Monday, December 30, 2013

সেই সব আপাতঃ নিরীহ অপরাধ

নবাব মিয়ার দিকে আমি তাকাতে পারি না অদ্ভুত এক অপরাধবোধে।


আমাদের কমিউনিটিতে ৬০টা অ্যাপার্টমেন্টে ৬০ পরিবার থাকে। প্রতিটা ফ্লোরে ৬টি অ্যাপার্টমেন্ট। এখানে সবাই ভাড়াটে। দালানের মালিক একজন। তিনি দেশের বাইরে থাকেন। এই কমপ্লেক্স চালাবার জন্য ১ জন ম্যানেজার এবং ৫ জন কর্মচারীসমৃদ্ধ একটা অফিস আছে ১২ তলায়। মূল মালিকের হয়ে তারাই এই কমপ্লেক্সের তত্ত্বাবধায়ক সরকার।

আধুনিক নগরগুলোতে বিচ্ছিন্ন জীবনযাপনের অলিখিত সংস্কার বা নিয়ম মেনে এই ৬০ পরিবারও যার যার মতো বিচ্ছিন্ন জীবনযাপন করে। এখানে এমনকি একই ফ্লোরের সব মানুষকে চেনে না সবাই। খুব ব্যক্তিগত সম্পর্ক না হলে কেউ কারো বাসায় যায় না। আমার ঠিক নীচের ফ্ল্যাটে কে থাকে আমি জানি না। আমার পাশের ফ্ল্যাটে আমি কখনো যাইনি। ওই ভদ্রলোকও কখনো আসেনি। আমাদের দেখা হয় লিফটে লবিতে। আমরা সৌজন্য হাসি বিনিময় করি মাত্র। এই ফ্লোরের ছয় পরিবারের অর্ধেক গৃহকর্তারও নাম জানি না। এখানে কোন বিধিনিষেধের ব্যাপার নাই, তবু সবাই কেমন যেন একটা দূরত্ব মেনে জীবনযাপন করে। শিশু-কিশোর পরিষদ যতটুকু পারে হৈ চৈ করে নিজেদের মধ্যে এই দূরত্ব ঘোচাবার চেষ্টা করলেও উচ্চ মধ্য পরিষদে সুশীল  নীরবতা। অবশ্য অবসরপ্রাপ্ত অতি প্রবীন সমাজ নিজেদের মধ্যে সামান্য কিছু যোগাযোগ রাখে পরকাল সমৃদ্ধ করার তাগিদে।

আমি আজ লিখতে বসেছি একজন অবসরপ্রাপ্ত প্রবীণের কথা যিনি আমার কথিত কূলীন সমাজের অন্তর্ভুক্ত নন। যিনি রাত জেগে এই দালানের নিরাপত্তার দেখাশোনা করেন। তিনি এই দালানের নিরাপত্তা বিভাগের ৬ জনের একজন। সংসারের প্রয়োজন কতটা গুরুত্বপূর্ন হলে সত্তরোর্ধ অসুস্থ একজন মানুষকে কাজ করে যেতে হয় সেটা বোঝার জন্য সমাজবিজ্ঞানী হবার দরকার নেই। লোকটার চেহারায় সমীহ জাগানোর মতো কিছু একটা আছে। বাকী পাঁচ জনের চেয়ে তিনি কেমন আলাদা। তবু এরকম মানুষগুলোকে আসা যাওয়ার পথে সালাম বিনিময় ছাড়া ভালো করে জানা হয় না কখনো।

আমার সাথে তাঁর  কোন কাজ নেই, কোন যোগসুত্র নেই, এমনকি আমি তাঁর নামও জানি না। নামের চেয়ে বুড়া সিকিউরিটি পরিচয়টাই বড় হয়ে সামনে এসে গিয়েছিল বলেই কি? একদিন রাতে অফিস থেকে ফেরার পথে বুড়া সিকিউরিটি আমার হাতে একটা হলুদ খাম দিয়ে বলে - স্যার এটা আপনার জন্য।

আমি বাসায় ঢুকে চা খেতে বসে খামটা খুলে দেখি আমার নামে কম্পিউটারে টাইপ করা একটা চিঠি। লিখেছেন নবাব মিয়া নামের একজন মানুষ। যিনি গলার ক্যান্সারে ভুগছেন দীর্ঘদিন ধরে। চিকিৎসা করাতে গিয়ে সর্বশান্ত হয়ে গেছেন। তিনি না বাঁচলে তাঁর পরিবারও বাঁচবে না। চিকিৎসার জন্য সাহায্য চেয়েছেন। আমি এই নামে কাউকে চিনি না। কে এই নবাব মিয়া?

১২ তলার তত্তাবধায়ক সরকারের অফিসে ফোন করে জানতে পারলাম আমাদের বুড়া সিকিউরিটিই নবাব মিয়া। চমকে উঠেছিলাম খুব। আমার ক্যান্সার হলেও ব্যয়বহুল চিকিৎসা করাতে গিয়ে ফতুর হয়ে যেতে হবে, আর এই দরিদ্র সর্বহারা বুড়া সিকিউরিটি কি করবে? কত টাকা লাগবে, কতটা করতে পারি আমি, এসব ভেবে খুব অসহায় লাগলো আমার। সবচেয়ে খারাপ লাগছে নবাব মিয়া আমার উপর এরকম একটা সাহায্য প্রত্যাশা রেখেছে। এই প্রত্যাশার দায় আমারই। আমি কি করে এই দায় মেটাবো? এমন সময় চিঠিটা এলো যখন আমার চাকরীর লে অফ নোটিশ আসতে পারে যে কোন সময়। নিজের চিন্তায় অস্থির এখন নবাব মিয়ার জন্য কি করবো?

কি করবো সিদ্ধান্ত নিতে না পেরে চেষ্টা করতে লাগলাম নবাব মিয়ার মুখোমুখি না হতে। প্রতিদিন গেট দিয়ে বেরুবার সময় নিজেকে চোরের মতো লাগে। এক অদ্ভুত অপরাধবোধ আমাকে গ্রাস করে। দুদিন পর আমি নবাব মিয়ার হাতে কোনমতে দুহাজার টাকা দিয়ে পালিয়ে আসি। কেননা আমার মনে হচ্ছিল নবাব মিয়া আমার কাছ থেকে বিশ হাজার টাকার প্রত্যাশা করেছিল। আমি এত কম দিয়ে দায় সারলাম? পরে জানতে পারি নবাবমিয়া আরো কয়েকজনের কাছ থেকে সাহায্য পেয়ে চিকিৎসা শুরু করে। কি চিকিৎসা আমি ভয়ে জিজ্ঞেস করি না। চিকিৎসা চলার সময় তার গলা চেহারা সব কালো হয়ে যায়।

মাসখানেক চিকিৎসা করার পর সে আবারো কাজে যোগ দেয়। আমার সাথে চোখাচোখি হলে 'কেমন আছেন' ইত্যাদি বলে সৌজন্য দায় সারি। এগিয়ে জিজ্ঞেস করি না, কতটাকা লাগলো, আর কত লাগবে?

সেদিন বাড়ি ফেরার পথে নবাব মিয়া বলে  আমাকে দেখে বলে, স্যার একটা কথা ছিল। কথা শুনে আমি দাড়াই। সংক্ষেপে জানালো, গলার চিকিৎসার প্রাথমিক পর্ব আপাততঃ শেষ, এখন এই চিকিৎসার প্রতিক্রিয়া ঠেকাতে যে ওষুধ দিয়েছে সেটা কিনতে সারা মাসের বেতন শেষ হয়ে যায়। এই ওষুধ কতদিন খেতে হবে জানে না। গাল গলা সব ফুলে যাচ্ছে।

আমি আবারো অপরাধী চোখে নবাব মিয়ার দিকে তাকাই। তারপর মানিব্যাগ খুলে একটা পাঁচশো টাকার নোট হাতে তুলে দেই এবং যত দ্রুত সম্ভব চলে আসি তাঁর কাছ থেকে। আমার মনে হচ্ছিল নবাব মিয়া আমার কাছ থেকে কমপক্ষে দু হাজার টাকা আশা করেছিল। আমার মানিব্যাগে দুহাজার টাকার বেশী ছিল। তবু আমি পাঁচশো টাকা দিলাম কেন?  আমাকে আরো কয়েকজন নবাবমিয়াকে সাহায্য করতে হয় বলে? আমার ক্ষমতা কম বলে? নাকি আমারও বেকারত্বের ভয় আছে বলে?

সেই থেকে আমি এই অদ্ভুত অপরাধবোধে ভুগতে শুরু করি। আমি ভুলে থাকতে চেষ্টা করি নবাবমিয়া শেষ পর্যন্ত হেরে যাবে এবং পথে বসবে নবাব মিয়ার পরিবার। আমি জানি না তার সংসারে কে আছে কি আছে, কতটা সহায় সম্বল। নবাবমিয়া মারা গেলে তার পরিবার কোন সর্বনাশের মুখোমুখি হবে আমি তা একবারও ভাবার চেষ্টা করি না। আমার আরো অনেক জরুরী কাজ আছে। আমার জন্য কারো কিছু থেমে থাকবে না।

সিদ্দিক মিয়ার জন্যও থেমে থাকেনি। সিদ্দিক মিয়া তিন বছর আগে নবাব মিয়ার চেয়ারে বসতো। আমার বাচ্চাদের স্কুলে যেতে রিকশা ঠিক করে দিত। স্কুল থেকে ফিরলে রিকশা থেকে নামিয়ে দিত। বৃষ্টি হলে ছাতা ধরে এগিয়ে দিত। সেই সিদ্দিক মিয়া একদিন এই চেয়ারে ঢলে পড়েছিল। সিদ্দিক মিয়াও একজন অবসরপ্রাপ্ত প্রবীণ ছিলেন। অবসরপ্রাপ্ত প্রবীণদের কাজ করতে দেখলে আমি একইরকম অপরাধবোধে ভুগতে শুরু করি।

Sunday, December 29, 2013

[চলমান ইতিহাস সংরক্ষণ] এবং.. এবং ডেমোক্রেসি ফর রোড মার্চ

পরিস্থিতি অত্যন্ত ভয়াবহ। আজকে মিথ্যাবাদী সরকার… সাংবাদিকদের ওপর নির্যাতন চালাচ্ছে… মা বোনদের ওপর নির্যাতন চালাচ্ছে।

দেশের প্রতি, জনগণের প্রতি দরদ আছে আমাদের, মায়া আছে। সেই জন্য আমরা জনগণকে গুলি করে হত্যা করতে পারি না। কিন্তু আপনারা যেভাবে হত্যা করছেন, তার জবাব আপনাদের দিতে হবে।

…প্রতিদিন আপনারা আসবেন, বসে থাকবেন গেইটের সামনে। ঠিক আছে।  প্রতিদিন আমিও এরকম বের হব। চলুক, কতো দিন চলে।

কি মনে করেছেন কি? দেশটা কি আপনাদের একলার? পৈত্রিক সম্পত্তি হয়ে গেছে আওয়ামী লীগের, যে গুণ্ডা বাহিনী দিয়ে আমাদের প্রোগ্রাম বন্ধ করতে চান? পুলিশ বাহিনী দিয়ে প্রোগ্রাম বন্ধ করতে চান?

যদি সাহস থাকে, কাউন্টার প্রোগ্রাম করে দেখাতেন। সাহস নেই, দশটা লোকও আসে না। ভাড়াটিয়া লোক ভাড়া করে ডিসি এসপিদের দিয়ে লোক আনায়। বুঝি এটা। না হলে এ রকম করুণ পরিণতি হয়? ১৫৪টা সিট আনকনটেস্টেড হয়ে যায়? আর বাকি রয়েছে কি? বাকিগুলোও করে ফেলবে।

…ওটা কোনো ইলেকশন নয়, এটা যে সিলেকশন হয়েছে, ভাগাভাগির নির্বাচন হয়েছে- এইটা আজকে জাতির কাছে পরিষ্কার। দেশের মানুষের কাছে পরিষ্কার।   

তাই মানুষ আজকে ধিক্কার দিচ্ছে। ধিক্কার দিই আমরা এই সরকারকে। এই সরকারকে ধিক্কার দিই।

আজকে কি করছেন? আপনাদের সঙ্গে আমাদের কোনো বিরোধ নেই। আপনারা দায়িত্ব পালন করছেন, কিন্তু আমি মনে করি, দায়িত্বটা সুন্দরভাবে পালন করেন। সম্মানের সঙ্গে যাতে আমরাও কাজ করতে পারি, আপনারাও কাজ করতে পারেন- সেভাবে আপনারা দায়িত্ব পালন করেন। আপনাদের সঙ্গে আমাদের কোনো বিরোধ নেই।

পুলিশ বাহিনী, কিন্তু এটাতো ঠিক নয়- যে আমাকে আমার বাড়ি থেকে বের হতে দেবেন না। এটা তো ঠিক নয়। এটা তো ঠিক না।

আপনাদের যে অফিসার ছিল, সে গেল কোথায়? তার সাথেই তো আমি কথা বলতে চেয়েছি; কেন আমার পথ আটকিয়েছে? কিন্তু সে কোথায়? কেন সে আসছে না এখন সামনে?

এতোক্ষণ তো অনেক কথা বললেন। আপনি কে? এখন মুখটা বন্ধ কেন? এই যে মহিলা, আপনার মুখটা এখন বন্ধ কেন? বলেন তো কি বলছিলেন এতাক্ষণ ধরে?

মুখটা বন্ধ কেন এখন? দেশ কোথায়, গোপালী? গোপালগঞ্জ জেলার নামই বদলিয়ে দেব বুচ্ছেন, গোপালগঞ্জ আর থাকবে না।

আল্লাহর গজব পড়বে- আপনারা যা শুরু করে দিয়েছেন।  কতোগুলা আলেমকে হত্যা করেছেন, এতিমকে হত্যা করেছেন।  কতোগুলা বিডিআর অফিসারকে হত্যা করেছেন।  সেদিন কোথায় ছিল হাসিনা? সেদিন হাসিনা কোথায় ছিল?

এতোগুলা অফিসার যে মারল, ৫৭ জন অফিসারকে হত্যা করল, সেদিন হাসিনার এই ফোর্স কোথায় ছিল? কেন সে ফোর্স পাঠায় নাই।  আসলে সে নিজেই জড়িত ছিল এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে…  সেজন্যই।

আজকে তো এমন অনেক আননোন চেহারা দেখা যায়, যাদেরকে চেনা যায় না যে তারা আসলেই বাংলাদেশি কি না। বাংলাদেশের আজকের যে কর্মসূচি ছিল, আপনারা যদি আসলেই দেশকে ভালবাসতেন, তাহলে আজকে ছিল আমাদের সার্বভৌমত্ব রক্ষা এবং.. এবং ডেমোক্রেসি ফর রোড মার্চ।  ডেমোক্রেসি ফর মার্চ ছিল আমাদের কর্মসূচি

গণতন্ত্রও চাবেন না, দেশ রক্ষা করতেও চাবেন না। গোলামী করবেন? দালালি করবেন? এই গোলামী তো রাখবে না। লেন্দুপ দর্জির (সিকিমের প্রথম মুখ্যমন্ত্রী) ইতিহাসটা পড়ে দেখেন। সেও কিন্তু টেকে নাই বেশি দিন। তাকেও বিদায় দিয়েছে। দালালি করে… দেশ বিক্রি করে…। কাজেই এই দেশ বিক্রি চলবে না হাসিনার।

দেশ রক্ষা হবেই ইনশাল্লাহ। দালালি বন্ধ করতে বলেন। আর হাসিনার দালালি করে লাভ হবে না। বাংলাদেশের মানুষের সঙ্গে থাকেন। জনগণের সঙ্গে থাকেন। দেশের মানুষের সঙ্গে থাকেন। তবেই কাজে দেবে। দেশ বাঁচবে, মানুষ বাঁচবে।

আজকে সকলের দায়িত্ব হয়ে গেছে- দেশ বাঁচানো, মানুষ বাঁচানো। আর আপনারা ঘরে ঘরে ঢুকে এখন মানুষ হত্যা করছেন। মনে করে যে এগুলোর হিসাব নেই… এই মা বোনোর কান্না, এই আলেম এতিমের কান্না, এই বিডিআরের অফিসারদের ওয়াইফদের কান্না… এগুলো কি বৃথা যাবে? এগুলো কোনো দিনও বৃথা যাবে না।

আজকে যারা এই জুলুম নির্যাতন করছেন, তাদেরকেও এদের মতো একদিন চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বা মুছতে মুছতে চোখ অন্ধ হয়ে যাবে।

এখনো সময় আছে। ধাক্কাধাক্কি বন্ধ করেন। আমরা কেউ ধাক্কাধাক্কি করতে আসিনি। আমরা কোনো ধাক্কাধাক্কি করতে আসিনি। আমি বলছি আপনারা চাকরি করেন, আপনারা করবেন।  কিন্তু এ রকম আমাদের গায়ের ওপর উঠে পড়বেন না।

দূরে থাকেন। দূরে থাকেন।  আপনাদের জায়গা যেখানে সেখানে থাকেন।  আপনাদের রাস্তাতে থাকার কথা। আপনারা বাড়ির মধ্যে এসে যাচ্ছেন কেন?   

কি, আপনাদের মেয়েরা এতো ঝগড়া করে কেন?

এই মেয়েরা- চোপ কর। কয়দিনের চাকরি হয়েছে যে  এতো কথা বল?

কিসের জন্য এতো কথা বল? চোপ থাক। বেয়াদব কোথাকার।

আপনাদের অফিসার কোথায় গেল? আসলো না? তাকে বলবেন, আমার সঙ্গে দেখা করতে, আমি তার সঙ্গে কথা বলতে চাই।  

বুঝেছেন? কি বোঝেননি কথাটা? এটা তো বাংলা ভাষা? নাকি অন্য কোনো ভাষায় বলতে হবে আপনাদেরকে?

বুঝেছেন? সেই অফিসার কোথায়? তাকে বলেন আমার সঙ্গে দেখা করতে।

[বেগম খালেদা জিয়া, নিজ বাসভবনের গেটে]

নির্বাচন ঠেকাতে বিএনপি যে কোনো মূল্যে নয়া পল্টনে সমাবেশ করার ঘোষণা দিলেও পুলিশের বাধায় বাড়ি থেকে বের হতে পারেননি দলের চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া।   

রওনা হওয়ার জন্য বেশ কিছু সময় গাড়িতে উঠে বসে থাকলেও রওনা হতে না পেরে নেমে এসে প্রথমে পুলিশের সঙ্গে এবং পরে মই ও পাইপ বেয়ে দেয়াল টপকে ভেতরে ঢোকা গণমাধ্যমকর্মীদের সামনে মিনিট দশেক কথা বলেন তিনি। এরপর কর্মসূচি অব্যাহত রাখার কথা জানিয়ে বাসার ভেতরে চলে যান।

ডিসেম্বর ২৯, ২০১৩ বিকেল

নীলিমা বোর্ডিং

'আই'ম অ্যান অর্ডিনারি ম্যান' বাক্যটাকে বাংলা করলে আমি একজন সাধারণ মানুষ বোঝায়। কিন্তু আমি বাংলার বদলে ইংরেজিতে অর্ডিনারি শব্দটা বেছে নিতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেছি কেননা বাংলায় সাধারণ মানুষ বলতে যা বোঝায় তাতে ঠিক অর্ডিনারি শব্দটার অনুবাদ হয় না। বরং আমি একজন যেনতেন মানুষ বললেই অধিক অর্থবহ হয়। কিন্তু যেনতেন মানুষের চেয়ে অর্ডিনারি শব্দটা অলংকার সমৃদ্ধ মনে হয়। তাই আই'ম এন অর্ডিনারি ম্যান বাক্যটাই যুতসই লাগলো।

কথাটা আক্ষরিক অর্থেই সত্য। একশোভাগ খাটি সত্য কথা বলা অসম্ভব হলেও এই বাক্যটির সততা সম্পর্কে আমার বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। কেননা বাক্যটা আমার নিজকে নিয়ে বলা, এবং নিজেকে আমি অন্য দশজনের চেয়ে বেশী বুঝি বলে মনে হয়। আমার সবকিছুই অর্ডিনারি। এই বাক্যটা শুনে আক্ষেপের সুর কল্পনা করবে কেউ কেউ। এটার সাথে আক্ষেপের চুল পরিমান সম্পর্কও নেই। অর্ডিনারি জীবনেই আমি তৃপ্ত। তবু এরকম একটা লেখার প্রয়োজনীয়তা আসলো কেন? সেকথায় পরে আসছি।

আমার চিন্তা চেতনা জীবনযাপন শিক্ষাদীক্ষা সবকিছুর মধ্যে সাধারণত্বের স্পষ্ট ছাপ। আমি কখনো  অসাধারণ হয়ে উঠতে চাইনি। অসাধারণ মানুষদের উপর কিছুটা দায়বদ্ধতা চাপে, আমি বরাবরই সবকিছু থেকে দায়মুক্ত থাকতে চেয়েছি। সাধারণ একটা স্কুল, সাধারণ একটা কলেজ, সাধারণ একটা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাধারণভাবে পাশ করে খুব সাধারণ একটা চাকরীতে ঢুকে পড়ি। চাকরী জীবনের আগাগোড়াই আমি সাধারণের দলে। ক্যারিয়ারে অসাধারণত্বের নিদর্শন প্রদর্শনের অনেক সুযোগ আমি হেলায় নিক্ষেপ করেছি। আমার ভয় ছিল যদি আমি অসাধারণ উচ্চতায় উঠে যাই তবে দায়িত্বের যে বোঝা, তার চাপে পিষ্ট হয়ে দুটো পয়সা বেশী কামাবার চেয়ে জীবনটা হালকা চালে উপভোগ করি। ফলে আমার উন্নতি একজায়গায় এসে থমকে গেছে।

থমকে যাবার পর আমাকে হাতছানি দিল সাহারা মরুভূমি। আমি একদিন উড়ে চলে আসি সাহারার মধ্যভাগের একটা শহরে। এই শহরটিও আমার মতো। এর পদে পদে মাটির গন্ধ রোদের গন্ধ উড়ে যাওয়া চিলের পাখার গন্ধ। এখানে চিল নেই, শকুন আছে। তবু আমি দূর থেকে তাদের মধ্যে জীবনানন্দের সোনালী ডানার চিল আবিষ্কার করি। সাহারা মরুভূমিতে আমি রাখালের কাজ করি। আমার পদবীকে বাংলা করলে রাখালই হবে। আমার অধীনে কয়েকশো ভেড়া কাজ করে। সেই ভেড়ার কাজ হলো প্রতিদিন কারো না কারো পিঠের লোম দান করা। পিঠ ন্যাড়া সেই ভেড়াগুলোকেও তখন আমার অর্ডিনারি ম্যান বলে ডাকতে ইচ্ছে করে। আই'ম এন অর্ডিনারি ম্যান উইথ হানড্রেডস অব অর্ডিনারী ল্যাম্ব, মাইলস টু গো বিফোর আই স্লিপ, মাইলস টু গো।

আমি যখন দেশে ছিলাম তখন আমি দেশের কথা ভাবতাম না। এখন দেশ আমার বুকের খাঁচায় ২৪ ঘন্টা। আমি কি দেশপ্রেমিক? প্রেমিক হতে হলে দূরে যেতে হয়। শরৎচন্দ্র এই জন্যই বলেছিলেন, বড় প্রেম শুধু কাছেই টানে না, দূরেও......আচ্ছা দূর কী? মাইলের পর মাইল ফিতে টেনে গুনে যাওয়া অচ্ছ্যুত গন্তব্যকেই দূর বলে?

আমি চলে আসার পর কোথাও কিছু থেমে থাকেনি। এন অর্ডিনারী ম্যানের অন্যতম বৈশিষ্ট হলো তার অস্তিত্ব বিনাশ হলেও কেউ টের পাবে না। সাড়া না জাগিয়ে চলে যাওয়ার মধ্যে নীরব আনন্দ আছে।

ফোকাস জিনিসটা আমার খুব অপছন্দ। পার্টিতে গেলে আমার উপর যেন কোন আলো এসে না পড়ে, আমার নাম ধরে মঞ্চ থেকে কেউ যেন ডাক না দেয়, আমি যেন ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে যেতে পারি, সেজন্য সতর্ক থাকতে হয়। একবার স্কুলে একহাজার মিটির দৌড় প্রতিযোগিতায় নাম দিয়ে আমি লুকিয়ে গিয়েছিলাম। আমাকে বারবার মাইকে ডাকা হচ্ছিল। যতই ডাকছিল ততই আমি সিঁটিয়ে লুকিয়ে গিয়েছিলাম যেন আমার কোন অস্তিত্ব নেই। আমি জানতাম না আমাকে ওভাবে ডাকা হবে। যদি না ডেকে বলা হতো, দৌড় দে! আমি অনায়াসে দৌড় দিতাম। চিরটা কাল আমি ফোকাস থেকে সযত্নে দূরত্ব রেখে চলেছি। আমাকে যত  কম লোক চেনে ততই স্বস্তিকর। আড়ালে থাকতে থাকতে থাকতে আমি অচেনা হয়ে যেতে চেয়েছি। তবু হঠাৎ রাস্তায় পুরোনো বন্ধুর মুখ খুব চমকে দিত কখনো কখনো। যেন কেউ জিজ্ঞেস করে কেমন আছিস? আমি জবাব দেই না। অচেনা দৃষ্টিতে তাকিয়ে সটকে পড়ি।

এই বিশাল দূরত্বে অর্ডিনারি ম্যান ভালো আছে। এখানে এত মরুভূমি ডিঙ্গিয়ে আমাকে কেউ খুঁজতে আসবে না। কিছুদিন স্মৃতিতে থাকবো কারো কারো। একদিন স্মৃতি থেকেও অপসারিত হয়ে যাবো। সেদিন আমি একজন খাঁটি অর্ডিনারি ম্যান হয়ে যেতে পারবো। অর্ডিনারি ম্যান দেশে ফিরবে অচেনা হয়ে। ভিড়ের মধ্যে হেঁটে যাবে, কেউ ফিরে তাকাবে না, কেউ ফিরে ডাকবে না। অবাধ ঘুরে বেড়াবো ফার্মগেট থেকে গুলিস্তান, কারওয়ান বাজার থেকে মতিঝিল, শাহবাগ থেকে যাত্রাবড়ি। ঢাকা চট্টগ্রাম সিলেট খুলনা রাজশাহী কোথাও কেউ খুঁজবে না অর্ডিনারি ম্যানকে। দিনের পর দিন বাসে ট্রেনে ফুটপাত রেলস্টেশানে যাযাবরের জীবন কাটিয়ে একদিন গারো পাহাড়ে উঠে যাবো। গারো পাহাড়ের চুড়ায় উঠে হিমালয়ের ছায়া খুঁজবো। হিমালয়ে আমার একটা আত্মা রাখা আছে।

তারপর একদিন ডাক আসলো দক্ষিণ সমুদ্রের সর্বশেষ দ্বীপটি থেকে। বহুকাল আগে আমি ওখানে ছিলাম। গত শতকের শেষ প্রান্তে। আমার জীবনের পূর্ব অধ্যায়ে। সেই নীলিমা বোর্ডিং আবারো ডাকলো আমাকে, যার ডানদিকে অসীম সমুদ্র আর বামদিকে নীল জলের স্বচ্ছ নদী। সেই নদী আর সমুদ্রের মধ্যখানে যে পাহাড়শ্রেনী তার কোলেই দাঁড়ানো নীলিমা বোর্ডিং।

এখানে এখন আর কেউ থাকে না। পরিত্যাক্ত হয়েছে অর্ধশতক আগেই। সাইনবোর্ড ঝরে গিয়ে জঙ্গলবাড়িতে রূপান্তরিত হওয়া নীলিমা বোর্ডিং এখন বিষাক্ত সাপখোপের আস্তানা। দোতলার সেই ঘরের দুটো ভেন্টিলেটরের একটিতে থাকে রাত জাগা পেঁচা, আরেকটিতে আমি। আমি পেঁচাটিকে হরদম দেখতে পেলেও সে আমাকে দেখতে পায় না। কেবল একবার আমার খোপটিতে বসতে গিয়ে বিদ্যুত চমকের ধাক্কা খেয়েছিল। তারপর থেকে এদিক মাড়ায় না আর।

আমার ভালোলাগার মানুষগুলো সব আরো অর্ধশতক আগেই পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে স্বর্গ বা নরকে আশ্রয় নিয়েছে। শুধু আমি মধ্যখানে ঝুলে আছি। অভিশপ্ত এক যাদুর কাঠির স্পর্শে যেদিন অদৃশ্য মানবে পরিণত হয়ে যাই, সেদিন থেকে আমার অস্তিত্ব সম্পর্কে আর কেউ জানে না। খোদ মৃত্যুদুত তার শিডিউল টাইমে এসে আমাকে খুঁজে না পেয়ে ভুল মানুষের জান কবজ করে নিয়ে দায়িত্ব শেষ করে। তারপর আমি আরো একশো বছর কাটিয়ে দিলাম। সাহারা থেকে বাংলাদেশ আসা যাওয়ার ক্লান্তিতে বিপর্যস্ত আমার একটা দীর্ঘমেয়াদের আশ্রয়কেন্দ্রের দরকার ছিল। নীলিমা বোর্ডিং এর হাতছানিটা তাই লোভনীয় মনে হলো।

কিন্তু মানুষের স্পর্শের মায়া কাটিয়ে নীলিমা বোর্ডিং নামের এই জঙ্গলবাড়িতে আরো একশো বছর কি কাটানো যাবে? উন্নয়ন সভ্যতা এখানে এসে আবারো দাঁত বসাবে না তো?


Friday, December 27, 2013

২৭ ডিসেম্বর ২০১৩: PS I know

১.
হিমালয় থেকে শৈত্য প্রবাহ গ্রাস করেছে সমগ্র বাংলাদেশ। কাল রাতে এসে পৌঁছেছে চট্টগ্রামেও। সকাল দশটায়ও সূর্যের দেখা নেই। কুয়াশার ঝাপসা আলোয় পথের উপর নজর চলে না। দূরের পাহাড়গুলো অদৃশ্য। এমনকি নিকটস্থ জলাশয়টিও মুছে যায় যায়। আমি আজ কোথাও যাবো না। কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে শুয়ে বই পড়বো ছুটির দিনের আমেজ গায়ে মেখে।

২.
একটি সোনালী ফিতে দিয়ে খুব যত্নে স্মৃতির টুকরোটা গিঁট দিয়ে রেখেছিলাম। ভয় ছিল যদি কখনো গিঁট খুলে যায়, স্মৃতির টুকরোটা হারিয়ে যায়, তাহলে আমি আর তোমাকে খুঁজে পাবো না। আজ আমি বাক্সটা খুলে বিস্মিত হয়ে দেখলাম সেখানে শুধু গিঁট দেয়া ফিতেটাই আছে, বাকী সবকিছু হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে অপ্রত্যাশিত এক দুপুর শীতের তীব্র কুয়াশায়। আমি কি দায়মুক্ত হলাম?

৩.
বিজয় মেলায় অনেক ভিড়। এই প্রথম সেই ভিড় থেকে দূরে আমি। আস্তে আস্তে এইসব ভিড় বিকর্ষণ করতে শুরু করছে আবারো। বছর শেষ হবার আগেই অন্য কোথাও উড়ে যাবার ইচ্ছেটা দমকা হাওয়ার মতো আঘাত করতে শুরু করেছে। অর্থ নয় বিত্ত নয় স্বচ্ছলতা নয়, আরো এক বিপন্ন বিস্ময় জীবনানন্দের মতো আমাকেও দিশেহারা করছে। জীবনের এই পর্বে নতুন কোন সূচনার সম্ভাবনা আছে কি?


Thursday, December 26, 2013

কংকাল


অসময়ে ক্রিং করে বাজলো কলিংবেলটা। এই ভর দুপুরে কে এল? দরোজা খুলতেই আচমকা একটা লোক তাকে ধাক্কা মেরে ঘরে ঢুকে ধারালো ছুরিটা গলার মধ্যে এমনভাবে চেপে বসালো যাতে সে একটু নড়লেই নালী কেটে যায়। প্রচণ্ড ভয় পেয়ে চিৎকারও করতে পারছে না। ঘরে কেউ নেই। স্বামী স্ট্রোক করে মারা গেছে দুবছর আগে। দুটো ছেলেমেয়ে। ওরা এখন স্কুলে। বিকেলে ফিরবে। পাশের বাসাটাও খালি। এসব কি হচ্ছে? মতলব কি লোকটার? দেখে তো ভদ্র মনে হচ্ছিল তাই দরোজা খুললো। তাছাড়া একদম অচেনাও মনে হচ্ছে না। স্বামীর বন্ধুদের কেউ কি? কিন্তু কোথায় দেখেছে ঠিক মনেও করতে পারছে না রাবেয়া বেগম।

চেহারায় ভদ্র আচরণে নিষ্ঠুর লোকটা তার চুলের মুঠি চেপে ধরে গলায় ছুরির ধারালো ফলাটা আটকে রেখেছে। সে বেশী নড়াচড়া করলে ছুরিটা গলার ভেতরে ডেবে যাবে। রাবেয়া বেগম বুঝে গেল আর উপায় নেই। সে বাধা দেবার বদলে আত্মসমর্পন করার জন্য মনে মনে প্রস্তুত হলো। ছেলেমেয়ে দুটোর জন্য তাকে বাঁচতে হবে। এভাবে বেফাঁস মারা পড়া চলবে না। লোকটা যা যায় বিনা আপত্তিতে দিয়ে দেবে। কিন্তু কি চায় সে?

লোকটা কানের কাছে হিসহিস করে বললো - ত্রিশ লাখ টাকা!!

রাবেয়া বেগম চমকে উঠলো। হ্যাঁ এবার মনে পড়েছে। এই সেই ব্যাংক ম্যানেজার। যে ব্যাংক ঋন দেবার প্রক্রিয়া চলার সময় এই বাড়িতে এসেছিল। সেই একবারই। ঘরটা তখন এমন খুঁটিয়ে দেখছিল, দলিলপত্র এমন চিপে চিপে দেখছিল, আর তাকে বেছে বেছে এমন কঠিন জেরা করছিল, যেন সে টাকাটা মেরে পালিয়ে যাবে। লোকটাকে প্রথম দর্শনেই অপছন্দ করেছিল রাবেয়া। তবু স্বামী মারা যাবার পর সংসারকে টিকিয়ে রাখতে তার একটা আয়ের দরকার ছিল। ঢাকা শহরের এই বাড়ি ছাড়া আর কোথাও কোন আশ্রয় নেই তার। বাড়িটা দিয়েই তাদের বেঁচে থাকতে হবে।

বাড়িটা ব্যাংকে বন্ধক রেখে ত্রিশ লাখ টাকা ঋন নিয়েছিল বছরখানেক আগে। মাসে মাসে ঋনের কিস্তি পরিশোধ করতে হয় ৫০ হাজার টাকা। ঋনের টাকা দিয়ে একটা কাভার্ড ভ্যান কিনে ভাড়ায় দিয়েছিল একটা কোম্পানীকে। বড় ভাইয়ের পরিচিত কোম্পানী। সেই সব ব্যবস্থা করে দেয়। সেই কোম্পানী মাসে ৮০ হাজার টাকা করে দেয়। কিস্তি পরিশোধ করার পার বাকী টাকায় তাদের তিনজনের সংসার খুব সুন্দর চলে। সে ঠিকমতোই ব্যাংকে টাকা জমা দিচ্ছিল। গত ১২ টা কিস্তির একটাও হেরফের হয়নি। নিশ্চিন্তে চলছিল সবকিছু।

কিন্তু তবু এই লোক, মানে ব্যাংক ম্যানেজার জাফর সাহেব এভাবে তার উপর চড়াও হলো কেন? কেন বলছে ত্রিশ লাখ টাকার কথা? সে তো মাসে মাসেই টাকাটা ফেরত দেবার কথা। একসাথে ফেরত চাইছে কেন এখন? সব কেমন এলোমেলো লাগছে।

তাছাড়া সে কল্পনাও করেনি কখনো কোন ব্যাংকের লোক এসে গলায় ছুরি ধরে টাকা ফেরত চায়। চোখ ফেটে জল আসছে তার। সে কোথা থেকে টাকা দেবে? তার জীবনটা দিয়ে দিলেও তো সে টাকাটা এখন দিতে পারবে না। আরো পাঁচ ছয় বছরে সব টাকা শোধ হবে। তার আগে কেন সে টাকা ফেরত চাইবে? দেশে কি আইন কানুন নেই? এমন তো কথা ছিল না।

কিন্তু কে বলতে যাবে তাকে এই কথা। নিষ্ঠুর লোকটা তার গলায় ছুরিটা চালিয়ে দিলে কেউ বাঁচাতে পারবে না। জাফর সাহেব তখনো দাঁত খিঁচিয়ে বলে যাচ্ছে, আমার ত্রিশ লাখ টাকা ফেরত দে!!

গলায় ব্যথা লাগছে রাবেয়া বেগমের। রক্ত বেরিয়ে গেছে মনে হয়। গলা দিয়ে কোন শব্দ বের হচ্ছে না। তার গলায় কি পোচ দিয়ে ফেলেছে লোকটা? কিছুই ভাবতে পারছে না। ঝাপসা লাগছে, কেমন ধোঁয়াশা। সে মরে যাবার আগে প্রাণপনে চিৎকার দিতে চাইল একটা। চীৎকার বের হচ্ছে না, কেমন গোঁ গোঁ শব্দ শুধু।

সেই চিৎকারেই ঘুম ভেঙ্গে গেল রাবেয়ার। চোখ মেলে দেখলো, বাইরে দুপুর নেমে গেছ। ঘরের দরোজা বন্ধ। কেউ আসেনি। সে এতক্ষণ দুঃস্বপ্ন দেখছিল। হাঁপ ছেড়ে বাঁচলো। কিন্তু গলার ব্যথাটা এখনো খচখচ করছে। ব্যথাটা মাছের কাঁটার।

দুপুরে কই মাছ আর শিমের বিচির ঝোল দিয়ে তৃপ্তির সাথে ভাত খাওয়ার সময় গলায় একটা কাঁটা লেগে যায় তার। কই মাছের কাঁটা জিনিসটা বড়শির মতো। ভয়ে কোনদিন কইমাছ কেনে না সে। আজ বোনের বাসা থেকে রান্না করে পাঠালে সে ভাবলো একটু খেয়ে দেখি। খেতে গিয়েই ঝামেলাটা হয়ে গেল। কোন উপায়েই বের করা গেল না। বিকেলে পাড়ার ডিসপেন্সারির সাধন ডাক্তারের কাছে গিয়ে ব্যবস্থা করতে হবে ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়েছিল।


রাবেয়া বেগম উঠে এক গ্লাস পানি খেল।
ব্যথাটা একটু কমেছে। মাছের কাঁটা নাকি আপনাআপনি নেমে যায় অধিকাংশ সময়।

ছেলেমেয়েদের আসার সময় হয়ে গেছে। তাদের জন্য নাস্তা বানাতে হবে।

স্বপ্নের কথাটা ভেবে শিউরে উঠলেও মনে মনে হাসলো।
ছি! সে ব্যাংক ম্যানেজারকে প্রথম দর্শনে অপছন্দ করেছিল বলে এরকম বাজে স্বপ্ন দেখেছে। লোকটা অতটা খারাপ না। ঋনের চেকটা হাতে নেবার সময় জাফর সাহেবকে বরং দয়ালুই মনে হয়েছিল।

ফ্রিজ থেকে কিমা বের করে কয়েকটা রোল বানিয়ে টেবিলে সাজিয়ে রাখলো। ছেলেমেয়ে দুজনই পছন্দ করে এই খাবার তেঁতুলের সস দিয়ে খেতে। ঘরে তৈরী সসও আছে।

বেসিনে হাত ধুয়ে কলিং বেলের শব্দের জন্য অপেক্ষা করছে রাবেয়া। এসময়ের কলিংবেলটা তার খুব প্রিয়। কিন্ত কলিং বেলের বদলে বাজতে শুরু করলো মোবাইলটা। বড় ভাইয়ের নাম্বার। তার খুব ভরসার নাম্বার এটি। সে খুশী হয়ে ভাবলো, ভাইয়াদের আসতে বলি। এই কিমাভর্তি রোলটা ভাইয়ারও খুব পছন্দ। ওদের বাসা কাছেই।

ফোন ধরে বললো, ভাইজান আগে আমার কথা শোনো, তোমরা কিন্তু আজ বিকালে আমার এখানে চা খাবা।

ভাইয়া কেমন থম ধরা গলায় বললো, আসবো। তার আগে একটা খারাপ খবর শোন। আজ দুপুরে সীতাকুণ্ডে কয়েকটা গাড়িতে আগুন দেবার খবর দেখেছিস টিভিতে?

রাবেয়ার আর শুনতে হলো না। বুঝে গেল বাকী অংশ। রাবেয়ার গলায় ব্যাংক ম্যানেজারের ছুরিটা গলায় করাত হয়ে বসে হিসহিস করতে লাগলো, ত্রিশ লাখ টাকা! 

আজ হরতাল ছিল না, অবরোধ ছিল না। তবু জামাত শিবিরের বর্বর হামলায় তাদের বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বনটা লোহার কংকালে পরিণত হয়ে গেল।

Wednesday, December 25, 2013

২৫ ডিসেম্বর ২০১৩ PS, I dont know

১.
পৃথিবীর প্রতিটি কুয়াশার কণায় এক টুকরো আলো আর এক টুকরো অন্ধকার লুকিয়ে থাকে। তোমার অন্ধকার আমরা দেখি না, তোমার আলো-তেই আমরা হাসি, তোমার আলো-কেই আমরা ভালোবাসি হে নিশাচর কূয়াশা।

২.
ছুটির দিনের অফিসেও সময়গুলো উড়ে উড়ে চলে গেল কালের হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে।


৩.
আমিও লং মার্চে যাবো!
এই কুসভ্য নগর ছেড়ে সুদূর অরণ্যে

----------------------------------------------------------------------------------------

হ্যাঁ কবি, পঁচিশ বছর তবু কেটে গেছে

আমার খুব ইচ্ছে হতো তুমি নাটোরের বনলতা সেন হবে
আর পাখির বাসার মতো দুটো চোখ তুলে আকুল হয়ে জিজ্ঞেস করবে
-এতদিন কোথায় ছিলেন?

আমার খুব ইচ্ছে হতো তুমি অভিমানে মুখ ঘুরিয়ে থাকবে
আর আমি তোমার এলোচুল সরিয়ে চিবুকে তর্জনী ছুঁয়ে দিলে তুমি প্রবল মাথা নেড়ে বলবে
-এতদিন আসেননি কেন?

আমার খুব ইচ্ছে হতো, তোমাকে সামনে বসিয়ে অনন্তকাল তাকিয়ে
তোমার দুচোখের সৌন্দর্য প্রাণভরে দেখতে।

আমার খুব ইচ্ছে হতো আমার বাংলা খাতার সবগুলো পাতা
কেবল তোমার নামের হরফ লিখেই ভরিয়ে ফেলতে।

আমার খুব ইচ্ছে করতো তোমার মেঘরং চুলের ভেতর নাক ডুবিয়ে নিঃশ্বাস নিতে
আমার খুব ইচ্ছে করতো দুহাত দিয়ে তোমার চোখের পাতা স্পর্শ করতে।

আমার সবগুলো ইচ্ছের কবর হয়ে গেল
যখন তুমি একদিন আমাকে একা রেখে কোথাও চলে গেলে।

তুমি চলে যাবার পর জীবনানন্দের বই খুলে পড়তে থাকি-

"তারপর কতবার চাঁদ আর তারা,
মাঠে মাঠে মরে গেল, ইঁদুর — পেচাঁরা
জোছনায় ধানক্ষেতে খুঁজে
এল-গেল। –চোখ বুজে
কতবার ডানে আর বায়ে
পড়িল ঘুমায়ে
কত-কেউ! — রহিলাম জেগে
আমি একা — নক্ষত্র যে বেগে
ছুটিছে আকাশে
তার চেয়ে আগে চলে আসে
যদিও সময়–
পঁচিশ বছর তবু কই শেষ হয়!–"

একদিন আমাকে তুমুল বিস্ময়ে ডুবিয়ে দিয়ে শেষ হয় প্রতীক্ষার পচিশ বছর।
আমি তখনো জানতাম না পঁচিশ বছর পর সেই কবর ফুঁড়ে জেগে উঠবে ভালোবাসার ভষ্ম।
আবার কোনদিন পুরোনো বাগানে ফোটাতে চাইবে নতুন ফুল।


"তারপর — একদিন
আবার হলদে তৃণ
ভরে আছে মাঠে- -
পাতায় শুকনো ডাঁটে
ভাসিছে কুয়াশা
দিকে দিকে, চড়ায়ের ভাঙা বাসা
শিশিরে গিয়েছে ভিজে — পথের উপর
পাখির ডিমের খোলা, ঠান্ডা-কড়কড়!
শসাফুল — দু-একটা নষ্ট শাদা শসা
মাকড়ের ছেঁড়া জাল, শুকনো মাকড়সা
লতায় — পাতায়;
ফুটফুটে জোছনারাতে পথ চেনা যায়;
দেখা যায় কয়েকটা তারা
হিম আকাশের গায় — ইঁদুর পেঁচারা
ঘুরে যায় মাঠে মাঠে, ক্ষুদ খেয়ে ওদের পিপাসা আজও মেটে,
পঁচিশ বছর তবু গেছে কবে কেটে!"


হ্যাঁ কবি পঁচিশ বছর তবু গেছে কেটে!


[ঋন স্বীকার: কবি জীবনানন্দ দাশ]


Tuesday, December 24, 2013

২৪ ডিসেম্বর ২০১৩ স্বচ্ছ জীবন, অস্বচ্ছ ছায়া

১.
জীবনটা মোটেও মসৃন নয়। এর ধারগুলো খাঁজকাটা খাঁজকাটা। জীবনের চাকা যখন ঘুরে তখন কাটা খাঁজগুলো আমাদের চামড়ায় ক্ষত সৃষ্টি করে। কিছু কিছু ক্ষত আমরা মলম দিয়ে সারিয়ে নিই, কিছু ক্ষত সারাজীবনেও সারে না। যে ক্ষতগুলো সারে না তাদের মেনে নেয়ার জন্য আমরা তৈরী করেছি নিয়তি নামের একটা উপলক্ষ। সেই উপলক্ষের হাত ধরে আমরা ক্ষয়ক্ষতি সমৃদ্ধ জীবনকে মেনে নিয়ে ভুল আনন্দে মেতে থাকি। কোন কোন আনন্দের ঠিক নীচের ভাঁজেই থাকে ভয়ংকর কুৎসিত কোন যন্ত্রণা। যে যন্ত্রণার উপশমের কোন সম্ভাবনা নেই। তবু আমরা বলি মানুষ মাত্রেই সম্ভাবনাময় প্রাণী। অথচ প্রাণ থাকলে প্রাণী হলেও মন না থাকলে মানুষ হয় না।

২.
আমি তোমাকেও পছন্দ করি না, তাকেও পছন্দ করি না। কিন্তু তোমাকেও বলি না, তাকেও বলি না। তোমাদের কিছু কাজ আমাদের সহ্য হলেও অধিকাংশ কাজে আমার তীব্র আপত্তি। কিন্তু তোমাদের ছেড়ে আমাদের উপায় নেই বলে আমি তোমাকের কাউকে কিছু বলছি না। যদি আমার একটি সঠিক বিকল্প হাতে থাকতো তাহলে এই মাটির শপথ, আমি তোমাদের দুজনকেই ছুঁড়ে দিতাম মহাকালের আবর্জনা ভাগাড়ে যেখানে তোমাদের যাবার কথা ছিল আরো অনেক বছর আগে।

৩.
সে একটা স্বচ্ছ সরু জলভর্তি টবে হাঁটু ডুবিয়ে কোমর বাঁকিয়ে মাথা সোজা রেখে দাঁড়িয়েছিল টেবিলের একটা কোনায়। তাকে বড় যত্নে আগলে রেখেছিল কাঁচের সরু টবটি। তবে সে নিজে কতটা স্বচ্ছন্দে ছিল, অথবা জায়গাটা তার জন্য যথাযথ ছিল কিনা, আরো একটু বড় জায়গা দরকার কিনা কেউ তাকে জিজ্ঞেস করেনি। তবু সে চুপচাপ দাড়িয়ে থাকতো। দিবানিশি রোদবৃষ্টি জ্যোৎস্না যত কিছুই থাকুক সে ঘরের আবছায়া আলো মেখে দাঁড়িয়ে থাকতো প্রতিদিনের ক্ষণিক জলবদলের আনন্দ নিয়ে। কতদিন সে দাঁড়িয়ে ছিল? এক দুই দশ দিন নয়। তিন পেরিয়ে সাড়ে তিন বছর। কিন্তু এক পায়ে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকতে হলে যতগুলো শিকড় দরকার, তার পায়ে হয়তো ততগুলো শিকড় ছিল না। শেকড় গজাবার জায়গা ছিল না। তাই সাড়ে তিন বছর পর একদিন সহ্যের সমাপ্তিরেখায় পৌঁছে নিজেকে অনিবার্য সেই পরিণতির কাছে সমর্পন করলো ছোট্ট সবুজ সজীব বৃক্ষকাণ্ডটি। হারিয়ে গেল চিরদিনের মতো। সে তো গেলই, সেই সাথে নিঃসঙ্গ করে গেল প্রতিদিনের আনন্দের সঙ্গী তার আশ্রয়দাতা সেই স্বচ্ছ কাঁচের টবটিকেও।

Monday, December 23, 2013

২৩ ডিসেম্বর ২০১৩ গ্যাৎচোরেৎশালা

১.
প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠলে মনে হয় আজ জটিল একটা দিন। বাইরে তখনো প্রায়ান্ধকার। শীতকালে এত ভোরে অফিস যাওয়াটা যুগ পার হবার পরও অভ্যেসে পরিণত হয়নি। তাই ভোরের দিকে ঘুমটা যখন সবচেয়ে বেশী মায়া নিয়ে চোখে জড়িয়ে ধরে, নকশী কাঁথাটা যখন গায়ের মধ্যে সবচেয়ে ভালো উষ্ণতাটা বিলায়, ঠিক তখনই বেরসিক এলার্মটা বাজে। শীতভোরের এলার্ম টোন পৃথিবীর সবচেয়ে বিরক্তিকর সঙ্গীত। আমি খুব চেষ্টা করি সকালে এলার্মের ডাকে মাধুর্য ঢালতে, বৈচিত্র আনতে। রিংটোন পাল্টাতে পাল্টাতে সব শেষ হয়ে যাবার পর এখন ধরেছি প্রিয় গানের সুর। আমি জানি এই গানগুলো কদিন পরই বিষবৎ হয়ে উঠবে। এখন দিয়েছি Scorpion এর Winds of Change. এই গানের সূচনা সঙ্গীত খুব মিষ্টি। শীতকাল যতদিন থাকবে এটা রাখবো ভাবছি।

২.
গতকাল পত্রিকায় চোখও বুলাইনি। কারণ পত্রিকায় প্রধান খবর হিসেবে যে শিরোনাম আর ছবি থাকবে সেই বিভৎসতা দিয়ে সন্ধেটা মাটি করতে চাইনি। আমি দৈনিক পত্রিকার হেডলাইনে চোখ বুলাই সন্ধায় অফিস থেকে ফেরার পর। বাকী সবার কাছে ওটা বাসী হয়ে গেলেও আমি তাজা মনেই চোখ বুলাই। এই চোখ বুলানো কোন সংবাদ অনুসন্ধিৎসা নয়, বরং এটা একটা নিজস্ব ভড়ং। এই ভড়ং দিয়ে আমি নিজেকে বোঝাই সময়টা এখন নয় সময়টা আরো ত্রিশ বছর আগের। যখন চট্টগ্রামে ঢাকার পত্রিকা আসতে বিকেল গড়িয়ে যেতো। আমি সেই সময়টার ঘ্রাণ পেতে ভালোবাসি। আমি যে কোন অতীতের ঘ্রাণে মুগ্ধ। এমনকি সেটা যদি দুঃসময়ের ঘ্রাণ হয় তবুও। আমার এই ভড়ং এর উদ্দেশ্য অতীতচারী হয়ে বর্তমান থেকে খানিক সময় পালিয়ে থাকা। বর্তমান সময়টাকে আমার সহ্য হচ্ছে না।

৩.
বুঝ হবার পর থেকে সজ্ঞানে আমি কখনো কোন পাকিস্তানী পণ্য কিনি না। মাল্টা নামের কমলার মতো দেখতে একটা ফল বাংলাদেশে খুব জনপ্রিয়। আমার ওটা খেতে কখনোই ভালো লাগেনি। তবে কখনো রোগী দেখতে গেলে জিনিসটা কিনতাম। একদিন দোকানীকে জিজ্ঞেস করে জানলাম এই বস্তু পাকিস্তান থেকে আসে। সেদিন থেকে রোগীর জন্যও এই ফল কেনা বন্ধ করে দিলাম। এতকাল পর দেখতে পাচ্ছি আরো অনেক বাঙালী পাকিপন্য বর্জনের ডাক দিয়েছে। ক্যাম্পেইন করছে অনেকে। ভালো কথা। কিন্তু আমার মতো অবোধ মানুষও যা বুঝেছে বহুবছর আগে, আপনাদের এতদিন লাগলো বুঝতে?

৪.

অতীন ব্যানার্জীর 'নীলকন্ঠের খোঁজে' বইটিতে 'গ্যাৎচোরেৎশালা' শব্দটি বহুল ব্যবহৃত। শব্দটা গালি নাকি ক্ষ্যাপাটে বুলি বুঝিনি। বন্ধু যদিও বলে এটা গালিই আমি নিশ্চিত নই। অতীন ব্যানার্জি বেঁচে থাকলে জিজ্ঞেস করতাম। তবে দেশের বর্তমান অবস্থা দেখে এরকম একটা গালি মুখ দিয়ে বের হয়ে যেতে চায়।

৫.
এবার একটু জীবনানন্দ সুধা-

প্রৌঢ় হৃদয়, তুমি
সেই সব মৃগতৃষ্ণিকাতলে ঈষৎ সিমুমে
হয়তো কখনো বৈতাল মরুভুমি,
হৃদয়, হৃদয় তুমি!
তারপর তুমি নিজের ভিতরে ফিরে এসে তব চুপে
মরীচিকা জয় করেছো বিনয়ী যে ভীষন নামরূপে
সেখানে বালির সব নিরবতা ধূ ধূ
প্রেম নয় তবু প্রেমেরই মতন শুধু।


Saturday, December 21, 2013

শিশুর পিতা ঘুমিয়ে আছে সব শিশুদের অন্তরে

দিনের অন্ততঃ একটা ঘন্টা বই পড়ার জন্য রাখার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হই। তার মানে এই নয় যে আমি ২৪ ঘন্টাই খুব ব্যস্ত। খুব ব্যস্ত না হলেও এক নাগাড়ে এক ঘন্টা সময় পাই না। সংসারী মানুষ মাত্রেই এই ঝামেলায় থাকে। পড়াশোনা বা লেখালেখি জাতীয় কাজে ব্রেক দেয়া মানে সেই ঘন্টাটা শেষ। আমার কাছে সেরকমই। একবার মুড নষ্ট হয়ে গেলে ফিরে আসা কঠিন। সঙ্গত কারণেই বিশ পঁচিশ বছর আগে যেরকম বই পড়তে পারতাম এখন পারি না।

কোন কোন রাতে বই পড়ার মুড নষ্ট হয়ে গেলে গান শুনি। ঘুমোবার আগে বাতি নিভিয়ে শুয়ে শুয়ে গান শোনার চেষ্টা করি। দেয়াল টিভির একটা ফোল্ডারে পছন্দের কয়েকশো গান বেছে জমা করে রেখেছি। গানগুলো অনেকবার শোনা। তবু অনিয়মিত নির্বাচনে (র‍্যানডম সিলেকশান) চালিয়ে দিলে শুনতে ভালো লাগে। প্রতিটা গানের সাথেই আমার কোন না কোন স্মৃতি জড়িত। চোখ বন্ধ করে সেই সব স্মৃতির দেশে বেড়াএ চলে যাই। কোন গানের পর কোন গান আসবে আগে থেকে জানা না থাকলে একরকমের বৈচিত্র্যও আসে। গান শোনার সময় মাঝে মাঝে আমার ছেলে মেয়ে দুজনও পাশে এসে যায়। এরাও গানের পাগল। ছোটদের গান বাদ দিয়ে বড়দের গান শুনতে শুরু করছে আজকাল। সেদিন আমাকে ফরমায়েশ করছে, বাবা 'কাভি কাভি' গানটা দাও, ওটা ভালো লাগে। মনে মনে বলি, বাপ্রে ওটা তোদের দাদার প্রিয় গান, এখন মাঝে মাঝে শুনি আমি, তোদের ভেতরেও ঢুকে গেছে ওটা?

কয়েকদিন আগেও সেরকম এক রাতে গান শুনতে শুনতে ঘুম এসে যাচ্ছিল প্রায়। এমন সময় 'ক্ষ' ব্যাণ্ডের গাওয়া বহুল আলোচিত বিতর্কিত 'আমার সোনা বাংলা'র প্রাথমিক সুর বাজতে শুরু করলো। গানটা অন্তরা থেকে শুরু। সূচনা সঙ্গীত শুনে আমি ভাবছিলাম গানটা রবীন্দ্রসঙ্গীত হিসেবে শুনবো, নাকি জাতীয় সঙ্গীত। কিন্তু আমার পাশে শুয়ে থাকা চার বছরের পুচকাটা ভাবাভাবির ধার ধারলো না, সে চট করে গায়ের চাদর ফেলে দিয়ে সটান দাঁড়িয়ে গেল মাথা ছুঁই ছুঁই মশারির ভেতরে। মুখে কোন কথা নেই। গম্ভীর চেহারায় হাত দুটো পরস্পর আকড়ে ধরে দাঁড়িয়ে আছে। ক্ষ ব্যাণ্ড যদিও বলেছে তারা এটাকে রবীন্দ্রসঙ্গীত হিসেবে গেয়েছে, কিন্তু আমার পুত্র সেটা মানতে রাজী নয়। অতএব বাকীদেরও বিছানা ছেড়ে দাঁড়িয়ে যেতে হয়।

গান শেষ হলে ঘটনা জানলাম। পুচকা যদিও এখনো স্কুলে যেতে শুরু করেনি, কিন্তু তার কেজি পড়ুয়া বোনের স্কুলে দেখেছে জাতীয় সঙ্গীত গাইলে দাঁড়িয়ে যেতে হয়। সে জিনিসটা মাথায় রেখে দিয়েছে এবং জায়গামত দাঁড়িয়ে গেছে। কথাটা অনস্বীকার্য যে ন্যায়-নিয়ম-নীতির প্রশ্নে শিশুদের কাছ থেকেও শেখার ব্যাপার আছে।

তো, এই শিশুরা যখন আমাদের মতো বড় হবে তখনো কি অপাপবিদ্ধ বিশ্বাস আর নিয়মগুলো অটুট রাখতে পারবে? যদি পারতো তাহলে ভণ্ডামি আর নষ্টামির পৃথিবী ওদের ভবিষ্যত অপচয় করতে পারতো না। এরকম আশাবাদ রেখেই যাই না কেন!


Thursday, December 19, 2013

বাঁশী শুনে আর কাজ নেই!

মেজমামা অনেকদিন পর বিদেশ থেকে ফিরছেন। সেই যে পাঁচ বছর আগে দেশ ছেড়েছেন আর কোন খবর নাই। মামাতো ভাইবোনেরা বাপের চেহারা পর্যন্ত ভুলে যাবার দশা। মামাতো ভাইরা তখনো ছোট। তাই আমরা দুই ভাগ্নে ঢাকা গেলাম এক মামাতো ভাইকে নিয়ে। এয়ারপোর্ট থেকে মহাসমারোহে মামাকে নিয়ে আসবো। ঢাকায় খালার বাসা। ওখানে উঠলাম। পরদিন সকালে এয়ারপোর্টে গেলাম মামাকে আনতে। মামা আমাদের দেখে খুব খুশী। জড়িয়ে ধরলেন আনন্দে। আর মামাতো ভাই জাবিরকে তো রীতিমত কোলে তুলে নিলেন। জাবির লজ্জায় মিশে যাচ্ছে। ক্লাস নাইন পড়ুয়া ছেলের তো লজ্জাই লাগার কথা। কিন্তু মামা ওকে শেষবার দেখেছে ক্লাস থ্রিতে, এখনো তাকে বড় ভাবতে পারছে না বলে কোলে নেবার চেষ্টা। আমরা দুই খালাতো ভাই মুখ টিপে হাসি।

ফিরলাম মালিবাগের খালার বাসায়। আজ চট্টগ্রাম ফেরা যাবে না। আগামী কাল ফিরবো। এই রাতটা শেষ রাত। খালার বাসাটা বেশী বড় না। তবে ছোট হলেও চারটা রুম আছে। প্রথম ঘরটা বসার ঘর, তবে এখানে একটা খাটও পাতা আছে। এটা পুরুষ মেহমানদের জন্য বরাদ্দ। তার পাশের ঘরটায় খালু থাকেন। তার পাশের ঘরে খালা আর খালাতো বোনেরা থাকে। চতুর্থ ঘরটা দুই খালাতো ভাইয়ের পড়া এবং ঘুমানোর। চারটা ঘরই সংলগ্ন, একটা ঘর থেকে অন্য ঘরে আসা যাওয়া করা যায়।

আমরা চার খালাতো ভাই একত্র হলে ঈদের আনন্দ। বড় খালাতো ভাই আমিন আর আমি চট্টগ্রামের। দুই খালাতো ভাই শাহেদ আর মুহিত ঢাকায় পড়ে। আমরা সবাই তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের নানান ধাপে। বয়সের তারতম্য থাকলেও মনের কোন তারতম্য ছিল না। চারজন একসাথে ঘুরি একসাথে খাই, একসাথে আড্ডাই, কিন্তু রাতে একসাথে ঘুমানো যায় না অত বড় খাট নেই বলে। গত দুই রাত শাহেদ আর আমিন এই ঘরে। মুহিত আর আমি বসার ঘরের অতিথি খাটে ঘুমিয়েছি। অতিথি ঘরের খাটটা এই ঘরের একদম লাগোয়া, দরোজার পাশে জানালাও আছে দুই ঘরের মাঝে। ফলে ভিন্ন খাটে শুয়েও একসাথে কথাবার্তা চলে, আড্ডা মারা যায় নির্বিবাদে। কিন্তু আজ মেজ মামাকে ছেড়ে দিতে হলো বসার ঘরের খাটটা। ফলে মুহিতকে শুতে হবে তার বাবার সাথে।

সন্ধ্যার পর থেকে এটা নিয়ে তার মুখ গোমড়া। মেজ খালু ভীষণ কড়া মানুষ। যমের মত ভয় পায় ঘরের সবাই। উনি বসার ঘরে থাকলে খালাতো ভাইয়েরা পেছনের দরোজা দিয়ে ঘরে ঢুকে। মেজ খালুর সাথে ঘুমানোর চেয়ে একটা বাঘের গুহায় ঘুমানো উত্তম বলে মনে করে মুহিত। এমনকি আমরা অতিথিরাও বাঘের চেয়ে কম ভয় পাই না খালুকে। ফজরের নামাজের সময় উঠেই ডাক দেয়, 'নামাজ পড়ার টাইম হইছে, মোমিন মুসলমান উঠে পড়েন'। আমরা অতিথিরা শুনেও না শোনার ভাণ করে মটকা মেরে পড়ে থাকি লেপকাথা কানে গুঁজে। অতিথিদের জন্য কোন শাস্তি নেই নামাজ না পড়লে। কিন্তু ছেলেদের জন্য কড়া ডোজ।

পাশে ঘুমালে তো কান ধরে তুলে দেবে। বেচারা মুহিতের জন্য মায়াই লাগলো। সে অনেক চেষ্টা করছে আমাদের খাটে জায়গা নিতে। কিন্তু এই দুর্বল খাটে তিনজনেরই জায়গা হয় না। শীতকাল বলে কোনমতে চাপাচাপি করে ম্যানেজ করা গেছে। চারজন তো প্রশ্নই ওঠে না। তবু মুহিত পারলে আমাদের খাটের নীচে শুয়ে থাকবে তবু বাপের সাথে এক খাটে শুতে রাজী না। যতই গাঁইগুই করুক রাতে শোবার আগে বাঘের গুহা থেকে শুধু 'মুহিত কই' বলে একবার ডাক এলো, অনতিবিলম্বে সুড়সুড় করে বাঘের গুহায় ঢুকে গেল মুহিত। আমরা ওকে শান্ত্বনা দিলাম, একটা মাত্র রাত, এ আর এমন কি। তাছাড়া ওই ঘরটাও খুব দূরে না। আমাদের খাট আর ওদের খাটের মধ্যে দশ ফুটের ব্যবধান। মেজমামার খাট আমাদের খাটের দুই ফুটের মধ্যে। মেজমামার সাথে থাকবে জাবির।

শোবার আগে হঠাৎ করে পিচ্চি খালাতো বোনটা এসে কানে কানে বলে গেল, "ভাইয়া, আজ রাতে বাঁশী বাজবে কিন্তু। সাবধান।"
 
আমরা ঘটনা বুঝতে পারলাম না। পিচ্চিকে জিজ্ঞেস করার আগেই ভোঁ দৌড়। বুঝতে পারিনি, কারণ আমরা চারজনই দুপুরে বাইরে গিয়েছিলাম খেয়েদেয়ে। মামা আর জাবির খেয়ে ভাতঘুম দিয়েছিল। যাই হোক পিচ্চিপাচ্চিদের কথা বাদ। আমরা বড়দের গপ শুরু করলাম বাতি নিভিয়ে। আগে কখনো তিনজন শুইনি এই খাটে। শুয়ে বুঝলাম, খাটটা তিনজনের ওজন নেবার মতো যথেষ্ট মজবুত না। সাবধানে থাকতে হবে। একটু নড়লেই 'ক্যাঁও' করে বিদঘুটে একটা শব্দ করছে। শব্দটা শুধু এই ঘরে সীমাবদ্ধ থাকলেই হতো। এটা আশপাশের ঘরের লোকদের কাছেও পৌঁছে যাচ্ছে। খালুর আবার একটু শব্দ হলেও ঘুম ভেঙ্গে যায়। তাছাড়া শীতকাল, ফ্যানট্যান বন্ধ থাকাতে শব্দটা আরো প্রকট লাগছে।

আসলে প্রায় সকল মধ্যবিত্ত খাটই অল্পবিস্তর শব্দ করে মনে হয়। শীতকালেই সেটা টের পাওয়া যায়। কেননা একটু পর খেয়াল করে শুনলাম, পাশের ঘরে মেজ খালুর খাটও সামান্য 'ক্যাঁচ' করে উঠলো। শুধু তাই না, মেজ খালাদের ঘর থেকেও একবার মৃদু 'কট কট কটররর' শব্দ শুনলাম যেন।  পিচ্চিপাচ্চি খালাতো বোনগুলো সব এক খাটে ঘুমায়। ওদের নড়াচড়ার শব্দ। শুধু শব্দ নেই আমাদের সবচেয়ে নিকটবর্তী খাট যেখানে মেজমামা ঘুমোচ্ছে নিঃশব্দে। পাশে জাবির। সবচেয়ে ভালো খাটটা বসার ঘরেই দেয়া হয়েছে।

কিন্তু না। বেশীক্ষণ নিঃশব্দ থাকলো না পাশের ঘরটি। দুই ঘরের জানালা দিয়ে প্রথমে একটা সুমিষ্ট সুর ভেসে আসলো। আমাদের তিনজনের গপ একটুর জন্য থেকে গেল শব্দটা শুনে।

-কিসের শব্দ?
-ব্যাপার কি?
-কে বাজায় বাশী?

একটু বিরতি নিল সুরটা। আবারো পোঁ করে বেজে উঠলো। এবার আগের চেয়ে আরেকটু উচু স্কেলে। তিনজনই কান খাড়া করলাম আবারো। আমিন ভাই উঠে বসতে চাইলে আমাদের খাটটা তার তিনগুন বাড়তি স্কেলে 'ক্যাঁও' করে যে কান্না ছাড়লো, ওই বাঁশী হার মানলো তাতে। তাড়াতাড়ি আমিন ভাই শুয়ে পড়লো। সেই বাঁশীর সুর ক্রমান্বয়ে বাড়তে বাড়তে পোঁ থেকে ভোঁ স্কেলে আসলো। এবার শোনা যেতে লাগলো পোঁ-ভোঁ, পোঁ-ভোঁ, পোঁ-ভোঁ.........।

শাহেদ সবার আগে ধরতে পারলো ব্যাপারটা। সে ফিসফিস করে বললো, মেজমামা!
আমরা জিজ্ঞেস করলাম, মেজমামা কি?
শাহেদ বললো, বাঁশীটা মেজমামা বাজাচ্ছে। নাসিকা বংশী।

এই কথা শুনে আমাদের তিনজনের এমন বিকট হাসি পেল যে মেজখালুর ভয়ে চাপতে গিয়ে বিপাকে পড়ে গেলাম। আপনারা জানেন, মানুষ যখন জোর করে হাসি চাপতে চায় তখন শরীরে একধরনের কম্পন তৈরী হয়, সেই কম্পন যত নিয়ন্ত্রন করতে চাইবেন, তার শক্তি তত বেড়ে যাবে। আমাদের তিনজনের হাসি চাপার কম্পনে সমগ্র খাটটা এমন ক্যাঁও, ক্র্যাঁও ইত্যাদি ত্রাহি চিৎকার শুরু করলো যে পাড়ার নিশিডাকা কুকুরগুলো পর্যন্ত কিছুক্ষণ থমকে গিয়েছিল।

আমরা মুখ দিয়ে কোন শব্দ করছি না। কিন্তু খাটটা আট মাত্রার ভূমিকম্প নিয়ে কাঁপছে আর চিৎকার করছে। সেই চিৎকার ছড়িয়ে পড়ছে ঘর থেকে ঘরে, এমনকি ঘর ছেড়ে বাইরে। কমপক্ষে মিনিট দুয়েক ক্যাঁও, ক্র্যাঁও, ক্যাঁও, ক্র্যাঁও,- ক্যাঁও, ক্র্যাঁও, ক্যাঁও, ক্র্যাঁও.........চলার পর থামলো। ফিসফিস করে একজন আরেকজনকে ধমক দিয়ে বললাম, এই চুপ কর, আর না, কেউ জেগে যাবে।

তিনজনই নিয়ন্ত্রণ করলাম। কিন্তু মামার পোঁ-ভোঁ, পোঁ-ভোঁ, পোঁ-ভোঁ চলছেই। এর মধ্যে খেয়াল করলাম, মেজখালুর ঘরে 'ক্যাঁচ ক্যাঁচ' শব্দটা দ্রুতলয়ে বাজতে শুরু করেছে। নিশ্চয়ই মুহিত হারামজাদা একা একা হাসছে মামার বাঁশী শুনে। ওদিকে মেজখালার ঘর থেকেও ভেসে আসতে থাকলো এক নাগাড়ে কট কট কটররর ধরণের শব্দ। নিশ্চয়ই খালাতো বোনগুলোও ওখানে হাসছে। এতক্ষণে আমরা বুঝলাম পিচ্চি কেন বলেছিল- আজ রাতে বাঁশী বাজবে। ওরা নিশ্চয়ই দুপুরে শুনেছে মামার বাঁশীর সুর। কী ফাজিল মেয়েরে!

আমি বাকী দুজনকে হাসতে বারণ করে নিজেকে নিয়ন্ত্রণে নিয়েছিলাম বিদ্যুত মিত্রের সুত্র দিয়ে। কিন্তু মেজ খালুর ঘরে মুহিতের একা একা হাসতে থাকার দৃশ্যটা কল্পনা করে আমার পেটটা হাসির চাপে আবারো একটু কেঁপে গেল। সেই কম্পনে খাটটা আবারো 'ক্যাঁও' করলো। আমার পাশে আমিন ভাই, আমার পেটের কম্পন টের পেয়ে পাশে আমিন ভাইও কেঁপে উঠলো, আবারো ক্যাঁও। এরপর শাহেদও বাকী থাকে কি করে। ফলে আবারো ভূমিকম্প শুরু হলো, এবার আরো প্রবলবেগে। এরকম হাসিগুলো প্রচণ্ড সংক্রামক। তিনটা ঘরে তিনটা খাট তিন রকমের ক্যাও- ক্র্যাঁত শব্দে পুরো বাসাটাকে কাঁপিয়ে ফেলতে লাগলো। অথচ কারো মুখে কোন শব্দ নেই।

অবধারিতভাবে খালুর ঘুম ভাঙ্গা ধমক শোনা গেল মুহিতকে লক্ষ্য করে। "কী হইসে, এত হাসির কি? ঘুমা"। খালুর ধমকে আমাদের হাসি থেমে গেল। ভয়ে চুন হয়ে শুয়ে আছি। মশারির উপর ডিম লাইটের মৃদু আলো। সেই আলোর একটা ছায়া মশারিতে পড়েছে টের পেয়ে আরো ভয়ে গুটিয়ে গেছি। নিশ্চয়ই মেজ খালু আমাদের দেখতে এসেছে। চোখ বন্ধ করে মটকা মেরে আছি। কিন্তু আমি হঠাৎ চোখ মেলে যা দেখলাত তাতে পুরাই পাত্থর।

আমাদের খাটের ক্যাঁও ক্যাঁও শব্দের তোড়ে মেজমামার পোঁ-পোঁ, ভোঁ-ভোঁ কখন যে থেমে গেছে কেউ খেয়াল করিনি। খাটের পাশে ডিমলাইটের ছায়ার লুঙ্গির গিট ঠিক করতে থাকা মানুষটা মেজমামা। মশারির ভিতর উকি দিয়ে বোঝার চেষ্টা করছেন ঘুমন্ত মানুষের খাট থেকে এত শব্দ কিভাবে বের হচ্ছে। সম্ভবতঃ তিনজনেরই চোখ খুলে গিয়েছিল এবং তিনজনের এতক্ষণ চেপে রাখা হাসির বোমাটা  মেজমামাকে দেখে এমন জোরে বিস্ফোরণ ঘটলো যে আমাদের ভগ্নপ্রায় খাটটা শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে ভূতলে আছড়ে পড়লো তিনজন জোয়ান মর্দ পুরুষকে নিয়ে।

আস্ত খাটটা ভূমিতে লুটিয়ে পড়ার পরও আমাদের হাসির ভূমিকম্প কিছুতে বাগ মানছে না। শেষে গলা দিয়ে একরকমের গররর গররর শব্দ বের হওয়া শুরু করলো। মামা ঘাবড়ে গেল তিন ভাগ্নের এই অবস্থা দেখে। মামা চীৎকার করে ডাকলেন, মুহিতরে, অ মুহিত, জলদি তোর বাপকে ডাক, এগুলারে নিশিতে পাইছে রে। এখনি ডাক্তার বৈদ্য কিছু ডাক।

মেজ খালুকে ডাকতে হলো না। তিনি নিজেই বেরিয়ে এলেন দরোজা খুলে। এরপর কি হলো, সেই ঘটনা প্রকাশ্যে বলাটা সম্মানজনক হবে না। কিছু কথা থাক না গুপন।

ও গানঅলা, আরেকটি গান গাও


আমাকে প্রথম যিনি সুমনের গান শুনিয়েছিলেন(তোমাকে চাই) তিনি এখন আমার দিগন্তের অন্য প্রান্তে। সুমনের গান ১৯৯৩ সালে প্রথম শোনা হয়।  শিমুল মোস্তফার কন্ঠে আবৃত্তিও শুনি এই গানের এবং কবিতার।

সুমন আমাকে বেশ কিছুদিন আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। গানের একটা নেশা আছে। একেক সময় একেকজন সেই নেশায় ডাকে। সুমনের সময়টাও আমার ভাঙচুরের একটা গুরুত্বপূর্ন সময়।

দীর্ঘদিন সুমনের গান শুনে শুনে যে ভাবনাগুলি খেলা করেছে সেই ভাবনার একটা অংশ পেয়ে গেলাম সচল মাহবুব লীলেনের এই লেখায়

লীলেন বলেছেন,
.....সুমনের গানগুলো শুনলে মনে হয় কোথাও একটা দেশ ছিল। ছিল একটা জীবন। যে জীবন ফেলে এসেছে সবাই অথচ ফেলে আসতে চায়নি কেউই.......

....গতি ও গতিহীনতায় আক্রান্ত বাংলাদেশের মানুষের কাছে সুমন এক অব্যক্ত অনুভূতির প্রকাশ। সুমনের চরিত্রগুলোর অনেক কিছুই আছে তবু যেন অনেক কিছু নেই। অনেক কিছু পেয়েও যেন অনেক হারিয়েছে তারা। অথবা পাবে না কোনো দিন.....

....সুমনের গানের আরেকটা প্রধান দিক হল এর বাউলিয়ানা। সবগুলো গানের আড়ালেই যেন কোথাও একটা বাউল সুর বেজে ওঠে। একটা দুঃখী ছিন্নমূল বৈরাগীর চেহারা ভাসে.....


আমি যখন একটা অনিশ্চিত অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলাম ১৯৯৫ সালে, তখন একবার রাতের বাসে ঢাকায় গিয়ে মামুনের ফকিরাপুলের বাসায় হাজির হই ভোরবেলা। সে অফিসে যাবার জন্য তৈরী হচ্ছিল। আমি নাস্তা করে ঘুমোবো। ওর ব্যাচেলর বাসাটি তখন আমাদের ঢাকার সরাইখানা। মামুন অফিসে যাবার সময় আমার কানে যে হেডফোনটি তুলে দিয়েছিল তাতে বাজছিল "ও গান অলা"। আমি সেদিন থেকে সুমনের গানের আরো গভীরে ঢুকে গেলাম।

সুমন ও নচিকেতা। নব্বই দশকে এই দুজনের গান একই সাথে জনপ্রিয়তা পায় দুই ধরনের শ্রোতার কাছে।  তবে নচিকেতা আমাকে টানেনি একদমই। আমাকে টেনেছিল সুমন। সুমন আমার কাছে ছিল নিঃসঙ্গ নাগরিক কবি। আমি নব্বই দশকের সুমনকে মিস করি।

সুমন এখন অনেক বদলে গেছে। বদলে যাওয়ার অনেকটাই ভালোলাগা ক্ষুণ্ন করেছে। তবু সুমনকে এখনো বলি, আরেকটা গান গাও, তুমি যা গাও তাতেই প্রচ্ছন্ন সুর ফুটে ওঠে-


শেষ পর্যন্ত তুইও?
আমি খুব সাবধানে রাস্তা মেপে হাঁটিনি কখনো
খালিপায়ে, জুতোপায়ে
ধুলোমাখা পথ ধরে
এলোমেলো হেঁটে গেছি আপন আনন্দে।
যে বাতাসে সীসার গন্ধ
সে বাতাসে আমি হাস্নাহেনার ঘ্রাণ,
যে আকাশের ওজোন স্তরে বিষবৎ ফুটকি
সে আকাশে স্নিগ্ধ মেঘের ছোঁয়া,

আমি জোর দাবীতে বৃষ্টি নামিয়েছি অঝোর ধারায়,
সিক্ত হয়েছি, ভেসে গিয়েছি, ভাসিয়ে নিয়ে গেছি, শুদ্ধ হয়েছি, অশুদ্ধ করেছি,
কখনো হাঁটুজল ভেঙ্গে অন্যের সাজানো বাগানেও ঢুকে পড়েছি।
জেনেশুনে আমি নষ্ট করেছি ফুলের কেয়ারী, ঢিল ছুড়ে অকালপক্ক ফল ঝরিয়েছি
অন্যায় সাগরের বন্যায় ভেসে গেছি অবাধ অগাধ
তবু আমি বিন্দুমাত্র অপরাধবোধ করিনি।
আমি আমার সকল সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করেছিলাম
তোরই জন্য- তোরই জন্য -তোরই জন্য........
তবু একদিন আর সবার মতো তুইও প্রবল ক্ষেদে আঙুল তুলে বললি - তুমি উচ্ছন্নে গেছো!!

আহত হয়েছি, অবাক হইনি।
জানা ছিল, একদিন তাই বলবি।
তবু আমি কেন যেন উচ্ছন্নের পথকেই বেছে নিয়েছিলাম।


ও গানঅলা, এবার এই গানটি গেয়ে শোনাও। নাগরিক কষ্ট বিলাসে আমি বুঁদ হয়ে আবারো তোমার গান শুনি। এবার কেউ পাশে নেই, তবু গানতো রয়েছেই।

Wednesday, December 18, 2013

আশির দশকের চট্টগ্রামের প্রথম বিজয়মেলা

সময়টা কি ১৯৮৮ নাকি ৮৯? ঠিক মনে আসছে না। তবে এই দুটো বছরের যে কোন একটা বছরে চট্টগ্রামে 'বিজয় মেলা' নামক একটা ব্যাপার চালু হয় সার্কিট হাউসের সামনের খোলা মাঠে। ওই মাঠটি তখন শিশুপার্ক হয়নি। সার্কিট হাউস তখনো জিয়া স্মৃতি যাদুঘর হয়নি। খোলা ময়দানটিতে আমার কোন কোন বিকেলে আড্ডা দিতাম। স্টেডিয়ামের উল্টোদিকের এই মাঠে কিছু কাঠের চেয়ার টেবিল বসানো থাকতো দারুল কাবাবের পক্ষ থেকে। স্টেডিয়াম মার্কেটে চট্টগ্রামের একমাত্র কাবাবের দোকান। সেখান থেকে ট্রেতে করে ধোঁয়া ওঠা কাবাব পরোটা নিয়ে আসা হতো সার্কিট হাউসের সামনের ঢালু ময়দানে। আমাদের পকেটে সেই সময়ে কাবাব খাওয়ার পয়সা হয়নি। তাই আড্ডা দিতে দিতে কেবল গন্ধ শুঁকেই অর্ধভোজন সেরে মনে মনে বলতাম, দেখিস একদিন আমরাও।

আমাদের সেই সময়ে বিশ্ববিদ্যালয় পাঠের প্রাথমিক ভাগে, তারুণ্যের সবচেয়ে উজ্জ্বল টগবগে সময়ে বিজয়মেলার সূচনা হয়। আমরা বিনাপয়সায় বিজয়মেলার আয়োজনে খাটতাম। কিন্তু সেই বেগার খাটুনীতেও কি তুমুল আনন্দ ছিল। সারা দেশে সেই প্রথম নতুন ভাবে বিজয়ের মাস উদযাপন করার শুরু হয়েছিল। তখন সারা দেশে স্বৈরাচার এরশাদের বিরুদ্ধে তুমুল আন্দোলন চলছিল। ওই মেলাটি যেন পরিণত হয় স্বৈরাচার আর রাজাকার বিরোধী একটা মঞ্চে। সেই মঞ্চে বাংলাদেশের সকল শীর্ষ বুদ্ধিজীবি রাজনীতিবিদরা আসতেন ঢাকাসহ সারাদেশ থেকে। বিজয়মেলায় মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণের যে অনুষ্ঠান হতো, সেই অনুষ্ঠান দেখার জন্য, সেই স্মৃতিচারণ শোনার জন্য বিশাল সেই মাঠে তিল ধারণের জায়গা থাকতো না। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কি তখন অনেক বেশী উজ্জীবিত ছিল? এখনকার মতো সুশীল সমাজ রাজাকার চেতনার মানুষ তখন আমরা চেরাগ দিয়েও খুঁজেও পেতাম না। আমি জানি না দেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার চেয়ে রাজাকার চেতনার চাষবাসে এতটা বাম্পার ফলন কি করে হলো? সেই আশির দশকের শেষভাগকে, আন্দোলনকে উৎসবে পরিণত করার সবচেয়ে স্মরণীয় কাল বলতে হবে।

মানুষের চেতনাকে সঠিকভাবে ধারণ করতে পেরেছিল বলে সেই বিজয়মেলা অসম্ভব জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। একসময় সেই বিজয়মেলা সারা বাংলাদেশে ছড়িয়ে যায়। বর্তমানে সারাদেশে যত বিজয়মেলা হয় তার আদি জননী চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজের মাঠের সেই প্রথম বিজয়মেলা। আজকে চট্টগ্রামে যারা দায়সারা চেহারার দারিদ্রে জর্জরিত বিজয়মেলা দেখছেন তারা, এমনকি গত দশ বছর ধরেও যারা দেখছেন তারাও কল্পনা করতে পারবেন না সূচনার সেই বিজয়মেলাটার চেহারা কতটা মহিমাময় ছিল, কতটা মুগ্ধকর ছিল। শাহবাগে প্রথম দুই সপ্তাহে যে স্বতঃস্ফূর্ত সৌন্দর্য দেখেছি আমরা, প্রথম কয়েক বছর চট্টগ্রামের বিজয়মেলাটাও সেরকম স্বতঃস্ফূর্ততা আর সৌন্দর্য আর মহিমা নিয়ে ছিল। দলমত নির্বিশেষে স্বৈরাচার বিরোধী চেতনার সব মানুষ জড়ো হতো সেই মাঠে।

তখনো বিজয়মেলার রাজনীতিকরণ করা হয়নি। রাজনীতিবিদরা তখনো কেবল অতিথি। বিজয়মেলা পরিচালনা করতেন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব কিংবা সাধারণ বিশিষ্টজনেরা। প্রথম কয়েকটা বছর সেরকমই চলছিল। কিন্তু আস্তে আস্তে বিজয়মেলা কমিটিতে রাজনীতিবিদদের সংখ্যা বাড়তে থাকে, বাড়তে বাড়তে বিজয়মেলা একসময় পুরোপুরি রাজনীতিবিদের দখলে চলে যায়। দলাদলির এক পর্যায়ে বিএনপি আলাদা বিজয়মেলা করার ঘোষণা দেয়। আউটার স্টেডিয়ামের পাশে তারাও আরেকটা মেলা চালু করে এক বছর। কিন্তু তাতে ব্যর্থ হয় সঙ্গত কারণেই। পরে তারা বিজয়মেলা জিনিসটাকেই নাজায়েজ মনে করতে থাকে হয়তো।

বিএনপি প্রথমবার ক্ষমতায় আসার কিছুদিন পর সার্কিট হাউসকে জিয়া স্মৃতি যাদুঘর বানানো হয়। সামনের মাঠটিতে শিশুপার্ক তৈরী হয়। সবকিছুই বিজয়মেলাকে উৎখাত করার জন্য। কিন্তু বিজয়মেলা জায়গা থেকে উৎখাত হলেও বন্ধ হয়নি। সার্কিট হাউস মাঠ থেকে সরে যায় পাশের আউটার স্টেডিয়ামে। স্মৃতিচারণ মঞ্চ আর মেলা আলাদা হয়ে যায়। আস্তে আস্তে মেলায় ধুলোবালির সাথে নানান উৎপাত যুক্ত হতে থাকে। একসময় বিজয়মেলা তার সাংস্কৃতিক চরিত্রটা হারিয়ে হয়ে গেল যেন তেন একটা মেলা। দায়সারা একটা অনুষ্ঠান মাত্র। যে বিজয়মেলায় সারাদেশ থেকে বিচিত্র সব পণ্যের সমাহার ঘটতো, সেই বিজয়মেলা বাজারী পণ্যের মেলা হয়ে গেল। এখনো বিজয়মেলা হয় প্রতিবছর। কিন্তু এই বিজয়মেলা একটা সাইনবোর্ড মাত্র। বিজয় মাসের কোন আমেজ তাতে নেই, সেই চেহারা, সেই গন্ধ, সেই ভাষা, সেই চরিত্র কিছুই নেই।

আমি ২০১৩ সালের বিজয় দিবসের প্রায় সন্ধিক্ষণে সেই আদি বিজয়মেলাকে খুব বেশী মিস করছি। কারণ ডিসেম্বরের পরাজিত শত্রু জামাত শিবির হায়েনাদের তাণ্ডবে এই বছর বিজয়ের গন্ধ কলুষিত হয়েছে রক্ত আর মাংসপোড়া গন্ধে। আমি আশংকায় আছি মুক্তিযুদ্ধের শক্তি ক্ষমতায় থেকেও যে দুঃসাহসে মাথা তুলেছে এই দানবের শক্তি, রাষ্ট্রক্ষমতায় মুক্তিযুদ্ধের শক্তির অভাবে সেই দানব কতটা লাঞ্ছিত করবে কতটা পদপিষ্ট করবে এই বাংলাদেশকে?

মকবুল সমুদ্রে যাবে (মনিভূষণ ভট্টাচার্য্য)

এই ডিসেম্বরে সবচেয়ে আলোড়িত করলো যে কবিতাটি। আমাদের অনেক অনেক মকবুল দরকার  আজকের এই বাংলাদেশে

------------------------------------------------------------------------------------------

মকবুল সমুদ্রে যাবে

- মনিভূষণ ভট্টাচার্য্য

আবৃত্তি এইখানে শুনতে পাবেন

কায়েদে আজম যখন তেঁজগাও বিমান বন্দর থেকে
হাজার হাজার মানুষের পাঁজর ভেদ করে বিকেলের হঠাৎ
বৃষ্টিতে নষ্ট হয়ে যাওয়া তরুনগুলির তেরচ্ছা
কুর্নিশ নিতে নিতে এগিয়ে যাচ্ছিলেন,
মকবুল তখন নদীর ধারে পলির ভেতরে পা ডুবিয়ে,
গর্তে লোহার শিক ঢুকিয়ে বড় বড় কাকড়া বের করে আনছিল।

আইয়ুবের মার্কিন খাপ থেকে যেদিন ইয়াহিয়া খাঁ মরচে ধরা তলোয়ার বকশিষ পেলেন,
সেদিন মকবুল উঁঠোনে গাবের কষে জাল সিদ্ধ করছিল।
মনে সওয়াস্তি নেই মকবুলের।
বাদলার রাতে যখন দক্ষিণ পশ্চিম থেকে হাওয়া উঠে, তার ঘুম ভেঙ্গে যায়।
বহুদূর থেকে কালাপানি তাকে ডাক দেয়
ভোর হতে না হতেই সে নৌকো ভাসিয়ে চলে যায় দূর দূরান্তে
কোথায় কুতুবদিয়ার চর, মহেশখালি, কক্সেস বাজার,
কোথায় সেই পরান কথার দেশে-
শংখ নদী ফিরাইল মরা গরু জিয়াইল।


আবার সন্ধ্যার আজান আর কাঁসার ঘন্টার রেশ মিলিয়ে যাবার পর
সুপুরি বনের অন্ধকার বেয়ে তার নৌকো ঘাটে ফিরে আসে।
সঙ্গে লাই ভর্তি কোরাল কিংবা লাওক্ষা মাছ।
কর্ণফুলির তীরে দামনা বেড়ার ঘর, পাশে মইঅলুর ক্ষেত
মাঝরাতে হরিণের পাল নেমে আসে, উঠোনে আড়াআড়ি জাল শুকোয়।

তিনটে ছেলেমেয়ে সারা গায়ে আঁশটে গন্ধ জড়িয়ে ছুটোছুটি করে ফড়িং ধরে।
পেছনে বারইয়া গুঁজে উড়িয়ে দিয়ে হাততালি দেয়।
তারপর জাল থেকে খুঁজে খুঁজে শুকনো চুনো মাছ ছাড়িয়ে নেয়
পুড়িয়ে পানিভাতের সঙ্গে খাবে বলে জমিয়ে রাখে।


একগাল ধোঁয়া ছেড়ে হুঁকোর মুখটা মুছে গোবিন্দের দিকে এগিয়ে দিতে দিতে মকবুল বলে
'বুইজ্জোসনি গয়িন নদীরত পেট ভরিব মন ভইরত ন'।
পুবদিকে গুন্ডা হাতীর পালের মত সারি সারি টিলা
বাড়ীর পাশদিয়ে অরন্যের গান গেয়ে যায় পাহাড় ভেঙ্গে বেড়িয়ে আসা কর্ণফুলি
দূরে দক্ষিন পশ্চিম আলিশান ধরিয়া, শাওন ভাদ্র মাসে গভীর রাতে তাকে ডাক দেয়।
মকবুল সেদিক পানে উদাস চোখ মেলে সুতো পাকায়।
তার নজরবন্দি চেলা গোবিন্দের হাতেও সুতোর গুলি
মনে বড় হাওস উস্তাদ তাকেও সঙ্গে নিবে।


রমনার ময়দানে যেদিন বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি হাতে নিয়ে
একের পর এক ঢেউ আছড়ে পড়ে মুজিবের গলায় গর্জন করছিল
সেদিন মকবুল মিয়া রাঙ্গামাটির পাহাড়ে একটা বেজায় ঝুনো শাকওয়ান গাছের গোড়ায়
কুড়ুল চালাচ্ছিল। তার ডিঙি  ছোট্ট- বড় নৌকো চাই।
মকবুল অথই জলে পাড়ি দেবে।
যেখানে রোজ বিয়ানে এবং সাঁজের বেলায় আসমান সোনার শাঁকনি ধুয়ে নেয়
সেই অনন্তকাল জলের মহাদেশ থেকে মাঝে মাঝে খোদার ফরমানের মত কাল তুফান ছুটে আসে।
যেখানে সেয়ানা মানুষদের সমস্ত দুনিয়াদারী খতম হয়ে যায়,
মকবুল সেই গজরানো গজবের দুনিয়ার নৌকা ভাসাবে, আল্লা কসম।


যেদিন চট্টগ্রাম, বরিশাল, রাজশাহী এবং ঢাকার সমস্ত বাড়ির মাথায়
রাতজাগা খলিফার সেলাই করা বাংলার উপর সুর্য্য পতপত করে উড়ছিল
সেদিন মকবুল নিশান উড়ায়নি
সারাদিন করাত চালিয়ে সন্ধ্যের পর রাতের আলোয় ডান হাতের আঙ্গুলের ফাঁকে ফাঁকে
তারপিন তেল ঢলতে ঢলতে বেড়ার গায়ে ভয়ে দুলে উঠা
ছায়ার সামনে সংকুচিত গোবিন্দকে শাসাচ্ছিল-
'ইনছাল্লা তরে যদি কাটি না ফালাই ত আর নাম নাই'।
গোবিন্দ দুপুরে দুটো কাঠের গজাল ভুল জায়গায় পুঁতেছিল।
মানুষের আকাংখা এবং প্রাপ্তির মধ্যে স্বপ্ন এবং সংগঠনের মধ্যে কোথাও একটা মস্ত খন্ড আছে।


জংগম বাংলার গহনসিন্ধু মন্থন করে একদিকে যখন সামরিক বিষ ফেনিয়ে উঠছে,
আর একদিকে লাফিয়ে উঠা বাঘিনীর মত গর্জন করছে রক্তের ঢেউ,
তখন একদিন মকবুল দেখল লোহার মত শক্ত তক্তার এক জায়গায়
যে কাঠের নকশা ফুটে উঠেছিল সেই অংশটা ঘুনে ঝুরঝুরে আর গোল হয়ে খসে গেছে
নৌকো তৈরি শেষ, সমস্ত তক্তাও ফুরিয়ে গেছে, টিন লাগালে নোনা জলে মরচে ধরবে
অন্য কাঠ লাগালে পঁচে যাবে।
কি করে গর্তটা ভরাট করা যায় ভাবতে ভাবতে ভাবতে
নৌকোটাকে কর্ণফুলির ডাংগায় চিত করে ফেলে রেখে
চেঙাট গোবিন্দকে সঙ্গে নিয়ে বিরাট একটা কড়ই গাছের তলায় বসে
গেজিয়ে উঠা দুহাড়ি তালের রস খেয়ে দুজনেই ভোঁ হয়ে পড়ে রইল


এদিকে শহরের নাড়িভুড়ি খেয়ে-ধেয়ে কখন যে সৈন্যরা গাঁয়ে ঢুকে
প্রথমে টুংকু সওদাগরের তারপরে হাজী সাহেবের তারপর ফকীর মিস্ত্রীর
এবং নিরঞ্জন পুরোহিতের বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে,
বেহুঁস মকবুল জানে না।
কেবল দক্ষিনের বাতাসে যখন উড়ে আসা ছনের ছাই চোখে পড়ল
এবং কানে এল বাচ্চাদের আর মেয়েদের বুক ফাটা কান্না
মকবুল চোখ রগড়ে উঠে বসল।
বসা থেকে উঠে দাড়িয়ে লুঙ্গিটাকে ঠিকঠাক করার আগেই
তার বুক বরাবর তিনটে বেটে লোহার নল রৌদ্রে চকচক করে উঠল।


পাকা লাউ বীচির মত দাঁতের ফাঁক দিয়ে থুথু মাখা কয়েকটি শব্দ বেড়িয়ে এল
'শাহালা বাইনচুত-বোট লাগাদে পানি পর'।
ট্রাক যাবার রাস্তা নেই, মুক্তিবাহিনী কেটে দিয়েছে।
নৌকো চেপে অন্য গাঁ গুলিতে ঢুকে বাড়ি জ্বালাবে লুটপাট করবে
আর মেয়েদের ছিঁড়ে খাবে।
পুরুষের বেশিরভাগই পাহাড়ে জংগলে আশ্রয় নিয়েছে।
মকবুল বলতে চাচ্ছিল – নৌকোর তলায় গর্ত
উপরের ছৈ আর পাটাতনের জন্য গর্ত দেখা যাচ্ছে না।
কিন্তু মেয়েদের চিৎকার থেমে গেলেও তখন উত্তর আকাশে ফুলকী
তখন বাতাসে পোড়া গন্ধ।


মকবুল দাঁত বের করে বলল – 'চল চল চল মিয়া, এহুনি দিয়ুম'।
গোবিন্দ কচুপাতার মত কাঁপছিল আর তাড়ির ঘোরে বেকুবের মত
দুটো ড্যাবড্যাবে চোখ মেলে উস্তাদের দিকে তাকিয়ে ছিল।
সৈন্যরা উঠে পড়ার সংগে সংগে মকবুল নৌকো স্রোতে ঠেলে দিয়ে দু'পা পিছু হটে এল
এক চক্কর ঘুরেই নৌকো কর্ণফুলির মাতাল টানে বিদ্যুৎবেগে ছুটে চলল
মকবুল খানিকক্ষন সেইদিকে তাকিয়ে রইল,
তারপর আকাশ ফাটিয়ে সে আচানক চিৎকার করে উঠল –
'আল্লাহ হু-আকবার, ডুবি যা, ডুবি যা, ডুবি যা। বদর বদর ক, গাজী গাজী ক।
হালার পুত হালারা ডুবি যা, ডুবি যা – বাইনচুত ডুবি যা'।
ফেনী নদীর তীর থেকে আরাকান সীমান্ত পর্যন্ত
চন্দ্রনাথ পাহাড় থেকে ধুসর দিগন্ত রেখার মত সন্দ্বীপ
সমস্ত পাহাড়ের ঢেউ আর চা বাগান সমস্ত নদীর জল ক্ষেতখামার আর স্বপ্নের মত
দেবাগ্রী পাহাড় যখন মকবুলের বুক ফাটা চিৎকারে কেঁপে উঠছে


তখন -
ধীরে ধীরে এপাড়া ওপাড়া থেকে কয়েকটা ভাঙ্গাচোরা মানুষ আর একটা রোগা কুকুর
মকবুলের পিছনে এসে দাড়াল।
তাদের চোখের উপর কর্ণফুলির অরাজক টানে কয়েকটা সামরিক টুপি
ঘুরপাক খেতে খেতে চলেছে দক্ষিণ সমুদ্রের দিকে।
মকবুল আবার রাঙামাটির পাহাড়ে যায়, হাতে কুড়োল
পাশে উস্তাদের মায়ায় আছন্ন গোবিন্দ।
মকবুল সমুদ্রে যাবে।

-------------------------------------

পাদটীকা: কবিতাটি  সাউণ্ডক্লাউড থেকে নামিয়ে শুনেছিলাম কয়েকদিন আগে। শোনার পর কেমন নেশা ধরে গেল। কবির নামটা জানতে ইচ্ছে করছিল। কিন্তু কোথাও পেলাম না। এমনকি সাউণ্ডক্লাউডের লিংকটাও হারিয়ে ফেললাম। তখন বন্ধুকে কবিতাটা শুনিয়ে জিজ্ঞেস করলাম কবির নাম খুঁজে বের করতে। বন্ধু আমার হারানো যে কোন কিছু খুঁজে বের করতে ওস্তাদ। সে খুঁজে দিল কবিতাসহ কবির নাম। কবিতাটি আমার ব্লগে টাইপ করেছেন ব্লগার পাভেল চৌধুরী । সেখান থেকে কিছু বানান সংশোধনী সহকারে আমি এখানে সংরক্ষণ করলাম। তবে কবি  মনিভূষণ ভট্টাচার্য্য সম্পর্কে আর কোন তথ্য পেলাম না কোথাও। এই কবি সম্পর্কে আরো জানতে ইচ্ছে করে। এই কবির কবিতা আরো পড়তে ইচ্ছে করে।

Thursday, December 12, 2013

১২ ডিসেম্বর ২০১৩ : আশংকার দিনগুলো

১.
এখন দিনগুলো স্বাভাবিক না। গত দেড় মাস যাবত অস্বাভাবিক রুটিনে দিনযাপন করছি। বিশেষ করে অফিসে আসা আর যাওয়া। অফিস বাসা এই দুই গন্তব্যের বাইরে আর কোথাও যাই না। যাতায়াত ব্যবস্থা দুর্বিসহ হয়ে গেছে হরতাল অবরোধে। আরো দীর্ঘসময় চলতে পারে এরকম অচলাবস্থা। এর চেয়ে আরো খারাপ অবস্থারও আশংকা করা যায়।

আমরা এখনো ভাগ্যবান, বড় কোন ঝামেলায় পড়িনি। কিন্তু যে কেউ যে কোন সময় পড়ে যেতে পারে। বোমা গুলি ভাঙচুর অগ্নিসংযোগ এখনো সরাসরি স্পর্শ করেনি। বাড়ি ফিরতে গিয়ে পথের মাঝে আটকে থাকিনি দুদিন। অনাহারে অর্ধাহারে পথে পথে ঘুরিনি। আমার বাসাটা শহরের ভেতরে। আমার সব স্বজনেরা এখানেই। আমাকে কাজের প্রয়োজনে কিংবা স্বজনের প্রয়োজনে ঢাকা চট্টগ্রাম করতে হচ্ছে না। অথবা ভিন্ন ভিন্ন জেলায়ও ছুটতে হচ্ছে না। যাদের প্রিয়জন ভিন্ন জেলায়, যারা ভিন্ন শহরে চাকরী করছে, তারা কেউ বাড়ি ফিরতে পারছে না নিরাপদে। প্রত্যেকের জীবন অনিরাপদ হয়ে গেছে।

দেশের কিছু আনাচে কানাচে পাকিস্তান আফগানিস্তানের দুর্গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। সেই দুর্গন্ধ বিকট আকার ধারণ করলে এই দেশে বাস করা অসম্ভব হয়ে পড়বে। এই গুমোট অশান্তি কবে কাটবে আমরা এখনো জানি না। দেশটা অশুভ শক্তির ছায়ার নীচে বাস করছে। এখানে সবচেয়ে বড় ভয় হলো কোন কিছু না জেনে, কোন কিছুতে জড়িত না থেকে খামাকা ক্রসফায়ারে পড়ে যাওয়া। বিনা কারণে মৃত্যুবরণ করাটাও বিব্রতকর।

২.
চট্টগ্রামে এখনো শীতের তেমন বাড়াবাড়ি নেই। মোটামুটি স্নিগ্ধ রোদ্রোজ্জল আবহাওয়া বলা যায়। পৌষের পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে। আর দুদিন বাদেই। আজ অঘ্রানের ২৮ তারিখ। বাংলাদেশে শীত পড়ে এক মাস এবং সেটা পৌষেই। পৌষ এলেই পিঠাপার্বন। পৌষ এলেই শীতের চুড়ান্ত অভিষেক। পৌষে আমার প্রিয় কুয়াশা চাদর। গত পৌষে ঢাকায় গিয়ে চরম শীতের কাঁপুনিতে সপরিবার ঠকঠক করেছিলাম ঢাকা চিড়িয়াখানার সবুজ বনানীতে। তবু এত সুন্দর, এত ভালো লাগা ছিল ওশিন শিহানকে নিয়ে প্রথম এক বনভোজনে। এবার আর সেরকম দিন কাটাবার সুযোগ হচ্ছে না।

৩.
কিছু কিছু অপ্রকাশিতব্য ঝামেলা মাঝে মাঝেই ঘোট পাকায়। আজও ছিল। এরকম ব্যাপারগুলো কাজের গতি ব্যহত করে, মনযোগ নষ্ট করে, অথচ আর কারো কাছে উল্লেখযোগ্য নয়। দার্শনিক হলে সুবিধা হতো। দার্শনিকেরা এরকম ব্যাপারগুলোকে কোন না কোন ছকে ফেলে তাতেই একটা ফরমূলা আবিষ্কার করে বসে। মানুষ একটা জটিল প্রাণী। তাই মানুষকে কেউ পুষতে পারে না। বরং মানুষই অন্য প্রাণীকে পোষে, সে হাতি হোক বা রয়েল বেঙ্গল টাইগার হোক।

৪.
স্মার্টনেস কাকে বলে? চকচকে নতুন জামাকাপড় পরাকে স্মার্টনেস বলে নাকি খুব চোস্ত ভাষায় আর্ট সহকারে বক্তৃতা করাকে স্মার্টনেস বলে?  কেউ কেউ পোষাকে বা কথাবার্তায় স্মার্ট হয় বটে। কিন্তু সবাইকে চকচকে জামাকাপড়ে মানায় না, সবাই চোস্ত ভাষায় গুছিয়ে কথা বলতে পারে না। আমার পোষাকও চকচকে না, ভাষাও চোস্ত না। তাই আমার মতে নিজের যা আছে তাকে মেনে নিয়ে সন্তুষ্ট থাকার নামই স্মার্টনেস। এটা কি সুবিধাবাদী সংজ্ঞা হয়ে যায় নাকি?

বাংলাদেশের দানবাধিকার ত্রাতা জাতিসংঘ?


মাসুদা ভাট্টির চমৎকার একটা লেখা পড়লাম আজ বাংলানিউজ২৪ডটকমে

মানবের বিরুদ্ধে দানবের যুদ্ধ চলছে বাংলাদেশে

মাসুদা ভাট্টি, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর
বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম



বিএনপি
'র ভাইস-চেয়ারম্যান শমসের মোবিন চৌধুরী ঠিকই বলেছেন, দেশে যুদ্ধাবস্থাই চলছে। একে যদি যুদ্ধাবস্থা না বলি তাহলে আর কাকে বলা যাবে? কিন্তু এ যুদ্ধ কার বিরুদ্ধে কে করছে?

এরকম প্রশ্ন নিয়ে যদি আজকের তরুণ প্রজন্মের সামনে দাঁড়াই তাহলে তারা নিঃসন্দেহে বলবে যে, এ যুদ্ধ মানবের বিরুদ্ধে দানবের; শুভ
'র বিরুদ্ধে অশুভ'র। দুঃখজনক সত্যি হলো, এদেশের একদল অশুভাকাঙ্ক্ষীর সঙ্গে বিদেশের একদল "লোভাতুর" ব্যক্তি মানবাধিকারের দোহাই দিয়ে দানবাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য আজ আদা-জল খেয়ে লেগেছে।

আইনি প্রক্রিয়া নিয়ে কথা বলা উচিত নয় এবং তা দেশের প্রচলিত আইনি ব্যবস্থাকে প্রশ্নেরই সম্মুখীন করে মাত্র। কিন্তু এ প্রশ্ন তো আজ তোলা প্রয়োজন যে, যুদ্ধাপরাধের দায়ে ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত কাদের মোল্লার ফাঁসি যেভাবে গতকাল (১০ ডিসেম্বর, ২০১৩) রাতে বন্ধ করা হলো, কোনো উন্নত গণতান্ত্রিক দেশেও এ ধরনের নজির পাওয়া যাবে না। আমরা এতোদিন শুনে আসছিলাম যে, এ দেশে আইনের শাসন নেই, যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রক্রিয়ায় আন্তর্জাতিক মান অনুসরণ করা হচ্ছে না। কিন্তু কালকে যে কাজটি আদালত প্রাঙ্গণ থেকে জেলখানা পর্যন্ত ঘটলো তাকে আমরা কোন্ মানদণ্ডে বিচার করবো? এরপরও কি আমাদের শুনতে হবে যে, বিচার প্রক্রিয়া আন্তর্জাতিক মানের হয়নি?

এতোটা দ্রুততার সঙ্গে যেদেশে একজন রাষ্ট্র-বিরোধী দণ্ডপ্রাপ্ত আসামির ফাঁসির রায় স্থগিত করা যায় সেদেশে আইনের শাসন আছে, সেকথা কি পাগলেও বিশ্বাস করবে? না করা উচিত? কিন্তু এদেশ সব সম্ভবের দেশ।

এদেশে ফাঁসির আসামিকে বাঁচানোর জন্য দেশব্যাপী চরম সহিংসতার ঘটনা ঘটে। গণ-পরিবহনে আগুন দিয়ে মানুষ পুড়িয়ে মারা হয়। রেললাইন উপড়ে ফেলে হাজারে হাজারে যাত্রীর জীবননাশের চেষ্টা চলে। মিডিয়াকে ব্যবহার করা হয় যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচানোর জন্য মিথ্যাচারের কাজে। তারপরও এদেশে মানবাধিকার লংঘিত হচ্ছে বলে বিশ্বের বড় বড় মানবাধিকারবাদীরা প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি লেখেন।

আমরা জানি যে, জাতিসংঘ থেকে প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি দিয়ে অনুরোধ জানানো হয়েছে কাদের মোল্লার ফাঁসি স্থগিত করার জন্য
আমরা সত্যিকার জাতিসংঘের কথা বলছি কিন্তু! যারা সাদ্দাম হোসেনের ফাঁসি কার্যকর করার সময় সেদেশের প্রচলিত আইনের প্রতি শ্রদ্ধা দেখিয়ে চুপ করে ছিল। আমরা সেই জাতিসংঘের কথা বলছি যারা ওসামা বিন লাদেনকে হত্যা-দৃশ্য সুদূর মার্কিন মুলুকে বসে সরাসরি সম্প্রচার-কাণ্ডে কোনো কথা বলেনি। এ জাতিসংঘ সেই জাতিসংঘ যারা ১৯৭১ সালে এদেশে যখন মুক্তিযুদ্ধ চলছিলো, চলছিলো হলোকাস্টের চেয়েও ভয়ঙ্কর ঘটনা তখন চুপ করে না থেকে পাকিস্তানকে অনৈতিক সুযোগ-সুবিধা করে দিয়েছিল গণহত্যা চালিয়ে যেতে।

শুধু জাতিসংঘ নয়, ব্রিটেন এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নও কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে দেয়া ফাঁসির রায়কে মানবাধিকার লংঘন বলে অভিহিত করে এ রায় যাতে কার্যকর করা না হয় তার অনুরোধ জানিয়েছে। বাহ্ চমৎকার!! ২০১১ সালে সৌদি আরবে ৮ বাংলাদেশির শিরশ্ছেদ করা হয় একজন মিশরীয়কে হত্যার জন্য। কিন্তু পরে প্রমাণিত হয় যে, তারা নির্দোষ ছিলো। কিন্তু এ নিয়ে কোনো শব্দ আমরা শুনিনি পশ্চিমাদের দিক থেকে। বাদ দিই বাংলাদেশীদের কথা, তারা তো মিসকিন গোত্রের।

২০১২ সালে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল পরিচালিত গবেষণায় দেখা গেছে সবচেয়ে বেশি ফাঁসি/মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয় চীনে। তালিকায় ক্রমানুসারে চীনের পরেই রয়েছে ইরান, ইরাক, সৌদি আরব, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইয়েমেন, সুদান, আফগানিস্তান, গাম্বিয়া এবং জাপান। সংখ্যানুসারে ফাঁসি/মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার সংখ্যা চীনে ২০১২ সালে এক হাজারের ওপরে, ইরানে ৩১৪, জাপানে ৭ এবং এর মধ্যবর্তী দেশগুলির প্রত্যেকটিতেই দশটিরও অধিক; যুক্তরাষ্ট্রে ৪৩ জন। এবার বলুন মহাশয়, এতো এতো ফাঁসির ঘটনার কোথায় আপনাদের
"মহান বিবেক" কেঁদেছিল? কোথায় আপনারা চিঠি দিয়ে ফাঁসির রায় স্থগিত করার অনুরোধ জানিয়েছিলেন? আমরা এ বিষয়ে কিছু জানি না, ব্যাপারটা খোলাসা করলে খুশি হই খুউব!!!

১৯৭১ নিয়ে আপনারা উচ্ছ্বসিত না হোন, তাতে আপনাদের দোষ দেবো না। কারণ, ১৯৭১ সালে বাঙালি যা অর্জন করেছিল তা আপনারা অনেকেই চান নি। চাইবেন কেন? পৃথিবীর কোনো দেশেই জনগণের প্রাণের দাবির প্রতি আপনাদের সমর্থন থাকার কথা নয়, নেইও। কারণ তাতে, আপনাদের নিজেদেরই অনেকেরই পশ্চাদ্দেশ উদোম হয়ে যাওয়ার ভয় থাকে। আমরা সে ভয়ের কারণটা বুঝি। বুঝি বলেই কিন্তু আপনারা যখন ইরাক আক্রমণ করেন, আমরা কথা বলি না।

চুপ করে থাকি, আর ভাবি যে, বড় ভাইয়ের সিদ্ধান্ত, আমরা ছোট মানুষ চুপ করে থাকাটাই নিরাপদ। আমাদের মতো ছোটরা কেউ যদিবা মুখ খোলে তার ওপর আপনাদের
"স্যাংকসনের" খড়্গ নেমে আসতে সময় নেয় না।

তাই ভয়ও পাই খুউব। কিন্তু ১৯৭১ যেহেতু বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসে একমাত্র বড় অর্জন সেহেতু এ নিয়ে বাঙালির উচ্ছ্বাসকে আপনারা থামিয়ে দিতে চেয়েছেন ১৯৭৫ সালেই। আমরা সে-ও সহ্য করে এগিয়ে এসেছি। আবার আজকে যখন ১৯৭১ সালের অপরাধীদের বিচার করছি আপনাদেরই দেখানো আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে (নুরেমবার্গ ট্রায়ালসহ অন্যান্য দেশে গণহত্যার বিরুদ্ধে বসানো স্বীকৃত কমিশন অনুসরণে) তখন আপনারা বলছেন, বিচার আন্তর্জাতিক মানের হয়নি।

আপনারা ধূয়া তুলছেন মানবাধিকারের। কিন্তু মশাই, ১৯৭১ সালে ওরা তো মানবের মতো কাজ করেনি, কাজ করেছে দানবের মতো। আপনারা ওদের জন্য
'মানবাধিকার' শব্দটি খরচ না করে 'দানবাধিকার' শব্দটি প্রয়োগ করলে যথার্থ হতো বলে আমরা মনে করি। মানবে আর দানবে যে বিশাল পার্থক্য রযেছে সেটি আপনাদেরকে বুঝতে হবে। আপনারা বুঝবেন না জানি, কারণ, আপনাদের কাছে পৌঁছেছে দানবের বাণী, মানবের বাণী আপনাদের কানে কখনও পৌঁছেনি, পৌঁছবেও না কোনোদিন।

আজকে বাংলাদেশের দিকে তাকান। কী দেখতে পান? দেশটা জ্বলছে। আপনাদের কি ধারণা? এ কেবল রাজনীতির কারণে? দু
'টি রাজনৈতিক দল ঐকমত্যে পৌঁছতে পারছে না, সেজন্য? একটুও না। যারা এরকমটি মনে করেন, তারা হয় অতি সরল, নয় অতি চালাকসরল বলছি এ কারণে যে, তারা শুধু ওপরে ওপরে দু'টি পক্ষের রাজনৈতিক কোন্দল দেখতে পাচ্ছেন। তারা ভুলে গিয়েছেন যে, বাংলাদেশে রাজনৈতিক কোন্দল অতীতেও হয়েছে কিন্তু এরকম সহিংসতা, এতো অগ্নুৎসব কখনও হয়নি। প্রাণহানিও হয়নি এমন।

তারা সরল বলে সেসব বিচারের পক্ষপাতি নয়। আরা যারা চালাক তারাতো এসবই চাইছেন, যাতে এই আগুনে তারা ক্ষমতার ছোলা পুড়িয়ে খেতে পারেন। জাতিসংঘ, ব্রিটেন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন--- আপনারা তো সকলেই বিবেকবান, সকলেই বুদ্ধিমান আর মানবতাবাদী। একটু মানবিকভাবে বিষয়টা ভেবে দেখুন তো! এই সেদিনও যারা এদেশকে আফগানিস্তান বানানোর হুমকি দিয়েছে, এদেশের সৃষ্টিশীল মানুষদের কুপিয়ে রক্তাক্ত করেছে, সারাদেশে বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে এদেশকে একটি ধর্মভিত্তিক উগ্রবাদী রাষ্ট্রে পরিণত করতে চেয়েছে আজকে তাদের জন্য আপনাদের মানবতাবাদী বিবেকের দরদ উথলে উঠেছে।

আপনারা তো গণতন্ত্রবাদী, সংখ্যাগরিষ্ঠের রায়কে মেনে নেন। আপনারা নিশ্চয়ই মানবেন যে, ২০০৮ সালে এদের বিপক্ষেই একটি রাজনৈতিক দলকে দুই-তৃতীয়াংশেরও বেশি সংখ্যাগরিষ্ঠতা দিয়ে ক্ষমতায় পাঠিয়েছিল এদেশের জনগণ। আপনারা নিশ্চয়ই একথাও মানবেন যে, তারা তাদের নির্বাচনীয় ইশতাহারেও ১৯৭১ সালের মানবতা-বিরোধী অপরাধীদের বিচারের প্রতিশ্রুতি জনগণকে দিয়েছিল।

এখন যখন জনগণকে দেয়া প্রতিশ্রুতি তারা রক্ষা করতে চাইছে তখন কেন আপনাদের বিবেকের দংশন (?) হচ্ছে, জানতে পারি কি? জানি, এ উত্তর অজ্ঞাত, আপনাদেরও হয়তো জানা নেই।

কোন্ সে যাদু আপনাদের মানবাধিকারবোধকে জাগ্রত করছে তা আপনারাই ভালো বলতে পারবেন, আমাদের তা না জানলেও চলবে।

তবে, একটা কথা। একটু আগেই বলেছি, এদেশে এখন চলছে যুদ্ধাবস্থা। দুই বিবদমান রাজনৈতিক দলের একপক্ষের ভাইস চেয়ারম্যানই আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকার দিয়ে সেটি স্বীকার করেছেন। তিনি আপনাদেরই উদাহরণ টেনেছেন, বলেছেন, আফগানিস্তান এবং ইরাকের কথা।

এবং এটাই বলতে চেয়েছেন যে, ওখানে যদি মানবাধিকার লংঘন না হয়ে থাকে, আপনারা দোষ না করে থাকেন তাহলে এদেশেও তারা এই হত্যা, ধ্বংস আর মিথ্যাচার চালিয়ে অন্যায় কিছু করছেন না। এবার বুঝুন তবে, আপনারা কিন্তু সবদিক দিয়েই ব্যবহৃত হচ্ছেন:

 এক. আপনাদের দিয়ে বলানো হচ্ছে যে, এদেশে মানবাধিকার লংঘিত হচ্ছে; দুই. আবার আপনাদের মানবাধিকার লংঘনের ঘটনাই উদাহরণ হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। এতে ক্ষতিটা কিন্তু আপনাদেরই হচ্ছে। পৃথিবীটা তো গোল, একা পশ্চিমও চলতে পারে না, পুবও পারবে না। তাই আপনারা পুবকে এভাবে আহত করে ছেড়ে দিলে আপনারা এক সময় বিচ্ছিন্ন হবেন, সন্দেহ নেই। আপনাদের গবেষকরাই কিন্তু বলছে,
"পুব জাগছে"
(ইস্ট ইজ রাইজিং)। এখন প্রশ্ন হলো, এই জাগন-প্রক্রিয়ায় আপনারা কোন্ পক্ষে থাকবেন? মানবের নাকি দানবের? আপনারা দয়া করে জানার চেষ্টা করুন, এদেশে সত্যিই এখন মানব আর দানবে যুদ্ধ চলছে।

দানবের হাতে আক্রান্ত মানব, মানবতা এবং সভ্যতা। এরা এই দেশকে ফিরিয়ে নিতে চাইছে মধ্যযুগে।

আফগানিস্তানে যেমন পারেননি তাদেরকে সভ্যতায় ধরে রাখতে, এদেশেও যদি ওরা জয়ী হয়, এখানেও তাদের সভ্যতায় ধরে রাখতে পারবেন না। তাই হয় আপনারা মানবের পক্ষে দাঁড়ান, না হয়, এদেশের মানুষের ন্যায় যুদ্ধ এদের নিজেদেরকেই করতে দিন। জয়-পরাজয় পরে দেখা যাবে। অন্ততঃ দানবের পক্ষে গলাবাজি করে আপনারা দুর্নামের ভাগিদার হবেন না। দোহাই আপনাদের।


--------------------------------------------------------------------------------------------------

মন্তব্য:মানবাধিকার সংস্থাগুলো আজকাল বাংলাদেশে ঢুকে দানবাধিকার রক্ষা সংস্থায় বিবর্তিত হচ্ছে।

Wednesday, December 11, 2013

১১ ডিসেম্বর ২০১৩ : এই বিজয়ের মাসে

এই ডিসেম্বরে বাংলাদেশের আকাশে শকুনের আনাগোনা। এই বিজয়ের মাসে হায়েনাদের বিষদাঁত সক্রিয়। এই ডিসেম্বরে স্বাধীনতার পতাকা খামচে ধরছে পুরোনো শকুন। বাংলাদেশ বেঁচে থাকুক নতুন পুরোনো সকল শকুনের উপদ্রপ থেকে। বিজয়ের ৪২ বছরপূর্তিতে বাংলাদেশ যেন হয়ে না ওঠো পরাজিত শত্রুদের অভয়ারণ্য। মানুষের দেশ মানুষের হাতেই নিরাপদ থাকুক।

Saturday, December 7, 2013

বই পড়া, বই কেনা

একসময় আমার প্রিয় জায়গা ছিল চট্টগ্রামের পাবলিক লাইব্রেরী। আশি নব্বই দশকের ছাত্রজীবনের অনেকগুলো দুপুর কেটেছে লাইব্রেরীতে। শুনে মনে হতে পারে খুব ভালো ছাত্র ছিলাম। আসলে একেবারেই উল্টো। আমার একাডেমিক বইয়ের একটা পাতাও কোনদিন আমি উল্টাইনি লাইব্রেরীতে। ওখানে যেতাম শুধু আনন্দ পাঠের জন্য, আউট বইয়ের খোঁজে, যে বইগুলোতে পৃথিবীর আলো হাওয়া ভেসে বেড়ায় সেই বইয়ের সমুদ্রে স্নান করার জন্য যেতাম। বেহুদা ক্লাসের বই পড়ে কে সময় নষ্ট করে।

বিনাপয়সায় অকাজের বই পড়ার জন্য আমার পছন্দের জায়গা ছিল তিনটা।
১) চট্টগ্রাম পাবলিক লাইব্রেরী(তখন এটা ছিল মুসলিম হলের ভেতরে, পরে নতুন ভবনে আসে),

২) চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরী(এটা ছিল তখন আর্টসফ্যাকাল্টির সামনের এডমিন বিল্ডিং এ,
বর্তমান অবস্থায় এসেছে নব্বই সালের পরে পাহাড়ের পাদদেশে),

৩) বৃটিশ কাউন্সিল লাইব্রেরী (তখন এটা ছিল লালদিঘির দক্ষিণ পাড়ে)।

একটা সময় আবিষ্কার করি লালদীঘির পাড়ে বৃটিশ কাউন্সিলের উপর তলায় আরেকটা লাইব্রেরী আছে, যার নাম মিউনিসিপ্যাল পাবলিক লাইব্রেরী। অনেকে এটার খোঁজ জানে না। এই লাইব্রেরীতে উপনিবেশ আমলের বই পত্রিকাও দেখেছিলাম। এটা চতুর্থ নাম্বার হতে গিয়েও হয়নি, কারণ এই লাইব্রেরীতে নিয়মিত যাতায়াত ছিল না।

এই লাইব্রেরীগুলোতে বই পড়া, বই খোঁজা ইত্যাদি খুব সহজ ছিল। সহজ মানে হাতের নাগালে থাকতো বইয়ের তাকগুলো। নিজে পছন্দ করে বই নিতে পারতাম। সব লাইব্রেরীতে এই সুবিধা থাকে না। ঢাকা গেলে আমি ঘুরঘুর করতাম পাবলিক লাইব্রেরীর আশেপাশে। ঢুকতে সাহস হতো না। একদিন সাহস করে ঢুকে গেলাম। কিন্তু ওখানে দেখি কঠোর নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থা। আমার ভালো লাগলো না।  ওখানে দুয়েকবার গিয়ে বিরক্ত হয়ে এসেছি। কয়েক বছর পর চট্টগ্রাম পাবলিক লাইব্রেরী বাদে চট্টগ্রামের বাকীগুলোতেও ঢাকার সিস্টেমে বই পড়া চালু হয়। তখন থেকে আমি লাইব্রেরীতে যাতায়াত বন্ধ করে দেই। গত দুই দশক আমি আর লাইব্রেরীতে যাই না। চট্টগ্রাম পাবলিক লাইব্রেরী এখন কি অবস্থায় আছে জানি না। ইচ্ছে করলেও সময় মেলাতে পারি না। ওরা যখন খোলে আমি তখন অফিসে, আমি যখন বের হই অফিস থেকে ওরা তখন বন্ধ করে চলে যায়।

ছেলেবেলায় বই কেনার জন্য প্রিয় জায়গা ছিল নিউমার্কেটের দোতলার বইঘর। এটা বন্ধ হয়ে যায় আমি বড় হতে হতে। যদ্দুর মনে পড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে শুরু করার পরও ছিল দোকানটা। বেশ কিছু দুর্লভ বই কিনেছিলাম শেষবারে। তারপর একদিন দেখি বইঘরে তালা। তারও কিছুদিন পর দেখি এটা স্বর্নের দোকান হয়ে গেছে। আমার বুক থেকে নিঃশব্দে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে গিয়েছিল। বইঘর আমার কাছে কেবল একটা দোকান ছিল না। আমার শৈশবে এই্ দোকানের মাধ্যমেই আমি বই পড়তে ভালোবেসেছিলাম। আমি ক্লাস থ্রিতে পড়ার সময় বাবা আমাকে নিয়ে এই দোকানে গিয়েছিল। সেই শৈশবেই ভালোবেসে ফেলেছিলাম দোকানটাকে। ওই স্মৃতিটা এখনো তরতাজা। ওই স্মৃতিকে আমি এখনো প্রবলভাবে ভালোবাসি।

বইঘর হারিয়ে ঝুঁকে পড়ি কারেণ্ট বুক সেন্টার, মনীষা, অমর বইঘর ইত্যাদির দিকে। এক তলায় লাইসিয়াম নামে একটা দোকান ছিল, সেখানেও বিস্তর বই ছিল। দামী দামী বই থাকতো লাইসিয়ামে। কেনার সাধ্য ছিল না আমার। তবু হাতে নিয়ে নেড়ে চেড়ে দেখতে এত ভালো লাগতো! কারেন্ট বুক সেন্টারেও সব দামী বই ছিল, কিন্তু তাদের পেছনে গুদামে বেশ কিছু পুরোনো এডিশনের বই থাকতো। সেখান থেকে সস্তায় বেশ কিছু বই কিনেছিলাম। বইঘরের পর কারেন্ট বুক সেন্টারের কাছে আমার ঋন। একসময় অমর বইঘরের খোঁজ পেয়ে যাই। সেই প্রথম পুরোনো বইয়ের সাম্রাজ্যে  ঢুকে পড়ি। অনেক বছর বুঁদ হয়ে ছিলাম সেখানে। নিউমার্কেটের মণীষা প্রিয় ছিল রাশিয়ান বইগুলোর জন্য। আমার রাশিয়ান কালেকশানের অনেকটাই ওখান থেকে নেয়া। আন্দরকিল্লার কথাকলির কথাও উল্লেখ করতে হয়। এটাও ছিল খান্দানী বইয়ের দোকান। দাম ধরাছোয়ার বাইরে। তবু বইয়ের ঘ্রাণ নিতে স্পর্শ পেতে, সস্তা এডিশনের কোন বইয়ের খোঁজে ঘুরে বেড়াতাম এই দোকানগুলোতে। বইয়ের একটা মজা ছিল গায়ের দামে কেনা যেত। আমি পাকিস্তান আমলে প্রকাশিত ৫ টাকা দামের মোটা একটা বই বিশ বছর পরেও একই দামে কিনেছি কারেন্ট বুক সেন্টার থেকে।

কারেন্ট বুক সেন্টারে আজকাল যাওয়া হয় না। যাওয়া হয় না অমর বইঘরেও। মণীষা তো নেই। বইকেনার যাতায়াত এখন বাতিঘর, বিশদ বাঙলায় সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে। অবাক লাগে শহরে জনসংখ্যা যানবাহন হাটবাজার শপিং সেন্টার বেড়েছে অগণিত, কিন্তু বই কেনার জায়গা বেড়েছে মাত্র তিন চারটে। যতটা বেড়েছে তার চেয়ে বন্ধ হয়ে যাওয়া দোকানের সংখ্যা বেশী। কারেণ্ট বুক সেন্টারকে চারপাশের ফুটপাত হকার যেভাবে গ্রাস করে রেখেছে ওটার নিঃশ্বাস নেবার জায়গাটুকুই কেবল আছে এখন।

আমি বইকেনার দিনগুলোর কথা ভেবে বিষন্নবোধ করি। তখন যদি আরেকটু স্বচ্ছলতা থাকতো, আরো কিছু বেশী বই কিনতে পারতাম, আরো কিছু বেশী পড়তে পারতাম। এখন সামর্থ্য আছে সময় নেই। মানুষের গোটা জীবনটাই এরকম নানাবিধ বৈপরীত্যে কেটে যায়।

Thursday, December 5, 2013

সামান্য ক্ষতি - ২০১৩!

ভয়ানক দুঃসময় অতিক্রম করছে অনেক মানুষ। অনেক না কিছু মানুষ? বেশীরভাগ মানুষ কি ভালো আছে? আমি কি ভালো আছি? আমি ভালো থাকলেই 'কিছু' মানুষের দুঃখ গায়ে কাঁটা দেয় না? এখন কিসের দুঃসময়? কতটা দুঃসময়? এক বন্ধু বললো এখনো তেমন দুঃসময় ঠিকভাবে এসে উপস্থিত হয়নি। এখনো দেখার অনেক বাকী। অনেক অন্ধকার এখনো বিষদাঁত লুকিয়ে আড়ালে অপেক্ষা করছে। সেই দাঁতাল অন্ধকার এসে উপস্থিত হলে এই যে লেখাটা টাইপ করছি, সেটাও কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। এই যে প্রাত্যাহিক ইন্টারনেট বিচরণ সেখানেও পড়বে করাল থাবা। তখন কেবল অন্ধকারেরই প্রবল রাজত্ব থাকবে।

তবু............এটা............বিচ্ছিন্ন............ একটা..........লেখা। এটার সাথে বাস্তবের কোন সম্পর্ক না থাকলেই ভালো হতো।


                            (... ... ... . .... .... ....  ... ... ...)
                              ______শূন্যতা_____

এটা কি?

এটা একটা দায়সারা শূন্যতা। এই যে বন্ধনীর ভেতর দেড় ইঞ্চির শূন্যস্থান - সেখানে আসলে কয়েক হাজার বা লক্ষ পৃষ্ঠা। একেকটা মানুষের সর্বনাশের ইতিহাস, সর্বনাশের বেদনার কথা কয়েক হাজার পৃষ্টা হবে যা লেখার সাধ্য আমার নেই। আমি প্রতিদিন পত্রিকার পাতা খুলে সংবাদ পাঠ করতে সাহস পাই না। শুধু হেডলাইন আর থেতলানো ঝলসানো শরীরগুলোর দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে নেবার পর আমার বুকের ভেতরে ক্রোধ আর বেদনা পরস্পরের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয় তখন আমার ইচ্ছে করে একটা নিউট্রন প্রোটন বা হাইড্রোজেন বোমায় পৃথিবীটা ধ্বংস করে দেই। কিন্তু কিছু করা হয় না। অতঃপর অক্ষমতার আগ্রাসনে এক টুকরো শূন্যস্থানে আমি লুকিয়ে থাকি। এ আমার দায়সারা শূন্যতা। 

আমার কি দায়? সে তুমি বুঝবে না। কারণ তোমার প্রিয়তম সন্তান এখনো পোড়েনি। তোমার বটবৃক্ষ বাবা এখনো বোমার আঘাতে থেতলে যায়নি। তোমার আদরের ভাই/বোনটা এখনো নিরাপদে বাড়ি ফিরে আসছে, এমনকি তোমার প্রিয় বন্ধুটি বলতে পারছে, চল আজ 'রোদেলা বিকেলে' বসে একটা আড্ডা দেই। তোমার কাছে এই সর্বনাশগুলো তৃতীয় কোন পক্ষের ঘটনা, কেবলই একটা খবরের হেডলাইন কিংবা নেহায়েত ২০ ফন্টের একটা ব্লগ টাইটেল।

অথচ কি জানো, কুড়িয়ে পাওয়া ককটেল বিস্ফোরিত হয়ে হাতের পাঁচটি আঙুল হারালো যে সাড়ে তিন বছরের শিশু লিমা -তার জন্য, তার অসহায় বাবা মায়ের জন্যও লেখা যাবে কয়েকশো পৃষ্ঠা।  আর গত এক মাসে দেশের সর্বনাশ হওয়া মানুষের কথার যোগফল লেখার মতো কাগজ সমগ্র বাংলাদেশেই নেই।

তাদের সবার জন্য ওই শূন্যস্থানটি। ওই শূন্যস্থানেই আমার শোকগাঁথা। বাংলাদেশে মানুষের জীবন এখন ঢাকা শহরের সীসা মিশ্রিত দুষিত বাতাসের চেয়েও সস্তা হয়ে গেছে। দাঁতাল শুয়োরের (শমসেরের) বাচ্চারা তবু বলছে এরকম পরিস্থিতিতে এটাই স্বাভাবিক। এই দেশ আফগানিস্তান হয়ে গেছে? ইরাক হয়ে গেছে? পাকিস্তান হয়ে গেছে? এই মৃত্যু, এই জীবন্ত দাহ্য শরীরগুলো সব স্বাভাবিক হয়ে গেছে শমসেরের বাচ্চাদের কাছে। তাদের চোখে স্বপ্নের সর্বনাশ গদিয়ান হয়ে মসনদী জয়গান গাইছে। তবু ওই বানচোত হয়তো একদিন গোলাপী ওড়নায় চড়ে দেশ বিদেশে বাংলার পতাকা নিয়ে দেশবিদেশে পররাষ্ট্র সেবা করবে। গ্রেনেড বোমা গুলি পেট্রোল বারুদের গন্ধ এড়িয়ে বেঁচে থাকলে আমার দুর্ভাগা চোখও কি তা দাঁতে দাঁত পিষে সহ্য করে নেবে?

এখানে যাদের সর্বনাশ হয়ে গেছে তাদের আর উপায় নেই। যাদের হয়নি তারা যে কোন সময় আশংকার করছে সর্বনাশের। যারা কোন রাজনীতি করে না, যাদের সাথে রাজনীতির কোন প্রেম বিদ্বেষের সম্পর্ক নেই, যারা কেবল নিজের কাজ করে, কাজ সেরে বাজারে যায়, শাক  ডাল সবজি কিনে বাড়ি ফিরে, রান্না করে গরম তুলতুলে ভাত খায়, খাওয়া শেষে শক্ত বিছানায় তৈলাক্ত বালিশে মাথা রেখে ঘুমায়, জগতের আর কোন ত্রিবিধ ব্যাপারে যারা কখনো মাথা ঘামায় না, রাজনীতির দুষ্টচক্র তাদেরকেও রেহাই দিচ্ছে না। কামড়ে ধরছে তাদের ঘাড়, কাঁধ, নাক মুখ চোখ। যে নির্বিবাদী মানুষটা কাজ করে বাড়ি ফিরছে তার সর্বনাশ করছে রাজনীতি, যে কর্মক্লান্ত মানুষ বাজারে গিয়ে পরিবারের জন্য পঞ্চাশ টাকার আলু ডাল কিনে আনছে তাদেরও সর্বনাশ করছে রাজনীতি, যারা কোথাও কোন পক্ষ নয়, কারো বাদ বিবাদ যোগ বিয়োগে নেই, রাজনীতি তাদেরকেও সুস্থ জীবন ধারণে বাধা দিচ্ছে। গুলি বোমা বারুদের ভাষায় ডেকে ডেকে বলছে, এই দেখ আমরা শুয়োরের বাচ্চারা এই দেশে আছি, এই দেশে বাস করেও এই দেশ জ্বালিয়ে দিচ্ছি। আমাদের লোহার নল দিয়ে গুলি ফুটাই, তোর বুক পেট মুণ্ডু ফুটা করি, কি করতে পারিস তুই?

এই ভূখণ্ডে বসবাস করাটাই অপরাধের পর্যায়ে পড়ে যাচ্ছে।

কেউ কেউ বলছে, এখানে আর থাকা যাবে না, এদেশ বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। এখান থেকে পালিয়ে যাও। কিন্তু নিজের দেশ ছেড়ে, নিজের জন্মভূমি ছেড়ে, নিজের আত্মীয় পরিজন ছেড়ে কোথায় পালাবে মানুষ? সবার পালিয়ে যাবার সামর্থ্য নেই। অনেকের সামর্থ্য থাকলেও পালাবে না। পালাতে পারবে না। পালিয়ে কোন সমাধান হবার নয়।

তাহলে কি মরে যাওয়াই সমাধান? এখনো যথেষ্ট মরেনি মানুষ? এখনো লাশের টার্গেট পুরণ হয়নি? এখনো কবরে জায়গা খালি রয়ে গেছে? নিঃশেষে প্রাণ এখনো করিতে পারো দান?

হায় রবীন্দ্রনাথ, তুমি শত বছর আগেই বুঝেছিলে অপরিণামদর্শী বাঙালীর মন। শতবর্ষ পেরিয়েও তাই তোমার কবিতা প্রাসঙ্গিক থেকে যায়-

বহে মাঘমাসে শীতের বাতাস,
          স্বচ্ছসলিলা বরুণা।
পুরী হতে দূরে গ্রামে নির্জনে
শিলাময় ঘাট চম্পকবনে,
স্নানে চলেছেন শতসখীসনে
          কাশীর মহিষী করুণা।

সে পথ সে ঘাট আজি এ প্রভাতে
          জনহীন রাজশাসনে।
নিকটে যে ক'টি আছিল কুটির
ছেড়ে গেছে লোক, তাই নদীতীর
স্তব্ধ গভীর, কেবল পাখির
          কূজন উঠিছে কাননে।

আজি উতরোল উত্তর বায়ে
          উতলা হয়েছে তটিনী।
সোনার আলোক পড়িয়াছে জলে,
পুলকে উছলি ঢেউ ছলছলে--
লক্ষ মানিক ঝলকি আঁচলে
          নেচে চলে যেন নটিনী।

কলকল্লোলে লাজ দিল আজ
          নারী কণ্ঠের কাকলি।
মৃণালভুজের ললিত বিলাসে
চঞ্চলা নদী মাতে উল্লাসে,
আলাপে প্রলাপে হাসি-উচ্ছ্বাসে
          আকাশ উঠিল আকুলি।

স্নান সমাপন করিয়া যখন
          কূলে উঠে নারী সকলে
মহিষী কহিলা, "উহু! শীতে মরি,
সকল শরীর উঠিছে শিহরি,
জ্বেলে দে আগুন ওলো সহচরী--
          শীত নিবারিব অনলে।'

সখীগণ সবে কুড়াইতে কুটা
চলিল কুসুমকাননে।
কৌতুকরসে পাগলপরানী
শাখা ধরি সবে করে টানাটানি,
সহসা সবারে ডাক দিয়া রানী
          কহে সহাস্য আননে--

"ওলো তোরা আয়! ওই দেখা যায়
          কুটির কাহার অদূরে,
ওই ঘরে তোরা লাগাবি অনল,
তপ্ত করিব করপদতল'--
এত বলি রানী রঙ্গে বিভল
          হাসিয়া উঠিল মধুরে।

কহিল মালতী সকরুণ অতি,
          "একি পরিহাস রানীমা!
আগুন জ্বালায়ে কেন দিবে নাশি?
এ কুটির কোন্‌ সাধু সন্ন্যাসী
কোন্‌ দীনজন কোন্‌ পরবাসী
          বাঁধিয়াছে নাহি জানি মা!'

রানী কহে রোষে, "দূর করি দাও
          এই দীনদয়াময়ীরে।'
অতি দুর্দাম কৌতুকরত
যৌবনমদে নিষ্ঠুর যত
যুবতীরা মিলি পাগলের মতো
          আগুন লাগালো কুটিরে।

ঘন ঘোর ধূম ঘুরিয়া ঘুরিয়া
          ফুলিয়া ফুলিয়া উড়িল।
দেখিতে দেখিতে হুহু হুংকারি
ঝলকে ঝলকে উল্কা উগারি
শত শত লোল জিহ্বা প্রসারি
          বহ্নি আকাশ জুড়িল।

পাতাল ফুঁড়িয়া উঠিল যেন রে
          জ্বালাময়ী যত নাগিনী।
ফণা নাচাইয়া অম্বরপানে
মাতিয়া উঠিল গর্জনগানে,
প্রলয়মত্ত রমণীর কানে
          বাজিল দীপক রাগিণী।

প্রভাতপাখির আনন্দ গান
          ভয়ের বিলাপে টুটিল--
দলে দলে কাক করে কোলাহল,
উত্তরবায়ু হইল প্রবল,
কুটির হইতে কুটিরে অনল
          উড়িয়া উড়িয়া ছুটিল।

ছোটো গ্রামখানি লেহিয়া লইল
          প্রলয়লোলুপ রসনা।
জনহীন পথে মাঘের প্রভাতে
প্রমোদক্লান্ত শত সখী-সাথে
ফিরে গেল রানী কুবলয় হাতে
          দীপ্ত-অরুণ-বসনা।



সামান্য ক্ষতি -রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

২০১৩ সালের রানীমাতার কাছেও এ বড় সামান্য ক্ষতি!

Tuesday, December 3, 2013

বাঙালী+ মুসলমান =???

পৃথিবীতে নির্বোধের সংখ্যা হিসেব করলে মুসলমানদের পাল্লা নিঃসন্দেহে সবচেয়ে ভারী। এ কথা শুনে বলতে পারেন মুসলমান কেন, আর কোন ধর্ম নেই?

শুধু ধর্ম নয়, জাতের হিসেবে পৃথিবীতে নির্বোধের সংখ্যা হিসেব করলে বাঙালীদের পাল্লা নিঃসন্দেহে সবচেয়ে ভারী। এবার বলবেন বাঙালী কেন, অন্য কোন জাত নেই?

আপনি যদি বাঙালী এবং মুসলমান দুটোই হয়ে থাকেন, তাহলে আপনি আমার গলা টিপে ধরার মতো ক্ষেপে গেলেও অবাক হবো না। তবে সবাই আপনার মতো নাও হতে পারে, কেউ কেউ আমার মতোও আছে। আমি নিজেও জন্মগতভাবে বাঙালী এবং মুসলমান। কিন্তু আমার কোন নির্দিষ্ট জাতপ্রেম-জাতবিদ্বেষ(পাকি বাদে), দেশপ্রেম-দেশবিদ্বেষ(পাকি বাদে), ধর্মপ্রেম-বিদ্বেষ নেই। বলতে পারেন আমি একজন নির্বিবাদী পর্যবেক্ষক। নিজের এবং ইতিহাসের চোখ মিলিয়ে যা দেখেছি সেখান থেকেই ধারণা করে এই লেখাটা লিখছি। জানেন নিশ্চয়ই, ধারণার কোন সীমাবদ্ধতা নেই, ধারণা স্থির কোন বস্তু নয়, আমার ধারণারর অবিনশ্বর সত্য হবারও কোন দায় নেই।

আপনি যদি একমত হন, আমি খুশী। যদি একমত না হন, তবে গলা টিপে ধরার বদলে যুক্তি হাজির করুন। তার আগে বাকী অংশ পড়ুন।

মুসলমান নির্বোধ কেন?
এই ধর্মের মানুষগুলো এক আল্লাহর উপর বিশ্বাস, এক রাসুলের উপর বিশ্বাস, এক কোরানের উপর বিশ্বাসের কথা বললেও ধর্ম নিয়ে নিজেদের মধ্যে হাজারো বিভক্তি তৈরী করে রেখেছে, সেই বিভক্ত দলগুলো শত শত বছর ধরে নিজেদের মধ্যে কাটাকাটি খুনাখুনি করছে। এরা যতটা অন্য ধর্মের সাথে যুদ্ধ করেছে তার চেয়ে বহুগুন বেশী যুদ্ধ নিজেদের মধ্যে করেছে, এবং করছে। এই একুশ শতকে এসেও দেখা যাচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে অস্থিতিশীল অঞ্চলগুলো সব মুসলমান অধ্যুষিত।

যদি বলেন ওই সব অস্থিতিশীলতা খ্রিস্টান ইহুদি নাসারার ষড়যন্ত্র, তাহলে আপনি নির্বোধ। যদি বলেন নির্বোধ মুসলমানরা নিজেরা নিজেদের প্রাণ নিচ্ছে বোমা মেরে গুলি মেরে, তাহলে স্বীকার করে নিলেন ওই মুসলমানরা নির্বোধ। আমেরিকা ইরাক থেকে চলে যাবার অনেকদিন পরেও ইরাকে আত্মঘাতী বা গাড়ি বোমা হামলায় গড়ে প্রতিদিন ১০০ জনের উপর মারা যেতো। যে গর্দভটা বোমা ফাটিয়েছে সে নিশ্চয়ই বেহেশতী হুরের লোভে পিতৃপ্রদত্ত প্রানটা নষ্ট করে আরো একশো জনকে মারলো। ইসলামের নীতি অনুসারে বোমাবাজ গর্দভটা দোজখে যাবে, আর যাদের সে মেরেছে, তারা বেহেশতে।

এরকম ঘটনা পাকিস্তান থেকে সমগ্র মধ্যপ্রাচ্যে অসংখ্যবার ঘটেছে, ঘটছে, ঘটবে। সুতরাং মুসলমানদের বিরাট একটা অংশ নির্বোধের দল। এই নির্বোধেরা মধ্যপ্রাচ্যে যেমন আছে, তেমনি আছে বাংলাদেশেও। বাংলাদেশকে হাজার বছর আগে মুসলমানী করানো হলেও এরা এত বছর পর আবারো ইসলামী বিপ্লব কায়েম করে মুসলমানী করানোর জন্য বোমা সন্ত্রাস অস্ত্রবাজির মহড়া চালিয়ে যাচ্ছে রাজনীতির ছদ্মবেশে।

বাঙালী নির্বোধ কেন?
এই জাতটারও প্রায় একই সমস্যা। আদিম কাল থেকে পৃথিবীর সবচেয়ে উর্বর জায়গা হলো এই বাংলাদেশ। হিমালয় পর্বতমালা থেকে যতগুলো নদী নেমেছে তার প্রায় সবগুলোই এই দেশের পেট চিরে বঙ্গোপসাগরে গিয়েছে। ফলে হাজার হাজার মাইল থেকে সংগৃহিত ময়লা আবর্জনাগুলো  বন্যার জলে মিলেমিশে নদী বেয়ে নেমে এসে এদেশের মাটিকে পলিমাটির উর্বরতায় সমৃদ্ধ করেছে। এখানে একই জমিতে বছরে তিন চারবার ফসল ফলে। জমিতে শস্যবীজ ছিটকে দিলেই আপনাতেই চারা গজিয়ে ওঠে। বিলের মাছে পুকুর ভর্তি হয়ে যায় অথবা পুকুরের মাছে বিল। নদী নালা খালবিল সবকিছু জুড়েই খানাপিনার চাষবাস। আবহাওয়া না গরম না ঠাণ্ডা। বসবাসের জন্য এত আরামদায়ক জায়গা দুনিয়াতে বিরল। তাই দলে দলে লোক এখানে বাস করতে থাকে আদিমকাল থেকেই।

দূরদেশ থেকে বেড়াতে এসে এখানে বিয়ে করে ঘরসংসারী হয়ে থেকে যেত বিদেশী লোকজন। নানান জাতির রক্তের মিশালে এদেশে বিশুদ্ধ জাতি ধারণাটাই নষ্ট হয়ে যায়। এখন যেমন কেউ সাঁতরে আমেরিকা বা কোন উন্নত দেশের তীর ছুঁতে পারলেই হয়, সেই দেশ ছেড়ে সহজে আসতে চায় না। একসময় এই বাংলাদেশও তেমন ছিল।

কিন্তু এই জাতের সমস্যা কখন থেকে শুরু হলো? যখন তারা রাজনীতি শিখলো। রাজনীতি শেখার পর তারা শিখলো কুটনীতি। আসলে হবে কুটনামি। রাজনীতি দিয়ে তারা ভিনদেশী আগ্রাসী শক্তিকে তাড়ানোর কায়দা শিখলো। ভিনদেশী শক্তি তাড়াবার পর তারা নিজেরা ক্ষমতার মালিক, দেশের মালিক হলো। এবার আর বিদেশী নাই। এবার নিজেদের মধ্যে খেলা। নিজেদের মধ্যে খেলতে গিয়ে তারা রাজনীতিকে ব্যবহার করে সুবিধা করতে পারলো না, ফলে তাদের দরকার হলো কুটনীতি বা কুটনামি। একসময় এই কুটনামিকে তারা রাজনীতি বলে ডাকতে লাগলো। ফলে আসল রাজনীতি হারিয়ে গেল প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেল রাজনীতি নামের কুটনামি।

বাংলাদেশে এখন সবাই নিজেকে রাজনীতিবিশারদ মনে করে। সবাই সবার চেয়ে বেশী বুঝে। বেশী বুঝতে গিয়ে অন্যের ক্ষতি করার জন্য কখনো কখনো নিজের পাছায়ও আঙুল ঢুকিয়ে দেয়। শুধু আঙুল না, আঙুল, আংটা, বড়শি, এমনকি গিরাসহ বাঁশ। সবকিছু। তারপর ব্যথা অসহ্য হলে সেই তাড়িয়ে দেয়া ভিনদেশীদের কাছে নালিশ করে। তাদেরকে সালিশ করার জন্য ডাকে। তারা বাঙালীর পাছা থেকে আংটা, বড়শি খুলে ক্ষতের উপর মলম লাগায়, শান্ত্বনা দেয়, উপদেশ দেয়। তখন বাঙালী দলেরা প্রতিযোগিতামূলক গর্ব করে বলে আমার পাছায় মলম বেশী দিছে, আমার পাছার ক্ষতি বেশী হইছিল। এইবার বলুন, এই জাত নির্বোধ কিনা?

আপনি যদি বাঙালী ও মুসলমান দুটোই হয়ে থাকেন আপনি হয় নির্বোধ, নয় দুর্ভাগা।
(বলে রাখি, নির্বোধ শব্দটার কয়েক রকম অর্থ আছে। তার মধ্যে প্রচলিত অর্থ হলো, বোকা। এখানে নির্বোধ শব্দের অর্থটা বোকা নয়। একেবারে আক্ষরিক। নির্বোধ=মানুষের জন্য যার কোন বোধ নেই।)

আপনি কোনটি?

ক্ষমতা নিয়ে কাড়াকাড়ি করে যারা সাধারণ মানুষের জীবন অতিষ্ট করে তারা নির্বোধ। যারা এই কাড়াকাড়ির চিপায় পড়ে বেঘোরে প্রাণ দেয় তারা দুর্ভাগা। এদেশে নির্বোধের চেয়ে দুর্ভাগার সংখ্যা অনেকগুন বেশী হলেও নির্বোধেরাই দুর্ভাগাদের উপর চাবুক ঘোরাবে।

এই নির্বোধেরা আন্দোলনের নামে ট্রেনের লাইন উপড়ে ফেলে হাজার হাজার নিরীহ মানুষকে মাঝপথে আটকে রেখেছে যাদের খাবার, পানি, মোবাইলের চার্জ সব শেষ। এমনকি প্রস্রাব পায়খানা সব বন্ধ। ৪২ ঘন্টা পরেও মুক্তি পায়নি। এখানে নারী, শিশু, হার্টের রোগী সবাই আছে। এই নির্বোধেরা নির্বাচন করে একদিন ক্ষমতায় বসে বড় বড় কথা বলবে। দুর্ভাগা দেশের দুর্ভাগা মানুষ এই দুর্ভোগ ভুলে আবারো হাত তালি বাজাবে।

ভাবছেন, শাসকদের কথা বললাম না কেন? শাসকদের কথা বলাই বাহুল্য। শাসকেরা বাই ডিফল্ট নির্বোধ হয়। বাংলাদেশের ষোল কোটি দুর্ভাগা মানুষ এখন লাখ খানেক নির্বোধের অত্যাচারে জর্জরিত। এরা বাঙালী ও মুসলমান।

Sunday, December 1, 2013

১ ডিসেম্বর ২০১৩ হাবিজাবি

১. প্রতিদিন নতুন নতুন মর্মান্তিকতায় আমাদের হৃদপিণ্ড যেভাবে আলোড়িত হচ্ছে, তাতে কিছুদিন পর মানুষ হিসেবে আমাদের প্রকৃতিই বিগড়ে যেতে পারে।

২. সম্ভাবনারও এমন দুঃসাহস নেই আগামীকাল আমাকে একটা নিরাপদ দিনের প্রতিশ্রুতি দিতে পারে।

৩. প্রকৃতির ধারণাটি এই গ্রহে যেমন, অন্য নীহারিকাতেও তেমন? এখানে প্রকৃতি সবুজ হারিয়ে হলুদ হয় হেমন্তের শেষে। ওইখানে ওই সুদূর নক্ষত্রের চারপাশে ঘুর্ণায়মান কোন গ্রহেও কি তাই ঘটে? নাকি ওখানে হলুদ প্রকৃতি মরে গিয়ে সবুজ হয়। প্রতিটি নক্ষত্র নীহারিকার আশ্চর্য সব বিচিত্র নিয়ম আছে যা আমাদের জ্ঞানের বাইরে।