অপরূপ এক স্বপ্ন দেখে এইমাত্র জেগে উঠলো সে।
এরকম স্বপ্ন এসময়ে দেখার কথা না তার। তবু দেখেছে এবং বিস্মিত হয়েছে। আবেশটা এখনো ছুঁয়ে আছে। ঘুম ভেঙ্গে গেলেও আধবোজা চোখে জানালা দিয়ে বাইরে তাকালো। বাইরে তখনো মিশমিশে কালো আঁধার। কিন্তু ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বুঝলো ভোরের সময় হয়ে এসেছে। কিন্তু ঘন মেঘলা বর্ষন ঢেকে রেখেছে চারদিক। একটানা বাতাসের সাথে তুমুল বৃষ্টি বাইরে।
এত ভোরে কখনো ঘুম ভাঙ্গে না তার। বরাবরই দেরীতে ঘুম ভাঙ্গা মানুষ ছিল। ছেলেবেলায় স্কুলে যেতে কষ্ট হতো ভোরবেলা। স্কুল শেষ হবার পর কলেজে কিছুদিন আরাম করার সাধ ছিল। শুনেছে কলেজে নাকি ক্লাস না করেও পরীক্ষা দেয়া যায়, কেউ কিচ্ছু বলে না। কথাটা শোনার পরপর কলেজে ওঠার জন্য তার ভেতর একটা স্বপ্ন জাগতে থাকে। ক্লাস এইট থেকেই সে নিজেকে কলেজে পড়ুয়া ভাবতে শুরু করে। কিন্তু সত্যি সত্যি যেদিন কলেজে উঠলো, মোহভঙ্গ হলো তার।
কলেজে দেরীতে গেলেও চলে, কিন্তু প্রাইভেট স্যারের বাসায় যাবার জন্য সেই সাতটায় উঠতে হতো। শীতকালে ভীষন কষ্ট। রিকশা নিয়ে চেরাগী পাহাড়ের পাশের গলিতে বিজয় স্যারের বাসা। বিজয় স্যার ফিজিক্স পড়াতেন। খুব নমনীয় একজন স্যার, আস্তে আস্তে বোঝাতেন, তার ভীষণ ভালো লাগতো এই স্যারকে। স্যারের বাসা থেকে বেরিয়ে খিদে পেয়ে যেতো। বন্ধুদের নিয়ে ঢুকে পড়তো গলির মুখে দস্তগীর রেস্তোরায়। সুগন্ধী সেঁকা পরোটা চায়ে ভিজিয়ে খেতে অপূর্ব লাগতো। তারপর আন্দরকিল্লায় গিয়ে মুড়ির টিন বাসে উঠে পড়তো। ২৫ পয়সা ভাড়া দিয়ে নিউ মার্কেট নেমে সিটি কলেজ।
কলেজে ক্লাস শেষে কোন কোন দুপুরবেলা কোন বন্ধুর আহবানে কলেজের লাগোয়া লায়ন সিনেমা হলে ঢুকে ৬ টাকার ব্যালকনি টিকেটে ১২-৩টার শো দিয়ে সেদিনের প্রাকটিক্যাল ক্লাসটা সেরে নেয়া হতো। এভাবে কতোবার যে ক্লাস ফাঁকি দিয়েছে! কখনোই ভালো ছাত্রের কাতারে ছিল না সে।
খারাপও হতে পারেনি সুযোগের অভাবে। সুযোগ পেলে নিশ্চয়ই সে এক বড় সড় রাজনৈতিক পান্ডা হতে পারতো। একবার সম্ভাবনাও দেখা দিয়েছিল। যখন তাকে বিনা দোষে হাজতবাস করিয়েছিল স্বৈরাচারী এরশাদ সরকার। বিদ্রোহী হয়ে উঠে রাজনৈতিক অস্ত্র তুলে নিতে চেয়েছিল হাতে। কিন্তু কেন যেন হওয়া হয়নি। আসলে নষ্ট রাজনীতি তখন থেকেই বিষময় হয়ে উঠেছিল তার কাছে।
আজ ভোরে ঘুম ভেঙ্গে কেন যেন সেই দিনগুলি ভেসে উঠলো চোখের সামনে। অথচ স্বপ্নটার কাছে ওই স্মৃতিগুলো একেবারেই অপ্রাসঙ্গিক। দেশে ফিরেছে তিন মাস হলো। এখনো মনে হয় অচেনা কোন দেশে চলে এসেছি ভুল করে। দীর্ঘ বারো বছর পর চেনা দেশটা অচেনা হয়ে গেল। যেখানে সে বাস করতো সেখানে চেনা কিছুই নেই। মাটির রাস্তাটা হয়ে গেছে চার লেইনের হাইওয়ে। বাড়ীর চারপাশের ধান ক্ষেতগুলো আকাশছোঁয়া দালানে ভরে গেছে। কোথাও এক ফোঁটা দম ফেলার জায়গা নেই। বিকট শব্দে ট্রাক বাস ছুটে যাচ্ছে একের পর এক। সন্ধ্যের পর বিশাল লম্বা জ্যাম লাগে। একটানা হৈ চৈ রাত এগারোটা অবধি। পুরোপুরি নিস্তব্ধ হয়না মাঝরাত পেরিয়ে গেলেও।
আজকের হাইওয়ে এই সেদিনও ছিল নির্জন জলাভূমি। ভাবতে কেমন লাগে। সন্ধ্যা হলেই সুনসান। টেবিলে পড়তে বসে জানালা দিয়ে মনটা উড়ে চলে যেতো কোথাও। আশেপাশে কোন ঘরবাড়ী ছিল না। দখিনের ঘরটাতে থাকতো সে। দখিনের জানালা দিয়ে দখিনো হাওয়া আসতো হু হু করে। ফ্যান লাগতো না তার। ঘরের মধ্যে আসবাব বলতে একটা চেয়ার একটা টেবিল। একটা চৌকি, দুটো বাশের কঞ্চির বুকশেলফ, আর একটা আলনা। এই নিয়ে ছিল তার নিজস্ব জগত। টেবিলে একটা আকাই স্টেরিও সেট।
সেখানে হারানো দিনের গান বাজতো। রবীন্দ্রসঙ্গীত বাজতো। "তুই ফেলে এসেছিস কারে মন মনরে আমার......." এত প্রিয় ছিল গানটা তখন! গাইতে গিয়ে তার চোখে জল এসে যেত। অথচ সে কাউকে হারায়নি তখনো পর্যন্ত। যখন সত্যি সত্যি হারিয়েছে তখন আর একটা গানও বাজেনি, কোথাও কোন সুর বাজে নি আর।
আজ শেষ রাতের স্বপ্নটিতে কি ছিল? সুন্দর একটা অবাস্তব দৃশ্য। নষ্টালজিক কোন উপাদান ছিল না। তবু বারবার সে ফিরে যাচ্ছে পুরোনো দিনে।
মানুষ বদলে যায়। সময় সবকিছুর বদলের কারিগর। বদলে গেলে কি চেনা মানুষও অচেনা হয়ে যায়? বারো বছর পর দেশে ফিরে সবকিছু অচেনা লাগছে। অনেক কিছু হারিয়ে গেছে। অনেক স্মৃতি মুছে গেছে। এরকমই হবার কথা। কিন্তু বদলে যাওয়ার কষ্ট তাকে এমন পোড়ায় কেন। ফিরে এসে প্রথমেই খুঁজেছে যা খোঁজা উচিত নয় তার খোঁজ নিতে গিয়ে কি বিড়ম্বিত হয়েছে তা কাউকে বলাও যায় না।
মানুষ বদলে যায় সময়ের প্রয়োজনে নাকি নিজের প্রয়োজনে? এতখানি বদলে যাওয়া কি করে সম্ভব? বারো বছর কি খুব দীর্ঘ সময়? চেনা মানুষ এত অচেনা হয়ে যায় কেন? অনুভুতি ব্যাপারটা কি চিরকাল আপেক্ষিক? যখন যার তখন তার- আলাদিনের চেরাগের মতো। প্রতিটি মানুষ কি একেকটি আলাদিনের চেরাগ? যার হাতে পড়বে তার ঘষাতেই হুকুম তামিল করবে। কি অদ্ভুত!
মানুষের মনের চেয়ে পরিবর্তনশীল বস্তু এই জগতে সৃষ্টি হয়নি। কত মিথ্যা বিশ্বাসে কত প্রাণ অহেতুক ঝরে যায়। কত জীবন নষ্ট হয়ে যায় ভুল বিশ্বাসে। যে ফুলের আয়ু মাত্র একদিন সেও প্রতিশ্রুতি দেয় আজীবন সুগন্ধ বিলানোর। এত আত্মপ্রতারণা। তবু জেনে শুনে বিশ্বাসে গা ভাসায় মানুষ।
আগে কখনো এত গভীরভাবে চিন্তা করেনি। আজকের স্বপ্নটা সব উলটপালট করে দিল। স্বপ্নটা মিথ্যা। মিথ্যা হলেও সুন্দর। মুগ্ধ করে রেখেছে তাকে। স্মৃতির পরতে পরতে যে আনন্দগুলি বিষাদের আবরনে ঢাকা ছিল, আজ বিষাদের ব্যান্ডেজ খুলে তাকে ডেকে বলেছে, আসো আমি মরিনি, এখনো আছি বেঁচে। তুমি আসো, নতুন করে বাঁচো। আমি ভুলিনি তোমাকে। তুমি যা দেখেছো তা দুঃস্বপ্নমাত্র। এই দেখো আমাকে। আমি আছি, আমিই সত্যি। আমার কাছেই থাকো তুমি।
ঘুম ভেঙ্গে গেলো তার। তারপর থেকেই মনের ওলটপালট চলছে। এমন মিথ্যা কেউ বলে। সে তো কখনো এমন মিথ্যাবাদী ছিল না। স্বপ্নে এমন ডাহা মিথ্যা বলতে পারলো?
এই মিথ্যা স্বপ্নও তার বুকে দ্রিম দ্রিম করে বাজাতে লাগলো অনুভুতির ঢোল। যে অনুভুতি সে কবর দিয়ে রেখেছিল বারোটি বছর। হঠাৎ সে ভাবতে লাগলো। এই যে জেগে উঠেছি, এটাও কোন স্বপ্ন নয়তো? বাইরের বৃষ্টির ঝিরঝির শব্দ। বিজলীর চমক। অন্ধকার। সবকিছুই স্বপ্ন নাতো?
মশারির বাইরে একটা ছায়া এসে দাঁড়ালো। এলোচুলে দাঁড়ানো। কে? এই ঘরে তো আর কেউ নেই। বিদেশ থেকে আসার পর এই হোটেলে তিনমাস ধরে বাস করছে সে। রুমের দরোজা বন্ধ। কিন্তু এই নারীমূর্তি কোথা থেকে এলো? হঠাৎ ভয়ে গা শির শির করে উঠলো তার। একটু আগের জেগে ওঠা প্রেমানুভুতিময় স্বপ্নের অপমৃত্যু ঘটলো নিমেষে।
বহু বছর আগে এক রাতে এরকম একটা অচেনা মূর্তি তার বুকের উপর চেপে বসেছিল। গলার ওপর দুহাতের সাড়াশি চাপ। দম বন্ধ হয়ে উঠছিল তার। মরে যেতে যেতে প্রচন্ড চীৎকারে জেগে উঠতে চাইছিল। কিন্তু কেউ তার ডাক শুনতে পাচ্ছিল না। একেবারে শেষ পর্যায়ে গোঁ গোঁ শব্দ শুনে মা ছুটে এসেছিল পাশের ঘর থেকে। তাকে ধাক্কা দিয়ে জাগিয়ে তুলেছিল। বলেছিল, খোকা উঠ, তোকে বোবায় ধরেছে খোকা। জেগে উঠ নইলে মারা যাবি। সে জেগে উঠে দেখে সারা শরীর ঘেমে ভিজে জবজবে হয়ে গেছে।
মশারির পাশে দাঁড়ানো আবছা নারী মূর্তিটা দেখলো সে আবারো। আজকে সে একা। এই হোটেলে আশেপাশের ঘরে কেউ নেই। প্রায়ই খালি থাকে হোটেলটি। এই বর্ষা সিজনে গ্রাহক কম। চিৎকার করলেও কেউ শুনবে না। আজ কে তাকে বাঁচাবে? কে জাগাবে তাকে?
প্রেম খেদ দুঃখ কষ্ট সব ছাড়িয়ে তার মধ্যে জেগে থাকে একটাই অনুভুতি- ভয়। স্বপ্নের ভেতরে আরেক স্বপ্নের প্রতারণায় আবদ্ধ সে। প্রথম স্বপ্নটা দেখে ঘুমিয়ে থাকলেই ভালো ছিল। ঘুমের মধ্যে কেউ বুকের উপর চেপে বসলেও টের পেত না। মৃত্যুভয় কি ঘুমেও জেগে থাকে? কে জানে। আসন্ন পরিণতির জন্য তৈরী হলো সে।
এরকম স্বপ্ন এসময়ে দেখার কথা না তার। তবু দেখেছে এবং বিস্মিত হয়েছে। আবেশটা এখনো ছুঁয়ে আছে। ঘুম ভেঙ্গে গেলেও আধবোজা চোখে জানালা দিয়ে বাইরে তাকালো। বাইরে তখনো মিশমিশে কালো আঁধার। কিন্তু ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বুঝলো ভোরের সময় হয়ে এসেছে। কিন্তু ঘন মেঘলা বর্ষন ঢেকে রেখেছে চারদিক। একটানা বাতাসের সাথে তুমুল বৃষ্টি বাইরে।
এত ভোরে কখনো ঘুম ভাঙ্গে না তার। বরাবরই দেরীতে ঘুম ভাঙ্গা মানুষ ছিল। ছেলেবেলায় স্কুলে যেতে কষ্ট হতো ভোরবেলা। স্কুল শেষ হবার পর কলেজে কিছুদিন আরাম করার সাধ ছিল। শুনেছে কলেজে নাকি ক্লাস না করেও পরীক্ষা দেয়া যায়, কেউ কিচ্ছু বলে না। কথাটা শোনার পরপর কলেজে ওঠার জন্য তার ভেতর একটা স্বপ্ন জাগতে থাকে। ক্লাস এইট থেকেই সে নিজেকে কলেজে পড়ুয়া ভাবতে শুরু করে। কিন্তু সত্যি সত্যি যেদিন কলেজে উঠলো, মোহভঙ্গ হলো তার।
কলেজে দেরীতে গেলেও চলে, কিন্তু প্রাইভেট স্যারের বাসায় যাবার জন্য সেই সাতটায় উঠতে হতো। শীতকালে ভীষন কষ্ট। রিকশা নিয়ে চেরাগী পাহাড়ের পাশের গলিতে বিজয় স্যারের বাসা। বিজয় স্যার ফিজিক্স পড়াতেন। খুব নমনীয় একজন স্যার, আস্তে আস্তে বোঝাতেন, তার ভীষণ ভালো লাগতো এই স্যারকে। স্যারের বাসা থেকে বেরিয়ে খিদে পেয়ে যেতো। বন্ধুদের নিয়ে ঢুকে পড়তো গলির মুখে দস্তগীর রেস্তোরায়। সুগন্ধী সেঁকা পরোটা চায়ে ভিজিয়ে খেতে অপূর্ব লাগতো। তারপর আন্দরকিল্লায় গিয়ে মুড়ির টিন বাসে উঠে পড়তো। ২৫ পয়সা ভাড়া দিয়ে নিউ মার্কেট নেমে সিটি কলেজ।
কলেজে ক্লাস শেষে কোন কোন দুপুরবেলা কোন বন্ধুর আহবানে কলেজের লাগোয়া লায়ন সিনেমা হলে ঢুকে ৬ টাকার ব্যালকনি টিকেটে ১২-৩টার শো দিয়ে সেদিনের প্রাকটিক্যাল ক্লাসটা সেরে নেয়া হতো। এভাবে কতোবার যে ক্লাস ফাঁকি দিয়েছে! কখনোই ভালো ছাত্রের কাতারে ছিল না সে।
খারাপও হতে পারেনি সুযোগের অভাবে। সুযোগ পেলে নিশ্চয়ই সে এক বড় সড় রাজনৈতিক পান্ডা হতে পারতো। একবার সম্ভাবনাও দেখা দিয়েছিল। যখন তাকে বিনা দোষে হাজতবাস করিয়েছিল স্বৈরাচারী এরশাদ সরকার। বিদ্রোহী হয়ে উঠে রাজনৈতিক অস্ত্র তুলে নিতে চেয়েছিল হাতে। কিন্তু কেন যেন হওয়া হয়নি। আসলে নষ্ট রাজনীতি তখন থেকেই বিষময় হয়ে উঠেছিল তার কাছে।
আজ ভোরে ঘুম ভেঙ্গে কেন যেন সেই দিনগুলি ভেসে উঠলো চোখের সামনে। অথচ স্বপ্নটার কাছে ওই স্মৃতিগুলো একেবারেই অপ্রাসঙ্গিক। দেশে ফিরেছে তিন মাস হলো। এখনো মনে হয় অচেনা কোন দেশে চলে এসেছি ভুল করে। দীর্ঘ বারো বছর পর চেনা দেশটা অচেনা হয়ে গেল। যেখানে সে বাস করতো সেখানে চেনা কিছুই নেই। মাটির রাস্তাটা হয়ে গেছে চার লেইনের হাইওয়ে। বাড়ীর চারপাশের ধান ক্ষেতগুলো আকাশছোঁয়া দালানে ভরে গেছে। কোথাও এক ফোঁটা দম ফেলার জায়গা নেই। বিকট শব্দে ট্রাক বাস ছুটে যাচ্ছে একের পর এক। সন্ধ্যের পর বিশাল লম্বা জ্যাম লাগে। একটানা হৈ চৈ রাত এগারোটা অবধি। পুরোপুরি নিস্তব্ধ হয়না মাঝরাত পেরিয়ে গেলেও।
আজকের হাইওয়ে এই সেদিনও ছিল নির্জন জলাভূমি। ভাবতে কেমন লাগে। সন্ধ্যা হলেই সুনসান। টেবিলে পড়তে বসে জানালা দিয়ে মনটা উড়ে চলে যেতো কোথাও। আশেপাশে কোন ঘরবাড়ী ছিল না। দখিনের ঘরটাতে থাকতো সে। দখিনের জানালা দিয়ে দখিনো হাওয়া আসতো হু হু করে। ফ্যান লাগতো না তার। ঘরের মধ্যে আসবাব বলতে একটা চেয়ার একটা টেবিল। একটা চৌকি, দুটো বাশের কঞ্চির বুকশেলফ, আর একটা আলনা। এই নিয়ে ছিল তার নিজস্ব জগত। টেবিলে একটা আকাই স্টেরিও সেট।
সেখানে হারানো দিনের গান বাজতো। রবীন্দ্রসঙ্গীত বাজতো। "তুই ফেলে এসেছিস কারে মন মনরে আমার......." এত প্রিয় ছিল গানটা তখন! গাইতে গিয়ে তার চোখে জল এসে যেত। অথচ সে কাউকে হারায়নি তখনো পর্যন্ত। যখন সত্যি সত্যি হারিয়েছে তখন আর একটা গানও বাজেনি, কোথাও কোন সুর বাজে নি আর।
আজ শেষ রাতের স্বপ্নটিতে কি ছিল? সুন্দর একটা অবাস্তব দৃশ্য। নষ্টালজিক কোন উপাদান ছিল না। তবু বারবার সে ফিরে যাচ্ছে পুরোনো দিনে।
মানুষ বদলে যায়। সময় সবকিছুর বদলের কারিগর। বদলে গেলে কি চেনা মানুষও অচেনা হয়ে যায়? বারো বছর পর দেশে ফিরে সবকিছু অচেনা লাগছে। অনেক কিছু হারিয়ে গেছে। অনেক স্মৃতি মুছে গেছে। এরকমই হবার কথা। কিন্তু বদলে যাওয়ার কষ্ট তাকে এমন পোড়ায় কেন। ফিরে এসে প্রথমেই খুঁজেছে যা খোঁজা উচিত নয় তার খোঁজ নিতে গিয়ে কি বিড়ম্বিত হয়েছে তা কাউকে বলাও যায় না।
মানুষ বদলে যায় সময়ের প্রয়োজনে নাকি নিজের প্রয়োজনে? এতখানি বদলে যাওয়া কি করে সম্ভব? বারো বছর কি খুব দীর্ঘ সময়? চেনা মানুষ এত অচেনা হয়ে যায় কেন? অনুভুতি ব্যাপারটা কি চিরকাল আপেক্ষিক? যখন যার তখন তার- আলাদিনের চেরাগের মতো। প্রতিটি মানুষ কি একেকটি আলাদিনের চেরাগ? যার হাতে পড়বে তার ঘষাতেই হুকুম তামিল করবে। কি অদ্ভুত!
মানুষের মনের চেয়ে পরিবর্তনশীল বস্তু এই জগতে সৃষ্টি হয়নি। কত মিথ্যা বিশ্বাসে কত প্রাণ অহেতুক ঝরে যায়। কত জীবন নষ্ট হয়ে যায় ভুল বিশ্বাসে। যে ফুলের আয়ু মাত্র একদিন সেও প্রতিশ্রুতি দেয় আজীবন সুগন্ধ বিলানোর। এত আত্মপ্রতারণা। তবু জেনে শুনে বিশ্বাসে গা ভাসায় মানুষ।
আগে কখনো এত গভীরভাবে চিন্তা করেনি। আজকের স্বপ্নটা সব উলটপালট করে দিল। স্বপ্নটা মিথ্যা। মিথ্যা হলেও সুন্দর। মুগ্ধ করে রেখেছে তাকে। স্মৃতির পরতে পরতে যে আনন্দগুলি বিষাদের আবরনে ঢাকা ছিল, আজ বিষাদের ব্যান্ডেজ খুলে তাকে ডেকে বলেছে, আসো আমি মরিনি, এখনো আছি বেঁচে। তুমি আসো, নতুন করে বাঁচো। আমি ভুলিনি তোমাকে। তুমি যা দেখেছো তা দুঃস্বপ্নমাত্র। এই দেখো আমাকে। আমি আছি, আমিই সত্যি। আমার কাছেই থাকো তুমি।
ঘুম ভেঙ্গে গেলো তার। তারপর থেকেই মনের ওলটপালট চলছে। এমন মিথ্যা কেউ বলে। সে তো কখনো এমন মিথ্যাবাদী ছিল না। স্বপ্নে এমন ডাহা মিথ্যা বলতে পারলো?
এই মিথ্যা স্বপ্নও তার বুকে দ্রিম দ্রিম করে বাজাতে লাগলো অনুভুতির ঢোল। যে অনুভুতি সে কবর দিয়ে রেখেছিল বারোটি বছর। হঠাৎ সে ভাবতে লাগলো। এই যে জেগে উঠেছি, এটাও কোন স্বপ্ন নয়তো? বাইরের বৃষ্টির ঝিরঝির শব্দ। বিজলীর চমক। অন্ধকার। সবকিছুই স্বপ্ন নাতো?
মশারির বাইরে একটা ছায়া এসে দাঁড়ালো। এলোচুলে দাঁড়ানো। কে? এই ঘরে তো আর কেউ নেই। বিদেশ থেকে আসার পর এই হোটেলে তিনমাস ধরে বাস করছে সে। রুমের দরোজা বন্ধ। কিন্তু এই নারীমূর্তি কোথা থেকে এলো? হঠাৎ ভয়ে গা শির শির করে উঠলো তার। একটু আগের জেগে ওঠা প্রেমানুভুতিময় স্বপ্নের অপমৃত্যু ঘটলো নিমেষে।
বহু বছর আগে এক রাতে এরকম একটা অচেনা মূর্তি তার বুকের উপর চেপে বসেছিল। গলার ওপর দুহাতের সাড়াশি চাপ। দম বন্ধ হয়ে উঠছিল তার। মরে যেতে যেতে প্রচন্ড চীৎকারে জেগে উঠতে চাইছিল। কিন্তু কেউ তার ডাক শুনতে পাচ্ছিল না। একেবারে শেষ পর্যায়ে গোঁ গোঁ শব্দ শুনে মা ছুটে এসেছিল পাশের ঘর থেকে। তাকে ধাক্কা দিয়ে জাগিয়ে তুলেছিল। বলেছিল, খোকা উঠ, তোকে বোবায় ধরেছে খোকা। জেগে উঠ নইলে মারা যাবি। সে জেগে উঠে দেখে সারা শরীর ঘেমে ভিজে জবজবে হয়ে গেছে।
মশারির পাশে দাঁড়ানো আবছা নারী মূর্তিটা দেখলো সে আবারো। আজকে সে একা। এই হোটেলে আশেপাশের ঘরে কেউ নেই। প্রায়ই খালি থাকে হোটেলটি। এই বর্ষা সিজনে গ্রাহক কম। চিৎকার করলেও কেউ শুনবে না। আজ কে তাকে বাঁচাবে? কে জাগাবে তাকে?
প্রেম খেদ দুঃখ কষ্ট সব ছাড়িয়ে তার মধ্যে জেগে থাকে একটাই অনুভুতি- ভয়। স্বপ্নের ভেতরে আরেক স্বপ্নের প্রতারণায় আবদ্ধ সে। প্রথম স্বপ্নটা দেখে ঘুমিয়ে থাকলেই ভালো ছিল। ঘুমের মধ্যে কেউ বুকের উপর চেপে বসলেও টের পেত না। মৃত্যুভয় কি ঘুমেও জেগে থাকে? কে জানে। আসন্ন পরিণতির জন্য তৈরী হলো সে।
1 comment:
বাহ সুন্দর
Post a Comment