সেই সুপ্রভাত!
ভোরে ঘুম ভাঙতে খুব কষ্ট হয় তবু উঠে যেতে হয়। হাসি পায় মাঝে মাঝে, সাথে দুঃখও। কী মানুষ কী হয়ে যায় চাপে পড়ে। দু মাস আগে নেয়া একটা সিদ্ধান্ত হুট করে জীবনের রুটিনটা পাল্টে দিল।
মেঘের দিন ছিল সেটা, ছিল আকাশ ভেঙ্গে বৃষ্টি। এমন দিনে কাঁথামুড়ি দিয়ে ঘুম না দিয়ে চাকরীর বাজারে ধর্না দেয় কে? নাকি এটাও এক অভিজ্ঞতা। একশোটা চেষ্টা করে একটাতে লাগানো যায়। প্রথম অভিজ্ঞতাটি নেবার জন্য যারা ঠেলে গুঁতিয়ে রাজী করিয়েছে তাদের মধ্যে প্রথম হলো মামুন। সে অভিজ্ঞ চাকরী অনুসন্ধানী, বিজ্ঞাপনের খবরটা প্রথমে আনলো মামুন। তারপর পত্রিকার কাটিং নিয়ে হাজির পারভেজ, এরপর ইন্টারভিউতে বসার জন্য জোর তাগাদা নওশাদের।
আমি আদিকাল থেকে মোলায়েম ধরণের একরোখা, হুট করে জেগে ওঠা বদরাগী। আমাকে বশ মানানো যায় না বলে বদনাম আছে। নিজের সিদ্ধান্ত নিজেই নেই। এই সিদ্ধান্তটা কি হবে? ততদিনে অবশ্য বুঝে ফেলেছি পিতার মুখ করুণ হয়ে আসলেও জননীর চোখে কোন চাওয়া ছিল না। আমাকে নিয়ে পরিবার ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখতে পারে তেমন কিছু করিনি। শুধু একবার একটা স্বপ্ন জেগে উঠেছিল মাঝে, বছরখানেক জ্বলে ছিল, তারপর দপ করে নিভে গেল প্রত্যাশিত পথেই।
তবু যেহেতু শিক্ষাজীবন শেষ, বাপের হোটেলের খাবার ফুরোলো বলে, কিছু না পারলে চাকরীর চেষ্টাটা যে চলছে তা প্রমাণ করাও কম কি। মায়ের কাছে হাত পাতার দিন শেষ। শেষ সম্বল ড্রয়ারে ডায়েরীর ভাঁজে দুটো একশো টাকার নোট, যদি কোনদিন ঘর ছেড়ে পালাতে ইচ্ছে করে তার গাড়িভাড়া।
সুতরাং স্থির একটা সিদ্ধান্তে আসার প্রয়োজনীয়তাটা খুব গোপন একটা চাপে রেখেছিল। সেই অন্তর্গত চাপটির কারণে দিস্তা কাগজের দুটো পাতা ছিঁড়ে একটা যেনতেন দরখাস্ত আর একটা বায়োডাটা লিখে নিয়ে নির্ধারিত দিনে নির্দিষ্ট স্থানে গিয়ে উপস্থিত।
প্রতিযোগিতা বরাবরই অপছন্দ আমার। যেখানে প্রতিদ্বন্দ্বী নেই আমি সেখানেই বিচরণ করি। আমার রাজ্যে আমি একাই অধীশ্বর। হবু কর্মস্থলের প্রার্থনীয় পরীক্ষাতে গিয়ে কয়েকশো প্রতিযোগী দেখে ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেছিলাম প্রায়। তবু ফিরে আসার আগমুহুর্তে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত গৃহে ডাক পড়লে কিছু একটা ভেবে কিংবা না ভেবে ঢুকে পড়লাম এবং চেয়ার টেনে বসে পড়লাম। সাদা চামড়ার এক সাহেব প্রার্থী যাচাইকর্মের প্রধান অতিথি। সাথে আরো জনা দুই দেশী। এমন অভিজাত কোন কক্ষে প্রবেশের পূর্বাভিজ্ঞতা না থেকেও গা ছেড়ে খানিকটা কৌতুকপ্রদ আলসেমি নিয়ে বসে আছি। আমি নিশ্চিত জানি যে গদিমোড়া চেয়ারটি আমাকে বসিয়ে রেখেছে তার মেয়াদ বড়জোর পাঁচমিনিট। তারপরই আমি উঠে যাবো। এটি একটি সৌজন্য সাক্ষাত মাত্র। ভোরে ঘুম ভাঙতে খুব কষ্ট হয় তবু উঠে যেতে হয়। হাসি পায় মাঝে মাঝে, সাথে দুঃখও। কী মানুষ কী হয়ে যায় চাপে পড়ে। দু মাস আগে নেয়া একটা সিদ্ধান্ত হুট করে জীবনের রুটিনটা পাল্টে দিল।
মেঘের দিন ছিল সেটা, ছিল আকাশ ভেঙ্গে বৃষ্টি। এমন দিনে কাঁথামুড়ি দিয়ে ঘুম না দিয়ে চাকরীর বাজারে ধর্না দেয় কে? নাকি এটাও এক অভিজ্ঞতা। একশোটা চেষ্টা করে একটাতে লাগানো যায়। প্রথম অভিজ্ঞতাটি নেবার জন্য যারা ঠেলে গুঁতিয়ে রাজী করিয়েছে তাদের মধ্যে প্রথম হলো মামুন। সে অভিজ্ঞ চাকরী অনুসন্ধানী, বিজ্ঞাপনের খবরটা প্রথমে আনলো মামুন। তারপর পত্রিকার কাটিং নিয়ে হাজির পারভেজ, এরপর ইন্টারভিউতে বসার জন্য জোর তাগাদা নওশাদের।
আমি আদিকাল থেকে মোলায়েম ধরণের একরোখা, হুট করে জেগে ওঠা বদরাগী। আমাকে বশ মানানো যায় না বলে বদনাম আছে। নিজের সিদ্ধান্ত নিজেই নেই। এই সিদ্ধান্তটা কি হবে? ততদিনে অবশ্য বুঝে ফেলেছি পিতার মুখ করুণ হয়ে আসলেও জননীর চোখে কোন চাওয়া ছিল না। আমাকে নিয়ে পরিবার ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখতে পারে তেমন কিছু করিনি। শুধু একবার একটা স্বপ্ন জেগে উঠেছিল মাঝে, বছরখানেক জ্বলে ছিল, তারপর দপ করে নিভে গেল প্রত্যাশিত পথেই।
তবু যেহেতু শিক্ষাজীবন শেষ, বাপের হোটেলের খাবার ফুরোলো বলে, কিছু না পারলে চাকরীর চেষ্টাটা যে চলছে তা প্রমাণ করাও কম কি। মায়ের কাছে হাত পাতার দিন শেষ। শেষ সম্বল ড্রয়ারে ডায়েরীর ভাঁজে দুটো একশো টাকার নোট, যদি কোনদিন ঘর ছেড়ে পালাতে ইচ্ছে করে তার গাড়িভাড়া।
সুতরাং স্থির একটা সিদ্ধান্তে আসার প্রয়োজনীয়তাটা খুব গোপন একটা চাপে রেখেছিল। সেই অন্তর্গত চাপটির কারণে দিস্তা কাগজের দুটো পাতা ছিঁড়ে একটা যেনতেন দরখাস্ত আর একটা বায়োডাটা লিখে নিয়ে নির্ধারিত দিনে নির্দিষ্ট স্থানে গিয়ে উপস্থিত।
মন পড়ে আছে পকেটের দিকে। পকেটে তিনটা সিগারেট এখনো অবশিষ্ট আছে। আকাশে মেঘ থাকলে সিগারেট জ্বালাতে ইচ্ছে করে। সিগারেটে নেশা নেই কিন্তু ধোঁয়া ছেড়ে উদাস হবার শখেই আমার নেশা। আকাশে এখন মেঘ, যত তাড়াতাড়ি বের হওয়া যায় ততই মঙ্গল। প্রশ্নোত্তরগুলো তাই একটু বেশীমাত্রায় বেয়াড়া ছিল। প্রশ্নকর্তা কিছুটা বিস্মিত। শুধু তাই না, কর্তাদের একটা অপছন্দের বিভাগে যোগদানের প্রস্তাব আসলে জবাবটা হলো চেয়ার ঠেলে উঠে দাঁড়িয়ে। তোমার চাকরীই করবো না আমি। এরকম সময়ে এমন পাগলামি কেউ করে না। তবু দুর্বিনীত আচরণে কর্তাগণ না দমে আবার বসতে বলা হলো। আগের প্রস্তাব ফিরিয়ে নিয়ে আমার পছন্দের কাজ দেয়া হলো। বললো চুড়ান্ত নির্বাচন জানানো হবে বিকেলে।
জানানোর গুল্লি মারি - মনে মনে বলে বেরিয়ে এসে দাঁড়ালাম ফুটপাতে। আকাশের দিকে একবার তাকিয়ে দিয়াশলাই জ্বালিয়ে তামাক শলাকায় সংযোগ দিলাম। বৃষ্টি আসছে শীঘ্রি। দ্রুত হেঁটে বড় রাস্তায় উঠে বাস ধরলাম। বৃষ্টি নামলো খুব চেপে। কোনমতে নওশাদের অফিসে পৌঁছালাম।
বললাম তোর অনুরোধে গিয়েছি। ইন্টারভিউ দিয়েছি কিন্তু চাকরী করবো না। অতদূরে অত খাটনি পোষাবে না। বৃষ্টির দিন, শেজানের খিচুড়ি খাওয়াবি নাকি বল, নইলে বাসায় যাইগা। নওশাদ রাজী। গোড়ালি ডোবা জল পেরিয়ে রাস্তায় উঠে একটা রিকশা নিয়ে শেজানে পৌঁছাতে পৌঁছাতে আধভেজা।
শেজানের খিচুড়ি খেয়ে ঢেকুর তুলতে তুলতে বললাম যা তুই অফিস করগে, আমি বাসায় গিয়ে ভাতঘুম দেই। এবার নওশাদ উল্টাসুর ধরে বললো, বাসায় যাবার আগে একবার ওদিকে দেখে যা। বিকেল হতে দেরী নেই। রেজাল্ট কী আছে দেখে অন্তত চোখে দেখে যা। কি আর করা, নেহাত খিচুড়িটা সে খাইয়েছে, চক্ষুলজ্জা বলে কথা। আবারো বাসে উঠলাম ইপিজেডের পথে। গিয়ে দেখি নামটা সত্যি সত্যি লিষ্টিতে উপরের দিকেই উঠে গেছে। একশো পঞ্চাশ জনের মধ্যে বারোজন চুড়ান্ত। এবার?
আবারো ডাক পড়লো সেই ঠাণ্ডা ঘরে। এবার নতুন এক সাদা চামড়ার বিদেশী। নতুন বউ দেখার মতো আমার আপাদমস্তক দেখে পছন্দ করা হলো শুধু একটা জায়গা বাদে। গোঁফটা ছেঁটে ফেলতে হবে।
বলে কী? এই গোঁফ দিয়েই তো চেনা যায় আমাকে। এটা ছাঁটলে আর কী থাকে বাকী। আমি পারবো না বলে চলে এলাম।
কিন্তু এক সপ্তাহ যাবার আগেই নিয়োগপত্র বাড়ি এসে হাজির। এবার বাসার সবাই জেনে গেলো। এখন কি উপায়? ধরে বেঁধে গোঁফ ছেঁটে কর্মজীবনে প্রবেশ করানোর জন্য তৈরী করলো তখনো বেকার থাকা বন্ধুরা।
উপায়ান্তর না দেখে মনে মনে অন্তত কিছুদিনের জন্য হলেও চাকরীটা পরীক্ষামূলকভাবে করে দেখার একটা মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছি। নিয়োগপত্রে দেয়া প্রাথমিক সম্মানীর অংকটা ২৫০০ দেখে খচখচানি ছিল। বিসিএস পাশ করলে ২৮৫০ স্কেল হতো। ব্যাংকের চাকরী হলে ৬০০০ টাকা। থাক এটাও মেনে নেয়া গেল। ১০০০ টাকা দিয়ে একটা মাসিক টেক্সি ঠিক করা গেল। পকেটে ফুটো পয়সা নাই, কিন্তু টেক্সি ছাড়া চলবে না। তাও নতুন টেক্সি হতে হবে। খুরশীদ ড্রাইভার প্রতিদিন সকালে ডেকে নিয়ে যাবে বাসা থেকে। ১০০০ টাকা মায়ের হাতে দিয়ে ভালো ছেলে হবার চেষ্টা করা যাবে। বাকী পাঁচশো টাকায় নিজের খরচ। চলবে? চলবে না কেন। একসাথে পাঁচশো টাকা হাতে নিয়েছি কবে মনে নেই।
পরিবারের সবচেয়ে অযোগ্য সন্তানটির নতুন পথে যাত্রা শুরু।
এরকম ক্লান্ত শ্রান্ত বিধ্বস্ত মানসিক অবস্থায় হঠাৎ এক ঝলক বাতাস এসে বললো, গুড মর্নিং! এক এলোকেশী, শ্যামলা মায়াকাড়া চেহারার সাদামাটা তরুণী। আমিও ফিরতি জবাবে বললাম, মর্নিং। সহকর্মী, আমার চেয়ে কয়েকমাস পুরোনো। বোধকরি চেহারা দেখে করুণা হয়েছিল। সেই থেকে রোজ একবার দেখা হলেই গুডমর্নিং। শুধু ওই টুকুই, আর কোন কথা না। অথচ কী অদ্ভুত একটা সাহস চলে এলো তাতেই। যেদিন খেয়াল করেছি ওটা শুধু আমাকেই বলতো। কেন বলতো তাও কখনো জিজ্ঞেস করা হয়নি। তবে শুনতে ভালো লাগতো। ওই একটি বাক্য যেন আমাকে বলতো, তুমি একা নও। আমিও তোমার মতো। আমি আছি পাশে। আমার দিনটা যেন একটু সহনীয় সুন্দর হয়ে উঠলো কিছুদিন পরেই। সেই একই খাটুনি, একই দীর্ঘসময়ের কাজ। শুধু সকালবেলা কয়েক সেকেণ্ডের একটা বাক্য। তাতেই আমার সকাল যেতো ভরে, আমার দিন উঠতো হেসে, কর্মে যেতাম ভেসে।
সামান্য একটু আন্তরিকতাপূর্ণ হাসিমুখের সম্ভাষণ একটি কঠিন বিরস দিন সহজ আনন্দে কাটাবার জন্য কতটা গুরুতর ভূমিকা রাখে সেই প্রথম দেখা।
No comments:
Post a Comment