শোনা যায় ছোটগল্প বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে কম আলোচিত বিষয়, কিছুটা উপেক্ষিতও হয়তো। উপন্যাস যতটা বিক্রি হয় সেই তুলনায় ছোটগল্পের বাজার অনেক ছোট। ব্যক্তিগতভাবে ছোটগল্প আমার পছন্দের বিষয় হলেও দীর্ঘদিন ছোটগল্পের জগত থেকে দূরে ছিলাম। সেই দূরত্বের কারণে বঞ্চিত হয়েছি যেসব ভালো গল্প থেকে তা পূরণ করতে গিয়ে সাম্প্রতিককালে যেসব লেখকের গল্প দ্বারা আলোড়িত হয়েছি তাঁদের কিছু গল্প নিয়ে গল্পসল্প করার ইচ্ছে থেকে একটা ছোটগল্প আলোচনা সিরিজের সূচনা করছি। যেখানে খুব বিখ্যাত লেখকের গল্প থাকবে তেমনি থাকবে লিটল ম্যাগাজিনের অখ্যাত অথচ ভীষণ সম্ভাবনাময় কোন তরুণ লেখকেরও। প্রতিটি পর্বে একটি করে গল্পের পাঠানুভূতি নিয়ে লিখিত হবে।
ছোটগল্পে আমার প্রিয় লেখক কারা? গত শতকের আশি দশকে ছাত্র বয়সে যখন প্রথম ছোটগল্প পড়তে শুরু করি, বিশ্বসাহিত্যের চারজন ছিলেন আমার বিশেষ প্রিয়। রবীন্দ্রনাথ, চেখভ, মোপাসাঁ, এডগার এলান পো। লক্ষণীয় যে ছাত্র বয়সে বিশ্বসাহিত্যের প্রতি মনোযোগটা একটু বেশী ছিল। ঘরের দিকে নজর ছিল কম। তারপর পেশাগত ব্যস্ততার কারণে বেশ লম্বা একটা সময় পাঠ থেকে দূরে থাকতে হয়। দ্বিতীয় পর্বে এসে এই শতকের প্রথম দশক পেরিয়ে আবারো ছোট গল্পের সাথে যোগাযোগ।
এবার বিশ্বসাহিত্য বাদ দিয়ে একদম ঘরের কাছের ছোটগল্পের অনুসন্ধান- যেখানে দুই বাংলার অসাধারণ কিছু গল্প বলিয়ের সাথে পরিচয় ঘটতে থাকে। বাংলা গদ্যের বৈচিত্র্যপূর্ণ সম্ভারের আবিষ্কারটিও এই সময়েই। হাসান আজিজুল হক, হুমায়ূন আহমেদ, পেরিয়ে শাহাদুজ্জামান এবং ইমতিয়ার শামীমে যখন এই গদ্য সম্ভারের আবিষ্কার চলছিল, তখন বিস্মিত পরিচয় ঘটে ওপার বাংলার কমলকুমার মজুমদার, সুবোধ ঘোষ, নবারুণ ভট্টাচার্য, জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী আর প্রেমেন্দ্র মিত্রের সাথে।
নতুন পরিচয়ের এই গদ্য সম্ভারে একরকম বুঁদ হয়ে পড়ি। কিন্তু না, তখনো বিস্ময়ের কিছু বাকী ছিল। নবনীতা দেবসেনের স্মৃতিকথা 'স্বজন সকাশে' পড়ে জানতে পারি শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের কথা। বস্তুতঃ তাঁর গল্পের সাথে এত দেরীতে পরিচয় ঘটার কারণে আক্ষেপের পাশাপাশি একটা আনন্দ কাজ করেছে। কিছু লেখার সাথে এমন বয়সে পরিচিত হওয়া ভালো, যে বয়সে ওই লেখাটা অধিকতর অর্থপূর্ণ। আজ থেকে বিশ বছর আগে শ্যামল পড়লে যে অনুভূতি হতো, সেটা এই সময়ে পড়ার অনুভূতির তুলনায় অনুল্লেখযোগ্য হতো, হয়তো। কিছু কিছু লেখা পরিণত বয়সে বেশী উপভোগ্য বলে আমার ব্যক্তিগত ধারণা।
শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের গল্পের সাথে আমার পরিচয় হলো ঠিক কল্যাণের বয়সে এসে। কল্যাণকে সবাই চিনবেন না। কিন্তু যারা তাঁর 'উর্বরাশক্তি' গল্পটি পড়েছেন কল্যাণকে তাঁদের মনে থাকার কথা।
কল্যাণের পরিচয়টি তাঁর গল্পের সূচনা থেকেই দিচ্ছি -
'পৃথিবীতে আগের চেয়ে এখন নিরুপায় লোকের সংখ্যা অনেক বেশী। এরকম একটি ধারণা কিছুদিন ধরেই কল্যাণের মাথায় চাক বেঁধে তৈরি হয়ে আসছিল। কল্যাণ এ পাড়ার আট বছরের পুরোনো ভাড়াটে। পাড়াটির প্রথম পুরুষরা সবাই এখন বিগত। মানে যারা জায়গা কিনে বাড়ি করেছিলেন- তাঁরা কেউ নেই। তাঁদের সন্তান সন্ততিদেরই বয়স এখন ষাট থেকে সত্তরের ভেতর। নিশুতি রাতে পাড়ার বেওয়ারিশ কুকুরগুলো এ পাড়ার মালিক। ভোরবেলা কাকের দল লেড়ো বিস্কুটের টুকরো খেতে চায়ের দোকানের সামনে ঝাঁক বেঁধে নামে। বাড়িগুলোর একতলার আগেকার গ্যারেজঘর এখন ধোবিখানা। ফুটপাত ঘেঁষে যা দু চারটে গাছ ছিল তাদের গোড়ায় গেরস্থ বাড়ির ছাই, খোসা আরো কত কি। কল্যাণ এখন সেই বয়সটায় - যখন ঘুম কমে আসে - রিটায়ারের বাকী থাকে তের বছর - স্ত্রী আলাদা শোয় - পেচ্ছাপ কম হয়।'
আশা করি কল্যাণ সম্পর্কে একটা ধারণা মিলেছে এইটুকু দিয়ে। 'উর্বরাশক্তি' গল্পটি কল্যাণকে দিয়ে শুরু হলেও এটি মূলত: একটি বেড়াল জুটির সম্পর্ক যাপনের গল্প। কল্যাণ সেখানে দর্শকমাত্র এবং আমরা কল্যাণের সহদর্শক।
জুটির একটি বেড়াল(নারী বেড়াল) অন্যটি হুলো(পুরুষ বেড়াল)। বেড়ালটি কল্যাণের বাড়ির আবাসিক বাসিন্দা হলেও হুলোটি বহিরাগত। কল্যাণের বারান্দার বাগানেই তাদের আলাপ পরিচয়। বারান্দা দিয়ে যাবার সময় দুজনের দেখা হয় কোন এক জ্যোৎস্না রাতে।
হুলো বহিরাগত হলেও আচরণে সে উদ্ধত এবং স্বাধীনচেতা। তার হাবভাব হলো 'পৃথিবীটা হলো ওদের দুজনের মানুষজন সব আসলে বেড়াল'। কল্যাণের দৃষ্টিতে 'আহার, বিহার আর মৈথুনে পারদর্শী একজন উচ্চশ্রেণীর বিষয়ী'। সে হুলোটির নাম দেয় 'প্রিয়গোপাল বিষয়ী' আর বিড়ালটির নাম রাখে 'রাধারানী'।
ওদের প্রথম দুটো বাচ্চা দুটো দুর্ঘটনায় মারা যায় দুজনের দুটো কার্যকারণে। একটা বাচ্চাকে হুলো খেয়ে ফেলেছিল। অন্যটি মায়ের দাঁতের চাপে মারা যায় এঘর ওঘর করতে গিয়ে। তবু কিছুদিন পরই রাধারানীর পেট মোটা হয় আবারো। মাঝরাতে এসে প্রিয়গোপাল ডাকে 'ক্যাঁ-রব-র ক্যাঁ-রব-র' করে। 'পনেরোই জুন রাধারাণীর আবার একটি খোকাও খুকু হলো। আকাশবাণীর তৃতীয় অধিবেশন সমাপ্ত হবার পর।....সে কাউকে ছানা দেখাতে চায় না। তাই আলনার শেষর্যাক থেকে বুকর্যাকে যায়, বুকর্যাক থেকে জুতোর বাক্সে বাচ্চাদের জন্য নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে'। যাদের বাড়িতে বেড়াল আছে এই দৃশ্যটি খুব পরিচিত। আমি নিজে পরিচিত এটার সাথে।
কদিন পর বাচ্চারা একটু বড় হয়ে উঠলে দুটোতে মিলে খেলাধুলো করে। রাধারানী মাছের কাটা মুখে নিয়ে বাচ্চাদের ডাকাডাকি করে। 'কাছে আয়। কাটা খাবি বাবা।এ হলো গিয়ে বড় মাছের শিরদাঁড়া। সাবধানে চিবোতে হয়'। কী মমতাময়ী ডাক!
কিন্তু পুরুষ চরিত্র। প্রিয়গোপাল মশাই বাচ্চা হবার পর থেকে রাধারাণীকে কাছে পাচ্ছে না। সে কল্যাণের বারান্দার লাগোয়া পাঁচিলে এসে রাধাকে ডাক দেয় 'এই রাধা। আয়। যাবিনে?' রাধারানী কোন জবাবই দেয় না। বাইরের লোকে হুলোর যে ডাক শোনে, সে ডাক আদেশের। যখন সে ডাক একটু খাদে নামে সেটা হলো আশাভঙ্গের। সে আবারো ডাকে ' আয় হৈমি ডাক্তারের বাড়ির ছাদে যাই। ও-বাড়ি আজ চতুর্থী। মৎস্যমুখী হচ্ছে। আয় বলছি-'
কাজ হলো না তাতেও। তারপর মাঝরাতে প্রিয়গোপাল একদম ঘরের ভেতর এলো। জানালা গলে। হিসেব নেওয়ার ভঙ্গীতে। ......প্রিয়গোপাল বাঘের ভঙ্গিতে মেঝেতেই বসলো। দুহাত দুরে রাধারানী একই ভঙ্গিতে বসা। মাঝখানে খোকাখুকু খেলছে। রাধারানী মিনতি করে দীর্ঘ মেয়াও ধ্বনি দিয়ে অনুরোধ করছে এবার যেন বাচ্চাদের না খায়। অন্ধকারেও কল্যাণ দেখতে পায় চারজনের আট জোড়া চোখ। বাপ এবং খাদক হিসেবে প্রিয়গোপালের সহনশীলতা কল্যাণকে মুগ্ধ করে। কেননা প্রিয়গোপাল এদেশের ভোটার নয়। নাগরিক নয়। যদিও সে এখানকার জল হাওয়ায় বড় হয়েছে। আচরণ আচরণের জন্য সে দেশের আইনের কাছে দায়বদ্ধ নয়। সে চাইলে সবার সামনে রাধারানীর উপর উপগত হতে পারতো।
এই বর্ণনাটুকু পড়তে পড়তে মানুষ হিসেব মানব সমাজের সাথে তুলনাটা আপনাতেই চলে আসে। লেখকও চেয়েছেন সেটাই। বাড়িতে একটি অতিথি আছে। কল্যাণের মেয়ে এসেছে বেড়াতে। তারও বাচ্চা হবে। কল্যাণের স্ত্রী মেয়ের সেবা নিয়ে ব্যস্ত। বাচ্চা হবার আগে বেড়ালছানা দুটো পার করতে হবে। নইলে মানুষের বাচ্চার অনিষ্ট হবে। কল্যাণ তার নিজের জীবনকে নিয়ে ভাবে। কোথাও কোথাও সে হুলোটার চেয়েও অসহায় পরাধীন। হুলোটি যতটা স্বাধীনভাবে রাধারানীর কাছে যেতে পারে, সে পারে না তার রাধারাণীর কাছে প্রত্যাখ্যানের দাপটে। তবু তার একটি আকাংখা, একটি মনোবেদনা প্রত্যাশা পূরণের সম্ভাবনার ছাপ রেখে যায় গল্পের শেষাংশে পৌঁছে।
মানব সমাজ এবং বিড়াল সমাজের একটা তুলনামূলক সংক্ষিপ্ত আচরণগত বিশ্লেষণ শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় সে সরস এবং সহজ দক্ষতার সাথে এঁকেছেন তাতে গল্পটি শেষ করার পরও আরো বহুক্ষণ গল্পের আমেজ পাঠকের মাথায় ঘুরপাক খায়। এই গল্পপাঠের সেই আনন্দটুকুই যথার্থ প্রাপ্তি।
ছোটগল্পে আমার প্রিয় লেখক কারা? গত শতকের আশি দশকে ছাত্র বয়সে যখন প্রথম ছোটগল্প পড়তে শুরু করি, বিশ্বসাহিত্যের চারজন ছিলেন আমার বিশেষ প্রিয়। রবীন্দ্রনাথ, চেখভ, মোপাসাঁ, এডগার এলান পো। লক্ষণীয় যে ছাত্র বয়সে বিশ্বসাহিত্যের প্রতি মনোযোগটা একটু বেশী ছিল। ঘরের দিকে নজর ছিল কম। তারপর পেশাগত ব্যস্ততার কারণে বেশ লম্বা একটা সময় পাঠ থেকে দূরে থাকতে হয়। দ্বিতীয় পর্বে এসে এই শতকের প্রথম দশক পেরিয়ে আবারো ছোট গল্পের সাথে যোগাযোগ।
এবার বিশ্বসাহিত্য বাদ দিয়ে একদম ঘরের কাছের ছোটগল্পের অনুসন্ধান- যেখানে দুই বাংলার অসাধারণ কিছু গল্প বলিয়ের সাথে পরিচয় ঘটতে থাকে। বাংলা গদ্যের বৈচিত্র্যপূর্ণ সম্ভারের আবিষ্কারটিও এই সময়েই। হাসান আজিজুল হক, হুমায়ূন আহমেদ, পেরিয়ে শাহাদুজ্জামান এবং ইমতিয়ার শামীমে যখন এই গদ্য সম্ভারের আবিষ্কার চলছিল, তখন বিস্মিত পরিচয় ঘটে ওপার বাংলার কমলকুমার মজুমদার, সুবোধ ঘোষ, নবারুণ ভট্টাচার্য, জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী আর প্রেমেন্দ্র মিত্রের সাথে।
নতুন পরিচয়ের এই গদ্য সম্ভারে একরকম বুঁদ হয়ে পড়ি। কিন্তু না, তখনো বিস্ময়ের কিছু বাকী ছিল। নবনীতা দেবসেনের স্মৃতিকথা 'স্বজন সকাশে' পড়ে জানতে পারি শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের কথা। বস্তুতঃ তাঁর গল্পের সাথে এত দেরীতে পরিচয় ঘটার কারণে আক্ষেপের পাশাপাশি একটা আনন্দ কাজ করেছে। কিছু লেখার সাথে এমন বয়সে পরিচিত হওয়া ভালো, যে বয়সে ওই লেখাটা অধিকতর অর্থপূর্ণ। আজ থেকে বিশ বছর আগে শ্যামল পড়লে যে অনুভূতি হতো, সেটা এই সময়ে পড়ার অনুভূতির তুলনায় অনুল্লেখযোগ্য হতো, হয়তো। কিছু কিছু লেখা পরিণত বয়সে বেশী উপভোগ্য বলে আমার ব্যক্তিগত ধারণা।
শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের গল্পের সাথে আমার পরিচয় হলো ঠিক কল্যাণের বয়সে এসে। কল্যাণকে সবাই চিনবেন না। কিন্তু যারা তাঁর 'উর্বরাশক্তি' গল্পটি পড়েছেন কল্যাণকে তাঁদের মনে থাকার কথা।
কল্যাণের পরিচয়টি তাঁর গল্পের সূচনা থেকেই দিচ্ছি -
'পৃথিবীতে আগের চেয়ে এখন নিরুপায় লোকের সংখ্যা অনেক বেশী। এরকম একটি ধারণা কিছুদিন ধরেই কল্যাণের মাথায় চাক বেঁধে তৈরি হয়ে আসছিল। কল্যাণ এ পাড়ার আট বছরের পুরোনো ভাড়াটে। পাড়াটির প্রথম পুরুষরা সবাই এখন বিগত। মানে যারা জায়গা কিনে বাড়ি করেছিলেন- তাঁরা কেউ নেই। তাঁদের সন্তান সন্ততিদেরই বয়স এখন ষাট থেকে সত্তরের ভেতর। নিশুতি রাতে পাড়ার বেওয়ারিশ কুকুরগুলো এ পাড়ার মালিক। ভোরবেলা কাকের দল লেড়ো বিস্কুটের টুকরো খেতে চায়ের দোকানের সামনে ঝাঁক বেঁধে নামে। বাড়িগুলোর একতলার আগেকার গ্যারেজঘর এখন ধোবিখানা। ফুটপাত ঘেঁষে যা দু চারটে গাছ ছিল তাদের গোড়ায় গেরস্থ বাড়ির ছাই, খোসা আরো কত কি। কল্যাণ এখন সেই বয়সটায় - যখন ঘুম কমে আসে - রিটায়ারের বাকী থাকে তের বছর - স্ত্রী আলাদা শোয় - পেচ্ছাপ কম হয়।'
আশা করি কল্যাণ সম্পর্কে একটা ধারণা মিলেছে এইটুকু দিয়ে। 'উর্বরাশক্তি' গল্পটি কল্যাণকে দিয়ে শুরু হলেও এটি মূলত: একটি বেড়াল জুটির সম্পর্ক যাপনের গল্প। কল্যাণ সেখানে দর্শকমাত্র এবং আমরা কল্যাণের সহদর্শক।
জুটির একটি বেড়াল(নারী বেড়াল) অন্যটি হুলো(পুরুষ বেড়াল)। বেড়ালটি কল্যাণের বাড়ির আবাসিক বাসিন্দা হলেও হুলোটি বহিরাগত। কল্যাণের বারান্দার বাগানেই তাদের আলাপ পরিচয়। বারান্দা দিয়ে যাবার সময় দুজনের দেখা হয় কোন এক জ্যোৎস্না রাতে।
হুলো বহিরাগত হলেও আচরণে সে উদ্ধত এবং স্বাধীনচেতা। তার হাবভাব হলো 'পৃথিবীটা হলো ওদের দুজনের মানুষজন সব আসলে বেড়াল'। কল্যাণের দৃষ্টিতে 'আহার, বিহার আর মৈথুনে পারদর্শী একজন উচ্চশ্রেণীর বিষয়ী'। সে হুলোটির নাম দেয় 'প্রিয়গোপাল বিষয়ী' আর বিড়ালটির নাম রাখে 'রাধারানী'।
ওদের প্রথম দুটো বাচ্চা দুটো দুর্ঘটনায় মারা যায় দুজনের দুটো কার্যকারণে। একটা বাচ্চাকে হুলো খেয়ে ফেলেছিল। অন্যটি মায়ের দাঁতের চাপে মারা যায় এঘর ওঘর করতে গিয়ে। তবু কিছুদিন পরই রাধারানীর পেট মোটা হয় আবারো। মাঝরাতে এসে প্রিয়গোপাল ডাকে 'ক্যাঁ-রব-র ক্যাঁ-রব-র' করে। 'পনেরোই জুন রাধারাণীর আবার একটি খোকাও খুকু হলো। আকাশবাণীর তৃতীয় অধিবেশন সমাপ্ত হবার পর।....সে কাউকে ছানা দেখাতে চায় না। তাই আলনার শেষর্যাক থেকে বুকর্যাকে যায়, বুকর্যাক থেকে জুতোর বাক্সে বাচ্চাদের জন্য নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে'। যাদের বাড়িতে বেড়াল আছে এই দৃশ্যটি খুব পরিচিত। আমি নিজে পরিচিত এটার সাথে।
কদিন পর বাচ্চারা একটু বড় হয়ে উঠলে দুটোতে মিলে খেলাধুলো করে। রাধারানী মাছের কাটা মুখে নিয়ে বাচ্চাদের ডাকাডাকি করে। 'কাছে আয়। কাটা খাবি বাবা।এ হলো গিয়ে বড় মাছের শিরদাঁড়া। সাবধানে চিবোতে হয়'। কী মমতাময়ী ডাক!
কিন্তু পুরুষ চরিত্র। প্রিয়গোপাল মশাই বাচ্চা হবার পর থেকে রাধারাণীকে কাছে পাচ্ছে না। সে কল্যাণের বারান্দার লাগোয়া পাঁচিলে এসে রাধাকে ডাক দেয় 'এই রাধা। আয়। যাবিনে?' রাধারানী কোন জবাবই দেয় না। বাইরের লোকে হুলোর যে ডাক শোনে, সে ডাক আদেশের। যখন সে ডাক একটু খাদে নামে সেটা হলো আশাভঙ্গের। সে আবারো ডাকে ' আয় হৈমি ডাক্তারের বাড়ির ছাদে যাই। ও-বাড়ি আজ চতুর্থী। মৎস্যমুখী হচ্ছে। আয় বলছি-'
কাজ হলো না তাতেও। তারপর মাঝরাতে প্রিয়গোপাল একদম ঘরের ভেতর এলো। জানালা গলে। হিসেব নেওয়ার ভঙ্গীতে। ......প্রিয়গোপাল বাঘের ভঙ্গিতে মেঝেতেই বসলো। দুহাত দুরে রাধারানী একই ভঙ্গিতে বসা। মাঝখানে খোকাখুকু খেলছে। রাধারানী মিনতি করে দীর্ঘ মেয়াও ধ্বনি দিয়ে অনুরোধ করছে এবার যেন বাচ্চাদের না খায়। অন্ধকারেও কল্যাণ দেখতে পায় চারজনের আট জোড়া চোখ। বাপ এবং খাদক হিসেবে প্রিয়গোপালের সহনশীলতা কল্যাণকে মুগ্ধ করে। কেননা প্রিয়গোপাল এদেশের ভোটার নয়। নাগরিক নয়। যদিও সে এখানকার জল হাওয়ায় বড় হয়েছে। আচরণ আচরণের জন্য সে দেশের আইনের কাছে দায়বদ্ধ নয়। সে চাইলে সবার সামনে রাধারানীর উপর উপগত হতে পারতো।
এই বর্ণনাটুকু পড়তে পড়তে মানুষ হিসেব মানব সমাজের সাথে তুলনাটা আপনাতেই চলে আসে। লেখকও চেয়েছেন সেটাই। বাড়িতে একটি অতিথি আছে। কল্যাণের মেয়ে এসেছে বেড়াতে। তারও বাচ্চা হবে। কল্যাণের স্ত্রী মেয়ের সেবা নিয়ে ব্যস্ত। বাচ্চা হবার আগে বেড়ালছানা দুটো পার করতে হবে। নইলে মানুষের বাচ্চার অনিষ্ট হবে। কল্যাণ তার নিজের জীবনকে নিয়ে ভাবে। কোথাও কোথাও সে হুলোটার চেয়েও অসহায় পরাধীন। হুলোটি যতটা স্বাধীনভাবে রাধারানীর কাছে যেতে পারে, সে পারে না তার রাধারাণীর কাছে প্রত্যাখ্যানের দাপটে। তবু তার একটি আকাংখা, একটি মনোবেদনা প্রত্যাশা পূরণের সম্ভাবনার ছাপ রেখে যায় গল্পের শেষাংশে পৌঁছে।
মানব সমাজ এবং বিড়াল সমাজের একটা তুলনামূলক সংক্ষিপ্ত আচরণগত বিশ্লেষণ শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় সে সরস এবং সহজ দক্ষতার সাথে এঁকেছেন তাতে গল্পটি শেষ করার পরও আরো বহুক্ষণ গল্পের আমেজ পাঠকের মাথায় ঘুরপাক খায়। এই গল্পপাঠের সেই আনন্দটুকুই যথার্থ প্রাপ্তি।
No comments:
Post a Comment