Sunday, April 18, 2010

এক অলস বিড়ালের প্রেম ও এক 'সুশীল' মানুষের অমানবিকতার গল্প

শব্দটা ক্ষীন, কিন্তু বাঁশীর মতো তীক্ষ্ণ। আধোঘুমে বুঝতে পারছিলাম না ঠিক কোথা থেকে শব্দটা আসছে। বাইরে থেকেও হতে পারে। আমি যে ঘরে ঘুমোতাম তার দুটো জানালা ছিল। খাটের পায়ের দিকে একটা, বামদিকে আরেকটা। জানালা খোলা, পর্দাগুলো নামানো। আরেকটু ঘোর কাটতেই শব্দটা আরো পরিষ্কার হলো। বেড়াল ছানার আওয়াজ নয়তো?

আমাদের একটা পোষা বিড়ালনী ছিল। তাকে বাচ্চা অবস্থায় আমরা সংগ্রহ করেছিলাম ইঁদুর তাড়ানোর জন্য। কিন্তু জন্ম থেকেই তার ইঁদুর-ভীতি কিংবা ইদুর-অরুচির কারনে তার ছয় বছরের কর্মজীবনে ছয়টা ইঁদুরও ধরতে পারেনি। না পারলেও তাকে ফেলে দেয়া যায়নি কারন আমার ছোটবোনের প্রচন্ড বিড়ালপ্রীতি। বিড়ালটাকে সে রীতিমতো দুধেভাতে রেখেছে, কদাদিৎ যদি বিড়ালটার উপর কোন অত্যাচার করা হয়, সে রীতিমত বিদ্রোহ করে বসতো বিড়ালাধিকার রক্ষায়। বিড়ালের জন্য জুতোর বাক্সে ফ্লীচের কম্বল দিয়ে বিছানা পাতা আছে, খাবার পাত্রে খাবার, পানির পাত্রে পানি, আর আলাদা বাথরুমের ব্যবস্থা করা আছে। এত সুবন্দোবস্তের পরও বিড়ালনী মাঝরাতে চুপি চুপি গিয়ে ঘুমোবে ড্রইংরুমের ফোমের সোফাটায়। এহেন আরাম আয়েশ সমেত গ্যারান্টেড চাকরী যেখানে, সেখানে দায়িত্ব পালনের কোন ব্যাপার নাই। সুতরাং তাকে দিয়ে ইঁদুর ধরানোর আশা ছেড়ে দিয়ে আমরা ইঁদুরের কলের প্রতি মনোযোগী হলাম।

কিন্তু সেয়ানা ইঁদুর কলে ধরা না দিলেও কলের ভেতরে রক্ষিত কেক বিস্কুট কলা সব খেয়ে আলগোছে কলের ফাঁদ এড়িয়ে কি করে যে বেরিয়ে যায় সেটা খোদা মালুম। এতে একটা জিনিস বুঝলাম মানুষের মতো অন্য প্রানীদেরও বিবর্তন হচ্ছে বিদ্যা বুদ্ধিতে, টেকনোলজিতে। হয়তো দেখা যাবে এক লক্ষ বছর পরে পৃথিবীতে ইঁদুরেরা রকেট-ফকেট নিয়ে এই গ্রহে সেই গ্রহে ঘুরে বেড়াচ্ছে আর মানুষেরা ফিরে গেছে গুহায়।

ধান ভানতে শিবের গীত হয়ে যাচ্ছে। ফিরে যাই বিড়াল গল্পে।

বিড়ালনী কর্মযজ্ঞে অলসের চুড়ান্ত হলেও প্রেমের ক্ষেত্রে মেরিলিন মনরোর চেয়েও এগিয়ে। তার বছর বছর নিত্য নতুন বয়ফ্রেন্ড আসে যায়। পাড়ার যত হুলো বেড়াল আছে সবগুলার সাথে ডেটিং করে বেড়ায় সুন্দরী বিড়ালনী। মাঝে মাঝে বয়ফ্রেন্ডদের মধ্যেকার আন্তঃকলহ রক্তারক্তির ঘটনাও প্রত্যক্ষ করেছি আমরা। মারামারির ধরন দেখলেই বুঝা যায় 'সখী তুমি কার' যুদ্ধ। সেই সব উপদ্রপও মেনে নিলাম।

কিন্তু চুড়ান্ত বিরক্তিকর ব্যাপার হলো তার প্রেমের ফসলগুলো। কয়েকমাস পর পর পোয়াতি হতো বিড়ালনী এবং কমপক্ষে দুটো করে বাচ্চার জন্ম হয় প্রতিবারে, কখনো বা তিনটে। বিড়াল সমাজের এত হাই প্রোডাক্টিভিটি হজম করা কঠিন হয়ে যায় আমাদের জন্য। কারন বিড়ালনীকে পুষলেও তার ছানাপোনাকে পোষার ক্ষমতা আমাদের ছিল না। তবু একেবারে শিশু বয়সে বাচ্চাগুলোকে ফেলতে পারতাম না। বিপদজনক বয়স পার হবার পর মা কাজের বুয়াকে দিয়ে বিড়ালগুলোকে দুরে কোথাও পাঠিয়ে দিত। বিড়াল ছানা পার করতে করতে আমাদের বুয়াও বিরক্ত। হিসেব করলে বিড়ালটা যে কয়েক ডজন বাচ্চা আমাদের বাসায় দিয়েছে সেগুলোর বংশবৃদ্ধি হলে পাঁচ বছরে কয়েকশো বিড়ালের বিশাল একটা খামার হয়ে যেতো।

সেদিন রাতের থেকে কিউ কিউ শব্দটা শুনে খানিকপর নিশ্চিত হলাম ওটা বিড়াল ছানার কান্না। বিড়ালনী নিশ্চয়ই বাচ্চা দিয়েছে আবার। এবং বেড়ালছানাগুলোকে আমার খাটের নীচে গুঁজে রেখে প্রেম করতে বেরিয়ে গেছে কোথাও। মেজাজ খাপ্পা হয়ে যায় আমার। বাতি জালিয়ে শব্দের উৎস খুঁজতে খুঁজতে যে জায়গায় পেলাম ওদের সেটা একটা অগম্য জায়গা। আমার স্টীলের বিশাল বুক শেলফের পেছনের চিপার ভেতরদিকে। যেখানে মানুষের হাত যাবে না, অন্য কিছু ঢুকানোও কঠিন। কিন্তু কি করে বজ্জাত বিড়ালছানা দুটো ওখানে ঢুকেছে বুঝলাম না।

টর্চ মেরে বয়স আন্দাজ করলাম। দেখে মনে হলো এখনো হাঁটতে পারে না। বেশ কিছুক্ষন শিউ শিউ করেও বের করা গেল না। এমন জায়গায় আটকে আছে যেখান থেকে নিজে না আসলে কেউ আনতে পারবে না। খোদ বিড়ালনীও না। পরদিন ভোরে অফিস আমার। রাত তিনটের সময় ঘুম থেকে জেগে বিড়ালছানা উদ্ধার কর্ম কেমন লাগে? কিন্তু ওদের বের না করলে ওদের চেয়েও আমার অসুবিধা বেশী। কিউ কিউ শব্দে ঘুম আসবে না আমার।

বাসার কাউকে না জাগিয়ে আমি লম্বা একটা পাইপ নিয়ে ওদের বের করার চেষ্টা করলাম। কিন্তু বিড়ালছানা দুটো বয়সে পুঁচকে হলেও গলায় চিতাবাঘের তেজ। আমি এলুমিনিয়ামের পর্দার পাইপটা ঢোকানো মাত্র ফোঁস ফোঁস করে উঠলো। যেন শত্রু এসে গেছে। অবচেতন বলে দেয় ওদের। ফলে ওরা সহযোগিতার বদলে প্রতিরোধ গড়ার ইচ্ছে প্রকাশ করলো। আমি যতই আনার চেষ্টা করি, ওর ততই ফোঁস ফোঁস করে পিছিয়ে যায়। পেছোতে পেছোতে এমন জায়গায় গেল, যেখান থেকে টেনে আনার সাধ্য ক্রেনেরও নাই। বুকশেলফটা সরাতে তিনচারজন শক্তিমান মানুষ লাগবে।

আমার অসহায়ত্ব তখন হঠাৎ করে মমত্ব থেকে প্রচন্ড রাগে পরিনত হলো। ব্যাটা, ওখানে আনঅথরাইজ ঢুকছস, আবার তেজ দেখাস। দিলাম পাইপ দিয়ে কয়েক ঘা ওই ফাঁক দিয়ে। ওরে, বাপস এরপর আরো তেজ, দুটোর কিঁউ কিঁউ চিৎকারে আশেপাশের বাড়ীতেও ঘুম ভেঙ্গে যাবার দশা। গেলে যাক আমার রোখ চেপে গেছে তখন। আমি নিশ্চিত বিড়ালাধিকার লংঘন করছি। কিন্তু মেজাজ এত খারাপ হলো যে, প্রায় পিটিয়ে পিটিয়ে খুঁচিয়ে বের করলাম দুটোকে সেই চিপা থেকে, আধাঘন্টার উদ্ধারকর্মে রীতিমতো গলদঘর্ম। মেজাজ তখনো খুব খারাপ, বের করে এনে গলাটা টিপে ধরতে ইচ্ছে হলো।

কিন্তু বের করার পর পুঁচকে তেজী বিড়ালছানা দুটোর আহত খোঁচানো মুখ দেখে আমার এমন কষ্ট লাগলো যে নিমেষেই সমস্ত রাগ অনুশোচনায় পরিনত হলো। কারন একটা বিড়ালের চোখ প্রায় নষ্ট করে দিয়েছি গুতিয়ে। অপরাধবোধে মিইয়ে গিয়ে বিড়ালছানাদুটোকে হাতে তুলে নিয়ে বাইরের বারান্দায় ছেড়ে আসলাম। বিড়ালনী তখনো ফেরেনি অভিসার থেকে। ফিরে এসে শুয়ে পড়লাম বাতি নিভিয়ে। আহত বিড়ালছানা দুটো বাইরে কুঁই কুঁই করছে। আমার ঘুম এলো না সে রাতে আর।

অনেক বছর কেটে গেছে। আমিও বাবা হয়েছি একসময়। কখনো কখনো মাঝরাতে আমার শিশুসন্তানের ডাক শুনে আমি চমকে উঠি। সেও মাঝে মাঝে কিঁউ কিঁউ অস্ফুট শব্দ করে পাশে শুয়ে থাকা মায়ের আশ্রয় খোঁজে। আমি একটু কেঁপে উঠি সেই বিড়ালছানাগুলোর কথা ভেবে।

1 comment:

সবজান্তা said...


"এক অলস বিড়ালের প্রেম ও এক 'সুশীল' মানুষের অমানবিকতার গল্প"