ছেলেবেলায় সব মানুষের নানান রকম স্বপ্ন থাকে। বেলাশেষে দেখা যায় সব স্বপ্ন হয় অসমাপ্ত নয় বহুত-দুর-অস্ত । আমারো সেরকম একটা অসমাপ্ত স্বপ্ন ছিল। ‘বড় হয়ে কী হতে চাও’ কেউ জিজ্ঞেস করলেই বলতাম- পাইলট হবো। আদতে জানতাম না পাইলট হতে হলে কী কী করতে হয়। শুধু জানতাম পাইলট আকাশে উড়তে পারে, আর আমার আজীবন সাধ আকাশে ওড়ার। বেন্জামিন ফ্রাংকলিন পড়ার আগ থেকেই আমার শখ আকাশ থেকে পৃথিবীটা দেখা। আকাশে কোন প্লেন দেখলে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকতাম -আহ্ ওই প্লেনের ভেতর যারা আছে তারা কী ভাগ্যবান, পুরো পৃথিবীটা দেখতে পাচ্ছে পাখির চোখে। অন্ততঃ পাখিও হতে পারতাম যদি, পাইলট না হলেও চলতো। চিল কিংবা ঈগল, নিদেন পক্ষে কাক হলেও চলতো। কিন্তু পাইলট হবার কিঞ্চিত সম্ভাবনা থাকলেও, পাখি হবার কোন সম্ভাবনাই নেই। শেষমেষ অবশ্য কিছুই হওয়া হয়নি। তারপরও আকাশে ওড়ার সাধ তিলমাত্র কমেনি। আকাশের প্রতি আমার মুগ্ধতা বেড়েই চলেছিল।
আরেকটু বড় হবার পর বাবা-চাচা-মামা যাদের দেশ বিদেশে আসা যাওয়া আছে, তাদের কাছ থেকে বিমানে চড়ার গল্প শুনতাম। সবাই বিমানের আরামদায়ক ব্যবস্থা, সুস্বাদু খাবার-দাবার, চাহিবা মাত্র চা-কফি-কোক-পেপসি পাওয়ার নিশ্চয়তার গল্প করতো(শরাবের কথা অবশ্য কেউ বলতো না)। কিন্তু কেউ গল্প করতো না বিমান যখন আকাশে ওড়ে তখন ওপর থেকে পৃথিবীটা কেমন লাগে সে কথা। অথচ আমি সেই দৃশ্যের বর্ননা শোনার জন্য আকুল হয়ে থাকতাম। কাউকে জিজ্ঞেস করলে বলতো, ওটা আবার দেখার কি আছে, অত খেয়াল করিনি, ইত্যাদি। তার মানে ওসব ছোটখাট ব্যাপার নিয়ে তাদের মাথাব্যাথা নেই। সদ্য কৈশোরোত্তীর্ন আমি অবাক হয়ে ভাবতাম, এত উপর থেকে পৃথিবীটা কেমন দেখায় সেটা নিয়ে মুগ্ধ হয় না কেন মানুষ, আমি হলে তো হৈ চৈ করে বর্ননা করতাম সে দুর্লভ অভিজ্ঞতার কথা।
চাকরী জগতের পাথুরে কঠিন ভুমিতে পা রাখার পর অদুর-সুদুর কোন ভবিষ্যতে বিমানে চড়ার কোন সম্ভাবনা দেখতে পেলাম না। বড়জোর টাকা জমিয়ে চট্টগ্রাম কক্সবাজার রুটে একবার চেষ্টা করা যেতে পারে। এরকম অবস্থায় কোন এক উপরঅলার অদৃশ্য যাদুর কাঠির বলে এক সকালে আমাকে অফিস থেকে জানানো হলো - বিদেশ সফরে যেতে হবে, পাসপোর্টের জন্য ছবি আর জাতীয়তা সনদ যেন ২৪ ঘন্টার মধ্যে যোগাড় করি। আমি সংবাদদাতার দিকে সরু চোখে তাকালাম। মশকরা করছে নাকি?
কিন্তু মশকরা না, সত্যি সত্যি আমাকে এক সপ্তাহ পরে ঢাকা থেকে সিঙ্গাপুরগামী বিমান ধরার জন্য চট্টগ্রাম এয়ারপোর্টে রাতের শেষ ডোমেষ্টিক ফ্লাইটটাতে চড়ে বসতে হলো। বাংলাদেশ বিমানের ছোট একটা আকাশযান, কিন্তু আমার চোখে বিরাট বিষ্ময়, শিহরন শরীরের পরতে পরতে। তবে সীটবেল্ট বেধে বসতে না বসতেই ফ্লাইট এটেন্টডেন্টের সতর্কীকরন বার্তা ও আনুসাঙ্গিক ক্যারিকেচার দেখে একটু ভয় ভয় লাগলো। বিরস মুখে চোখ বন্ধ করে সতর্কবার্তা মিথ্যাপ্রমান হবার জন্য সৃষ্টিকর্তার উদ্দেশ্যে বার্তা প্রেরন করার চেষ্টা করলাম। রানওয়েতে প্রবল শব্দ করে বিমানটি যখন শূন্যে লাফ দিল তখন কলিজাটা বুকের খাঁচার মধ্যে এমন ঝাঁকি খেয়ে গুড়গুড় শব্দে কাঁপতে লাগলো যে পাশের জনও শুনতে পাবে কান পাতলে। ভুলে গেলাম আকাশ থেকে পৃথিবী দেখার স্বপ্ন। বিমানের লাইটগুলো সব নিবিয়ে দেয়া হয়েছে, খোদা জানে কেন। বিমান উঠছে… উঠছে… উঠছে….. আমার উদ্বেগের স্কেলও দ্বিগুন তালে উর্ধমূখী হচ্ছে। ভয় চরমে ওঠার আগেই কয়েক মিনিট পর দপ করে জ্বলে উঠলো সবগুলো লাইট। মিষ্টি হেসে মোটাসোটা বয়স্ক বিমান বালা এগিয়ে এলো চকোলেটের ট্রে নিয়ে। চেহারা দেখে আমি হতাশ। আগে শুনতাম বিমানবালারা সব স্বর্গের হুরপরী টাইপ হয়, তারুন্যে ঝলমলে। কিন্তু গরীব দেশে হয়তো এরচে ভালো পাওয়া যায়নি। চকোলেট নিয়ে মুখে দিতেই পাইলটের কন্ঠস্বর ভেসে এল স্পীকারে। বলতে লাগলেন কত হাজার ফুট উপরে উঠেছি আমরা, আবহাওয়া খুব চমৎকার, মেঘমুক্ত আকাশ, বায়ুর গতি স্বাভাবিক, চল্লিশ মিনিট পর আমরা ঢাকা পৌছাবো ইত্যাদি। শুনে আস্বস্ত হলাম। জানালা দিয়ে শহরের লাইটগুলো খোজার চেষ্টা করলাম। অন্ধকার, কিছু দেখা গেল না।
তবে বেশীক্ষন আস্বস্তও থাকা হলো না। একটু পরেই খেয়াল করলাম বিমানটা নীচের দিকে নেমে যাচ্ছে যেন, লিফট নীচে নামলে যেরকম লাগে সেরকম। মনে হচ্ছে বিমানটা পড়ে যাচ্ছে। ঘটনা কী। অন্যন্য প্যাসেন্জারের দিকে তাকালাম, সবাই নির্বিকার। আমি কী একা ভুদাই নাকি। অভিনয় করে আমিও নিরুদ্বিগ্ন থাকার চেষ্টা করলাম। কিন্তু একটু পর বিমানটা প্রবল ঝাকুনি দিল। তবু আশেপাশের কারো মধ্যে বিকার দেখলাম না। আবার ঝাকুনি, ঝাকুনি চলছেই থেমে থেমে। সীটের উপরে মালামাল রাখার বক্সগুলো কাঁপছে থরথর করে। আমি আকাশ বিজ্ঞান সংক্রান্ত আমার যাবতীয় জ্ঞান দিয়ে ভাবতে চাইলাম এমন হবার কারনটা কি। আকাশের রাস্তা তো সিটি কর্পোরেশান বানায় না, খোদাতালার বানানো পথে গর্ত টর্ত থাকার কোন সুযোগ নেই। চিরকাল শুনে এসেছি বিমানের ট্রেতে রাখা একগ্লাস পানিও কাঁপে না, এত মসৃন বিমানযাত্রা। নাকি আমার যাত্রা পথেই যত কাঁটা? বিজ্ঞানচিন্তা বাদ দিয়ে দোয়া-দরুদ পড়া শুরু করলাম এবার। কেন যে এই কুক্ষনে বিদেশ যেতে হচ্ছে, আজই বোধহয় জীবনের শেষ দিন। তিরস্কার করলাম মনে মনে নিজেকে। বিমানের সব এয়ারকুলারের বাতাসও আমার কোটের ভেতরে ঘেমে ওঠা ঠেকাতে পারছে না। প্রথম বিদেশ যাত্রা বলে শখ করে স্যুট টাই পরে যাচ্ছি। পাইলট এখানো নীরব। কোন সংবাদ দিচ্ছে না। আমি যাবতীয় বিমান দুর্ঘটনার ঘটনা মনে করতে চাইলাম। এয়ার ডিজাস্টার বলে একটা বই পড়েছিলাম বিশ্বের বিখ্যাত বিমান দুর্ঘটনার উপর লেখা। তার লক্ষনগুলো মেলাতে চাইলাম। কয়েক মিনিট গেছে মাত্র, অথচ মনে হচ্ছে বহু ঘন্টা। আমার সাধ মিটে গেছে বিমানে চড়ার। সিদ্ধান্ত নিলাম, ঢাকা নেমেই পালাবো। সামান্য চল্লিশ মিনিটের যাত্রায়ই আমি কাহিল, আর ওদিকে ঢাকা-সিঙ্গাপুর, সিঙ্গাপুর-সিউল এই দুই ফ্লাইটের আট ঘন্টা কীভাবে টিকে থাকবো? কপালে যাই থাক, চাকরী চলে গেলেও পালাবো ঢাকা নেমে। দরকার নাই বাপু আমার বিমানে করে বিদেশ যাত্রার। প্রান বাঁচাই আগে।
এসব ভাবছি আর ঘামছি এমন সময় পাইলট সাহেবের বহু কাংখিত কন্ঠ ভেসে আসলো স্পীকারে। আমরা ঢাকার আকাশে পৌছে গেছি। আহ, আমার ধড়ে প্রান এলো। কী দারুন সুসংবাদ। আজাবের অবসান হবে শীঘ্রই। সৃষ্টিকর্তার কাছে শুকরিয়া আদায় করলাম এ যাত্রা মাফ করে দেয়ার জন্য। প্লেন ঢাকা এয়ারপোর্টে নামলো নির্বিঘ্নে। কী শান্তি, মাটির মানুষ মাটির কাছে ফিরে এসেছি। তখনই বোধ হলো, মাটি আমাদের কত আপন, কত প্রিয়। মাটি বিহনে কী করে বাঁচে আদম সন্তান। এসব আধ্যাত্বিক ভাব নিয়ে বেরিয়ে এলাম এয়ারপোর্ট দিয়ে। ঢাকা অফিসের আলী যথারীতি দাড়িয়ে আছে আমাকে নেবার জন্য। দু’ঘন্টা ওর তত্তাবধানে থাকবো। তারপর রাত বারোটায় পরবর্তী ফ্লাইট সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্সের। সেই যাত্রাটা ছিল সত্যিকার মসৃন আকাশ ভ্রমন, মর্তের হুরপরীদের নিয়ে। সে গল্প আরেকদিন।
সবশেষে একটা কথা না বললেই নয়। পরবর্তী জীবনে বহুবার আকাশ ভ্রমন করেছি, কিন্তু বাংলাদেশ বিমান ছাড়া আর কোন ফ্লাইটে এত ঝাঁকুনি দেখিনি। তাতে মনে হয়েছে, হয় বাংলাদেশ বিমানগুলোর যন্ত্রপাতিতে সমস্যা আছে নয়তো পাইলটের মাথার যন্ত্রপাতিতে সমস্যা । ড্রাইভিং একটা আর্টও বটে। সে স্বর্গে হোক বা মর্তে হোক।
No comments:
Post a Comment