বাতিঘরে গিয়েছিলাম প্রীতম বসুর 'পাঁচকড়ির পঞ্চাননমঙ্গল' বইটির খোঁজে। বইটি পাওয়া গেল না। কিন্তু হঠাৎ করেই নলিনী দাশের লেখা 'সত্যজিতের ছেলেবেলা' বইটি দেখা গেল বুকশেলফের একটা জায়গায়। নলিনী দাশ নামটা খুব চেনা, কিন্তু ঠিক মনে পড়ছিল না। বইটি হাতে নিয়ে পাতা উল্টেই মনে পড়লো। জীবনানন্দ দাশের ভাতৃবধু নলিনী দাশ, ডাকনাম নিনি। জীবনানন্দ দাশের জীবনী পড়তে গিয়ে তাঁর কথা জেনেছিলাম এবং আরো জেনেছিলাম তিনি সত্যজিৎ রায়ের পিসতুতো বোন।
সত্যজিৎ রায় ও নলিনী দাশের শৈশব কাছাকাছি সময়ের বলে বইটির স্মৃতিচারণা নিয়ে আগ্রহটা একটু বেশী জাগলো। তাছাড়া বইটি উল্টে পাল্টে দুর্লভ কিছু ছবি এবং সত্যজিতের একদম বাল্যকালের কাঁচা হাতের লেখা চিঠি ইত্যাদি দেখে বইটি কিনে ফেললাম। অতঃপর পড়তেও শুরু করি। পড়তে গিয়ে একটা জায়গায় এসে কষ্টকর একটা দৃশ্যের বর্ণনায় এসে থেমে গিয়ে এই লেখাটা লিখতে বসলাম। ওই স্মৃতিটুকু সত্যজিতের নয়। তাঁর বাবা সুকুমার রায়ের শেষ দিনগুলোর কথা।
মানিকের (সত্যজিতের) বাবা সুকুমার রায়ের অসুস্থ অবস্থায় দার্জিলিং নিয়ে যাওয়া হয়েছিল ১৯২৩ সালে।
দার্জিলিং যাবার সময় সুকুমার রায়ের স্ত্রী-পুত্রের সাথে গিয়েছিল বোন পূন্যলতা(নিনির মা) ও নিনি। নিনির মা সুকুমার রায়ের পিঠেপিঠি ছোটবোন। মানিক তখন মাত্র ২ বছরের, নিনির বয়স ৭। সুকুমার রায় দার্জিলিং-এর 'মেরি লজ' বাংলোর জানালা দিয়ে ডিভানে শুয়ে কাঞ্চনজঙ্ঘার রূপ দেখতেন, সূর্যাস্ত-সূর্যোদয় দেখতেন। তাঁর জীবনের শেষ ছবিটি ওখানেই বসেই আঁকেন। দুবছর ধরে অসুস্থ তিনি, তাঁকে নানান জায়গায় হাওয়া বদলের জন্য নেয়া হতো। দার্জিলিংও গিয়েছেন একাধিকবার। সেই অসুস্থ অবস্থাতেই তিনি লেখালেখি চালিয়েছেন, ছবি এঁকেছেন। কখনো আদরের ছোট্ট মানিককে কোলে বুকে নিয়ে সময় পার করছেন।
কিছুদিন পরে তিনি আবার কোলকাতা ফিরে এলেন। কিন্তু অসুখ তাকে নিস্তার দেয়নি। ৯ সেপ্টেম্বর একটা বড় ভূমিকম্প হয়েছিল কলকাতায়, পরদিন ১০ সেপ্টেম্বর ১৯২৩ রায় পরিবারে ভূমিকম্প ঘটিয়ে তিনি চলে গেলেন মহাপ্রস্থানের পথে। মাত্র ৩৬ বছর বয়সে। ৩৬ কী এমন বয়স? ছোট্ট মানিক তখন তার কিছুই বোঝেনি, সেই ছোট্ট শিশুটি একদিন কত বড় হয়ে উঠবে তাঁর বাবা কোনদিনই জানতে পারবেন না।
এই অংশটুকু পড়ে কেমন একটা কষ্ট লাগলো। এত অল্প সময়ে সুকুমার রায় বাংলা সাহিত্যকে, সমস্ত বাঙালী জাতিকে কী বিপুল উপহার দিয়ে গেলেন। তাঁর বই না হলে অনেকের ছেলেবেলাটাই বিরস কাটতো। আমরা সবসময় তাঁর সৃষ্টিকর্মের আনন্দটা গ্রহণ করেছি। সুকুমার রায় মানেই মজার এক মানুষ, দম ফাটানো হাসির যোগানদাতা মজার সব রচনা তাঁর। অথচ তিনি নিজের জীবনটা উপভোগ করার মধ্য গগনে থাকতেই সব ছেড়ে চলে গেলেন অকাল বয়সে। প্রতিটি মানুষের চিরপ্রস্থানই বিষাদের। কিন্তু এই প্রস্থানটির বর্ণনা একদম ব্যক্তিগত স্মৃতি নেয়া বলেই হয়তো বেশী নাড়া দিল। নলিনী দাশের এই স্মৃতির টুকরোটা না পড়লে সুকুমার রায়ের ওই বেদনার্ত শেষবেলাটুকু কখনো জানা হতো না।
সত্যজিৎ রায়ের জীবনী সম্পর্কে কমবেশি সবাই জানেন। এখানে শুধু দুটো মজার বাল্য স্মৃতির উল্লেখ করি। সুকুমার রায়ের মৃত্যুর পর রায় পরিবারের প্রকাশনা ব্যবসা ইত্যাদি বিক্রি করে দিতে হয় পরিচালকের অভাবে। আড়াই বছরের সত্যজিতকে নিয়ে তার মা ভাইয়ের বাড়িতে উঠে যান। সেখানেই সত্যজিতের শিক্ষা দীক্ষা বেড়ে ওঠা। সেই বাড়িতে অন্যন্য বাচ্চাদের সাথে খেলতে গিয়ে একদিন 'ডাক্তার- রোগী' খেলায় সত্যজিৎ ডাক্তার সেজেছিল। কেউ তাকে বলেছিল তুমি বড় হয়ে ডাক্তার হবে। জবাবে সত্যজিৎ যা বলেছিল তা শুনে সবাই হেসে খুন। সে বলেছিল -বড় হয়ে সে জার্মানি গিয়ে সিনেমা তৈরি শিখে এসে সিনেমা বানাবে। ভাবা যায় পাঁচ বছর বয়সী একটা বাচ্চার মুখে এমন কথা!
সত্যজিৎ স্কুলে ভর্তি হয়েছিল সাড়ে আট বছর বয়সে। সেই বয়সে বই ডিকশেনারী খুঁজে মজার মজার কিছু শিখে অন্যদের সাথে শেয়ার করতো। একদিন এসে শেখালো নতুন একটি শব্দ floccinaucinihilipilification যার বাংলা অর্থ হলো 'অনুমান করে দেখা গেল যৎসামান্য'। আমি এই বয়সেও কখনো এই শব্দের দেখা পাইনি। চেক করে জানলাম এই শব্দটি ইংরেজি ডিকশেনারীর সবচেয়ে দীর্ঘ নন টেকনিক্যাল শব্দ। ওই পুঁচকে ছেলের প্রতিভা ছেলেবেলা থেকেই ফুটে বের হবার অপেক্ষায় ছিল তা বলাই বাহুল্য।
বইটি দেখতে একদম সাদামাটা। আকারেও তেমন বড় না, ১২০ পাতার মতন। ছাপাও উন্নত না, কাগজের মান, প্রচ্ছদের মান সবকিছুই দুর্বল। এমন বই, একটা ভালো প্রকাশক পেলো না বলে আক্ষেপ লাগছে। তবু সত্যজিতের দুর্লভ কিছু ছবি আর ছেলেবেলার বেশ কিছু হাতে লেখা পত্রের কারণে বইটি সংগ্রহে রাখার মতো।
ধন্যবাদ নলিনী দাশ বইটি লেখার জন্য। ধন্যবাদ অমিতানন্দ দাশ বইটি প্রকাশের দায়িত্ব নেবার জন্য। অমিতানন্দ দাশ নলিনী দাশের সন্তান, জীবনানন্দের ভাতুষ্পুত্র। যিনি জীবনানন্দের অপ্রকাশিত সব রচনা প্রকাশ করার ব্যাপারেও অসম্ভব পরিশ্রম করেছেন দায়িত্বশীলতার সাথে। ধন্যবাদ তাকেও যার উসিলায় বইটির সন্ধান পাওয়া গেল।
সত্যজিৎ রায় ও নলিনী দাশের শৈশব কাছাকাছি সময়ের বলে বইটির স্মৃতিচারণা নিয়ে আগ্রহটা একটু বেশী জাগলো। তাছাড়া বইটি উল্টে পাল্টে দুর্লভ কিছু ছবি এবং সত্যজিতের একদম বাল্যকালের কাঁচা হাতের লেখা চিঠি ইত্যাদি দেখে বইটি কিনে ফেললাম। অতঃপর পড়তেও শুরু করি। পড়তে গিয়ে একটা জায়গায় এসে কষ্টকর একটা দৃশ্যের বর্ণনায় এসে থেমে গিয়ে এই লেখাটা লিখতে বসলাম। ওই স্মৃতিটুকু সত্যজিতের নয়। তাঁর বাবা সুকুমার রায়ের শেষ দিনগুলোর কথা।
মানিকের (সত্যজিতের) বাবা সুকুমার রায়ের অসুস্থ অবস্থায় দার্জিলিং নিয়ে যাওয়া হয়েছিল ১৯২৩ সালে।
দার্জিলিং যাবার সময় সুকুমার রায়ের স্ত্রী-পুত্রের সাথে গিয়েছিল বোন পূন্যলতা(নিনির মা) ও নিনি। নিনির মা সুকুমার রায়ের পিঠেপিঠি ছোটবোন। মানিক তখন মাত্র ২ বছরের, নিনির বয়স ৭। সুকুমার রায় দার্জিলিং-এর 'মেরি লজ' বাংলোর জানালা দিয়ে ডিভানে শুয়ে কাঞ্চনজঙ্ঘার রূপ দেখতেন, সূর্যাস্ত-সূর্যোদয় দেখতেন। তাঁর জীবনের শেষ ছবিটি ওখানেই বসেই আঁকেন। দুবছর ধরে অসুস্থ তিনি, তাঁকে নানান জায়গায় হাওয়া বদলের জন্য নেয়া হতো। দার্জিলিংও গিয়েছেন একাধিকবার। সেই অসুস্থ অবস্থাতেই তিনি লেখালেখি চালিয়েছেন, ছবি এঁকেছেন। কখনো আদরের ছোট্ট মানিককে কোলে বুকে নিয়ে সময় পার করছেন।
কিছুদিন পরে তিনি আবার কোলকাতা ফিরে এলেন। কিন্তু অসুখ তাকে নিস্তার দেয়নি। ৯ সেপ্টেম্বর একটা বড় ভূমিকম্প হয়েছিল কলকাতায়, পরদিন ১০ সেপ্টেম্বর ১৯২৩ রায় পরিবারে ভূমিকম্প ঘটিয়ে তিনি চলে গেলেন মহাপ্রস্থানের পথে। মাত্র ৩৬ বছর বয়সে। ৩৬ কী এমন বয়স? ছোট্ট মানিক তখন তার কিছুই বোঝেনি, সেই ছোট্ট শিশুটি একদিন কত বড় হয়ে উঠবে তাঁর বাবা কোনদিনই জানতে পারবেন না।
এই অংশটুকু পড়ে কেমন একটা কষ্ট লাগলো। এত অল্প সময়ে সুকুমার রায় বাংলা সাহিত্যকে, সমস্ত বাঙালী জাতিকে কী বিপুল উপহার দিয়ে গেলেন। তাঁর বই না হলে অনেকের ছেলেবেলাটাই বিরস কাটতো। আমরা সবসময় তাঁর সৃষ্টিকর্মের আনন্দটা গ্রহণ করেছি। সুকুমার রায় মানেই মজার এক মানুষ, দম ফাটানো হাসির যোগানদাতা মজার সব রচনা তাঁর। অথচ তিনি নিজের জীবনটা উপভোগ করার মধ্য গগনে থাকতেই সব ছেড়ে চলে গেলেন অকাল বয়সে। প্রতিটি মানুষের চিরপ্রস্থানই বিষাদের। কিন্তু এই প্রস্থানটির বর্ণনা একদম ব্যক্তিগত স্মৃতি নেয়া বলেই হয়তো বেশী নাড়া দিল। নলিনী দাশের এই স্মৃতির টুকরোটা না পড়লে সুকুমার রায়ের ওই বেদনার্ত শেষবেলাটুকু কখনো জানা হতো না।
সত্যজিৎ রায়ের জীবনী সম্পর্কে কমবেশি সবাই জানেন। এখানে শুধু দুটো মজার বাল্য স্মৃতির উল্লেখ করি। সুকুমার রায়ের মৃত্যুর পর রায় পরিবারের প্রকাশনা ব্যবসা ইত্যাদি বিক্রি করে দিতে হয় পরিচালকের অভাবে। আড়াই বছরের সত্যজিতকে নিয়ে তার মা ভাইয়ের বাড়িতে উঠে যান। সেখানেই সত্যজিতের শিক্ষা দীক্ষা বেড়ে ওঠা। সেই বাড়িতে অন্যন্য বাচ্চাদের সাথে খেলতে গিয়ে একদিন 'ডাক্তার- রোগী' খেলায় সত্যজিৎ ডাক্তার সেজেছিল। কেউ তাকে বলেছিল তুমি বড় হয়ে ডাক্তার হবে। জবাবে সত্যজিৎ যা বলেছিল তা শুনে সবাই হেসে খুন। সে বলেছিল -বড় হয়ে সে জার্মানি গিয়ে সিনেমা তৈরি শিখে এসে সিনেমা বানাবে। ভাবা যায় পাঁচ বছর বয়সী একটা বাচ্চার মুখে এমন কথা!
সত্যজিৎ স্কুলে ভর্তি হয়েছিল সাড়ে আট বছর বয়সে। সেই বয়সে বই ডিকশেনারী খুঁজে মজার মজার কিছু শিখে অন্যদের সাথে শেয়ার করতো। একদিন এসে শেখালো নতুন একটি শব্দ floccinaucinihilipilification যার বাংলা অর্থ হলো 'অনুমান করে দেখা গেল যৎসামান্য'। আমি এই বয়সেও কখনো এই শব্দের দেখা পাইনি। চেক করে জানলাম এই শব্দটি ইংরেজি ডিকশেনারীর সবচেয়ে দীর্ঘ নন টেকনিক্যাল শব্দ। ওই পুঁচকে ছেলের প্রতিভা ছেলেবেলা থেকেই ফুটে বের হবার অপেক্ষায় ছিল তা বলাই বাহুল্য।
বইটি দেখতে একদম সাদামাটা। আকারেও তেমন বড় না, ১২০ পাতার মতন। ছাপাও উন্নত না, কাগজের মান, প্রচ্ছদের মান সবকিছুই দুর্বল। এমন বই, একটা ভালো প্রকাশক পেলো না বলে আক্ষেপ লাগছে। তবু সত্যজিতের দুর্লভ কিছু ছবি আর ছেলেবেলার বেশ কিছু হাতে লেখা পত্রের কারণে বইটি সংগ্রহে রাখার মতো।
ধন্যবাদ নলিনী দাশ বইটি লেখার জন্য। ধন্যবাদ অমিতানন্দ দাশ বইটি প্রকাশের দায়িত্ব নেবার জন্য। অমিতানন্দ দাশ নলিনী দাশের সন্তান, জীবনানন্দের ভাতুষ্পুত্র। যিনি জীবনানন্দের অপ্রকাশিত সব রচনা প্রকাশ করার ব্যাপারেও অসম্ভব পরিশ্রম করেছেন দায়িত্বশীলতার সাথে। ধন্যবাদ তাকেও যার উসিলায় বইটির সন্ধান পাওয়া গেল।
No comments:
Post a Comment