Saturday, August 13, 2016

মুসল্লী

গুলবদন রান্নাঘর থেকে খরচের তীরটা ছুঁড়ে দিয়ে জানালো, পেঁয়াজ নাই, পেঁয়াজ আনতে হবে।

পেয়ারালী দূর থেকে তীরটাকে আসতে দেখে লুঙিতে গিঁট দিয়ে গাঁট হয়ে বসলো, তীরটাকে খপ করে ধরে আবার জায়গামতন ফেরত পাঠাতে হবে। পকেটে একটা টাকাও নাই। কাল রাতে চাল ডাল তরকারি কিনে সব শেষ। পেঁয়াজের কথা মনে ছিল না। তবে লুঙ্গির গোপন খুপরিতে ১০০ টাকার একটা নোট লুকিয়ে আছে, সেটা  আরো মহা কোন বিপদের জন্য। তরকারীতে পেঁয়াজ না খেলে কিছু এসে যায় না। সাবেক অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান সাহেবেরও সেই মত ছিলপেঁয়াজের দাম বাড়ছে তো কি হইছে, পেয়াজ না খাইলে কিতা অয়?

কিন্তু গুলবদনকে ওটা বলা যাবে না। প্রথমতঃ সে সাইফুর রহমান নয়, সে পেয়ারালী। দ্বিতীয়তঃ গুলবদনের বয়স তার অর্ধেক। তাকে সামলানো কী কঠিন কাজ তা পেয়ারালীর মেরুদণ্ডের বুড়ো হাড্ডিই জানে। নাই জাতীয় কথার বদলে তাকে বলতে হবে পেঁয়াজের চেয়েও গুরুতর কোন সমস্যার কথা। তুলনামূলক সমস্যা তত্ত্বে বিশ্বাসী গুলবদন।

রিকশা চালানোর শক্তি শেষ হয়ে যাওয়াতে ঝালমুড়ি বিক্রি করতো পেয়ারলী। কিন্তু ঝালমুড়ি ব্যবসায় টান পড়ছে দোকানে প্রাণ কোম্পানীর ঝালমুড়ির তৈরী প্যাকেট চলে আসার পর থেকে। লোকজন তরতাজা বানানো ঝালমুড়ির চেয়ে প্যাকেটের ঝালমুড়ির দিকে ঝুঁকে গেছে। সেই থেকে পেয়ারালী বিপদে আছে।

সিনেমা হলের সামনে কিছু বেচা বিক্রি হয়। কিন্তু শহরে সিনেমা হল জিনিসটা উঠে গেছে। আলমাস ছাড়া আর কোন সিনেমা হল নেই শহরে। এক আলমাসের দুই শোতে ঝালমুড়ি বেচে কি আর সংসার চলে? তার চেয়ে ভিক্ষা করে বেশী আয়। কিন্তু গুলবদন ভিক্ষাবৃত্তির কঠোর বিরোধী। সে সোজা বলে দিয়েছে পেয়ারালী যদি ভিক্ষা করে তাহলে পরদিন থেকে সে গতর বেচতে দাঁড়িয়ে যাবে আলমাসের পাশের ফুটপাতে। এই বস্তির নুরবানু আর ফুলবানু তাই করছে গার্মেন্টসের চাকরী ছেড়ে। খাটনি কম, আয় বেশী। দুই বোন এক ঘরে থাকে। তাদের ঘরে রঙিন টেলিভিশনও আছে। জোয়ান বউয়ের হুমকিতে মাঝবয়সী পেয়ারালী চুপসে থাকে। পেয়ারালীর মতে ভিক্ষার চেয়ে বেশ্যাবৃত্তি আরো নিকৃষ্ট।

সে মাঝে মাঝে একটা সুতার কারখানায় থেকে বাতিল খোল সংগ্রহের কাজ করে। বিক্রি করে যা পায় তা আধাআধি ভাগাভাগি হয় দারোয়ানের সাথে। আজ কারখানা বন্ধ। সেদিকেও রাস্তা নাই। সুতরাং পেয়ারালীকে গুলবদনের তীরকে ফেরত দেবার জন্য বলতে হয়, গিট্টু মাকড়ার সাথে দেখা হইছিল আইজ। সন্ধ্যার পর আসবে

গিট্টু মাকড়ার কাছ থেকে দুই হাজার টাকা ধার নিয়ে ঝালমুড়ির ব্যবসা শুরু করছিল সে। পাঁচশো টাকা শোধ হয়েছে, বাকী দেড় হাজার। গিট্টু লোকটা বস্তির সাক্ষাত আতংক হলেও পেয়ারালীর সাথে অদ্ভুত খাতির। নেশা ভাং করার সুযোগ দেয় বিনা পয়সায়। পাওনা টাকার জন্য এখনো সেরকম কোন চাপ দেয়নি। এই চাপ না দেয়াটাই গুলবদনের ভয়ের কারণ। তার উদ্দেশ্য কি? 

যখনই গিট্টু ঘরে আসে তখনই গুলবদনের মুখ শুকিয়ে যায়। তাকে আসতে বারণও করা যায় না, আবার খাতির করতেও মন সায় দেয় না চাউনিতে নেশাড়ু ছায়া তারপেয়ারালীর অনুপস্থিতিতে ঘরে ঢুকে যখন সে –‘ভাউজের শরীর কেমন আইজ- বলে তখন বুকটা শুকিয়ে যায় ভয়ে। কথাটার মধ্যে খারাপ কিছু না থাকলেও গুলবদন তাতে মতলবের গন্ধ পায়।

পেয়ারালী সফল। গিট্টুর নাম শুনে পেঁয়াজের কথা না বাড়িয়ে রান্নার কাজে মন দেয় গুলবদন

এবার আসল কাজে বের হতে হবে। প্রতি শুক্রবার জুমার নামাজটা পড়তেই হয় তাকে। বেড়ার খুটি থেকে পাঞ্জাবীটা খুলে নেয়। পাঞ্জাবীর ডান পকেটে টুপি আছে। একটু আতরও দিল গায়ে। একটা কাপড়ের থলে ভাঁজ করে ঢুকালো বাম পকেটে। আজানের শব্দ শোনা যাচ্ছে মসজিদ থেকে। জুম্মাবারে একটু আগে না গেলে মসজিদে যুতমতো জায়গা মেলে না। আবার বেশী আগে গেলেও কাজের অসুবিধা হয়। তার পছন্দ মাঝামাঝি জায়গা।

যখন যে মসজিদে নামাজ পড়ে তার পুরো চেহারা ভালো করে দেখে নেয় আগেভাগে। প্রতি শুক্রবার নতুন নতুন মসজিদে নামাজ পড়তে যায় পেয়ারালী। শহরের প্রায় সব মসজিদে নামাজ পড়া শেষ। বড় বড় মসজিদে নামাজ পড়লে প্রাণ জুড়িয়ে যায়। আজকাল এসির বাতাসও পাওয়া যায় কোন কোন মসজিদে। বেছে বেছে বড়লোকদের দামী মসজিদগুলোতে যায় সে। ধর্মকর্মের এই জায়গাটা তার পছন্দ একটা কারণে। বড়লোকদের আর সব জায়গায় ঢুকতে সমস্যা হলেও মসজিদ ব্যাপারটা একদম আলাদা। গরীব বলে তাকে অভিজাত এলাকার মসজিদে ঢুকতে কেউ বারণ করবে না। যে কোন কাতারে গিয়ে দাঁড়াতে পারবে।

আজকে যাবে কাছের এক মসজিদে। লালখান বাজারে হাইওয়ে প্লাজার পেছনে যে একটা সুন্দর মসজিদ আছে এতদিন কেন চোখে পড়লো না। আহ, সেদিন মাগরেবের সময় চোখ জুড়িয়ে গেল দেখে। মসজিদটা ছোট, কিন্তু লোকজন দামী। অফিস ফেরত টাই কোট পরা অনেক মুসল্লী গাড়িটা মার্কেটের সামনে রেখে এখানে নামাজটা সেরে বাড়ি ফেরে।
দোতলা মসজিদটার নীচে অজুখানা। সে অজু সেরে দোতলায় পেছনের সারিতে দরোজার পাশে একটা পিলারের সামনে দাঁড়িয়ে নামাজের নিয়ত ধরলো। 

মসজিদে যতক্ষণ থাকে সে নামাজেই লিপ্ত থাকে। নইলে তাকে সামনের কাতারে যাবার জন্য তাগিদ দেবে পেছনের লোক। নামাজে থাকলে কেউ বিরক্ত করে না। সামনে বা পাশে পিলার থাকলে সবচেয়ে সুবিধা। প্রায় সব মসজিদেই পিলারের সাথে জুতার বাক্স রাখা থাকে। জুতার বাক্সের কাছাকাছি নামাজ না পড়লে ঈমানী সমস্যা হয় অনেকের। মনটা খোদার চেয়েও জুতার বাক্সের দিকে পড়ে থাকে বেশী। 

বিড়বিড় করে সুরা পাঠ অবস্থাতে সে এক ঝলক দেখলো সামনের জুতার বাক্সে একটা নতুন চামড়ার স্যাণ্ডেল ঢুকলো। দ্রুত নামাজ শেষ করে পেয়ারালী মোনাজাত ধরলো। মোনাজাত অবস্থাতেই দেখতে পেল নতুন স্যাণ্ডেলের মালিক নীল পাঞ্জাবী এদিক ওদিক তাকিয়ে বাক্সের সামনের কাতারেই বসে পড়লো। পেয়ারালী একটু ভালো করে তাকিয়ে জুতাটার শুকতলিতে এপেক্স লেখাটা পড়ে উঠে দাঁড়িয়ে আবারো নামাজের নিয়ত করে ফেলল। ইমাম সাহেব ওয়াজের ফাঁকে ফাঁকে পেছনের মুসল্লীদের বলছে সামনের খালি জায়গা পুরণ করে নিতে। আরো কঠিন মনোযোগে নামাজে ডুবে গেল পেয়ারালী।

পেছনের লোক সামনের সারি পুরণ করছে। পেয়ারালী নামাজে মগ্ন। নীল পাঞ্জাবি আরো তিন সারি এগিয়ে গেল। সবাই জায়গা পুরণ করে বসে গেল। পেয়ারালীর নফল নামাজ শেষ হলো।

খোতবা শেষে নামাজ শুরু। ফরজ নামাজ দুই রাকাত। সেই দুই রাকাতও শেষ। মোনাজাত শেষে চাক ভাঙ্গা মৌমাছির মতো একদল লোক মসজিদ ছেড়ে পালাবার জন্য তাড়াহুড়া শুরু করে দেয়। বাকীরা সুন্নত নফল সেরে বের হয় আস্তে ধীরে। 

পেয়ারালী উঠে দাঁড়িয়ে নীল পাঞ্জাবীর দিকে তাকিয়ে বুঝলো লোকটা সুন্নতের নিয়ত করে ফেলেছে। 

একদম নিশ্চিন্ত হয়ে সে উঠে এপেক্স লেখা স্যাণ্ডেলটা হাতে নিয়ে আলগোছে ভিড়ের মধ্যে মিশে মসজিদ থেকে বেরিয়ে গেল।



No comments: