'যখন সময় থমকে দাঁড়ায়......' একটা থমকে যাওয়া দুঃসময়ে গানটা প্রথম শুনেছিলাম বলেই সেই গানের সূচনা সঙ্গীত এখনো স্মৃতি কাতরতা জাগিয়ে তোলে। গান, কবিতা, সিনেমা কিংবা বই - এসব অনেক দুঃসময়ে মলমের কাজ করে। প্রায় প্রতিটি মানুষ কোন না কোন ক্ষত নিয়ে জীবন পার করে, কিছু ক্ষত প্রকাশ্য কিছু ক্ষত অপ্রকাশ্য। আমরা কী সবার সব ক্ষত দেখতে পাই? কিংবা আমার ক্ষতটা কি আর কাউকে দেখতে দেই? দেই না। মানুষ নিজের জগতে শুধু নিজেই জানে এখানে কতটা অসহায় একটা প্রাণী। কতোটা একাকীত্ব অনুভুতির ঘুপচি ঘরে লুকোনো আছে।
দেবেশ রায়ের মফস্বলি বৃত্তান্তের পর হাতে আসলো 'উচ্ছিন্ন উচ্চারণ'। পড়তে পড়তে কিছুদূর এগিয়ে ইচ্ছে করলো কিছু অনুচ্ছেদের অংশবিশেষ লিখি। নতুন এক দেবেশ রায়কে আবিষ্কার করা হলো এই বইটিতে। একটি সম্পূর্ণ অনুভুতিময় বই, চিরচেনা কিছু অনুভুতি অথচ আর কেউ লেখেনি এমন করে। আর কেউ ভাবেনি এমন করে। নতুন একটা মুগ্ধতা এসে জড়িয়ে ধরলো আজ। লালনের গান যেমন একটা ভাবের জগতে নিয়ে যায় আমাদের। এই বইটিও তেমনি ভাসায়, আর ভাবায়। ভাবতে ভাবতে...........পড়তে পড়তে.......কিছু টুকে রাখা টুকরো অংশ.......
--------------------------------------------------------------------------------------
--------------------------------------------------------------------------------------
বাঁশের ঝাড়ে ঢুকলে বাতাস পথ হারিয়ে ফেরে। তখন সে বাঁশের গুচ্ছমূল থেকে বাঁশের পাতা বেয়ে বাইরে বেরিয়ে আসতে চায়। বাঁশপাতার ভিতর দিয়ে তখন ছোট নদীর সেই কল্লোল শোনা যায়, যা দিনের বেলায় অনেক আওয়াজের সঙ্গে মিশে থাকে। তাকে আলাদা করা যায় না। এই কথাগুলো বাঁশপাতার বহতা নদীর মতো এখন কলধ্বনিতে স্পষ্ট।
যে একক দিয়েই মাপো না কেন, তুমি তো আমাদের সম্বন্ধকে এক জন্মের বেশী টেনে নিয়ে যেতে পারবে না। তাও সে জন্মের কতটাই তো আমাদের বাধ্যত আলাদা কেটেছে। তাহলে, মাত্র এক জন্ম? একটাই মাত্র জন্ম? আর তা এতই ছোট? এরই ভিতর আমাদের জন্ম জন্মান্তর জড়ানো মিলন ঘটে গেল, ঘটে শেষ হয়ে গেল? এরই ভিতর আমাদের জন্ম-জন্মান্তর দিয়েও ঘোচানো যাবে না, এমন বিচ্ছেদ ঘটে গেল? আর, আমরা দুজন এই এক জন্মব্যাপী সময় ধরে, ধীরে-ধীরে, ধীরে-ধীরে, যেমন করে ধীরে-ধীরে মরুভূমির বায়ুহীনতায় সারা রাত বালিয়াড়ির বালি ঝুরঝুর ঝুরঝুর ঝরে যেতে থাকে, অথবা, আর এক জায়গায় পুঞ্জিত হতে থাকে, তেমনি ধীরে-ধীরে, ধীরে-ধীরে জেনে গেলাম, জেনে গেলাম, যে, আমাদের ভিতরে যে বিচ্ছেদ ঘটে গেছে, তা যুগ-যুগান্ত কেটে গেলেও আর ভরাট হবে না।......আমাদের অভিকর্ষের বদল ঘটে গেছে, আমাদের আকাশের বদল ঘটে গেছে। আকাশ একবার বদলে গেলে কি আর তার পুনরুদ্ধার ঘটানো যায়? [তের]
তুমি কী দিয়ে মাপতে আমাদের সম্বন্ধের বয়স? সূর্যের উদয় ও অস্ত দিয়ে? তাতে তো প্রতিটি দিনকে আলাদা করে গুনতে হয়। তুমি কি তাতে সম্মত হতে পারততে-আমাদের একটা দিনকে আর একটা দিন থেকে আলাদা করতে? তোমার কাছে তো আমাদের পুরোটা জীবনের সময় ছিল এমন, যাকে খণ্ড করা যায় না, যাকে ছিন্ন করা যায় না, যাকে গণনা করা যায় না।
...............
আমাদের দুজনের দুজনের কাছে পৌঁছাতে কতগুলো বছর শৈশব খেয়েছে, কতগুলো বছর বাল্য খেয়েছে, কৈশোরেও প্রথমদিকের বছরগুলি নিজেদের দেখতে নিজেরা খেয়েছি। তারপর কতো কোটি আলোকবর্ষ পেরিয়ে নবজাতক নক্ষত্রের আলো চোখে এসে লাগলো। তখন থেকে যদি জন্মের হিসেব নাও, তাহলে দেখবে কটি বছর, মাত্র কটি বছর আমাদের সম্বন্ধের আয়ু। সেটা কি হিসেবে আসে? আর কটি মানববর্ষের হিসেব করতেই কি সূর্য চন্দ্র ও নক্ষত্রকে পরিমাপের একক হিসেবে বাছছিলে? তোমার অনন্ত, ক-বছরের অনন্ত? [নয়]
..................................
.......................................
তুমি কি অন্যের অনুমোদিত স্ত্রী ছিলে? তুমি কি তখনো অনূঢ়া ছিলে? এসব প্রশ্নের কোন মীমাংসা নেই, কেননা এসব কোন শব্দের ভিত্তি নেই। আমাদের সব শব্দের ভিতর কোনো না কোনো সামাজিক অনুমোদন বা নিষেধ লিপ্ত আছে। কোন নারী কি এমন থাকতে পারে যে অনূঢ়াও নয়, আবার অন্যের অনুমোদিত স্ত্রীও নয়, কিংবা ধরা যাক, বিধবাবো নয়। তাহলে তুমি আমার কী ছিলে? আমরা আমাদের জীবনের সবচেয়ে উদ্বেল, গভীর ও অমেয় সময় কাটালাম যে বন্ধনে, সে বন্ধনের কোন নাম নেই? এই বন্ধনকেই কেন জোর দিতে চাইছি? আমাদের দুজনের বন্ধন তো ছিল কত অজস্র আজন্ম, বংশানুক্রমিক ও অর্জিত বন্ধন থেকে মুক্তি। এত মুক্তির পথ দিয়ে, বা, এত মুক্তি ঘটাতে-ঘটাতে, যে বন্ধন তৈরী হয়, সে কি বন্ধন? আমরা কি তাহলে সেই বন্ধনে বাঁধা পড়েছিলাম, যে বন্ধন বাধা যায় মানুষের পূর্ণ স্বাধীন ইচ্ছায়। সে বন্ধনের মুক্তিও ঘটে মানুষের পূর্ণ স্বাধীন ইচ্ছায়। কোন মানুষ নিজেকে এতটাই অধীন করে রাখে, যে, সে তার মুক্তিকেও মুক্তি বলে চিনে নিতে পারে না, এমনকি সেই মুক্তির বন্ধনের কোন নাম বা পরিচয় পর্যন্ত দিতে পারে না। অথচ সভ্যতা বলতে তুমি যদি কিছু অনুমান করে নিতে পারো, তাহলে যে সভ্যতাগুলো আমরা পেরিয়ে এসেছি, ও যে সভ্যতার আলোড়নের মধ্যে আমাদের বসবাস, জীবনযাপন করছি ও এই সভ্যতার পর যেসব সভ্যতা তৈরী হয়ে উঠবে, সমুদ্রের প্রবালদ্বীপের মত, সেই সব সভ্যতার দিকে তাকিয়ে দেখো, মানুষ শুধু এই একটি বন্ধনের, বা মুক্তির, বা সম্বন্ধের নামকরণ করতে চাইছে এমন একটি শব্দে, যার ভেতরে কোন আনুগত্য বা সামাজিকতা লুকোনো নেই। মানুষ এখনো কোনো ভাষায় তার স্বাধীনতম সেই সম্বন্ধের কোন পথ খুঁজে পায়নি, যে সম্বন্ধ একমাত্র মানব মানবীই রচনা করতে পারে, যে সম্বন্ধে মানব মানবী উত্তীর্ণ হতে পারে। আমার এমন একটি জিজ্ঞাসা-তোমার আমার সম্বন্ধ কদিনের থাকল-তৈরী করতে গিয়ে, আমি সেই সম্বন্ধের পরিচয় কী, এই প্রাক প্রাথমিক জিজ্ঞাসাতেই ঠেকে গেলাম। [এক]
এবং বর্তমান সময় ও ঘটনাবলীর সাথে প্রচণ্ডভাবে প্রাসঙ্গিক কয়েকটি লাইনও---
মানুষের ভালোবাসার শক্তি মৃত্যুকে পরাজিত করার শক্তি হারিয়েছে। কারণ, মানুষ নিজের জ্ঞানকে হত্যা, আরো হত্যা ও আরো হত্যার কাজে ব্যবহার করেছে। মানুষ যখন জ্ঞানের শক্তি নিজেই আয়ত্ত করেছিল, তখনই সে তার নিজের উপর এক নিষেধও জারি করেছিল। এই আহরিত ও আবিষ্কৃত জ্ঞান যেন কখনোই হত্যার ভিত্তি হয়ে না উঠে। তারপর, মানুষ নিজেই নিজের সেই নিষেধাজ্ঞা অস্বীকার করেছে। যে মানুষ নিজেই মৃত্যুর এক প্রধান কারণ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছে, সে মানুষ মৃত্যুকে পরাজিত করার শান্তি, শক্তি ও নিশ্চয়তা সংগ্রহ করবে কোথা থেকে? [১১০ পৃষ্ঠা]
মানুষের ভালোবাসার শক্তি মৃত্যুকে পরাজিত করার শক্তি হারিয়েছে। কারণ, মানুষ নিজের জ্ঞানকে হত্যা, আরো হত্যা ও আরো হত্যার কাজে ব্যবহার করেছে। মানুষ যখন জ্ঞানের শক্তি নিজেই আয়ত্ত করেছিল, তখনই সে তার নিজের উপর এক নিষেধও জারি করেছিল। এই আহরিত ও আবিষ্কৃত জ্ঞান যেন কখনোই হত্যার ভিত্তি হয়ে না উঠে। তারপর, মানুষ নিজেই নিজের সেই নিষেধাজ্ঞা অস্বীকার করেছে। যে মানুষ নিজেই মৃত্যুর এক প্রধান কারণ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছে, সে মানুষ মৃত্যুকে পরাজিত করার শান্তি, শক্তি ও নিশ্চয়তা সংগ্রহ করবে কোথা থেকে? [১১০ পৃষ্ঠা]
বইটি এখনো শেষ হয়নি। হয়তো আরো সংযোজনের প্রয়োজন হবে.....আরো কিছু লাইন।
No comments:
Post a Comment