নোনাসমুদ্রে এতকাল কাটার পর মিঠাপানির প্রথম স্পর্শটা সুখের ছিল তা বলতে পারি না। বরং বলতে পারি স্পর্শটা বড় বিচিত্র ছিল। মুখে নিয়ে কুলি করার মতো করে ফেলে দেবার পর শান্তি।
আবহাওয়া ঠিক আছে। জলের কোলাহলও তেমনি। ঘনত্বে একটু পার্থক্য, আর রঙে। এখানকার রঙটা যেন ফ্যাকাসে। তবু কেউ কেউ বলছিল যে যাই বলুক, যত সুখ শান্তি সব মিষ্টি জলের নদীতে। অগাধ ঝড়ঝঞ্ছাবিক্ষুব্ধ সমুদ্রে অনিশ্চিত জীবনযাপন করার চেয়ে এখানে অনেকটা নিশ্চিন্ত জীবন। চাইলে যখন তখন কূলের কাছাকাছি যাওয়া যায়, গাছ লতাপাতা ফুল পাখিদের সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়। সমুদ্রে কি তা সম্ভব? তবু এতকালের অভ্যেস সমুদ্র। এই নেশা কাটানো মুশকিল। আমি ওদের পিছু পিছু নদীতে আসার পর সেই কথাই ভাবছিলাম।
কিছুদিন গেলে নদীর পরিবেশে অভ্যস্ত হবার পর একদিন একজন জানালো, একটা বিপদ দেখা যাচ্ছে। ওদিকে কিছু জলদস্যু নেমেছে। তাদের হাতে মারা পড়েছে অনেকে।
আমি আগে কখনো জলদস্যু দেখিনি। সমুদ্রের কিছু এলাকা এড়িয়ে চলতে হয় জলদস্যুদের উৎপাতের কারণে। আমি খুব ভালো করে চিনি কোন কোন পথে জলদস্যু হামলা করে। সমুদ্রে আমি তাই কখনো জলদস্যুদের হাতে পড়িনি। কিন্তু নদী সম্পর্কে আমি অনভিজ্ঞ। এখানে পালাবার পথঘাট ঠিক চেনা হয়নি। বন্ধুদের প্ররোচণায় এসে পড়েছিলাম, অভ্যস্ত হবার চেষ্টা করছিলাম, অনেকটা অভ্যস্ত হয়েও পড়েছিলাম নতুন জীবনে। কিন্তু নৌ দস্যুদের কথা শুনে তো রীতিমত চিন্তায় পড়লাম।
কিছুদিন যাবার পর টের পেলাম আমার চারপাশে চেনাজানা সবাই উধাও হয়ে যাচ্ছে একে একে। আস্তে আস্তে আমি একা হয়ে গেলাম। আমাকে ওরা ফেলে চলে গেছে কোথাও? এরকম কেউ চলে যেতে পারে? এতকালের চেনা জানা কেউ?
মনে হয় না। একাকীত্বের কষ্ট এমনিতেই অসহ্য। কিন্তু কেউ ফেলে চলে গেলে সেটা যেন বেশী কষ্টের। আমার শান্ত্বনা হলো, না শান্ত্বনা নয়, আমি নিশ্চিত ওরা কেউ আমাকে ফেলে যায়নি। নিশ্চয়ই ধরা পড়েছে জলদস্যুদের হাতে। মারা পড়েছে ওদের হাতে। একা হবার পর আমি সাবধানে চলি। গভীর জলের মাছেদের মতো আমি মাঝ নদীতে লুকিয়ে চুরিয়ে ঘুরাফেরা করি।
মাঝনদীটা অনেকটা নিরাপদ। জলদস্যুরা এদিকে সহজে আসে না। আসলেও টিকতে পারে না। আজকাল আমি ভুলেও কিনারের দিকে যাই না। জলদস্যুরা ওদিকে নোঙর ফেলে ঘাঁটি গেড়েছে। আমি একবার ধরা পড়তে পড়তে অল্পের জন্য বেঁচে গেছি। সেই প্রথম আমার নোঙর চেনা।
আত্মরক্ষার জন্য আমাকে এবার পূর্বপুরুষের শরণাপন্ন হতে হয়। পূর্বপুরুষের কাছ থেকে আমি একটা অদ্ভুত বিদ্যা রপ্ত করেছিলাম। প্রত্যেক বংশে একেক প্রজন্মে মাত্র একজনকে সেই ক্ষমতা দেয়া হয়। আমার প্রজন্মে আমি পেয়েছিলাম সেই ক্ষমতা। শরীরের যে কোন অংশে প্রাণ লুকিয়ে রাখার ক্ষমতা। সর্বোচ্চ শক্তির মহাপ্রাণ জানিয়েছেন, তুমি যখন এমন কোন বিপদগ্রস্থ যে তুমি ধ্বংস হলে তোমার বংশ লুপ্ত হবে, তখন তুমি এই ক্ষমতা প্রয়োগ করবে। তার আগে নয়। এই ক্ষমতা প্রয়োগ করলে তুমি নিজে মৃত্যুবরণ করবে কিন্তু তোমার প্রাণ জেগে থাকবে তোমার কোন একটা অঙ্গে। সেই প্রাণ তুমি শত্রুর উপর প্রতিশোধ হানার জন্য ব্যবহার করবে। এতে তোমার পাপ হবে না কারণ এটা তোমার বংশ রক্ষার মহাজাগতিক অধিকার।
আমার এখন সময় হয়েছে সেই বিদ্যা প্রয়োগের। ধরা পড়লে আর কোন বিকল্প নেই আমার। আমি জলে একটা দীর্ঘ ডুব দিয়ে মন্ত্রপাঠ করে নিজেকে তৈরী করে নিলাম। এবার আর মৃত্যুভয় নেই আমার। মরে গেলেও প্রাণ থাকবে শরীরের কোথাও। আমার হাতে কোন অস্ত্র নেই কিন্তু আমার সমস্ত শরীরই এখন অস্ত্র। চাইলে আমি এখন বিষে বিষাধার করে ফেলতে পারি নিজেকে। জলদস্যুদের কোন আক্রমন আমাকে আর ভীত করবে না।
এবার আমি মাঝ নদী ছেড়ে তীরের কাছাকাছি খাড়িতে খাড়িতে ঘুরে বেড়াতে লাগলাম। আমি এখন একদম একা। অন্য কোন বংশের সাথে আমার মেলামেশা নেই। ভেবে কষ্ট হয় মাঝে মাঝে, আমার বংশের আর কেউ বেঁচে নেই এই অবিচারের দেশে। এখানে জলদস্যুরাই রাজা, জলদস্যুরাই আইন। হাটবাজার গ্রামগঞ্জ সব ওদের। একাকী ঘুরতে ঘুরতে আমার মাথার প্রতিশোধের আগুন বুড়বুড়ি হয়ে বেরুতে থাকে।
সময় যেতে যেতে আকাশে মেঘের আনাগোনা বাড়লো। ঘন কালো অন্ধকার হয়ে গেল দিন। নীলাকাশ হয়ে গেল কুচকুচে ছাই। যেদিন খুব বৃষ্টি নামলো আমার ইচ্ছে হলো মাথা তুলে নাচি। আমি নাচতে শুরু করলাম। নাচতে নাচতে নদীর কিনারে চলে গেলাম। এদিকে বৈঠা বাইছে এক মাঝি। আমাকে দেখে মাঝি কী খুশী। আমিও মাঝিকে দেখে খুশী। এই মানুষকে বিশ্বাস করা যায়।
আমি মাঝির নৌকায় উঠে গেলাম এক লাফে। 'আমারে লইয়া যাও মহুয়ার দেশে'। না, এটা আমি গাইছি না। আমি গানটান জানি না। মাঝি গান গাইছে আমাকে পাবার পর। সে আমাকে নিয়ে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে একটা বাজারে গেল। আমি খুশীমনে মাঝির সাথে যাচ্ছি। জলদস্যুদের হাতে পড়লে নিশ্চয় আমাকে এত আরামে নিত না। কচুকাটা করে ফেলতো এতক্ষণে।
কিন্তু খুশী হয়ে কি হবে। আমার চুড়ান্ত পরিণতি তো একই। মাঝির হাত দিয়ে গেলে যা, জলদস্যুর হাত দিয়ে গেলেও তা। এটা ভেবে আমি একটু বিমর্ষ হয়ে থাকলাম।
বাজারে গিয়ে মাঝির পাশে চুপ করে বসে বসে আমি মানুষ দেখতে দেখতে ভুলে গেলাম এখানে কেন এসেছি আমি। আশেপাশের দোকানের ভাজাপোড়ার গন্ধ ভেসে আসছে। কত কি খায় এখানকার মানুষ!
নদীতে এত কিছুর ব্যবস্থা নেই। মাঝি আমাকে খাওয়াবে কিনা বুঝতে পারছি না। সে গরীব, চেহারা দেখলেই বোঝা যায়। বেচারা আমার চেয়েও হতভাগা। খানিকপর একটা লোক এসে আমার দিকে কেমন যেন চোখ পাকিয়ে তাকালো। যেন আমাকে খুঁজছে অনেককাল।
আমি ভয় পেতে গিয়েও থেমে গেলাম। হাসলাম মনে মনে। লোকটা মাঝির সাথে কথা বলছে। বলছে আমাকে চায় সে। কিন্তু মাঝি আমাকে হাতছাড়া করতে চাইছে না। সে এমন সব কথা বলছে লোকটা প্রায় ক্ষেপে গেছে।
কথায় কথায় বুঝলাম এই লোক যে সে নয়। সে এলাকার জলদস্যু সরদার। তাকে কেউ না করতে পারে না। আমাকে তার চাইইইই চাই। দস্যু সর্দার জলদাস আমাকে তার গাড়িতে তুলে নিল। আমি অশ্রুবিহীন বেদনায় মাঝির কাছ থেকে বিদায় নিলাম। মাঝি লোকটা আজব। এত আদর করে এনেছে আমাকে। অথচ আমাকে বিদায় দেবার বদলে তার পকেটে এক তাড়া কাগজের দিকে তাকিয়ে আছে কেমন লোভী চোখে। এই কাগজগুলো দিয়েছে জলদাস। যাক আমার কি, এরা সব এক জাত। স্বার্থপর গোঁজামিল।
যেতে যেতে জলদাস আমার সাথে গল্প করতে লাগলো। একটু পর আমি ভুল বুঝতে পারলাম। আমার কথা বলছে ঠিকই, কিন্তু আমার সাথে বলছে না। বলছে তার সাথের আরেক জলদস্যুর সাথে। সেও বলেছে আমার মতো একজনকে নাকি সমুদ্রে দেখেছিল একবার। জলদাস সে কথা এক ফুৎকারে উড়িয়ে দিল। সে বললো আমার মতো আর একজনও নাই এই সমুদ্রে। আমি তুলনাহীন।
আমি তাদের দুজনের তর্ক উপভোগ করতে করতে পৌঁছে গেলাম জলদাসের বাড়ি। বিশাল সেই বাড়ি। আমি কখনো এমন বাড়ি দেখিনি। আমাকে যেখানে নেয়া হলো সেখানে আমাকে গোসল করিয়ে যত্ন করে শুইয়ে রাখা হলো। এরপর আমি আয়েশে ঘুমিয়ে পড়লাম। অনেক দীর্ঘ যাত্রা পথ পেরুতে হয়েছে আজ। গাড়িতে চড়ার অভ্যেস নেই আমার। ভাগ্যিস বমি করে দেইনি। তাহলে বংশের মান মর্যাদা সব চলে যেতো।
আমি যখন জেগে উঠলাম তখন অনেক বদলে গেছে সবকিছু। এভাবে বদলে যাবো কখনো ভাবিনি।
আমার চেহারা পোষাক বিছানা সব বদলে দেয়া হয়েছে। আমি শুভ্র সুন্দর একটা বিছানায় শোয়া। বিছানাটা গোলাকার চকচকে। বিছানার কিনারটা সোনা রঙে মোড়ানো। তার পাশে দুটো রুপোলী দণ্ড সোজাসুজি রাখা। সূর্যের আলো ঠিকরে বেরুচ্ছে যেন। আমাকে পরানো হয়েছে জমকালো পোষাক। কত বাহারী অলংকার আমার উপরে ছড়ানো।
সুগন্ধে মৌ মৌ করছে সমস্ত ঘর। আমারই সুগন্ধ। আমি আমার নিজের এত দারুন সুগন্ধ আগে কখনো পাইনি। সবাই আমাকে ঘিরে বসেছে। যেন আমাকে পুজা করছে। আমি এমনকি ঘুমাবার আগেও বুঝিনি আমি এতটা খ্যাতিমান কেউ। আমাকে দেবতার সম্মান দিয়ে এখানে রাখা হয়েছে ভাবতেই আমি জলদাসের প্রতি কৃতজ্ঞবোধ করলাম। এরা নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছে আমি যা তা কেউ নই। এ নিশ্চয়ই আমার স্বর্গারোহনের আয়োজন। আমি আমোদে চোখ বুঝলাম আবারো।
হঠাৎ বুকে খচ করে বিধলো কি যেন। আমি চোখ মেলে তাকিয়ে দেখি জলদাসের হাতে উঠে এসেছে আমার পাশে রাখা রুপোলী দণ্ড দুটো। তার একটি বুকে সেঁদিয়ে দিয়েছে লোভাক্রান্ত জলদাস। তার মুখ থেকে এক ফোটা লালা আমার গায়ে পড়লো। আমি এবার আসল ঘটনা বুঝতে পারলাম।
জলদাস আমার স্বর্গারোহনের আয়োজন করেনি। আমার চারপাশে বসে থাকা লোকগুলো আমার পুজো করছে না। এবার তারা আমাকে টুকরো টুকরো করে তাদের উদরপূর্তি করবে। পূর্বপুরুষের ভবিষ্যতবাণীর কথা মনে পড়লো। এবার আর রক্ষা নেই। আমি ভয় পেতে আচ্ছি না। আমি ভাবছি এখন সময় হয়েছে প্রতিশোধের। মনে পড়লো আমাকে কি করতে হবে উদরের পথে যেতে যেতে। আমার শরীরের একটি বিশেষ কাঁটাকে আমি বিষাক্রান্ত করে রাখলাম। এটাই আমার প্রতিশোধের তীর। জলদাস আমার ওই অংশটাকে কাঁটাচামচে তুলে মুখে পুরে দিল। আমি এখন শুধুই একটি চোখা কাঁটা। আমার সমস্ত শরীর থেকে আমি জীবনের কনাকে এখানেই সন্নিবদ্ধ করেছি। বিষে বিষাক্রান্ত করেছি এই একটি বিন্দু। ওখানেই আমার জীবন কণা।
আমি জলদাসের উদরের পথে যেতে যেতে গোলাপী রঙের সরু গলিপথে পৌঁছামাত্রই আমার বাঁকানো কাঁটাকে আচ্ছা করে বিঁধিয়ে দিলাম সমস্ত শক্তি দিয়ে।
জলদাস তীব্র চিৎকার দিয়ে খাওয়া থামিয়ে দিল। সবাই অবাক। এমন কি ঘটলো। মুখে কোন কিছু বলছে না। কেবল ব্যথায় তীব্র চিৎকার করছে। সবাই ছুটে আসলো চারপাশ থেকে। কী হলো কী হলো? কাঁটা বিধেছে। কাটা কোথায়। গলায় হাত দিয়ে কেউ দেখলো না। জলদাস কথা বলতে পারছে না।
আমার সমস্ত বিষ জলদাসের শরীরে ছড়িয়ে পড়তে লাগলো। জলদাসের শরীর ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে যেতে থাকলো।
আমার কাজ শেষ। এবার আমিও তৃপ্তিতে শান্তিতে চিরঘুমের দেশে চলে যেতে থাকলাম অবশ হয়ে। বংশের প্রতিজ্ঞা রক্ষা করে আমি গর্বিত।