Friday, August 26, 2016

একটি অনন্য কবিতাপাঠ

তোর মা'কে বলিস-- আমি আর ফিরবো না কখনো।
.
নলিনী খুড়োর দেনাগুলো শোধ করে গেলাম; সুবোধের নামে লিখে দিলাম উত্তরপাড়ার দু'বিঘে। আজই দফারফা হয়ে গেলো বিজয়ার সাথে; সে আর আঁচল পেঁচিয়ে হবে না এ-মুখো; কড়ায়-গণ্ডায় তাকে বুঝিয়ে দিয়েছি বজরা দু'খানা।
.
আমি আর ফিরবো না, নিখিল; আমি আর কখনোই ফিরবো না---
.
তোর মা'কে বলিস-- বসতভিটে, বর্গাজমি, বাবলা'র পুকুর আর ঐ দক্ষিণপাড়ার পাঁচ বিঘে তার নামেই দলিল করেছি কাল;
-- বালিশের তলায় রাখা আছে সব। তোর মায়ের অবর্তমানে সব যেন 'বুড়ির'ই হয়-- এও বলিস মা'কে। আরেকটু বড় হ'লে, কান্তাকে বুঝিয়ে বলিস: 'যেখানে সুর নেই, নেই তাল-- সেখানে আগুনও জ্বালাতে নেই'।
ঝুম বৃষ্টির রাতে, নিশিন্ধা' ঘাটে-- সে যেন আর 'মা গঙ্গা', 'মা গঙ্গা'-ব'লে ডুব না-দেয়, দেখিস।
.
--- তোর হরি জেঠু এ'লে, তাঁকে দু'বেলা খেতে দিস, বাপ। আর কেউ না-জানুক, তুই তো জানিস-- কতোটা দেবতা তিনি, কতোটা মানুষ! তাঁকে বলিস-- গৌরাক্ষ ফিরেছিলো, আমি আর ফিরবো না কখনো...
.
উঠোনের ঝোপগুলো আলগোছে কেটে নিস; গতরাতে, ওখানে 'শঙ্খিনী'র মতো কী-একটা চোখে ঠেকলো-- খুব সাবধান! পুবের নিমগাছটা আরো বাড়ুক; বাড়তে বাড়তে তার ছায়া যেন উঠোন ছাড়িয়ে যায়; তোর মা যতই চেঁচাক-- কাটিস না বাপ, গাছটা কাটিস না কখনো।
.
তোর মা'কে বলিস-- আমার অতল আঁধার জুড়ে সে-ই ছিলো ধ্রুব-পূর্ণিমা। নাইবা হলো হাঁটা মৃত্যুলগ্ন অবধি একসাথে-- মায়াপ্রেম ধ'রে। এ জন্মে নাইবা হলাম সংসারী; পরজন্মে, তারেই- শুধু তারেই যেন পাই সুখ-সংসারে; যদি থাকে কিছু ক্ষমা তার অবশিষ্ট-- যদি বাসে ভালো...!
.
আমি আর ফিরবো না, নিখিল; আমি আর কখনোই ফিরবো না।
.
তোর মুখে মুখে ফেরা গীতগুলো আর ঐ দোতারাটা ছাড়া, তোর জন্য কী-এক পিছুটানে রেখে গেলাম না কিছুই...! পারিস তো, ঐ ছোট মুখেই অভিশাপের দণ্ড দিস আমায়...।
.
কেনো নিরুদ্দেশ হলাম, কেনোই বা ছেড়ে গেলাম এই ভরা-সংসার-- অজানাই থাক তোর। শুধু মন কাঁদলে, দোতরায় পরম বিরহে দিস দু'টো টোকা; গলা ছেড়ে দু'কলি গাইতে গাইতে আমারই মতো ভিজিয়ে দিস 'কালিন্দী' পাড়...


নিখিলকে লেখা চিঠি...
রুবেল সরকার
...............................................................................................

ফেসবুকের 'বিস্তার' গ্রুপে এই কবিতাটি পড়ে চমকে গেলাম। বুকের খুব গভীরে এমন একটা চিনচিনে ব্যথা মোচড় দিয়ে উঠলো! এমন করেও আজকাল কেউ লিখতে পারে? আমি নিখিলকে চিনি না, রুবেল সরকারের সাথেও পরিচয় হয়নি। কিন্তু পাঠ পরবর্তী সীমাহীন মুগ্ধতা আমাকে বাধ্য করেছে কবিতাটি শেয়ার করতে। এটি কেবল একটি কবিতা নয়, জীবনের গূঢ় গভীর একটা বার্তা- যে বার্তাটি খুব গোপনে বাজে আরো অনেকের প্রাণে। যেদিন অন্য জগতে পাড়ি জমাবো সেদিন এমন একটি বার্তা লিখে বিদায় নিতে চাই আমিও।

তোমাকে যেখানে খুঁজি

এক.
আজকাল তোমাকে অনেক বেশী করে খুঁজি। অনুপস্থিতিতে অভ্যস্ত হয়ে যাবার পরেও তোমাকে কোথাও কোথাও দেখতে ইচ্ছে করে। কোথাও কোথাও পেতে ইচ্ছে করে। মনে পড়ে সেই সন্ধ্যাগুলো। যেখানে অনেক গান ছিল, অনেক গীত ছিল, আনন্দ ছিল অঢেল। জীবনকে তুমি যেভাবে উপভোগ করেছিলে, মাঝে মাঝে আমারো ইচ্ছে করে তোমার মতো উপভোগ করতে। আমাকে তুমি যেমন বইয়ের জগত চিনিয়েছিলে তেমনি চিনিয়েছিলে গানের জগত। গানের জগতটা বোধকরি একটু বেশীই ছিল তোমার জীবনে।

এত বছর পর তোমাকে খুঁজতে গিয়ে আমি তাই গানগুলোতে ফিরে যাই বারবার। বহুবার শোনা গানগুলো বারবার শুনে তোমাকে অনুভব করার চেষ্টা, তোমার অনুভুতি বোঝার চেষ্টা। তোমাকে আমি এভাবে খুঁজিনি আগে কখনো। এখন বয়স বেড়ে যেতে যেতে যখন সীমান্তের কাছাকাছি পৌঁছে যাচ্ছি, তখন মনে হয় আমি তোমাকে আগের চেয়ে বেশী বুঝতে পারছি, তোমার নৈকট্য অনুভব করছি।

আমার স্মৃতিতে সবচেয়ে উজ্জ্বল সময় তোমার গানের সময়গুলো। তোমার মতো এত গান পাগল মানুষ আমি খুব বেশী দেখিনি। অলস অবসরের প্রায় সবটুকু সময় গানের সাথেই কাটতো তোমার। বোঝার বয়স হবার আগ থেকেই তাই তোমার গানের জগত আমাকেও স্পর্শ করেছিল।

একটু বড় হবার পর আমার নিজের পছন্দের গানের জগত সৃষ্টি হয়। তখন তোমার গান, আমার গান এরকম একটা বিভক্তিতে আমরা নিজস্ব পছন্দের জগতে আলাদা হতে শুরু করি। আমি একটু আধুনিকে, তুমি একটু পুরোনো দিনে। আঠারো ছোঁবার পর আমি প্রথমবারের মতো নিজের পছন্দের গান কিনতে শুরু করি। তখন ছিল ক্যাসেট যুগ। তোমার শত শত ক্যাসেটের সংগ্রহ ছিল দেশ বিদেশের। সবচেয়ে
বেশী ছিল Thomsun Electronics নামে একটা ব্র্যাণ্ডের Sony কিংবা TDK ক্যাসেট।


[এই ছবিগুলো ইন্টারনেট থেকে নেয়া। তোমার ক্যাসেটের ছবি তোলা হয়নি কোনদিন। তবু সেগুলো এরকমই ছিল বলেই ছবিগুলো দেয়া]


আমি কখনো অত দামী ক্যাসেট কিনিনি। আমার জগত সীমাবদ্ধ ছিল ৩৫ টাকার সস্তা দেশীয় ক্যাসেটে। কয়েক মাস পরেই ফিতা আটকে কিংবা ঘড়ঘড় শব্দ করে যার জীবনাবসান ঘটতো। তবু আমি তোমার কাছ থেকে আলাদা অবস্থান নিয়ে আধুনিক ক্যাসেটের সংগ্রহ বাড়িয়ে চলছিলাম। শেষ পর্যন্ত তোমার এক চতুর্থাংশেও পৌঁছাতে পারিনি।

তুমিই জিতে গিয়েছিলে। আবার, আমি হেরে গিয়ে বিন্দুমাত্র লজ্জিত হইনি। কেননা আমি তোমার সাথে প্রতিযোগিতা করতে যাইনি, আমি কেবল চেয়েছিলাম নিজের জগতে একটু স্বতন্ত্র অবস্থানে থাকতে। তারুণ্যের সেটা স্বাভাবিক ধর্ম। সেই স্বাতন্ত্র্য অবস্থানের কিছুটা যে পেরেছিলাম, সে তোমার ছায়াটা ছিল বলেই। তুমি যেদিন সব আমার জন্য রেখে চিরতরে চলে গেলে সেদিন আমি তোমার আমার দুই পছন্দের যোগফলের মালিক হয়েও বিষন্নতার সমুদ্রে ডুবে গিয়েছিলাম।

সে যাক। যে কথা তুমি জানো না। তোমার-আমার আমাদের এত বছরের আগলে রাখা সমস্ত ক্যাসেটের সংগ্রহ একদিনের আকস্মিক কিন্তু ভয়াবহ বন্যায় ভেসে গিয়েছিল। তবু ভেজা সেই নষ্ট ক্যাসেট আরো বহুদিন বয়ে বেরিয়েছিলাম।

তোমার সাথে বসে আর কখনো গান শোনা হবে না, বড় হবার পর, আলাদা পছন্দের জগত হবার পর কখনো শুনিনি। কবে শেষবার শুনেছি ভুলেই গেছি। তবে তখন যে গানগুলো বুঝিনি, ভালোবাসিনি, এখন পরিণত বয়সে এসে সেই গানগুলো আমার কানে সুরের বেদনা জাগায়, বুকের ভেতরটা তোমার অভাবের কষ্টের আগুনে পোড়ায়। সেই গানগুলো আমি খুঁজে পেয়েছি অন্য এক মাধ্যমে। যে প্রযুক্তির কথা তুমি জানার আগেই চলে গেছো, সেই প্রযুক্তির নাম ইন্টারনেট। সেই মাধ্যমটা ইউটিউব।


দুই.
তোমার প্রধান পছন্দ ছিল হিন্দি গান। তারপর বাংলা। তারপর ইংরেজী। আমাদের ইংরেজি গানের সংগ্রহ ছিল খুবই কম। শুধু মনে আছে ABBA আর Boney M নামের দুটো ব্যান্ডের কথা। হিন্দি গানের কথাই বলবো আজ। ছেলেবেলায় এই গানগুলো শুনতে শুনতে কান পচে গেছে বলতাম। সেই গানগুলো এত বছর পর ইউটিউবে আবিষ্কার করার পর মনে হলো একটা হীরার খনি আবিষ্কার করেছি। যে গানগুলোর শুধু অডিও শুনে বড় হয়েছি, সেই গানগুলো জলজ্যান্ত ভিডিও হয়ে চোখের সামনে ভেসে ওঠা কী যে আনন্দের ব্যাপার তা বোঝানো মুশকিল। হ্যাঁ, আমার সবগুলো গানের কথা মনে নেই। যে কটা মনে আছে সে কটা গান আমি এখন প্রাণভরে শুনছি, ডাউনলোড করছি। আমার পাগলামি দেখে পরিবার বলছে আমি হঠাৎ করে বুড়ো হয়ে গেলাম কেন? হিসেব করে দেখলাম আমি সত্যি সত্যি তোমার সেই বয়সের কাছাকাছি চলে এসেছি। যে বয়সে তুমি এইসব গান শুনতে ভালোবাসতে, আমিও সেই বয়সে এসে ওই গানগুলোর প্রেমে পড়ে গেছি। যারা বলছে আমি বুড়ো হয়ে গেছি, তারা বোঝে না আমি আসলে আমার কৈশোরে ফিরে গেছি। আমার কৈশোরের স্মৃতিমগ্নতাই আমার এই গান প্রিয়তার অন্যতম কারণ।


সবচেয়ে বেশী মনে পড়ে এই গান দুটোর কথা। এই গান দুটো তুমি সবচেয়ে বেশীবার বাজিয়েছো। এখনো আমার কানে বাজছে। 

এই গানটা ১৯৫১ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত 'মালহার' সিনেমার
https://www.youtube.com/watch?v=shjfQSqswDU


এই গানটা ১৯৬৩ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত 'তাজমহল' সিনেমার
https://www.youtube.com/watch?v=PEUtLHYM35s


আরো অসংখ্য গান ছিল, গজল ছিল। তবে বেশীরভাগই সিনেমার গান। গজলের মধ্যে ছিল জগজিত সিং, চিত্রা সিং, অনুপ ঘোষাল, অনুপ জলোটা, গোলাম আলী, মেহেদী হাসান ইত্যাদি। আমার খোঁজাখুঁজি আপাততঃ সীমাবদ্ধ আছে হিন্দি গানে যার কিছু গান মাত্র খুঁজে পেয়েছি।

কাভি কাভি

তুমহি মেরে মন্দির

মেরে স্বপ্নকি রানী

হাম ভুল গেয়ি

মেরা জীবন কোরা কাগজ

ইয়ে কাঁহা আগেয়ি

নীলা আসমান

লাগ যা গলে


বেছে এই কয়টি গান নির্বাচিত করলাম এই কারণে যে গানগুলো আমার নিজেরও খুব পছন্দের। আরো গান খুঁজে পেলে যোগ করা হবে পরবর্তীতে।

[অসমাপ্ত ....]

Friday, August 19, 2016

দুঃসময়ের অপেক্ষমান শাস্তি

স্টেশনে বসে আছি অনেকক্ষণ। ট্রেন ঠিকসময়ে ছাড়বে না। চট্টগ্রাম থেকে উর্মি গোধূলী ট্রেনটা আসার পর ঢাকা থেকে তূর্ণা নিশীথা হয়ে ছাড়বে। ভাগ্যক্রমে টিকেট পেয়ে গেছি। নন এসি হলেও অসুবিধে নেই। ঢাকার যানজট থেকে পালিয়ে বাঁচার জন্য একদিন আগেই চলে যাচ্ছি। নইলে আরো দুদিন থাকার কথা।

অনেক বছর পর কমলাপুর থেকে ট্রেনে উঠবো। সেই ছাত্রজীবন ছাড়ার পর এদিকে আসা হয়নি আর। ট্রেনে আসলে বরাবরই এয়ারপোর্ট স্টেশনেই নামতাম। কাজকর্ম সব গুলশান বনানী কেন্দ্রিক ছিল বলেই। এবারই ব্যতিক্রম। বহুদিন পর বলে চিরাচেনা এই স্টেশনটা খুব অচেনা লাগছিল এবার। কেমন পুরোনো হয়ে গেছে টার্মিনালটা। ওয়েটিং হলটা একদম অগোছালো। এর চেয়ে চট্টগ্রামের রেল টার্মিনালটা অনেক বেশী সুন্দর, পরিচ্ছন্ন, আধুনিক। আকারেও বড় হবে কিছুটা। তবে ঢাকার প্ল্যাটফর্মে ফ্যানের ব্যবস্থা আছে যেটা চট্টগ্রামের প্ল্যাটফর্মে নেই।

একটা ফ্যানের নীচে যুত হয়ে বসে মোবাইলে একটা ইবুক পড়ার চেষ্টা করছিলাম। কিছু পড়ে আবার ট্রেন লাইনের দিকে তাকাই। চট্টগ্রামের ট্রেনটা আসলো কিনা। রাত এগারোটা বাজে প্রায়। কতক্ষণ বসে থাকবো এভাবে?

যেখানে বসেছি সেই পিলারের উল্টোদিকে এক্সসারসাইজ খাতার মতো একটা জিনিস চোখে পড়লো।  হাত বাড়ালেই ধরা যায়। কার না কার জিনিস কে জানে। ফেলে গেছে কেউ। কৌতুহল হলো, নিশ্চয়ই কোন বাচ্চার স্কুলের খাতা হবে। হাতে নিয়ে দেখলাম কোথাও ঠিকানা আছে কিনা। খাতা ঠিকই আছে, কিন্তু স্কুলের খাতা না। ভেতরে শুধু গোটা গোটা অক্ষরে কিছু লেখা। একটু চোখ বুলিয়ে ডায়েরীর মতো লাগলো। নাকি সাহিত্য কে জানে? কোথাও ঠিকানা দেখা গেল না। রেখে দিলাম খাতাটা।

কিন্তু কিছুক্ষণ ইবুক পড়ার পর খাতাটার দিকে নজর গেল আবার। কী আছে ওতে? কারো গোপন কথা? নিষিদ্ধ কৌতুহল বিজয়ী হলো এবার। আবারো হাতে নিলাম। পড়তে শুরু করলাম নিজের অজান্তেই.........


কথাগুলো খুব রূঢ় শোনাবে। তবু বলতেই হচ্ছে। আপনাকে শোনাবার ইচ্ছে নেই। নিজেকে শুনিয়েই বলছি। বয়স হলে অনেক মানুষই সময়ের কোপানলে পতিত হয়। আপনিও হয়েছেন। একটু বেশী পরিমানেই হয়েছেন। শুধু সময় না, আপনার কর্মফলের কোপানলেই পতিত হয়েছেন বেশী। শুনতে আপনার খারাপ লাগতে পারে কিন্তু আজকে আপনি যে পরিস্থিতির শিকার হয়েছেন সেটার জন্য প্রায় সর্বাংশে আপনিই দায়ী। আপনার বয়স অনধিক আশি বছর। এই বয়সে আপনার যা আছে তা নিয়ে আরো ভালো থাকার কথা ছিল। আপনার বয়স পর্যন্ত আমার টিকে থাকা হবে না। থাকলে সেটা দুর্ভাগ্য বলতে হবে। কেননা আমরা জানি না ভবিতব্য আমাদের জন্য কী প্রস্তুত করে রেখেছে। আপনার জন্য ভবিতব্য যা রেখেছে তার জন্য আমি দুঃখিত, কিন্তু তবু বলবো এটা আমার কাছে খুব অপ্রত্যাশিত ছিল না। আপনার অতীতের কর্মকাণ্ডগুলো আজকের এই পরিণতির জন্য দায়ী। আপনি জানেন আপনি কী করেছেন, কিন্তু আপনি কি কখনো ভেবেছিলেন আপনি দিনের পর দিন, বছরের পর বছর ভুল পথে চলছিলেন? আপনাকে যারা সুবুদ্ধি দিয়েছিল, সৎ পরামর্শ দিয়ে সঠিক পথে থাকতে বলেছিল আপনি তাদের কথায় কান দেননি।

আপনি আজীবন চালাক মানুষ হিসেবেই জীবনযাপন করেছেন। বয়স হলেও আপনার চালাকির মাত্রা এতটুকু কমেনি। আপনি বৈষয়িক ব্যাপারে অতিমাত্রায় চালাকির চেষ্টা করে পরের সম্পদ হরণে ব্যস্ত সময় কাটিয়েছেন। আপনি নিজে করেছেন, সন্তানদেরও সেই পথে প্রশিক্ষিত করেছেন। আপনি পরিবারকে একটা দুষ্টচক্র বানিয়ে তুলেছেন মাত্রাহীন লোভ আর স্বার্থপরতা দিয়ে। আপনি নিজের পরিবার ছাড়া বাকী সবার সাথে চরম অবিচার করেছেন। নিজের পরিবারকে অতিমাত্রায় ভোগ করাবার জন্য বঞ্চিত করেছেন আপনার পৈত্রিক পরিবারকেও। আপনি গ্রাস করেছেন আপনার পাওনার কয়েকগুন বেশী। আপনার কুসন্তানদের আপনি কর্মকাণ্ডের সহযোগী বানিয়ে নিয়েছিলেন। কিন্তু আপনি বোঝেননি অপ্রাপ্য সম্পদের যোগফলের হিসেব করতে করতে জীবনচক্রের একটা অন্ধকুপে পতিত হচ্ছেন। এখন সেই অন্ধকূপ থেকে আপনাকে টেনে তোলার কেউ নেই। আপনার সেই কুসন্তান সমূহ এখন আপনার দিকেও ফিরে তাকাচ্ছে না।

আপনার সম্পদগ্রাসী কর্মকাণ্ড সম্পর্কে আমি জানতাম, কিন্তু আপনার অন্ধকূপে পতিত হবার কাহিনীটা আমি জেনেছি আপনার নিজের মুখেই। আমি আপনার কোন উপকার করতে পারবো না জেনেও আপনি আমাকে দুঃখের কাহিনীগুলো শুনিয়েছেন সময় নিয়ে। আমি আপনার জন্য শান্ত্বনার বাক্য উচ্চারণ করিনি। কেননা আমি ধরে নিয়েছি এটা সময়ের একটা শাস্তি। আপনার কাহিনী শুনে আমি দুঃখিতবোধ করলেও করার কিছু নেই আমার। আপনার পরিবার বা কুসন্তানদের সাথে আমার কোন লেনাদেনা নেই। ওরা সব আপনারই সৃষ্ট ফ্রাংকেনস্টাইন। অবশেষে আজ আপনাকেই গ্রাস করেছে। আপনি একা নন, পৃথিবীতে এমন দুর্ভাগা আরো আছে। আপনি তাদের সংখ্যা আরেকটি বাড়ালেন মাত্র। স্বার্থপরতার শাস্তিগুলো সময়ই দিয়ে দেয়।
"মানুষ জানে না সে নিজে কত অসহায় একটা প্রাণী। নিজেই নিজের ভার সইতে পারে না ঠিকমতো, তবু কেন অন্যের বাড়া ভাতে ছাই দিতে এত ব্যস্ত হয়, নিজের নাক কেটে পরের যাত্রা ভঙ্গ করতে চেষ্টা করতে থাকে এটা ভেবে আমি কূল পাই না।" ......আড়াই দশক আগে আপনাদের অপকর্ম দেখে আমাকে ডায়েরীতে এই লাইনগুলো লিখতে হয়েছিল। আমি খুব সোজা বাংলায় তখনই বুঝেছিলাম সময় কাউকে ক্ষমা করে না। আপনাকেও করেনি।
আপনি এখন বলছেন আপনার পরিবার চরম কুৎসিত একটা ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। আমিও জানি সেটা। আপনার পরিবার থেকে আমি নিজেকে বিচ্ছিন্ন ঘোষণা করেছি বহুবছর আগেই। আপনার যে কর্মকাণ্ডগুলোকে আমি ঘৃণিত বলছি আপনার স্ত্রী এবং কুসন্তানদের কর্মকাণ্ড তার চেয়ে দশগুন বেশী ঘৃণ্য। যথাসময়ে তারাও শাস্তির আওতায় আসবে বলে আমার বিশ্বাস। ওরা কতগুলো নারীকে কিভাবে অবমাননার চুড়ান্তে নিয়ে গেছে, সেটা লিখতে গেলে কয়েকটি ট্র্যাজিক উপন্যাস লিখতে হবে। লেখার ক্ষমতা থাকলে আমি লিখতাম। কিন্তু ঘটনাক্রমের স্মৃতিচারণার ক্রোধে ঘৃণায় আমি এত বেশী প্রজ্জ্বলিত যে আমার হাত দিয়ে কোন লেখাই আসে না।

আপনি কী এখন স্বীকার করবেন, প্রাথমিক পর্বে আপনারও প্রশ্রয় ছিল স্ত্রী সন্তানদের অবৈধ কর্মকাণ্ডে? হয়তো করবেন না। প্রতিটি মানুষই কিছুটা এরকম। নিজের ভুলগুলো কিছুতে চোখে পড়ে না। কেননা প্রতিটি মানুষই কিছু না কিছু মানসিক প্রতিবন্ধী। তাই নিজের অনেক মারাত্মক ভুল নিজেরই কাছে অন্ধকারে থেকে যায় চিরকাল। কিন্তু আপনি স্বার্থান্ধ না হয়ে একটু খোলা মনে যদি ভাবতেন তাহলে খুব স্পষ্টভাবেই দেখতে পেতেন। প্রতিটি মানুষের একটি করে বিচার করার বিবেক থাকে সেখানে চাইলে সে নিজেকে যাচাই করতে পারে একটা আয়নায়। আপনি সেটা কখনো করেননি হয়তো। তাই এই শেষ সময়ে এসেও আপনি ভুলগুলো দেখতে পান না।
একটা মানুষের দুঃসময়ের কথা শুনে এমন কথা কেন লিখছি? লিখছি কেননা আপনি এখনো অনুতপ্ত নন। আপনি এখনো বলছেন না আপনার ভুলের কারণেই এই পরিণতি। আপনি এখনো শুধু ফ্রাংকেনস্টাইনের দোষ খুঁজে বেড়াচ্ছেন। ফ্রাংকেনস্টাইনের স্রষ্টাকে আপনি এখনো খুঁজছেন না। সেই কারণে আপনাকে প্রতি সহমর্মী হতে পারলাম না। আপনি অনুতপ্ত না হলে আমিও সহানুভুতিশীল হতে পারি না। শুধুমাত্র বয়সের কারণে কারো অন্যায় ক্ষমার চোখে দেখা আমার চরিত্রে নেই।


খাতার লেখা এখানেই শেষ। কোন নাম ধাম তারিখ কিছু নেই। সম্ভবতঃ অসমাপ্ত কোন চিঠি। খাতাটা আবারো জায়গামতো রেখে দিলাম। ট্রেনের বাঁশী শোনা যাচ্ছে। এসে পড়েছে উর্মি গোধূলী। রাত বারোটা বেজে গেছে। উঠে পড়লাম। বসতে বসতে ঝিঁঝি ধরে গেছে পায়ে। আড়মোড়া ভেঙ্গে ব্যাগটা কাঁধে ফেলে হাঁটতে শুরু করলাম ট্রেনের দিকে। জীবনে অনেক বৈচিত্র্যময় অনুভুতির অধিকারী হয় মানুষ, তার কটিই বা প্রকাশ পায়, কটিই বা আমাদের জানা হয়। আজকে তার একখানা চোখে পড়ে গেল দুর্ঘটনাবশতঃ।

Saturday, August 13, 2016

নিয়ম ভাঙ্গার কারিগর

প্রকৃতির একটা চরিত্র সার্বজনীন। এই যে বিশাল মহাকাশ, সেখানে কোটি কোটি গ্রহ নক্ষত্র নীহারিকা। রাতের আকাশে খালি চোখে যতটা দেখা যায় তার চেয়ে বহুকোটিগুন বেশী নক্ষত্র আছে জগত জুড়ে। সবকিছুই ছুটছে। নির্দিষ্ট একটা গতিতে, নির্দিষ্ট একটা বলয়ে। উপগ্রহ, গ্রহ, নক্ষত্র, নীহারিকা সবাই ঘুরছে। উপগ্রহ ঘুরছে গ্রহকে ঘিরে, গ্রহ ঘুরছে নক্ষত্রকে ঘিরে, নক্ষত্র ঘুরছে নীহারিকা ঘিরে, আবার নীহারিকাও ঘুরছে আরো বিশাল বলয় নিয়ে।

এই যে ঘুরন্তিস, তার একটি নিয়ম আছে। ছোট বড়কে ঘিরে ঘুরবে। ছোটকে ঘিরে বড়টা কখনোই ঘুরবে না। যেমন পৃথিবীকে ঘিরে চাঁদ ঘুরছে তেমন বৃহস্পতিকে ঘিরে প্রদক্ষিণ করছে তার উপগ্রহ। পৃথিবীর একটাই চাঁদ, কিন্তু বৃহস্পতির একাধিক চাঁদ। পৃথিবীর নিয়ম আর বৃহস্পতির চন্দ্রোদয়ের নিয়মে পার্থক্য আছে। আবার সৌরজগতে যে রুটিন, অন্য একটি নক্ষত্রে সেই রুটিন হবে না।

যদি কখনো পৃথিবীর চাঁদ বৃহস্পতির সংস্পর্শে আসে সে আর পৃথিবীর কাছে ফিরতে পারবে না। মহাজাগতিক নিয়মে বড় গ্রহের আকর্ষণ অনেক বেশী। পৃথিবীর চাঁদ নির্দ্বিধায় বৃহস্পতির কাছে চলে যাবে। এতকাল যে চাঁদ পৃথিবীর নিয়মে চলেছে, সে এখন এখন বৃহস্পতির নিয়মে চলবে। চাঁদকে যদি ওখানে বলা হয় তুমি পৃথিবীর নিয়মে চলো, তখন সে নির্ঘাত ক্ষেপে গিয়ে বলবে দূরে গিয়ে মর।

চাঁদকে দোষ দেয়া যায় না, বৃহস্পতি পৃথিবীর চেয়ে বারো হাজার গুন বড়। তার আকর্ষণ ক্ষমতাও সেই রকম মারাত্মক। পৃথিবীর নিয়ম চাঁদের মনে থাকার কথাও না। তখন সে বৃহস্পতির হয়ে কথা বলবে। আবার সূর্যের চেয়ে বড় কোন নক্ষত্রের সাথে যদি বৃহস্পতির দেখা হয়ে যায়, তখন সে লাফ দিয়ে ওই নক্ষত্রের কাছে চলে যাবে। সূর্যের এত কালের আকর্ষণের মায়া কাটাতে তার একবিন্দুও দ্বিধা হবে না। হবার কথা নয়। সবই মহাকর্ষের ব্যাপার। পুরো বিশ্বজগত জুড়ে এই ঘটনা। সবকিছুই ঘুরছে কিছু না কিছুকে প্রদক্ষিণ করে। সেই গ্রহ নক্ষত্র নীহারিকা কিংবা অনুপরমানু থেকে ইলেক্ট্রন প্রোটন নিউট্রন সবই।

এই যে বিশ্বজাগতিক শক্তি সবকিছুর উৎস যে এক, তাতে কোন সন্দেহ নেই। ধর্মে বিশ্বাসীরা বলে এই সবকিছুর উৎস বিশ্ববিধাতা। আর বিজ্ঞান বিশ্বাসীরা বলে বিগ ব্যাং। আর সুবিধাবাদিরা বলে বিশ্ববিধাতা বিগব্যাং দিয়ে বিশ্বসৃষ্টি করেছে।

পৃথিবীতে মানুষ বাদে সবকিছুই একটা নিয়মের অধীনে চলে। একমাত্র মানুষই কোন নিয়ম মানে না, যেমন খুশী চলতে পারে, যেমন খুশী বলতে পারে, এই বিশৃংখলাকে কোথাও মানুষ গণতন্ত্র বলে, কোথাও স্বাধীনতা বলে, কোথাও মানবাধিকারও বলে। একমাত্র মানুষের কাছেই আছে নিয়ম ভাঙার অজুহাতের ভাণ্ড। এই মানুষ শ্রেষ্ঠজীব না হয়ে যায় কোথা!

মুসল্লী

গুলবদন রান্নাঘর থেকে খরচের তীরটা ছুঁড়ে দিয়ে জানালো, পেঁয়াজ নাই, পেঁয়াজ আনতে হবে।

পেয়ারালী দূর থেকে তীরটাকে আসতে দেখে লুঙিতে গিঁট দিয়ে গাঁট হয়ে বসলো, তীরটাকে খপ করে ধরে আবার জায়গামতন ফেরত পাঠাতে হবে। পকেটে একটা টাকাও নাই। কাল রাতে চাল ডাল তরকারি কিনে সব শেষ। পেঁয়াজের কথা মনে ছিল না। তবে লুঙ্গির গোপন খুপরিতে ১০০ টাকার একটা নোট লুকিয়ে আছে, সেটা  আরো মহা কোন বিপদের জন্য। তরকারীতে পেঁয়াজ না খেলে কিছু এসে যায় না। সাবেক অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান সাহেবেরও সেই মত ছিলপেঁয়াজের দাম বাড়ছে তো কি হইছে, পেয়াজ না খাইলে কিতা অয়?

কিন্তু গুলবদনকে ওটা বলা যাবে না। প্রথমতঃ সে সাইফুর রহমান নয়, সে পেয়ারালী। দ্বিতীয়তঃ গুলবদনের বয়স তার অর্ধেক। তাকে সামলানো কী কঠিন কাজ তা পেয়ারালীর মেরুদণ্ডের বুড়ো হাড্ডিই জানে। নাই জাতীয় কথার বদলে তাকে বলতে হবে পেঁয়াজের চেয়েও গুরুতর কোন সমস্যার কথা। তুলনামূলক সমস্যা তত্ত্বে বিশ্বাসী গুলবদন।

রিকশা চালানোর শক্তি শেষ হয়ে যাওয়াতে ঝালমুড়ি বিক্রি করতো পেয়ারলী। কিন্তু ঝালমুড়ি ব্যবসায় টান পড়ছে দোকানে প্রাণ কোম্পানীর ঝালমুড়ির তৈরী প্যাকেট চলে আসার পর থেকে। লোকজন তরতাজা বানানো ঝালমুড়ির চেয়ে প্যাকেটের ঝালমুড়ির দিকে ঝুঁকে গেছে। সেই থেকে পেয়ারালী বিপদে আছে।

সিনেমা হলের সামনে কিছু বেচা বিক্রি হয়। কিন্তু শহরে সিনেমা হল জিনিসটা উঠে গেছে। আলমাস ছাড়া আর কোন সিনেমা হল নেই শহরে। এক আলমাসের দুই শোতে ঝালমুড়ি বেচে কি আর সংসার চলে? তার চেয়ে ভিক্ষা করে বেশী আয়। কিন্তু গুলবদন ভিক্ষাবৃত্তির কঠোর বিরোধী। সে সোজা বলে দিয়েছে পেয়ারালী যদি ভিক্ষা করে তাহলে পরদিন থেকে সে গতর বেচতে দাঁড়িয়ে যাবে আলমাসের পাশের ফুটপাতে। এই বস্তির নুরবানু আর ফুলবানু তাই করছে গার্মেন্টসের চাকরী ছেড়ে। খাটনি কম, আয় বেশী। দুই বোন এক ঘরে থাকে। তাদের ঘরে রঙিন টেলিভিশনও আছে। জোয়ান বউয়ের হুমকিতে মাঝবয়সী পেয়ারালী চুপসে থাকে। পেয়ারালীর মতে ভিক্ষার চেয়ে বেশ্যাবৃত্তি আরো নিকৃষ্ট।

সে মাঝে মাঝে একটা সুতার কারখানায় থেকে বাতিল খোল সংগ্রহের কাজ করে। বিক্রি করে যা পায় তা আধাআধি ভাগাভাগি হয় দারোয়ানের সাথে। আজ কারখানা বন্ধ। সেদিকেও রাস্তা নাই। সুতরাং পেয়ারালীকে গুলবদনের তীরকে ফেরত দেবার জন্য বলতে হয়, গিট্টু মাকড়ার সাথে দেখা হইছিল আইজ। সন্ধ্যার পর আসবে

গিট্টু মাকড়ার কাছ থেকে দুই হাজার টাকা ধার নিয়ে ঝালমুড়ির ব্যবসা শুরু করছিল সে। পাঁচশো টাকা শোধ হয়েছে, বাকী দেড় হাজার। গিট্টু লোকটা বস্তির সাক্ষাত আতংক হলেও পেয়ারালীর সাথে অদ্ভুত খাতির। নেশা ভাং করার সুযোগ দেয় বিনা পয়সায়। পাওনা টাকার জন্য এখনো সেরকম কোন চাপ দেয়নি। এই চাপ না দেয়াটাই গুলবদনের ভয়ের কারণ। তার উদ্দেশ্য কি? 

যখনই গিট্টু ঘরে আসে তখনই গুলবদনের মুখ শুকিয়ে যায়। তাকে আসতে বারণও করা যায় না, আবার খাতির করতেও মন সায় দেয় না চাউনিতে নেশাড়ু ছায়া তারপেয়ারালীর অনুপস্থিতিতে ঘরে ঢুকে যখন সে –‘ভাউজের শরীর কেমন আইজ- বলে তখন বুকটা শুকিয়ে যায় ভয়ে। কথাটার মধ্যে খারাপ কিছু না থাকলেও গুলবদন তাতে মতলবের গন্ধ পায়।

পেয়ারালী সফল। গিট্টুর নাম শুনে পেঁয়াজের কথা না বাড়িয়ে রান্নার কাজে মন দেয় গুলবদন

এবার আসল কাজে বের হতে হবে। প্রতি শুক্রবার জুমার নামাজটা পড়তেই হয় তাকে। বেড়ার খুটি থেকে পাঞ্জাবীটা খুলে নেয়। পাঞ্জাবীর ডান পকেটে টুপি আছে। একটু আতরও দিল গায়ে। একটা কাপড়ের থলে ভাঁজ করে ঢুকালো বাম পকেটে। আজানের শব্দ শোনা যাচ্ছে মসজিদ থেকে। জুম্মাবারে একটু আগে না গেলে মসজিদে যুতমতো জায়গা মেলে না। আবার বেশী আগে গেলেও কাজের অসুবিধা হয়। তার পছন্দ মাঝামাঝি জায়গা।

যখন যে মসজিদে নামাজ পড়ে তার পুরো চেহারা ভালো করে দেখে নেয় আগেভাগে। প্রতি শুক্রবার নতুন নতুন মসজিদে নামাজ পড়তে যায় পেয়ারালী। শহরের প্রায় সব মসজিদে নামাজ পড়া শেষ। বড় বড় মসজিদে নামাজ পড়লে প্রাণ জুড়িয়ে যায়। আজকাল এসির বাতাসও পাওয়া যায় কোন কোন মসজিদে। বেছে বেছে বড়লোকদের দামী মসজিদগুলোতে যায় সে। ধর্মকর্মের এই জায়গাটা তার পছন্দ একটা কারণে। বড়লোকদের আর সব জায়গায় ঢুকতে সমস্যা হলেও মসজিদ ব্যাপারটা একদম আলাদা। গরীব বলে তাকে অভিজাত এলাকার মসজিদে ঢুকতে কেউ বারণ করবে না। যে কোন কাতারে গিয়ে দাঁড়াতে পারবে।

আজকে যাবে কাছের এক মসজিদে। লালখান বাজারে হাইওয়ে প্লাজার পেছনে যে একটা সুন্দর মসজিদ আছে এতদিন কেন চোখে পড়লো না। আহ, সেদিন মাগরেবের সময় চোখ জুড়িয়ে গেল দেখে। মসজিদটা ছোট, কিন্তু লোকজন দামী। অফিস ফেরত টাই কোট পরা অনেক মুসল্লী গাড়িটা মার্কেটের সামনে রেখে এখানে নামাজটা সেরে বাড়ি ফেরে।
দোতলা মসজিদটার নীচে অজুখানা। সে অজু সেরে দোতলায় পেছনের সারিতে দরোজার পাশে একটা পিলারের সামনে দাঁড়িয়ে নামাজের নিয়ত ধরলো। 

মসজিদে যতক্ষণ থাকে সে নামাজেই লিপ্ত থাকে। নইলে তাকে সামনের কাতারে যাবার জন্য তাগিদ দেবে পেছনের লোক। নামাজে থাকলে কেউ বিরক্ত করে না। সামনে বা পাশে পিলার থাকলে সবচেয়ে সুবিধা। প্রায় সব মসজিদেই পিলারের সাথে জুতার বাক্স রাখা থাকে। জুতার বাক্সের কাছাকাছি নামাজ না পড়লে ঈমানী সমস্যা হয় অনেকের। মনটা খোদার চেয়েও জুতার বাক্সের দিকে পড়ে থাকে বেশী। 

বিড়বিড় করে সুরা পাঠ অবস্থাতে সে এক ঝলক দেখলো সামনের জুতার বাক্সে একটা নতুন চামড়ার স্যাণ্ডেল ঢুকলো। দ্রুত নামাজ শেষ করে পেয়ারালী মোনাজাত ধরলো। মোনাজাত অবস্থাতেই দেখতে পেল নতুন স্যাণ্ডেলের মালিক নীল পাঞ্জাবী এদিক ওদিক তাকিয়ে বাক্সের সামনের কাতারেই বসে পড়লো। পেয়ারালী একটু ভালো করে তাকিয়ে জুতাটার শুকতলিতে এপেক্স লেখাটা পড়ে উঠে দাঁড়িয়ে আবারো নামাজের নিয়ত করে ফেলল। ইমাম সাহেব ওয়াজের ফাঁকে ফাঁকে পেছনের মুসল্লীদের বলছে সামনের খালি জায়গা পুরণ করে নিতে। আরো কঠিন মনোযোগে নামাজে ডুবে গেল পেয়ারালী।

পেছনের লোক সামনের সারি পুরণ করছে। পেয়ারালী নামাজে মগ্ন। নীল পাঞ্জাবি আরো তিন সারি এগিয়ে গেল। সবাই জায়গা পুরণ করে বসে গেল। পেয়ারালীর নফল নামাজ শেষ হলো।

খোতবা শেষে নামাজ শুরু। ফরজ নামাজ দুই রাকাত। সেই দুই রাকাতও শেষ। মোনাজাত শেষে চাক ভাঙ্গা মৌমাছির মতো একদল লোক মসজিদ ছেড়ে পালাবার জন্য তাড়াহুড়া শুরু করে দেয়। বাকীরা সুন্নত নফল সেরে বের হয় আস্তে ধীরে। 

পেয়ারালী উঠে দাঁড়িয়ে নীল পাঞ্জাবীর দিকে তাকিয়ে বুঝলো লোকটা সুন্নতের নিয়ত করে ফেলেছে। 

একদম নিশ্চিন্ত হয়ে সে উঠে এপেক্স লেখা স্যাণ্ডেলটা হাতে নিয়ে আলগোছে ভিড়ের মধ্যে মিশে মসজিদ থেকে বেরিয়ে গেল।



অতি লোভে...

টেক্সি গন্তব্যে পৌঁছানোর পরও স্বামী স্ত্রী দুজনের ঝগড়া থামেনি। রমিজ ড্রাইভার অতিষ্ট হয়ে গাড়ি চালিয়েছে সমস্ত রাস্তা। রাস্তার যানজট, ধূম্র-ধুলো, সূর্যের তাপ, পেছনের তিক্ত কলহ সব মিলিয়ে পরিবেশটা বিষাক্ত হয়ে উঠেছিল। মুরাদপুরে বাড়ির সামনে পৌঁছালে স্ত্রীটি গটগট করে নেমে চলে গেল স্বামীকে পেছনে ফেলে। স্বামী ভাড়া মিটিয়ে হাতের ব্যাগটা নিয়ে বাসার দিকে রওনা দিলে রমিজ টেক্সি নিয়ে বাদুরতলার দিকে রওনা দিল। চরম খিদা পেটে। গ্যারেজে গাড়িটা রেখে খেয়ে একটু বিশ্রাম করে বিকালে বের হবে। গ্যারেজের কাছেই বাসা। বউ ফোন করে জানিয়েছে কই মাছ ভাজা করেছে, শহরের মধ্যে থাকলে যেন বাসায় গিয়ে খাই আজকে।

রোজার দিন, এমনিতে হোটেল-ফোটেল বন্ধ। চারটা বেজে গেছে। ইফতারের আরো অনেক দেরী। ততক্ষণ খিদে সহ্য হবে না। গাড়িটা গ্যারেজে রেখে বের হতে গিয়ে পেছনের সিটে চোখ গেল। একটা ব্যাগের হাতল দেখা যাচ্ছে সিটের পেছনে। সেই যাত্রী মহিলার ব্যাগ। ঝগড়ার তাণ্ডবে ভুলে গেছে পেছনে রাখা ব্যাগের কথা। ব্যাগটা নিয়ে রমিজ ভাবলো কী করা যায়। যে বাড়ির সামনে নামিয়ে দিয়েছে সেখানে গিয়ে ফিরিয়ে দেয়া যায়। ওর সততা দেখে নিশ্চয়ই খুশী হয়ে কিছু বকশিশও দেবে।

আগে খাওয়া হোক। খিদের সময় অন্য কিছু ভালো লাগে না। ঘরে ঢুকতে বউয়ের প্রশ্নের জবাবে জানালো ঘটনা। বউও বললো, খেয়ে উঠে ফেরত দিয়ে আইসো।

খাওয়া হলো। বিছানায় একটু গড়াগড়িও। বিকেলে বের হতে গিয়ে ব্যাগটা হাতে নিতে হঠাৎ একটা অচেনা মোবাইলের বাজনা শুনলো। বাজনাটা আসছে ব্যাগের ভেতর থেকে। চেইন খুলে দেখলো দামী একটা মোবাইল বাজছে। নিশ্চয়ই মোবাইলের মালিক এতক্ষণে হুঁশে ফিরেছে। সে মোবাইল ধরলো না। ওটা বাজতেই আছে। বাজনা অব্যাহত রেখে তার ভেতরে একটা নিষিদ্ধ কৌতুহল জাগলো ভেতরে কী আছে দেখতে। বউ রান্নাঘরে ধোয়ামোছা করছে। একটা চিরুনি, কিছু ক্লিপ, রুমাল, লিপস্টিক, ছোট আয়না, এরকম হাবিজাবি জিনিস। পাশের আরেক কম্পার্টমেন্টে লাল একটা বাক্স। দেখে বুকটা ধ্বক করে উঠলো তার। এই বাক্স তার চেনা। জুয়েলারীর দোকানের বাক্স। বাক্সটা দ্রুত খুললো এবং দেখে চোখ কপালে উঠলো। একটা ভারী গলার হার, দুটো বালা, কানের দুল, চুড়ি ইত্যাদি নানান গহনা। দেখে মনে হচ্ছে স্বর্ণ। কত ভরি হবে আন্দাজ করতে পারলো না।

মোবাইলটা বাজতে আছে তখন থেকে। বউ রান্নাঘর থেকে এসে বললো, ‘ফোনটা ধরো, তারা নিশ্চয়ই ফোন করছে, আহারে। ধরে কও তুমি যাইতেছ এখনি’।
‘না!’
‘না মানে?’
‘যাবো না’
‘কেন?’
‘এই দেখো’, বলে রমিজ সোনার গহনাগুলো বউয়ের সামনে মেলে ধরলো।

মালেকা জীবনেও এতগুলো গহনা কোথাও দেখেনি চোখের সামনে। তার চোখ দিয়ে বিস্ময় আর ভয় দুটোই। এখন কী হবে? সে তো কোন অপরাধ করেনি। তবু ভয় লাগছে কেন। রমিজের ‘না’ শুনে ভয়? সে তো ব্যাগটা ফিরিয়ে দিতে চায়। রমিজের ‘না’ শুনে ভয় করছে কেন? সে কি রমিজের ‘না’ এর সাথে একমত হয়ে গেছে মনে মনে?

মোবাইলটা বন্ধ করে রমিজ আর মালেকা গুম হয়ে বসে থাকলো কিছুক্ষণ। তারপর ব্যাগটা টেনে নিল কাছে। ব্যাগটা হাতিয়ে আরো হাজার দশেক নগদ টাকা মিললো। ছোট পকেটে ছিল টাকাগুলো। সাথে একটা দোকানের মেমো। একটা টেইলার্সের রসিদ। ঈদের জামা সেলাই করতে দিয়েছিল বোধহয়।

মোবাইল থেকে সিম খুলে ফেলে দিল। রমিজ জানে সিম থাকলে ধরা পড়ার সম্ভাবনা। সে কোন সম্ভাবনার ছিটেফোঁটা বাকী রাখতে চায় না। সেই সন্ধ্যাতেই ফোনটা বিক্রি করে দিল এমন এক জায়গায় যেখানে ওকে কেউ চেনে না। এবার নিশ্চিন্ত। বুকের মধ্যে চরম ফূর্তি লাগতেছে। এবার জমজমাট ঈদের বাজার হবে। জীবনে পয়লাবারের মতো ঈদের আনন্দ আসতেছে ফূর্তির জোয়ার হয়ে।

ঈদের কয়েকদিন বাকী। ধুমিয়ে কেনাকাটা করেছে দুজনে মিলে। গ্রামে থাকা বাবা মা ভাইবোনের জন্যও জামা কিনে পাঠিয়ে দিল। অসুখের ভাণ করে কদিন গাড়ি নিয়ে বের হয়নি। মালিক অবাক, দিন চলবে কী করে তোর? সে গ্যারেজের মালিককে বললো, কিছু টাকা ধার দেন চাচা। শরীরটা সারুক। ঈদের পর পুষিয়ে দেবো। বিশ্বাসী পুরোনো ড্রাইভার সে। সহজেই ধার মিললো।

এই ঘটনা কাকপক্ষীও জানে না। শুধু বশিরকে বলেছিল একটা ব্যাগ পাইছি, ভেতরে কয়েকশো টাকা আর একটা জামার রসিদ ছিল। রাস্তার মোড়ে নেমে গেছে, খুঁজে পাইনাই আর।

বশির শান্ত্বনা দিয়ে বললো, ‘থাক মন খারাপ করিস না। তোর চেষ্টা তুই করছিস। গরীবরে এভাবেই সাহায্য করে ভাগ্য’। সে আরো পাল্টা বুদ্ধি দিল, ‘জামার রসিদ দিয়ে ভাবীর ঈদের কাজ হয়ে যাবে’।

রমিজ বুদ্ধিটা নিল। মালেকার জন্য তিনটা জামা কিনেছে সে। কিন্তু এইটা একটু অভিজাত দোকানের জামা। মাগনা পেয়ে গেলে ক্ষতি কী? সে বললো ঈদের আগে একদিন ওই টেইলার্সে গিয়ে জামাটা নিয়ে আসতে হবে। বশির বললো, কোন ব্যাপার না। আমারে দিস, আমি নিয়ে আসবো।

ঈদের দুদিন আগে বিকেলবেলা বশির শপিং কমপ্লেক্সের দোকানটায় গেল। খুব ভিড় দোকানে। ওরা রসিদ দেখলো, তারপর বশিরের চেহারার দিকে তাকালো। বশির তাড়াতাড়ি জানালো, স্যারে একটু বিজি আজকে, আমারে নিয়ে যেতে বললো।

টেইলার্সের কর্মচারী এদিক সেদিক জামাটা খুঁজে না পেয়ে বললো, এখনো কাজ বাকী আছে একটু। ঘন্টাখানেক পরে আসেন।

বশির ইফতারের পর গেল। মার্কেট একটু ফাঁকা এখন। কাজ হয়ে গেছে বোধহয় এতক্ষণে। বশির দোকানে ঢুকে রসিদটা কাউন্টারে রাখলো। কাউন্টারের লোকটা ফোনে কথা বলছিল, তাকে দেখে একটু আড়ালে চলে গেল। বশির দাঁড়িয়ে আছে। বাকী কর্মচারীরা ইফতার সেরে ঝিম মেরে বসেছিল। হঠাৎ কয়েকজন লোক হুড়মুড় করে দোকানে ঢুকে তাকে ঘিরে কিল ঘুষি লাথি মারতে শুরু করলো। সে বুঝলো ঘটনা খারাপ। দৌড়ে পালাতে চেষ্টা করলো, কিন্তু ততক্ষণে তাকে মেরে শুইয়ে দেয়া হয়েছে। একসাথে বিশ ত্রিশজন মার শুরু করলে তার ভয় ধরলো, সে বললো, আমি না, আমি না, সব রমিজের কাজ। আমারে পাঠাইছে রমিজ। আমি কিছু জানি না ভাইসব, আমারে মাফ করেন। কিন্তু লোকজন প্রথম কিস্তির মার তার উপর দিয়েই চালালো।

ভিড় থেকে একজন এসে কলার চেপে তাকে দাঁড় করালো। বললো, ওই হারামীর বাচ্চা স্বর্ণ কই? টাকা কই? মোবাইল কই? জলদি বল হারামজাদা। এখনি বল, নইলে মেরে ফেলবো তোকে আজ।

বশির আকাশ থেকে পড়লো এবার। রমিজ তো আর কিছু বলেনি তাকে। তার মানে ওই হারামজাদা সবকিছু সরিয়েও এই জামার উপর লোভ ছাড়তে পারেনি? রমিজের উদ্দেশ্যে কুৎসিত একটা গালি আসলো তার মুখেও। সে তখন বললো, ভাই আমারে একটু বলার সুযোগ দেন। তারপর আপনাদের যা বিবেচনা।

সে যতটুকু জানে ততটুকু বললো সমবেত জনতাকে। সরোয়ার নামের সেই ভদ্রলোক যার বউয়ের স্বর্ণ চুরি হয়েছে তিনি সবটুকু শুনে বললেন, তোকে মাফ করতে পারি এক শর্তে। তুই এখন ফোন করে তোর দোস্তকে এখানে আসতে বলবি। বলবি জামা ডেলিভারী নেয়া হয়েছে। সে যেন এসে নিয়ে যায় মার্কেটের সামনে থেকে। কোন চালাকি করলে মরবি।
বশির এক কথায় রাজী। সে নিজেও ক্ষিপ্ত রমিজ হারামজাদার উপর। সে রমিজকে ফোন করে মিষ্টি গলায় আসতে বললো।

রমিজ এসে টেক্সি থেকে মার্কেটের সামনে নেমে একটা সিগারেট ধরিয়ে ভাবলো, বশিরাকে আজ বিরানী খাওয়াতে হবে। ব্যাটা একটা বাঘের বাচ্চা। কত সহজে এই কাজটা করে দিল। মনে মনে খিকখিক করে হাসতে লাগলো।

কিন্তু হাসিটা বেশী সময় থাকলো না। মাথার উপর আস্ত একটা বাজ নেমে আসলো হঠাৎ করে এবং তাকে ছোঁ মেরে তুলে নিল। পার্কিং এলাকায় ওঁত পেতে দাঁড়িয়ে থাকা পুলিশের গাড়ি সে খেয়াল করেনি, খেয়াল করলে দেখতে পেতো বশির পুলিশের গাড়ির ভেতর বসে আছে।

জেল হাজতে বসে রমিজ ভাবতে লাগলো, ওই একটা বড়লোকী জামা না হলে মালেকার ঈদে এমন কী ক্ষতি হতো? আর বশির হারামজাদা!!

Thursday, August 11, 2016

বিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্র বসুর একমাত্র বাংলা পুস্তক - 'অব্যক্ত'.......পাঠমুগ্ধ প্রতিক্রিয়া

জগদীশ চন্দ্র বসু যে নিউটন ও গ্যালিলিওর সমতূল্য বিজ্ঞানী ছিলেন তাঁর জীবদ্দশাতেই বলেছিল লণ্ডনের ডেইলি মেইল ১৯২৭ সালে। আর আইনস্টাইন নিজের মুখেই বলেছেন - 'জগদীশচন্দ্র যেসব অমূল্য তথ্য পৃথিবীকে উপহার দিয়েছেন তার যে কোনোটির জন্যই বিজয়স্তম্ভ স্থাপন করা উচিত।'

কিন্তু শুরুর পথটা খুবই জটিল বাধাবিঘ্নে পরিপূর্ণ ছিল। স্বদেশে পাত্তা পাননি, বিদেশেও পেয়েছেন অঢেল অবজ্ঞা। তবু তিনি থামেননি। শিক্ষাজীবনটাও ছিল অনির্দিষ্ট লক্ষ্যের দিকে ধাবমান। বিএ পাশ করার পর তিনি চেয়েছিলেন আইসিএস পাশ করে জজ ম্যাজিস্ট্রেট হবেন বাপের মত। তাঁর পিতা ভগবানচন্দ্র ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন। কিন্তু পিতা চাইলেন তিনি কৃষিবিদ্যা নিয়ে পড়ে দেশ সেবা করবেন। পরে ডাক্তারে পড়ার উদ্দেশ্যেই ইংল্যাণ্ডে গিয়ে অসুস্থতার জন্য ডাক্তারিবিদ্যায় ইস্তফা দিয়ে প্রকৃতিবিজ্ঞানে পড়াশোনা করেন এবং লণ্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএসসি ডিগ্রি নিয়ে দেশে ফিরে কলকাতায় প্রেসিডেন্সি কলেজে পদার্থবিজ্ঞানে অধ্যাপনার কাজে যোগ দেন ১৮৮৫ সালে।

শিক্ষকতা করলেও তাঁর লক্ষ্য ছিল অনেক দূরের দিগন্তে। তিনি শিক্ষকতার পাশাপাশি গবেষণাকর্ম শুরু করেন অভিনব কিছু বিষয়ে যা ইতিপূর্বে কোন ভারতীয় করতে সাহস করেনি। বৈদ্যুতিক তরঙ্গ বিষয়ে তাঁর গবেষণাকর্মের হাতিয়ার ছিল নিজের বেতনের টাকায় নিয়োজিত দেশীয় মিস্ত্রিদের হাতে গড়া যন্ত্রপাতি। সেই গবেষণার ফলাফল যখন ইংল্যাণ্ড পর্যন্ত পৌঁছায় তখন প্রথমদিকে তা কিছু বাধার সম্মুখীন হলেও পরবর্তীতে খোদ রয়েল সোসাইটি তাঁকে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়। তাঁর বক্তৃতা শুনতে লাঠিতে ভর দিয়ে চলে এসেছিলেন বিখ্যাত বিজ্ঞানী লর্ড ক্যালভিন। এই একশো বছর পরও সারা দুনিয়াতে টেলিকমিউনিকেশনের যেসব অভিনব সুযোগ সুবিধায় বিস্তৃতি দেখতে পাই, তার ভিত্তি তৈরী করে দিয়েছিলেন জগদীশচন্দ্র বসু। আমি নিশ্চিত অধিকাংশ বাঙালী তাঁর এই কৃতিত্ব সম্পর্কে জানে না। তাঁর নামটা 'গাছের প্রাণ আবিষ্কারক' ধরণের ভাসা ভাসা ধারণায় সীমাবদ্ধ হয়ে আছে।

মজার ব্যাপার হচ্ছে তিনি কিন্তু গাছের প্রাণ আবিষ্কার করেননি, ওটা বহু শত বছর আগ থেকেই মানুষ জানতো। তিনি যা আবিষ্কার করেছিলেন তা মূলত গাছের অনুভূতি জগতের বিষয় আশয় সম্পর্কিত ব্যাপার। গাছের বৃদ্ধি পরিমাপ করার একটি যন্ত্র আবিষ্কার করেছিলেন এই অনুভূতিগুলো প্রমাণ করার জন্য।  যন্ত্রটির নাম ক্রেসকোগ্রাফ (Crescograph) । এটা দিয়ে উদ্ভিদের অতি সুক্ষ্ণ পরিবর্তন/ বৃদ্ধি পরিমাপ করা যায়। এক ইঞ্চির এক লক্ষ ভাগের এক ভাগ পরিবর্তনও এই যন্ত্রে দৃশ্যমান হয়।

তিনি একবার একটা গাছ পরীক্ষা করার সময় দেখতে পেলেন যে গাছটি মিনিটে এক ইঞ্চির লক্ষ ভাগের ৪২ ভাগ বৃদ্ধি পাচ্ছে। তিনি গাছটিকে একটা বেত দিয়ে আঘাত করলেন। সাথে সাথে গাছের বৃদ্ধি থেমে যায়। এবং সেই আঘাত ভুলে আবার বৃদ্ধি শুরু হতে আধ ঘন্টা সময় লেগেছিল। আরেকবার একটা গাছকে সুঁই দিয়ে গুঁতো দিয়ে দেখলেন গাছটার বৃদ্ধি এক চতুর্থাংশে নেমে গেছে। এক ঘন্টা পরও সে স্বাভাবিক হতে পারেনি। একইভাবে ছুরি দিয়ে চিরে দেখলেন গাছের বৃদ্ধি আরো ক্ষতিগ্রস্থ হয়। এইসব বিচিত্র পরীক্ষা নিরীক্ষা ওই ক্রেসকোগ্রাফ দিয়েই করতেন তিনি। এই যন্ত্র ছাড়াও আরো উদ্ভিদের নানান বিষয় পরীক্ষা করার জন্য অনেক বিচিত্র যন্ত্রপাতি তৈরী করেন দেশীয় কারিগর দিয়েই।

আমার বিশ্বাস জগদীশচন্দ্র বসুর আবিষ্কার ইত্যাদি নিয়ে উপরে উল্লেখ্য বিষয়ে অনেকেরই আরো ভালো জানাশোনা আছে। আমি তাই আবিষ্কার বিষয়ে না বলে তাঁর লেখা একমাত্র বাংলা বইটি নিয়ে কিছু আলোচনা করবো। এই বই জগদীশচন্দ্র বসুর জীবন, দর্শন, চরিত্র, দেশভাবনা ইত্যাদি সম্পর্কে আরো নতুন কিছু বিষয় আমাদের অবগত করে।

'অব্যক্ত' - নামের বইটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ১৯২১ সালে। বাংলাদেশে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের পুনর্মুদ্রনের সুবাদে বইটি পড়ার সুযোগ হলো সম্প্রতি। বইটি কিনেছিলাম কিছু না জেনেই। ভেবেছিলাম একজন বিজ্ঞানীর কিছু কাটখোট্টা প্রবন্ধের সংকলন।

কিন্তু পড়তে শুরু করার পর টের পেলাম, বইটি না কিনলে অনন্য সুন্দর কিছু অনুভূতি থেকে বঞ্চিত থাকতাম। তিনি শুধু বিজ্ঞানী নন, একজন সুলেখক, সুরসিক সাহিত্যিক, দার্শনিক মানবও বটে। সহজ গদ্যে বিজ্ঞানের বিচিত্র প্রবন্ধ যেমন লিখেছেন, তেমনি লিখেছেন 'পলাতক তুফান' নামক চমকপ্রদ স্যাটায়ারও। তাঁর যৌবনে ভাগীরথির উৎস সন্ধানে তিনি যে পর্বতারোহনের চেষ্টাও করেছেন সেই অভিজ্ঞতার বর্ণনাও অভিনব।

সবচেয়ে অবাক হয়েছি 'অগ্নিপরীক্ষা' রচনাটি পড়ে। 'বলভদ্র' নামে এক নেপালী সেনানায়ক ১৮১৪ সালে মাত্র তিনশোজন অনাহারী সৈন্য দিয়ে কিভাবে একটি দুর্গ এক মাস ধরে আগলে রেখেছিলেন কয়েক হাজার কামান সজ্জিত বৃটিশ সৈন্যের মোকাবেলা করে সেই বর্ণনা শিউরে ওঠার মতো। এই বিষয়ে আলাদা একটি লেখা দেয়া হবে পরবর্তীতে। বলভদ্রের এই ঘটনা কোনদিন জানা হতো না আমার, যদি জগদীশ চন্দ্র বসু না লিখতেন, কিংবা এই বইটি না পড়তাম।

তাঁর বইটিতে আরো বিচিত্র বিষয়ে অনেক লেখা আছে স্বল্প পরিসরেই। সবটুকু আলোচনা করা সম্ভব না। শুধু বিজ্ঞানের গবেষণা বিষয়ক একটি অংশ এখানে উদ্ধৃত করছি পাঠকের জন্য-

'সর্বদা শুনিতে পাওয়া যায় যে, আমাদের দেশে যথোচিত উপকরণবিশিষ্ট পরীক্ষাগারের অভাবে অনুসন্ধান অসম্ভব।........পরীক্ষাসাধনে পরীক্ষাগারের অভাব ব্যতীত আরো বিঘ্ন আছে। আমরা অনেক সময়ই ভুলিয়া যাই যে, প্রকৃত পরীক্ষাগার আমাদের অন্তরে। সেই অন্তরতম দেশে অনেক পরীক্ষাই পরীক্ষিত হইতেছে.......নিরাসক্ত একাগ্রতা যেখানে নাই সেখানে বাহিরের আয়োজনও কোন কাজে লাগে না। কেবল বাহিরের দিকে যাহাদের মন ছুটিয়া যায়, সত্যকে লাভ করার চেয়ে দশজনের কাছে প্রতিষ্ঠা লাভের জন্য যাহারা লালায়িত হইয়া উঠে, তাহারা সত্যের দর্শন পায় না।....দ্রুতবেগে খ্যাতিলাভ করিবার লালসায় তাহারা লক্ষ্যভ্রষ্ট হইয়া যায়।'

তাঁর এই পর্যবেক্ষণ বাঙালীর চরিত্রের জন্য এখনো শতভাগ প্রযোজ্য। বাঙালী এই মহান চরিত্রের সত্যতা বুকে ধারণ করিয়া শত শত বছর ধরিয়া অপরিবর্তনীয় রূপে বিরাজ করিতেছে।

Wednesday, August 10, 2016

গুরুদেব, মিলুর জন্য একটা চাকরী দেবেন?

জীবননান্দ দাশ চিরকাল আর্থিক অনটনে কাটিয়েছেন, একটি চাকরীর জন্য হন্যে হয়ে ঘুরেছেন, কোথাও সুস্থির হতে পারেননি, জীবনীগ্রন্থের এই অংশটা আমাকে ব্যক্তিগতভাবে খুব পীড়া দেয়। আমি একটি হিসেব কিছুতে মেলাতে পারি না। সেই আমলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রী নিয়ে একজন মানুষ জীবন ধারণের মতো চাকরী জোটাতে পারছেন না, কেমন অবিশ্বাস্য লাগে। চাকরী পাননি তা নয়, কিন্তু চাকরী টিকিয়ে রাখতে পারেননি। বারবার তাঁকে চাকরী বদলাতে হয়েছে।

এম এ পাশ করার পর থেকে জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তিনি যেসব চাকরী করেছেন তা এরকম-
সিটি কলেজ, কলকাতা (১৯২২-১৯২৮), বাগেরহাট কলেজ, খুলনা (১৯২৯); রামযশ কলেজ, দিল্লী (১৯৩০-১৯৩১), ব্রজমোহন কলেজ, বরিশাল (১৯৩৫-১৯৪৮), খড়গপুর কলেজ (১৯৫১-১৯৫২), বড়িশা কলেজ (অধুনা 'বিবেকানন্দ কলেজ', কলকাতা) (১৯৫৩) এবং হাওড়া গার্লস কলেজ, কলকাতা (১৯৫৩-১৯৫৪)। এর মধ্যে ১৯৩১ থেকে ১৯৩৫ কোন চাকরি করেননি সম্ভবতঃ। এই সময়টা পুরোটাই সাহিত্য করেছেন। সম্ভবতঃ তিনি গদ্য সাহিত্য প্রচেষ্টা শুরু করেছিলেন আয় করার ইচ্ছে থেকেই। কিন্তু সেই সাহিত্য তেমন ফলদায়ী হয়নি। তিনি সেইসব গদ্য কোথাও প্রকাশ করেননি জীবদ্দশায়। কেন প্রকাশ করেননি? তাঁর সেই গদ্য কি মানসম্পন্ন মনে হয়নি নিজের কাছে? জানা হবে না কখনো।

অন্যদিকে বয়সে তাঁর চেয়ে ৪০ বছর এগিয়ে থাকা রবীন্দ্রনাথ তখন সমগ্র বিশ্বে পরিচিত একটি নাম। জীবনানন্দ দাশ যখন দিল্লীর রামযশ কলেজ থেকে চাকরীচ্যুত হয়ে ফিরে এসেছেন, তখন রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতন আলো করে আছেন ৭০ বছর বয়সেও। ব্যস্ততার এতটুকু কমতি নেই। দেশ বিদেশের সাহিত্য সংস্কৃতির জগতও ঘুরছেন, রাজা মহারাজার নিমন্ত্রণও রক্ষা করছেন। শান্তিনিকেতনেও বিশ্বের নানান দেশ থেকে নানান প্রকৃতির মানুষ এসে শিক্ষা নিচ্ছে, শিক্ষা দিচ্ছে, কাজ করছে। শান্তিনিকেতন সবার জন্য উন্মুক্ত একটি শিক্ষালয়। রবিঠাকুর সেই অভিনব শিক্ষা নিকেতনের গুরু। নামযশের সাথে হাতযশেরও কমতি নেই তাঁর। উদার হাতে তিনি জ্ঞান, ধন, সুযোগ, মহত্ব বিলোচ্ছেন মানুষের মাঝে।

রবীন্দ্রনাথ ও জীবনানন্দ, দুই ধারার দুই কবিই আমার বিশেষ প্রিয়। কে বেশী প্রিয় সেই প্রসঙ্গ অবান্তর। আনন্দ বেদনার প্রিয় সঙ্গী তাঁদের সৃষ্ট সাহিত্যকর্ম। তাঁদের সৃষ্টি না থাকলে কার কবিতা নিয়ে জীবনের অপার সব বেদনা ভুলে থাকতাম, তা বলা মুশকিল। এই দুই কবির কথা একসাথে ভাবতে গেলে একটি উর্বর চিন্তার উদ্ভব ঘটে।

জীবনানন্দ এত কঠিন জীবন কাটাচ্ছেন, তখন রবীন্দ্রনাথ জীবিত এবং প্রবল প্রতাপে প্রতিষ্ঠিত। জীবনানন্দ কি কখনো রবীন্দ্রনাথের কাছে যেতে পারতেন চাকরীর ব্যাপারে? শান্তিনিকেতনে কত মানুষের চাকরী হয়েছে, কতো জীবন কেটে গেছে, তাঁর জন্যও একটা ব্যবস্থা হতে পারতো না? জীবননানন্দ দাশকে কি রবিঠাকুর ফিরিয়ে দিতেন? একজন জীবনানন্দের যদি ঠাঁই হতো শান্তিনিকেতনের একটা কুটিরে জীবনের সব দুষ্ট ক্ষতি পুষিয়ে নিজেকে গুছিয়ে নিতে পারতেন তিনি। পারতেন না?

রবীন্দ্র জীবনী পড়ে মনে হয়েছে তাঁর কাছে যে কেউ পৌঁছাতে পারতো। তিনি কঠিন আড়ালের মানুষ ছিলেন না। সহজতাই তাঁর চরিত্রের অন্যতম একটা বৈশিষ্ট্য। তাঁর এত জনপ্রিয়তার মূলে আছে সেই বৈশিষ্ট্য। সাহিত্যে যেমন, জীবনেও তেমনি। প্রভাতকুমার, প্রমথনাথ বিশী, প্রমথ চৌধুরী, রানীচন্দসহ আরো বেশ কজনের স্মৃতিচারণে তা স্পষ্ট। চাইলে জীবনানন্দ তাঁর সাথে সহজেই দেখা করতে পারতেন এবং বলতে পারতেন সমস্যার কথা। যে পঞ্চপাণ্ডবের দলে তিনি ছিলেন(বুদ্ধদেব বসু, অমিয় চক্রবর্তী, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, বিষ্ণু দে, জীবনানন্দ দাশ) তাদের কেউ কেউ রবিঠাকুরের কাছের মানুষ ছিলেন। তবু তিনি সে পথে যাননি। কেন যাননি? আত্মসম্মানবোধ? নাকি আত্মসংকোচ? প্রবল অন্তর্মূখী জীবনানন্দ দাশ নিজের যোগ্যতা নিয়ে যথেষ্ট আত্মবিশ্বাসী ছিলেন না। সুযোগ সন্ধানী ছিলেন না। দুঃখকে গিলে খেয়ে জীবনধারণ করেছেন আর বিষাদের কবিতায় তা উগড়ে গেছেন বছরের পর বছর। তাঁর সবগুলো কবিতাই জীবনের চরম বেদনাদায়ক একেকটা অভিজ্ঞতার নির্ঝাস।

এই ভাবনাটা আমার নিজের। জীবনানন্দ নিশ্চয়ই এমন করে ভাবেননি কোনদিন। যদি ভাবতেন তিনি কি তাঁর জীবনকে আরেকটু সুখী সন্তুষ্ট করতে পারতেন না? যদি সুখী সন্তুষ্ট একটি জীবন পেতেন, নির্জনে বসে নিরুপদ্রপ সময় উপভোগ করতেন, তাহলে কেমন সাহিত্য হতো সেটা? প্রবল দুঃখ ও বেদনাবোধের যে কবিতাগুলো তিনি লিখেছেন, সেই কবিতাগুলো কি লেখা হতো? যদি লেখা না হতো তাহলে আজকে আমরা যেমন রবিঠাকুর ও জীবনানন্দ দাশকে পাশাপাশি রেখে আলোচনা করছি, সেই মর্যাদায় আসীন হতেন? নাকি নেহাত আরেকজন শান্তিনিকেতনের নির্জীব অধ্যাপক হিসেবে অবসর নিয়ে শান্তিপূর্ন জীবন শেষে পরপারে চলে যেতেন। আমরা হয়তো তাঁর নামও খুঁজে পেতাম না সাহিত্য অঙ্গনের মহাসড়কে। সেইটা কি ভালো হতো?

হ্যাঁ, এই দিকটা ভাবলে মনে হয় তাঁকে রবিঠাকুরের কাছে চাকরীর জন্য পাঠানো ঠিক হতো না। তিনি এখন নিজের দারিদ্র দিয়ে সাহিত্যের সাম্রাজ্যের অধীশ্বর হয়েছেন সেই মর্যাদা থেকে তিনি বঞ্চিত থাকতেন। কোন সন্দেহ নেই, আমরা আমাদের সাহিত্যে একজন জীবননান্দে প্রয়োজনীয়তা খুব অনুভব করি। জীবনানন্দ আমাদের বেদনাগুলো তাঁর নিজস্ব রক্তক্ষরণের ধারা দিয়ে লিখে গেছেন, আমরাও তা থেকে বঞ্চিত হতাম। জীবনানন্দের দুঃখভরা জীবনটা আমাদের সাহিত্য উপভোগের অনুকুল পথেই হাঁটে।
 
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও জীবনানন্দ দাশ এই সময়ে এসে বাংলা সাহিত্যের দুই দিকপাল। তাঁদের নিয়ে উচ্চশিক্ষিত সাহিত্য বোদ্ধামহলে জ্ঞানগর্ভ আলোচনা চলে পাশাপাশি। কিন্তু তাঁদের জীবদ্দশায় কী এই দৃশ্য কল্পনাও করা যেতো? সেই সময়ে দুজনের মধ্যেকার দূরত্ব ছিল যোজন যোজন। রবীন্দ্রনাথ ও জীবনানন্দের তুলনামূলক কোন আলোচনা হতে পারে সেটা স্বপ্নেরও অগম্য ছিল তখন। একজন জগত আলোকিত করা বিশ্বকবি, সারা পৃথিবীতে দৃপ্ত পদচারণা যার। আরেকজন বরিশাল কোলকাতায় খুব কায়ক্লেশে পরিবার নিয়ে জীবনধারণ করতে হিমশিম খেয়ে যাচ্ছেন। মাঝে মাঝে কিছু কবিতা লিখে পত্রিকায় পাঠাচ্ছেন, সমালোকদের চাবুকে ক্ষতবিক্ষত হচ্ছেন, এমনকি অসঙ্গত কবিতা লেখার দায়ে চাকরীচ্যুত হচ্ছেন।

কী অদ্ভুত বৈপরীত্যে ভরপুর আমার দুই প্রিয় কবির জীবন। যদি সাধ্য থাকতো তাহলে বলতাম, তোমরা যদি আরেকটু কাছাকাছি হতে পারতে। জীবনানন্দ যে কি  বিপুল বেদনা নিয়ে জীবন কাটাচ্ছে তা রবিঠাকুরকে জানাবার কেউ ছিল না। অমিয় চক্রবর্তীর সুযোগ ছিল, তিনি দীর্ঘকাল রবীন্দ্রনাথের সেক্রেটারী ছিলেন, তিনি জানতেন জীবনানন্দ কী দুর্দশায় জীবন কাটাচ্ছে। তিনি কি কখনো এভাবে ভেবেছিলেন? ভাবেননি। আসলে তখন কেউই তাঁকে নিয়ে সেভাবে ভাবেননি। কেননা তখন কেউ জানতেন না কবি জীবনানন্দ দাশ একদিন বাংলাসাহিত্যে মহীরূহ হয়ে উঠবেন। মৃত্যুর ত্রিশ বছর পর জীবনানন্দ ও রবিঠাকুর এক টেবিলে আলোচিত হবার মতো সম্মান লাভ করবেন।

যদি জানতেন, তাহলে কেউ না কেউ নিশ্চয়ই রবিঠাকুরকে গিয়ে বলতেন, গুরুদেব, মিলুর জন্য একটা চাকরী দেবেন শান্তিনিকেতনে?

[**মিলু, জীবনানন্দ দাশের ডাক নাম]

কাছের বাড়ি, দূরের বাড়ি- নিজের বাড়ি, পরের বাড়ি

আমার বাড়ি কোনটি? যেখানে আমি বাস করি বর্তমানে? নাকি যেখানে আমার নাড়িপোতা আছে পূর্বপুরুষের রক্তে? বাড়ি বিষয়ক অনুভুতিসমূহে আমি খুবই আপেক্ষিক আবেগ অনুভুতিতে ভাসি এবং এটা সময় পরিস্থিতি ভেদে ভিন্ন ভিন্ন দিকে প্রবাহিত হয়। বাল্যকাল থেকেই আমি আগ্রাবাদ এলাকার বাসিন্দা ছিলাম, গ্রামের বাড়ির চেয়ে ওই এলাকার প্রতি আমার জানাশোনা বেশী, সঙ্গতকারণে আমার বাড়ির প্রতি টান বলতে আমি আগ্রাবাদের প্রতি টান বুঝতাম। ভাবতাম ওই টানটা চিরন্তন। ওখানেই কাটাবো চিরকাল। ধূ ধূ ধানখেত চিরে তৈরী হওয়া মহাসড়কটি যখন ব্যস্ত হয়ে ওঠেনি, তখনকার সবুজ নির্জনতার মাঝে বাস করে বলতাম, এখানেই আমি গড়ে ফেলেছি আমার ঠাঁই। এটা ছেড়ে নতুন কোন জায়গায় যাবো না কখনোই।

কিন্তু অপ্রত্যাশিত এক পরিস্থিতিতে সেই বাড়িটা ছেড়ে দিতে হয় এক দুপুরে। তারপর থেকে গত ৮ বছর ধরে বাস করছি নতুন এলাকা কাজির দেউড়িতে। নতুন এলাকায় আসার পর থেকে অবাক হয়ে দেখলাম আমার বাড়ি ফেরার টানটা আর আগ্রবাদমুখী নেই। যে বাড়িতে ফেরার জন্য প্রতিদিন হন্যে হয়ে থাকতাম, সেটা এখন কাজির দেউড়ির দিকে ঘুরে গেছে। তার মানে যেখানে আমার পরিবার বাস করে সেটাই আমার বাড়ি। বাড়ি বলতে দালানকোটা নয়, বাড়ি হলো পরিবার।

'বাড়ি ফেরা'র এই ব্যাপারটা একেবারে আপেক্ষিক। আমি যখন ঢাকা যাই তখন ফেরার পথে চট্টগ্রামের সীমানায় প্রবেশ করলেই মনে হয় এই তো আমার বাড়ি চলে এসেছে। বিদেশে গেলে ফেরার পথে প্লেন যখন বাংলাদেশ সীমানায় প্রবেশ করে তখনই মনে হয় এই তো, বাড়ি ফিরে এলাম। আকাশ থেকে বাংলাদেশের নদী নালা মাঠ ঘাট যাই দেখি তাকেই মনে হয় আমার অতি নিকটজন।

সবচেয়ে মজার ব্যাপার ঘটেছিল সড়কপথে ভারত যাবার পর। রুট ছিল চট্টগ্রাম-ঢাকা-কোলকাতা-দিল্লী-সিমলা এরকম। সিমলা থেকে ফেরার পথে একটা ঝামেলা হয়ে যায়। যেদিন ফিরবো সেদিনের ট্রেনটা মিস করে ফেলি। হোটেল ছেড়ে রাস্তায় নেমে অচেনা অজানা বন্ধুহীন অবাঙালী জায়গায় রাতের বেলা কেমন অনুভুতি হয় সেটা বোধগম্য নিশ্চয়ই। তারপর অনেক ঘাম ঝরিয়ে, হোটেল ম্যানেজারের সহায়তায় একটা গাড়ি ভাড়া করে ১০০ কিলোমিটার দুর্গম পাহাড়ি পথ অতিক্রম করে মাঝরাতে এসে যখন কালকা পৌঁছালাম, তখন মনে হলো সত্যিই বাড়ির পথে একটু হলেও এগিয়ে গেলাম। কালকা আসার পর মনটা অনেকখানি হালকা হয়ে গেল। এই তো এখান থেকে ছাড়বে দিল্লীর ট্রেন। দিল্লী আমার দেশ থেকে বহুদূরের একটা শহর। তবু মনে হলো আপাতত দিল্লীটাই আমার কাছের একটা বাড়ি। যে শহর  একটুখানি চিনি, একটা গলির একটা হোটেলে আছে আমাদের ঠাঁই। সারারাত যাত্রা করে ভোরবেলা যখন দিল্লীর স্টেশানে নামলাম, মনে হলো নিজের দেশে ফিরলাম। চেনা শহর মনে হলো সুদূর দিল্লীকেও।

আবার দিল্লী থেকে যখন কোলকাতার ট্রেনে উঠলাম, তখন অন্য এক বাড়ি ফেরার আনন্দ। কোলকাতাকে দিল্লীর চেয়ে আপন লাগে। নিজের ভাষায় ইচ্ছেমতো কথা বলার স্বাধীনতা। শিয়ালদা নেমে প্রবল আত্মবিশ্বাসের সাথে যখন টেক্সির দরদাম করছি তখন মনেই হচ্ছে না আমি অন্য দেশে আছি। টেক্সিতে যখন এসে মারকুইস স্ট্রিটে এসে নামলাম, তখন মনে হলো নিজের পাড়া। এখানে মাত্র দুদিন ছিলাম। তবু হোটেল, রাস্তা, টেক্সি, ট্রাম সব যেন আপন করে ডাকলো। ওই তো কস্তুরি হোটেল, যেখানে আমার প্রিয় খাবারের আয়োজন করা থাকে। সত্যি বলতে কি আমি বাংলাদেশেও এতখানি আনন্দ পাইনি রেস্তোরায় খেয়ে। কস্তুরির খাবার ছিল অমৃতসমান। সে যেন আমার পাড়ারই হোটেল।

শুধু কী তাই। ট্রামে চড়ে দিব্যি পৌঁছে গেলাম কলেজ স্ট্রিট। প্রেসিডেন্সি কলেজ, কফি হাউস, যেন অনেক কালের চেনা। কী অসাধারণ আনন্দ বাংলায় হাসতে মাততে। তারপর কোলকাতা থেকে বাসে চেপে যখন বেনাপোল বর্ডারে পৌঁছালাম তখন তো একেবারেই নিজের দেশ। বেনাপোল থেকে ঢাকা হয়ে চট্টগ্রাম পৌঁছে গেলাম এক রাতের ভ্রমণেই।

এবার সত্যি সত্যি বাড়ি ফেরা হলো। এবং এই বাড়িটা হলো পরিবার। যেখানে পরিবার থাকে, সেটাকেই বাড়ি বলে ভাবি আমরা। পূর্বপুরুষের গ্রামকে আমরা বাড়ি বললেও পরিবারের কেউ সেখানে থাকে না বলে তাকে আমরা ঠিক 'বাড়ি'র মর্যাদা দিতে পারি না। ওখানে আমরা স্বল্প সময়ের অতিথি মাত্র।  আমাদের শেকড় গেঁথে আছে পরিবারের বন্ধনেই। ওটাই আমাদের বাড়ি। ওখানেই আমরা ফিরি। বাড়ি ফেরাকে তাই পরিবারের কাছে ফেরা বলেই মনে করি।


অকাজের পড়াশোনা অপচয় নিদারুণ!

- ভাতিজা নাকি চাকরি বাকরি সব ছেড়ে বেকার? আমার এক বন্ধুর কোম্পানী তোমার মতো একজনকে খুঁজছে। তুমি রাজী থাকলে আমি বলে দেখবো। লাখ দেড়েকের মতো দেবে। সার্বক্ষণিক গাড়ি, ড্রাইভার  সব আছে।

- না চাচা, কর্পোরেট চাকরি আর করবো না বলেই তো ছাড়লাম। তবে ফ্রি ল্যান্সার হিসেবে চুক্তিভিত্তিক ছোট্ট একটা কাজ করি অনলাইনে। দৈনিক চার পাঁচ ঘন্টার কাজ। তারপর বাকী সময় পড়াশোনা এবং নিজের অন্য কাজে কাটাই।

- কী সর্বনাশ! চার ঘন্টার কাজ করে জীবন চলবে তোমার? ভার্সিটির পড়াশোনা তো শেষ করছো বিশ বছর আগে। এখন মাঝবয়সে এসে আবার কী পড়াশোনা করে সময় নষ্ট করতেছো খামাকা। আমাদের বয়সে আসলে বুঝবা সময় গেলে সাধন হয় না। এখনই ধরে নিতে হবে যতটা পারো। এই বয়সটাই হলো কামাই করার বয়স। কামাইবা আর জমাইবা, দ্বিতীয় কোন কথা নাই। এখন ঠিকমতো কামাই করতে না পারলে বুড়ো বয়সে কষ্ট পাবা।

গল্পাংশটি আংশিক সত্য। ঠিক বয়সে কামাতে না পারলে বুড়া বয়সে কষ্ট পেতে হবে। কিন্তু বুড়ো যে হতে পারবো তার নিশ্চয়তা কোথায়। দেশ বিদেশে ঘরে বাইরে শরীরে যে অবস্থা আমার ধারণা আর দশ বছর টিকে থাকাও চ্যালেঞ্জিং। সেক্ষেত্রে কামাই করে গেলেও ভোগ করার সুযোগ নেই। সুতরাং সেই দশ বছর বরং পড়াশোনার সময়টা বাড়িয়ে নেয়া যাক। এখন লেখালেখি বা পড়াশোনার ব্যাপারটা কি কাজের পর্যায়ে পড়ে কিনা। যারা পেশাদার লেখিয়ে তাদের জন্য এটা একটা কাজ। তাদের আয় আছে। আমি লিখে বা পড়ে কোন আয় করি না, সেজন্য আমার ক্ষেত্রে এটা কাজ না। তার মানে কাজের সাথে আয়ের সম্পর্কই সবচেয়ে গভীর। যা করলে দুপয়সা আয় রোজগার করা যায়, সেটাই কাজ। অধিকাংশ মানুষ তাই ভাবে। অধিকাংশ মানুষ পড়াশোনাকে কোন কাজ মনে করে না


তাই কি?

মানুষের শরীরের দুটো অংশ দেহ আর মন আমরা দেহের খোরাকের জন্য, জৈবিক আনন্দের জন্য টাকা পয়সার সন্ধান করি এর ফাঁকে ফাঁকে মনের আনন্দ মেটানোর জন্য কেউ কেউ বিনোদনের সঙ্গী হই


বিনোদন কি

বিনোদন হলো মনের খোরাক খাদ্য যেমন পেটের খোরাক আমাদের শুধু পেটের খোরাক হলেই চলে না শরীর  ঢাকার জন্য যে জামাকাপড় সেটাও দেহের বাহ্যিক খোরাকই এরপর দেহকে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় স্থানান্তরের যে কাজ, সেটার জন্য যানবাহন লাগে, ওটা দেহের প্রয়োজনেই। শরীর অসুস্থ হলে ডাক্তারের কাছে ছুটি ওটাও দেহের প্রয়োজনে


দেখা যায় আমাদের জীবনের অধিকাংশ কর্মসূচী দেহকে সন্তুষ্ট রাখতেই মনকে সন্তুষ্ট করা আমরা গুরুত্বপূর্ন মনে করি না ওটাকে প্রধান কর্মসূচিতে না রেখে ঐচ্ছিক কর্মসূচীতে অন্তর্ভুক্ত করি


মনের খোরাক কী কী?

আনন্দের যত কাজ সবই মনের খোরাক, হতে পারে সিনেমা দেখা, হতে পারে গান শোনা, হতে পারে ভ্রমণ করা, বই পড়া, বাগান করা কিংবা লেখালেখি করা মনের খোরাকের কোন সীমা পরিসীমা নেই


প্রায় সব মানুষই দেহের খোরাক মেটানোকেই জরুরী মনে করে এবং দেহের খোরাক মিটিয়ে প্রয়োজনের চেয়ে অতিরিক্ত মনোযোগী হতে গিয়ে এতখানি ব্যস্ত হয়ে পড়ে যে মনের খোরাক মেটানোর সামর্থ্য থাকলেও সে পথে হাঁটার কথা মনে থাকে না

আমি অনেক মানুষ দেখেছি যারা প্রচুর অর্থ উপার্জন করে, কিন্তু সেই অর্থ দিয়ে একটা বই কেনে না, দেশ ভ্রমণ করে না, একটা ভালো সিনেমা দেখে না সারাদিন শুধু ব্যস্ত সময় কাটায় টাকা আর টাকা নিয়ে অফিসে যায় টাকার গন্ধে, ব্যাংকে যায় টাকার গন্ধে, বাসায় ফিরে টাকার গন্ধে আলাপ আলোচনা আড্ডা সবখানে শুধু টাকার হিসেব, আরো বেশী কিভাবে কামানো যায়, আরো উপরে কিভাবে ওঠা যায় সেই আলাপ

মজার ব্যাপার কি, বিনোদন বলতেও শুধু টাকার প্রসঙ্গটাই উঠে আসে এদের মধ্যে যার এক কোটি আছে সে দশ কোটির স্বপ্ন দেখে, যার দশ কোটি আছে সে একশো কোটির স্বপ্নে বিভোর এই টাকা-টাকা করতে করতেই একদিন মাটির গর্তে নেমে যায় চিরকালের মতো। পরবর্তী বংশধরের জন্য রেখে যায় আরো টাকার স্বপ্ন।

সে যাকগে। এই লেখাটির ভূমিকাটা একটু বড় হয়ে গেল। লেখাটির মূল উদ্দেশ্য নিশ্চয়ই বোঝাতে পেরেছি। উদ্দেশ্য হলো একটি প্রশ্নের উত্তর অনুসন্ধান। আর প্রশ্নটি হলো -দেহের খোরাকের যোগানদাতাকে যদি আমরা কাজের অন্তর্ভুক্ত করতে পারি, তাহলে মনের খোরাকের যোগানদাতাকে কাজের অন্তর্ভুক্ত করতে পারি না কেন?

প্রশ্নটাও সোজা নয়, উত্তরও সহজ হবার কথা না।

Tuesday, August 9, 2016

অনিরাময়

ক)
পূর্ণতা একবারই হোক শূন্যতা যদি বারবার: 
একবারই ছুঁয়ে যাক অনন্ত সুখ: আর যদি কিছু না হয় না হোক: আমৃত্যু প্রতীক্ষা অর্থহীন: একবার যা হয়েছে তাই অটুট থাকুক:  এক সত্যিতে সমগ্র জীবন: দিন বদলের হাটে অনুভূতির বিকিকিনি সে আরেক অধ্যায়: ব্যাসার্ধ কমতে কমতে বিন্দুতে থেমে যাওয়া বৃত্তটি অসমাপ্তই থাকুক, ক্ষতি কী?

খ)
প্রতিদিন সমাপ্য জীবনে বসবাস দীর্ঘজীবি না হোক: একবার যা হয়েছে তাই তো কালের খাতার আলোকিত সুখ: সুখপত্র পল্লবিত থাকুক বিরল বৃক্ষের অপুষ্পক বাগানে: চতুর্থ অধ্যায়ের আয়ুষ্কাল গুনিতক হারে ক্রমহ্রাসমান: যে পূর্ণতা একবারই এসেছিল নিমন্ত্রণের প্রতীক্ষা না করে মানুষ জীবন তাতেই পরিতৃপ্ত হউক:

গ)
সকল বেদনা কী প্রকাশযোগ্য? যতটুকু জানি ততটুকুও নিরাময়যোগ্য নয়: আরো কিছু থাকলে বাড়তি আড়াল তা ধরে রাখছে: সব আড়াল সরানো যায় না: কিছু ভার একাকী বহন করার শক্তি ধারণ করতেই হয় ৷

ঘ)
চক্রে বন্দী বহুরূপী মানুষ তুমি নিজের চক্রেই আটকে থাকো চিরকাল:  তোমার মুক্তি নেই অনিরাময়যোগ্য এই ব্যাধি থেকে

Sunday, August 7, 2016

যে শহরে সমুদ্র প্রবেশ করেছে ঐতিহাসিক অধিকারে

ক্রমশঃ নিমজ্জিত হতে থাকা একটি শহর-
কর্ণফুলী নদী ও চট্টগ্রাম শহরের ঐতিহাসিক ভৌগলিক বিবর্তনের প্রভাব



ইতিহাসের সাথে ভূগোলের গভীর একটি সম্পর্ক আছে। চট্টগ্রাম শহরের বর্তমানের একটি জটিল সমস্যা নিয়ে ভৌগলিক ইতিহাসের ভিত্তিতে সংক্ষেপে আলোচনা প্রচেষ্টা।

চট্টগ্রামের আজকের স্থানীয় পত্রিকাতেও বিনাবৃষ্টিতে শহর প্লাবিত হবার দুটো সংবাদ।
১) এছাক ব্রাদার্সের কন্টেইনার ডিপো তলিয়ে গেছে,
২) চাক্তাই খাতুনগঞ্জের ব্যাপক এলাকা প্লাবিত সাধারণ জোয়ারে। শত কোটি টাকার ক্ষতির সম্ভাবনা।

চট্টগ্রাম শহরের কিছু অঞ্চল বিনা বৃষ্টিতে স্বাভাবিক জোয়ারের পানিতেই প্লাবিত হচ্ছে বেশ কয়েক বছর ধরে। এই ঘটনাটিকে প্রায় স্বাভাবিক বলে ধরে নিয়েছে অনেকেই। অপরিকল্পিত নগরায়ন, জলবায়ু পরিবর্তন, সমুদ্রের উচ্চতাবৃদ্ধি ইত্যাদিকে দায়ী করা হয়েছে ঘটনাটির জন্য। কিন্তু তার বাইরেও আরেকটি কারণ থাকতে পারে কিনা সেটি বিচার করার জন্য এই লেখাটির সুত্রপাত।

চট্টগ্রাম শহরের জন্মের ইতিহাস এবং কর্ণফূলী নদীর বিবর্তনের ধারাবাহিকতাকে বিবেচনায় এনে দেখলে বৈশ্বিক কারণ বাদেও স্থানীয় একটি কারণকে দায়ী করা যায় এই শহরটির অস্বাভাবিক জোয়ারের ব্যাপারটিকে। বলা বাহুল্য এটি কোনমতেই বিশেষজ্ঞ মত না, পরীক্ষিত, নিরীক্ষিত কোন বিষয় না। একজন ইতিহাস পাঠক হিসেবে গত কয়েকশো বছরে চট্টগ্রাম শহরের ভৌগলিক পরিবর্তনের যে বিষয়গুলো চোখে পড়েছে তারই ভিত্তিতে এই ভাবনাটা এসেছে।
আমরা সবসময় এই সমস্যার জন্য সমুদ্রের উচ্চতাবৃদ্ধিকে দায়ী করে আসলেও কখনো ভূমির নিন্মগামীতার কথা বলিনি। কোন কারণে ভূমির উচ্চতা কী হ্রাস পেতে পারে না? বিশেষ করে সেই ভূমি যদি সমুদ্রগর্ভ থেকে জেগে ওঠা চর হয়ে থাকে? চট্টগ্রাম শহরের যে অঞ্চলগুলো জোয়ারের পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে তার সবগুলোই একশো বছর আগেও বিস্তৃর্ণ চরাঞ্চল ছিল। তারো আগে ছিল ছোট ছোট দ্বীপ। তারো আগে ছিল নদী। তারো আগে ছিল বঙ্গোপসাগরের অংশ। কর্নফূলী নদীর মোহনা ক্রমাগত ভরাট হতে হতে আজকের চট্টগ্রাম শহরের অধিকাংশ অঞ্চল গড়ে উঠেছে।
এখন দেখা যাক কোন কোন অঞ্চলকে পাঁচশো বছর আগের সমুদ্রের অংশ হিসেবে চিহ্নিত করা যায়।

প্রাথমিক পর্যবেক্ষনে দেখা গেছে বাকলিয়া, চর চাক্তাই, পতেঙ্গা, হালিশহর, আগ্রাবাদ, ডাঙ্গার চর ইত্যাদি এলাকা এই সমস্যায় আক্রান্ত। বর্তমান মানচিত্রের উপর লাল দাগ দিয়ে আনুমানিক অঞ্চলকে দেখানো হয়েছে এখানে। শহরের জোয়ার প্লাবিত অঞ্চলও এই একই জায়গাগুলো। সমুদ্রের জোয়ার নতুন কোন বিষয় না। কিন্তু দশ বছর আগের তুলনায় সেই জোয়ারের উচ্চতা প্রায় ছয় ফুট বেড়ে গেছে আগ্রাবাদ অঞ্চলেই। সিডিএ এবং আগ্রাবাদ এক্সেস রোডের বাসিন্দাগন এটা সবচেয়ে ভালো জানেন।

যদি বলা হয় সমুদ্রের উচ্চতাবৃদ্ধিই এর কারণ, তাহলে বলতে হবে সমুদ্র তো শুধু চট্টগ্রামের সাথে যুক্ত না। সেই সমুদ্র বঙ্গোপসাগর না শুধু, সেই সমুদ্র মহাসাগরের সাথে যুক্ত। ভারত মহাসাগর।

সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধিই এর একমাত্র কারণ হলে মালদ্বীপ সম্পূর্ণভাবে তলিয়ে যাবার কথা। পৃথিবীর নানান মহাসাগরের আরো অনেক দ্বীপ আছে মাত্র এক দেড় ফুট উচ্চতা বাড়লেও তা তলিয়ে যাবে। সুতরাং চট্টগ্রাম জোয়ারের পানিতে তলিয়ে যাবার মূল কারণ সমুদ্রের উচ্চতাবৃদ্ধি নয়। বরং উল্টোটা হবার সম্ভাবনা। যে অঞ্চলগুলো সমুদ্রের অংশ ছিল কয়েকশো বছর আগে, সেই অঞ্চলগুলো কোন কারণে উচ্চতা হারাচ্ছে। উচ্চতা হারানোর ব্যাপারটা কেউ নিরীক্ষা করেছে বলে জানা নেই। বিশ বছর আগের চট্টগ্রামের ওই চিহ্নিত এলাকাগুলোর উচ্চতা কতো ছিল, আর এখন কতোটা কমেছে সেটার সরেজমিন তদন্ত করার দরকার আছে। আশা করা যায় উচ্চতা পরিমাপ করার যথাযথ প্রযুক্তি কতৃপক্ষের কাছে আছে।

এই লেখাটির উদ্দেশ্য যথাযথ কতৃপক্ষ যেন জোয়ার প্লাবনের এই সমস্যাটির সমাধানে চট্টগ্রাম শহরের ভৌগলিক বিবর্তনকেও বিবেচনায় আনেন।

পর্ব -১: Map-0
এই পর্বে বর্তমান কর্ণফুলীর মানচিত্রটি দেয়া হয়েছে Map-0 নামে। এরপর পুরোনো মানচিত্রগুলো দেয়া হবে ধারাবাহিকভাবে পেছনের দিকে। আমার হাতে আপাততঃ আরো পাঁচটি প্রাচীন মানচিত্র আছে। প্রত্যেকটি মানচিত্র আলাদা পোস্টে দেয়া হবে সময়কাল উল্লেখ করে। বর্তমান মানচিত্রের সাথে তুলনা করতে সুবিধা হবে তাতে। প্রতিটি মানচিত্রের যথাযথ সুত্র প্রাপ্তি সাপেক্ষে উল্লেখ করা হবে। বলার অপেক্ষা রাখে না, বর্তমান মানচিত্রটি গুগল ম্যাপ থেকে নেয়া


---------------------------------------------------------------------------------------------------------------------

পর্ব -২: Map-1
এর সময়কাল ১৯৫৫ সালের কাছাকাছি সময়ে।
চট্টগ্রাম ও কর্ণফুলী নদীর আশপাশের ভৌগলিক অবস্থান নির্দেশক। খুব বেশী পুরোনো না হলেও কিছু পরিবর্তন লক্ষ্যনীয়।



---------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
পর্ব -৩: Map-2 
Map-2 এর সময়কাল ১৯৩২
এই মানচিত্র তৈরী করেছে আমেরিকার মেরিন সার্ভে দপ্তর। এই মানচিত্রটি আরো হাই রেজুল্যুশন হলে ভালো হতো। চট্টগ্রাম বন্দরের কাছে এর কপি থাকার সম্ভাবনা আছে। কিন্তু এটুকুতেই আমার বেশ বুঝতে পারছি কর্নফূলী নদীর মোহনাটা কিভাবে পরিবর্তিত হয়েছে। ডাঙ্গার চর নাম জায়গাটা একসময় নদী ও সমুদ্রের অংশ ছিল তাতে কোন সন্দেহ নেই। বাকীটা ছবি দেখেই বোঝা যাবে।

---------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
পর্ব -৪: Map-3 
Map-3 জেমস রেনেলের তৈরী ১৭৮৬ সালের মানচিত্র।
দেড়শো বছর পেছনে চলে গেলাম এই মানচিত্রে এসে। এটা বৃটিশ শাসনের সূচনাযুগ। শুধু চট্টগ্রামের মানচিত্র মিলবে না ওই যুগে। শুধু ঐতিহাসিক বিবরণই পেতে পারি। সেই সব বিবরণ এবং এই মানচিত্র মিলিয়ে দেখলে কিছুটা অনুমান করা যায় কর্নফূলী নদীর মোহনা, সংলগ্ন দ্বীপ এবং চট্টগ্রাম শহরের তৎকালীন অবস্থা। এটা সম্ভবত সেই সময় যখন পতেঙ্গা এলাকাটি সমুদ্র গর্ভে ছিল। চট্টগ্রাম শহরের শেষ অংশটি সরু হয়ে শেষ হয়ে গেছে যেখানে সেই অংশটির কোন নাম পাই না এই মানচিত্রে। হতে পারে সেটি ফিরিঙ্গীবাজার বা সদরঘাটের দিকের কোন অংশ।


---------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
পর্ব -৫: Map-4 
Map-4 জোহান হোমান(Johann Homann) এর তৈরী মানচিত্র থেকে নেয়া।
হোমান ছিলেন জার্মান ভূগোলবিদ যিনি ইউরোপ আমেরিকার বেশ কিছু বিশ্বখ্যাত মানচিত্র তৈরী করেছিলেন। ভারতবর্ষের মানচিত্রটি সম্ভবত ১৭২০ সালের কাছাকাছি সময়ে তৈরী করেছিলেন। এই মানচিত্রে দেখা যাবে কর্ণফুলীর মোহনা থেকে পূর্বেকার ম্যাপের দ্বীপসমূহ অপসারিত। তার মানে তখন চট্টগ্রাম শহরের অনেকটা অংশ সমুদ্রের গর্ভেই বিলীন অবস্থায় ছিল। মোহনা বহুগুন বড় ছিল। বঙ্গোপসাগর অনেকখানি শহরের ভেতরেই অবস্থান করছিল। সেক্ষেত্রে পুরোনো কিছু ঐতিহাসিক মিথের সত্যতা মেলে। যেখানে বলা হতো বাটালী হিলের পাদদেশে বসে লোকে বড়শি দিয়ে সমুদ্রেরর মাছ ধরতো কিংবা পরীর পাহাড়ে(কোর্টহিল)র পাদদেশে সাগরের ঢেউ আছড়ে পড়তো। এই ঘটনাগুলো সত্যিই ঘটতো মাত্র কয়েকশো বছর আগে।




---------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
পর্ব ৬: Map-5 

Map-5 মানচিত্রটি ডাচ ভুগোলবিদ Johannes Janssonius এর তৈরী।
সময়কাল ১৬৫৫ খ্রিস্টাব্দ। আমাদের হাতে থাকা এই অঞ্চলের সবচেয়ে প্রাচীন মানচিত্র।
এই মানচিত্রটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল ইউরোপের সব রাজ শক্তির কাছে। বস্তুত এই মানচিত্রের উপর ভিত্তি করেই ইউরোপের উপনিবেশবাদী সকল শক্তি এই অঞ্চলে সকল অভিযান চালিয়েছিল। এই মানচিত্রটি সব দিকে নিখুঁত বলা যাবে না। কিন্তু কর্ণফুলী নদী ও তৎসংলগ্ন অঞ্চলে তখন ইউরোপীয় জাহাজের বিচরণ স্বচ্ছন্দ। তাই এই অঞ্চলের দ্বীপ, নদী ও সমুদ্রের মোহনাগুলোর অবস্থানের ক্ষেত্রে এই মানচিত্রটির উপর নির্ভর করা চলে। আমরা এই মানচিত্রে দেখবো চট্টগ্রাম শহর, কর্নফুলী নদী ও তার মোহনা ইত্যাদি বিষয়। এই মানচিত্রে Bengala নামক একটি জায়গার নাম আছে যা মূলত শহরের উল্টোদিকে দেয়াঙ্গে অবস্থিত পর্তুগীজ ঘাটিকে বোঝানো হয়েছে। তখন এই এলাকাকে বেঙ্গালা বন্দর হিসেবে ধরা হতো। এই মানচিত্রটি চট্টগ্রামের ভৌগলিক অবস্থার বিবর্তন পর্যবেক্ষণে আগ্রহীদের জন্য অনেক তথ্যের খোরাক হতে পারে। বিশেষ করে চট্টগ্রাম শহরের আশেপাশে অবস্থিত দ্বীপগুলোর ভবিষ্যত পরিণতি আমাদের বর্তমানের চট্টগ্রাম শহরের সাথে সম্পর্কিত তাতে কোন সন্দেহ নেই।




বিনা বৃষ্টিতে চট্টগ্রাম শহরের জোয়ারমগ্ন হয়ে পড়ার যে সমস্যার কথা বলা হয়েছিল প্রথম লেখাটিতে, উপস্থাপিত ৫টি মানচিত্রে তার কিছু উত্তর হয়তো মিলবে। এই বিষয়ে ভবিষ্যতে আরো অনেক আলোচনার অবকাশও রয়েছে। আপাতত এটুকুই।

Wednesday, August 3, 2016

সাশ্রয়ী মৃত্যু এই তামাশার দেশে

মানুষ জীবন সর্বাত্মক এক তামাশা এদেশে: দুটো তামাশার কথা সবার আগে আসে

এক:  চিকিৎসা তামাশা

অসুস্থতা এখানে একটা অপরাধ বা ভুল:

ডাক্তার, হাসপাতাল, ডায়াগনস্টিক সেন্টার- ত্রয়ী এক যুথবদ্ধ শিকারী ফাঁদের নাম:

রোগী একটি সহজ বধ্য শিকার মাত্র:

টোপ ফেলে এখানে ওখানে বসে আছে শিকারীর দল:

একবার তুমি ফাঁদে পড়ো, আর ধনে প্রাণে মারা পড়ো:

সিঁদেল চোর, সেও খানিকটা ভালো, তারা লুকিয়ে সাফাই করে, গলাতে ছুরি ধরে বলে না সেবা দিচ্ছি রক্ত গিলে খাও:

হাতে আছে ধারালো ক্ষুর,  যা দিয়ে গলাও কাটে, পকেটও:

অপেক্ষা করো,  আসছে তোমার পালা:

তুমি সর্বহারা? তবে সস্তায় মরে যাও ঘুমের ঘোরে:

সাশ্রয়ী মৃত্যুই এদেশে সর্বোচ্চ কাম্য ৷৷
***********************************

দুই: আইন তামাশা

উকিল,  পুলিশ,  আদালত- ত্রয়ী আরেক যুথবদ্ধ শিকারী ফাঁদের নাম:

বাদী বিবাদী দুটোই শিকারের নাম:

প্রথমাংশের বাকী ঘটনা এখানেও:  বিশেষ্য বিশেষণের পুনরুক্তি নিষ্প্রয়োজন

আইনের ফাঁদ এড়িয়ে বেঁচে থাকুক মানুষ
*************************************