Saturday, June 28, 2014

সুসংবাদ নেই

নিয়ত দুঃসংবাদ
প্রতিদিন দুঃসংবাদ। ঘুম ভাঙ্গে দুঃসংবাদ শুনে। ঘুমোতে যাই দুঃসংবাদ শুনে। একদিন নিজেও হয়ে যাবো দুঃসংবাদের অংশ। আশংকা নয়, সম্ভাবনা নয়, অনিবার্য পরিণতি। কোন স্বজন বন্ধুর আটকানো নিঃশ্বাস হাসপাতালে জমা রেখেই আমরা বুক ভর্তি হাওয়া গিলে ঘুরে বেড়াই। কাজ করি, আড্ডা দেই, বিশ্বকাপ দেখি, খাই, ঘুমাই। একই সময়ে কেউ কেউ নির্ঘুম রাত পার করে। এক ফোঁটা বাতাসের জন্য কারো কান্না ভেসে বেড়ায় পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে। অথচ আমার চোখ জুড়ে তখন জানোয়ারের মতো বিশুদ্ধ নিঃশ্বাসে নির্লজ্জ ঘুম ভেঙ্গে আসে।

শৃংখলবৃদ্ধি
দু হাতে শেকল পরানো ছিল বহুকাল। শেকল ছেঁড়ার শক্তি ছিল না। নিয়তির শৃংখল অথবা শৃংখলিত নিয়তি মেনে নিয়েও কাটছিল সময়। হাত বন্ধ থাকলেও হাঁটা বন্ধ হয়নি। হাঁটতে পারতাম যখন খুশী। চোখ মেলে তাকাতে পারি আকাশ অথবা সবুজে। একদিন সবুজের ঘ্রাণ পেয়েছিলাম। সজীব সময়। এরপর অবসর হতো সবুজের কাছে যাবার। সবুজের মুগ্ধতা ভুলিয়ে দিয়েছিল শৃংখলের যন্ত্রণা। অতঃপর নজরে পড়ে গেলাম অসময়ের। একদিন অসময় এসে শৃংখল পরিয়ে দিল দু'পায়েও। 

মগডাল
গাছটার একদম মগডালে ওঠার পর অবাক হয়ে ভাবছিল কিভাবে এত বিশাল একটা বৃক্ষের চুড়াশীর্ষ স্পর্শ করলো। সেই কবে গাছে উঠেছিল মনেই নেই। তাই এই শীর্ষারোহন তাকে বিশেষ তৃপ্তি দিল। শীর্ষে বসে সে অনুমান করার চেষ্টা করছে গাছটার উচ্চতা কত হতে পারে। একটা চারতলা দালানের চেয়েও বেশী হবে। কটা ডাল পার হয়ে আসলো? বিশটা তো হবেই। গাছের বাকলের রঙ কি, পাতাগুলো কতটা সবুজ। এই সবুজের আড়ালে বসে থাকতে কতটা ভালো লাগা। বাতাসে গা জুড়িয়ে যাচ্ছে। যত উপরে তত বেশী বাতাস। সে দুহাত মেলে বাতাস ছুঁয়ে দিতে চাইল। উঠে আসার আনন্দটা দ্বিগুন হয়ে ভর করলো যেন। ...........তারপর সর্বশেষ ডালের শীর্ষে দাঁড়িয়ে সে পাতার ফাঁক দিয়ে তাকাবার চেষ্টা করলো শেকড়ের দিকে....ঐ তো ওখান দিয়ে উঠে এসেছিলাম আমি। তাকানোই হলো ভুল, অপরিণামদর্শী এক ভুল। পা হড়কে ধপাস করে পড়ে গেল নীচে। ডালের সাথে বাড়ি খেতে খেতে, পাতার ফাঁক দিয়ে পড়তে পড়তে সে কিছুই ভাবতে পারছিল না, এমনকি ভুলে গেল একদিন সে সর্বোচ্চ চুড়াটা স্পর্শ করতে পেরেছিল।

রমজানে বঙ্গদেশ
আর একদিন পরেই রোজার শুরু। যদি সুযোগ থাকতো এই একটা মাস আমি বাংলাদেশ থেকে দূরে কোথাও থাকতাম। রমজান হলো সংযমের মাস। কিন্তু এই মাসটার মতো অসহনীয় অসংযমের মাস আমি একটিও দেখি না। চারদিকে শুধু খাই খাই হৈ হৈ রৈ রৈ তেলেভাজা পিয়াজু বেগুনি কি মরীচিকার খেলা। ধোঁয়া ধোঁয়া তেলতেলে রাজপথ গলিপথের বাতাস। মার্কেটে মার্কেটে গিলে ফেলা হা-গিলের দল হাহা রবে ছুটে বেড়ায়। রাস্তাঘাট যানজটে আটকা ঘন্টার পর ঘন্টা। গরমে রোদে বিকেলের ভাজাভুজিতে অসহ্য আচার। হঠাৎ মুসল্লীর দল ভিড় করে মসজিদে মসজিদে ইফতার পার্টিতে। ভণ্ড ধার্মিক পাঞ্জাবি পাতলুনে চিকচিকে চেকনাই, মুখে মুখে হাদিসের বাহার। ধর্ম নিয়ে ব্যবসাপাতি চাঙ্গা করার খায়েশ।

কোন মতে এই একমাস যদি নির্বাসনে যেতে পারতাম? এই একটা মাস, আমার পোড়াভাজা বাংলাদেশ, আমি তোমায় ভালোবাসি না।

Wednesday, June 25, 2014

উন্নয়ন, ইপিজেড ও বাংলাদেশ বিষয়ক ক্যাচাল

বাংলাদেশ সরকার বিশেষ সুবিধা দিয়ে একের পর এক ইপিজেড চালু করেছে ঢাকা চট্টগ্রামসহ সারা দেশে। ইপিজেড একটি বণ্ডেড জোন। এই জোনগুলোর সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক অনেকটা আন্তর্জাতিক। এখানে কেউ পন্য বিক্রি করলে তা হবে বাংলাদেশের এক্সপোর্ট। এখান থেকে কেউ পন্য কিনলে তা হবে বাংলাদেশের ইমপোর্ট। ইপিজেডগুলো বণ্ড সুবিধার আওতায় ডিউটি ফ্রি আমদানী করে তা দিয়ে রপ্তানী পন্য তৈরী করে বিদেশে পাঠায় নির্ধারিত প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে। ইপিজেডের প্রত্যেকটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ১০ বছরের জন্য করমুক্ত সুবিধা পায়। কিন্তু ১০ বছর পার হবার পরও এদের খুব বেশী কর দিতে হয় না। কারণ এদের আয় অধিকাংশ সময়ই করমুক্ত সীমার ভিতরে থাকে অথবা অগ্রিম কর থেকে এই করের পরিমান খুব কম হয়। ফলে বাংলাদেশ সরকার এখান থেকে কিছুই পায় না বছর শেষে।

তাহলে ইপিজেড বাংলাদেশের উন্নয়নে কী ভূমিকা রাখছে? কেউ বলবেন, কর্মসংস্থান। কেউ বলবেন, বৈদেশিক মুদ্রা আহরন।

দুটোই সত্যি। কর্মসংস্থানও হচ্ছে, বৈদেশিক মুদ্রাও আহরন চলছে। কিন্তু কর্মসংস্থান কি স্থানীয় কারখানাগুলোতে হচ্ছে না? বৈদেশিক মুদ্রা কি স্থানীয় কোম্পানী গুলো আয় করছে না? ইপিজেডকে অধিক সুবিধা দেবার কারণটা কি তাহলে?

সেটা সরকার জানে। আমি বাংলাদেশের একজন নাগরিক অনুভূতির কথা বলি।

আমার ধারণা ইপিজেড বিদেশীদের জন্য যতটা লোভনীয়, বাংলাদেশের জন্য ততটা নয়। বিদেশীদের জন্য লোভনীয় কারণ এখানে আইনের আওতায় দুর্নীতি করার সুযোগ আছে। একটা উদাহরণ দেই।

ডাকসিল কোম্পানী ৪ মিলিয়ন ডলার খরচ করে একটা কারখানা খুলেছে। কর্ম সংস্থান করেছে ২০০০ মানুষের। কোম্পানীটি বছরে রপ্তানী করে ২০ মিলিয়ন ডলার। যার মধ্যে আমদানী ব্যয় ১৬ মিলিয়ন ডলার। অন্যন্য খরচ ২ মিলিয়ন। নেট লাভ ২ মিলিয়ন ডলার। দশ বছরের করমুক্ত সুবিধায় কোম্পানীটি ২০ মিলিয়ন ডলার নেট লাভ করলো দশ বছরে। সেই লাভ থেকে তিন বছর পরপর আবারো বিনিয়োগ করলো ৪ মিলিয়ন ডলার করে দুইবার। এখন তাদের ৩ টি কারখানা। প্রতিটা কারখানায় ২০ মিলিয়ন করে মোট বার্ষিক রপ্তানী ৬০ মিলিয়ন ডলার দাড়ায়। ডাকসিল-১ যখন দশবছর পূর্ন করলো সেবছর তাদের আয় কমতে শুরু করলো। ১১তম বছরে ডাকসিল-১ এর মূনাফা ২ লাখ ডলারে নেমে আসে।  পরের বছর আরো কম। এভাবে দেখা যায় ডাকসিলকে তেমন কোন কর দিতে হচ্ছে না ১০ বছর পার হবার পরও।

ডাকসিল খুশী, কারখানার কর্মচারীগন খুশী, শুধু খুশী হতে পারে না বাংলাদেশ সরকার। বাংলাদেশ সরকার ভাবতে থাকে ডাকসিলকে এত সুবিধা দিয়ে বিনিয়োগে উৎসাহিত করে আমার কি লাভ হলো?
লাভ নেই জেনেও ডাকসিলকে ব্যবসা করার অনুমোদন দিয়েছে বাংলাদেশ সরকার।

ডাকসিলকে বন্ধ করে দিলে ক্ষতিগ্রস্থ হবে কে কে?
১. ডাকসিলের মালিক (বছরে ২ মিলিয়ন ডলার আয়)
২. ডাকসিলের ২০০০ কর্মী (বছরে ১.৬ মিলিয়ন ডলার বেতন)
৩. ডাকসিলের সাথে কর্মরত বাংলাদেশী প্রতিষ্ঠানসমূহ (বছরে ১ মিলিয়ন ডলার আয়)
৪. বাংলাদেশ কর বিভাগ ( বছরে ২৫ হাজার ডলারের উৎস কর)

তেল কোম্পানীর সাথে সম্পাদিত পিএসসি চুক্তির মতো এই ইপিজেডগুলো বাংলাদেশে বিনিয়োগের মাধ্যমে যতটা উপকার করছে, তারা নিজেরা উপকৃত হচ্ছে কয়েকগুন বেশী। কিন্তু আমাদের আর কোন উপায় নেই বলে আমরা বাধ্য হচ্ছি সেই অলাভজনক বিনিয়োগ উৎসাহিত করতে। এ যেন সেই গরীব মানুষের বউ যে পরিবারের অভাব মেটাতে ব্যর্থ হয়ে স্বামীর অনুমোদন নিয়ে শরীর বেচে।

অথচ সেই বউটি যদি শিক্ষিত হতো, সে ভিন্ন একটা সম্মানজনক কর্মসংস্থান বেছে নিত। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা অবকাঠামো। বিদ্যুত আর যোগাযোগ খাতটা যদি উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন বিনিয়োগ বান্ধব হতো, তাহলে বাংলাদেশকে ইপিজেডগুলোর মতো ক্ষুদে বিনিয়োগকারীদের উপর এতটা নির্ভর করতে হতো না।

মাঝে মাঝে শোনা যায় বাংলাদেশকে গার্মেন্টস সেক্টরের উপর নির্ভরশীলতা কমাতে হবে। সেদিন এক মন্ত্রী বলছিলেন ২০২১ সালে বাংলাদেশ গার্মেন্টসএর চেয়ে অধিক পরিমান সফটওয়ার রপ্তানী করবে। আমি বলবো, এসব বাকোয়াজী বন্ধ করে অবকাঠামো উন্নয়ন করার জন্য কাজ করেন আগামী পাঁচ বছর। উন্নয়ন ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে আপনার বাড়িতে এসে ঢুকবে। সনি, স্যামসাং, এলজি, হুন্দাই, এসব কোম্পানীর বিনিয়োগ আশা করতে হলে আপনাকে বিদ্যুতখাতকে ১০০% নিশ্চিদ্র করতে হবে। ০.০০০১% বিচ্যুতিও সহ্য করবে না বিদ্যুতখাত। সুতরাং বক্তিমা কমান, কাম করেন!

লক্ষ্য যখন বস্তু নয়!

স্বাধীনতা ব্যাপারটি যে নিঃশব্দেও হরন হতে পারে সেটি জানা ছিল না ভুক্তভোগী হবার আগ পর্যন্ত। আমি বরাবরই অজাতশত্রু ভাবতাম নিজেকে। আমার কোন ব্যক্তিগত শত্রু নেই। এখনো নেই, আগেও ছিল না। তবু আমি আক্রান্ত হয়েছি তৃতীয় পক্ষের কারণে। আক্রান্ত হবার আগে কিছু অস্বস্তিকর মুহুর্ত থাকে। সেই মুহুর্তগুলোতে অনুভব করা যায় কেউ আমাকে লক্ষ্য করছে। বিশেষভাবে লক্ষ্য করছে, বিশেষ কোন উদ্দেশ্য নিয়ে। কিন্তু কেউ আমাকে লক্ষ্য করলেই আমি অভিযোগ দায়ের করতে পারি না। বিচারপ্রার্থী হওয়া যায় তখনই যখন আমি আক্রান্ত হয়ে যাবো। সুতরাং আক্রান্ত হবার আগ পর্যন্ত আমাকে অপেক্ষা করতে হয়।

আমার ব্যক্তিগত কোন শত্রু নেই, কিন্তু রাজনৈতিক শত্রুর সংখ্যা অজানা হলেও জানি, ওরা আছে। আমার ছাত্রজীবনের বিরাট একটা অংশ শত্রুশিবিরে কেটেছে। তখনো আমি জানতাম ওরা আছে। আমাকে লক্ষ্য করছে। লক্ষ্য করছে জেনেও আমি কখনো নিজেকে বিপন্ন মনে করিনি। আমি দুর্দান্ত কোন সাহসী মানুষ না, কিন্তু আমার রাজনৈতিক মতবাদের অবস্থানটা ছিল অত্যন্ত স্পষ্ট এবং প্রকাশ্য। শত্রুশিবিরেও আমি কখনো চুপ থাকিনি। এবং একবার সেই স্পষ্ট সরবতার খেসারতও দিতে যাচ্ছিলাম শত্রুপক্ষের ঘেরাওর কবলে পড়ে। আমার অপরিনামদর্শীতা বন্ধুদের এতই ভীত করে তুলেছিল ওরা একটু দূরত্বে অবস্থান নিয়েছিল। ওরা দূরে থাকলেও আমার বুকে ছিল সমগ্র বাংলাদেশের স্বাধীনতার দুর্মর শক্তি। আমাকে আক্রান্ত করতে দেয়নি সেই বিশ্বাস। শত্রুর চোখে পোড়া চোখ দুটো জ্বালিয়ে রেখেই বের হয়ে আসতে পেরেছিলাম। বুঝলাম ২১ বছর বয়সটা আসলেই দুরন্ত বেপরোয়া।

সেই একুশেই আরো একবার বেপরোয়া হয়েছিলাম একই শত্রুর মুখোমুখি হয়ে। সামনে কী আছে জেনেই পা বাড়িয়েছিলাম। কোথা থেকে একটা উড়ো রাগ এসে ভর করেছিল। সবকিছু ভেঙ্গে গুড়িয়ে দেবার অদম্য জেদে হাঁটতে শুরু করেছিলাম মিছিলে। শুধু একটু ভুল করেছিলাম কাছের দুই বন্ধুকেও আমার সেই যুদ্ধে জোর করে টেনে নিয়ে। যখন আক্রান্ত হলাম, তখন কে কোন দিকে ছিটকে গেলাম মনে পড়ে না। সেই প্রথম আক্রান্ত হয়ে পালিয়েছিলাম সরাসরি গুলির মুখে। মরলে বাকী যুদ্ধ সমাপ্ত করবে কে? নাকি আগে নিজে বাঁচো, তারপর সহযাত্রী? নিজের এবং সহযাপাঠির রক্তমাখা শার্ট মনে করিয়ে দিচ্ছিল সেই একই শত্রু ১৯৭১ এবং ১৯৯০। একই শত্রু, ভিন্ন শিবিরে। অতঃপর পলায়নের চুড়ান্তে দুই বন্ধুকে অক্ষত পেয়ে বেঁচে থাকার বিজয়ের তৃপ্তি।

বহুদিন পর আবারো লক্ষ্যের শিকার। লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হওয়া এড়াতে নতুন একটা ক্যামোফ্লেজ জড়াতে হয়েছিল। বেশ কিছুকাল নিরাপত্তা চাদরে থাকার পর একদিন একটু একটু করে ছিদ্র হতে থাকে ক্যামোফ্লেজ। একদিন টের পেয়ে যাই আবারো লক্ষ্যের শিকার। চেনাপথগুলোতে চলাচল করছে পর্যবেক্ষকের চোখ। এবার আক্রান্ত হবার ধরন ভিন্ন হবার সম্ভাবনা জেনেও অস্বস্তি সরে না। চেনাপথগুলো দিয়ে হাঁটতে গিয়েও সতর্ক থাকতে হয়।

হাঁটতে হাঁটতে টের পাই চোখগুলো কিভাবে আমাকে অনুসরণ করছে। কাউকে না জানিয়ে আমি ক্যামোফ্লেজ পাল্টে ফেলবো কিনা ভাবতে থাকি। কিন্তু আমার পথে কেউ কাঁটা বিছিয়ে দেয়নি, শুধু কয়েকটি দৃষ্টিপাত মাত্র। সামান্য সেই দৃষ্টিপাতেই এত অস্বস্তি? আমি নতুন উপায় খুঁজতে শুরু করি।

ঠিকানা পাল্টানো? আমি ক্যামোফ্লেজ পাল্টে ফেললেও আমার ঠিকানা পাল্টাতে পারছি না বিবিধ কারণে। ঠিকানা পাল্টাতে না পারলে লক্ষ্যবস্তু হওয়া কিছুতেই ঠেকানো যাবে না। আমার স্বাধীনতাও ফিরবে না। এখন উপায়?

কোন উপায় নেই, আপাততঃ গোলাম হোসেন আপাতঃ পরাধীনতায় আক্রান্ত। যেখানে জ্বর গায়ে ঘাড়-মাথা ব্যথার মতো বস্তুর সাথে আটকে আছে লক্ষ্যের দৃষ্টি।

Tuesday, June 24, 2014

হা-গিলে

আমি ছোট একটা দেশে বাস করি। দেশ ছোট কিন্তু কিছু কিছু মানুষ আছে যাদের হা তার শরীরের চেয়েও বড়। তারা চাইলে আস্ত মানুষ খপখপাখপ করে খেয়ে ফেলতে পারে। আমি সেই দেশের ছোট মুখের মানুষ। আমি একদিন রাজার কাছে আবেদন করলাম আমি জলপাই আচারের কারখানা বানাবো। রাজা অনেক চিন্তা ভাবনা করে বললো, তুমি উজিরের সাথে কথা বলো। আমি গেলাম উজিরের কাছে। উজির বললো, তুমি নাজিরের কাছে গিয়ে বলো। নাজিরের কাছে গেলাম। নাজির বললো, তুমি গোমস্তার সাথে কথা বলো। আমি গোমস্তার কাছে গেলাম।

গোমস্তা আমাকে আসতে দেখে দরোজা বন্ধ করে দিল। আমি অবাক হয়ে গেলাম। কিন্তু আমাকে তো কথা বলতেই হবে। দরোজার কড়া নাড়তে শুরু করলাম। অনেকক্ষণ কড়া নাড়ার পর, দরোজার ফাঁক দিয়ে একটা রক্তচক্ষু বের হয়ে বললো, তোর এত সাহস আমার ঘরের দরোজা ঝাঁকাঝাকি করিস? দাড়া কোতোয়াল দিয়ে তোকে শায়েস্তা করি। আমি ভয়ে গোমস্তার কাছে মাফ চাইলাম হাত জোড় করে। জোড়হাতের নতজানুত্বে একটু যেন মন গলে গেল গোমস্তার। তারপর আসল কথা পাড়লাম।

গোমস্তা শুনে অনেকক্ষণ চুপ করে থাকলো। তারপর বললো। বড় কঠিন আবদার। দেশে তো জলপাই সংকট আছে, আচার বানিয়ে শেষ করে ফেললে দেশের লোক খাবে কি। আচ্ছা, তবু তুই যখন আবদার করলি, ভেবে দেখি কি করা যায়। কালকে আসিস।

পরদিন গেলাম। গিয়ে দেখি দরজায় তালা। সে কোথাও গেছে। আমি সারাদিন অপেক্ষা করে ফিরে আসলাম। তারপরদিন আবারো গেলাম। তিনদিন ব্যর্থ হবার পর চতুর্থ দিনের সকালে অনেক কড়া নাড়ানাড়ির পর দরোজা খুলে বললো, কি রে কী চাস?

আমি অবাক হলাম আমাকে ভুলে গেছে দেখে। স্মরণ করিয়ে দিতেই বললো, ও সেই কথা? আচ্ছা কাল আসিস। আজ আরো একটু ভাবি। রাজার অনুমতি ছাড়া হবে না। বড্ড কঠিন কাজ। সরাসরি তো রাজার কাছে যাওয়া যায় না।

আমি ফিরে আসতে গেলে পেছন থেকে ডাক দিল। তুই যে জলপাই আচার বানাবি, টাকাপয়সা আছে তোর? বললাম, আছে। জিজ্ঞেস করলো কত আছে?  বললাম ২০০ টাকা আছে।

চোখ জ্বলজ্বল করে বললো, এত টাকা!! ঠিকাছে কালকে ২০ টাকা নিয়ে আসিস। দেখি রাজার কাছে পৌঁছানো যায় কিনা।

অনেক কষ্টে রাজার অনুমতি জোগার করে জলপাই আচার বানাবার কারখানা খুললাম। অনুমতি পত্রে লিখে দিয়েছিল- জলপাই বানাতে যা যা লাগবে সবকিছুর যেন পাই পাই হিসেব রাখি। রাজা চাহিবামাত্র প্রদান করতে বাধ্য থাকবে। আমি জলপাই আচার বানাতে যা যা লাগে সবকিছুর হিসেব রাখি। জলপাই, তেল, সরিষা, আদা, রসুন, পেয়াজ, পাঁচফোড়ন, নুন, গরম মশলার গুড়া সবকিছু লিখে রাখি। আমার গুদামে নানান সাইজের বৈয়ামে থরে থরে সাজানো আচার।

একদিন গোমস্তা এলো কারখানা দেখতে। বললো, রাজার হুকুমে সব ঠিক আছে কিনা দেখতে এলাম। আমি খুশীমনে রাজার উপর কৃতজ্ঞতা জানিয়ে গোমস্তাকে সব হিসেব বুঝিয়ে দিতে লাগলাম। গোমস্তা গম্ভীর মুখে সবকিছু দেখেটেখে বললো, হিসেব তো রেখেছিস, কিন্তু কোন বৈয়ামে কতটা জলপাই তার হিসেব আছে তো?

আমি ওজন মেপে হিসেব রাখি। কিন্তু গুনে গুনে রাখতে হবে ভাবিনি। গোমস্তাকে বললাম, আজ্ঞে গুনে তো রাখিনি।

সাথে সাথে তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলো গোমস্তা। এত বড় সাহস তোর!! হুকুম করা সত্ত্বেও তুই সব হিসেব রাখিস নি? আমি এখন রাজাকে কী জবাব দেবো।

আমি তখন একটা বৈয়াম থেকে আচার ঢেলে জলপাই গুনে ফেললাম। বেশি সময় লাগলো না। পনের মিনিটে গুনে বের করলাম ৩৯টা জলপাই ধরেছে এই বৈয়ামে। হিসেব শুনে আরো গম্ভীর হয়ে গেল গোমস্তার চেহারা। মাথা নাড়তে লাগলো সে। বললো, এভাবে তো হবে না বাপু। শুধু কি জলপাই এখানে? বাকী মশলার হিসেব কি আমি বের করবো? শোনো হে বাপু। যদি আচারের কারখানা রাখতে চাও তাহলে কালকের মধ্যে আমাকে প্রতি বৈয়ামের হিসেব দিবা। কতটা জলপাই, কতফোটা তেল, কত দানা সরিষা, কতদানা পাঁচফোড়ন, সব হিসেব চাই।

এই হুকুম জারি করে সে চলে গেল। রাতে আমার ঘুমই এলো না। এই হিসেব কেমনে দেবে। এতকিছু গুনে রাখা কি সম্ভব? সে কি আচার বানাবে নাকি সরিষাদানা গুনবে বসে। তার চেয়ে ব্যবসা বন্ধ করে চলে যাবো। চিন্তায় আমার মাথার চুল যেন অর্ধেক পেকে গেল রাতে।

পরদিন গোমস্তা এলো, সাথে কোতোয়াল। কোতোয়ালের হাতে খাপখোলা চকচকে এক ছুরি। ভয়ে আমার অন্তরাত্মা কেঁপে উঠে।

কোতোয়াল এসে এক বৈয়াম আচার জব্দ করে বললো, এই আচার কতটা বিশুদ্ধ তা রাজার হুকুমে চেক করে দেখতে হবে। তারপর গোমস্তা এসে ফিসফিস করে বললো, তোর জন্য একটা উপায় বের করেছি। কোতোয়াল আর আমাকে দুই বৈয়াম আচার দিবি আর নগদে দিবি ৫০ টাকা। তোর যত খুশী সরিষা দে, যতখুশী জলপাই। কোন হিসেব লাগবে না। যাহ তোর জন্য এইটা করে দিলাম। এবার বিদায় কর আমাদের দুজনকে।

আমি চোখে অন্ধকার দেখলাম। জলপাই বিক্রি করেও ৫০ টাকা আয় করি না। এদেরকে ৫০ দিলে আমার উপায় কি। এ কথা বলতেই রক্তচক্ষু মেলে গোমস্তা বললো, তাহলে তোর কারখানা বন্ধ আজ থেকে।

আমি ছুটে গেলাম নাজিরের কাছে। ঘটনা খুলে বলতেই নাজির বললো, ১০০ টাকা রেখে যাও। দেখি কি করতে পারি। আমি পাগলের মতো ছুটলাম উজিরের কাছে। উজির বললো ২০০ টাকা দাও দেখি কোন উপায় করা যায় কিনা। আমি উপায় না দেখে রাজার কাছে ছুটে গেলাম। রাজা আমাকে দেখেই বললেন, তোমার কারখানার অবস্থা তো ভালো না হে। আচার খেয়ে লোকজন অসুস্থ হয়েছে বিস্তর। তোমার জরিমানা হবে ৫০০ টাকা। কারখানা বন্ধ করে তুমি গায়ে ফিরে গিয়ে ৫০০ টাকা কোষাগারে জমা দিয়ে যাও। নইলে তোমাকে শূলে চড়ানো হবে।

আমি গ্রামে গিয়ে জমিজোত বিক্রি করে ৫০০ টাকা জরিমানা শোধ করে শূলের হাত থেকে রক্ষা পেলাম।

গ্রামে ফিরে বুড়ো ওস্তাদের কাছে সবকিছু খুলে বলার পর তিনি কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে কিছু একটা ভেবে বললেন, আরো দেড় হাজার বছর পর গাঙ্গেয় অঞ্চলে বান্দেশ নামের যে দেশের জন্ম হবে, সেই দেশটাও আমাদের এই হা-গিলে দেশের মতো হবে। সেই দেশ শাসন করবে হা-গিলের বংশধরেরা।


আমি স্পষ্টতঃই বুঝলাম, এই বুড়োর মাথাটা একেবারে পচে গেছে!

Monday, June 23, 2014

লাক্সের সবচেয়ে পুরোনো বাংলা বিজ্ঞাপনটি

বৃষ্টির সাথে স্মৃতিচারণের একটা অচ্ছেদ্য সম্পর্ক আছে। অনেক পুরোনো একটা টিভি বিজ্ঞাপন দেখে লাক্স স্মৃতি মাথাচাড়া দিল। বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশী ব্যবহৃত সাবান। তখন লাক্স সাবান বলতে একটু বিলাসী সাবান বোঝাতো। যাদের টাকা পয়সা একটু বেশী তারাই লাক্স সাবান দিয়ে গোসল করতো। যাদের পয়সা কম আরা লাইফবয়। লিভার ব্রাদার্স এভাবেই দেশের ধনী দরিদ্র দুই ভাগের পকেটে হাত ঢুকিয়ে দিয়েছিল। আমাদের যখন টাকাপয়সা কম ছিল তখন আমরা একটা লাইফবয় কিনে দুই ভাগে কেটে ব্যবহার করতাম। লাক্স সাবান কেনার কথা ভাবতাম না তখন। আবার যখন বাবার পকেটে টাকা আসে তখন শুধু লাক্স না, ডাভ, কেমি এসব সাবানও চলেছে। যাই হোক, আজকের বিষয় আর্থিক অবস্থার বিবর্তন নয়। আজকের বিষয় শুধুই লাক্স বিজ্ঞাপন।

[দুপুরে এক ঝলক রোদের আমেজ আসলেও এখন আকাশ সমস্তটাই কালো, এই দুপুরেই সন্ধ্যা নামিয়ে দিয়েছে। মুষলধারে শুরু হয়েছে দ্বিতীয় দফার বর্ষণ।]

আমার স্মৃতিতে লাক্সের সবচেয়ে পুরোনো বিজ্ঞাপন নূতনের। এর আগেও কি আরেকটা বিজ্ঞাপন হয়েছিল অলিভিয়ার? মনে নেই, মনে পড়ছে না। যে বিজ্ঞাপনটি ইউটিউবে দেখছি সেটি রঙিন। আমার দেখা টিভি স্মৃতি সাদাকালো। তাহলে কি এটা সিনেমা হলের জন্য বানানো চিত্র? হতে পারে। এই বিজ্ঞাপন যখন দেখানো হতো তখনো টেলিভিশন একটি দুর্লভ বস্তু। দীর্ঘদিন এই বিজ্ঞাপন চলার পর লাক্স তারকা বদল করলো। আসলো সুবর্না। একই স্লোগান নিয়ে। বিশ্বজুড়ে চিত্রতারকাদের সৌন্দর্য সাবান। প্রথমটি যখন দেখায় তখন আমি স্কুলে। সুবর্নার বিজ্ঞাপনের সময় আমি কলেজে। তারপর একসময় কলেজ টপকে বিশ্ববিদ্যালয়ে উঠে যাই। লাক্স বিজ্ঞাপনে আবারো বদল আসে। এবারের তারকা বিপাশা হায়াত। বিপাশা হায়াতের যুগ শেষ হবার আগেই আমার জগত পাল্টে যায়, আমি টিভি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ি। এখনো নিশ্চয়ই এই সৌন্দর্য সাবানের বিজ্ঞাপন তৈরী হয়। এখনকার তারকা কে? জানি না।

এবার দেখা যাক আমার দেখা প্রথম সেই বিজ্ঞাপনটি।
লাক্স বিশ্বজুড়ে চিত্রতারকাদের সৌন্দর্য সাবান

বৃষ্টির প্রথম ধাক্কাটা শেষ হয়ে এখন স্থির ঝরছে। আকাশের রং কালো নেই। ধপধপে সাদা হয়ে আছে কোটি কোটি জলকণার আলোয়।


Sunday, June 22, 2014

আনস্মার্টের গদ্য এবং বৃষ্টি দিনের কথকতা

১. স্মার্ট বনাম আনস্মার্ট

আমি জীবনভরই আনস্মার্ট। জীবনযাপন পোষাকআশাক শিক্ষাদীক্ষা সবকিছুতেই। প্রযুক্তিতে এসেও সেই আনস্মার্ট জীবনযাপন। এখন আবার স্মার্ট আনস্মার্টের সংজ্ঞা অন্যরকম। মোবাইল দিয়ে মাপা হয় সেটা। সেই হিসেবে আমি বছরখানেক স্মার্ট ছিলাম। শখ করে একটা সনি এক্সপেরিয়া কিনে কাক হয়ে ময়ূর সেজেছিলাম এই এক বছর। সেদিন মানে গত বিষ্যুদবার আমার সংক্ষিপ্ত স্মার্টজীবনের অবসান ঘটতে শুরু করলো যখন আমি পুরোনো ধাচের একটা মোবাইল কিনলাম।

যে দোকান থেকে স্মার্ট কিনেছিলাম সানমার ওশান সিটির সেই একই দোকানে গিয়ে বললাম, ভাই এবার একটা আনস্মার্ট ফোন দেন, আমার স্মার্টনেসের চেয়েও বেশী দরকার চার্জ। দিনে তিনবার না, তিনদিনে একবার চার্জ দিতে হয় তেমন একটা সেট দেন। আর যদি সম্ভব হয় তাতে যেন গানটান শোনার একটু ব্যবস্থা থাকে। যে কোন ভ্রমণে আমার গান শোনার নেশাটা অনেক প্রিয়। ভ্রমণে বই সাথে থাকলেও চোখ বন্ধ করে গান শোনাই হয় বেশী।

দোকানী আমার জন্য একটা নকিয়া সাদামাটা(আসলে কালোমাটা) একটা সেট বের করে দিলেন। একদম আমার দাদার যুগের চেহারা। দাম মাত্র ২০০০ টাকা। কালোমাটা চেহারাটা পছন্দ হলে আর দেরী না করে জিনিসটা বগলদাবা করে নিয়ে এলাম।


আগের স্মার্টফোনের অভ্যেসগুলো আস্তে আস্তে বদলাতে হবে। প্রযুক্তির সাথে অতিমাত্রায় বন্ধুতার বিপদ অনেক। পদে পদে নাজেহাল করতে পারে সে। একটু কানেকশান বিঘ্ন ঘটলে মনে হয় দুনিয়ার তার ছিঁড়ে গেল। বি কানেক্টেড ব্যাপারটাই একটা মানসিক রোগ হয়ে যায়। পকেটে করে যেন সবসময় আস্ত একখানা অফিস বয়ে নিয়ে যাই। অফিসের মেইল, ফাইলপত্র, দরকারী তথ্য, ছবি, গান,এমনকি মুভিও।  সব বোঝা থেকে হালকা হয়ে ভাসতে ভাসতে বাসায় ফিরলাম।

আনস্মার্ট ফোন থেকে প্রথমে একটা সংক্ষিপ্ত ফোন করলাম এক বন্ধুকে। দেখলাম আগের ফোনের চেয়ে এই ফোনে কথা আরো পরিষ্কার। শুধু একটা সমস্যা। এটাতে ভাইবার নাই। স্মার্টের ভাইবারে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম বেশ কিছুকাল। ভাইবার সেট থেকে শেষবার যখন ফোন করি তখনো ভাবছিলাম মাঝে মাঝে ভাইবারের জন্য স্মার্টফোনের দরকার হবে। কিন্তু ফোনটা করার পর বুঝলাম, ভাইবারও বিগড়ে গেছে।


২. বৃষ্টির অনিষ্ট বনাম বৃষ্টির রোমান্টিকতা

গত তিনদিন ধরে শহরজুড়ে অঝোর ধারায় বর্ষণ। বঙ্গোপসাগরের সবগুলো মেঘ এখন গাঙ্গেয় মোহনায় অবস্থান করছে। নগরজীবন অচল প্রায়। তলিয়ে গেছে অনেক এলাকা। বর্ষণের গতি এত তীব্র যে জানালা দিয়ে বাইরে তাকালে ধোঁয়াশা ছাড়া কিছুই দেখা যায় না। ২০০৭ এর জুনে এরকম এক বৃষ্টিতে তলিয়ে গিয়েছিল আমাদের আগের বাড়িটা। ঘরের মধ্যেই এক কোমর জল হয়েছিল। আমরা পাশের দোতলা বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলাম সব জিনিসপত্রের মায়া ছেড়ে। ১৯৯১ ঘূর্নিঝড়ের মতো সেবারো প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল, তবু বইগুলো বেঁচে গিয়েছিল। ওই একতলা বাড়ির নিরাপত্তাহীনতা ছেড়ে আমরা পালিয়ে বেঁচেছিলাম শেষমেষ। কিন্তু কত মানুষ পালাবার সুযোগ পায় না। বছরের পর বছর আটকে থাকে চক্রবন্দী হয়ে। বৃষ্টি আমার বুকে ভালোলাগার আমেজ ঘটায়। শুধু কি আমার? এত দূর্যোগ বন্যা সত্ত্বেও বাঙালীর রক্তে বৃষ্টির প্রতি কেমন একটা সিক্ত রোমান্টিকতা কাজ করে না? বৃষ্টি নিয়ে বিশেষ কিছু স্মৃতি? আছে, তবে আজ নয়। আজ একটা কবিতা পড়া যাক। সচলের রোমেল ভাই কিছুদিন আগে লিখেছিলেন-

তোমাকেই লিখছি, তবু তোমাকে জানাতে নয়
হয়তো এ লিখা নয়—
স্মৃতির দোলচেয়ারে বসে
এলোমেলো ভাবনার আঙ্গিনায়
একটু আধটু ঢেউ তোলা...
অনিমেষ চেয়ে দেখা ভাঙনের বিদীর্ণ বুক।

হয়ত অন্ধের রাস্তা হাঁটবার মতো করে
হাতড়ে হাতড়ে চলা
তারপর কিছু কথা বলা ঘোরের ভেতর
তারপর বেলাবেলি হলে বুকের ভেতরের কবন্ধ হাহাকারগুলো
আলগোছে নেড়ে চেড়ে দেখা—
হাওয়ার ভেতরে খুঁজে ফেরা দীর্ঘশ্বাসের কিছু বিমূর্ত সংলাপ।

==========================

৩. এবং আংশিক সংলাপ

বৃষ্টির গান এখনো অবিরাম বেজে যাচ্ছে। আজ ভিজতে হবে। গাড়ি নেই। ছাতা ব্যবহারে অনভ্যস্ত। পকেট বাঁচিয়ে, রাস্তার জমা জল ঠেলে, জুতো মোজা একাকার করে, কতদূর যাবে তুমি, কত দূর।

যেতে যেতে বাংলা গান শুনি-

বন্ধু তোমার মন ভালো নেই

তারপর একখানা ইংলিশ-

And if you ever get lost on life's highway
Don't know where to go
There's just one thing that I want you to know
I am here for you, always here for you
When you're needin' someone to hold you
Remember I told you
I am here for you, I am here for you

[তুঁই যদি লাইপের মেইনরোডে পথ হারায় ফেলো, আঁই আছি, তোঁয়ারলাই আঁই ইয়ানে খাঁড়ায় আছি]

এর ফড়েও যদি তোঁয়ার মন ভালা না হয় তাইলে দেশী চ্যাং এর ক্যারিশমা দেখো






Thursday, June 19, 2014

অসমদুপুরসন্ধ্যারাত্রি

ডায়াল করতেই বহুবার শোনা বাক্যটি আবারো শোনা গেল - 'এই নাম্বারটি বর্তমানে খালি আছে, অনুগ্রহপূর্বক..........'। আমি জানি নাম্বারটা এখন খালি থাকারই কথা। ওই নাম্বারটি আর কেউ নেয়নি। মোবাইল কোম্পানীর এত কোটি নাম্বারের মধ্যে সামান্য একটা নাম্বার খালি থাকলে কারো কিছু এসে যায় না।

সংবাদটা আমাকে কে দিয়েছিল মনে পড়ছে না। দিনটা খুব গরম ছিল মনে আছে। আমি সংবাদটা পেয়ে গন্তব্যে পৌঁছাতে শুরু করেছিলাম। অতদূর অচেনাতে আগে কখনো যাইনি। তবু আমি পৌঁছে গিয়েছিলাম ঠিকঠাক। পৌঁছে তোর অপেক্ষায় ছিলাম। সেই প্রথম আমি তোর প্রতীক্ষায় কোথাও দাঁড়িয়ে ছিলাম। তুই এসেছিস সময়ের একটু পরে। অইটুকু সামান্য বিলম্বে কীই বা এসে যায়। আমি কিছু মনে করিনি।

অতদূর থেকে আরো দূর যাত্রার উদ্দেশ্যে তুই আসলি তবু তোর সাথে দেখা হলো না। কেন দেখা হলো না সেটা তুই ভালো করে জানিস। জানে আরো দশজনা।

বাঁশবাগানের মাথার উপর রূপোলী এক চাঁদ উঠেছিল সেদিন। তবু স্নিগ্ধতা ছিল না তাতে। দিনের মতো রাতটুকুও উষ্ণতা ছড়িয়ে যাচ্ছিল। বাঁশবনের ছায়া আমাকে আড়াল করে রাখলেও তোর উপর জ্বলজ্বলে নিটোল পূর্নিমা। অজর আঁধারের গালিচা সরিয়ে তুই কি দেখতে পেয়েছিলি তোর জন্য রাখা এক ফোঁটা জল? তোকে জিজ্ঞেস করা হবে না কোনদিন।

আজ সেই একটা বছর ছুঁয়ে দেবার দিন। তোকে আর কখনো দেখতে যাবো না আমি। আর কখনো তোর প্রতীক্ষায় থাকবো না। আমাদের সবার মধ্যে তুই প্রথম হয়ে গেলি বলে আমরা তোকে হিংসে করি? জানি না। তবে এটা জানি এবার তোর প্রতীক্ষার পালা। এরপর আমরাও আসতে থাকবো একে একে। কোন এক বর্ষণমূখর অথবা বর্ষণহীন রাতে। তখন হয়তো হবে দেখা। অন্য কোন ভূবনে।

১৯শে জুন ২০১৪

Tuesday, June 10, 2014

অচেনা স্বপ্নের বিহ্বলতা

অনেক বছর আগে দূর স্বপ্নের কুয়াশা মেখে ঘুম থেকে জেগে উঠেছিলাম একবার। জেগে ওঠার পরও স্বপ্নটা পিছু ছাড়েনি সারাটা দিন। এমনকি কয়েকদিন। ঘোরের মধ্যে মাটিরাঙ্গা পথে ধুলো মেখে হাঁটতে হাঁটতে সূর্যাস্ত পর্যন্ত গিয়েও দিগন্ত ছুঁতে পারিনি। আমি যত কাছে যাই দিগন্ত তত দূরে সরে যায়। আমার চোখের ঘোর একসময় ঢেকে যায় সন্ধ্যার অন্ধকারে। সন্ধ্যাকাশের জ্বলে ওঠা শুকতারাটি যখন গভীর উজ্জ্বলতা নিয়ে নিবিড় বনানীর পেছনে আশ্রয় নিল তখন যে লাইনগুলো বেজে উঠেছিল বুকের গহীনে-

কোনোদিন দেখিব না তারে আমি: হেমন্তে পাকিবে ধান, আষাঢ়ের রাতে
কালো মেঘ নিঙড়ায়ে সবুজ বাঁশের বন গেয়ে যাবে উচ্ছ্বাসের গান
সারারাত, — তবু আমি সাপচরা অন্ধ পথে — বেনুবনে তাহার সন্ধান
পাবো নাকে: পুকুরের পাড়ে সে যে আসিবে না কোনোদিন হাঁসিনীর সাথে,
সে কোনো জ্যোৎস্নায় আর আসিবে না — আসিবে না কখনো প্রভাতে,
যখন দুপুরে রোদে অপরাজিতার মুখ হয়ে থাকে ম্লান,
যখন মেঘের রঙে পথহারা দাঁড়কাক পেয়ে গেছে ঘরের সন্ধান,
ধূসর সন্ধ্যায় সেই আসিবে না সে এখানে; — এইখানে ধুন্দুল লতাতে
জোনাকি আসিবে শুধু: ঝিঁঝিঁ শুধু; সারারাত কথা কবে ঘাসে আর ঘাসে
বাদুড় উড়িবে শুধু পাখনা ভিজায়ে নিয়ে শান্ত হয়ে রাতের বাতাসে;
প্রতিটি নক্ষত্র তার স'ান খুঁজে জেগে রবে প্রতিটির পাশে
নীরব ধূসর কণা লেগে রবে তুচ্ছ অনূকণাটির শ্বাসে
অন্ধকারে — তুমি, সখি চলে গেলে দূরে তবু; — হৃদয়ের গভীর বিশ্বাসে
অশ্বত্থের শাখা ঐ দুলিতেছে; আলো আসে, ভোর হয়ে আসে।

অতঃপর আমি যেন বিষন্ন পরাজিত নাবিক এক। আমাকে ক্লান্ত.... ক্লান্ত করে দিয়েছিল পৃথিবীর সকল অবশিষ্ট উপাদান। পথের বিছানো ইটের অমসৃন সমতলে পা ঘষতে ঘষতে, ঘষতে ঘষতে এগিয়ে যাচ্ছিলাম অন্ধকার এক অনিশ্চয়তার পথে। আমাকে ফিরে ডাকার কেউ ছিল না তখন। মহাসড়কে উঠে অচেনা গন্তব্যের বাস ধরে আমি ঝুলতে ঝুলতে এগিয়ে যাচ্ছিলাম বিম্বিসার ধূসর জগতের দিকে। যেখানে জীবনের সমুদ্র সফেন। তারপর দীর্ঘ পদযাত্রা, অফুরন্ত সেই পথ। কিন্তু আমাকে দুদণ্ড শান্তি দেবার মতো কোন অশ্বথ বট পথের ধারে অপেক্ষমান ছিল না। আমি এক অন্ধকার থেকে অন্য অন্ধকারে পথ হারিয়ে ঘুরে মরছিলাম। সবগুলো পথের দিশা আমার কাছে একাকার হয়ে গিয়েছিল। সেই ঘন সুপুরি বনের পাশে কলকল বয়ে যাও সরু জলধারা আমাকে কেবলই বিভ্রান্ত করে যাচ্ছিল। তখন আবারো বেজে উঠলো নতুন এক বেদনার্ত সুর-

খুঁজে তারে মরো মিছে — পাড়াগাঁর পথে তারে পাবে নাকো আর;
রয়েছে অনেক কাক এ উঠানে — তবু সেই ক্লান্ত দাঁড়কাক
নাই আর; — অনেক বছর আগে আমে জামে হৃষ্ট এক ঝাঁক
দাঁড়কাক দেখা যেত দিন — রাত, — সে আমার ছেলেবেলাকার
কবেকার কথা সব; আসিবে না পৃথিবীতে সেদিন আবার:
রাত না ফুরাতে সে যে কদমের ডাল থেকে দিয়ে যেত ডাক, —
এখনো কাকের শব্দে অন্ধকার ভোরে আমি বিমনা, অবাক
তার কথা ভাবি শুধু; এত দিনে কোথায় সে? কি যে হলো তার
কোথায় সে নিয়ে গেছে সঙ্গে করে সেই নদী, ক্ষেত, মাঠ, ঘাস,
সেই দিন, সেই রাত্রি, সেই সব ম্নান চুল, ভিজে শাদা হাত
সেইসব নোনা গাছ, করমচা, শামুক গুগলি, কচি তালশাসঁ
সেইসব ভিজে ধুলো, বেলকুড়ি ছাওয়া পথ, ধোয়া ওঠা ভাত,
কোথায় গিয়েছে সব? — অসংখ্য কাকের শব্দে ভরিছে আকাশ
ভোর রাতে — নবান্নের ভোরে আজ বুকে যেন কিসের আঘাত!

রাত শেষ হয়, আমার পথ চলা শেষ হয় না, তখন আরো একটি নতুন ভোরের আলোয় উজ্জ্বল হয়ে ওঠে পুবদিগন্ত। হারিয়ে যেতে থাকে রাতভর জ্বলতে থাকা নক্ষত্রমণ্ডলী। আমি হারিয়ে ফেলা অন্ধকারের জন্য কেঁদে উঠতেই ওরা আগে বলে উঠলো, ভেবো না, আমরা আছি দিনের আলোর গভীরেও। আবার ফিরবো সন্ধ্যা তারার ডাকে। তুমি থেকো, পথের দিশে হারিও না। আবার হবে দেখা।

তখন থেকে আমি অন্ধকারের প্রেমে পড়ে যাই। অন্ধকারের বুকেই আছে আমার প্রিয় নক্ষত্র নীহারিকার আলো। আকাশের বাতিঘর হয়ে আমাকে পথ দেখায় নিরন্তর।


[কবিতা কৃতজ্ঞতাঃ জীবনানন্দ দাশ, অরণ্যচিত্রঃ লাউয়াছড়া,সিলেট, রাতের আকাশঃ নামিবিয়া]

Monday, June 9, 2014

বিষাক্রান্ত বাংলাদেশ

বাংলাদেশে ১০০% বিশুদ্ধ খাবার খেতে পারেন কত শতাংশ মানুষ? তাদের বিশুদ্ধ খাবারের উৎস কী? তারা কোথা থেকে বাজার করে? সেই বাজার রান্না হবার আগে এবং পরে বিশুদ্ধতা যাচাই করে কে? যাচাই করার পদ্ধতি কি?

হতে পারে কিছু শীর্ষ ক্ষমতাবান মানুষ, সংখ্যানুপাতে যারা ০.১% অথবা ০.০১% এর মতো ক্ষুদ্রাংশ, নিশ্চয়ই বিশুদ্ধ খাবার খায়। তাদের মধ্যে অবশ্যই প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতিসহ মন্ত্রী আমলা শীর্ষ ধনকুবেরগন রয়েছেন। নিশ্চয়ই ভেজালমুক্ত রান্নাঘর তৈরীর ক্ষমতা তাদের আছে। সাধারণ মানুষের সে ক্ষমতা নেই, এমনকি ভেজালমুক্ত মানুষেরা কী পদ্ধতিতে ভেজাল থেকে নিজেদের বাঁচিয়ে রাখেন তাও জানার উপায় নেই।

ভেজাল দিয়ে যদি ভাগ করি, তাহলে দেশটা দুই ভাগে বিভক্ত। বিশাল অংশের ভাগটা ভেজাল খাবার খায়, আরেকটা ছোট্ট অংশ ভেজালমুক্ত খাবার খান।

যারা ভেজালমুক্ত আছেন, তারা কি ভেজালযুক্ত মানুষের কথা ভাবেন? মনে হয় না। দেশের ৯৯.৯% মানুষের বাজার, খাবার, রান্নাঘর ইত্যাদি পরীক্ষা করার কোন ব্যবস্থা নেই। আমরা জানতেও পারি না প্রতিদিন আমরা কি পরিমান ফরমালিন খেলাম, কি পরিমান কার্বাইড গিললাম, কি পরিমান ক্রোমিয়াম পাকস্থলীতে জমা করলাম। যদি জানতাম তাহলে হয়তো আমরা আমাদের আয়ু সম্পর্কে একটা ধারণা করতে পারতাম। বুঝতে পারতাম, আমি মরবো কিডনী রোগে, তুমি মরবে যকৃতধ্বংস হয়ে অথবা সে মরবে পাকস্থলীর কোলন ক্যান্সারে।

একটা লঞ্চ ট্রেন কিংবা বাস দুর্ঘটনায় ৫০ জন মানুষ মারা গেলে সারাদেশ ব্যাপী তোলপাড় ঘটে যায়। কিন্তু ভেজাল খেয়ে বছরের পর পর হাজার হাজার মানুষ নীরবে মারা যাচ্ছে সেটা খুব বেশী গুরুত্ব পায় না। এই মৃত্যুগুলো স্বাভাবিক হয়ে গেছে।

এদেশে হাসপাতাল, ক্লিনিক, ডায়গনস্টিক সেন্টার, ডাক্তারের চেম্বার কোথাও তিল ধারণের জায়গা নেই। হাজার হাজার মানুষ প্রতিদিন ছুটছে চিকিৎসা পেতে। বাজার খরচের টাকা না থাকলে আধপেটা থাকা যায়। কিন্তু চিকিৎসা খরচ না থাকলে ডাক্তার চোখ তুলেও দেখবে না, ডায়গনস্টিক সেন্টারও বলে তফাত যাও। তাই সর্বস্বান্ত হয়ে, ঋনগ্রস্থ হয়েও চিকিৎসার খরচ যোগাতে হয়। আমার চারপাশের চেনাজানা আত্মীয়বন্ধুর গড়পড়তা ৫০টি পরিবারের খোঁজ নিলে দেখবো, সম্পূর্ণ সুস্থ আছে তেমন পরিবার একটিও নেই। প্রতি পরিবারে একজন না একজন অসুস্থ রোগীর দেখা মিলবেই।

বিশ পচিশ বা পঞ্চাশ একশো বছর আগেও অসুস্থ হতো মানুষ। কিন্তু সেটার ধরণ ছিল ভিন্ন। ওটা ঘটতো বছরে দুয়েকবার মাত্র। জ্বরজারি সর্দি কাশি আমাশা ডায়রিয়া ছাড়া তেমন গুরুতর কোন সমস্যা থাকতো না। এখন তো প্রতিমাসে, কখনো কখনো প্রতি সপ্তাহেও আমাকে ডাক্তারের কাছে, ডায়াগনস্টিক সেন্টারে, হাসপাতালে ছুটতে হচ্ছে পরিবারের কোন না কোন সদস্য নিয়ে। একজন সুস্থ হতে না হতেই আরেকজন অসুস্থ হয়। গুরুতর সব রোগের নাম। কারো কিডনী চলে গেছে, কারো লিভার নষ্ট, কারো পাকস্থলী, কারো খাদ্যনালী। সামাজিক বা বন্ধুবান্ধবের যে কোন আড্ডায় বসলে অবধারিতভাবে চলে আসবে ডাক্তার হাসপাতাল রোগ বালাই ইত্যাদির কথা।

দেশব্যাপী এই বিরামহীন অসুস্থতার পেছনে প্রধান অবদান খাবারের। বেঁচে থাকার জন্য মানুষ যে খাবার সংগ্রহ করছে দিনরাত পরিশ্রম করে, সেই খাবার খেয়েই মানুষ মরতে বসছে। শরীরের যেসব অংশ দিয়ে খাবারদাবার আসা যাওয়া করে সেই পথগুলো ভয়াবহ সব সমস্যায় আক্রান্ত।
সামর্থ্য থাকলে আমি হয়তো ভালোমন্দ বাজার করে রান্নাঘর ভর্তি করে ফেলতে পারি কিন্তু বিষমুক্ত খাবারের ব্যবস্থা করা আমার জন্য অসম্ভব। ফলমূল, শাকসবজী, মাছ, মাংস, তেল মশলা কিসে নেই বিষ? আমার কাছে বিষাক্ততার মাত্রা যাচাই করার যন্ত্রপাতি নেই। তবু আমি জানি প্রতিদিন যা কিছু খাবার কিনছি তার বিরাট অংশেই ছড়িয়ে আছে নিঃশব্দ ঘাতক। আমি বাজারের থলেভর্তি করে বিষমুক্ত খাবার কিনে বাসায় যাই। পরিবারের পুষ্টি, আমিষ-প্রোটিন বাড়াতে গিয়ে রক্তের মধ্যে ঢুকিয়ে দেই বিষের ভিটামিন।

আমাদের কথা বাদ দিলাম। বলি যারা দেশ পরিচালনা করেন, যারা দেশের আইন কানুন, পরিবেশ, বাজার নিয়ন্ত্রণ করেন, তাদের সবার খাবার কি ১০০% বিষমুক্ত? তারা কি নিশ্চিত হয়ে প্রতিদিন বাজার করেন, রান্না করেন? যদি না হয় তাহলে তারাও কী ধীরে ধীরে ধ্বংসের পথে হাঁটছেন না? তাহলে সমগ্র জাতিই দীর্ঘমেয়াদী আত্মহননের পথে যাচ্ছে? কী ভয়াবহ ব্যাপার!!

এই জাতির ভবিষ্যত কী? নিকষ কালো আঁধার? নাকি একটু আলো আছে। শেষমেষ বাংলাদেশকে কেউ বিষমুক্ত করতে না পারলে আমরা কি এমন অসম্ভব কোন আশা করতে পারি বিষের সঙ্গে বসবাস করতে করতে মানুষের শরীর কোন একদিন এই সকল বিষ হজম করার মতো শক্তি অর্জন করে ফেলবে অভিযোজন প্রক্রিয়ায়? উটপাখির পাকস্থলী নাকি লোহা পাথর ইত্যাদি কঠিন জিনিস হজম করার মতো শক্তি রাখে। আমাদের পাকস্থলীও কি একদিন সেরকম শক্তিমান হয়ে উঠবে?


সবশেষে একটা সংবাদ পড়ে মনটা আরো দমে গেল। এতদিন ভাবতাম অন্য ফলে যাই ঘটুক, মোটা চামড়ার কাঁঠাল নিশ্চয়ই ফরমালিন মুক্ত। পছন্দের ফল না হলেও এতে একটু ভরসা রাখার জায়গা পেয়েছিলাম। কিন্তু সেই কাঁঠালেও ফরমালিন। হারাধনের আর একটি ছেলেও অবশিষ্ট রইলো না।

Sunday, June 8, 2014

ব্লগ যুগের হারিয়ে যাওয়া পর্বগুলো : ২০১১-২০১৩

যেসব প্রিয় ব্লগারদের সাথে নিয়মিত আড্ডা হতো তাদের অনেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে।  সেইসব আড্ডায় একে অন্যের সাথে কতটা আন্তরিক ছিলাম আমরা। এই লেখাটা তার একটা নজির হয়ে আছে। লিখেছিলেন আমাদের সবার প্রিয় লেখক ব্লগার নুশেরা তাজরীন। চতুর্মাত্রিক ব্লগের এই লেখাটা কদিন পরপর আপডেট করা হতো। কয়েক বছরের আপডেটের একটা সারাংশ আছে বলে লেখাটা সংরক্ষণ করলাম। আমরা প্রায়ই বলতাম একদিন সবকিছু গল্প হয়ে যায়। তখন হয়তো কথার কথা বলতাম। আজ দুবছর পর মনে হচ্ছে সত্যি সত্যি গল্প হয়ে গেছে সবকিছু। এখন আর আমরা কেউ কারো সাথে চিঠি লিখি না, আমাদের কারো সাথে কারো যোগাযোগ নেই। সেই গল্পগুলো প্রাগৈতিহাসিক যুগের স্মৃতি হয়ে আছে।


.............


লিখেছেনঃ নুশেরা (তারিখঃ ৩১ জানুয়ারি ২০১৩, ৫:২৮ পূর্বাহ্ন)

।।সতের।।

চারপাশ থেকে কিছু মানুষ মাঝেমাঝেই নেই হয়ে যাচ্ছে। চিরতরে।
আইছ একা যাইবা একা সঙ্গে কিছু যাবে না- মরমী বাণীটি মনে হয় পুরোপুরি সত্যি না।
মানুষ চলে যায়; সঙ্গে নিয়ে যায় তার সমস্ত সম্ভাবনা, আশা-ভালবাসা; মহত্তম আকাঙ্ক্ষা, স্নায়ুক্ষয়ী আশঙ্কা... নিজস্ব পৃথিবীর সবটুকু গ্লানি, গহনতম বেদনা... যাবতীয় প্রাপ্তির তৃপ্তি, অপ্রাপ্তির হাহাকার... উপচে পড়া আশীর্বাদ, উথলানো স্মৃতিকাতরতা, উগরানো অভিশাপ... কত সত্য কত মিথ্যা, কত প্রতিশ্রুতি কত ভান কত অপেক্ষা কত স্বপ্নসাধ...
অন্তর্গত অনুভূতির সমুদয় প্রকরণ সঙ্গে নিয়েই তো বিদায়ের পথ ধরে মানুষ!

বিভূতিভূষণের অপুর আকাঙ্ক্ষাময় কল্পনাজুড়ে রাজত্ব করেছিল রেলগাড়ির চলাচল; দুর্গা চেয়েছিল সবার ভাল থাকা আর অপুর মাষ্টারমশাইকে...
বইয়ের পাতার ভাঁজে কার যেন স্বপ্ন ছিল একদিন পাহাড় দেখা হবে তার, কারও স্বপ্নসাধের ইন্দ্রজালে সমুদ্রের ফেনাতোলা জলরাশি।
একবার একজনের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল- যার ইচ্ছে ছিল জীবনানন্দের ষোলটি কবিতা ইংরেজিতে অনুবাদের। মাত্র তিনটির কাজ শেষ করেছিলেন, তারপর অনেকগুলো বছর ধরে যে জীবন তিনি যাপন করে আসছেন তাতে ওটুকু ইচ্ছের পূরণ আর সম্ভব হয়নি, কোনদিন হবে এমন কোন সম্ভাবনাও দেখেন না; তবু খাতাটি নাকি লুকিয়ে রেখেছেন খুব যত্নে- যত্নে এবং সাবধানেও- কেউ যেন কোনদিন খুঁজে না পায়!

ঘুমিয়ে কখনও দেখিনি, ঘুমঘোরেও না; শুধু কল্পনায় এই স্বপ্নটা মাঝেমাঝে দেখি। নিতান্ত হাস্যকর ছেলেমানুষি। আমার একটা ক্যাফে হবে। ছোট্ট একটা ক্যাফে। দুপুরবেলায় কেউ থাকবে না ভেতরে, তবে দিনরাতের সবটুকু সময় এর দরজা খোলা থাকবে।
একটা পুরনো বাতিঘরের ধারে আঙুরলতায় ছাওয়া ঘন সবুজ পাহাড়; সেই পাহাড়ের পাথুরে ঢাল সোজা নেমে গেছে সোনালী বালির সৈকতে; ঝকঝকে ফেনা মাথায় বয়ে আনা নীলচে সবুজ ঢেউ আসছে, একের পর এক, আছড়ে পড়ছে বড় বড় পাথরের চাঁইতে। ওরকম একটা পাহাড়ের শেষ প্রান্তে থাকবে ছোট্ট ক্যাফেটা; কাঠের মেঝে- টালির ছাদ- কাচের জানলা- অল্প কটা বেতের চেয়ার। তন্দুরের গর্ভে ফুলেফেঁপে উঠবে মাখনগন্ধী কুকি, ফুলকাটা আনারসফালিতে চিনিপোড়া গন্ধ মাখামাখি হবে পাইনঅ্যাপল কেকের তলায়। ক্রিমের ফেনা উঠবে কফির কাপে, কেতলির জলে আদাএলাচ ফুটবে লেবুচায়ের অপেক্ষায়। হঠাৎ কোন রোদসম্ভাবী ভোরে আসে যদি কোন প্রিয়বাঞ্ছিত আগন্তুক; চাইলে গরমাগরম মুচমুচে পরোটাভাজিও জুটবে তার!

রাত গভীর হলে ঝুলবারান্দায় জেগে বসে থাকব- সামনে সমুদ্র, ডানে পাহাড়, আর বাঁয়ে শূন্যতা নিয়ে- আঁধারে চেয়ে বসে থাকবে তিনজন- আমি, আমার একাকীত্ব, আর অপেক্ষা (বাহ্, সবাই স্বরবর্ণে শুরু!)...
হয়ত মনে পড়বে গুলজারকে, নিজের মতো করে-
a few of my belongings
are still in your possession
a few wet days of monsoon
a night wrapped in a letter
return to me what is mine...
a few autumns
the sound of falling leaves
return to me what is mine...
once under a single umbrella
both of us were half wet and half dry
the dry half I had brought along
the wet part , perhaps , is still lying by the bed
send it across...
a hundred and sixteen moonlit nights
the lone mole on your shoulder
the aroma of still-moist henna
a few complaints that were forged
a few false promises too
let me remind you of them all...
send them all back to me
return to me what is mine...

but grant me this one last wish
that when I bury these memories
may I bury myself there too...

একদিন, একদিন না একদিন, এমন একটা জীবনে চলে যাব ঠিকঠিক!
অর্থ নয়, কীর্তি নয়... কত তুচ্ছ, কত অর্থহীন স্বপ্নসাধের খড়কুটো, কত যত্নেই না আগলে রাখে মানুষ!

ডিসেম্বর ২০১১
-------------------------------

।।ষোল।।

কোন কোন দিন কম্পিউটারের স্ক্রিনে হাত বুলিয়ে বৃষ্টি ছোঁয়া যায়!

অন্তহীন অনিঃশেষ বরষা নামুক চরাচর জুড়ে, জানালার ধারের পয়জন আইভির ঝাড়টা কোন জাদুবলে সন্ধ্যামালতী হয়ে যাক, টালির ছাদের সোলার প্যানেলটা ঢেউটিনের চালা হয়ে টেনে আনুক অযুতনিযুত অলৌকিক বর্শাফলা, ফায়ার হাইড্র্যান্টের বদলে উঠোনের একপাশে একাকী ভিজুক জংধরা চাপকল, ভিজতে ভিজতে চুপসে যাক নারকেলের ছাড়ানো খোসা, ছিঁড়ে যাক কাগজের এরোপ্লেন... য়ো কাগজ কি কাশতি য়ো বারিষ কা পানি...........

এপ্রিল ২০০৯
-------------------------------

।।পনের।।

চুড়ির শব্দটা খুব ছন্দময়, নূপুরেরও...
তারপরও সবচেয়ে আদুরে বাজনা হলো টলমল পায়ে সদ্য-হাঁটতে-শেখা শিশুর হাতের ঝুমঝুমি।
ছোট্ট গোল টিপ আমার পছন্দ...
পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর টিপটাও পরে অনূর্ধ্ব এক-এর শিশু, কপালের একপাশে মায়ের আঙুলডগার কাজলছোপে।

জানুয়ারি ২০১৩

-------------------------------

।।চৌদ্দ।।

"কত চিঠি লেখে লোকে
কত সুখে প্রেমে আবেগে স্মৃতিতে
কত দুঃখে ও শোকে..."

স্বার্থে-টা বাদ গেছে, হে সুকান্ত!

মে ২০১২
-------------------------------

।।তেরো।।

বসন্তদিন এল বাংলাদেশে, এখানে নয়

আমি অপেক্ষা করব
আমি অপেক্ষা করব
আমি অপেক্ষা করব
আ মি অ পে ক্ষা ক র ব
আ মি অ পে ক্ষা ক র ব
আ মি অ পে ক্ষা ক র ব
আ মি অ পে ক্ষা ক র ব
আ মি অ পে ক্ষা ক র ব

-------------------------------

।।বারো।।

পৃথিবীর অনেক দেশেইতো হিজাব/নিকাব/বোরকা জাতীয় পোশাক পরতে হয়, সেসব দেশে কি হিজাব/নিকাব/বোরকা না পরার স্বাধীনতা আছে? আরো পরিস্কার করে বলি, একটা ইসলামী শাসনতান্ত্রিক দেশে (কারেন্ট স্ট্যান্ডার্ড না, আদর্শ ইসলামী অনুশাসন বলি) কোন অমুসলিম বা মুসলিম নারীর কি হিজাব/নিকাব/বোরকা না পরার অধিকার থাকবে? উত্তর হ্যাঁ বা না হবে।

সহব্লগার রোবোট বরাবরই গোছানো যুক্তিতে কথা বলেন। যারা বলেন- নারীরা হিজাব স্বেচ্ছায় পরে, কেউ চাপিয়ে দেয় না- তারা এই প্রশ্নের জবাব এড়িয়ে যান। মেলবোর্নে চারজন ইরানী তরুণীর সঙ্গে সখ্য ছিল; সবাই উচ্চশিক্ষারত মেধাবী মুসলমান; প্রত্যেকের একই গল্প- শেষবার বোরকা/হিজাব পরেছিল প্লেনে ওঠার সময়। একাকী চলাফেরায় নিয়ন্ত্রণারোপ, গাড়ি চালানোতে নিষেধাজ্ঞা আর পোশাকের ওপর খবরদারির কারণে দেশে ফিরে যেতে চাইত না তাদের কেউই; একজন একটি অস্ট্রেলিয়ান ক্রিশ্চান ছেলেকে বিয়েও করে ফেলে, বাকিরাও পাত্র খুঁজছিল...

--------------------------------

।।এগারো।।

যুদ্ধাপরাধী ও তাদের দোসরমুক্ত দেশ হোক আমাদের।
জয়তু প্রজন্ম চত্বর!
ব্লগার হিসেবে গর্বিত।

ফেব্রুয়ারি ২০১৩

----------------------------------

।।দশ।।

বাচ্চু রাজাকার ওরফে মাওলানা আবুল কালাম আজাদের ফাঁসির আদেশ হলো। "বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ" পরিচয়ে এটিএন বাংলা আর এনটিভিতে বহুদিন বয়ান করেছে এই বরাহ; তার মুখে বিসমিল্লাহ্ বলা ছাড়া তৈরি খাবারের বিপদ শুনে পুজোর সময় প্রতিবেশির বাড়ি থকে আসা নাড়ুসন্দেশের থালা উল্টে ভাগাড়ে ফেলার বেদনাদায়ক দৃশ্যটি মনে পড়ে গেল।
সাপ মেরে ফেলা যায়; বিষ রয়ে যায়।

জানুয়ারি ২০১৩

----------------------------------

।।নয়।।

আজকের প্রথম আলোর প্রথম পাতা জুড়ে সুসংবাদ। মাতৃত্বকালীন ছুটি বাড়িয়ে ছয়মাস করা হয়েছে, নারীবান্ধব-শিশুবান্ধব রাষ্ট্র আমাদের। নারীমঞ্চ পাতা আলো করে আছেন বিরাশি বছরেও বেগমের সম্পাদক নূরজাহান বেগম। কমবেশি সব পাতাতেই নারীর ক্ষমতায়নের নবতর নজির সৃষ্টির অপেক্ষায় পৌর নির্বাচনের বহু মহিলা প্রার্থী। এতোসবের মধ্যে বিশাল বাংলা পাতার ঝাপসামতো ছবিটি। কীর্তনখোলা নদীতে খেয়া পারাপার করছেন এক নারী; এক হাত ধরেছে বৈঠা, আরেক হাত আগলে আছে কাঁথামোড়ানো মানবশিশু। ছবি দেখে অনুমান করা সহজ, শিশুটির বয়স বড়জোর দুতিন মাস। ছবিটি সকালবেলায় তোলা; গতকাল দক্ষিণাঞ্চলে ঘন কুয়াশার জন্য বেলা এগারোটা পর্যন্ত ফেরি চলাচল বন্ধ থাকার খবরও কাগজের অন্যত্র আছে। সর্বনিম্ন তাপমাত্রা গেছে ৬.৩'সে.।

ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গলে ঈশ্বরী পাটনী খেয়ানৌকায় পা-রাখার অংশের কাঠ সোনা হয়ে যেতে বুঝেছিলেন, দেবী এসেছেন যাত্রী হয়ে। দেবীর কাছে বর চেয়েছিলেন- আমার সন্তান যেন থাকে দুধেভাতে। খেয়াঘাটের পাটনীর পেশা যার, সেই ঈশ্বরী পাটনী নারী নাকি পুরুষ-- একথা স্পষ্ট করে বলেনি অন্নদামঙ্গল। আমার ব্যক্তিগত ধারণায় তিনি নারী। ধনসম্পদ-বিত্তবৈভব কিছুই না, সন্তানের সুখময় জীবনযাপনের অতিরিক্ত কোন চাহিদা যার নেই, তিনি জননী ছাড়া আর কে হতে পারেন!

নিরাপদ কর্মক্ষেত্র অথবা মাতৃত্বকালীন ছুটির আওতা থেকে বহু বহু দূরের, বরিশালের কীর্তনখোলা নদীর রসুলপুর খেয়াঘাটের সেই ঈশ্বরী পাটনীর প্রতি আমার আভূমি প্রণাম।

ডিসেম্বর ২০১০

----------------------------------

।।আট।।

দেবব্রতের মেইল পেলাম, উত্তর দেয়া হলো না ওকে আপনি না তুমি কোনটা বলতাম মনে পড়ল না বলে। কী অদ্ভুত, একসময়ের সহকর্মী নিজেও ভাববাচ্যে ঝামেলা মিটিয়েছে! "নাটোরের প্রসঙ্গ এলে সবার আগে কী মনে পড়ে?"- এমন প্রশ্নের জবাবে "জীবনানন্দ" বলে একদিন দেবব্রতকে খুব হাসিয়েছিলাম। ওর ধারণা, চোখ বুজে থাকলে বনলতা সেন, আর চোখ খুলে থাকলে এলাচগন্ধী কাঁচাগোল্লা! এ বিষয়ে নাটোরের ছেলে যাই বলুক, মেনে নেয়া দস্তুর।

জীবনানন্দের কবিতায় তাঁর নিজের জেলা বরিশালের নাম কি এসেছে কখনও? মনে করতে পারছি না।

সেই মুখ মনে পড়ে, সেই গান,
সেই সন্ধ্যাতারা
এখন নেমেছে মেঘ, এখন বর্ষার জলধারা
মনে হয় ফিরে যাই সেই নদী আকাশের কাছে
হয়তো এখনো কেউ গান গায়, কেউ বসে আছে
কি যেন সে তার নাম, সেও তা হয়েছে কতকাল
জীবনানন্দের বাড়ি, মন বলে যাই বরিশাল।

পুরনো ডায়রির পাতা খুলে দেখি পেপার-কাটিং সাঁটা; মহাদেব সাহার মতো আমারও মন বলছে- যাই বরিশাল...

জুন ২০১০

----------------------------

।।সাত।।

শাশ্বত স্বপনের ফিরতি মন্তব্য পড়ে মনটা খারাপ হলো... হয়তো সরল মনেই লেখা ছাপানোর কথা বলেছিলেন, রুড প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে ফেলেছি... নার্ভ ধরে রাখা শেখার এখনও অনেক বাকি... চতুরের পাতায় অচেনা প্রকাশক, ঢাকা-চাটগাঁর জনাদুতিনেক... তাঁদের জানার কথা না, এ ধরনের কথা শোনার পূর্ব-অভিজ্ঞতা কেমন হতে পারে... উৎসাহও এখন আর নিঃস্বার্থ নয়; আজ যিনি বিপুল উদারতায় কোন আনপড়কে অনুপ্রেরণা দিয়ে মুদ্রণমাধ্যমের জন্য লিখতে বলেন, দুদিন পর তাঁর মুখে শোনা যায় "লেখালেখির জগতে ঢোকার" জন্য সেই আনপড় তাঁর কত ক্ষয়ক্ষতি করেছে...

লাভলোকসানের হিসাব আমার তোলা থাক জন্মের মতো, অন্তহীন চক্রবৃদ্ধি মুনাফায় থাকুক সবাই............

জানুয়ারি ২০১৩

------------------------------

।।ছয়।।

- আমি একটা লেমোনেড স্ট্যান্ড দিতে চাই, কন্যার মুখ গম্ভীর।

ওর আশাআকাঙ্ক্ষাগুলো বিচিত্র। বিশাল বড় একটা ফুলের মাঝখানে সে শুয়ে আছে, সেই ফুলটা আবার দুটো পাতার ডানা মেলে মেঘের মধ্য দিয়ে উড়ে যাচ্ছে - এমন একটা কর্মপরিকল্পনা তার আছে। ফুলছাপের ওয়াড়ের বালিশের ওপর শুয়ে-বসে এই উড্ডয়নকর্মের প্র্যাকটিস চলে প্রতি রাতে, ঘুম না আসা পর্যন্ত। সমুদ্রের ঢেউয়ের মধ্যে মারমেইড হয়ে ভেসে বেড়ানো আরেকটা ইচ্ছে। একদম বিপরীত মেরুতে দমকলবাহিনীর ফায়ারট্রাক, রাস্তাঘাটে দেখা বুলডোজার- ক্রেনের মতো বিটকেল বাহনের চালক হবার বাসনাও আছে। এই তালিকায় নবতম সংযোজন ঠেলাগাড়িতে শরবতের দোকানদারি। শিশুদের "না" বলায় মানা আছে।

- ঠিক আছে, দেবে। বাইরে একফুট স্নো, এটা গলে যাক, সামার আসুক, তারপর। আচ্ছা এখন ধর, এষা আর আয়লা তোমার কাছ থেকে একগ্লাস করে লেমোনেড নিল। প্রতিগ্লাসের দাম এক টাকা। তোমাকে এষা দিল একটাকা আর আয়লা দিল একটাকা। তাহলে তোমার কত টাকা হবে?
- ওদেরকে আমি ফ্রি খেতে দেব, টাকা নেব না (ফ্রি ব্যাপারটা সে সদ্য শিখেছে; গোনাগুন্তির হিসাব তার প্রায় আসেই না)
- ও। তা কোথায় হবে তোমার লেমোনেড স্ট্যান্ড?
- বাসার পিছনে, গাছের নীচে ঘাসের উপর।
- ওখানে তো কেউ যায় না, কে খাবে শরবত!
- ওখানে পাখিরা আসে। কাঠবিড়ালিও আসবে।
- আহা, ওরা তোমার স্ট্যান্ড নোংরা করে দেবে। তুমি বরং এক কাজ করো... নদীর ধারে, অথবা সিটি সেন্টারের সামনে ফুটপাথে, অথবা স্কুল বা মিউজিয়ামের সামনে এমন একটা জায়গায় স্ট্যান্ড দাও, যেখানে মানুষ আসা-যাওয়া করবে। তোমার স্ট্যান্ড দেখে ওরা আসবে, লেমোনেড খাবে, তারপর তোমাকে লেমোনেডের দাম দিয়ে যাবে। ব্যাকইয়ার্ডে দোকান দিলে কেউ আসবে না!
- না, অন্য কোথাও যাব না। আমি স্ট্যান্ড দিতে চাই আমার প্রিয় জায়গায়। শুধু এই জায়গাটাই আমার পছন্দের।

ফেব্রুয়ারি ২০১৩

------------------------------

।।পাঁচ।।

রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের "কাদম্বরী দেবীর সুইসাইড নোট" উপন্যাসটি খুব জনপ্রিয়তা পেয়েছে; বিপণনের এমন যুগে কেউ পিছিয়ে নেই; কলকাতার বাংলা টিভি চ্যানেলে নিজের বইটি হাতে নিয়ে গর্বিত ভঙ্গিতে বিজ্ঞাপনের মডেল হিসেবে লেখক নিজেই জানাচ্ছেন- মাত্র চার মাসে (নাকি সপ্তাহে?) প্রকাশিত হলো সাতটি সংস্করণ...

বইটি তেমন "না চললে" বিজ্ঞাপনের ভাষা কেমন হতো? লেখক কি এমন কিছু বলতেন- গভীরতাসম্পন্ন লেখার পাঠক খুব বেশি নেই। আপনি কি সেরকম পাঠক? তাহলে পড়ুন আমার সাম্প্রতিক বই...

অক্টোবর ২০১২

------------------------------

।।চার।।

জলবৎ তরলং, পানির মতো সোজা, জলের মতো সহজ- কথায় কথায় কতবার বলি! আসলেই কি খুব সহজ-সরল এই জল বস্তুটি? মনে হয় না। পানি একটা বহুরূপী। ঠাণ্ডায় জমবে, গরমে ভাপ হয়ে উড়ে যাবে। পিপাসার কষ্ট মেটাবে, আবার বন্যায় ডোবাবে। চিনি মেশালে মিষ্টি হবে, লবণ দিলে নোনতা, বিষ ঢাললে বিষ। যে পাত্রে রাখা হবে তার রঙ দেখাবে, আকার নেবে। বহুরূপী মাত্রেই মহা জটিল, সহজ-সরল না।

চেনাজানা জগৎসংসারে আপাতসরলতার ট্রেডমার্ক এঁটে-থাকা মানুষজন আসলে পানির মতোই সহজ!

জুন ২০১১
------------------------------

।।তিন।।

যে কোন বই হাতে নিয়ে শুরুতে ফ্ল্যাপের লেখা পড়া হয়, পাশাপাশি উৎসর্গপত্রটিও একনজর দেখা হয়। খুব বেশি বৈচিত্র্য থাকে না তাতে। লেখকের পরিবারের সদস্য, বন্ধুবান্ধব অথবা অগ্রজ বা সমসাময়িক কোনো সতীর্থের নাম থাকে, বড়জোর একটা-দুটো আন্তরিক বাক্যের বরাদ্দ। কবি আহসান হাবীবের ‘প্রেমের কবিতা’ বইটির উৎসর্গপত্র সেদিক থেকে দারুণ ব্যতিক্রমী ও আকর্ষণীয়-

সুলেখা বন্দ্যোপাধ্যায় সুচরিতাসু
চল্লিশের দশকে আপনি থাকতেন হাজরা রোডে। এখন কোথায় জানা নেই। রসা রোডের দিকে এগিয়ে এলে ডান দিকের একতলা সাদা বাড়িটায় টুনুরাও থাকতো, মনে পড়ে? যদি ওর সঙ্গে দেখা হয়, বলবেন, আমি এই বইটি ওর নামেই উৎসর্গ করেছি। আর আপনি যদি মনে করেন, একটু ঘুরিয়ে এই বই আমি আপনারই নামে উৎসর্গ করছি, ভালো লাগবে তাও। তবে রিচি রোডে এসবের কিছুই জানবেন না, জবাবদিহি করে হয়রান হয়ে যাবো। আপনার ছোট বোন শ্রীলেখাকে কিছু বলবেন কি বলবেন না সে ভাবনা আপনার। আর আমার স্ত্রীকে যা বলবার আমিই বুঝিয়ে বলবো। অবশ্য এত কথা যখন উঠেছেই তখন, কৈশোরের জোবেদা, নূরজাহান, রমলা, আর প্রথম যৌবনের সেই সরুচেন শ্যামলাঘাড়, আরো সেই যে কলেজের পথে প্রায় নিত্যসঙ্গী নাম না জানা শ্যামাঙ্গিনী এরাই বা--- আসলে কি জানেন? এই উৎসর্গ-ফুৎসর্গের ব্যাপারে যাওয়াই উচিৎ হয় নি।
আহসান হাবীব
মাঘ। ১৩৮৭

জুন ১৯৯৯

-----------------------------
।।দুই।।

ভোর থেকে তীব্র বাতাসের চাবুক, উড়িয়ে আনছে অযুতনিযুত তুষারকণা ... ... ...

একসময় আমাদের চট্টগ্রামের বাসায় দেখতাম টিলার ওপর পুরনো গাছের গুঁড়ি থেকে সন্ধ্যে নামার সঙ্গে সঙ্গে শতসহস্র উইপোকা বেরিয়ে আসছে। বছরে দুবার নিয়ম করে ঘটত এই অদ্ভুত ঘটনাটি, প্রতি শীতের আগে-পরে দু্টো দিন সূর্যাস্তের পর পর। সূক্ষ্ম পাখায় বিজবিজ শব্দ আর অবিরাম কাঁপন তুলে কাছাকাছি স্ট্রিট লাইট অথবা বাসার ভেতরের কোন আলোর উৎসের দিকে ধেয়ে যেত উইপোকার ঝাঁক, তাদের স্বচ্ছ পাখায় ঝিকমিকিয়ে উঠত বিদ্যুতের আলো... কিছুক্ষণের মধ্যে সবগুলো পোকার পাখা ঝরে যেত ঝরঝরিয়ে, ঝরা পাতার মতো...

স্নো শাওয়ার অথবা ফ্লারিজ নামের এই ইলশেগুঁড়ি তুষারপাতের সঙ্গে সেই উইয়ের ঝাঁক অথবা বছরের প্রথম ঝিরিঝিরি বৃষ্টির কোথায় যেন মিল আছে... শুরু হতে দেখলেও ছুটে পালাতে ইচ্ছে করে না... গায়ে মেখে ঘোরাঘুরির সময়টা পেরিয়ে গেলেও ঝেড়ে ফেলতে ইচ্ছে করে না...

জানুয়ারি ২০১৩

-----------------------------

।।এক।।

সুমনের একটা গান আছে- রোদ্দুর। রোদের মতো প্রতিদিনের চেনাজানা প্রাকৃতিক অনুষঙ্গকে খুব একটা মনোযোগ দিয়ে খেয়াল করা হয় না। এই রোদ্দুর যে গাছের আড়ালে বাঘের মতো ওঁৎপেতে থাকে, কিংবা সবুজের ফাঁকে ফাঁকে হরিণের মতো ছোটে; এর রঙ যে সোনালী-বাদামী মেশা হতে পারে, অথবা জংলা গন্ধে হারিয়ে যাবার নেশা ধরাতে পারে; এতরকম বিশেষণে ভূষিত হতে পারে এই দিগ্বিজয়ী বিদ্রোহী রোদ্দুর- গানটা শোনার আগে তেমন করে ভাবিনি!

প্রচলিত বাংলা গানে দারুণ দহন দিন আছে, আছে শরতের আকাশ; হেমন্তের হিমঝরা রাত, পৌষের ফসলডালা। বসন্তের নতুন পাতা আর পলাশশিমুল থেকে জোছনা রাত, দখিনা বাতাস, মেঘমেদুর বর্ষাবন্দনা- সবই কমবেশি আছে; সে তুলনায় রোদমুগ্ধতা প্রায় অনুপস্থিত; অন্তত সুমনের গানটির আগে শোনা হয়নি। ঘোর বর্ষা কি শৈত্যপ্রবাহের আঙুলে-গোণা ক'টা দিন বাদ দিলে আমাদের দেশে সারাবছর রোদের দেখা মেলে, না চাইতেই। তাই কি এর মর্ম কিংবা সৌন্দর্য নিয়ে আমরা ভাবি কম?

বিপরীতে পশ্চিমের গানে রোদের তুমুল জয়গান; রোদ মেটায় সৌন্দর্যতৃষ্ণা, যোগান দেয় নির্ভরতা থেকে আনন্দাশ্রু- সবকিছুরই। সানশাইন অন মাই শোল্ডার্স গানে জন ডেনভার জানিয়ে দেন- প্রিয় মানুষটিকে বলার কোন গল্প থাকলে নিশ্চয়ই তা হবে আনন্দের; তার জন্য কিছু চাইবার থাকলে অবশ্যই তা হবে সার্বক্ষণিক রৌদ্রকরোজ্জ্বলতা। পশ্চিমের জলহাওয়ায় দীর্ঘমেয়াদী হিমশীতলতা আর একাকীত্ব একাকার হয়ে আছে বিটলসের গানে- লিটল ডার্লিং, ইটস বিন আ লং কোল্ড লোনলি উইন্টার। রোদ এলেই সবকিছু বদলে যাবে এক লহমায়- হিয়ার কামস দ্য সান, অ্যান্ড আই সে ইটস অল রাইট! বিচ্ছেদযন্ত্রণার তীব্রতার তুলনা চলে কেবল রোদ হারিয়ে ফেলার সঙ্গেই- এমনটা বুঝিয়ে দেয় শঙ্কিত সকাতর আকুতি- ডোন্ট টেইক মাই সানশাইন অ্যাওয়ে...

জীবনযাপনের বাস্তবতায় নাগরিক বর্ষার অভিজ্ঞতা যেমনই হোক, আমাদের বাঙালি-হৃদয়ের অন্তরতম যোগাযোগ সম্ভবত বর্ষা কিংবা বৃষ্টির সঙ্গেই- অন্তত গানের লিরিকের সূত্রে। যে কথা এ জীবনে রহিয়া গেল মনে, সে-কথাটি বলা যায় শুধু ঘনঘোর বরিষার এমন কোন দিনে- রবীন্দ্রনাথ যথাযথ বাতলে গিয়েছেন। তুমি এলে অনেক দিনের পরে যেন বৃষ্টি এল- হেমন্তের গান কবুল করছে কতজনের মনের কথা!
আর যদি না-ই বা এল কেউ, একাকীত্বের হাহাকারটুকুও বড় বেশি বাজে তেমন কোন দিনেই- বঁধু এমন বাদলে তুমি কোথা, আজ পড়িছে মনে কত কথা (অতুলপ্রসাদ)... অথবা এমনই বরষা ছিল সেদিন (প্রণব রায়- কমল দাশগুপ্ত), কিংবা এ ঘোর বাদলে নারি থাকিতে একা (নজরুল)।
শুধু কি ভরা বর্ষা, কালো মেঘের ছায়া ঘনিয়ে এলেও বড় একা লাগে এই আঁধারে, মেঘের খেলা আকাশ পারে (মান্না দে)।

তুষারপাত নিয়ে বাংলা গান নেই, অন্তত আমার জানা নেই। বর্ষাকাতর-স্মৃতিকাতর প্রবাসে, চরাচরজুড়ে তুষারজমা আঁধারঘোলা নিশূন্য একাকী দিনে, নজরুল বেজে ওঠেন বড় বেদনার মতো, পরদেশী মেঘের কাছে রাখা প্রশ্নে- সে দেশে যবে বাদল ঝরে, কাঁদে না কি প্রাণ কাহারো তরে?.............

ডিসেম্বর ২০১১
.
.
.
========================================================
অনেকদিন ব্লগ লেখা হয় না, আসলে কিছু লিখতেই ইচ্ছে করে না...
নোটপ্যাডে মাঝেমধ্যে ডায়রি লেখা হয়- (ঠিক দিনপঞ্জী-গোছের কিছু না, এসব হাবিজাবি কেন লিখি তার কারণটাও খুব স্পষ্ট না; সম্ভবত কথাগুলো কাউকে বলতে ইচ্ছে করে অথচ শোনার মতো কেউ নেই!)- ওখান থেকে সামান্য সম্পাদিত কিছু কপিপেস্ট এই পোস্টে যতদিন সম্ভব চালিয়ে যাবার ইচ্ছে রইল...‌>

যা দিনকাল পড়েছে, অকারণ স্নেহমমতার দেখা পাওয়া মুশকিল; তাছাড়া আমি যে প্রজন্মের একজন তাতে স্নেহ বর্ষানোর মতো খুব বেশি কেউ ব্লগে অন্তত নেই। যে দুচারজন আছেন; কেন যেন মনে হয়, কদিন পর পর এই তুচ্ছ পাতাটি তারা দেখে যান... ... তাদের একজনের জন্যই এই পোস্ট (কার কথা ভাবলাম, কে বলতে পারবেন? )।