ী পুরুষদের জন্ম হয়। সেই বিশেষ গুনের অন্যতম হলো একটা মাত্র বিচি থাকা। ঐতিহাসিকদের মতে চেঙিজ খানের নাকি একটা বিচি ছিল, হিটলারেরও এক বিচি। যে বিচির গুনে তার বিশ্বজয়ী যোদ্ধা হতে পেরেছিল। আজ আমরা তাদের যে সুবংশধর আমাদের মাঝে পেয়েছি তারাও এক বিচি ভাগ্যের অংশীদার। তারা হয়তো এই জাতির ভাগ্যবিধাতা হতে যাচ্ছে শীঘ্রই। তাই জাতির উচিত তাদের দুজনের প্যান্ট খুলে বিচির সংখ্যাগুলো যাচাই করে নেয়া........."

এই পর্যন্ত আসতেই মাসুম আর জুনায়েদ যৌথ গলায় "হারামজাদা, শুয়োরের বাচ্চা, আইজ তোরে পাইছি" বলে আমার দিকে তেড়ে এলে, আমি মঞ্চ থেকে লাফ দিয়ে নেমে নিরাপদ দুরত্বে ভোঁ দৌড় দিলাম বাইরের বৃষ্টিতে। ভেতরে তখন হাসির ফোয়ারা চলছে দুজনকে নিয়ে। পন্ড হয়ে গেল বক্তৃতার আসর। একটু পর গান ধরলাম সবাই মিলে। দেখা গেল যে গানই ধরি দুই বেসুরো কন্ঠের কারনে ভজঘট হয়ে যাচ্ছে। আবার নতুন গান ধরতে হয়। সৃষ্টিকর্তা সবার গলায় যে সারেগামা দেয় নাই সেটা পরিষ্কার বোঝা গেল জুনায়েদ আর আমিরভাইয়ের কন্ঠে। এইসব হাবিজাবি করতে করতে বৃষ্টি ধরে এল, আমরা স্কুল ঘর ছেড়ে বাইরে এলাম। বাইরে সুনসান নীরবতা। ঝিঁঝিঁ পোকার শব্দটা বেশ কানে বাজে। রাস্তায় লোকজন তেমন নেই। পাশ দিয়ে যারা যায় সবাই আমাদের দিকে অবাক হয়ে তাকায়। হাঁটতে হাঁটতে একটা জায়গায় গিয়ে হঠাৎ সেন্টমার্টিন হাইওয়েটা শেষ হয়ে গেল। জুনায়েদ বলেছিল এই রাস্তার শেষে আছে হুমায়ুন আহমেদের অসমাপ্ত বাড়ী। আলোচিত বাড়ীটা দেখার ইচ্ছা সবার। কিন্তু অন্ধকারে লোকেশান ঠাহর করা যাচ্ছে না। রাস্তা শেষে বালির পথ আছে, সেই পথে কিছুদুর হাটার পর কিসের যেন গুড়গুড় শব্দ শোনা গেল। থমকে দাড়িয়ে কান পেতে শুনলাম। শব্দটা তখনো চলছে। ঘুর্নিঝড়ের সময় এ ধরনের শব্দের সাথে পরিচিত আমরা। শরীরে কেমন কাটা দিয়ে উঠলো। আরেকটু এগিয়ে ঝোপের ফাক দিয়ে দেখি সামনেই সমুদ্র, তীরে বিশাল বিশাল ঢেউ আছড়ে পড়ছে। ব্যাপার তাহলে এই।

আসলে দ্বীপটা তো খুব ছোট। যেদিকেই যাওয়া হোক, পাঁচ দশ মিনিট সোজা হাটলে সমুদ্র চলে আসবে। দ্বীপের এই এলাকা লোকবসতি বিবর্জিত। নির্জনতার একটা শিহরন আছে। এতগুলো মানুষ একসাথে আছি তবু কেমন ভয় ভয় আধিভৌতিক অনুভুতি হলো। আমরা জঙ্গলের ছায়ায়, সামনে কেয়াঝোপের ফোকড় দিয়ে বালির উপর আছড়ে পড়া গর্জানো ঢেউগুলো দেখা যাচ্ছে। ওই পাগলা সমুদ্রে কাটিয়েছি আনেকটা সময় কয়েক ঘন্টা আগে। ভাবতে কেমন যেন লাগলো। জঙ্গলটা যেন কেমন রহস্যে ঘেরা। অন্ধকারের কারনেই এমনটা লাগছে? কে জানে। তবে এই জায়গাটার কী যেন অস্বাভাবিকতা আছে। কেন যেন সামনের জঙ্গল পেরিয়ে সমুদ্রের দিকে যেতে ভালো লাগলো না। মনে হচ্ছে পৃথিবীটা ওখানে কাত হয়ে আছে, সমুদ্রের কাছাকাছি গেলে, খাদের কিনারা গড়িয়ে নীচে পড়ে যেতে পারি। এমন লাগলো কেন? সবারই এই অনুভুতি হচ্ছে কী? সবাই এত চুপ হয়ে গেছে কেন হঠাৎ। এতক্ষনের রসিকতা হৈ হুল্লোড় সব থেমে গেল যেন কোন অদৃশ্য যাদুর ছোঁয়ায়। কিন্তু কেউ কাউকে কিছু বললো না। ঘড়ি দেখলাম রাত সাড়ে আটটা বাজে। আর না এগিয়ে ফিরতি পথ ধরলাম সবাই। আমাদের পুরো চারদিনের ত্রিমাত্রিক আনন্দ ভ্রমনে ওটাই ছিল একমাত্র ছন্দপতন। তবে রহস্যটা কখনোই বুঝিনি।

ফিরে আসার সময় একজায়গায় বিরাট একটা গাছ চোখে পড়লো। গাছটার সামনে দাড়িয়ে পড়লাম আমরা। ওরেবাপস্। এত্ত বড় গাছও আছে ছোট্ট এই দ্বীপে! কী গাছ বোঝা যাচ্ছে না অন্ধকার। ফলজ গাছ নয় সেটা প্রায় নিশ্চিত। আগা থেকে মাথায় চোখ বুলিয়ে গাছটার বয়স কত হবে আন্দাজ করার চেষ্টা করছি, একেকজন একেক ধারনা দিচ্ছিল ইচ্ছেমতো। পেছনে কে একজন এসে দাড়িয়েছে খেয়ালই করিনি অন্ধকারে। গলা শুনে চমকে ফিরে তাকালাম খুব বয়স্ক একজন লোক দাঁড়িয়ে আছে।

-অনরা কন বাজি (আপনার কে বাবা?)
-আঁরা শহরততুন আসসিদি( আমরা শহর থেকে এসেছি)
-কিল্লাই, গাছ চাইবাল্লাই না? (কেন গাছ দেখার জন্য?)
এটা শুনে সমীরের মাথায় দুষ্টবুদ্ধি খেললো। সে বললো।
-জী চাচা, আঁরা গাছ বিশেষজ্ঞ। সেনমার্টিনর বেয়াগুততুন বড় গাছ হোন্নোয়া তোয়াইবারলাই আসসিদি (আমরা গাছ বিশেষজ্ঞ, সেন্টমার্টিনের সবচেয়ে বয়স্ক গাছটা খুঁজে বের করতে এসেছি)
-অ, ইবা ত একশ দেড়শ বছরর বেশী অইবু, আঁর দাদারও আগে, কিন্তু ইবাততুনো ফুরান গাছ আছিল, তুয়ানে ফরি গেইয়িগুই (এটা তো এক দেড়শ বছরের বেশী হবে, আমার দাদারও আগে, কিন্তু এটার চেয়েও পুরোনো একটা ছিল, তুফানে পড়ে গেছে)
-চাচার বয়স হত অইবু? (চাচা আপনার বয়স কত?)
-তা বাজি বউত (তা অনেক বাবাজী)
-বউত হত? (বহু কত?)
-একশ বছরর হাছাহাছি (একশো বছরের কাছাকাছি)
-ওমমারেম্মা, অনর বয়সত এই গাছর হাছাহাছি (ও মারে মা,আপনি তো এই গাছের কাছাকাছি বয়স)
-আঁই সেনমাটিনর বেয়াগুততুন বুড়া মানুষ (আমি সেন্টমার্টিনের সবচেয়ে বুড়ো মানুষ)

শুনে আমরা চমৎকৃত হলাম। সেন্টমার্টিনের সবচেয়ে বয়স্ক মানুষ ও সেন্টমার্টিনের সবচেয়ে বয়স্ক গাছ দুটোকে এক সাথে পাওয়ার সৌভাগ্য কজনের হবে। নিশ্চয়ই এই বুড়ো সেন্টমার্টিনের জীবন্ত ইতিহাস। চাচাজানের দীর্ঘ সাক্ষাৎকার নেবার ইচ্ছেটাকে দমন করতে হলো পরিবেশ পরিস্থিতি ও সময় স্বল্পতার কারনে। বিদায় নিয়ে চলে গেলেন তিনি।





রাতের সেন্টমার্টিনে সৈকতজুড়ে আলোর মিছিল

ফেরার পথে মনে হলো একেবারে খাওয়াদাওয়া শেষ করেই কটেজে যাই। কারন কটেজ এখান থেকে অন্ততঃ পোয়ামাইল দুরে, বালির উপর দিয়ে হাঁটার ঝক্কিও কম না। হোটেলের প্রবেশ মুখে টিমটিম করে কেরোসিনের হারিকেন জ্বলছে। রান্না শেষ। যাওয়া মাত্র খাবার পরিবেশন করা হলো। মুরগীর ঝোলটা প্রত্যাশার চেয়ে অনেক বেশী স্বাদু হয়েছে। পেঁয়াজ মরিচ কেটে সালাদের মতো একটা বস্তু তৈরী করা হয়েছে। দারুন লাগলো। খেতে খেতে আবদুল্লাহকে আসতে দেখা গেল। আমাদের দেখে এগিয়ে এল। বললো কাল সকালে সে টেকনাফ যাবে, আমরা গেলে যেতে পারি। আমরা তখনো নিশ্চিত না যাবো কি না। সমুদ্র ওরকম ফোঁসফোঁস করতে থাকলে যাবো না। তবু তাকে বললাম, দেখা যাক। আলাপ হলো আবদুল্লাহর সাথে। সে এখানকার স্থানীয় বাসিন্দা। বাড়ীটা কাছাকাছিই ইশারায় দেখালো। আমাদের বললো তার ঘরে যেতে। কিন্তু আমরা তার ঝামেলা হবে ভেবে রাজী হলাম না। সে বললো তার পেশাকে সে খুব উপভোগ করে। আমি আর সমীর ওর সাথে আড্ডা জমিয়ে দিলাম বন্ধুর মতো। হুমায়ুন আহমেদের মতো আমরাও যদি একটা ঘর বানাতে পারতাম এই দ্বীপে, মাঝে মাঝে এসে থাকা যেতো। এখানে জমির দাম কেমন জিজ্ঞেস করাতে আবদুল্লাহ বললো, এটা কোন ব্যাপার না। পাঁচ হাজার টাকা দিলে ঘর বানানোর মতো জায়গা কেনা পাওয়া যাবে। তবে সে আমাদের জন্য দুই কাঠা জমি ফ্রী দিতেও রাজী। আমরা তার এত বড় মহানুভবতায় অবাক হয়ে গেলাম। আমাদের আস্তানার ঠিকানা জানিয়ে বিদায় নিলাম ওর কাছ থেকে।

সমুদ্রতীর ধরে বালিয়াড়ির উপর দিয়ে হেঁটে হেঁটে কটেজে ফিরছি। সমুদ্রে জোয়ার এখন। আসার সময় যেদিক দিয়ে হেঁটে এসেছি সেখানে এখন অথৈ জল। অন্ধকার টর্চ জালিয়ে হাঁটছি। সাবধানে হাটতে হচ্ছিল, কারন জেলে নৌকাগুলো এক ধরনের আকশি দিয়ে বালির ভেতর আটকানো, কোন কোনটার চোখা মাথা বালির ভেতর থেকে উঁকি মেরে আছে, ভুলে একবার পা পড়লেই হয়েছে, এফোড় ওফোড় হয়ে যাবে পা। কিছুদুর হাঁটার পর কটেজের কয়েকশো গজ আগে সমুদ্রের গজরানো ঢেউগুলোর দিকে চোখটা হঠাৎ আটকে গেল। ঢেউগুলো সাদা সাদা ফেনা মাথায় নিয়ে সৈকতে আছড়ে পড়ছে। সমুদ্রের ঢেউ সাদা ফেনা নিয়ে আছড়ে পড়বে এটা তো বিরল কোন দৃশ্য নয়। তবু কী যেন মিলছে না। আকাশে চাঁদ নেই। তারার আলোয় এতটা দ্যুতি নেই যে দুরবর্তী সমুদ্রের ঢেউ দেখা যাবে। এখানে কোথাও বিদ্যুত নেই। দশদিগন্ত অন্ধকার। তবু কেন সেই ঢেউগুলো এত স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে? নিজে নিজে দেখছি, ওদের কাউকে তখনো বলিনি। নিজেকে কোন ব্যাখ্যায় সন্তুষ্ট করতে না পেরে হেটে সমুদ্রের দিকে এগিয়ে গেলাম কাছ থেকে দেখার জন্য। এবার সাদা নয় নীলাভ দেখাচ্ছে। যেন ঢেউয়ের মাথায় কেউ মার্কারি বাতি জ্বালিয়ে দিয়েছে। রহস্যময় ঢেউগুলো যেখানে আছড়ে পড়ছে সেখানে পৌছালাম।

ওহ্ গড!! এ কী দৃশ্য দেখলাম আমি! চিৎকার করে সমীরকে ডাকলাম। সবাই ছুটে এলো। বিরল অবিস্মরনীয় একটা দৃশ্য পুরো সৈকত জুড়ে। লক্ষ কোটি তারার মেলা বসেছে যেন সেন্টমার্টিনের পুরো সৈকতে। যে আলো ঢেউয়ের মাথায় জ্বলছিল, তা এই সকল আলোক দানার সমষ্টি। উপরে আকাশে যেমন লক্ষ কোটি তারা নানা বর্নে ছড়িয়ে আছে, এখানেও বালির মধ্যে জ্বলজ্বল করছে লাল, নীল, সবুজ, হলুদ, বেগুনী হরেক বর্নের হীরক খন্ড। নিজস্ব আলোতে উদ্ভাসিত এইসকল সাগর তারকারাজি। ছোট বড় নানান উজ্জ্বলতায় জ্বলছে তারাগুলো। সেন্টমার্টিন দ্বীপের অনেক বর্ননা পড়েছি, কিন্তু এরকম একটা বিরল সৌন্দর্যের বর্ননা কোথাও চোখে পড়েনি। এই অপরূপ সৌন্দর্যের কোন তুলনা কী আছে? প্রথম কয়েক মিনিট সবাই বাকহারা। আস্তে আস্তে সবাই ধাতস্ত হলো। তারপর শুরু হলো সৈকত জুড়ে বাচ্চা ছেলেদের মতো লাফালাফি। চিৎকার। হোওওওওওওওওওও করে ডাক পাড়লাম মহাবিশ্বের উদ্দেশ্যে। এই সৌন্দর্যের বর্ননা করার ভাষা আমার জানা নেই। নিজ চোখে না দেখলে কেউ বুঝবে না কী অপূর্ব সেই সৌন্দর্য। এক মুহুর্তেই যেন জীবন নিয়ে যত হতাশা ছিল সব উবে গেল। পৃথিবীতে আমাদের আর কোন চাওয়া নেই। মানুষ যুগ যুগ অপেক্ষা করতে পারে এরকম একটা বিস্ময়কর দৃশ্যের জন্য। এই দৃশ্যকে ধারন করার কোন যন্ত্র থাকতো যদি! ক্যামেরায় দৃশ্যটা তোলা সম্ভব নয়। একটা তারা হাতে নিয়ে টর্চ দিয়ে দেখলাম। স্বচ্ছ লেবু দানার মতো একটা বস্তু, সরিষা দানার সাইজ। হাতে নিয়ে দেখলাম বেশ কিছুক্ষন জ্বলে, এই আলোতে ঘড়ির সময় পর্যন্ত দেখা যায়। এতটা উজ্জ্বল ও দ্যুতিময়। দুহাতে পিষে মেখে নিয়ে দেখি পুরো হাতটাই জ্বলজ্বল করছে। আলোকিত একটা হাত। অদ্ভুত। পরে জেনেছি ওইগুলি নাকি ফসফরাস। বিশেষ বিশেষ সময়ে দেখা যায়। প্রবাল দ্বীপেই দেখা যায় সাধারনত।

সেন্টমার্টিনের সবচেয়ে সুন্দর এই দৃশ্যটা অনেকেই দেখতে পায় না, কারন এটা বিশেষ বিশেষ সময়েই দেখা যায়। জোয়ার ভাটার সাথে কোন একটা সম্পর্ক হয়তো আছে। প্রায় দশ বছর পর ২০০৩ সালে দ্বিতীয়বার সেন্টমার্টিন গিয়েছিলাম বউকে নিয়ে হানিমুনে। তখন অনেক খুঁজেও দেখতে পাইনি সেই দৃশ্যটা।

এরকম একটা দৃশ্য প্রানভরে উপভোগ করতে হলে দ্বীপটাকে অবশ্যই বিদ্যুৎবিহীন হতে হবে। নইলে বিদ্যুতের আলোকে হারিয়ে যাবে এই বিস্ময়কর সৌন্দর্য। যারা পূর্নিমা দেখতে সেন্টমার্টিন যায় তাদের বলি পূর্নিমা দেখার জন্য কষ্ট করে সেন্টমার্টিন পর্যন্ত আসার দরকার নেই, কক্সবাজার-ইনানীই যথেষ্ট। হুমায়ুন আহমেদ অনেক পূর্নিমা রাত কাটিয়েছেন এই দ্বীপে। সম্ভবতঃ তিনি পূর্নিমা নিয়ে বেশী ব্যস্ত থাকাতে এই দৃশ্যটা থেকে বঞ্চিত থেকেছেন, নইলে তাঁর লেখায় এমন একটা বিরল সৌন্দর্যের বর্ননা আমার চোখে পড়েনি কখনো। আমি কেবল একজনের লেখাতে এই সৌন্দর্যের বর্ননা পেয়েছি। নীচে তার খানিকটা দিলামঃ

......when on rising one night, after my three hours' nap, while it was yet dark, I was amazed and a little alarmed to find myself floating in what appeared to be a sea of blue fire! I had often noticed the beautiful appearance of phosphorescent light, but this far exceeded anything of the sort I ever saw before. The whole sea appeared
somewhat like milk and was remarkably luminous.

I rose in haste, and, letting down a bucket into the sea, brought some of the water on board and took it down to the cabin to examine it; but no sooner did I approach the light than the strange appearance disappeared, and when I removed the cabin lamp the luminous light appeared again. I was much puzzled with this, and took up a little of the water in the hollow of my hand and then let it run off, when I found that the luminous substance was left behind on my palm. I ran with it to the lamp; but when I got there it was gone. I found, however, that when I went into the dark my hand shone again; so I took the large glass of the ship's telescope and examined my hand minutely, when I found that there were on it one or two small patches of a clear, transparent substance like jelly, which were so thin as to be almost invisible to the naked
eye. Thus I came to know that the beautiful phosphoric light, which I had so often admired before, was caused by animals, for I had no doubt that these were of the same kind as the medusae or jelly-fish which are seen in all parts of the world.

Robert M. Ballantyne
The Coral Island (1857)


আমরা কটেজের সামনের সৈকতে আলোকদানাগুলো হাতে নিয়ে খেলতে লাগলাম। তারাগুলো যেখানে ছড়িয়ে পড়ছে সেখানকার বালিগুলো কেমন যেন একটু উষ্ণ। এই বস্তুগুলোর কারনেই কী? তারাগুলোর উপর দিয়ে হেঁটে যেতে রাজকীয় অনুভুতি হলো। লাফালাফি নাচানাচিতে ক্লান্ত হয়ে বালির চড়ায় বসে পড়লাম। ছোট একটা ব্যাটারী চালিত ক্যাসেট প্লেয়ার এনেছিলাম । রুম থেকে ওটা এনে একটা ক্যাসেট লাগিয়ে দিলাম। মান্না দে গাইছে -"গভীর হয়েছে রাত, পৃথিবী ঘুমায়......"

কোথাও কোন শব্দ নেই। একটানা সমুদ্রের শোঁ শোঁ গর্জন। সামনের সৈকতজুড়ে আলোর মিছিল। নীল রঙের ঢেউগুলো ঝাঁপিয়ে পড়ে রাঙিয়ে দিচ্ছে সমস্ত সৈকত অপূর্ব এক আলোয়। মান্না দে একা একা গেয়ে যাচ্ছে। সবাই কেমন নিশ্চুপ হয়ে গেছে। ভীষন ভালো লাগায় বিষাদও থাকে? কিছু বলতে ইচ্ছে হলো না। জীবনের কোন না মেলা হিসেব নিয়ে আর মাথা ব্যাথা নেই আমাদের। নেই চাওয়া পাওয়ার হাহাকার। তুচ্ছ অতি তুচ্ছ আমাদের সকল চাওয়া পাওয়া।

মনে পড়লো ওর কথা। ওর সাথে শেষ অভিমানি কথা। কতদিন দেখি না ওকে। ওকে নিয়ে কখনো কি আসা হবে এই সুদুর দ্বীপে? সে তো বলেছে অপেক্ষা করবে আমার জন্য। কতদিন? কতদিন? "জিমি প্লীজ সে ইউ উইল ওয়েট ফর মি, আই উইল গ্রো আপ সাম ডে ইউ সে......." এই গানটিতে জিমি জনিকে বলেছিল অপেক্ষা করতে। কিন্তু আমার জনি বলেছে সে আমার জন্য অপেক্ষা করবে আমি বড় না হওয়া পর্যন্ত। আমি বড় হওয়া মানে চাকরি বাকরি করে ওর বড়লোক বাবাকে সন্তুষ্ট করার মতো প্রতিষ্ঠিত হওয়া। সে অপেক্ষা করেছিল, কিন্তু তার বাবা করেনি। আমি জনিকে এই সমুদ্র দেখাতে পারিনি। জনি এখন অন্য রাজার পাটরানী। হেলাল হাফিজের মতো বলি, 'আজ দেখি রাজ্য আছে রাজা আছে ইচ্ছে আছে, শুধু তুমি অন্য ঘরে।'

ব্যাটারী শেষ না হওয়া পর্যন্ত গান বেজে থামলো সঙ্গীত যন্ত্র। মাঝরাত পেরিয়ে গেছে। আমরাও উঠলাম। কটেজে মোম জ্বেলে তাস নিয়ে বসলাম আবার। তাস খেলতে খেলতে মোমের আলো ফুরিয়ে এল। এবার ঘুমোবার পালা। বেশ রাত অবধি ঘুম এল না আমার। জানালা দিয়ে বারবার উঁকি মেরে দেখছি এখনো জ্বলছে কিনা সেই আলোকমালা। রাত তিনটার দিকে একবার ঘুম ভেঙে গেলে উঠে তাকিয়ে দেখলাম, না সেই আলো নিবে গেছে। তার মানে নির্দিষ্ট সময় পরে শেষ হয়ে যায় সেই আলোর খেলা।

ভোরে সূর্যোদয় দেখার জন্য সূর্য ওঠার আগেই বেরিয়ে গেল সমীর, আমির, জুনায়েদ, ইকবাল। আমি আর মাসুম ঘুমকাতুরে, আমরা সাতটা পর্যন্ত ঘুমোলাম। তারপর নেমে ওদের সাথে যোগ দিলাম। নীচে দেখি ডাবের স্তুপ। সেই কেয়ারটেকার ভদ্রলোক আমাদের জন্য ডাব পেড়েছে নিজের গাছ থেকে। নামমাত্র দাম। আমরা ডাব আর গ্লুকোজ বিস্কুট দিয়ে প্রাতঃরাশ করলাম। অপূর্ব। তারপর হাটতে বেরিয়ে ঝিনুক শামুক কুড়ালাম, প্রবাল পাথর নিলাম। দ্বীপের ভেতর দিকে চক্কর দিলাম আবার। দিনের আলোয় দেখলাম অন্যরকম গ্রাম। গ্রামের মাঝখানে অদ্ভুত একটা মসজিদ আছে। মসজিদের পুকুরটা পাথর দিয়ে বাধানো। প্রবাল পাথর। ভেতরে জমা পানিতে লোনাজল ঢোকে না। কত সংগ্রাম করে এখানকার অধিবাসীরা টিকে আছে। বর্ষাকালে যোগাযোগ প্রায় বিচ্ছিন্ন থাকে। তখন কি করে এই মানুষগুলো। ভাবতেই শিউরে উঠলাম। ফেরার পথে সেই হোটেলে গিয়ে নানরুটি আর ডাল দিয়ে শেষবারের মতো খাবার খেলাম। আবদুল্লাহর সাথে দেখা হলো। একগাল হেসে বললো, নৌকা সাড়ে দশটায় ছাড়বে। সমুদ্র শান্ত এখন। অসুবিধা নাই।

আমরা শেষবারের মতো এদিক সেদিক হেঁটে বিদায় জানালাম সেন্টমার্টিনকে। নৌকা ছাড়লো। এগিয়ে যাচ্ছে উত্তরমূখী পথে বাংলাদেশের মূল ভুখন্ডে। আশ্চর্য এবার একফোঁটা ঢেউ নেই। শান্ত সমুদ্র। সামান্য দোলা। কিছুক্ষন পর বিরক্তই লাগলো। আসলেই তো। ঢেউ না থাকলে সমুদ্র একটা বিরক্তিকর জিনিস। এক ঘন্টার মধ্যে শাহপরী দ্বীপের কাছাকাছি চলে এলাম। যাবার সময় দুই ঘন্টা লেগেছিল প্রতিকূল বাতাসের জন্য বোধহয়।

শাহপরীর দ্বীপে কয়েকজন যাত্রী নামবে। ওদের নামাতে ঘাটের পাশে একটা জায়গায় নৌকা থামলো। আবদুল্লাহও নামলো ওখানে। হঠাৎ একটা শোরগোল উঠলো ঘাটে। তাকিয়ে দেখি আবদুল্লাহকে একদল লোক চ্যাংদোলা করে তুলে নিয়ে যাচ্ছে। ছাড়া পাবার জন্য আবদুল্লাহ হাঁসফাঁস করছে। সে চিৎকার করে কী যেন বললো তার নৌকার সহকারীদের। সহকারীরা তাকে রেখেই নৌকা দিল ছেড়ে। নৌকাকে ধরার জন্য লোকগুলো ছুটে এলেও আমরা নাগালের বাইরে চলে এলাম। এবার ঢিল মারছে নৌকা লক্ষ্য করে। আরে, কি মুশকিল, মাথায় পড়লে ফেটে যাবে তো। ভয়ে আছি। নৌকাটা ঢিলের নাগালের বাইরে এসে চলতে লাগলো। আমরা চিন্তায় পড়লাম। আবদুল্লাহর কি হবে। ওকে যারা ধরেছে তার কি ডাকাত নাকি? ওর সহকারীরা কেমন যেন নির্বিকার। বললো, অসুবিধা নেই, আবদুল্লাহ এসে পড়বে। একটু পর তীর থেকে চিৎকার এলো। দেখলাম আবদুল্লাহ ওদের হাত থেকে ছাড়া পেয়ে ছুটছে সামনের দিকে। নৌকার সাথে সাথে দৌড়াচ্ছে। পেছন থেকে তাড়া করছে দশ বারোটা লোক। একপর্যায়ে আবদুল্লাহ আমাদের অবাক করে দিয়ে লাফ দিল নাফ নদীতে। নদীতে পড়েই একটা হাত উচু করে রেখে অন্য হাতে সাঁতার দিচ্ছে। আমরা সবাই চিৎকার করে তাকে উৎসাহ দিচ্ছি। সে নৌকার সমান্তরালে সাঁতরিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। পেছনের তাড়া করা লোকগুলো ওকে লক্ষ্য করে একের পর এক পাথর ছুড়ে মারছে। একসময় সেও চলে এল ঢিলের নাগালের বাইরে। আমরা সবাই হৈ হৈ করে তালি দিয়ে উঠলাম। অল্পক্ষন পরে সে নৌকার কাছ চলে এলে দড়ি ফেলে তাকে তুলে নেয়া হলো। তার এক হাত তখনো উঁচু করে ধরে রেখেছে। আর চিৎকার করে বলছে- 'লইত্ ন ফারে। লইত্ ন ফারে'। মানে 'নিতে পারে নাই'। কিন্তু কী নিতে পারে নাই? ওরা কারা?

ঘটনা হলো, ওই ঘাটে কোন নৌকা ভিড়লে তাকে টোল দিতে হয়। কিন্তু আবদুল্লাহ ঠিক ঘাটে না ভিড়িয়ে পাশেই নামিয়ে দিয়েছে যাত্রীদের। তাই সে টোল দিতে রাজী না। সেকারনে ঘাটের লোকজন মাস্তান ডেকে আবদুল্লাহর সব টাকা পয়সা কেড়ে নিতে চেয়েছিল। আবদুল্লাহ তাদের হটিয়ে দিয়ে বিজয়ীর বেশে নদী সাঁতরে চলে এসেছে এবং টাকাগুলো বাঁচিয়েছে। সাঁতার দেবার সময় সেই টাকার থলেটাই সে হাত দিয়ে উঁচু করে ধরে রেখেছিল। সেকারনেই বিজয়ীর সুরে বলছিল - লইত্ ন ফারে।

আমরা দুপুরের মধ্যে পৌছে গেলাম টেকনাফ। নিরিবিলিতে উঠলাম। কেউ কেউ আজই চট্টগ্রাম রওনা দিতে চাইলেও আমি আর সমীর আরেকটা দিন টেকনাফ থাকতে চাইলাম। বিশ্রামও হবে, বেড়ানোও হবে। টেকনাফকে ইতিমধ্যে আমাদের ভালো লেগে গিয়েছিল। দুপুরে আল্লাহর দান হোটেলে খেয়ে বিছানায় গড়াগড়ি দিলাম। কেউ কেউ এদিক সেদিক ঘুরে বেড়ালো। বিকেলে আমি বললাম টেকনাফেও সৈকত আছে, অনেক সুন্দর। দেখা দরকার। বেরুতে বেরুতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। রাস্তা চিনি না। হেটে যেতে যেতে একটা মেঠো পথে ঢুকলাম। নির্জন রাস্তা। এই রাস্তায় মাইল দুয়েক গেলেই সৈকত। এই সৈকতের বাতাস এবং সমুদ্রের গর্জন সবচেয়ে খান্দানী। নির্জন পথে এগিয়ে দুই রাস্তার মাথা পড়লো। কোনটাতে যেতে হবে বুঝতে পারছিলাম না। একটা টং দোকানে কয়েকজন বসে আড্ডা দিচ্ছিল। তারা জিজ্ঞেস করলো

-ওবাই হন্ডে যাইবেন (ও ভাই কোথায় যাবেন)
-আঁরা ইক্কিনি বীচত যাইতাম চাইলাম (আমরা একটু বীচে যাবো)
-রাতিয়া বীচত কী (রাত্র বীচে কেন)
-ইক্কিনি ঘুরি চাইবাল্লাই (একটু ঘুরে দেখার জন্য)
-ঝাপটাবাজর আতত ফরিবাল্লাই নি(ছিনতাইকারীর হাতে পড়ার জন্য?)
-ঝাপটাবাজ নিবার কিছু নাই আঁরাত্তে(ছিনতাইকারী নেয়ার মতো কিছু নেই আমাদের)
-অনরা বেগ্গুনে ফেন পরা আছোন নি (আপনারা সবাই প্যান্ট পরা আছেন না?)
-জী ফেন পরা আছে (জী প্যান্ট পরা আছে)
-ইবা তাইলি অইবু(ওটা থাকলেই চলবে)
-মানি ? (মানে?)
-মানি, তোয়ারার ফেনগুন খুলি রাখিদিবু আর কিছু ন ফাইলি। বাড়িত যাইবা কি ফরিয়েরে( মানে ওরা আর কিছু না পেলে, আপনাদের প্যান্ট খুলে রেখে দেবে, বাড়ীতে যাবেন কী পরে)

এইটা শুনে আমরা একটু দমে গেলাম। টেকনাফের লোকজন মগা টাইপের। বলা যায়না এরকম কিছু করলেও করতে পারে। বেইজ্জতির সীমা থাকবে না শেষে। জুনায়েদ আর সমীর তবু সাহস করে চেয়েছিল যেতে। কিন্তু ইকবাল আর আমি সাহস করলাম না। ইজ্জতটা বড় আমাদের কাছে। চল যাইগা। বললাম ওদের।

ফেরার পথে রাস্তার পাশে কোলাহলমুক্ত নির্জন একটা জায়গায় খাবার রেষ্টুরেন্ট দেখা গেল। ভিন্নস্বাদের লোভে ঢুকে পড়লাম। দেখে পছন্দ হলো। ছিমছাম, ভীড় নেই। খাবার ও পরিবেশনা আল্লার দানের চেয়েও উন্নত। প্রতি টেবিল ছোট ছোট গোলাপী টেবিলক্লথ। জানালায় কুচি দেয়া পর্দা। এটাও কিন্তু বেড়ার তৈরী। কিন্তু পরিচ্ছন্নতার পরিচয় পদে পদে।

নিরিবিলিতে ফেরার পথে ব্রীজের উপর দিয়ে আসার সময় মাঝি আবদুল্লাহকে দেখলাম। আমাদের দেখে পরিচিত হাসিটা দিল। আমি আর সমীর গিয়ে হাত মিলিয়ে বললাম, তোমার জন্য আমরা গর্বিত আবদুল্লাহ, তুমি গ্রেট। সে কি বুঝলো কে জানে, বললো যে কোন সময় সেন্টমার্টিন গেলে তার ঘরে যেন যাই। এবার আমরা যাইনি বলে দুঃখিত। আমরা কথা দিলাম পরেরবার আসলে নিশ্চয়ই যাবো। সেন্টমার্টিন আমাদের এত ভালো লেগেছে বারবার আসলেও তৃপ্তি মিটবে না। সেন্টমার্টিনের সহজ সরল মানুষগুলোকে খুব ভালো লেগেছে আমাদের। অথচ সেখানে যাবার আগে কত জন কতভাবে আমাদের ভুল তথ্য দিয়ে বিভ্রান্ত করেছে। সামুদ্রিক পরিবেশের কারনে চেহারায় কর্কশ হলেও মনটা চেহারার বিপরীত। খুবই নিরীহ মানসিকতা এদের। আবদুল্লাহর সাথে ছবি তোলা হলো। গ্রেট আবদুল্লাহর কাছ থেকে বিদায় নিলাম। পরদিন সকালে চট্টগ্রাম যাবার একটা সরাসরি বাস পেয়ে গেছি। এটার খোঁজ আগে পেলে কক্সবাজার ঘুরে আসতে হতো না আমাদের।

এরপরও আমরা বহু জায়গায় বেড়াতে গিয়েছি, কিন্তু সেন্টমার্টিনের সেই ১৯৯৪ ভ্রমনের মতো আর একটিও হয়নি। বিয়ের পর হানিমুনও করেছি এই দ্বীপে। প্রাসাদ প্যারাডাইসের বিলাসবহুল আরামদায়ক আথিতেয়তায় থেকেও প্রথমবারের সেই তৃপ্তি পাইনি। প্রথম ভ্রমনকে অতিক্রম করতে পারবে তেমন আনন্দদায়ক ভ্রমন হয়তো আর কখনো আসবে না।