Sunday, August 7, 2016

যে শহরে সমুদ্র প্রবেশ করেছে ঐতিহাসিক অধিকারে

ক্রমশঃ নিমজ্জিত হতে থাকা একটি শহর-
কর্ণফুলী নদী ও চট্টগ্রাম শহরের ঐতিহাসিক ভৌগলিক বিবর্তনের প্রভাব



ইতিহাসের সাথে ভূগোলের গভীর একটি সম্পর্ক আছে। চট্টগ্রাম শহরের বর্তমানের একটি জটিল সমস্যা নিয়ে ভৌগলিক ইতিহাসের ভিত্তিতে সংক্ষেপে আলোচনা প্রচেষ্টা।

চট্টগ্রামের আজকের স্থানীয় পত্রিকাতেও বিনাবৃষ্টিতে শহর প্লাবিত হবার দুটো সংবাদ।
১) এছাক ব্রাদার্সের কন্টেইনার ডিপো তলিয়ে গেছে,
২) চাক্তাই খাতুনগঞ্জের ব্যাপক এলাকা প্লাবিত সাধারণ জোয়ারে। শত কোটি টাকার ক্ষতির সম্ভাবনা।

চট্টগ্রাম শহরের কিছু অঞ্চল বিনা বৃষ্টিতে স্বাভাবিক জোয়ারের পানিতেই প্লাবিত হচ্ছে বেশ কয়েক বছর ধরে। এই ঘটনাটিকে প্রায় স্বাভাবিক বলে ধরে নিয়েছে অনেকেই। অপরিকল্পিত নগরায়ন, জলবায়ু পরিবর্তন, সমুদ্রের উচ্চতাবৃদ্ধি ইত্যাদিকে দায়ী করা হয়েছে ঘটনাটির জন্য। কিন্তু তার বাইরেও আরেকটি কারণ থাকতে পারে কিনা সেটি বিচার করার জন্য এই লেখাটির সুত্রপাত।

চট্টগ্রাম শহরের জন্মের ইতিহাস এবং কর্ণফূলী নদীর বিবর্তনের ধারাবাহিকতাকে বিবেচনায় এনে দেখলে বৈশ্বিক কারণ বাদেও স্থানীয় একটি কারণকে দায়ী করা যায় এই শহরটির অস্বাভাবিক জোয়ারের ব্যাপারটিকে। বলা বাহুল্য এটি কোনমতেই বিশেষজ্ঞ মত না, পরীক্ষিত, নিরীক্ষিত কোন বিষয় না। একজন ইতিহাস পাঠক হিসেবে গত কয়েকশো বছরে চট্টগ্রাম শহরের ভৌগলিক পরিবর্তনের যে বিষয়গুলো চোখে পড়েছে তারই ভিত্তিতে এই ভাবনাটা এসেছে।
আমরা সবসময় এই সমস্যার জন্য সমুদ্রের উচ্চতাবৃদ্ধিকে দায়ী করে আসলেও কখনো ভূমির নিন্মগামীতার কথা বলিনি। কোন কারণে ভূমির উচ্চতা কী হ্রাস পেতে পারে না? বিশেষ করে সেই ভূমি যদি সমুদ্রগর্ভ থেকে জেগে ওঠা চর হয়ে থাকে? চট্টগ্রাম শহরের যে অঞ্চলগুলো জোয়ারের পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে তার সবগুলোই একশো বছর আগেও বিস্তৃর্ণ চরাঞ্চল ছিল। তারো আগে ছিল ছোট ছোট দ্বীপ। তারো আগে ছিল নদী। তারো আগে ছিল বঙ্গোপসাগরের অংশ। কর্নফূলী নদীর মোহনা ক্রমাগত ভরাট হতে হতে আজকের চট্টগ্রাম শহরের অধিকাংশ অঞ্চল গড়ে উঠেছে।
এখন দেখা যাক কোন কোন অঞ্চলকে পাঁচশো বছর আগের সমুদ্রের অংশ হিসেবে চিহ্নিত করা যায়।

প্রাথমিক পর্যবেক্ষনে দেখা গেছে বাকলিয়া, চর চাক্তাই, পতেঙ্গা, হালিশহর, আগ্রাবাদ, ডাঙ্গার চর ইত্যাদি এলাকা এই সমস্যায় আক্রান্ত। বর্তমান মানচিত্রের উপর লাল দাগ দিয়ে আনুমানিক অঞ্চলকে দেখানো হয়েছে এখানে। শহরের জোয়ার প্লাবিত অঞ্চলও এই একই জায়গাগুলো। সমুদ্রের জোয়ার নতুন কোন বিষয় না। কিন্তু দশ বছর আগের তুলনায় সেই জোয়ারের উচ্চতা প্রায় ছয় ফুট বেড়ে গেছে আগ্রাবাদ অঞ্চলেই। সিডিএ এবং আগ্রাবাদ এক্সেস রোডের বাসিন্দাগন এটা সবচেয়ে ভালো জানেন।

যদি বলা হয় সমুদ্রের উচ্চতাবৃদ্ধিই এর কারণ, তাহলে বলতে হবে সমুদ্র তো শুধু চট্টগ্রামের সাথে যুক্ত না। সেই সমুদ্র বঙ্গোপসাগর না শুধু, সেই সমুদ্র মহাসাগরের সাথে যুক্ত। ভারত মহাসাগর।

সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধিই এর একমাত্র কারণ হলে মালদ্বীপ সম্পূর্ণভাবে তলিয়ে যাবার কথা। পৃথিবীর নানান মহাসাগরের আরো অনেক দ্বীপ আছে মাত্র এক দেড় ফুট উচ্চতা বাড়লেও তা তলিয়ে যাবে। সুতরাং চট্টগ্রাম জোয়ারের পানিতে তলিয়ে যাবার মূল কারণ সমুদ্রের উচ্চতাবৃদ্ধি নয়। বরং উল্টোটা হবার সম্ভাবনা। যে অঞ্চলগুলো সমুদ্রের অংশ ছিল কয়েকশো বছর আগে, সেই অঞ্চলগুলো কোন কারণে উচ্চতা হারাচ্ছে। উচ্চতা হারানোর ব্যাপারটা কেউ নিরীক্ষা করেছে বলে জানা নেই। বিশ বছর আগের চট্টগ্রামের ওই চিহ্নিত এলাকাগুলোর উচ্চতা কতো ছিল, আর এখন কতোটা কমেছে সেটার সরেজমিন তদন্ত করার দরকার আছে। আশা করা যায় উচ্চতা পরিমাপ করার যথাযথ প্রযুক্তি কতৃপক্ষের কাছে আছে।

এই লেখাটির উদ্দেশ্য যথাযথ কতৃপক্ষ যেন জোয়ার প্লাবনের এই সমস্যাটির সমাধানে চট্টগ্রাম শহরের ভৌগলিক বিবর্তনকেও বিবেচনায় আনেন।

পর্ব -১: Map-0
এই পর্বে বর্তমান কর্ণফুলীর মানচিত্রটি দেয়া হয়েছে Map-0 নামে। এরপর পুরোনো মানচিত্রগুলো দেয়া হবে ধারাবাহিকভাবে পেছনের দিকে। আমার হাতে আপাততঃ আরো পাঁচটি প্রাচীন মানচিত্র আছে। প্রত্যেকটি মানচিত্র আলাদা পোস্টে দেয়া হবে সময়কাল উল্লেখ করে। বর্তমান মানচিত্রের সাথে তুলনা করতে সুবিধা হবে তাতে। প্রতিটি মানচিত্রের যথাযথ সুত্র প্রাপ্তি সাপেক্ষে উল্লেখ করা হবে। বলার অপেক্ষা রাখে না, বর্তমান মানচিত্রটি গুগল ম্যাপ থেকে নেয়া


---------------------------------------------------------------------------------------------------------------------

পর্ব -২: Map-1
এর সময়কাল ১৯৫৫ সালের কাছাকাছি সময়ে।
চট্টগ্রাম ও কর্ণফুলী নদীর আশপাশের ভৌগলিক অবস্থান নির্দেশক। খুব বেশী পুরোনো না হলেও কিছু পরিবর্তন লক্ষ্যনীয়।



---------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
পর্ব -৩: Map-2 
Map-2 এর সময়কাল ১৯৩২
এই মানচিত্র তৈরী করেছে আমেরিকার মেরিন সার্ভে দপ্তর। এই মানচিত্রটি আরো হাই রেজুল্যুশন হলে ভালো হতো। চট্টগ্রাম বন্দরের কাছে এর কপি থাকার সম্ভাবনা আছে। কিন্তু এটুকুতেই আমার বেশ বুঝতে পারছি কর্নফূলী নদীর মোহনাটা কিভাবে পরিবর্তিত হয়েছে। ডাঙ্গার চর নাম জায়গাটা একসময় নদী ও সমুদ্রের অংশ ছিল তাতে কোন সন্দেহ নেই। বাকীটা ছবি দেখেই বোঝা যাবে।

---------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
পর্ব -৪: Map-3 
Map-3 জেমস রেনেলের তৈরী ১৭৮৬ সালের মানচিত্র।
দেড়শো বছর পেছনে চলে গেলাম এই মানচিত্রে এসে। এটা বৃটিশ শাসনের সূচনাযুগ। শুধু চট্টগ্রামের মানচিত্র মিলবে না ওই যুগে। শুধু ঐতিহাসিক বিবরণই পেতে পারি। সেই সব বিবরণ এবং এই মানচিত্র মিলিয়ে দেখলে কিছুটা অনুমান করা যায় কর্নফূলী নদীর মোহনা, সংলগ্ন দ্বীপ এবং চট্টগ্রাম শহরের তৎকালীন অবস্থা। এটা সম্ভবত সেই সময় যখন পতেঙ্গা এলাকাটি সমুদ্র গর্ভে ছিল। চট্টগ্রাম শহরের শেষ অংশটি সরু হয়ে শেষ হয়ে গেছে যেখানে সেই অংশটির কোন নাম পাই না এই মানচিত্রে। হতে পারে সেটি ফিরিঙ্গীবাজার বা সদরঘাটের দিকের কোন অংশ।


---------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
পর্ব -৫: Map-4 
Map-4 জোহান হোমান(Johann Homann) এর তৈরী মানচিত্র থেকে নেয়া।
হোমান ছিলেন জার্মান ভূগোলবিদ যিনি ইউরোপ আমেরিকার বেশ কিছু বিশ্বখ্যাত মানচিত্র তৈরী করেছিলেন। ভারতবর্ষের মানচিত্রটি সম্ভবত ১৭২০ সালের কাছাকাছি সময়ে তৈরী করেছিলেন। এই মানচিত্রে দেখা যাবে কর্ণফুলীর মোহনা থেকে পূর্বেকার ম্যাপের দ্বীপসমূহ অপসারিত। তার মানে তখন চট্টগ্রাম শহরের অনেকটা অংশ সমুদ্রের গর্ভেই বিলীন অবস্থায় ছিল। মোহনা বহুগুন বড় ছিল। বঙ্গোপসাগর অনেকখানি শহরের ভেতরেই অবস্থান করছিল। সেক্ষেত্রে পুরোনো কিছু ঐতিহাসিক মিথের সত্যতা মেলে। যেখানে বলা হতো বাটালী হিলের পাদদেশে বসে লোকে বড়শি দিয়ে সমুদ্রেরর মাছ ধরতো কিংবা পরীর পাহাড়ে(কোর্টহিল)র পাদদেশে সাগরের ঢেউ আছড়ে পড়তো। এই ঘটনাগুলো সত্যিই ঘটতো মাত্র কয়েকশো বছর আগে।




---------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
পর্ব ৬: Map-5 

Map-5 মানচিত্রটি ডাচ ভুগোলবিদ Johannes Janssonius এর তৈরী।
সময়কাল ১৬৫৫ খ্রিস্টাব্দ। আমাদের হাতে থাকা এই অঞ্চলের সবচেয়ে প্রাচীন মানচিত্র।
এই মানচিত্রটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল ইউরোপের সব রাজ শক্তির কাছে। বস্তুত এই মানচিত্রের উপর ভিত্তি করেই ইউরোপের উপনিবেশবাদী সকল শক্তি এই অঞ্চলে সকল অভিযান চালিয়েছিল। এই মানচিত্রটি সব দিকে নিখুঁত বলা যাবে না। কিন্তু কর্ণফুলী নদী ও তৎসংলগ্ন অঞ্চলে তখন ইউরোপীয় জাহাজের বিচরণ স্বচ্ছন্দ। তাই এই অঞ্চলের দ্বীপ, নদী ও সমুদ্রের মোহনাগুলোর অবস্থানের ক্ষেত্রে এই মানচিত্রটির উপর নির্ভর করা চলে। আমরা এই মানচিত্রে দেখবো চট্টগ্রাম শহর, কর্নফুলী নদী ও তার মোহনা ইত্যাদি বিষয়। এই মানচিত্রে Bengala নামক একটি জায়গার নাম আছে যা মূলত শহরের উল্টোদিকে দেয়াঙ্গে অবস্থিত পর্তুগীজ ঘাটিকে বোঝানো হয়েছে। তখন এই এলাকাকে বেঙ্গালা বন্দর হিসেবে ধরা হতো। এই মানচিত্রটি চট্টগ্রামের ভৌগলিক অবস্থার বিবর্তন পর্যবেক্ষণে আগ্রহীদের জন্য অনেক তথ্যের খোরাক হতে পারে। বিশেষ করে চট্টগ্রাম শহরের আশেপাশে অবস্থিত দ্বীপগুলোর ভবিষ্যত পরিণতি আমাদের বর্তমানের চট্টগ্রাম শহরের সাথে সম্পর্কিত তাতে কোন সন্দেহ নেই।




বিনা বৃষ্টিতে চট্টগ্রাম শহরের জোয়ারমগ্ন হয়ে পড়ার যে সমস্যার কথা বলা হয়েছিল প্রথম লেখাটিতে, উপস্থাপিত ৫টি মানচিত্রে তার কিছু উত্তর হয়তো মিলবে। এই বিষয়ে ভবিষ্যতে আরো অনেক আলোচনার অবকাশও রয়েছে। আপাতত এটুকুই।

No comments: