টেক্সি গন্তব্যে পৌঁছানোর পরও স্বামী স্ত্রী দুজনের ঝগড়া থামেনি। রমিজ ড্রাইভার অতিষ্ট হয়ে গাড়ি চালিয়েছে সমস্ত রাস্তা। রাস্তার যানজট, ধূম্র-ধুলো, সূর্যের তাপ, পেছনের তিক্ত কলহ সব মিলিয়ে পরিবেশটা বিষাক্ত হয়ে উঠেছিল। মুরাদপুরে বাড়ির সামনে পৌঁছালে স্ত্রীটি গটগট করে নেমে চলে গেল স্বামীকে পেছনে ফেলে। স্বামী ভাড়া মিটিয়ে হাতের ব্যাগটা নিয়ে বাসার দিকে রওনা দিলে রমিজ টেক্সি নিয়ে বাদুরতলার দিকে রওনা দিল। চরম খিদা পেটে। গ্যারেজে গাড়িটা রেখে খেয়ে একটু বিশ্রাম করে বিকালে বের হবে। গ্যারেজের কাছেই বাসা। বউ ফোন করে জানিয়েছে কই মাছ ভাজা করেছে, শহরের মধ্যে থাকলে যেন বাসায় গিয়ে খাই আজকে।
রোজার দিন, এমনিতে হোটেল-ফোটেল বন্ধ। চারটা বেজে গেছে। ইফতারের আরো অনেক দেরী। ততক্ষণ খিদে সহ্য হবে না। গাড়িটা গ্যারেজে রেখে বের হতে গিয়ে পেছনের সিটে চোখ গেল। একটা ব্যাগের হাতল দেখা যাচ্ছে সিটের পেছনে। সেই যাত্রী মহিলার ব্যাগ। ঝগড়ার তাণ্ডবে ভুলে গেছে পেছনে রাখা ব্যাগের কথা। ব্যাগটা নিয়ে রমিজ ভাবলো কী করা যায়। যে বাড়ির সামনে নামিয়ে দিয়েছে সেখানে গিয়ে ফিরিয়ে দেয়া যায়। ওর সততা দেখে নিশ্চয়ই খুশী হয়ে কিছু বকশিশও দেবে।
আগে খাওয়া হোক। খিদের সময় অন্য কিছু ভালো লাগে না। ঘরে ঢুকতে বউয়ের প্রশ্নের জবাবে জানালো ঘটনা। বউও বললো, খেয়ে উঠে ফেরত দিয়ে আইসো।
খাওয়া হলো। বিছানায় একটু গড়াগড়িও। বিকেলে বের হতে গিয়ে ব্যাগটা হাতে নিতে হঠাৎ একটা অচেনা মোবাইলের বাজনা শুনলো। বাজনাটা আসছে ব্যাগের ভেতর থেকে। চেইন খুলে দেখলো দামী একটা মোবাইল বাজছে। নিশ্চয়ই মোবাইলের মালিক এতক্ষণে হুঁশে ফিরেছে। সে মোবাইল ধরলো না। ওটা বাজতেই আছে। বাজনা অব্যাহত রেখে তার ভেতরে একটা নিষিদ্ধ কৌতুহল জাগলো ভেতরে কী আছে দেখতে। বউ রান্নাঘরে ধোয়ামোছা করছে। একটা চিরুনি, কিছু ক্লিপ, রুমাল, লিপস্টিক, ছোট আয়না, এরকম হাবিজাবি জিনিস। পাশের আরেক কম্পার্টমেন্টে লাল একটা বাক্স। দেখে বুকটা ধ্বক করে উঠলো তার। এই বাক্স তার চেনা। জুয়েলারীর দোকানের বাক্স। বাক্সটা দ্রুত খুললো এবং দেখে চোখ কপালে উঠলো। একটা ভারী গলার হার, দুটো বালা, কানের দুল, চুড়ি ইত্যাদি নানান গহনা। দেখে মনে হচ্ছে স্বর্ণ। কত ভরি হবে আন্দাজ করতে পারলো না।
মোবাইলটা বাজতে আছে তখন থেকে। বউ রান্নাঘর থেকে এসে বললো, ‘ফোনটা ধরো, তারা নিশ্চয়ই ফোন করছে, আহারে। ধরে কও তুমি যাইতেছ এখনি’।
‘না!’
‘না মানে?’
‘যাবো না’
‘কেন?’
‘এই দেখো’, বলে রমিজ সোনার গহনাগুলো বউয়ের সামনে মেলে ধরলো।
মালেকা জীবনেও এতগুলো গহনা কোথাও দেখেনি চোখের সামনে। তার চোখ দিয়ে বিস্ময় আর ভয় দুটোই। এখন কী হবে? সে তো কোন অপরাধ করেনি। তবু ভয় লাগছে কেন। রমিজের ‘না’ শুনে ভয়? সে তো ব্যাগটা ফিরিয়ে দিতে চায়। রমিজের ‘না’ শুনে ভয় করছে কেন? সে কি রমিজের ‘না’ এর সাথে একমত হয়ে গেছে মনে মনে?
মোবাইলটা বন্ধ করে রমিজ আর মালেকা গুম হয়ে বসে থাকলো কিছুক্ষণ। তারপর ব্যাগটা টেনে নিল কাছে। ব্যাগটা হাতিয়ে আরো হাজার দশেক নগদ টাকা মিললো। ছোট পকেটে ছিল টাকাগুলো। সাথে একটা দোকানের মেমো। একটা টেইলার্সের রসিদ। ঈদের জামা সেলাই করতে দিয়েছিল বোধহয়।
মোবাইল থেকে সিম খুলে ফেলে দিল। রমিজ জানে সিম থাকলে ধরা পড়ার সম্ভাবনা। সে কোন সম্ভাবনার ছিটেফোঁটা বাকী রাখতে চায় না। সেই সন্ধ্যাতেই ফোনটা বিক্রি করে দিল এমন এক জায়গায় যেখানে ওকে কেউ চেনে না। এবার নিশ্চিন্ত। বুকের মধ্যে চরম ফূর্তি লাগতেছে। এবার জমজমাট ঈদের বাজার হবে। জীবনে পয়লাবারের মতো ঈদের আনন্দ আসতেছে ফূর্তির জোয়ার হয়ে।
ঈদের কয়েকদিন বাকী। ধুমিয়ে কেনাকাটা করেছে দুজনে মিলে। গ্রামে থাকা বাবা মা ভাইবোনের জন্যও জামা কিনে পাঠিয়ে দিল। অসুখের ভাণ করে কদিন গাড়ি নিয়ে বের হয়নি। মালিক অবাক, দিন চলবে কী করে তোর? সে গ্যারেজের মালিককে বললো, কিছু টাকা ধার দেন চাচা। শরীরটা সারুক। ঈদের পর পুষিয়ে দেবো। বিশ্বাসী পুরোনো ড্রাইভার সে। সহজেই ধার মিললো।
এই ঘটনা কাকপক্ষীও জানে না। শুধু বশিরকে বলেছিল একটা ব্যাগ পাইছি, ভেতরে কয়েকশো টাকা আর একটা জামার রসিদ ছিল। রাস্তার মোড়ে নেমে গেছে, খুঁজে পাইনাই আর।
বশির শান্ত্বনা দিয়ে বললো, ‘থাক মন খারাপ করিস না। তোর চেষ্টা তুই করছিস। গরীবরে এভাবেই সাহায্য করে ভাগ্য’। সে আরো পাল্টা বুদ্ধি দিল, ‘জামার রসিদ দিয়ে ভাবীর ঈদের কাজ হয়ে যাবে’।
রমিজ বুদ্ধিটা নিল। মালেকার জন্য তিনটা জামা কিনেছে সে। কিন্তু এইটা একটু অভিজাত দোকানের জামা। মাগনা পেয়ে গেলে ক্ষতি কী? সে বললো ঈদের আগে একদিন ওই টেইলার্সে গিয়ে জামাটা নিয়ে আসতে হবে। বশির বললো, কোন ব্যাপার না। আমারে দিস, আমি নিয়ে আসবো।
ঈদের দুদিন আগে বিকেলবেলা বশির শপিং কমপ্লেক্সের দোকানটায় গেল। খুব ভিড় দোকানে। ওরা রসিদ দেখলো, তারপর বশিরের চেহারার দিকে তাকালো। বশির তাড়াতাড়ি জানালো, স্যারে একটু বিজি আজকে, আমারে নিয়ে যেতে বললো।
টেইলার্সের কর্মচারী এদিক সেদিক জামাটা খুঁজে না পেয়ে বললো, এখনো কাজ বাকী আছে একটু। ঘন্টাখানেক পরে আসেন।
বশির ইফতারের পর গেল। মার্কেট একটু ফাঁকা এখন। কাজ হয়ে গেছে বোধহয় এতক্ষণে। বশির দোকানে ঢুকে রসিদটা কাউন্টারে রাখলো। কাউন্টারের লোকটা ফোনে কথা বলছিল, তাকে দেখে একটু আড়ালে চলে গেল। বশির দাঁড়িয়ে আছে। বাকী কর্মচারীরা ইফতার সেরে ঝিম মেরে বসেছিল। হঠাৎ কয়েকজন লোক হুড়মুড় করে দোকানে ঢুকে তাকে ঘিরে কিল ঘুষি লাথি মারতে শুরু করলো। সে বুঝলো ঘটনা খারাপ। দৌড়ে পালাতে চেষ্টা করলো, কিন্তু ততক্ষণে তাকে মেরে শুইয়ে দেয়া হয়েছে। একসাথে বিশ ত্রিশজন মার শুরু করলে তার ভয় ধরলো, সে বললো, আমি না, আমি না, সব রমিজের কাজ। আমারে পাঠাইছে রমিজ। আমি কিছু জানি না ভাইসব, আমারে মাফ করেন। কিন্তু লোকজন প্রথম কিস্তির মার তার উপর দিয়েই চালালো।
ভিড় থেকে একজন এসে কলার চেপে তাকে দাঁড় করালো। বললো, ওই হারামীর বাচ্চা স্বর্ণ কই? টাকা কই? মোবাইল কই? জলদি বল হারামজাদা। এখনি বল, নইলে মেরে ফেলবো তোকে আজ।
বশির আকাশ থেকে পড়লো এবার। রমিজ তো আর কিছু বলেনি তাকে। তার মানে ওই হারামজাদা সবকিছু সরিয়েও এই জামার উপর লোভ ছাড়তে পারেনি? রমিজের উদ্দেশ্যে কুৎসিত একটা গালি আসলো তার মুখেও। সে তখন বললো, ভাই আমারে একটু বলার সুযোগ দেন। তারপর আপনাদের যা বিবেচনা।
সে যতটুকু জানে ততটুকু বললো সমবেত জনতাকে। সরোয়ার নামের সেই ভদ্রলোক যার বউয়ের স্বর্ণ চুরি হয়েছে তিনি সবটুকু শুনে বললেন, তোকে মাফ করতে পারি এক শর্তে। তুই এখন ফোন করে তোর দোস্তকে এখানে আসতে বলবি। বলবি জামা ডেলিভারী নেয়া হয়েছে। সে যেন এসে নিয়ে যায় মার্কেটের সামনে থেকে। কোন চালাকি করলে মরবি।
বশির এক কথায় রাজী। সে নিজেও ক্ষিপ্ত রমিজ হারামজাদার উপর। সে রমিজকে ফোন করে মিষ্টি গলায় আসতে বললো।
রমিজ এসে টেক্সি থেকে মার্কেটের সামনে নেমে একটা সিগারেট ধরিয়ে ভাবলো, বশিরাকে আজ বিরানী খাওয়াতে হবে। ব্যাটা একটা বাঘের বাচ্চা। কত সহজে এই কাজটা করে দিল। মনে মনে খিকখিক করে হাসতে লাগলো।
কিন্তু হাসিটা বেশী সময় থাকলো না। মাথার উপর আস্ত একটা বাজ নেমে আসলো হঠাৎ করে এবং তাকে ছোঁ মেরে তুলে নিল। পার্কিং এলাকায় ওঁত পেতে দাঁড়িয়ে থাকা পুলিশের গাড়ি সে খেয়াল করেনি, খেয়াল করলে দেখতে পেতো বশির পুলিশের গাড়ির ভেতর বসে আছে।
জেল হাজতে বসে রমিজ ভাবতে লাগলো, ওই একটা বড়লোকী জামা না হলে মালেকার ঈদে এমন কী ক্ষতি হতো? আর বশির হারামজাদা!!