Wednesday, August 10, 2016

গুরুদেব, মিলুর জন্য একটা চাকরী দেবেন?

জীবননান্দ দাশ চিরকাল আর্থিক অনটনে কাটিয়েছেন, একটি চাকরীর জন্য হন্যে হয়ে ঘুরেছেন, কোথাও সুস্থির হতে পারেননি, জীবনীগ্রন্থের এই অংশটা আমাকে ব্যক্তিগতভাবে খুব পীড়া দেয়। আমি একটি হিসেব কিছুতে মেলাতে পারি না। সেই আমলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রী নিয়ে একজন মানুষ জীবন ধারণের মতো চাকরী জোটাতে পারছেন না, কেমন অবিশ্বাস্য লাগে। চাকরী পাননি তা নয়, কিন্তু চাকরী টিকিয়ে রাখতে পারেননি। বারবার তাঁকে চাকরী বদলাতে হয়েছে।

এম এ পাশ করার পর থেকে জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তিনি যেসব চাকরী করেছেন তা এরকম-
সিটি কলেজ, কলকাতা (১৯২২-১৯২৮), বাগেরহাট কলেজ, খুলনা (১৯২৯); রামযশ কলেজ, দিল্লী (১৯৩০-১৯৩১), ব্রজমোহন কলেজ, বরিশাল (১৯৩৫-১৯৪৮), খড়গপুর কলেজ (১৯৫১-১৯৫২), বড়িশা কলেজ (অধুনা 'বিবেকানন্দ কলেজ', কলকাতা) (১৯৫৩) এবং হাওড়া গার্লস কলেজ, কলকাতা (১৯৫৩-১৯৫৪)। এর মধ্যে ১৯৩১ থেকে ১৯৩৫ কোন চাকরি করেননি সম্ভবতঃ। এই সময়টা পুরোটাই সাহিত্য করেছেন। সম্ভবতঃ তিনি গদ্য সাহিত্য প্রচেষ্টা শুরু করেছিলেন আয় করার ইচ্ছে থেকেই। কিন্তু সেই সাহিত্য তেমন ফলদায়ী হয়নি। তিনি সেইসব গদ্য কোথাও প্রকাশ করেননি জীবদ্দশায়। কেন প্রকাশ করেননি? তাঁর সেই গদ্য কি মানসম্পন্ন মনে হয়নি নিজের কাছে? জানা হবে না কখনো।

অন্যদিকে বয়সে তাঁর চেয়ে ৪০ বছর এগিয়ে থাকা রবীন্দ্রনাথ তখন সমগ্র বিশ্বে পরিচিত একটি নাম। জীবনানন্দ দাশ যখন দিল্লীর রামযশ কলেজ থেকে চাকরীচ্যুত হয়ে ফিরে এসেছেন, তখন রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতন আলো করে আছেন ৭০ বছর বয়সেও। ব্যস্ততার এতটুকু কমতি নেই। দেশ বিদেশের সাহিত্য সংস্কৃতির জগতও ঘুরছেন, রাজা মহারাজার নিমন্ত্রণও রক্ষা করছেন। শান্তিনিকেতনেও বিশ্বের নানান দেশ থেকে নানান প্রকৃতির মানুষ এসে শিক্ষা নিচ্ছে, শিক্ষা দিচ্ছে, কাজ করছে। শান্তিনিকেতন সবার জন্য উন্মুক্ত একটি শিক্ষালয়। রবিঠাকুর সেই অভিনব শিক্ষা নিকেতনের গুরু। নামযশের সাথে হাতযশেরও কমতি নেই তাঁর। উদার হাতে তিনি জ্ঞান, ধন, সুযোগ, মহত্ব বিলোচ্ছেন মানুষের মাঝে।

রবীন্দ্রনাথ ও জীবনানন্দ, দুই ধারার দুই কবিই আমার বিশেষ প্রিয়। কে বেশী প্রিয় সেই প্রসঙ্গ অবান্তর। আনন্দ বেদনার প্রিয় সঙ্গী তাঁদের সৃষ্ট সাহিত্যকর্ম। তাঁদের সৃষ্টি না থাকলে কার কবিতা নিয়ে জীবনের অপার সব বেদনা ভুলে থাকতাম, তা বলা মুশকিল। এই দুই কবির কথা একসাথে ভাবতে গেলে একটি উর্বর চিন্তার উদ্ভব ঘটে।

জীবনানন্দ এত কঠিন জীবন কাটাচ্ছেন, তখন রবীন্দ্রনাথ জীবিত এবং প্রবল প্রতাপে প্রতিষ্ঠিত। জীবনানন্দ কি কখনো রবীন্দ্রনাথের কাছে যেতে পারতেন চাকরীর ব্যাপারে? শান্তিনিকেতনে কত মানুষের চাকরী হয়েছে, কতো জীবন কেটে গেছে, তাঁর জন্যও একটা ব্যবস্থা হতে পারতো না? জীবননানন্দ দাশকে কি রবিঠাকুর ফিরিয়ে দিতেন? একজন জীবনানন্দের যদি ঠাঁই হতো শান্তিনিকেতনের একটা কুটিরে জীবনের সব দুষ্ট ক্ষতি পুষিয়ে নিজেকে গুছিয়ে নিতে পারতেন তিনি। পারতেন না?

রবীন্দ্র জীবনী পড়ে মনে হয়েছে তাঁর কাছে যে কেউ পৌঁছাতে পারতো। তিনি কঠিন আড়ালের মানুষ ছিলেন না। সহজতাই তাঁর চরিত্রের অন্যতম একটা বৈশিষ্ট্য। তাঁর এত জনপ্রিয়তার মূলে আছে সেই বৈশিষ্ট্য। সাহিত্যে যেমন, জীবনেও তেমনি। প্রভাতকুমার, প্রমথনাথ বিশী, প্রমথ চৌধুরী, রানীচন্দসহ আরো বেশ কজনের স্মৃতিচারণে তা স্পষ্ট। চাইলে জীবনানন্দ তাঁর সাথে সহজেই দেখা করতে পারতেন এবং বলতে পারতেন সমস্যার কথা। যে পঞ্চপাণ্ডবের দলে তিনি ছিলেন(বুদ্ধদেব বসু, অমিয় চক্রবর্তী, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, বিষ্ণু দে, জীবনানন্দ দাশ) তাদের কেউ কেউ রবিঠাকুরের কাছের মানুষ ছিলেন। তবু তিনি সে পথে যাননি। কেন যাননি? আত্মসম্মানবোধ? নাকি আত্মসংকোচ? প্রবল অন্তর্মূখী জীবনানন্দ দাশ নিজের যোগ্যতা নিয়ে যথেষ্ট আত্মবিশ্বাসী ছিলেন না। সুযোগ সন্ধানী ছিলেন না। দুঃখকে গিলে খেয়ে জীবনধারণ করেছেন আর বিষাদের কবিতায় তা উগড়ে গেছেন বছরের পর বছর। তাঁর সবগুলো কবিতাই জীবনের চরম বেদনাদায়ক একেকটা অভিজ্ঞতার নির্ঝাস।

এই ভাবনাটা আমার নিজের। জীবনানন্দ নিশ্চয়ই এমন করে ভাবেননি কোনদিন। যদি ভাবতেন তিনি কি তাঁর জীবনকে আরেকটু সুখী সন্তুষ্ট করতে পারতেন না? যদি সুখী সন্তুষ্ট একটি জীবন পেতেন, নির্জনে বসে নিরুপদ্রপ সময় উপভোগ করতেন, তাহলে কেমন সাহিত্য হতো সেটা? প্রবল দুঃখ ও বেদনাবোধের যে কবিতাগুলো তিনি লিখেছেন, সেই কবিতাগুলো কি লেখা হতো? যদি লেখা না হতো তাহলে আজকে আমরা যেমন রবিঠাকুর ও জীবনানন্দ দাশকে পাশাপাশি রেখে আলোচনা করছি, সেই মর্যাদায় আসীন হতেন? নাকি নেহাত আরেকজন শান্তিনিকেতনের নির্জীব অধ্যাপক হিসেবে অবসর নিয়ে শান্তিপূর্ন জীবন শেষে পরপারে চলে যেতেন। আমরা হয়তো তাঁর নামও খুঁজে পেতাম না সাহিত্য অঙ্গনের মহাসড়কে। সেইটা কি ভালো হতো?

হ্যাঁ, এই দিকটা ভাবলে মনে হয় তাঁকে রবিঠাকুরের কাছে চাকরীর জন্য পাঠানো ঠিক হতো না। তিনি এখন নিজের দারিদ্র দিয়ে সাহিত্যের সাম্রাজ্যের অধীশ্বর হয়েছেন সেই মর্যাদা থেকে তিনি বঞ্চিত থাকতেন। কোন সন্দেহ নেই, আমরা আমাদের সাহিত্যে একজন জীবননান্দে প্রয়োজনীয়তা খুব অনুভব করি। জীবনানন্দ আমাদের বেদনাগুলো তাঁর নিজস্ব রক্তক্ষরণের ধারা দিয়ে লিখে গেছেন, আমরাও তা থেকে বঞ্চিত হতাম। জীবনানন্দের দুঃখভরা জীবনটা আমাদের সাহিত্য উপভোগের অনুকুল পথেই হাঁটে।
 
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও জীবনানন্দ দাশ এই সময়ে এসে বাংলা সাহিত্যের দুই দিকপাল। তাঁদের নিয়ে উচ্চশিক্ষিত সাহিত্য বোদ্ধামহলে জ্ঞানগর্ভ আলোচনা চলে পাশাপাশি। কিন্তু তাঁদের জীবদ্দশায় কী এই দৃশ্য কল্পনাও করা যেতো? সেই সময়ে দুজনের মধ্যেকার দূরত্ব ছিল যোজন যোজন। রবীন্দ্রনাথ ও জীবনানন্দের তুলনামূলক কোন আলোচনা হতে পারে সেটা স্বপ্নেরও অগম্য ছিল তখন। একজন জগত আলোকিত করা বিশ্বকবি, সারা পৃথিবীতে দৃপ্ত পদচারণা যার। আরেকজন বরিশাল কোলকাতায় খুব কায়ক্লেশে পরিবার নিয়ে জীবনধারণ করতে হিমশিম খেয়ে যাচ্ছেন। মাঝে মাঝে কিছু কবিতা লিখে পত্রিকায় পাঠাচ্ছেন, সমালোকদের চাবুকে ক্ষতবিক্ষত হচ্ছেন, এমনকি অসঙ্গত কবিতা লেখার দায়ে চাকরীচ্যুত হচ্ছেন।

কী অদ্ভুত বৈপরীত্যে ভরপুর আমার দুই প্রিয় কবির জীবন। যদি সাধ্য থাকতো তাহলে বলতাম, তোমরা যদি আরেকটু কাছাকাছি হতে পারতে। জীবনানন্দ যে কি  বিপুল বেদনা নিয়ে জীবন কাটাচ্ছে তা রবিঠাকুরকে জানাবার কেউ ছিল না। অমিয় চক্রবর্তীর সুযোগ ছিল, তিনি দীর্ঘকাল রবীন্দ্রনাথের সেক্রেটারী ছিলেন, তিনি জানতেন জীবনানন্দ কী দুর্দশায় জীবন কাটাচ্ছে। তিনি কি কখনো এভাবে ভেবেছিলেন? ভাবেননি। আসলে তখন কেউই তাঁকে নিয়ে সেভাবে ভাবেননি। কেননা তখন কেউ জানতেন না কবি জীবনানন্দ দাশ একদিন বাংলাসাহিত্যে মহীরূহ হয়ে উঠবেন। মৃত্যুর ত্রিশ বছর পর জীবনানন্দ ও রবিঠাকুর এক টেবিলে আলোচিত হবার মতো সম্মান লাভ করবেন।

যদি জানতেন, তাহলে কেউ না কেউ নিশ্চয়ই রবিঠাকুরকে গিয়ে বলতেন, গুরুদেব, মিলুর জন্য একটা চাকরী দেবেন শান্তিনিকেতনে?

[**মিলু, জীবনানন্দ দাশের ডাক নাম]

No comments: