অনুর্বর মাস্তানীঃ
ভাল ছাত্র হিসেবে কখনোই নাম ছিলনা ছাত্রজীবনে। তবে দুষ্টামিতেও যশ কুড়াতে পারিনি তেমন। ডানপিঠে হবার প্রচেষ্টা ব্যহত হয়েছে বারেবারে নানান কারনে। তারুন্যের শুরুতে মাস্তান হবার শখ জেগেছিল কিছুদিন। স্বপ্ন দেখতাম একটা ‘মাছমার্কা’ ছুরির মালিক হবার। আশির দশকে যারা তরুন ছিলেন তাঁরা মাছমার্কা ছুরির খ্যাতি সম্বন্ধে অবগত আছেন। এখনকার তরুনেরা চিনবে না হয়তো। ১৯৮৪তে এসএসসি পাশ করার পর থেকে মাছমার্কার মালিক হবার প্রচেষ্টা জোরদার হয়। বন্ধুদের কয়েকজন মাছমার্কা যোগাড় করে ফেলেছিল ইতিমধ্যে। এটা সাথে থাকলে নাকি বুকে সাহস অনেক বেড়ে যায়, বাঘ-ভালুকও ভয় লাগে না। মাছমার্কা নামকরন হবার কারন হচ্ছে এটার খাপটা মাছের লেজের মতো। তবে নকল মাছমার্কাও ছিল। আসল নকল চেনার উপায় হলো ভাঁজ থেকে ছুরির ফলাটা খোলার সময় কট কট করে সাতটা আওয়াজ দেবে, এজন্য অনেকে এটাকে সেভেন গিয়ার নামেও ডাকতো। খুব ধারালো ফলা, নিমেষে ফালা ফালা করে দেয়া যায় শরীরের যে কোন অংশ। আমার এক বন্ধুকে তার প্রতিপক্ষ মাছমার্কা দিয়ে আক্রমন করেছিল, সে সরে গিয়েছিল বলে আঘাতটা লেগেছিল উরুতে, তার জিন্স কেটে উরুর ভেতরে আধ ইঞ্চি ঢুকে গিয়েছিল ছুরির ধার। বন্ধুটি মার্শাল আর্টে ব্ল্যাকবেল্ট হলেও মাছমার্কাকে ঠেকাতে পারেনি। তবে কদিন পর ছুরি খাওয়া বন্ধুটিও যখন মাছমার্কার মালিক হয়, তখন প্রতিপক্ষ এলাকা ছেড়ে পালায়। প্রধানতঃ সেই ঘটনা থেকে আমরা মাছমার্কার ভক্ত হয়ে পড়ি। একটা মাছমার্কা যোগাড় করতেই হবে। কিন্তু পাওয়া সহজ ছিল না। এটা ব্ল্যাকমার্কেটের জিনিস, পুলিশের খাতায় নিষিদ্ধ আইটেম।
বাবা তখন দেশের বাইরে থাকতেন। বছরে একবার ছুটিতে আসতেন। একবার বাবা ছুটিতে আসলে, ড্রয়ারে বাবার বিদেশী নানান জিনিসের মধ্যে ছোট একটা ছুরি পাই। নেইল কাটারের চেয়ে একটু বড় হবে। ফলটল কাটার জন্য হবে। দুইদিকে দুটো ব্লেড আছে, একটা বড়, আরেকটা ছোট। কৌতুহলী হয়ে ধার টেষ্ট করতে যেতেই বুড়ো আঙুলটা কেটে গেল অনেকটা। রক্ত পড়ছে আঙুল থেকে। কিন্তু আমি ব্যাথা-ট্যাথা ভুলে অবাক-বিষ্ময়ে তাকিয়ে আছি ছোট্ট ধারালো বস্তুটার দিকে। এই কী সেই জিনিস যা আমি খুজে বেড়াচ্ছি দিনের পর দিন? দেরী না করে পকেটে চালান করে দিলাম ছুরিটা। যদিও মাছের লেজের কোন চিহ্ন নেই গায়ে, কিন্তু রুপালী ষ্টীলের চকচকে শরীরটা ভক্তি জাগিয়ে দিয়েছে আমার ভেতর, তাছাড়া একটু আগের রক্তাক্ত কান্ডে নিশ্চিত হয়েছি এর ক্ষমতা সম্পর্কে।
আমি নিশ্চিত যে এটা মাছমার্কা না হলেও নির্ঘাত তার সাক্ষাত খালাতো মামাতো ভাইটাই হবে। কথাটা গোপন রাখতে হবে। পরদিন কলেজে যাবার সময় নিয়ে যাবো, গোপনে লুকিয়ে রাখতে হবে যেন কেউ টের না পায়। পকেটে রাখলে ধরা পড়ে যাবো, বন্ধুরা সবসময় পকেট হাতায়। হঠাৎ মনে পড়লো গত সপ্তাহে এক নব্যমাস্তান বন্ধু কলেজের এক কোনে গিয়ে গোপনে তার লুকানো ভ্রাম্যমান অস্ত্রভান্ডার দেখিয়েছিল। তার পায়ের সাথের বেল্টে বাঁধা অস্ত্র। আমার সেরকম কোন বেল্ট নেই, তাতে কী, আমি একটা ইলাস্টিক দিয়ে পায়ের সাথে মজবুত করে বেধে নিলাম ক্ষুদ্র রুপালী অস্ত্রটি। কেউ টের পাবে না। এবার আসুক কোন শালা, ভুঁড়ি ফাসিয়ে দেবো। বুক ফুলিয়ে চলাচল শুরু করলাম কলেজে।
কিন্তু কারো ভুঁড়ি ফাসানোর সুযোগ হয়নি। কেউ আসেনি আমার ধারে কাছে। কোন হুমকি নয়, কোন আক্রমন নয়। এমন কোন ছুতা পাই না যাতে খপ করে ছুরিটা বের করে কাউকে দাবড়ানি দিতে পারি। আসবেই বা কোত্থেকে? কলেজে তো আমাদের কোন প্রতিপক্ষ নাই। এখানে শিবির নিষিদ্ধ, ছাত্রদল নিষিদ্ধ, যে কোন রাজাকার সংগঠন এখানে নিষিদ্ধ। ‘মাথা তুললেই খাবি মার’ এমন কঠিন আইন। শুধু জাতীয় ছাত্রলীগ এখানে। শুধু নিজেরা নিজেরা আড্ডা দেয়া, হৈ হৈ করে সিনেমা দেখা, হোটেলে খাওয়া। ফলে নীরস লাগলো দিনের পর দিন ছুরি বয়ে বেড়ানো। কদিন বাদে ছুরিটা খুলে রেখে দিলাম আমার গোপন ড্রয়ারে। বন্ধুদের সারপ্রাইজ দেয়ার সুযোগ হলো না ক্ষুদে বিষ্ময়টা দিয়ে। মাঠে মারা গেল মাস্তানির স্বপ্ন।
সফল মাস্তানীঃ
তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি। আমাদের এক নতুন প্রতিবেশী পাশে বাড়ী করার জন্য ইট বালি এনে জড়ো করছে। এলাকায় নতুন কেউ আসলে কিছু চিহ্নিত লোকাল মাস্তান বরাবর এসে হাজির হয় চাঁদাবাজি করতে। এবারও যথারীতি মাস্তানরা এসেছে। সারাদিন হম্বিতম্বি করেছে, নির্মান কাজ বন্ধ করে দিয়েছে। মাস্তানরা ফিরে যাবার আগে হুমকি দিয়েছে রাতে হামলা করে ইট বালি সব নিয়ে যাবে, দেয়াল ভেঙে দিবে। প্রতিবেশী নিরীহ ভদ্রলোকের প্রায় কাঁদো কাঁদো অবস্থা। আমাদেরকে এসে বললো একটু যেন সাহায্য করি। আমি ভার্সিটি থেকে ফিরে ঘটনা শুনলাম। বুঝতে পারলাম না, কিভাবে ভদ্রলোককে সাহায্য করবো। বিশেষ করে রাতের বেলা একা ওদের কীভাবে ঠেকাবো।
কিন্তু জেদ চাপলো, আমি তো আর বইঙ্গা না। এক বন্ধু মিজানকে খবর দিলাম। বললাম রাতে আমার সাথে থাকতে, পাহারা দিতে হবে। বন্ধু রাজী। প্ল্যান করলাম কিভাবে কী করবো। রাত এগারটার দিকে খাওয়া-দাওয়া সেরে তৈরী হলাম বাইরে যাবার জন্য। বন্ধুটি এসেছে শীতের জবরজং পোষাকে। কালো হাইনেক সুয়েটার, কালো জ্যাকেট, কালো প্যান্ট, কালো সু। আর সবচেয়ে ইন্টারেষ্টিং চোখে দুটো ছিদ্র সমেত কালো মাংকি ক্যাপ। পুরোপুরি তৈরী হবার পর ওকে দেখে ব্ল্যাকক্যাট কমান্ডো মনে হচ্ছিল। আমার কাছে বিদেশী দুটো খেলনা পিস্তল ছিল। দুটোই কালো চকচকে, দেখে আসলই মনে হয়। একটা ছোট পকেট সাইজ, আরেকটা বড় নলের পয়েন্ট থ্রী ফাইভ টাইপের। দুজনে দুটো গুজে নিলাম জ্যাকেটের ভেতর। বেরিয়ে রাস্তায় গেলাম। এ মাথা ও মাথা হাঁটছি আর খুজছি কাউকে দেখা যায় কি না।
শীতকাল বলে পুরো এলাকা ঘুমিয়ে গেছে। রাস্তা সুনসান। দু একটা কুকুরের ডাক শোনা যাচ্ছিল দুর থেকে। সামনের বাড়ীর এক দারোয়ান হান্নান উপরে আমাদের পক্ষের লোক, ভাজা মাছও উল্টে খেতে জানে না, কিন্তু ভেতরে ওই মাস্তানদের ইনফরমার। আমি সেটা জানতাম। ওই বাড়ির সামনে হাটছি, আমাদের দেখে হান্নান বেরিয়ে এল। আমি আর বন্ধু তখন হাঁটতে হাটতে পিস্তল বদলা বদলি করছি। হান্নানের চোখে পড়ে গেল ব্যাপারটা। আমিও চাইছিলাম সেটা। আমি হান্নানকে জিজ্ঞেস করলাম মাস্তানদের কাউকে দেখেছে কিনা। হান্নান তখন কিঞ্চিত ভীত। বললো, না দেখেনি। আমি তখন বললাম- শোন মিজান, রাতে যদি ওদের দেখা যায় হান্নান টর্চ মারবে ওদের গায়ে, আর তুই ওদের পাছায় গুলি করবি। বিচি রেডী রাখ। একজনের জন্য একটা করে বিচি। হান্নানকে বললাম - খেয়াল রাখিস। বলে আমরা আবার পায়চারি শুরু করলাম। এদিক থেকে ওদিক। ওদিক থেকে এদিক। টহল পুলিশের মতো। একটু পর দুর থেকে খেয়াল করলাম হান্নান হন হন করে কোথায় যেন যাচ্ছে। ওদের খবর দিতে বোধহয়। আমাদের কাজ শেষ। আমি আর মিজান বাসায় এসে ঘুমিয়ে পড়লাম।
আমার বিশ্বাস ছিল কাজ হবে। হয়েছিলও। এক ওষুধে খেল খতম। সে রাতে কেউ আসেনি, পরেও না। খবর পৌছে গিয়েছিল ওদের কাছে। পাছায় গুলির রিস্ক নেয়া সহজ না। ওরা ভাবেনি আমি কমান্ডো নিয়ে আসবো। পরেও আর কোন অসুবিধা হয়নি। প্রতিবেশী নির্বিঘ্নে কাজ শেষ করেছে। আমার প্রথম সফল কাউন্টার মাস্তানী।
No comments:
Post a Comment