.............
লিখেছেনঃ নুশেরা (তারিখঃ ৩১ জানুয়ারি ২০১৩, ৫:২৮ পূর্বাহ্ন)
।।সতের।।
চারপাশ থেকে কিছু মানুষ মাঝেমাঝেই নেই হয়ে যাচ্ছে। চিরতরে।
আইছ একা যাইবা একা সঙ্গে কিছু যাবে না- মরমী বাণীটি মনে হয় পুরোপুরি সত্যি না।
মানুষ চলে যায়; সঙ্গে নিয়ে যায় তার সমস্ত সম্ভাবনা, আশা-ভালবাসা; মহত্তম আকাঙ্ক্ষা, স্নায়ুক্ষয়ী আশঙ্কা... নিজস্ব পৃথিবীর সবটুকু গ্লানি, গহনতম বেদনা... যাবতীয় প্রাপ্তির তৃপ্তি, অপ্রাপ্তির হাহাকার... উপচে পড়া আশীর্বাদ, উথলানো স্মৃতিকাতরতা, উগরানো অভিশাপ... কত সত্য কত মিথ্যা, কত প্রতিশ্রুতি কত ভান কত অপেক্ষা কত স্বপ্নসাধ...
অন্তর্গত অনুভূতির সমুদয় প্রকরণ সঙ্গে নিয়েই তো বিদায়ের পথ ধরে মানুষ!
বিভূতিভূষণের অপুর আকাঙ্ক্ষাময় কল্পনাজুড়ে রাজত্ব করেছিল রেলগাড়ির চলাচল; দুর্গা চেয়েছিল সবার ভাল থাকা আর অপুর মাষ্টারমশাইকে...
বইয়ের পাতার ভাঁজে কার যেন স্বপ্ন ছিল একদিন পাহাড় দেখা হবে তার, কারও স্বপ্নসাধের ইন্দ্রজালে সমুদ্রের ফেনাতোলা জলরাশি।
একবার একজনের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল- যার ইচ্ছে ছিল জীবনানন্দের ষোলটি কবিতা ইংরেজিতে অনুবাদের। মাত্র তিনটির কাজ শেষ করেছিলেন, তারপর অনেকগুলো বছর ধরে যে জীবন তিনি যাপন করে আসছেন তাতে ওটুকু ইচ্ছের পূরণ আর সম্ভব হয়নি, কোনদিন হবে এমন কোন সম্ভাবনাও দেখেন না; তবু খাতাটি নাকি লুকিয়ে রেখেছেন খুব যত্নে- যত্নে এবং সাবধানেও- কেউ যেন কোনদিন খুঁজে না পায়!
ঘুমিয়ে কখনও দেখিনি, ঘুমঘোরেও না; শুধু কল্পনায় এই স্বপ্নটা মাঝেমাঝে দেখি। নিতান্ত হাস্যকর ছেলেমানুষি। আমার একটা ক্যাফে হবে। ছোট্ট একটা ক্যাফে। দুপুরবেলায় কেউ থাকবে না ভেতরে, তবে দিনরাতের সবটুকু সময় এর দরজা খোলা থাকবে।
একটা পুরনো বাতিঘরের ধারে আঙুরলতায় ছাওয়া ঘন সবুজ পাহাড়; সেই পাহাড়ের পাথুরে ঢাল সোজা নেমে গেছে সোনালী বালির সৈকতে; ঝকঝকে ফেনা মাথায় বয়ে আনা নীলচে সবুজ ঢেউ আসছে, একের পর এক, আছড়ে পড়ছে বড় বড় পাথরের চাঁইতে। ওরকম একটা পাহাড়ের শেষ প্রান্তে থাকবে ছোট্ট ক্যাফেটা; কাঠের মেঝে- টালির ছাদ- কাচের জানলা- অল্প কটা বেতের চেয়ার। তন্দুরের গর্ভে ফুলেফেঁপে উঠবে মাখনগন্ধী কুকি, ফুলকাটা আনারসফালিতে চিনিপোড়া গন্ধ মাখামাখি হবে পাইনঅ্যাপল কেকের তলায়। ক্রিমের ফেনা উঠবে কফির কাপে, কেতলির জলে আদাএলাচ ফুটবে লেবুচায়ের অপেক্ষায়। হঠাৎ কোন রোদসম্ভাবী ভোরে আসে যদি কোন প্রিয়বাঞ্ছিত আগন্তুক; চাইলে গরমাগরম মুচমুচে পরোটাভাজিও জুটবে তার!
রাত গভীর হলে ঝুলবারান্দায় জেগে বসে থাকব- সামনে সমুদ্র, ডানে পাহাড়, আর বাঁয়ে শূন্যতা নিয়ে- আঁধারে চেয়ে বসে থাকবে তিনজন- আমি, আমার একাকীত্ব, আর অপেক্ষা (বাহ্, সবাই স্বরবর্ণে শুরু!)...
হয়ত মনে পড়বে গুলজারকে, নিজের মতো করে-
a few of my belongings
are still in your possession
a few wet days of monsoon
a night wrapped in a letter
return to me what is mine...
a few autumns
the sound of falling leaves
return to me what is mine...
once under a single umbrella
both of us were half wet and half dry
the dry half I had brought along
the wet part , perhaps , is still lying by the bed
send it across...
a hundred and sixteen moonlit nights
the lone mole on your shoulder
the aroma of still-moist henna
a few complaints that were forged
a few false promises too
let me remind you of them all...
send them all back to me
return to me what is mine...
but grant me this one last wish
that when I bury these memories
may I bury myself there too...
একদিন, একদিন না একদিন, এমন একটা জীবনে চলে যাব ঠিকঠিক!
অর্থ নয়, কীর্তি নয়... কত তুচ্ছ, কত অর্থহীন স্বপ্নসাধের খড়কুটো, কত যত্নেই না আগলে রাখে মানুষ!
ডিসেম্বর ২০১১
-------------------------------
।।ষোল।।
কোন কোন দিন কম্পিউটারের স্ক্রিনে হাত বুলিয়ে বৃষ্টি ছোঁয়া যায়!
অন্তহীন অনিঃশেষ বরষা নামুক চরাচর জুড়ে, জানালার ধারের পয়জন আইভির ঝাড়টা কোন জাদুবলে সন্ধ্যামালতী হয়ে যাক, টালির ছাদের সোলার প্যানেলটা ঢেউটিনের চালা হয়ে টেনে আনুক অযুতনিযুত অলৌকিক বর্শাফলা, ফায়ার হাইড্র্যান্টের বদলে উঠোনের একপাশে একাকী ভিজুক জংধরা চাপকল, ভিজতে ভিজতে চুপসে যাক নারকেলের ছাড়ানো খোসা, ছিঁড়ে যাক কাগজের এরোপ্লেন... য়ো কাগজ কি কাশতি য়ো বারিষ কা পানি...........
এপ্রিল ২০০৯
-------------------------------
।।পনের।।
চুড়ির শব্দটা খুব ছন্দময়, নূপুরেরও...
তারপরও সবচেয়ে আদুরে বাজনা হলো টলমল পায়ে সদ্য-হাঁটতে-শেখা শিশুর হাতের ঝুমঝুমি।
ছোট্ট গোল টিপ আমার পছন্দ...
পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর টিপটাও পরে অনূর্ধ্ব এক-এর শিশু, কপালের একপাশে মায়ের আঙুলডগার কাজলছোপে।
জানুয়ারি ২০১৩
-------------------------------
।।চৌদ্দ।।
"কত চিঠি লেখে লোকে
কত সুখে প্রেমে আবেগে স্মৃতিতে
কত দুঃখে ও শোকে..."
স্বার্থে-টা বাদ গেছে, হে সুকান্ত!
মে ২০১২
-------------------------------
।।তেরো।।
বসন্তদিন এল বাংলাদেশে, এখানে নয়
আমি অপেক্ষা করব
আমি অপেক্ষা করব
আমি অপেক্ষা করব
আ মি অ পে ক্ষা ক র ব
আ মি অ পে ক্ষা ক র ব
আ মি অ পে ক্ষা ক র ব
আ মি অ পে ক্ষা ক র ব
আ মি অ পে ক্ষা ক র ব
-------------------------------
।।বারো।।
পৃথিবীর অনেক দেশেইতো হিজাব/নিকাব/বোরকা জাতীয় পোশাক পরতে হয়, সেসব দেশে কি হিজাব/নিকাব/বোরকা না পরার স্বাধীনতা আছে? আরো পরিস্কার করে বলি, একটা ইসলামী শাসনতান্ত্রিক দেশে (কারেন্ট স্ট্যান্ডার্ড না, আদর্শ ইসলামী অনুশাসন বলি) কোন অমুসলিম বা মুসলিম নারীর কি হিজাব/নিকাব/বোরকা না পরার অধিকার থাকবে? উত্তর হ্যাঁ বা না হবে।
সহব্লগার রোবোট বরাবরই গোছানো যুক্তিতে কথা বলেন। যারা বলেন- নারীরা হিজাব স্বেচ্ছায় পরে, কেউ চাপিয়ে দেয় না- তারা এই প্রশ্নের জবাব এড়িয়ে যান। মেলবোর্নে চারজন ইরানী তরুণীর সঙ্গে সখ্য ছিল; সবাই উচ্চশিক্ষারত মেধাবী মুসলমান; প্রত্যেকের একই গল্প- শেষবার বোরকা/হিজাব পরেছিল প্লেনে ওঠার সময়। একাকী চলাফেরায় নিয়ন্ত্রণারোপ, গাড়ি চালানোতে নিষেধাজ্ঞা আর পোশাকের ওপর খবরদারির কারণে দেশে ফিরে যেতে চাইত না তাদের কেউই; একজন একটি অস্ট্রেলিয়ান ক্রিশ্চান ছেলেকে বিয়েও করে ফেলে, বাকিরাও পাত্র খুঁজছিল...
--------------------------------
।।এগারো।।
যুদ্ধাপরাধী ও তাদের দোসরমুক্ত দেশ হোক আমাদের।
জয়তু প্রজন্ম চত্বর!
ব্লগার হিসেবে গর্বিত।
ফেব্রুয়ারি ২০১৩
----------------------------------
।।দশ।।
বাচ্চু রাজাকার ওরফে মাওলানা আবুল কালাম আজাদের ফাঁসির আদেশ হলো। "বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ" পরিচয়ে এটিএন বাংলা আর এনটিভিতে বহুদিন বয়ান করেছে এই বরাহ; তার মুখে বিসমিল্লাহ্ বলা ছাড়া তৈরি খাবারের বিপদ শুনে পুজোর সময় প্রতিবেশির বাড়ি থকে আসা নাড়ুসন্দেশের থালা উল্টে ভাগাড়ে ফেলার বেদনাদায়ক দৃশ্যটি মনে পড়ে গেল।
সাপ মেরে ফেলা যায়; বিষ রয়ে যায়।
জানুয়ারি ২০১৩
----------------------------------
।।নয়।।
আজকের প্রথম আলোর প্রথম পাতা জুড়ে সুসংবাদ। মাতৃত্বকালীন ছুটি বাড়িয়ে ছয়মাস করা হয়েছে, নারীবান্ধব-শিশুবান্ধব রাষ্ট্র আমাদের। নারীমঞ্চ পাতা আলো করে আছেন বিরাশি বছরেও বেগমের সম্পাদক নূরজাহান বেগম। কমবেশি সব পাতাতেই নারীর ক্ষমতায়নের নবতর নজির সৃষ্টির অপেক্ষায় পৌর নির্বাচনের বহু মহিলা প্রার্থী। এতোসবের মধ্যে বিশাল বাংলা পাতার ঝাপসামতো ছবিটি। কীর্তনখোলা নদীতে খেয়া পারাপার করছেন এক নারী; এক হাত ধরেছে বৈঠা, আরেক হাত আগলে আছে কাঁথামোড়ানো মানবশিশু। ছবি দেখে অনুমান করা সহজ, শিশুটির বয়স বড়জোর দুতিন মাস। ছবিটি সকালবেলায় তোলা; গতকাল দক্ষিণাঞ্চলে ঘন কুয়াশার জন্য বেলা এগারোটা পর্যন্ত ফেরি চলাচল বন্ধ থাকার খবরও কাগজের অন্যত্র আছে। সর্বনিম্ন তাপমাত্রা গেছে ৬.৩'সে.।
ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গলে ঈশ্বরী পাটনী খেয়ানৌকায় পা-রাখার অংশের কাঠ সোনা হয়ে যেতে বুঝেছিলেন, দেবী এসেছেন যাত্রী হয়ে। দেবীর কাছে বর চেয়েছিলেন- আমার সন্তান যেন থাকে দুধেভাতে। খেয়াঘাটের পাটনীর পেশা যার, সেই ঈশ্বরী পাটনী নারী নাকি পুরুষ-- একথা স্পষ্ট করে বলেনি অন্নদামঙ্গল। আমার ব্যক্তিগত ধারণায় তিনি নারী। ধনসম্পদ-বিত্তবৈভব কিছুই না, সন্তানের সুখময় জীবনযাপনের অতিরিক্ত কোন চাহিদা যার নেই, তিনি জননী ছাড়া আর কে হতে পারেন!
নিরাপদ কর্মক্ষেত্র অথবা মাতৃত্বকালীন ছুটির আওতা থেকে বহু বহু দূরের, বরিশালের কীর্তনখোলা নদীর রসুলপুর খেয়াঘাটের সেই ঈশ্বরী পাটনীর প্রতি আমার আভূমি প্রণাম।
ডিসেম্বর ২০১০
----------------------------------
।।আট।।
দেবব্রতের মেইল পেলাম, উত্তর দেয়া হলো না ওকে আপনি না তুমি কোনটা বলতাম মনে পড়ল না বলে। কী অদ্ভুত, একসময়ের সহকর্মী নিজেও ভাববাচ্যে ঝামেলা মিটিয়েছে! "নাটোরের প্রসঙ্গ এলে সবার আগে কী মনে পড়ে?"- এমন প্রশ্নের জবাবে "জীবনানন্দ" বলে একদিন দেবব্রতকে খুব হাসিয়েছিলাম। ওর ধারণা, চোখ বুজে থাকলে বনলতা সেন, আর চোখ খুলে থাকলে এলাচগন্ধী কাঁচাগোল্লা! এ বিষয়ে নাটোরের ছেলে যাই বলুক, মেনে নেয়া দস্তুর।
জীবনানন্দের কবিতায় তাঁর নিজের জেলা বরিশালের নাম কি এসেছে কখনও? মনে করতে পারছি না।
সেই মুখ মনে পড়ে, সেই গান,
সেই সন্ধ্যাতারা
এখন নেমেছে মেঘ, এখন বর্ষার জলধারা
মনে হয় ফিরে যাই সেই নদী আকাশের কাছে
হয়তো এখনো কেউ গান গায়, কেউ বসে আছে
কি যেন সে তার নাম, সেও তা হয়েছে কতকাল
জীবনানন্দের বাড়ি, মন বলে যাই বরিশাল।
পুরনো ডায়রির পাতা খুলে দেখি পেপার-কাটিং সাঁটা; মহাদেব সাহার মতো আমারও মন বলছে- যাই বরিশাল...
জুন ২০১০
----------------------------
।।সাত।।
শাশ্বত স্বপনের ফিরতি মন্তব্য পড়ে মনটা খারাপ হলো... হয়তো সরল মনেই লেখা ছাপানোর কথা বলেছিলেন, রুড প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে ফেলেছি... নার্ভ ধরে রাখা শেখার এখনও অনেক বাকি... চতুরের পাতায় অচেনা প্রকাশক, ঢাকা-চাটগাঁর জনাদুতিনেক... তাঁদের জানার কথা না, এ ধরনের কথা শোনার পূর্ব-অভিজ্ঞতা কেমন হতে পারে... উৎসাহও এখন আর নিঃস্বার্থ নয়; আজ যিনি বিপুল উদারতায় কোন আনপড়কে অনুপ্রেরণা দিয়ে মুদ্রণমাধ্যমের জন্য লিখতে বলেন, দুদিন পর তাঁর মুখে শোনা যায় "লেখালেখির জগতে ঢোকার" জন্য সেই আনপড় তাঁর কত ক্ষয়ক্ষতি করেছে...
লাভলোকসানের হিসাব আমার তোলা থাক জন্মের মতো, অন্তহীন চক্রবৃদ্ধি মুনাফায় থাকুক সবাই............
জানুয়ারি ২০১৩
------------------------------
।।ছয়।।
- আমি একটা লেমোনেড স্ট্যান্ড দিতে চাই, কন্যার মুখ গম্ভীর।
ওর আশাআকাঙ্ক্ষাগুলো বিচিত্র। বিশাল বড় একটা ফুলের মাঝখানে সে শুয়ে আছে, সেই ফুলটা আবার দুটো পাতার ডানা মেলে মেঘের মধ্য দিয়ে উড়ে যাচ্ছে - এমন একটা কর্মপরিকল্পনা তার আছে। ফুলছাপের ওয়াড়ের বালিশের ওপর শুয়ে-বসে এই উড্ডয়নকর্মের প্র্যাকটিস চলে প্রতি রাতে, ঘুম না আসা পর্যন্ত। সমুদ্রের ঢেউয়ের মধ্যে মারমেইড হয়ে ভেসে বেড়ানো আরেকটা ইচ্ছে। একদম বিপরীত মেরুতে দমকলবাহিনীর ফায়ারট্রাক, রাস্তাঘাটে দেখা বুলডোজার- ক্রেনের মতো বিটকেল বাহনের চালক হবার বাসনাও আছে। এই তালিকায় নবতম সংযোজন ঠেলাগাড়িতে শরবতের দোকানদারি। শিশুদের "না" বলায় মানা আছে।
- ঠিক আছে, দেবে। বাইরে একফুট স্নো, এটা গলে যাক, সামার আসুক, তারপর। আচ্ছা এখন ধর, এষা আর আয়লা তোমার কাছ থেকে একগ্লাস করে লেমোনেড নিল। প্রতিগ্লাসের দাম এক টাকা। তোমাকে এষা দিল একটাকা আর আয়লা দিল একটাকা। তাহলে তোমার কত টাকা হবে?
- ওদেরকে আমি ফ্রি খেতে দেব, টাকা নেব না (ফ্রি ব্যাপারটা সে সদ্য শিখেছে; গোনাগুন্তির হিসাব তার প্রায় আসেই না)
- ও। তা কোথায় হবে তোমার লেমোনেড স্ট্যান্ড?
- বাসার পিছনে, গাছের নীচে ঘাসের উপর।
- ওখানে তো কেউ যায় না, কে খাবে শরবত!
- ওখানে পাখিরা আসে। কাঠবিড়ালিও আসবে।
- আহা, ওরা তোমার স্ট্যান্ড নোংরা করে দেবে। তুমি বরং এক কাজ করো... নদীর ধারে, অথবা সিটি সেন্টারের সামনে ফুটপাথে, অথবা স্কুল বা মিউজিয়ামের সামনে এমন একটা জায়গায় স্ট্যান্ড দাও, যেখানে মানুষ আসা-যাওয়া করবে। তোমার স্ট্যান্ড দেখে ওরা আসবে, লেমোনেড খাবে, তারপর তোমাকে লেমোনেডের দাম দিয়ে যাবে। ব্যাকইয়ার্ডে দোকান দিলে কেউ আসবে না!
- না, অন্য কোথাও যাব না। আমি স্ট্যান্ড দিতে চাই আমার প্রিয় জায়গায়। শুধু এই জায়গাটাই আমার পছন্দের।
ফেব্রুয়ারি ২০১৩
------------------------------
।।পাঁচ।।
রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের "কাদম্বরী দেবীর সুইসাইড নোট" উপন্যাসটি খুব জনপ্রিয়তা পেয়েছে; বিপণনের এমন যুগে কেউ পিছিয়ে নেই; কলকাতার বাংলা টিভি চ্যানেলে নিজের বইটি হাতে নিয়ে গর্বিত ভঙ্গিতে বিজ্ঞাপনের মডেল হিসেবে লেখক নিজেই জানাচ্ছেন- মাত্র চার মাসে (নাকি সপ্তাহে?) প্রকাশিত হলো সাতটি সংস্করণ...
বইটি তেমন "না চললে" বিজ্ঞাপনের ভাষা কেমন হতো? লেখক কি এমন কিছু বলতেন- গভীরতাসম্পন্ন লেখার পাঠক খুব বেশি নেই। আপনি কি সেরকম পাঠক? তাহলে পড়ুন আমার সাম্প্রতিক বই...
অক্টোবর ২০১২
------------------------------
।।চার।।
জলবৎ তরলং, পানির মতো সোজা, জলের মতো সহজ- কথায় কথায় কতবার বলি! আসলেই কি খুব সহজ-সরল এই জল বস্তুটি? মনে হয় না। পানি একটা বহুরূপী। ঠাণ্ডায় জমবে, গরমে ভাপ হয়ে উড়ে যাবে। পিপাসার কষ্ট মেটাবে, আবার বন্যায় ডোবাবে। চিনি মেশালে মিষ্টি হবে, লবণ দিলে নোনতা, বিষ ঢাললে বিষ। যে পাত্রে রাখা হবে তার রঙ দেখাবে, আকার নেবে। বহুরূপী মাত্রেই মহা জটিল, সহজ-সরল না।
চেনাজানা জগৎসংসারে আপাতসরলতার ট্রেডমার্ক এঁটে-থাকা মানুষজন আসলে পানির মতোই সহজ!
জুন ২০১১
------------------------------
।।তিন।।
যে কোন বই হাতে নিয়ে শুরুতে ফ্ল্যাপের লেখা পড়া হয়, পাশাপাশি উৎসর্গপত্রটিও একনজর দেখা হয়। খুব বেশি বৈচিত্র্য থাকে না তাতে। লেখকের পরিবারের সদস্য, বন্ধুবান্ধব অথবা অগ্রজ বা সমসাময়িক কোনো সতীর্থের নাম থাকে, বড়জোর একটা-দুটো আন্তরিক বাক্যের বরাদ্দ। কবি আহসান হাবীবের ‘প্রেমের কবিতা’ বইটির উৎসর্গপত্র সেদিক থেকে দারুণ ব্যতিক্রমী ও আকর্ষণীয়-
সুলেখা বন্দ্যোপাধ্যায় সুচরিতাসু
চল্লিশের দশকে আপনি থাকতেন হাজরা রোডে। এখন কোথায় জানা নেই। রসা রোডের দিকে এগিয়ে এলে ডান দিকের একতলা সাদা বাড়িটায় টুনুরাও থাকতো, মনে পড়ে? যদি ওর সঙ্গে দেখা হয়, বলবেন, আমি এই বইটি ওর নামেই উৎসর্গ করেছি। আর আপনি যদি মনে করেন, একটু ঘুরিয়ে এই বই আমি আপনারই নামে উৎসর্গ করছি, ভালো লাগবে তাও। তবে রিচি রোডে এসবের কিছুই জানবেন না, জবাবদিহি করে হয়রান হয়ে যাবো। আপনার ছোট বোন শ্রীলেখাকে কিছু বলবেন কি বলবেন না সে ভাবনা আপনার। আর আমার স্ত্রীকে যা বলবার আমিই বুঝিয়ে বলবো। অবশ্য এত কথা যখন উঠেছেই তখন, কৈশোরের জোবেদা, নূরজাহান, রমলা, আর প্রথম যৌবনের সেই সরুচেন শ্যামলাঘাড়, আরো সেই যে কলেজের পথে প্রায় নিত্যসঙ্গী নাম না জানা শ্যামাঙ্গিনী এরাই বা--- আসলে কি জানেন? এই উৎসর্গ-ফুৎসর্গের ব্যাপারে যাওয়াই উচিৎ হয় নি।
আহসান হাবীব
মাঘ। ১৩৮৭
জুন ১৯৯৯
-----------------------------
।।দুই।।
ভোর থেকে তীব্র বাতাসের চাবুক, উড়িয়ে আনছে অযুতনিযুত তুষারকণা ... ... ...
একসময় আমাদের চট্টগ্রামের বাসায় দেখতাম টিলার ওপর পুরনো গাছের গুঁড়ি থেকে সন্ধ্যে নামার সঙ্গে সঙ্গে শতসহস্র উইপোকা বেরিয়ে আসছে। বছরে দুবার নিয়ম করে ঘটত এই অদ্ভুত ঘটনাটি, প্রতি শীতের আগে-পরে দু্টো দিন সূর্যাস্তের পর পর। সূক্ষ্ম পাখায় বিজবিজ শব্দ আর অবিরাম কাঁপন তুলে কাছাকাছি স্ট্রিট লাইট অথবা বাসার ভেতরের কোন আলোর উৎসের দিকে ধেয়ে যেত উইপোকার ঝাঁক, তাদের স্বচ্ছ পাখায় ঝিকমিকিয়ে উঠত বিদ্যুতের আলো... কিছুক্ষণের মধ্যে সবগুলো পোকার পাখা ঝরে যেত ঝরঝরিয়ে, ঝরা পাতার মতো...
স্নো শাওয়ার অথবা ফ্লারিজ নামের এই ইলশেগুঁড়ি তুষারপাতের সঙ্গে সেই উইয়ের ঝাঁক অথবা বছরের প্রথম ঝিরিঝিরি বৃষ্টির কোথায় যেন মিল আছে... শুরু হতে দেখলেও ছুটে পালাতে ইচ্ছে করে না... গায়ে মেখে ঘোরাঘুরির সময়টা পেরিয়ে গেলেও ঝেড়ে ফেলতে ইচ্ছে করে না...
জানুয়ারি ২০১৩
-----------------------------
।।এক।।
সুমনের একটা গান আছে- রোদ্দুর। রোদের মতো প্রতিদিনের চেনাজানা প্রাকৃতিক অনুষঙ্গকে খুব একটা মনোযোগ দিয়ে খেয়াল করা হয় না। এই রোদ্দুর যে গাছের আড়ালে বাঘের মতো ওঁৎপেতে থাকে, কিংবা সবুজের ফাঁকে ফাঁকে হরিণের মতো ছোটে; এর রঙ যে সোনালী-বাদামী মেশা হতে পারে, অথবা জংলা গন্ধে হারিয়ে যাবার নেশা ধরাতে পারে; এতরকম বিশেষণে ভূষিত হতে পারে এই দিগ্বিজয়ী বিদ্রোহী রোদ্দুর- গানটা শোনার আগে তেমন করে ভাবিনি!
প্রচলিত বাংলা গানে দারুণ দহন দিন আছে, আছে শরতের আকাশ; হেমন্তের হিমঝরা রাত, পৌষের ফসলডালা। বসন্তের নতুন পাতা আর পলাশশিমুল থেকে জোছনা রাত, দখিনা বাতাস, মেঘমেদুর বর্ষাবন্দনা- সবই কমবেশি আছে; সে তুলনায় রোদমুগ্ধতা প্রায় অনুপস্থিত; অন্তত সুমনের গানটির আগে শোনা হয়নি। ঘোর বর্ষা কি শৈত্যপ্রবাহের আঙুলে-গোণা ক'টা দিন বাদ দিলে আমাদের দেশে সারাবছর রোদের দেখা মেলে, না চাইতেই। তাই কি এর মর্ম কিংবা সৌন্দর্য নিয়ে আমরা ভাবি কম?
বিপরীতে পশ্চিমের গানে রোদের তুমুল জয়গান; রোদ মেটায় সৌন্দর্যতৃষ্ণা, যোগান দেয় নির্ভরতা থেকে আনন্দাশ্রু- সবকিছুরই। সানশাইন অন মাই শোল্ডার্স গানে জন ডেনভার জানিয়ে দেন- প্রিয় মানুষটিকে বলার কোন গল্প থাকলে নিশ্চয়ই তা হবে আনন্দের; তার জন্য কিছু চাইবার থাকলে অবশ্যই তা হবে সার্বক্ষণিক রৌদ্রকরোজ্জ্বলতা। পশ্চিমের জলহাওয়ায় দীর্ঘমেয়াদী হিমশীতলতা আর একাকীত্ব একাকার হয়ে আছে বিটলসের গানে- লিটল ডার্লিং, ইটস বিন আ লং কোল্ড লোনলি উইন্টার। রোদ এলেই সবকিছু বদলে যাবে এক লহমায়- হিয়ার কামস দ্য সান, অ্যান্ড আই সে ইটস অল রাইট! বিচ্ছেদযন্ত্রণার তীব্রতার তুলনা চলে কেবল রোদ হারিয়ে ফেলার সঙ্গেই- এমনটা বুঝিয়ে দেয় শঙ্কিত সকাতর আকুতি- ডোন্ট টেইক মাই সানশাইন অ্যাওয়ে...
জীবনযাপনের বাস্তবতায় নাগরিক বর্ষার অভিজ্ঞতা যেমনই হোক, আমাদের বাঙালি-হৃদয়ের অন্তরতম যোগাযোগ সম্ভবত বর্ষা কিংবা বৃষ্টির সঙ্গেই- অন্তত গানের লিরিকের সূত্রে। যে কথা এ জীবনে রহিয়া গেল মনে, সে-কথাটি বলা যায় শুধু ঘনঘোর বরিষার এমন কোন দিনে- রবীন্দ্রনাথ যথাযথ বাতলে গিয়েছেন। তুমি এলে অনেক দিনের পরে যেন বৃষ্টি এল- হেমন্তের গান কবুল করছে কতজনের মনের কথা!
আর যদি না-ই বা এল কেউ, একাকীত্বের হাহাকারটুকুও বড় বেশি বাজে তেমন কোন দিনেই- বঁধু এমন বাদলে তুমি কোথা, আজ পড়িছে মনে কত কথা (অতুলপ্রসাদ)... অথবা এমনই বরষা ছিল সেদিন (প্রণব রায়- কমল দাশগুপ্ত), কিংবা এ ঘোর বাদলে নারি থাকিতে একা (নজরুল)।
শুধু কি ভরা বর্ষা, কালো মেঘের ছায়া ঘনিয়ে এলেও বড় একা লাগে এই আঁধারে, মেঘের খেলা আকাশ পারে (মান্না দে)।
তুষারপাত নিয়ে বাংলা গান নেই, অন্তত আমার জানা নেই। বর্ষাকাতর-স্মৃতিকাতর প্রবাসে, চরাচরজুড়ে তুষারজমা আঁধারঘোলা নিশূন্য একাকী দিনে, নজরুল বেজে ওঠেন বড় বেদনার মতো, পরদেশী মেঘের কাছে রাখা প্রশ্নে- সে দেশে যবে বাদল ঝরে, কাঁদে না কি প্রাণ কাহারো তরে?.............
ডিসেম্বর ২০১১
.
.
.
========================================================
অনেকদিন ব্লগ লেখা হয় না, আসলে কিছু লিখতেই ইচ্ছে করে না...
নোটপ্যাডে মাঝেমধ্যে ডায়রি লেখা হয়- (ঠিক দিনপঞ্জী-গোছের কিছু না, এসব হাবিজাবি কেন লিখি তার কারণটাও খুব স্পষ্ট না; সম্ভবত কথাগুলো কাউকে বলতে ইচ্ছে করে অথচ শোনার মতো কেউ নেই!)- ওখান থেকে সামান্য সম্পাদিত কিছু কপিপেস্ট এই পোস্টে যতদিন সম্ভব চালিয়ে যাবার ইচ্ছে রইল...>
যা দিনকাল পড়েছে, অকারণ স্নেহমমতার দেখা পাওয়া মুশকিল; তাছাড়া আমি যে প্রজন্মের একজন তাতে স্নেহ বর্ষানোর মতো খুব বেশি কেউ ব্লগে অন্তত নেই। যে দুচারজন আছেন; কেন যেন মনে হয়, কদিন পর পর এই তুচ্ছ পাতাটি তারা দেখে যান... ... তাদের একজনের জন্যই এই পোস্ট (কার কথা ভাবলাম, কে বলতে পারবেন? )।