Thursday, July 28, 2016

এক + আ

দুজন কখন একা হয়?
যখন বিয়োগফল হয়

জলের আয়নায়

এখানে আকাশধোয়া বৃষ্টির জল। স্বচ্ছ টলোমল। হাঁটুপানি, নামলেই পায়ে সুড়সুড়ি। ছোট মাছের দল নিজেদের নিয়ে খেলছে। হাত ডোবালে আমিও তাদের সঙ্গী হতে পারি। মাছেদের সাথে লুকোচুরি ছোঁয়াছুয়ি। ভালোর চেয়ে বেশী বাসি। কত বর্ষা কেটে গেছে হিসেব রাখিনি। ছায়া ছায়া আবছায়া অগভীর জলের জগত। বেড়ে ওঠা ঘাসের ডগা প্রতিচ্ছবি দর্শনে মুগ্ধ। এখানেই, এইখানে শৈশব স্মৃতির সকল আধার। হাঁটুজলে ডুব দেয় অতীত সন্ধানী মন। 
আষাঢ়ে শ্রাবণে এখানে আমি স্মৃতির প্লাবনে ভাসি। 



Wednesday, July 27, 2016

একটি সাহিত্য পত্রিকার ছোটগল্প পাঠ এবং তার সংক্ষিপ্ততম প্রতিক্রিয়া

একটা সময় ছিল দৈনিক বা সাপ্তাহিক পত্রিকার ঈদ সংখ্যাগুলোর জন্য সারা বছর একটা প্রতীক্ষা থাকতো আমাদের। ব্যক্তিগতভাবে আমার ঈদসংখ্যা পাঠের বয়স মোটামুটি দশ বছরের মতো। মধ্য আশির দশক থেকে মধ্য নব্বই পর্যন্ত। তখন সাপ্তাহিক বিচিত্রা পছন্দের শীর্ষে ছিল, এর সাথে উল্লেখযোগ্য ছিল রোববার এবং সন্ধানী। রোববার ও সন্ধানী বন্ধ হয়ে যায় একসময়। বিচিত্রাও একদিন নাম বদলে সাপ্তাহিক ২০০০ হয়ে পড়ে।

পছন্দ ব্যাপারটা আপেক্ষিক, সবার ক্ষেত্রে সমান না। আমার আগ্রহ ছিল উপন্যাসকেন্দ্রিক। কারণটা পরিষ্কার। ছাত্রজীবনে হাতে বই কেনার টাকাপয়সা যথেষ্ট থাকতো না। তাই ঈদ সংখ্যায় একসাথে তিন থেকে পাঁচটা উপন্যাস পেয়ে যাওয়াটা ভাগ্যের ব্যাপার মনে হতো। আশির দশকে সাহিত্যের বাণিজ্যিকীকরণ শুরু হয়নি। নব্বইয়ের শেষ দিকে প্রযুক্তির প্রসারের সাথে সাথে সাহিত্যে বাণিজ্যে অনুপ্রবেশ ঘটতে শুরু করে এবং প্রবলভাবেই আক্রান্ত হয়। এটা সেই সময় যখন মিডিয়ার সাথে কর্পোরেট জগতের বাণিজ্যিক প্রেম যুক্ত হতে থাকে। সেই সময় থেকে ঈদসংখ্যায় উপন্যাসের সংখ্যা বাড়তে শুরু করলো, শব্দ সংখ্যা কমতে শুরু করলো, ফরমায়েশী লেখার তোড়ে সৃষ্টিশীলতা গেল ভেসে। একসময় ঈদ সংখ্যা কেনা বাদ দিতে হলো। বিখ্যাত লেখকদের অখাদ্য উপন্যাসে ঈদসংখ্যার ওজন বাড়লেও মন ভরানোর মতো বস্তুর খুব অভাব ছিল। দুয়েকটি ভালো লেখা ছাপা হচ্ছিল না তা নয়, পরিমানটা মোটেও আশাপ্রদ না।

অনেকদিন পর এবছর একটা ঈদ সংখ্যা কিনে ফেললাম সাহস করে। জনপ্রিয় পত্রিকা বাদ দিয়ে সাহিত্যপত্রিকার ঈদসংখ্যা কিনলাম একটু বেশী আশাবাদ নিয়ে। আমার সাম্প্রতিক পড়াশোনায় মনোযোগের অন্যতম কেন্দ্র ছোটগল্প। 'শব্দঘরে'র ঈদসংখ্যা ২০১৬ কিনেছি মূলতঃ ছোটগল্প পড়ার জন্য। এই সংখ্যায় বিশটির মতো ছোটগল্প আছে। তার মধ্যে প্রথমদিকে ধারাবাহিকভাবে কয়েকজনের গল্প নিয়ে পড়লাম। যে গল্পগুলো পড়েছি তা হলো-

থুতু - সেলিনা হোসেন
শৈত্যপ্রবাহ - ওয়াসি আহমেদ
মৈত্রেয়ী অথবা প্রার্থনার গল্প - হরিশংকর জলদাস
এক সন্ধ্যায় পরিদের বাড়িতে - দিলওয়ার হাসান
বৃষ্টি খুঁজে ফিরি - ওমর কায়সার
অবচেতনের সহোদরা - জাকির তালুকদার
ব্যালেন্স শিট - জুনাইদুল হক
খরা - ধ্রুব এষ
নদীও গড়ে - মনি হায়দার
উপেক্ষিত - জুলফিয়া ইসলাম
বিনামূল্যে বিতরণের জন্য - শাহনাজ মুন্নী

দুঃখের সাথে বলতে হচ্ছে অধিকাংশ গল্প আমাকে হতাশই করেছে। এতগুলো গল্পের আলোচনা লেখা খুব সহজ নয়। তাই আলোচনায় না গিয়ে খুব সংক্ষেপে গল্পগুলো পড়ে পাঠক হিসেবে আমার তাৎক্ষণিক ক্ষুদে মূল্যায়ন চেষ্টা। বলা বাহুল্য, এই কয়েকটি গল্প দিয়ে ওইসব লেখকের সামগ্রিক সাহিত্য মান বোঝা যাবে না। এই লেখকদের অন্য বেশ কিছু গল্প আছে আমার ভীষণ প্রিয়। আমি শুধু এই ঈদ সংখ্যায় ছাপানো গল্পের রেটিং নিয়ে বলছি আজ।

-সেলিনা হোসেনের 'থুতু' গল্পটিতে বড়লোকের শিক্ষিত কর্মহীন একটা ছেলেকে প্রায় আরোপিত সমস্যাগ্রস্থ করে নাটকীয়তা আনার চেষ্টা করা হয়েছে, যা শেষমেষ কোন পরিণতিই পায় না। গল্পটিতে লেখক তার নিজের প্রতি সুবিচার করেননি।

-ওয়াসি আহমেদের 'শৈত্য প্রবাহ' তাঁর অন্যন্য গল্পের মতো আশা জাগানিয়া না হলেও অবসরে যাওয়া একজন মানুষের মানসিক অবস্থানের বিবরণ নিয়ে মোটামুটি ভালো লিখেছেন।

-কিন্তু দিলওয়ার হাসানের 'এক সন্ধ্যায় পরিদের বাড়ি' গল্পটি বলার ধরণে উৎরে গেলেও প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে বেশ কয়েকটি জায়গায়।

-ওমর কায়সার 'বৃষ্টি খুঁজে ফিরি' গল্পটি আত্মকথনের ধরণে একটি ডায়েরীর অংশ বলে মেনে নেয়া গেলেও গল্প হিসেবে দুর্বল, বহুল চর্চিত একটি সস্তা প্লট।

-জাকির তালুকদারের 'অবচেতনের সহোদরা' গল্পটিকে চলনসই বলা যায় যেমন বলা যায় ধ্রুব এষ এর 'খরা' গল্পটির ক্ষেত্রেও।

-জুনাইদুল হক 'ব্যালেন্স শিট' গল্পটি মোটামুটি জমিয়ে ফেলেছিলেন, কিন্তু চরম পুরুষতান্ত্রিক শেষ লাইনটি দিয়ে গল্পটির লেজটাই কেটে দিলেন।

-মনি হায়দারের 'নদীও গড়ে' গল্পটির সুত্রপাত ভালো লাগলেও সম্পূর্ণ গল্পটি শেষ করার আসল বক্তব্য বুঝতে ব্যর্থ হয়েছি।

-জুলফিয়া ইসলামের 'উপেক্ষিত' গল্পটি লেখালেখির অপরিণত বয়সের চেষ্টা বলে মনে হয়েছে।

-শাহনাজ মুন্নীর 'বিনামূল্যে বিতরণের জন্য' গল্পটি গদ্য ভালো লাগলেও বক্তব্যটি খুব খেলো। সবচেয়ে বড় কথা বিশ্বাসযোগ্যতা ছিল না গল্পের ঘটনায়। যে সমস্যাকে সমস্যা হিসেবে উপস্থাপিত করেছেন তাকে পাঠকের পক্ষ থেকে কোন সমস্যা বলেই মনে হয়নি।

- একমাত্র হরিশংকর জলদাসের 'মৈত্রেয়ী অথবা প্রার্থনার গল্প' পড়ে একটা সম্পূর্ণ পাঠতৃপ্তি পেয়েছি। অনেকদিন পর প্রাণস্পর্শী একটি গল্প পড়লাম। গল্পটি দুই পিতার দুর্ভাগা দুই কন্যাকে নিয়ে। দুই পিতা সমান্তরাল জায়গায় দাঁড়িয়ে যে প্রবল মানবিক কষ্টের মধ্যে তাদের সময় পার করেছেন সেই চিত্রটি দক্ষতার সাথে আঁকতে পেরেছেন লেখক। পাঠক হিসেবে এই একটি গল্পেই আমি সন্তুষ্ট হতে পেরেছি। বাকী গল্পগুলো ঈদসংখ্যার দায়সারা ফরমায়েশী লেখা বলে মনে হয়েছে।

আমি জানি না পত্রিকায় লেখাজোকা ছাপানোর ক্ষেত্রে ভালো লেখকদের খারাপ গল্প বাদ দেবার ক্ষমতা কোন সম্পাদক রাখেন কিনা। সম্ভবত রাখেন না বলে প্রতিষ্ঠিত লেখকদের দায়সারা লেখায় ভরপুর থাকে এরকম বিশেষ সংখ্যাগুলো। তুলনামূলকভাবে নবীন লেখিয়েদের গল্পগুলো প্রতিষ্ঠিত লেখকদের চেয়ে ভালো হয়। অধিকাংশ বড় লেখক বিশেষ সংখ্যাগুলোতে ভালো লেখা দিতে পারেন না। কেন পারেন না? যতটুকু বুঝি সাহিত্য ব্যাপারটা ফরমায়েশ দিয়ে হয় না। প্রাণের তাগিদে, অনুভূতির বিস্তারে যে লেখা সম্পন্ন হয় তার সাথে টাইমটেবল বেঁধে, রুটিন মেপে, অনুরোধ রাখতে গিয়ে যে লেখা বের হয় তার তুলনা চলে না।

এই সমস্যাটা আগেও ছিল। কিন্তু এখন পত্রিকার সংখ্যা বেড়ে যাওয়াতে লেখার চাহিদা বেশী। সেলেব্রিটি লেখকদের একাধিক পত্রিকায় লেখার তাগিদ থাকে। পত্রিকার সম্পাদকেরা নতুন লেখককে স্থান দেবার চেয়ে প্রতিষ্ঠিত লেখকের গল্প উপন্যাস ছাপাতেই পছন্দ করেন। প্রতিটি পত্রিকার ঈদ সংখ্যায় দেখা যাবে দশ বারোজন প্রতিষ্ঠিত লেখকের লেখাই ঘুরে ফিরে প্রতি বছর থাকে। নতুন লেখকের দেখা মেলে না তেমন। সে গল্প হোক বা উপন্যাস হোক। ঈদ সংখ্যার লেখাগুলোই আবার একটু ঘষে মেজে পরবর্তীকালে বইমেলাতে প্রকাশিত হয়।

বছরের পর বছর ধরে চলা এই প্রক্রিয়ার মধ্যে সুসাহিত্যের গুনাগুন ভালোমন্দ একাকার হয়ে যাচ্ছে। দুয়েকজন ব্যতিক্রম বাদ দিয়ে অধিকাংশ লেখকই সাহিত্য বাণিজ্যের চক্রে আটকে গেছেন। ফলে আমরা সাধারণ পাঠকরা নতুন কিছু পাচ্ছি না। না গল্পে, না উপন্যাসে। যেন বছর বছর একই গল্পই লেখা হচ্ছে। রাজনীতিতে যেমন পুরোনো নেতার দাপটে তরুণ নেতার জায়গা হয় না, সাহিত্যেও কি সেই ব্যাপার চলে এসেছে? আমার জানা নেই।

একটি সাহিত্য পত্রিকা চালানো সহজ কথা নয়। ভালো লেখার সংকলন আরো কঠিন ব্যাপার। তবু এরকম শীর্ষস্থানীয় সাহিত্য পত্রিকার একটি বিশেষ সংখ্যায় মানসম্পন্ন গল্পের অভাব থাকাকে বাংলা ছোটগল্পের খরা হিসেবে চিহ্নিত করা যায়? নাকি লেখক সম্পাদকের বাণিজ্যিক মানসিকতার পরিপূরক চক্রটিকে দায়ী করা উচিত?

আনন্দ-বিষাদের আপেক্ষিক গুরুত্ব

আনন্দ, তুমি সরে যাবার পর বিষাদ এসে আমাকে আঁকড়ে ধরে। আনন্দ, তুমি বেশী সময় থাকো না কেন? তোমার কেবলই দেরী হয়ে যায়। তোমার জন্য কেবলি গাড়িটা ছেড়ে যাবার অপেক্ষায় থাকে। তোমার হাত ধরার আগেই তুমি টুপ করে অপেক্ষার ট্রেনে উঠে যাও আমাকে পেছনে ফেলে। প্ল্যাটফর্মে আমি যখন একা, তখন ওঁত পেতে থাকা বিষাদ এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলে- আমি, আমিই তোমার আসল, আনন্দ কেবল মায়া, ভ্রান্তি।

তুমি বলো আনন্দ, আমি কী করি? বিষাদকে ঝেড়ে ফেলে আমি আবার ফিরতি ট্রেনের অপেক্ষায় থাকি যদি তুমি ফিরে আসো। তুমি কখনো আসো, কখনো সপ্তাহান্তেও আসো না। আনন্দ তুমি জানো আমি আমার সব কাজ তোমাকে সাথে নিয়েই। তুমি থাকলে আমি সব করতে পারি। তুমি চলে গেলে আমার কাজ থেমে যায়, হাত থেমে যায়, মুখ থেমে যায়, হাসি উড়ে যায়, আমার মুখে ঝোলভাতের অমৃতও রোচে না।

বিষাদকে তুমি চেনো? বিষাদের কোন রং নেই, বিষাদ ধূসর, মেঘলা দুপুরের বৃষ্টিহীন আকাশের মতো।  বিষাদ আমাকে ভালোবাসে। আমাকে সুযোগ পেলেই আকড়ে ধরে। আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে রাখে। কোন কাজ করতে দেয় না। আমার হাত পা অচল করে রাখে। বলে আমি, আমিই তোমার আসল। তোমার কিছু করতে হবে না। এই দেখো আমি তোমাকে চেপে হৃদপিণ্ডে রক্তপাত বন্ধ করে দিতে পারি। আমাকেই তুমি রাখো, আনন্দ তোমার কেউ না। আনন্দকে ভুলে যাও।

অথচ আনন্দ, আমি তোমাকে ভুলতে পারি না। বিষাদ আমার সবকিছু আটকে দিতে পারে, স্মৃতি ছাড়া। যদি স্মৃতিও আটকে দিতে পারতো আমার এত কষ্ট হতো না। আমি তোমাকে ভুলে বিষাদকে নিয়ে কাটিয়ে দিতাম বাকীটা সময়। আনন্দ তুমি কেন চলে যাও আমি জানি না। তুমি কখনো বলে যাও না, বলো না কেন তুমি চলে যাও। তোমাকে কারণ জিজ্ঞেস করতে আমার সাহস হয় না।

আনন্দ আমি কি তোমাকে ভয় পাই? তোমাকে হারাবার ভয় আমাকে তাড়া করে। তুমি এলে আমার ভয় কেটে যায়, কিন্তু সেই ভয় কাটিয়ে সোজা হয়ে বসার আগেই তোমার ট্রেন চলে আসে। তুমি হুট করে সেই অচেনা ট্রেনে উঠে চলে যাও।

আনন্দ তুমি কোথায় ঘুরে বেড়াও? আনন্দ তুমি কখনো সমুদ্রে গিয়েছো কিংবা পাহাড়ে। আমি তোমাকে নিয়ে সমুদ্রে যেতে চাই, পাহাড়ে চড়তে চাই। তোমার কখনো কি সময় হবে আনন্দ? আমি যেভাবে যতক্ষণ তোমাকে চেয়েছি সেভাবে কখনোই পাইনি। তুমি এসেই চলে যাও। তোমার কেবলি তাড়া, তোমার কেবলি সময়স্বল্পতা। তোমাকে পেতে আমাকে আর কী করতে হবে?

আনন্দ, তোমাকে আমি কত বয়স থেকে চিনি? তুমি আমাকে চেনো কোন বয়স থেকে? তোমার কি বয়স আছে? তোমার তো বয়স নেই। তুমি সৃষ্টির আদিকাল থেকে আছো। আমার জন্মেরও বহুবছর আগ থেকে।

আনন্দ, আমি যখন তোমাকে বুঝতে শিখেছি, পেতে শিখেছি -তখন খুব অল্প বয়স। আমি চাইতাম তুমি আমার সাথে সাথে থাকো। কিন্তু তোমাকে রাখার সামর্থ্য আমার নেই বলে আমার চাওয়া কখনো পূর্ণ হয়নি। যখন তোমাকে পেতে শুরু করলাম, যখন তোমার সাথে আমার দেখা হতে শুরু হলো, তখন তুমি ছিলে, তখন তুমি আমার সাথেই থাকতে চাইতে। তখন ভেবেছি আমি তোমাকে পেয়ে গেছি আনন্দ। আমি ভুল আনন্দে নিজেকে স্বপ্ন দেখিয়েছি। সময় সময় সময় করে হারিয়ে গেছে তোমার সময়। এখন তোমার সাথে আমার খুব অল্প সময়ের দেখা হয়, খুব সামান্য কয়েকটি মুহূর্ত মাত্র। তুমি এসেই মাধবীর মতো বলো, যাই।

তুমি কোথায় কোথায় যাও আনন্দ? পরেরবার এলে তোমার ঠিকানাটা রেখে যেও। আমি সেই ঠিকানায় উড়ে যাবো সোনালী ঈগলের ডানা হয়ে। উড়ে যেতে যেতে ভাবতে থাকবো, জীবনানন্দ তোমাকে পায়নি, আমি কী পাবো? জীবনানন্দের জীবনে তুমি শুধু নামটিতে ছাপ রেখেছিলে, বাকী জীবনে তুমি নেই, বাকী জীবন বিষাদের কাছে গছিয়ে তুমি চলে গেছো অন্য কোন ট্রেনে চড়ে।


[যদি জীবনানন্দ দাশ এমন করে ভাবতো....]

Tuesday, July 26, 2016

যে তারিখ লিখবে অন্য কেউ

যা কিছু না পাওয়ার আশংকা কিংবা আক্ষেপ ছিল একদিন, কালের স্রোতে ভাসতে ভাসতে একদিন তাও পাওয়া হয়ে যাবার পর বাকী থাকলো শুধু তোমাকে স্পর্শ করা৷ সে স্পর্শ না করলেও তুমি ঠিক ঠিক একদিন এসে স্পর্শ করে যাবে তাকে এমনকি বিসাদৃশ কোন স্থানে হলেও৷ যেমন স্পর্শ করলে জীবনানন্দকে ট্রাম লাইনে৷

তুমি কখনো মিথ্যে নও, অলীক নও৷ তবু তুমি কখন আসবে কেউ জানে না৷ নিজের এপিটাফ কেউ কেউ লিখতে পারলেও তোমার আগমনী তারিখ কেউ লিখে যেতে পারে না৷ তুমি যেদিন আসবে সেদিন তাকে চলে যেতে হবে৷ তারিখটা তাই লিখবে অন্য কেউ৷

তুমি শুধু জেনে রাখো তুমি তাকে নিয়ে যেতে পারো ঠিক৷ কিন্তু সে যা পেয়েছে তার অতীত আনন্দটুকু কেড়ে নিতে পারো না৷ সব পাওয়ার আনন্দ ঘোষণা তুমি আসার আগেই লিখে রাখলাম৷ এবার যখন খুশী আসতে পারো তুমি৷ তারিখ লেখার কলম কীবোর্ড তৈরী কোথাও!

Friday, July 22, 2016

সাবটাইটেলের টাইমিং এডজাস্ট বিষয়ক মেরামতি অভিজ্ঞতা

সাবটাইটেলের অভাবে অনেক ভালো মুভি দেখা হয়নি নামানো সত্ত্বেও। না দেখে মুছে দিয়েছি কত মুভি। ঘুরতে ঘুরতে অনেকদিন পর পছন্দসই সাবটাইটেল সাইট পেয়ে গেলাম একটা আজ। জাফর পাহানির Taxi মুভিটা দেখার জন্য নামালাম srt file.

https://isubtitles.net/taxi-20151219022329/english-subtitles/881459

এই সাইটে বিজ্ঞাপনের উৎপাত নেই। গলা চেপে ধরে বলে না তোকে দেখতেই হবে। কিছু সাইট বিশ্রী রকমের পপ আপ আর বিজ্ঞাপন উৎপাতের।


 কিন্তু মুভি দেখতে বসে সাবটাইটেলের সাথে মুভির টাইমিং মেলে না। সাবটাইটেল আসে ডায়লগের অনেক পরে। কিছুক্ষণ দেখে বিরক্ত লাগলো। রেখে দিলাম। তারপর উপায় খুঁজে দেখতে গিয়ে নতুন একটা সাইটের সন্ধান মিললো। যেখানে এই টাইমিং এডজাস্ট করা হয় srt ফাইলের।
এই সাইটের লিংকে গিয়েও পছন্দ হলো। এটাও পরিচ্ছন্ন। বিজ্ঞাপনের উৎপাত নেই। ১৮ সেকেন্ড টাইমিং এডজাস্ট করার পর দেখলাম বরাবর ঠিক সব। বেশ ভালো লাগলো এই আবিষ্কারে।

ভাবছি ইন্টারনেটে এসব মেরামতির দোকানপাট যারা দেয় তাদের লাভ কি? অথচ এরা থাকাতে কত ঝামেলা সহজে সারানো যাচ্ছে। আমার লাভটা বুঝে নিয়ে সন্তুষ্ট থাকছি আপাতত।


Thursday, July 21, 2016

'সত্যজিতের ছেলেবেলা' পাঠে সুকুমার রায়ের শেষবেলা দর্শন

বাতিঘরে গিয়েছিলাম প্রীতম বসুর 'পাঁচকড়ির পঞ্চাননমঙ্গল' বইটির খোঁজে। বইটি পাওয়া গেল না। কিন্তু হঠাৎ করেই নলিনী দাশের লেখা 'সত্যজিতের ছেলেবেলা' বইটি দেখা গেল বুকশেলফের একটা জায়গায়। নলিনী দাশ নামটা খুব চেনা, কিন্তু ঠিক মনে পড়ছিল না। বইটি হাতে নিয়ে পাতা উল্টেই মনে পড়লো। জীবনানন্দ দাশের ভাতৃবধু নলিনী দাশ, ডাকনাম নিনি। জীবনানন্দ দাশের জীবনী পড়তে গিয়ে তাঁর কথা জেনেছিলাম এবং আরো জেনেছিলাম তিনি সত্যজিৎ রায়ের পিসতুতো বোন।

সত্যজিৎ রায় ও নলিনী দাশের শৈশব কাছাকাছি সময়ের বলে বইটির স্মৃতিচারণা নিয়ে আগ্রহটা একটু বেশী জাগলো। তাছাড়া বইটি উল্টে পাল্টে দুর্লভ কিছু ছবি এবং সত্যজিতের একদম বাল্যকালের কাঁচা হাতের লেখা চিঠি ইত্যাদি দেখে বইটি কিনে ফেললাম। অতঃপর পড়তেও শুরু করি। পড়তে গিয়ে একটা জায়গায় এসে কষ্টকর একটা দৃশ্যের বর্ণনায় এসে থেমে গিয়ে এই লেখাটা লিখতে বসলাম। ওই স্মৃতিটুকু সত্যজিতের নয়। তাঁর বাবা সুকুমার রায়ের শেষ দিনগুলোর কথা।

মানিকের (সত্যজিতের) বাবা সুকুমার রায়ের অসুস্থ অবস্থায় দার্জিলিং নিয়ে যাওয়া হয়েছিল ১৯২৩ সালে।
দার্জিলিং যাবার সময় সুকুমার রায়ের স্ত্রী-পুত্রের সাথে গিয়েছিল বোন পূন্যলতা(নিনির মা) ও নিনি। নিনির মা সুকুমার রায়ের পিঠেপিঠি ছোটবোন। মানিক তখন মাত্র ২ বছরের, নিনির বয়স ৭। সুকুমার রায় দার্জিলিং-এর 'মেরি লজ' বাংলোর জানালা দিয়ে ডিভানে শুয়ে কাঞ্চনজঙ্ঘার রূপ দেখতেন, সূর্যাস্ত-সূর্যোদয় দেখতেন। তাঁর জীবনের শেষ ছবিটি ওখানেই বসেই আঁকেন। দুবছর ধরে অসুস্থ তিনি, তাঁকে নানান জায়গায় হাওয়া বদলের জন্য নেয়া হতো। দার্জিলিংও গিয়েছেন একাধিকবার। সেই অসুস্থ অবস্থাতেই তিনি লেখালেখি চালিয়েছেন, ছবি এঁকেছেন। কখনো আদরের ছোট্ট মানিককে কোলে বুকে নিয়ে সময় পার করছেন।

কিছুদিন পরে তিনি আবার কোলকাতা ফিরে এলেন। কিন্তু অসুখ তাকে নিস্তার দেয়নি।  ৯ সেপ্টেম্বর একটা বড় ভূমিকম্প হয়েছিল কলকাতায়, পরদিন ১০ সেপ্টেম্বর ১৯২৩ রায় পরিবারে ভূমিকম্প ঘটিয়ে তিনি চলে গেলেন মহাপ্রস্থানের পথে। মাত্র ৩৬ বছর বয়সে। ৩৬ কী এমন বয়স? ছোট্ট মানিক তখন তার কিছুই বোঝেনি, সেই ছোট্ট শিশুটি একদিন কত বড় হয়ে উঠবে তাঁর বাবা কোনদিনই জানতে পারবেন না।

এই অংশটুকু পড়ে কেমন একটা কষ্ট লাগলো। এত অল্প সময়ে সুকুমার রায় বাংলা সাহিত্যকে, সমস্ত বাঙালী জাতিকে কী বিপুল উপহার দিয়ে গেলেন। তাঁর বই না হলে অনেকের ছেলেবেলাটাই বিরস কাটতো। আমরা সবসময় তাঁর সৃষ্টিকর্মের আনন্দটা গ্রহণ করেছি। সুকুমার রায় মানেই মজার এক মানুষ, দম ফাটানো হাসির যোগানদাতা মজার সব রচনা তাঁর। অথচ তিনি নিজের জীবনটা উপভোগ করার মধ্য গগনে থাকতেই সব ছেড়ে চলে গেলেন অকাল বয়সে। প্রতিটি মানুষের চিরপ্রস্থানই বিষাদের। কিন্তু এই প্রস্থানটির বর্ণনা একদম ব্যক্তিগত স্মৃতি নেয়া বলেই হয়তো বেশী নাড়া দিল। নলিনী দাশের এই স্মৃতির টুকরোটা না পড়লে সুকুমার রায়ের ওই বেদনার্ত শেষবেলাটুকু কখনো জানা হতো না।

সত্যজিৎ রায়ের জীবনী সম্পর্কে কমবেশি সবাই জানেন। এখানে শুধু দুটো মজার বাল্য স্মৃতির উল্লেখ করি। সুকুমার রায়ের মৃত্যুর পর রায় পরিবারের প্রকাশনা ব্যবসা ইত্যাদি বিক্রি করে দিতে হয় পরিচালকের অভাবে। আড়াই বছরের সত্যজিতকে নিয়ে তার মা ভাইয়ের বাড়িতে উঠে যান। সেখানেই সত্যজিতের শিক্ষা দীক্ষা বেড়ে ওঠা। সেই বাড়িতে অন্যন্য বাচ্চাদের সাথে খেলতে গিয়ে একদিন 'ডাক্তার- রোগী' খেলায় সত্যজিৎ ডাক্তার সেজেছিল। কেউ তাকে বলেছিল তুমি বড় হয়ে ডাক্তার হবে। জবাবে সত্যজিৎ যা বলেছিল তা শুনে সবাই হেসে খুন। সে বলেছিল -বড় হয়ে সে জার্মানি গিয়ে সিনেমা তৈরি শিখে এসে সিনেমা বানাবে। ভাবা যায় পাঁচ বছর বয়সী একটা বাচ্চার মুখে এমন কথা!

সত্যজিৎ স্কুলে ভর্তি হয়েছিল সাড়ে আট বছর বয়সে। সেই বয়সে বই ডিকশেনারী খুঁজে মজার মজার কিছু শিখে অন্যদের সাথে শেয়ার করতো। একদিন এসে শেখালো নতুন একটি শব্দ floccinaucinihilipilification যার বাংলা অর্থ হলো 'অনুমান করে দেখা গেল যৎসামান্য'। আমি এই বয়সেও কখনো এই শব্দের দেখা পাইনি। চেক করে জানলাম এই শব্দটি ইংরেজি ডিকশেনারীর সবচেয়ে দীর্ঘ নন টেকনিক্যাল শব্দ। ওই পুঁচকে ছেলের প্রতিভা ছেলেবেলা থেকেই ফুটে বের হবার অপেক্ষায় ছিল তা বলাই বাহুল্য।

বইটি দেখতে একদম সাদামাটা। আকারেও তেমন বড় না, ১২০ পাতার মতন। ছাপাও উন্নত না, কাগজের মান, প্রচ্ছদের মান সবকিছুই দুর্বল। এমন বই, একটা ভালো প্রকাশক পেলো না বলে আক্ষেপ লাগছে। তবু সত্যজিতের দুর্লভ কিছু ছবি আর ছেলেবেলার বেশ কিছু হাতে লেখা পত্রের কারণে বইটি সংগ্রহে রাখার মতো।

ধন্যবাদ নলিনী দাশ বইটি লেখার জন্য। ধন্যবাদ অমিতানন্দ দাশ বইটি প্রকাশের দায়িত্ব নেবার জন্য। অমিতানন্দ দাশ নলিনী দাশের সন্তান, জীবনানন্দের ভাতুষ্পুত্র। যিনি জীবনানন্দের অপ্রকাশিত সব রচনা প্রকাশ করার ব্যাপারেও অসম্ভব পরিশ্রম করেছেন দায়িত্বশীলতার সাথে। ধন্যবাদ তাকেও যার উসিলায় বইটির সন্ধান পাওয়া গেল।

Tuesday, July 19, 2016

বাংলাদেশের বই জগতের দুই সেনাপতি

আজ ১৯শে জুলাই তারিখে বাংলাদেশের বই রাজ্যের দুই সেনাপতির কথা বলি। এই দিনে একজনের আগমন ঘটেছিল পৃথিবীতে, আরেকজনের প্রস্থান ঘটেছিল। তারিখের মিলটা কাকতাল হলেও বাংলাদেশে এই দুজন মানুষ একটি কারণে গুরুত্বপূর্ণ। দুজনেই বাংলাদেশে বিশাল একটা অংশের তরুণ পাঠক সৃষ্টি করেছিলেন। তাঁদেরকে কিছু কিছু জায়গায় সাহিত্যিকের মর্যাদা দেয়া না হলেও তাঁদের দুজনের গ্রহনযোগ্যতা আছে তেমন মানুষের সংখ্যাটা মোটেও উপেক্ষা করার মতো নয়। অসংখ্য মানুষের বইপ্রীতির সূচনাটা তাঁদের মাধ্যমে হয়েছিল।

তাঁরা হলেন কাজী আনোয়ার হোসেন (জন্ম ১৯শে জুলাই ১৯৩৬) এবং হুমায়ূন আহমেদ (প্রয়াত ১৯শে জুলাই ২০১২)

কাজী আনোয়ার হোসেন সেবা প্রকাশনীর প্রতিষ্ঠাতা। এই প্রতিষ্ঠানটি রীতিমত একটি মহীরূহ। বাংলাদেশে বিশ্বখ্যাত বিদেশী সাহিত্যকে জনপ্রিয় এবং সহজলভ্য করার পেছনে সেবা প্রকাশনীর চেয়ে বেশী অবদান কারো নেই বলে জানি। যে আমলে ইন্টারনেট ছিল না, বিশ্বাসাহিত্য সম্পর্কে জানার সুযোগ সবার জন্য অবারিত ছিল না, এমনকি ঢাকা শহরের মধ্যেও যার পরিধি ছিল খুবই সীমিত, সেই সময়ে সেবা অনুদিত বিশ্ববিখ্যাত বইপত্র আমরা মফস্বলে বসেও স্বচ্ছন্দে পেয়ে যেতাম। এটা যে কী অসাধারণ একটা প্রাপ্তি ছিল সেটা বুঝতে হলে ওই সময়ের বাস্তবতায় না ভাবলে বোঝা অসম্ভব। আর অনুবাদের মান হিসেব করলে বলবো সেবার সমতূল্য অনুবাদ আমি উপমহাদেশের কোথাও পাইনি। শুধুমাত্র একটি অনুবাদের উদাহরণ দেই এখন। জেরোম কে জেরোমের 'থ্রি ম্যান ইন আ বোট' বইটির সেবা অনুবাদের নাম 'ত্রিরত্নের নৌবিহার'। অনুবাদ করেছিলেন এ.টি.এম শামশুজ্জামান। এই বইটি আমার পড়া এখনো পর্যন্ত সবচেয়ে সেরা রম্য বই, সেরা অনুবাদ। এই বইয়ের আরো দুই খানা অনুবাদ(দুই বাংলার) পড়ার সৌভাগ্য হলেও তাঁরা অনুবাদের সেবার কাছাকাছিও যেতে পারেননি।

কাজী আনোয়ার হোসেন সেবা প্রকাশনীতে বেশ কজন প্রতিভাবান তরুণ লেখক সৃষ্টি করেছিলেন যারা পরবর্তীতে নিজ নিজ ক্ষেত্রে সাহিত্যের জগত আলোকিত করেছেন। তাছাড়া ছাপাখানা জগতেও নতুন একটি বিপ্লবকে তিনি উপস্থাপিত করেছিলেন। নিউজপ্রিন্টে ছাপা পেপারব্যাক বই বাংলাদেশে এত ব্যাপকভাবে আর কেউ চালু করতে পারেনি। সেবা প্রকাশনীর সুলভে বই ছাপার এই প্রক্রিয়াটা যদি অন্য প্রকাশনীগুলোও অনুসরণ করতো তাহলে অনেক পাঠক সাশ্রয়ী মূল্যে বই কিনতে পারতো।

অন্যদিকে হুমায়ূন আহমেদের ব্যাপারে দুটো বাস্তবতা আমার চোখে পড়ে-

১. তিনি বাংলাদেশে বিশাল একটা পাঠক শ্রেণী তৈরী করেছেন, যারা কোনদিন বইপত্র পড়তো না, পড়লেও তা রোমেনা আফাজ কিংবা কাশেম বিন আবু বাকারের চটি বইয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতো। সেই পাঠককূলকে সুস্থ ধারার বই পাঠে আকৃষ্ট করেছেন।
২. তিনি সাহিত্যকে বাণিজ্যিকীকরণ করেছেন সফলভাবে। শুধুমাত্র লেখালেখিকে পেশা হিসেবে নেবার দুঃসাহস মনে হয় খুব বেশী লেখকের ছিল না। বই বিক্রির টাকায় স্বচ্ছলতম জীবনযাপন করার উদাহরণ সম্ভবত বাংলাদেশে এই একটিই। এটি ভালো হলো কি মন্দ হলো সেই বিচারে না গিয়ে বলা যায় বই লিখে আর্থিকভাবে সফল জীবনের কৃতিত্ব তাঁকে দেয়া যায়ই।

এই দুই কৃতিত্বের দাবীদার হুমায়ূন আহমেদের হলেও এটা বলতে হয় যে শংখনীল কারাগার বা নন্দিত নরকের মতো উপন্যাস খুব বেশী লেখেননি। তাঁর ছোটগল্পগুলোকে বরং অনেক বেশী উল্লেখযোগ্য সাহিত্যকর্ম বলা চলে। সাহিত্যের মান নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে, সমালোচনার অনেক বিষয় আশয় আছে। তবু তিনি যে সরস, সহজ গদ্য দিয়ে অসংখ্য পাঠকের মন জয় করেছিলেন সেই ভূমিকাটা অস্বীকার করা যায় না। সেই কারণেই তিনি সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য।

সবশেষে বলি, কাজী আনোয়ার হোসেন ও হুমায়ূন আহমেদের জন্ম না হলে হয়তো বাংলাদেশে অনেক পাঠক বইয়ের জগতে প্রবেশ করতো না। এবং বই জগতের দুই সেনাপতির এই কৃতিত্বটা স্বীকার করাই লেখাটির মূল উদ্দেশ্য।

Monday, July 18, 2016

আত্মশুদ্ধির শিল্প

পড়াশোনা আত্মার অন্যতম একটি ফিল্টারের কাজ করে৷ আত্মশুদ্ধির জন্য কিছু কিছু বই খুব দরকারী৷ প্রতিদিন যেসব আবর্জনা আমাদের সত্তাকে দুষিত করে, একটা ভালো বই কিংবা মর্মস্পর্শী গল্প তাকে কিছুটা হলেও দুষনমুক্ত করে৷ শুধু কি বই? একটি ভালো সিনেমা অথবা গানও কি সেই ভূমিকা রাখে না?

কিন্তু সব বই নয়৷ সব গান নয়৷ সব সিনেমা নয়৷ যেসব শিল্প এই পরিশোধনের কাজটি করতে সক্ষম কেবল তাকেই বলা যায় শিল্পোত্তীর্ণ সৃষ্টি৷

Sunday, July 17, 2016

দেবেশ রায়ের 'উচ্ছিন্ন উচ্চারণ' থেকে....

'যখন সময় থমকে দাঁড়ায়......' একটা থমকে যাওয়া দুঃসময়ে গানটা প্রথম শুনেছিলাম বলেই সেই গানের সূচনা সঙ্গীত এখনো স্মৃতি কাতরতা জাগিয়ে তোলে। গান, কবিতা, সিনেমা কিংবা বই - এসব অনেক দুঃসময়ে মলমের কাজ করে। প্রায় প্রতিটি মানুষ কোন না কোন ক্ষত নিয়ে জীবন পার করে, কিছু ক্ষত প্রকাশ্য কিছু ক্ষত অপ্রকাশ্য। আমরা কী সবার সব ক্ষত দেখতে পাই? কিংবা আমার ক্ষতটা কি আর কাউকে দেখতে দেই? দেই না। মানুষ নিজের জগতে শুধু নিজেই জানে এখানে কতটা অসহায় একটা প্রাণী। কতোটা একাকীত্ব অনুভুতির ঘুপচি ঘরে লুকোনো আছে।

দেবেশ রায়ের মফস্বলি বৃত্তান্তের পর হাতে আসলো 'উচ্ছিন্ন উচ্চারণ'। পড়তে পড়তে কিছুদূর এগিয়ে ইচ্ছে করলো কিছু অনুচ্ছেদের অংশবিশেষ লিখি। নতুন এক দেবেশ রায়কে আবিষ্কার করা হলো এই বইটিতে। একটি সম্পূর্ণ অনুভুতিময় বই, চিরচেনা কিছু অনুভুতি অথচ আর কেউ লেখেনি এমন করে। আর কেউ ভাবেনি এমন করে। নতুন একটা মুগ্ধতা এসে জড়িয়ে ধরলো আজ। লালনের গান যেমন একটা ভাবের জগতে নিয়ে যায় আমাদের। এই বইটিও তেমনি ভাসায়, আর ভাবায়। ভাবতে ভাবতে...........পড়তে পড়তে.......কিছু টুকে রাখা টুকরো অংশ.......

--------------------------------------------------------------------------------------


বাঁশের ঝাড়ে ঢুকলে বাতাস পথ হারিয়ে ফেরে। তখন সে বাঁশের গুচ্ছমূল থেকে বাঁশের পাতা বেয়ে বাইরে বেরিয়ে আসতে চায়। বাঁশপাতার ভিতর দিয়ে তখন ছোট নদীর সেই কল্লোল শোনা যায়, যা দিনের বেলায় অনেক আওয়াজের সঙ্গে মিশে থাকে। তাকে আলাদা করা যায় না। এই কথাগুলো বাঁশপাতার বহতা নদীর মতো এখন কলধ্বনিতে স্পষ্ট।


যে একক দিয়েই মাপো না কেন, তুমি তো আমাদের সম্বন্ধকে এক জন্মের বেশী টেনে নিয়ে যেতে পারবে না। তাও সে জন্মের কতটাই তো আমাদের বাধ্যত আলাদা কেটেছে। তাহলে, মাত্র এক জন্ম? একটাই মাত্র জন্ম? আর তা এতই ছোট? এরই ভিতর আমাদের জন্ম জন্মান্তর জড়ানো মিলন ঘটে গেল, ঘটে শেষ হয়ে গেল? এরই ভিতর আমাদের জন্ম-জন্মান্তর দিয়েও ঘোচানো যাবে না, এমন বিচ্ছেদ ঘটে গেল? আর, আমরা দুজন এই এক জন্মব্যাপী সময় ধরে, ধীরে-ধীরে, ধীরে-ধীরে, যেমন করে ধীরে-ধীরে মরুভূমির বায়ুহীনতায় সারা রাত বালিয়াড়ির বালি ঝুরঝুর ঝুরঝুর ঝরে যেতে থাকে, অথবা, আর এক জায়গায় পুঞ্জিত হতে থাকে, তেমনি ধীরে-ধীরে, ধীরে-ধীরে জেনে গেলাম, জেনে গেলাম, যে, আমাদের ভিতরে যে বিচ্ছেদ ঘটে গেছে, তা যুগ-যুগান্ত কেটে গেলেও আর ভরাট হবে না।......আমাদের অভিকর্ষের বদল ঘটে গেছে, আমাদের আকাশের বদল ঘটে গেছে। আকাশ একবার বদলে গেলে কি আর তার পুনরুদ্ধার ঘটানো যায়?  [তের]


তুমি কী দিয়ে মাপতে আমাদের সম্বন্ধের বয়স? সূর্যের উদয় ও অস্ত দিয়ে? তাতে তো প্রতিটি দিনকে আলাদা করে গুনতে হয়। তুমি কি তাতে সম্মত হতে পারততে-আমাদের একটা দিনকে আর একটা দিন থেকে আলাদা করতে? তোমার কাছে তো আমাদের পুরোটা জীবনের সময় ছিল এমন, যাকে খণ্ড করা যায় না, যাকে ছিন্ন করা যায় না, যাকে গণনা করা যায় না।
...............
আমাদের দুজনের দুজনের কাছে পৌঁছাতে কতগুলো বছর শৈশব খেয়েছে, কতগুলো বছর বাল্য খেয়েছে, কৈশোরেও প্রথমদিকের বছরগুলি নিজেদের দেখতে নিজেরা খেয়েছি। তারপর কতো কোটি আলোকবর্ষ পেরিয়ে নবজাতক নক্ষত্রের আলো চোখে এসে লাগলো। তখন থেকে যদি জন্মের হিসেব নাও, তাহলে দেখবে কটি বছর, মাত্র কটি বছর আমাদের সম্বন্ধের আয়ু। সেটা কি হিসেবে আসে? আর কটি মানববর্ষের হিসেব করতেই কি সূর্য চন্দ্র ও নক্ষত্রকে পরিমাপের একক হিসেবে বাছছিলে? তোমার অনন্ত, ক-বছরের অনন্ত?
[নয়]
..................................
.......................................
তুমি কি অন্যের অনুমোদিত স্ত্রী ছিলে? তুমি কি তখনো অনূঢ়া ছিলে? এসব প্রশ্নের কোন মীমাংসা নেই, কেননা এসব কোন শব্দের ভিত্তি নেই। আমাদের সব শব্দের ভিতর কোনো না কোনো সামাজিক অনুমোদন বা নিষেধ লিপ্ত আছে। কোন নারী কি এমন থাকতে পারে যে অনূঢ়াও নয়, আবার অন্যের অনুমোদিত স্ত্রীও নয়, কিংবা ধরা যাক, বিধবাবো নয়। তাহলে তুমি আমার কী ছিলে? আমরা আমাদের জীবনের সবচেয়ে উদ্বেল, গভীর ও অমেয় সময় কাটালাম যে বন্ধনে, সে বন্ধনের কোন নাম নেই? এই বন্ধনকেই কেন জোর দিতে চাইছি? আমাদের দুজনের বন্ধন তো ছিল কত অজস্র আজন্ম, বংশানুক্রমিক ও অর্জিত বন্ধন থেকে মুক্তি। এত মুক্তির পথ দিয়ে, বা, এত মুক্তি ঘটাতে-ঘটাতে, যে বন্ধন তৈরী হয়, সে কি বন্ধন? আমরা কি তাহলে সেই বন্ধনে বাঁধা পড়েছিলাম, যে বন্ধন বাধা যায় মানুষের পূর্ণ স্বাধীন ইচ্ছায়। সে বন্ধনের মুক্তিও ঘটে মানুষের পূর্ণ স্বাধীন ইচ্ছায়। কোন মানুষ নিজেকে এতটাই অধীন করে রাখে, যে, সে তার মুক্তিকেও মুক্তি বলে চিনে নিতে পারে না, এমনকি সেই মুক্তির বন্ধনের কোন নাম বা পরিচয় পর্যন্ত দিতে পারে না। অথচ সভ্যতা বলতে তুমি যদি কিছু অনুমান করে নিতে পারো, তাহলে যে সভ্যতাগুলো আমরা পেরিয়ে এসেছি, ও যে সভ্যতার আলোড়নের মধ্যে আমাদের বসবাস, জীবনযাপন করছি ও এই সভ্যতার পর যেসব সভ্যতা তৈরী হয়ে উঠবে, সমুদ্রের প্রবালদ্বীপের মত, সেই সব সভ্যতার দিকে তাকিয়ে দেখো, মানুষ শুধু এই একটি বন্ধনের, বা মুক্তির, বা সম্বন্ধের নামকরণ করতে চাইছে এমন একটি শব্দে, যার ভেতরে কোন আনুগত্য বা সামাজিকতা লুকোনো নেই। মানুষ এখনো কোনো ভাষায় তার স্বাধীনতম সেই সম্বন্ধের কোন পথ খুঁজে পায়নি, যে সম্বন্ধ একমাত্র মানব মানবীই রচনা করতে পারে, যে সম্বন্ধে মানব মানবী উত্তীর্ণ হতে পারে। আমার এমন একটি জিজ্ঞাসা-তোমার আমার সম্বন্ধ কদিনের থাকল-তৈরী করতে গিয়ে, আমি সেই সম্বন্ধের পরিচয় কী, এই প্রাক প্রাথমিক জিজ্ঞাসাতেই ঠেকে গেলাম।
[এক]

এবং বর্তমান সময় ও ঘটনাবলীর সাথে প্রচণ্ডভাবে প্রাসঙ্গিক কয়েকটি লাইনও---

মানুষের ভালোবাসার শক্তি মৃত্যুকে পরাজিত করার শক্তি হারিয়েছে। কারণ, মানুষ নিজের জ্ঞানকে হত্যা, আরো হত্যা ও আরো হত্যার কাজে ব্যবহার করেছে। মানুষ যখন জ্ঞানের শক্তি নিজেই আয়ত্ত করেছিল, তখনই সে তার নিজের উপর এক নিষেধও জারি করেছিল। এই আহরিত ও আবিষ্কৃত জ্ঞান যেন কখনোই হত্যার ভিত্তি হয়ে না উঠে। তারপর, মানুষ নিজেই নিজের সেই নিষেধাজ্ঞা অস্বীকার করেছে। যে মানুষ নিজেই মৃত্যুর এক প্রধান কারণ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছে, সে মানুষ মৃত্যুকে পরাজিত করার শান্তি, শক্তি ও নিশ্চয়তা সংগ্রহ করবে কোথা থেকে? [১১০ পৃষ্ঠা]

বইটি এখনো শেষ হয়নি। হয়তো আরো সংযোজনের প্রয়োজন হবে.....আরো কিছু লাইন।

প্রথম যাত্রার ভোর - পর্ব এক

সেই সুপ্রভাত!

ভোরে ঘুম ভাঙতে খুব কষ্ট হয় তবু উঠে যেতে হয়। হাসি পায় মাঝে মাঝে, সাথে দুঃখও। কী মানুষ কী হয়ে যায় চাপে পড়ে। দু মাস আগে নেয়া একটা সিদ্ধান্ত হুট করে জীবনের রুটিনটা পাল্টে দিল।

মেঘের দিন ছিল সেটা, ছিল আকাশ ভেঙ্গে বৃষ্টি। এমন দিনে কাঁথামুড়ি দিয়ে ঘুম না দিয়ে চাকরীর বাজারে ধর্না দেয় কে? নাকি এটাও এক অভিজ্ঞতা। একশোটা চেষ্টা করে একটাতে লাগানো যায়। প্রথম অভিজ্ঞতাটি নেবার জন্য যারা ঠেলে গুঁতিয়ে রাজী করিয়েছে তাদের মধ্যে প্রথম হলো মামুন। সে অভিজ্ঞ চাকরী অনুসন্ধানী, বিজ্ঞাপনের খবরটা প্রথমে আনলো মামুন। তারপর পত্রিকার কাটিং নিয়ে হাজির পারভেজ, এরপর ইন্টারভিউতে বসার জন্য জোর তাগাদা নওশাদের।

আমি আদিকাল থেকে মোলায়েম ধরণের একরোখা, হুট করে জেগে ওঠা বদরাগী। আমাকে বশ মানানো যায় না বলে বদনাম আছে। নিজের সিদ্ধান্ত নিজেই নেই। এই সিদ্ধান্তটা কি হবে? ততদিনে অবশ্য বুঝে ফেলেছি পিতার মুখ করুণ হয়ে আসলেও জননীর চোখে কোন চাওয়া ছিল না। আমাকে নিয়ে পরিবার ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখতে পারে তেমন কিছু করিনি। শুধু একবার একটা স্বপ্ন জেগে উঠেছিল মাঝে, বছরখানেক জ্বলে ছিল, তারপর দপ করে নিভে গেল প্রত্যাশিত পথেই।

তবু যেহেতু শিক্ষাজীবন শেষ, বাপের হোটেলের খাবার ফুরোলো বলে, কিছু না পারলে চাকরীর চেষ্টাটা যে চলছে তা প্রমাণ করাও কম কি। মায়ের কাছে হাত পাতার দিন শেষ। শেষ সম্বল ড্রয়ারে ডায়েরীর ভাঁজে দুটো একশো টাকার নোট, যদি কোনদিন ঘর ছেড়ে পালাতে ইচ্ছে করে তার গাড়িভাড়া।

সুতরাং স্থির একটা সিদ্ধান্তে আসার প্রয়োজনীয়তাটা খুব গোপন একটা চাপে রেখেছিল। সেই অন্তর্গত চাপটির কারণে দিস্তা কাগজের দুটো পাতা ছিঁড়ে একটা যেনতেন দরখাস্ত আর একটা বায়োডাটা লিখে নিয়ে নির্ধারিত দিনে নির্দিষ্ট স্থানে গিয়ে উপস্থিত।

প্রতিযোগিতা বরাবরই অপছন্দ আমার। যেখানে প্রতিদ্বন্দ্বী নেই আমি সেখানেই বিচরণ করি। আমার রাজ্যে আমি একাই অধীশ্বর। হবু কর্মস্থলের প্রার্থনীয় পরীক্ষাতে গিয়ে কয়েকশো প্রতিযোগী দেখে ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেছিলাম প্রায়। তবু ফিরে আসার আগমুহুর্তে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত গৃহে ডাক পড়লে কিছু একটা ভেবে কিংবা না ভেবে ঢুকে পড়লাম এবং চেয়ার টেনে বসে পড়লাম। সাদা চামড়ার এক সাহেব প্রার্থী যাচাইকর্মের প্রধান অতিথি। সাথে আরো জনা দুই দেশী। এমন অভিজাত কোন কক্ষে প্রবেশের পূর্বাভিজ্ঞতা না থেকেও গা ছেড়ে খানিকটা কৌতুকপ্রদ আলসেমি নিয়ে বসে আছি। আমি নিশ্চিত জানি যে গদিমোড়া চেয়ারটি আমাকে বসিয়ে রেখেছে তার মেয়াদ বড়জোর পাঁচমিনিট। তারপরই আমি উঠে যাবো। এটি একটি সৌজন্য সাক্ষাত মাত্র।

মন পড়ে আছে পকেটের দিকে। পকেটে তিনটা সিগারেট এখনো অবশিষ্ট আছে। আকাশে মেঘ থাকলে সিগারেট জ্বালাতে ইচ্ছে করে। সিগারেটে নেশা নেই কিন্তু ধোঁয়া ছেড়ে উদাস হবার শখেই আমার নেশা। আকাশে এখন মেঘ, যত তাড়াতাড়ি বের হওয়া যায় ততই মঙ্গল। প্রশ্নোত্তরগুলো তাই একটু বেশীমাত্রায় বেয়াড়া ছিল। প্রশ্নকর্তা কিছুটা বিস্মিত। শুধু তাই না, কর্তাদের একটা অপছন্দের বিভাগে যোগদানের প্রস্তাব আসলে জবাবটা হলো চেয়ার ঠেলে উঠে দাঁড়িয়ে। তোমার চাকরীই করবো না আমি। এরকম সময়ে এমন পাগলামি কেউ করে না। তবু দুর্বিনীত আচরণে কর্তাগণ না দমে আবার বসতে বলা হলো। আগের প্রস্তাব ফিরিয়ে নিয়ে আমার পছন্দের কাজ দেয়া হলো। বললো চুড়ান্ত নির্বাচন জানানো হবে বিকেলে।

জানানোর গুল্লি মারি - মনে মনে বলে বেরিয়ে এসে দাঁড়ালাম ফুটপাতে। আকাশের দিকে একবার তাকিয়ে দিয়াশলাই জ্বালিয়ে তামাক শলাকায় সংযোগ দিলাম। বৃষ্টি আসছে শীঘ্রি। দ্রুত হেঁটে বড় রাস্তায় উঠে বাস ধরলাম। বৃষ্টি নামলো খুব চেপে। কোনমতে নওশাদের অফিসে পৌঁছালাম।

বললাম তোর অনুরোধে গিয়েছি। ইন্টারভিউ দিয়েছি কিন্তু চাকরী করবো না। অতদূরে অত খাটনি পোষাবে না। বৃষ্টির দিন, শেজানের খিচুড়ি খাওয়াবি নাকি বল, নইলে বাসায় যাইগা। নওশাদ রাজী। গোড়ালি ডোবা জল পেরিয়ে রাস্তায় উঠে একটা রিকশা নিয়ে শেজানে পৌঁছাতে পৌঁছাতে আধভেজা।

শেজানের খিচুড়ি খেয়ে ঢেকুর তুলতে তুলতে বললাম যা তুই অফিস করগে, আমি বাসায় গিয়ে ভাতঘুম দেই। এবার নওশাদ উল্টাসুর ধরে বললো, বাসায় যাবার আগে একবার ওদিকে দেখে যা। বিকেল হতে দেরী নেই। রেজাল্ট কী আছে দেখে অন্তত চোখে দেখে যা। কি আর করা, নেহাত খিচুড়িটা সে খাইয়েছে, চক্ষুলজ্জা বলে কথা। আবারো বাসে উঠলাম ইপিজেডের পথে। গিয়ে দেখি নামটা সত্যি সত্যি লিষ্টিতে উপরের দিকেই উঠে গেছে। একশো পঞ্চাশ জনের মধ্যে বারোজন চুড়ান্ত। এবার?

আবারো ডাক পড়লো সেই ঠাণ্ডা ঘরে। এবার নতুন এক সাদা চামড়ার বিদেশী। নতুন বউ দেখার মতো আমার আপাদমস্তক দেখে পছন্দ করা হলো শুধু একটা জায়গা বাদে। গোঁফটা ছেঁটে ফেলতে হবে।

বলে কী? এই গোঁফ দিয়েই তো চেনা যায় আমাকে। এটা ছাঁটলে আর কী থাকে বাকী। আমি পারবো না বলে চলে এলাম।

কিন্তু এক সপ্তাহ যাবার আগেই নিয়োগপত্র বাড়ি এসে হাজির। এবার বাসার সবাই জেনে গেলো। এখন কি উপায়? ধরে বেঁধে গোঁফ ছেঁটে কর্মজীবনে প্রবেশ করানোর জন্য তৈরী করলো তখনো বেকার থাকা বন্ধুরা।

উপায়ান্তর না দেখে মনে মনে অন্তত কিছুদিনের জন্য হলেও চাকরীটা পরীক্ষামূলকভাবে করে দেখার একটা মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছি। নিয়োগপত্রে দেয়া প্রাথমিক সম্মানীর অংকটা ২৫০০ দেখে খচখচানি ছিল। বিসিএস পাশ করলে ২৮৫০ স্কেল হতো। ব্যাংকের চাকরী হলে ৬০০০ টাকা। থাক এটাও মেনে নেয়া গেল। ১০০০ টাকা দিয়ে একটা মাসিক টেক্সি ঠিক করা গেল। পকেটে ফুটো পয়সা নাই, কিন্তু টেক্সি ছাড়া চলবে না। তাও নতুন টেক্সি হতে হবে। খুরশীদ ড্রাইভার প্রতিদিন সকালে ডেকে নিয়ে যাবে বাসা থেকে। ১০০০ টাকা মায়ের হাতে দিয়ে ভালো ছেলে হবার চেষ্টা করা যাবে। বাকী পাঁচশো টাকায় নিজের খরচ। চলবে? চলবে না কেন। একসাথে পাঁচশো টাকা হাতে নিয়েছি কবে মনে নেই।

পরিবারের সবচেয়ে অযোগ্য সন্তানটির নতুন পথে যাত্রা শুরু।

ভোরে ঘুম ভাঙতে তাই খুব কষ্ট হয়। পুরো ছাত্রজীবন ধরেই দশটার আগে উঠি না, রাত দুটোর আগে ঘুমাই না। এসব চাকরী মানুষে করে? প্রতি মাসেই ভাবি, আজ কদিন গেল। এ মাসটা যাক, তারপর ছেড়ে দেবো। অমানুষের খাটনি। সকাল সাতটায় দিন শুরু করে গাধার খাটুনিতে রাত এগারোটা। কোন কোন দিন রাত বারোটা পার ফিরতে ফিরতে। ছুটিছাটা এক অলীক বস্তু। সাপ্তাহিক ছুটি ব্যাপারটি ওখানে অলীক বিষয়। প্রথম তিন মাস চাকরী ছুটিবিহীন। দম ফুরিয়ে আসে মাঝে মাঝে। মাঝরাতে বাড়ি ফিরে মড়ার মতো ঘুমাই। খুব ভোরে আবার জেগে উঠি, ঘুম শেষ না হতে। এমন দিন আর কতকাল চলবে। আর পারি না। আজকেই চলে আসবো শেষবারের মতো করে। কিন্তু আসা হয় না।

এরকম ক্লান্ত শ্রান্ত বিধ্বস্ত মানসিক অবস্থায় হঠাৎ এক ঝলক বাতাস এসে বললো, গুড মর্নিং! এক এলোকেশী, শ্যামলা মায়াকাড়া চেহারার সাদামাটা তরুণী। আমিও ফিরতি জবাবে বললাম, মর্নিং। সহকর্মী, আমার চেয়ে কয়েকমাস পুরোনো। বোধকরি চেহারা দেখে করুণা হয়েছিল। সেই থেকে রোজ একবার দেখা হলেই গুডমর্নিং। শুধু ওই টুকুই, আর কোন কথা না। অথচ কী অদ্ভুত একটা সাহস চলে এলো তাতেই। যেদিন খেয়াল করেছি ওটা শুধু আমাকেই বলতো। কেন বলতো তাও কখনো জিজ্ঞেস করা হয়নি। তবে শুনতে ভালো লাগতো। ওই একটি বাক্য যেন আমাকে বলতো, তুমি একা নও। আমিও তোমার মতো। আমি আছি পাশে। আমার দিনটা যেন একটু সহনীয় সুন্দর হয়ে উঠলো কিছুদিন পরেই। সেই একই খাটুনি, একই দীর্ঘসময়ের কাজ। শুধু সকালবেলা কয়েক সেকেণ্ডের একটা বাক্য। তাতেই আমার সকাল যেতো ভরে, আমার দিন উঠতো হেসে, কর্মে যেতাম ভেসে।

সামান্য একটু আন্তরিকতাপূর্ণ হাসিমুখের সম্ভাষণ একটি কঠিন বিরস দিন সহজ আনন্দে কাটাবার জন্য কতটা গুরুতর ভূমিকা রাখে সেই প্রথম দেখা।

[চলবে......]

Tuesday, July 12, 2016

বৃক্ষ ছায়া

বৃক্ষপ্রেম নিয়ে কোন সন্দেহ না থাকলেও বৃক্ষরোপন ও লালন পালনে আমার অদক্ষতা এবং অযোগ্যতা সুবিদিত। আমি কখনো কোন গাছ লাগিয়ে ফুল ফোটাতে পারিনি, ফল ধরেনি আমার লাগানো কোন গাছে। শুনলে বিশ্বাস হবে না হয়তো, আমার বাগান জুড়ে এত গাছ গাছালির মেলা ছিল তার সবটুকুই আকাশ থেকে পাওয়া। আমি বৃক্ষদের ভালোবাসি, কিন্তু তারা আমার হাতে বড় হতে পছন্দ করতো না। আমার হাতের ছোঁয়া পেলে তাদের বৃদ্ধি থেমে যেতো।

একটা জলপাই গাছ দশ বছরেও তিন ফুটের বেশী বাড়েনি। একটা কাঁঠাল চাপা যেটুক লাগিয়েছি, সেই ডালেই তিনটি ফুল দিয়েছিল তিন বছরে বাড়েনি এক ইঞ্চিও। সবচেয়ে বেশী প্রতারিত হয়েছি গোলাপের কাছে। আমার হাতে গোলাপ ফোটেনা বলে তৈরী ফুটন্ত কালচে মেরুন রঙের গোলাপসহ গাছ লাগালাম। নার্সারি থেকে বলেছিল গোলাপটির নাম পাপ্পা মেলন। 

সেই ফুল ঝরে যাবার পর ওই গাছে আর কোন ফুল ফোটেইনি বরং গাছের ডাল ফুঁড়ে দীর্ঘ কন্টকময় অসংখ্য কাণ্ডের জন্ম হয়েছিল যা লতার মতো বেড়ে আমার বাগানের একাংশ গ্রাস করে ফেলেছিল। কোন ফুল নেই, শুধু সুন্দর সুন্দর কাঁটা ঝোপের পাতা। এত সুন্দর গোলাপ পত্র আর কোথাও দেখিনি। কিন্তু ফুলের দেখা নেই যেখানে দীর্ঘ এক বছরেও পাতা দিয়ে কী করবো।

একদিন সিদ্ধান্ত নিলাম গাছটিকে ঝাড়ে বংশে উৎখাত করবো। সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত করার আগেই গাছটি নতুন একটা চাল দিল।  হঠাৎ করে সেই বন্ধ্যা কাণ্ড থেকে এক থোকা কুঁড়ি বের হয়ে এলো। পরের সপ্তাহে আরো। একটা ফুল না। এক থোকায় দশ পনেরোটি ছোট ছোট ফুল, দেখতে গোলাপের মতো, কিন্তু রঙটা সাদাটে গোলাপী। আমি যে ফুল দেখে গাছটি কিনেছি তার সাথে কোন মিল নেই। ওই অদ্ভুত ফুল গুলি তার রূপ দেখিয়ে গাছের জীবন রক্ষা করেছিল সেবারের মতো।

ঘটনাটি আজ অবধি রহস্যময় হয়ে আছে আমার কাছে। সেই শেষ। আমি আর কোন গোলাপের সাথে লেনদেন করিনি পরবর্তী জীবনে। শুধু গোলাপ নয়, কোন বৃক্ষ লালনে আমার আর আগ্রহ নেই। আমি বুঝে গেছি আমার হাতে বৃক্ষদের বৃদ্ধি নেই। তবু আকাশ থেকে পাওয়া বৃক্ষরা আমাকে যে অগণিত ফুল ফল ছায়া মায়া উপহার দিয়েছিল, সেগুলো আমি প্রাণভরে উপভোগ করেছি, তাতেই আমার সারা জীবনের সকল তৃষ্ণা মিটে গেছে।

তবু অনেক বছর পর, যুগের পর যুগ কেটে যাবার পর, নতুন সময়ে এসে আরেকটি বৃক্ষের চারা রোপন করলাম। এই গাছের অনেক সুনাম। আমি নিশ্চিত এই গাছের ফুলে ফলে ছেয়ে যাবে একদিন নির্জন প্রান্তর। গাছটি আমি বিক্রি করবো না, ফার্নিচার বানাবো না, কেটেছেঁটে লাকড়ির চুলাও জ্বালাবো না। গাছটিকে বড় করার স্বপ্নটা তবু আমাকে দিন রাত আচ্ছন্ন করে রাখে। গাছটি জানে না আমি কেন তাকে বড় করতে চাই। আমি জানি কেন করছি। এই বৃক্ষের কাছ থেকে আমি কিছুদিনের জন্য একটা ছায়ার বাগান চাই। শুধু ছায়া আর কিছু নয়। ছায়া দিতে কোন বৃক্ষ কখনো দ্বিমত করে না। ছায়া রেখে কোন গাছ কাউকে বিমুখ করে না।

তবু কেন যেন অমূলক একটা আশংকা এসে ভর করে, কেউ যেন বলছে জেনো, এই বৃক্ষটা একদিন তোমাকে ছায়াবিমুখ হতাশ করবে।


ছোটগল্পপাঠঃ শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের 'উর্বরাশক্তি'

শোনা যায় ছোটগল্প বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে কম আলোচিত বিষয়, কিছুটা উপেক্ষিতও হয়তো। উপন্যাস যতটা বিক্রি হয় সেই তুলনায় ছোটগল্পের বাজার অনেক ছোট। ব্যক্তিগতভাবে ছোটগল্প আমার পছন্দের বিষয় হলেও দীর্ঘদিন ছোটগল্পের জগত থেকে দূরে ছিলাম। সেই দূরত্বের কারণে বঞ্চিত হয়েছি যেসব ভালো গল্প থেকে তা পূরণ করতে গিয়ে সাম্প্রতিককালে যেসব লেখকের গল্প দ্বারা আলোড়িত হয়েছি তাঁদের কিছু গল্প নিয়ে গল্পসল্প করার ইচ্ছে থেকে একটা ছোটগল্প আলোচনা সিরিজের সূচনা করছি। যেখানে খুব বিখ্যাত লেখকের গল্প থাকবে তেমনি থাকবে লিটল ম্যাগাজিনের অখ্যাত অথচ ভীষণ সম্ভাবনাময় কোন তরুণ লেখকেরও। প্রতিটি পর্বে একটি করে গল্পের পাঠানুভূতি নিয়ে লিখিত হবে।

ছোটগল্পে আমার প্রিয় লেখক কারা? গত শতকের আশি দশকে ছাত্র বয়সে যখন প্রথম ছোটগল্প পড়তে শুরু করি, বিশ্বসাহিত্যের চারজন ছিলেন আমার বিশেষ প্রিয়। রবীন্দ্রনাথ, চেখভ, মোপাসাঁ, এডগার এলান পো। লক্ষণীয় যে ছাত্র বয়সে বিশ্বসাহিত্যের প্রতি মনোযোগটা একটু বেশী ছিল। ঘরের দিকে নজর ছিল কম। তারপর পেশাগত ব্যস্ততার কারণে বেশ লম্বা একটা সময় পাঠ থেকে দূরে থাকতে হয়। দ্বিতীয় পর্বে এসে এই শতকের প্রথম দশক পেরিয়ে আবারো ছোট গল্পের সাথে যোগাযোগ।

এবার বিশ্বসাহিত্য বাদ দিয়ে একদম ঘরের কাছের ছোটগল্পের অনুসন্ধান- যেখানে দুই বাংলার অসাধারণ কিছু গল্প বলিয়ের সাথে পরিচয় ঘটতে থাকে। বাংলা গদ্যের বৈচিত্র্যপূর্ণ সম্ভারের আবিষ্কারটিও এই সময়েই। হাসান আজিজুল হক, হুমায়ূন আহমেদ, পেরিয়ে শাহাদুজ্জামান এবং ইমতিয়ার শামীমে যখন এই গদ্য সম্ভারের আবিষ্কার চলছিল, তখন বিস্মিত পরিচয় ঘটে ওপার বাংলার কমলকুমার মজুমদার, সুবোধ ঘোষ, নবারুণ ভট্টাচার্য, জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী আর প্রেমেন্দ্র মিত্রের সাথে।

নতুন পরিচয়ের এই গদ্য সম্ভারে একরকম বুঁদ হয়ে পড়ি। কিন্তু না, তখনো বিস্ময়ের কিছু বাকী ছিল। নবনীতা দেবসেনের স্মৃতিকথা 'স্বজন সকাশে' পড়ে জানতে পারি শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের কথা। বস্তুতঃ তাঁর গল্পের সাথে এত দেরীতে পরিচয় ঘটার কারণে আক্ষেপের পাশাপাশি একটা আনন্দ কাজ করেছে। কিছু লেখার সাথে এমন বয়সে পরিচিত হওয়া ভালো, যে বয়সে ওই লেখাটা অধিকতর অর্থপূর্ণ। আজ থেকে বিশ বছর আগে শ্যামল পড়লে যে অনুভূতি হতো, সেটা এই সময়ে পড়ার অনুভূতির তুলনায় অনুল্লেখযোগ্য হতো, হয়তো। কিছু কিছু লেখা পরিণত বয়সে বেশী উপভোগ্য বলে আমার ব্যক্তিগত ধারণা।

শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের গল্পের সাথে আমার পরিচয় হলো ঠিক কল্যাণের বয়সে এসে। কল্যাণকে সবাই চিনবেন না। কিন্তু যারা তাঁর 'উর্বরাশক্তি' গল্পটি পড়েছেন কল্যাণকে তাঁদের মনে থাকার কথা।

কল্যাণের পরিচয়টি তাঁর গল্পের সূচনা থেকেই দিচ্ছি -

'পৃথিবীতে আগের চেয়ে এখন নিরুপায় লোকের সংখ্যা অনেক বেশী। এরকম একটি ধারণা কিছুদিন ধরেই কল্যাণের মাথায় চাক বেঁধে তৈরি হয়ে আসছিল। কল্যাণ এ পাড়ার আট বছরের পুরোনো ভাড়াটে। পাড়াটির প্রথম পুরুষরা সবাই এখন বিগত। মানে যারা জায়গা কিনে বাড়ি করেছিলেন- তাঁরা কেউ নেই। তাঁদের সন্তান সন্ততিদেরই বয়স এখন ষাট থেকে সত্তরের ভেতর। নিশুতি রাতে পাড়ার বেওয়ারিশ কুকুরগুলো এ পাড়ার মালিক। ভোরবেলা কাকের দল লেড়ো বিস্কুটের টুকরো খেতে চায়ের দোকানের সামনে ঝাঁক বেঁধে নামে। বাড়িগুলোর একতলার আগেকার গ্যারেজঘর এখন ধোবিখানা। ফুটপাত ঘেঁষে যা দু চারটে গাছ ছিল তাদের গোড়ায় গেরস্থ বাড়ির ছাই, খোসা আরো কত কি। কল্যাণ এখন সেই বয়সটায় - যখন ঘুম কমে আসে - রিটায়ারের বাকী থাকে তের বছর - স্ত্রী আলাদা শোয় - পেচ্ছাপ কম হয়।'

আশা করি কল্যাণ সম্পর্কে একটা ধারণা মিলেছে এইটুকু দিয়ে। 'উর্বরাশক্তি' গল্পটি কল্যাণকে দিয়ে শুরু হলেও এটি মূলত: একটি বেড়াল জুটির সম্পর্ক যাপনের গল্প। কল্যাণ সেখানে দর্শকমাত্র এবং আমরা কল্যাণের সহদর্শক।

জুটির একটি বেড়াল(নারী বেড়াল) অন্যটি হুলো(পুরুষ বেড়াল)। বেড়ালটি কল্যাণের বাড়ির আবাসিক বাসিন্দা হলেও হুলোটি বহিরাগত। কল্যাণের বারান্দার বাগানেই তাদের আলাপ পরিচয়। বারান্দা দিয়ে যাবার সময় দুজনের দেখা হয় কোন এক জ্যোৎস্না রাতে।

হুলো বহিরাগত হলেও আচরণে সে উদ্ধত এবং স্বাধীনচেতা। তার হাবভাব হলো 'পৃথিবীটা হলো ওদের দুজনের মানুষজন সব আসলে বেড়াল'। কল্যাণের দৃষ্টিতে 'আহার, বিহার আর মৈথুনে পারদর্শী একজন উচ্চশ্রেণীর বিষয়ী'। সে হুলোটির নাম দেয় 'প্রিয়গোপাল বিষয়ী' আর বিড়ালটির নাম রাখে 'রাধারানী'।
 
ওদের প্রথম দুটো বাচ্চা দুটো দুর্ঘটনায় মারা যায় দুজনের দুটো কার্যকারণে। একটা বাচ্চাকে হুলো খেয়ে ফেলেছিল। অন্যটি মায়ের দাঁতের চাপে মারা যায় এঘর ওঘর করতে গিয়ে। তবু কিছুদিন পরই রাধারানীর পেট মোটা হয় আবারো। মাঝরাতে এসে প্রিয়গোপাল ডাকে 'ক্যাঁ-রব-র ক্যাঁ-রব-র' করে। 'পনেরোই জুন রাধারাণীর আবার একটি খোকাও খুকু হলো। আকাশবাণীর তৃতীয় অধিবেশন সমাপ্ত হবার পর।....সে কাউকে ছানা দেখাতে চায় না। তাই আলনার শেষর‍্যাক থেকে বুকর‍্যাকে যায়, বুকর‍্যাক থেকে জুতোর বাক্সে বাচ্চাদের জন্য নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে'। যাদের বাড়িতে বেড়াল আছে এই দৃশ্যটি খুব পরিচিত। আমি নিজে পরিচিত এটার সাথে।

 কদিন পর বাচ্চারা একটু বড় হয়ে উঠলে দুটোতে মিলে খেলাধুলো করে। রাধারানী মাছের কাটা মুখে নিয়ে বাচ্চাদের ডাকাডাকি করে। 'কাছে আয়। কাটা খাবি বাবা।এ হলো গিয়ে বড় মাছের শিরদাঁড়া। সাবধানে চিবোতে হয়'। কী মমতাময়ী ডাক!

কিন্তু পুরুষ চরিত্র। প্রিয়গোপাল মশাই বাচ্চা হবার পর থেকে রাধারাণীকে কাছে পাচ্ছে না। সে কল্যাণের বারান্দার লাগোয়া পাঁচিলে এসে রাধাকে ডাক দেয় 'এই রাধা। আয়। যাবিনে?' রাধারানী কোন জবাবই দেয় না। বাইরের লোকে হুলোর যে ডাক শোনে, সে ডাক আদেশের। যখন সে ডাক একটু খাদে নামে সেটা হলো আশাভঙ্গের। সে আবারো ডাকে ' আয় হৈমি ডাক্তারের বাড়ির ছাদে যাই। ও-বাড়ি আজ চতুর্থী। মৎস্যমুখী হচ্ছে। আয় বলছি-'

কাজ হলো না তাতেও। তারপর মাঝরাতে প্রিয়গোপাল একদম ঘরের ভেতর এলো। জানালা গলে। হিসেব নেওয়ার ভঙ্গীতে। ......প্রিয়গোপাল বাঘের ভঙ্গিতে মেঝেতেই বসলো। দুহাত দুরে রাধারানী একই ভঙ্গিতে বসা। মাঝখানে খোকাখুকু খেলছে। রাধারানী মিনতি করে দীর্ঘ মেয়াও ধ্বনি দিয়ে অনুরোধ করছে এবার যেন বাচ্চাদের না খায়। অন্ধকারেও কল্যাণ দেখতে পায় চারজনের আট জোড়া চোখ। বাপ এবং খাদক হিসেবে প্রিয়গোপালের সহনশীলতা কল্যাণকে মুগ্ধ করে। কেননা প্রিয়গোপাল এদেশের ভোটার নয়। নাগরিক নয়। যদিও সে এখানকার জল হাওয়ায় বড় হয়েছে। আচরণ আচরণের জন্য সে দেশের আইনের কাছে দায়বদ্ধ নয়। সে চাইলে সবার সামনে রাধারানীর উপর উপগত হতে পারতো।

এই বর্ণনাটুকু পড়তে পড়তে মানুষ হিসেব মানব সমাজের সাথে তুলনাটা আপনাতেই চলে আসে। লেখকও চেয়েছেন সেটাই। বাড়িতে একটি অতিথি আছে। কল্যাণের মেয়ে এসেছে বেড়াতে। তারও বাচ্চা হবে। কল্যাণের স্ত্রী মেয়ের সেবা নিয়ে ব্যস্ত। বাচ্চা হবার আগে বেড়ালছানা দুটো পার করতে হবে। নইলে মানুষের বাচ্চার অনিষ্ট হবে। কল্যাণ তার নিজের জীবনকে নিয়ে ভাবে। কোথাও কোথাও সে হুলোটার চেয়েও অসহায় পরাধীন। হুলোটি যতটা স্বাধীনভাবে রাধারানীর কাছে যেতে পারে, সে পারে না তার রাধারাণীর কাছে প্রত্যাখ্যানের দাপটে। তবু তার একটি আকাংখা, একটি মনোবেদনা প্রত্যাশা পূরণের সম্ভাবনার ছাপ রেখে যায় গল্পের শেষাংশে পৌঁছে।

মানব সমাজ এবং বিড়াল সমাজের একটা তুলনামূলক সংক্ষিপ্ত আচরণগত বিশ্লেষণ শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় সে সরস এবং সহজ দক্ষতার সাথে এঁকেছেন তাতে গল্পটি শেষ করার পরও আরো বহুক্ষণ গল্পের আমেজ পাঠকের মাথায় ঘুরপাক খায়। এই গল্পপাঠের সেই আনন্দটুকুই যথার্থ প্রাপ্তি।




পাশবিকতা বনাম মানবিকতা

একদল হিংস্র পশু এবং একদল হিংস্র মানুষের মধ্যে সভ্য আচরণের তুলনামূলক বিচার করলে পশু সমাজ যে এগিয়ে থাকবে তা আমরা এখন আর কেউ অস্বীকার করতে পারি না। পশুর হিংস্রতা কোন একটি মৌলিক চাহিদা পূরণ ঘটিত সমস্যা থেকে উদ্ভুত হয় এবং সেই হিংস্রতা প্রয়োগের একটা মাত্রা থাকে একটা যুক্তি থাকে। কিন্তু মানুষ কোন রকম যৌক্তিক কারণ ছাড়াই স্বজাতির উপর চড়াও হয়ে চরম নির্মমতার পরিচয় দিতে পারে খুব অনায়াসে।

বাঘ সিংহ গণ্ডার কয়োট হায়েনা বেড়াল কুকুর যেই হোক, সবাই নিজ নিজ সীমানাটা মেনে চলে। সিংহ কখনো বেড়ালকে কামড়ে দিয়ে বলে না তোর কেন কেশর হয় না, কিংবা হাতি কখনো কুকুরকে লাথি দিয়ে বলে না তুই কেন শুড় দিয়ে মাংস খাস না। আন্তঃপশু সংঘর্ষের কোন সংবাদ আমরা তেমন দেখি না। পশুরা কী করে যেন একটা সুশৃংখল সভ্যতা গড়ে তুলেছে। অথচ তাদের কোন রাষ্ট্রনায়ক নেই, মহামানব নেই, অবতার নেই, দেবতা নেই, পথ নির্দেশক নেই। তাদের নেই কোন রাষ্ট্র, ধর্ম, বিজ্ঞান, দর্শন, বিদ্যালয়, উপাসনালয়। এসব কিছু না থেকেই ওরা আদি থেকে এই সভ্যতা কিভাবে ধরে রেখেছে সেটা একটা বিস্ময়।

প্রাণীজগতের মধ্যে মানুষই একমাত্র প্রাণী যাদের রাষ্ট্র, নেতা, ধর্ম, মহামানব, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি সবকিছু আছে। এই সব কিছুর যোগফল নিয়ে মানবকূল পৃথিবীটা দখল করে শাসন করছে এবং নিজেকে শ্রেষ্ঠ প্রাণী হিসেবে ঘোষণা করেছে। বাকী প্রাণীসমাজ অবশ্য জানে না 'মানুষ শ্রেষ্ঠ জীব', জানার মতো শিক্ষাদীক্ষাও তাদের নেই। জানলে এই শ্রেষ্ঠত্ব বিনাতর্কে মেনে নিতো কিনা সন্দেহ আছে। কিন্তু মানব সমাজের বাইরে একটা তৃতীয় অবস্থান নিয়ে যদি আমি মানুষ এবং অন্য প্রাণীদের তুলনামূলক অবস্থানটা দেখি, তাহলে দেখবো, প্রযুক্তি, জ্ঞানবিজ্ঞান এবং ক্ষমতার দিক থেকে মানুষ বর্তমানে শ্রেষ্ঠ অবস্থানে আছে (৫০ হাজার বছর আগে হলে এটা বলতে পারতাম না) এটা সত্যি হলেও যাকে আমরা গড়পড়তা 'মানবতা' বলি, সেই হিসেবে মানুষ পশুদের চেয়ে সামগ্রিকভাবে পিছিয়ে।

মানুষকে বাই ডিফল্ট শ্রেষ্ঠ ধরে ভালো গুন সমৃদ্ধ অর্থে 'মানবতা' শব্দটি ব্যবহার করা হয়। মানবতা বলতে মায়া দয়া স্নেহ মমতা সমৃদ্ধ একটি উদার একটি চরিত্রের নিদর্শনকে বুঝি। অথচ মানুষের ভেতরে যে চরম স্বার্থপর হিংস্রতম নির্দয় চরিত্রের অন্ধকার বিষয় লুকিয়ে আছে তাকে প্রকাশ করতে গেলে আমরা পশুর নামানুসারে আখ্যায়িত করি 'পশুত্ব' বলে। যদিও যুক্তিহীন নির্দয় হিংস্রতার ব্যাপারে পশু সমাজ একদমই নিষ্পাপ। মানুষের মতো অযৌক্তিক হিংস্র হওয়া কোন পশুর পক্ষে সম্ভব না।  তাই মানুষের অমানবিক আচরণের প্রকাশ করতে গিয়ে 'পশুত্ব' শব্দটি বাদ দিয়ে আমাদের উচিত মানব উপযোগী নতুন একটি শব্দের উদ্ভাবন করা।  মানুষের কুৎসিত আচরণের দায় নির্দোষ পশু সমাজের উপর চাপানো নিতান্তই অপমানের সামিল।


পর্বত ও প্রতীক্ষা

Waiting is painful. You wont have to wait for me. I will bear that pain. I will wait wait wait even in vein. Waiting is my part within us. You just go on with other inevitable pain that I cant take away. You know I dont wait for anyone else. Nobody can keep me standstill anywhere. Just you. Because its only you whom I have decided to let all my waiting times to flow.
- Rio Escober

অপেক্ষা কারো কারো জন্য সংকলিত উপহার কারো জন্য সমন্বিত বেদনা৷ নির্ভর করে ফলাফল সূচকের উপর৷ অপেক্ষা যদি অধৈর্য বয়ে আনে তার ক্ষতি বহুমাত্রিক৷

তিনি যা বলেছেন তা পর্বতের জন্যই প্রযোজ্য হতে পারে৷ আমরা পর্বত হতে পারি না৷ আমরা বড়ই অস্থির৷ অধৈর্য৷ নাজুক৷ মানবীয় দুর্বলতায় পরিপূর্ন প্রাণী৷ আমরা বড়জোর পর্বত ছুঁয়ে আসতে পারি৷ আর কিছু না ৷

আরো একবার ডাকছে পর্বত ৷ আরো একবার যেতে হবে হিমালয়ে ৷ কবে কে জানে?