ফরহাদ ভাইকে প্রত্যাখ্যান করা আমার জন্য বেদনাদায়ক। কিন্তু না করে উপায় ছিল না। বিপদগ্রস্থ মানুষকে সাহায্য করা সবার নৈতিক দায়িত্ব। তাছাড়া ফরহাদ ভাই আমার খুব পছন্দের মানুষ ছিলেন।
আমাদের কোম্পানীতে চাকরী করতেন অনেক বছর আগে। এখান থেকে যাবার পর ভালো ভালো জায়গায় চাকরী বাকরী করে বেড়িয়েছেন, প্রচুর টাকা কামিয়েছেন। ভালো আছেন বলে শুনেছি। গত পনের বছর কোন যোগাযোগই ছিল না।
পনের বছর পর হঠাৎ মাস দুয়েক আগে তিনি উদয় হলেন অফিসে। আমাকে দেখে জড়িয়ে ধরলেন। আমিও আপ্লুত হলাম। কুশলাদি জিজ্ঞেস করলাম। তিনি এখন একটা নামকরা কোম্পানীর ডিরেক্টর। কার্ড দিলেন আমাকে। বললাম যোগাযোগ রাখতে। ফোন নাম্বার দিলাম। রাতে ডিনার করতে বললাম কোথাও বসে। কিন্তু তিনি খুব ব্যস্ত তাই পারবেন না। পরে কথা বলবেন এবং যাবার সময় জানাবেন বললেন। বললেন ঠিক, কিন্তু চলে গেছেন কিছু না বলে। অবাক হলাম। আগে কখনো এমন করতেন না। এরপর আর কোন যোগাযোগই করলেন না। ভাবলাম ব্যস্ত মানুষ হয়তো। ওনার সম্পর্কে পনের বছর আগের বিশেষ একটা কথা মনে পড়তে গিয়েও পড়লো না।
দুমাস পর আজ দুপুরে কোনরকম হঠাৎ করে এসে হাজির আবারো। এসেই আমাদের পাঁচজনকে ডাকলেন। আমরা যারা তাঁর পুরোনো সহকর্মী। তিনি খুব বিপদে পড়েছেন। একটা কাজে পাঁচ লাখ টাকা লাগছে। সাড়ে চার লাখ যোগাড় হয়েছে। বাকী মাত্র পঞ্চাশ হাজার। একজনের পক্ষে হয়তো সম্ভব না তাই তিনি আমাদের পাঁচ জনের কাছে চাইতে এসেছেন। টাকাটা আজকেই লাগবে। নইলে তার খুব অসম্মান হয়ে যাবে।
আমরা ভাবনায় পড়লাম। এত টাকা হাতে নেই। মাসের শেষদিক এখন। ওনাকে বললাম একটু সময় দেন দুয়েকদিন। কিন্তু ওনার হাতে সময় নেই। এখুনি দিতে হবে। কালকে দিলেও হবে না। কিন্তু কেউ পকেটে করে অত টাকা নিয়ে ঘোরে না। মাসের বিশ তারিখ পার হবার পর হাত এমনিতে টানাটানিতে থাকে। তবু কোথাও থেকে ধার করে দেয়া যায় কি?
ভাবছিলাম আমি। ভাবছিল অন্যরাও। আমরা সবাই ফরহাদ ভাইকে পছন্দ করি। ওনার ব্যক্তিত্বই সেরকম আকর্ষণীয়। দশ মিনিটের কথা দিয়ে তিনি দশ বছরের মতো ঘনিষ্টতা তৈরী করে ফেলতে পারেন। কিন্তু সেই ফরহাদ ভাইকে সাহায্য করতে আমাদের সবার কেমন একটু দ্বিধা যেন। পকেট সামর্থ্য না থাকলেও ধার করে কি দিতে পারি না? তিনিও তার ইঙ্গিত দিলেন। কারো কাছ থেকে ধার করে দাও।
এবার মনে হয় সবারই মনে পড়ে গেল ফরহাদ ভাই সম্পর্কে পনের বছর আগের ধারণাটা।
প্রথম ঘটনাটা আমাদের সাথে তার প্রথম পরিচয়ের দু'বছরের মধ্যে। আমাদের অফিসে যোগ দেবার পরপর জানতে পারি তাঁর স্ত্রী সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন। তাঁর পাঁচ বছর বয়সী কন্যাটি ঢাকায় নানাবাড়িতে থাকে। তিনি স্ত্রীর শোকে ঢাকা শহর ছেড়ে চট্টগ্রাম চলে এসেছেন। বউয়ের স্মৃতিগুলো তাঁকে খুব বেদনার্ত করে বলে ঢাকা তাঁর সহ্য হয় না।
শুনে আমরাও খুব ব্যথিত হয়েছিলাম। সহমর্মী হয়ে তাকে নিয়মিত সঙ্গ দিতাম। তিনি মৃত স্ত্রীর স্মৃতিচারণ করতে পছন্দ করতেন। তাদের মধ্যে কতটা প্রেম ছিল, কতটা ভালোবাসা ছিল, কতটা কেয়ার নিত তাঁকে সেসব বলতেন আমাদের। ওরকম একটা কেয়ারিং সংসারের জন্য আমাদের খুব লোভ হতো। আমরা কেউ তখন বিয়ে করিনি।
কিছুদিন পর তিনি চাকরী ছেড়ে চলে গেলেন। নতুন জায়গায় বাসা নিলেন। তবু আমাদের সাথে যোগাযোগ অব্যাহত ছিল ওনার আন্তরিকতার কারণে। একদিন আমরা ফরহাদ ভাইয়ের বাসায় বেড়াতে গেলাম। গিয়ে দেখি ব্যাপক খানাপিনার আয়োজন। বললেন, ওনার কন্যা ঢাকা থেকে বেড়াতে এসেছে, সেই উপলক্ষে খাওয়াদাওয়া।
আমরা তাঁর ফুটফুটে কন্যা সঞ্চিতাকে দেখে মুগ্ধ। কী সুন্দর করে কথা বলে মেয়েটা!
কিন্তু আমাদের মুগ্ধতাকে ছাড়িয়ে ভেতরের ঘর থেকে নিঃশব্দে যে মুর্তিমান বিস্ময়টি উপস্থিত হলেন, তিনি সঞ্চিতার মা, ফরহাদ ভাইয়ের স্ত্রী।
ফরহাদ ভাই আজব মানুষ। একটুও বিব্রতবোধ না করে বললেন, এই হলো আমার স্ত্রী অপলা, সঞ্চিতার মা, যার কথা শুনেছো তোমরা। ঢাকা থেকে বেড়াতে এসেছে আজ।
আমাদের মাথায় আকাশ ভেঙ্গে না পড়লেও বিস্ময়ে থ হয়ে গিয়েছিলাম কয়েক মিনিট। যথাসম্ভব বিস্ময় চেপে রেখে পরিচিত হলাম ভাবীর সাথে। মৃত মানুষ কিভাবে জীবিত হলো সেই প্রশ্নটা মাথায় ঠোক্কর খেতে খেতেই সৌজন্য বিনিময় শেষ হলো। ভাবী ভেতরে চলে গেলে ফরহাদ ভাই বললেন, অপলা দুর্ঘটনায় আহত হয়ে হাসপাতালে ছিল দীর্ঘকাল। পঙ্গুত্বের হাত থেকে অল্পের জন্য রক্ষা পেয়েছে। এখনো ধকল কাটিয়ে ওঠেনি।
আমরা কিছুতে কোন হিসেব মেলাতে পারলাম না। এসবের মানে কি? নিজের স্ত্রীকে নিয়ে কেন এই মিথ্যে। আমাদেরকে আসল কথাটা আগে বললে কি সমস্যা ছিল? কিন্তু কোন ব্যাখ্যা নেই। আমরাও ওনাকে বিব্রত করি না।
কিছুদিন পর এক সন্ধ্যায় তিনি হঠাৎ বিপদে পড়ে আমার কাছে এলেন। বললেন কিছু টাকা লাগবে। আমার কাছে বেশী টাকা ছিল না। দেড় হাজার টাকা দিলাম। কিন্তু এরকম 'হঠাৎ বিপদ' ওনার প্রায়ই হতে থাকলো। অন্যন্য কলিগের কাছ থেকেও তিনি টাকাকড়ি ধার করতে থাকলেন। যেহেতু উনি নিজেও মানুষের আপদ বিপদে সাহায্য করেন, তাই ওনার এসব হঠাৎ বিপদে আমরা টাকা পয়সা দিতে দ্বিধা করতাম না। কিন্তু টাকা ফেরত পাওয়া কঠিন হয়ে যায়।
আরেকবার বিপদের স্কেল বাড়িয়ে এক সিনিয়র কলিগের বিশ হাজার টাকা নিলেন দুদিনে ফেরত দেবেন বলে। দুদিনের কথা বলে নিলেও দুমাসেও দেবার নাম নেই। ছমাসে অনেক ঝামেলা করে অর্ধেক উদ্ধার করতে পেরেছিল সেই কলিগ। কিছুদিন পর ফরহাদ ভাই চট্টগ্রাম থেকে পাট চুকিয়ে ঢাকায় চলে যান। কেউ ঠিকানা জানতো না।
আজ এত বছর পর আবারো ওনার 'হঠাৎ বিপদ। এই বিপদ আসল কি নকল জানার কি উপায় আছে কারো? ওনার ঠিকানাও কেউ জানি না।
আগেই বলেছি ফরহাদ ভাইয়ের এমন একটা ব্যক্তিত্ব আছে, যার ফলে ওনার দোষ ত্রুটি জানা সত্ত্বেও ওনাকে খুব বেশী অপছন্দ করতে পারেনা কেউ। দেখা যায় অনেক দোষই আমরা লঘু চোখে দেখি। ফলে জিতে যায় পছন্দ। পছন্দ করি ঠিক কিন্তু বিশ্বাসটা করতেই দ্বিধা।
সবশেষে পছন্দ আর অবিশ্বাসের দ্বন্দ্বে ফরহাদ ভাইকে আমরা বিনয়ের সাথে অক্ষমতা জানিয়ে দিলাম। বিমর্ষমুখে ফরহাদ ভাই চলে গেলেন।
ফরহাদ ভাই চলে যাবার পর আমরা পাঁচজন বসলাম।
যুক্তিগুলো আমরা এভাবেই সাজালাম। এখানে আসার আগে উনি আগে একটা ফোনও করলেন না। সরাসরি এসে টাকা চেয়ে বসলেন। এ কেমন কথা? তাছাড়া আমাদের মতো চাকরীজীবিদের হাতে এত টাকা নগদে থাকে না এটা উনি জানেন না বলেও অবাক লাগলো। এমনকি ঢাকা থেকে ছুটে আসার আগে একটা টেলিফোনও করেননি উনি এরকম একটা বিপদে পড়েছেন। ঢাকা থেকে আমাদের কাছে ছুটে এসেছেন শুধু এই টাকার জন্য? কেমন যেন হিসেব মিলছে না।
আসলে পনের বছর আগের অবিশ্বাসের বীজটা এতদিন সুপ্ত ছিল। আজ তার এই নতুন বিপদ যেন সেই অবিশ্বাসের বীজের অংকুরোদগোম ঘটাতে শুরু করলো।
ফিরিয়ে দেবার পর আমার একটু কষ্টবোধ হতে থাকে, ঘটনা যদি সত্যি হয়? যদি সত্যিই বিপদে পড়ে থাকেন?
আমি ফরহাদ ভাইয়ের কার্ড খুজে বের করি, মোবাইল নম্বরটা দেখে দেখে ডায়াল করি। যান্ত্রিক একটা কন্ঠ তখন ওই প্রান্ত থেকে জানান দিল - 'এই নম্বরটি বর্তমানে আর ব্যবহৃত হচ্ছে না। অনুগ্রহপূর্বক.....।'