Sunday, January 18, 2009

বেদনার্ত হবার কিংবা বেদনা ভোলার অধিকার

একদিন.
১) হাড়তো জিরোয় না, কম্পুনি দিতে দিতেই সারারাত পার করিয়াছে। হাড়ের কী দোষ, হাড়ের উপর চামড়াখানা হাড়কে যথাযথ উপায়ে রক্ষা করিতে ব্যর্থ হইয়াছে। কম্পমান চর্মের উপর ঠক ঠক করিয়া সারারাত ঝাল ঝাড়িতেছে ২০৩ খানা শুকনো হাড়। চামড়াই বা কি করিবে, বেচারা একতিল উষ্ণ চর্বিযুক্তি মাংস কবে কোন কালে দেখিয়াছে তার কি ঠিক আছে। ফলাফল হাড়ে-চর্মে রাতব্যাপী ঠোকা-ঠুকি, ঠোকা-ঠুকি। চামড়ার উপরে কুয়াশায় আধভেজা কাঁথাখানা ঢুপ করিয়া বসিয়া আছে, যদিচ তাহা চাপিয়া রাখা বাদে আর কোন ভুমিকা রাখিয়াছে কিনা সন্দিহান। ঠকঠক তো থামে নাই একদন্ড। তবু মিনসের বাচ্চা দুটোরে চাপিয়া চুপিয়া ঢাকিয়া রাখিয়াছে। একটার নয় মাস আরেকটার দুই বছর। মরনঘুমে ঠাঠাইয়া পড়িয়া আছে দুটো। বাপের কুনো পাত্তা নাইক্কা। বাপ কেডা কেলা কইবো। আহাতের সুময় কুন বেডারটা কহন লাগিয়া গিয়াছে। বেডার দুষ নাই, সিকিমের মার একা একা লাগে জীবনে, বুড়োকাল আসিলে দেখিবে কে, এই চিন্তায় ঘুম আসিতো না। সে-ই চালাকিডা করিয়া দুইটা বাইচ্চা বাগাইছে মিনসেগো থেকে। মিনসেরা কাম সাইরা কথা কয় না আর। লাগাবি তো লাগাবি, কথা কবি না ক্যান। আমিও কম নাই, চালাকিডা করছি। দুই মিনসের কাছ থেকইক্যা দুইটা বাগাইছি। অহন অফুরাৎ জীবন তার এই নন্দনকাননের ফুটপাতে। সামনে সবুজ পাহাড়ের আধখানা খাড়াই। মুয়াজ্জিনের ডাক শেষে আধারেও একটু আশার আলো, শালার সূয্যিমামা আইবে কতক্ষন পর। হাড়-চামড়ার ঠোকা-ঠুকি কমিবে। ভোরের আলো ফুটিতে থাকে ধীরে ধীরে। ক্যাএএএএএ .......করে আধভেজা কাঁথায় নাড়ন দেয় ছুডো মিয়া। উল্টিয়ে দেখে পুরানা পত্রিকার বিছানায় মল-মুত্রের ছরছরানি। মর জালা আকাইম্যার বাইচ্চা-চিৎকার কইরা উঠে সিকিমের মা, চিরিৎকারের চোটে ধাম করি উঠি বসে ২ বছরের সিকিম। মাআআআ.... মনা আগু দিসে। মা'র পাল্টা ধমক আবার, চুপ হারামির পুত বানাজ্যার বাচ্চা। পাহাড়ে ধাক্কা খেয়ে ফেরত আসে সেই চিৎকার। ফুটপাতে হাঁটা মানুষ ফিরে তাকায়, পার্কে সাদা গেন্জী গায়ে জোয়ান বুড়ো ব্যায়ামী মানুষের কেউ কেউ চোখ ফেরায়। দুহাতে নেংটো বাচ্চার হাত ধরে ঝুলিয়ে রাখে সিকিমের মা। প্যান্টুতো ভিজিয়া গেইছে, গেন্জীটাও ভিজা। রোদ উঠিলে শুকাইবে প্যান্টু, তার আগে পেশাবের পানি ঝরায়া লই শরিল থেইক্যা।

২) সেই মুহুর্তে হুশ করে বেরিয়ে যায় নীল রঙের একটা সিডান গাড়ী। সময় সাড়ে ছটা পেরিয়েছে। গাড়ীর জানালা থেকে এক জোড়া নজর ফুটপাতে উপর দিয়ে গড়িয়ে যেতে ঝুলন্ত অর্ধনগ্ন শিশুটির সাথে আটকে যায় এক সেকেন্ড কিংবা আধসেকেন্ড। দৃশ্যটি ইমরাজের চোখে ভাসমান থাকে অফিস যাওয়া অবধি। সেই শিশুটি ঝুলন্ত অর্ধনগ্ন দেহ। ওই শিশুটা, ওই যে ঝুলানো শিশুটা, শীত নাই ওর? অফিসগাড়ির বদ্ধ আরামে উল জ্যাকেটের উষ্ণতার ভেতরেও শিউরে উঠে ইমরাজ। সামান্য দৃশ্যটা নাড়া দেয় তাকে প্রবলভাবে। ওর কিছু একটা করতে ইচ্ছা করে। ইচ্ছে করে এখুনি ছুটে গিয়ে শিশুটির গায়ে নরম কম্বল দিয়ে ঢেকে দেয়। আহারে কী কষ্ট ওদের, কী কষ্টে আছে খোদা। করুন চিন্তায় ডুবে যায় সে। কিছু একটা করতেই হবে এবার। বহুবছর ভাবছে। নিজের যা কিছু আছে তার থেকে কিছু একটা করার তাগিদ। এই শুক্রবার ভোরেই চলে আসবে ডিসি পার্কের সামনে। আগের রাতে কিনে রাখবে উষ্ণ কম্বল আর শীতের পোষাক। গেলবার রংপুরে পাঠিয়েছিল কিছু শীত কাপড়। এবার নিজ শহরে। গাড়ী অফিসে পৌছে কাঁচের দরজা ঠেলে ভেতরের উষ্ণতায় প্রবেশ করে।


পরদিন.
১) কুয়াশায় আধভেজা কাঁথার আড়ালে ঠকঠক সিকিমের মা। ত্রিশেই বুড়িয়ে শরীর। সিকিম, সিকিমের নয় মাসের ভাই ঘুমে কাদা জড়াজড়ি। কাল রাতে কেউ আসেনি সিকিমের মার কাছে। বাচ্চার মার সাথে কেউ শুতে চায় না। খাওয়া তাই যথেষ্ট মেলেনি। ক্ষুধায় ঘুম আসেনা। কটকট করে কাঁপতে কাঁপতে সূয্যিমামার অপেক্ষা করে সিকিমের মা।

২) সেই মুহুর্তে হুশ করে বেরিয়ে যায় নীল রঙের সিডান গাড়ীটা। সাড়ে ছয়টা বাজে। পত্রিকার পাতায় ছিনতাই-খুনের ঘটনায় নিমগ্ন ইমরাজ। দেশটা রসাতলে গেল। নতুন সরকার আসার সাথে সাথে শুরু হয়ে গেছে পুরোনো রোগ। নাহ, এবার দেশটাকে বদলাতে হবে। উন্নত ভাবনায় ডুবে যায় ইমরাজ। জানালার বাইরে চোখ যায় না, গেলে দেখতে পেতো ঝুলন্ত শিশুটিকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না আজ। ফুটপাতে শুধু একটা কুয়াশাভেজা কাঁথার পিন্ড নড়ছে ঠক্ ঠক্ ঠক্।

শুক্রবার.
১) বেলা বাড়লে সিকিমের মা খুব খুশী রোদের দেখা পেয়ে, সারারাতের ঠকঠকানি একটু কমেছে। কাল রাতে তিন জন থেকে ইনকাম পেয়েছে বলে কোচড়ে আজ টাকার ঝনঝনানি। মাছ কিনবে সে আজ।

২) ইমরাজ সাহেব দেরীতেই ওঠেন ছুটির দিনে। সাড়ে আটটা বাজে। চা খেয়ে চ্যানেল আইতে গোলাম মোর্তজার আজকের পত্রিকা দেখতে বসে যান তিনি। শুক্রবারটাই দেখা হয়। নটার পর বাজারে যাবেন। আজ আর কোন কাজ নেই।

পাদটিকাঃ
ইমরাজ সাহেব ভুলে গেছেন ফুটপাতের ঝুলন্ত শিশুটির কথা। ভুলে গেলেও সিকিমের মা কিছু মনে করেনি। কারন সিকিমের মা জানেও না ইমরাজ সাহেব তার শীতার্ত শিশুটির দিকে চেয়ে বেদনায় হাহাকার করে উঠেছিলেন সেদিন। জানলেই বা কী হতো। ইমরাজ সাহেবের ভুলে যাওয়াকে কি দোষ দেয়া যায়? যায় না, কারন তিনি কাউকে কোন প্রতিশ্রুতি দেননি। প্রতিশ্রুতি না দিলে প্রতিশ্রুতি পালনেরও কোন দায় থাকে না। বেদনায় হাহাকার করার অধিকার যেমন আছে, তেমনি বেদনা ভুলে যাবারও অধিকার আছে ভদ্রলোকদের। জীবন বহতা নদী।

No comments: