এক.
গ্রামের জন্য মাঝে মাঝেই মনটা কেমন যেন করে। আমাদের গ্রামটা আমার দেখা সবচেয়ে সুন্দর গ্রাম। এটা নিরপেক্ষ বিবেচনা অবশ্যই নয়। প্রতিটি মানুষই হয়তো নিজের গ্রামকে সর্বশ্রেষ্ঠ মনে করে, যেমন প্রতিটা মায়ের চোখে তার সন্তান। স্থায়ীভাবে গ্রামে আমি বেশীদিন ছিলাম না। জীবনের প্রথম ৪/৫ বছর। তখনকার তেমন কোন স্মৃতি বেঁচে নেই। স্কুলে ভর্তি হবার সময় পাকাপাকিভাবে শহরে চলে আসি ১৯৭৪ সালে। আগে চাকরী সুত্রে বাবা একাই বাসা ভাড়া নিয়ে শহরে থাকতেন। শহরে স্কুলে ভর্তি হবার পর ছুটিছাটাতেই গ্রামে যাওয়া হতো মাঝে মাঝে। কখনো এক সপ্তাহের জন্য, কখনো বা দুই সপ্তাহের জন্য। সেই দিনগুলোর কথা মনে পড়ে বেশী। ছুটির সেই কয়েকটা দিন যেন স্বর্গীয় সুখে ভরপুর। গ্রামের মাঠে মাঠে দৌড়ানো, গাছে চড়া, ফল পাড়া, পুকুরে ভেসে থাকা বাঁশ ধরে ধরে সাঁতার শেখার চেষ্টা, পাশের পাহাড়ি ছড়ার হাঁটুসমান টলটলে স্বচ্ছ পানিতে ছোট ছোট মাছের পিছু পিছু ছোটা। অবাধ স্বাধীনতা। আহ, ভাবলে চোখ মুদে আসে এখনো। স্বর্গের সুন্দর কোন ছবি কল্পনা করতে গেলে আমার গ্রামের আদলটাই ফুটে ওঠে সবার আগে। হাস্যকর, তাই না? কিন্তু আমার সুখবোধ সীমিত হয়ে আছে আমার গ্রামের সৌন্দর্যের ভেতরে। টাইম মেশিনে কয়েক মুহুর্তের জন্যও যদি অতীতে ফিরে যাওয়া যেতো, বেরিয়ে আসতাম সেই ছুটির গ্রামটি থেকে।
এখনও গ্রামে গেলে ভালো লাগে। শুধু ভালো না, খুব বেশী ভালো লাগে। কিন্তু এখন গ্রামে যাওয়া হয় খুব অল্প সময়ের জন্য। থাকা হয় না। শহরে আমাদের অনেক কাজ, অনেক ব্যস্ততা, অনেক যোগাযোগ। কাজের হোক, অকাজের হোক। এসব রক্ষার্থে রাতের মধ্যেই ফিরে আসা চাই। এছাড়া শহুরে নাগরিক সুবিধা ছাড়া আমাদের একদিনও চলে না। আমার গ্রামে ইলেকট্রিসিটি থাকলেও, লাইনের পানি নেই, টাইলসের বাথরুম নেই, নিরাপত্তা নেই, রাতে হঠাৎ অসুখ করলে ডাক্তার নেই ইত্যাদি অনেক শহুরে সুবিধা থেকে বঞ্চিত। ফলে সারাদিন ঘুরে ফিরে আবার রাতে শহরে ফিরে আসা।
দুই.
আমি হাড়ে হাড়ে জানি অভাব কাকে বলে। মধ্যবিত্ত অভাবের কী নিদারুন চিত্র তা আমার খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে। আমি যখন চরম দারিদ্রের সেই স্বরূপ দেখেছি তখন আমার বয়স বিশের কোটায়। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শুরু। মোটামুটি পুরোপুরি বিশ্ববিদ্যালয় জীবনটা কাটিয়েছি চরম দারিদ্রের মুখোমুখি দাড়িয়ে। আমার মতো অভাবী ঘরের ছেলেরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার স্বপ্ন দেখে না। আমারও তেমন স্বপ্ন ছিলনা। পড়ার জন্যই পড়া। ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে টিকে গেছি বলেই পড়তে শুরু করলাম। না করে কি করা। আর কী করার আছে। ঘরে বসে থাকার উপায় তো নেই। পড়াশোনাটা শেষ করে একটা চাকরী ধরতে হবে সংসারের দায়িত্ব কাঁধে নিতে হবে। দারিদ্রের কারনে আমি অনেক বন্ধুবান্ধব এড়িয়ে চলতাম যাদের সাথে মেলামেশা করা ব্যয়বহুল। আমার নিজের কোনরকম আয় ছিল না কারন আমি টিউশানী বা সেরকম কিছু করতাম না। মোটামুটি একরকম অকর্মাই বলা চলে আমাকে। ভার্সিটি যাবার সময় মা হাতে ১৫ টাকা দিয়ে দিত গাড়ীভাড়া বাবদ। সেই ১৫টাকাই অনেক ছিল আমার জন্য। তখন রেলষ্টেশানে যাওয়ার রিকশা ভাড়া ছিল ৫/৬ টাকার মধ্যে। কদমতলী নামলে ৪ টাকায় যাওয়া যেত। তাই প্রায়ই কদমতলী নামতাম। ভার্সিটিতে গিয়ে সিঙাড়া চা কিংবা পরটা ভাজি খাওয়ার জন্য খরচ ছিল ৫ টাকার মতো। এভাবে পনের টাকায় পুরো দিন পার করে দেয়ে যেত সহজেই। কখনো কখনো বাসে যেতাম। বাসে গেলে মুরাদপুর থেকে নাজিরহাটের বাস ধরতাম। বাসা থেকে আগ্রাবাদ গিয়ে মুরাদপুরের বাস ধরতাম। বাসভাড়া ১ টাকার ভেতর ছিল। মুরাদপুর থেকে ভার্সিটি ভাড়া ছিল দুটাকা। আমরা ডিসকাউন্টে ১ টাকাও দিতাম কখনো কখনো। ছাত্র ডিসকাউন্ট। আজ বুঝি সেসব নাই আর। ভার্সিটি এক নম্বর গেটে নামলে ভেতরে যাবার বাস থাকতো ভার্সিটি কতৃপক্ষের। কোন ভাড়া লাগতো না। সে বাসে মেন গেটে রেলষ্টেশানের ওখানে যেতাম। স্টেশান থেকে অন্য বাসে আর্টস ফ্যাকাল্টি। এভাবেই চলতো আসা যাওয়া। আসার সময় আমি বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই বাসে চলে আসতাম। ট্রেনে ভিড় বেশী আর ট্রেনে দেরী হবে বলে ট্রেন এড়িয়ে চলতাম প্রায় সময়ই।
সেই সময়টা আমাদের সংসারে নিদারুন অভাব। বেপারীপাড়ার বাড়ীটা মাত্র শেষ হয়েছে। আমরা প্রান্তরের মাঝখানে একলা বাড়ীতে বসবাস করছিলাম। বেপারীপাড়া মসজিদের লাগোয়া পশ্চিম পাশের গলিতে ঢুকে ২০০ গত মতো গেলে হাতের বায়ে পুকুর পাড় দিয়ে একটা মাটির রাস্তা পশ্চিম দিকে চলে গেছে। সেই রাস্তায় শ'পাচেক গজ গেলে হাতের ডানে আমাদের একতলা সেমিপাকা বাড়ীটা। তিন দিকে দেয়াল, রাস্তার দিকে বাশের বেড়া দিয়ে ঘেরা। বাড়ীর সামনে কিছু সবজি লাগানো, কলাগাছ, আরো নানান ফলফলারির চারাগাছ। আশে পাশে আর কোন বাড়ী নেই। পেছনে ধুধু প্রান্তর পেরিয়ে ছোটপোল পুলিশ লাইনের বিল্ডিংটা দেখা যায়, তারও পরে বহুদুরে যেন হালিশহরের বাড়ীগুলি ছোট ছোট দেখা যায়। উত্তর দিকেও খালি মাঠ, অনেক দুরে রঙ্গীপাড়ার সবুজ গাছপালা দিগন্তছোয়া আভাস। সেই নিস্তব্ধ বিরানভুমিতে আমরা প্রথম বসত গড়ি। এই বসত না গড়লে আমরা শহরে শেষ পর্যন্ত টিকতে পারতাম কিনা সন্দেহ আছে। গ্রামে গিয়ে পরের কাজ করে খেতে হতো। সেটা হয়নি বলে নিজেকে খুব ভাগ্যবান মনে হয়। এই আমি আর সেই আমার মধ্যে অনেক দিগন্তজোড়া তফাৎ হয়ে যেতো। আমাকে আমিই চিনতাম না। এত অভাবেও টিকে গেছিলাম সেই বসত ঘরটার জন্য।
অভাব কেন ছিল? বাবার অনেক টাকা ছিল কয়েক বছর আগেও। বিদেশ থেকে মোটা অংকের টাকা এনেছিলেন তিনি। কিন্তু পরিকল্পনার অভাবে ও নানা জনের দুর্বুদ্ধিতে সব শেষ হয়ে যায়। টাকা পয়সা শেষ হবার পর গ্রামের জমি জমা বিক্রি শুরু হয়। গ্রামের জমি শেষ হবার পর ঘরের যত স্বর্নালংকার ছিল সেগুলো বিক্রি শুরু হয়। তারপর ধারকর্জ। টিকে থাকার প্রানপন যুদ্ধ। মুখোমুখি না হলে কেউ বুঝবে না অভাব কী জিনিস। আমরা পাচ ভাইবোন। সংসার কম বড় নয়। আত্মীয় স্বজন সবাই বুঝে গেছে আমরা আর টিকবো না। শুধু সময়ের অপেক্ষা, কখন পতন ঘটবে। খরচের ভয়ে আমরা কোথাও বেড়াতে যেতাম না। দাওয়াত খাওয়া ছিল বিলাসিতা। দাওয়াতের গিফট কেনার জন্য টাকার যোগাড় হবে কোত্থেকে, সে চিন্তায় আমরা দাওয়াতেও যেতাম না নিতান্ত বাধ্য না হলে। বন্ধুবান্ধব কেউ জানতো না আমার এই নিদারুন অভাবের কথা। তখন আমার চেয়ে অভাবী বন্ধু একজনও ছিল না। আত্মীয়কূলেও আমরা ছিলাম সবচেয়ে নিন্মস্তরের দরিদ্র। হয়ে গেছিলাম। জানিনা আত্মীয়রা মনে মনে কী বলতো আমাদের নিয়ে, মুখে অবশ্য হাসিখুশীই দেখাতো। বাসায় আত্মীয়-স্বজন বেড়াতে এলে আমরা বিব্রত বোধ করতাম কী খাওয়াবো সে ভাবনায়। আমরা তো কচু ঘেচু খেয়ে চলছি, মেহমানকে তো তা খাওয়ানো যায় না। মা কী করে যেন ম্যানেজ করতো। ভাবতে অবাক লাগে এখন।
সেই দিনগুলোর কথা ভাবলে বাবার জন্য কষ্ট হয়। বাবা আমাদের ছেড়ে গেছে ১১ বছর আগে। বাবা আমাদের সুখের দিনগুলো দেখে যেতে পারলো না। আমাদের স্বচ্ছলতার দিন আসার আগেই বাবাকে চলে যেতে হয়েছে। যাবার আগ পর্যন্ত বাবা বিশ্বাস করতো না আমরা কখনো উঠে দাড়াবো। এরকম অবস্থা থেকে কেউ উঠে দাড়াতে পারে না। আজ আমরা যে উঠে দাড়িয়েছি সেটাও অলৌকিক। আমি নিজেই অবাক হই কিভাবে সব কিছু ঘুরে দাড়ালো। যারা আমাদের ত্যাগ করেছিল, তারাও আমাদের পাশে ফিরে আসতে লাগলো।
অভাবের দিনগুলিকে আমি একদিনও ভুলি না। অনেক বছর পেরিয়ে গেছে তবু আমি প্রতিনিয়ত মনে রাখি সেই দিনগুলো, রাতগুলো। আমার আজকের জীবনের ভিত্তিমূল গাথা হয়েছিল সেই সময়ে। আমি তখন জানতাম না। যেমন এখন জানিনা ভবিষ্যতে কী অপেক্ষা করছে।
No comments:
Post a Comment