পছন্দ ব্যাপারটা আপেক্ষিক, সবার ক্ষেত্রে সমান না। আমার আগ্রহ ছিল উপন্যাসকেন্দ্রিক। কারণটা পরিষ্কার। ছাত্রজীবনে হাতে বই কেনার টাকাপয়সা যথেষ্ট থাকতো না। তাই ঈদ সংখ্যায় একসাথে তিন থেকে পাঁচটা উপন্যাস পেয়ে যাওয়াটা ভাগ্যের ব্যাপার মনে হতো। আশির দশকে সাহিত্যের বাণিজ্যিকীকরণ শুরু হয়নি। নব্বইয়ের শেষ দিকে প্রযুক্তির প্রসারের সাথে সাথে সাহিত্যে বাণিজ্যে অনুপ্রবেশ ঘটতে শুরু করে এবং প্রবলভাবেই আক্রান্ত হয়। এটা সেই সময় যখন মিডিয়ার সাথে কর্পোরেট জগতের বাণিজ্যিক প্রেম যুক্ত হতে থাকে। সেই সময় থেকে ঈদসংখ্যায় উপন্যাসের সংখ্যা বাড়তে শুরু করলো, শব্দ সংখ্যা কমতে শুরু করলো, ফরমায়েশী লেখার তোড়ে সৃষ্টিশীলতা গেল ভেসে। একসময় ঈদ সংখ্যা কেনা বাদ দিতে হলো। বিখ্যাত লেখকদের অখাদ্য উপন্যাসে ঈদসংখ্যার ওজন বাড়লেও মন ভরানোর মতো বস্তুর খুব অভাব ছিল। দুয়েকটি ভালো লেখা ছাপা হচ্ছিল না তা নয়, পরিমানটা মোটেও আশাপ্রদ না।
অনেকদিন পর এবছর একটা ঈদ সংখ্যা কিনে ফেললাম সাহস করে। জনপ্রিয় পত্রিকা বাদ দিয়ে সাহিত্যপত্রিকার ঈদসংখ্যা কিনলাম একটু বেশী আশাবাদ নিয়ে। আমার সাম্প্রতিক পড়াশোনায় মনোযোগের অন্যতম কেন্দ্র ছোটগল্প। 'শব্দঘরে'র ঈদসংখ্যা ২০১৬ কিনেছি মূলতঃ ছোটগল্প পড়ার জন্য। এই সংখ্যায় বিশটির মতো ছোটগল্প আছে। তার মধ্যে প্রথমদিকে ধারাবাহিকভাবে কয়েকজনের গল্প নিয়ে পড়লাম। যে গল্পগুলো পড়েছি তা হলো-
থুতু - সেলিনা হোসেন
শৈত্যপ্রবাহ - ওয়াসি আহমেদ
মৈত্রেয়ী অথবা প্রার্থনার গল্প - হরিশংকর জলদাস
এক সন্ধ্যায় পরিদের বাড়িতে - দিলওয়ার হাসান
বৃষ্টি খুঁজে ফিরি - ওমর কায়সার
অবচেতনের সহোদরা - জাকির তালুকদার
ব্যালেন্স শিট - জুনাইদুল হক
খরা - ধ্রুব এষ
নদীও গড়ে - মনি হায়দার
উপেক্ষিত - জুলফিয়া ইসলাম
বিনামূল্যে বিতরণের জন্য - শাহনাজ মুন্নী
দুঃখের সাথে বলতে হচ্ছে অধিকাংশ গল্প আমাকে হতাশই করেছে। এতগুলো গল্পের আলোচনা লেখা খুব সহজ নয়। তাই আলোচনায় না গিয়ে খুব সংক্ষেপে গল্পগুলো পড়ে পাঠক হিসেবে আমার তাৎক্ষণিক ক্ষুদে মূল্যায়ন চেষ্টা। বলা বাহুল্য, এই কয়েকটি গল্প দিয়ে ওইসব লেখকের সামগ্রিক সাহিত্য মান বোঝা যাবে না। এই লেখকদের অন্য বেশ কিছু গল্প আছে আমার ভীষণ প্রিয়। আমি শুধু এই ঈদ সংখ্যায় ছাপানো গল্পের রেটিং নিয়ে বলছি আজ।
-সেলিনা হোসেনের 'থুতু' গল্পটিতে বড়লোকের শিক্ষিত কর্মহীন একটা ছেলেকে প্রায় আরোপিত সমস্যাগ্রস্থ করে নাটকীয়তা আনার চেষ্টা করা হয়েছে, যা শেষমেষ কোন পরিণতিই পায় না। গল্পটিতে লেখক তার নিজের প্রতি সুবিচার করেননি।
-ওয়াসি আহমেদের 'শৈত্য প্রবাহ' তাঁর অন্যন্য গল্পের মতো আশা জাগানিয়া না হলেও অবসরে যাওয়া একজন মানুষের মানসিক অবস্থানের বিবরণ নিয়ে মোটামুটি ভালো লিখেছেন।
-কিন্তু দিলওয়ার হাসানের 'এক সন্ধ্যায় পরিদের বাড়ি' গল্পটি বলার ধরণে উৎরে গেলেও প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে বেশ কয়েকটি জায়গায়।
-ওমর কায়সার 'বৃষ্টি খুঁজে ফিরি' গল্পটি আত্মকথনের ধরণে একটি ডায়েরীর অংশ বলে মেনে নেয়া গেলেও গল্প হিসেবে দুর্বল, বহুল চর্চিত একটি সস্তা প্লট।
-জাকির তালুকদারের 'অবচেতনের সহোদরা' গল্পটিকে চলনসই বলা যায় যেমন বলা যায় ধ্রুব এষ এর 'খরা' গল্পটির ক্ষেত্রেও।
-জুনাইদুল হক 'ব্যালেন্স শিট' গল্পটি মোটামুটি জমিয়ে ফেলেছিলেন, কিন্তু চরম পুরুষতান্ত্রিক শেষ লাইনটি দিয়ে গল্পটির লেজটাই কেটে দিলেন।
-মনি হায়দারের 'নদীও গড়ে' গল্পটির সুত্রপাত ভালো লাগলেও সম্পূর্ণ গল্পটি শেষ করার আসল বক্তব্য বুঝতে ব্যর্থ হয়েছি।
-জুলফিয়া ইসলামের 'উপেক্ষিত' গল্পটি লেখালেখির অপরিণত বয়সের চেষ্টা বলে মনে হয়েছে।
-শাহনাজ মুন্নীর 'বিনামূল্যে বিতরণের জন্য' গল্পটি গদ্য ভালো লাগলেও বক্তব্যটি খুব খেলো। সবচেয়ে বড় কথা বিশ্বাসযোগ্যতা ছিল না গল্পের ঘটনায়। যে সমস্যাকে সমস্যা হিসেবে উপস্থাপিত করেছেন তাকে পাঠকের পক্ষ থেকে কোন সমস্যা বলেই মনে হয়নি।
- একমাত্র হরিশংকর জলদাসের 'মৈত্রেয়ী অথবা প্রার্থনার গল্প' পড়ে একটা সম্পূর্ণ পাঠতৃপ্তি পেয়েছি। অনেকদিন পর প্রাণস্পর্শী একটি গল্প পড়লাম। গল্পটি দুই পিতার দুর্ভাগা দুই কন্যাকে নিয়ে। দুই পিতা সমান্তরাল জায়গায় দাঁড়িয়ে যে প্রবল মানবিক কষ্টের মধ্যে তাদের সময় পার করেছেন সেই চিত্রটি দক্ষতার সাথে আঁকতে পেরেছেন লেখক। পাঠক হিসেবে এই একটি গল্পেই আমি সন্তুষ্ট হতে পেরেছি। বাকী গল্পগুলো ঈদসংখ্যার দায়সারা ফরমায়েশী লেখা বলে মনে হয়েছে।
আমি জানি না পত্রিকায় লেখাজোকা ছাপানোর ক্ষেত্রে ভালো লেখকদের খারাপ গল্প বাদ দেবার ক্ষমতা কোন সম্পাদক রাখেন কিনা। সম্ভবত রাখেন না বলে প্রতিষ্ঠিত লেখকদের দায়সারা লেখায় ভরপুর থাকে এরকম বিশেষ সংখ্যাগুলো। তুলনামূলকভাবে নবীন লেখিয়েদের গল্পগুলো প্রতিষ্ঠিত লেখকদের চেয়ে ভালো হয়। অধিকাংশ বড় লেখক বিশেষ সংখ্যাগুলোতে ভালো লেখা দিতে পারেন না। কেন পারেন না? যতটুকু বুঝি সাহিত্য ব্যাপারটা ফরমায়েশ দিয়ে হয় না। প্রাণের তাগিদে, অনুভূতির বিস্তারে যে লেখা সম্পন্ন হয় তার সাথে টাইমটেবল বেঁধে, রুটিন মেপে, অনুরোধ রাখতে গিয়ে যে লেখা বের হয় তার তুলনা চলে না।
এই সমস্যাটা আগেও ছিল। কিন্তু এখন পত্রিকার সংখ্যা বেড়ে যাওয়াতে লেখার চাহিদা বেশী। সেলেব্রিটি লেখকদের একাধিক পত্রিকায় লেখার তাগিদ থাকে। পত্রিকার সম্পাদকেরা নতুন লেখককে স্থান দেবার চেয়ে প্রতিষ্ঠিত লেখকের গল্প উপন্যাস ছাপাতেই পছন্দ করেন। প্রতিটি পত্রিকার ঈদ সংখ্যায় দেখা যাবে দশ বারোজন প্রতিষ্ঠিত লেখকের লেখাই ঘুরে ফিরে প্রতি বছর থাকে। নতুন লেখকের দেখা মেলে না তেমন। সে গল্প হোক বা উপন্যাস হোক। ঈদ সংখ্যার লেখাগুলোই আবার একটু ঘষে মেজে পরবর্তীকালে বইমেলাতে প্রকাশিত হয়।
বছরের পর বছর ধরে চলা এই প্রক্রিয়ার মধ্যে সুসাহিত্যের গুনাগুন ভালোমন্দ একাকার হয়ে যাচ্ছে। দুয়েকজন ব্যতিক্রম বাদ দিয়ে অধিকাংশ লেখকই সাহিত্য বাণিজ্যের চক্রে আটকে গেছেন। ফলে আমরা সাধারণ পাঠকরা নতুন কিছু পাচ্ছি না। না গল্পে, না উপন্যাসে। যেন বছর বছর একই গল্পই লেখা হচ্ছে। রাজনীতিতে যেমন পুরোনো নেতার দাপটে তরুণ নেতার জায়গা হয় না, সাহিত্যেও কি সেই ব্যাপার চলে এসেছে? আমার জানা নেই।
একটি সাহিত্য পত্রিকা চালানো সহজ কথা নয়। ভালো লেখার সংকলন আরো কঠিন ব্যাপার। তবু এরকম শীর্ষস্থানীয় সাহিত্য পত্রিকার একটি বিশেষ সংখ্যায় মানসম্পন্ন গল্পের অভাব থাকাকে বাংলা ছোটগল্পের খরা হিসেবে চিহ্নিত করা যায়? নাকি লেখক সম্পাদকের বাণিজ্যিক মানসিকতার পরিপূরক চক্রটিকে দায়ী করা উচিত?
No comments:
Post a Comment