তাঁরা হলেন কাজী আনোয়ার হোসেন (জন্ম ১৯শে জুলাই ১৯৩৬) এবং হুমায়ূন আহমেদ (প্রয়াত ১৯শে জুলাই ২০১২)
কাজী আনোয়ার হোসেন সেবা প্রকাশনীর প্রতিষ্ঠাতা। এই প্রতিষ্ঠানটি রীতিমত একটি মহীরূহ। বাংলাদেশে বিশ্বখ্যাত বিদেশী সাহিত্যকে জনপ্রিয় এবং সহজলভ্য করার পেছনে সেবা প্রকাশনীর চেয়ে বেশী অবদান কারো নেই বলে জানি। যে আমলে ইন্টারনেট ছিল না, বিশ্বাসাহিত্য সম্পর্কে জানার সুযোগ সবার জন্য অবারিত ছিল না, এমনকি ঢাকা শহরের মধ্যেও যার পরিধি ছিল খুবই সীমিত, সেই সময়ে সেবা অনুদিত বিশ্ববিখ্যাত বইপত্র আমরা মফস্বলে বসেও স্বচ্ছন্দে পেয়ে যেতাম। এটা যে কী অসাধারণ একটা প্রাপ্তি ছিল সেটা বুঝতে হলে ওই সময়ের বাস্তবতায় না ভাবলে বোঝা অসম্ভব। আর অনুবাদের মান হিসেব করলে বলবো সেবার সমতূল্য অনুবাদ আমি উপমহাদেশের কোথাও পাইনি। শুধুমাত্র একটি অনুবাদের উদাহরণ দেই এখন। জেরোম কে জেরোমের 'থ্রি ম্যান ইন আ বোট' বইটির সেবা অনুবাদের নাম 'ত্রিরত্নের নৌবিহার'। অনুবাদ করেছিলেন এ.টি.এম শামশুজ্জামান। এই বইটি আমার পড়া এখনো পর্যন্ত সবচেয়ে সেরা রম্য বই, সেরা অনুবাদ। এই বইয়ের আরো দুই খানা অনুবাদ(দুই বাংলার) পড়ার সৌভাগ্য হলেও তাঁরা অনুবাদের সেবার কাছাকাছিও যেতে পারেননি।
কাজী আনোয়ার হোসেন সেবা প্রকাশনীতে বেশ কজন প্রতিভাবান তরুণ লেখক সৃষ্টি করেছিলেন যারা পরবর্তীতে নিজ নিজ ক্ষেত্রে সাহিত্যের জগত আলোকিত করেছেন। তাছাড়া ছাপাখানা জগতেও নতুন একটি বিপ্লবকে তিনি উপস্থাপিত করেছিলেন। নিউজপ্রিন্টে ছাপা পেপারব্যাক বই বাংলাদেশে এত ব্যাপকভাবে আর কেউ চালু করতে পারেনি। সেবা প্রকাশনীর সুলভে বই ছাপার এই প্রক্রিয়াটা যদি অন্য প্রকাশনীগুলোও অনুসরণ করতো তাহলে অনেক পাঠক সাশ্রয়ী মূল্যে বই কিনতে পারতো।
অন্যদিকে হুমায়ূন আহমেদের ব্যাপারে দুটো বাস্তবতা আমার চোখে পড়ে-
১. তিনি বাংলাদেশে বিশাল একটা পাঠক শ্রেণী তৈরী করেছেন, যারা কোনদিন বইপত্র পড়তো না, পড়লেও তা রোমেনা আফাজ কিংবা কাশেম বিন আবু বাকারের চটি বইয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতো। সেই পাঠককূলকে সুস্থ ধারার বই পাঠে আকৃষ্ট করেছেন।
২. তিনি সাহিত্যকে বাণিজ্যিকীকরণ করেছেন সফলভাবে। শুধুমাত্র লেখালেখিকে পেশা হিসেবে নেবার দুঃসাহস মনে হয় খুব বেশী লেখকের ছিল না। বই বিক্রির টাকায় স্বচ্ছলতম জীবনযাপন করার উদাহরণ সম্ভবত বাংলাদেশে এই একটিই। এটি ভালো হলো কি মন্দ হলো সেই বিচারে না গিয়ে বলা যায় বই লিখে আর্থিকভাবে সফল জীবনের কৃতিত্ব তাঁকে দেয়া যায়ই।
এই দুই কৃতিত্বের দাবীদার হুমায়ূন আহমেদের হলেও এটা বলতে হয় যে শংখনীল কারাগার বা নন্দিত নরকের মতো উপন্যাস খুব বেশী লেখেননি। তাঁর ছোটগল্পগুলোকে বরং অনেক বেশী উল্লেখযোগ্য সাহিত্যকর্ম বলা চলে। সাহিত্যের মান নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে, সমালোচনার অনেক বিষয় আশয় আছে। তবু তিনি যে সরস, সহজ গদ্য দিয়ে অসংখ্য পাঠকের মন জয় করেছিলেন সেই ভূমিকাটা অস্বীকার করা যায় না। সেই কারণেই তিনি সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য।
সবশেষে বলি, কাজী আনোয়ার হোসেন ও হুমায়ূন আহমেদের জন্ম না হলে হয়তো বাংলাদেশে অনেক পাঠক বইয়ের জগতে প্রবেশ করতো না। এবং বই জগতের দুই সেনাপতির এই কৃতিত্বটা স্বীকার করাই লেখাটির মূল উদ্দেশ্য।
No comments:
Post a Comment