Sunday, January 18, 2009

মধ্যবিত্তের ইতিবৃত্ত

[একবার ভেবেছি লিখবো না। আবার ভাবলাম, ভাবনাগুলো সবসময় গোছানো থাকে না, লিখেই ফেলি। নিজের ব্লগের জন্যই লেখা। কিছুটা স্মৃতিকথা, কিছুটা পারিবারিক কথা, কিছুটা মধ্যবিত্ত জীবনের ইতিহাস, কিছুটা আত্মকথা, সব মিলিয়ে বলা যায় কথার খিচুড়ি, মধ্যবিত্তের সাতকাহন। ব্লগের জন্য কপি-পেষ্ট করলাম অনুভুতি শেয়ার করার জন্য। লেখাটা কিঞ্চিত বড় হয়ে গেছে, কিন্তু একসাথে না দিলে বোঝা যাবে না ]

মধ্যবিত্ত পূর্বপুরুষঃ
মধ্যবিত্ত জীবন একটা ফ্যাকড়া। আমি মধ্যবিত্ত, আমার বাবা মধ্যবিত্ত, আমার দাদা মধ্যবিত্ত, দাদার দাদাও মধ্যবিত্ত ছিল এবং পূর্বপুরুষের ইতিহাস যতদুর জেনেছি ততদুর মধ্যবিত্তই পেয়েছি। এমনকি প্রায় কয়েকশ বছর আগে যখন পটিয়ার আজিমপুর গ্রামে আমাদের বংশের গোড়াপত্তন হয় যাদের মাধ্যমে তারাও মধ্যবিত্তই ছিলেন। মোহাম্মদ শরীফ ও তোয়ার শরীফ নামের দুই ভাইয়ের মাধ্যমে আমাদের বংশ যাত্রা শুরু করে প্রায় চার-পাঁচশ বছর আগে, যারা স্থানীয় জমিদার আলী আকবর শাহের আমন্ত্রনে মসজিদের ইমাম ও মুয়াজ্জিন হিসেবে এখানে এসেছিলেন পশ্চিম পটিয়া থেকে। আমাদের গ্রামটা আগে মগদের এলাকা ছিল, মগদের কাছ থেকেই পুরো পাড়াটা আমার পূর্বপুরুষ কিনে নিয়েছিল বলে শুনেছি। ক'বছর আগেও আমাদের পুকুর পাড়ে বিশাল বিশাল দুটি তেঁতুল গাছ মগদের স্বাক্ষী হিসেবে দাঁড়িয়ে ছিল। ওর মধ্যে নাকি জ্বীনদের বসতি ছিল। মন্ত্রপড়া বড় বড় পেরেক পোঁতা আছে বলে জ্বীনকূল এখান থেকে বসতি গুটাতে বাধ্য হয়েছিল বলে এলাকায় প্রচার আছে। তবে গাছ দুটো এত বিশাল যে দশ-বারোজন গাছে উঠে লুকিয়ে থাকলেও নীচ থেকে কেউ দেখতে পাবে না। একেকটি গাছের বেড় ছিল অন্ততঃ বিশ হাত। ছেলেবেলায় খুব ভয় পেতাম ওই তেঁতুল গাছের নীচ দিয়ে হাঁটতে। এমনকি দিনের বেলায় বিশেষ করে ভর দুপুরেও গা ছম ছম করতো। রাতে তো বড়রাও তেঁতুল গাছের নীচে একা একা ঘুরতে ভরসা পেতো না।

আমার দাদা স্বাবলম্বী লোক ছিলেন। খুব উচ্চ শিক্ষিত ছিলেন না, কিন্তু লেখার হাত এবং হাতের লেখা এই দুটোই এত ভাল ছিল যে বৃটিশ আমলে দাদীর কাছে লেখা চিঠিতে ইংরেজীর ব্যবহার দেখে আমি টাসকি খেয়ে গিয়েছিলাম। সেরকম ইংরেজী হাতের লেখা আমি খুব কম দেখেছি এ যুগে। আমার বাবাও হাতের লেখার সে ধারাটা পেয়েছিলেন, তবে আমি বহু চেষ্টা করেও রপ্ত করতে পারিনি সেটা। আমার দাদারা ছিলেন পাঁচ ভাই। দাদা সবার ছোট ছিলেন। দাদাদের সবগুলো ভাই ভাগ্য অন্বেষনে রেঙ্গুন-আকিয়াব গিয়েছিলেন কোন না কোন সময়। ওখানে ব্যবসার পসার জমিয়েছিলেন সবাই। সবার শেষে দাদা ফিরে আসেন ১৯৪৭ সালে দেশ-ভাগের পর। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় দাদার বিশাল আর্থিক ক্ষতি হয়ে যায় বার্মায়। রেঙ্গুনে যখন বোমা পড়েছিল তখন দাদার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান পুড়ে যায়। দাদা নগদ কয়েক লক্ষ টাকা নিয়ে মাটির নীচের সুরঙ্গে প্রায় সাতদিন অর্ধাহারে কাটিয়ে বোমাবাজি থামার পর সব কিছু ফেলে দেশে পালিয়ে আসেন। যুদ্ধের পর ফিরে গিয়ে কিছুই পাননি আর । নতুন করে শুরু করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু হয়নি আগের মতো। ততদিনে দেশ ভাগ হয়ে গিয়েছিল। এতদিন বিনা পাসপোর্টে আসা যাওয়া করলেও, শেষবার দেশে আসতে হয় পাসপোর্ট নিয়ে। প্রায় ধনী হয়ে যাওয়া আমার দাদা আবার মধ্যবিত্ত চক্রে ফিরে আসেন।

দেশে জমানো টাকা পয়সা দিয়ে চট্টগ্রামের পতেঙ্গায় ব্যবসা শুরু করেন আবার। বাবাকে গ্রাম থেকে নিয়ে আসেন, শহরের স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেন। বাবা সকালে স্কুল করে বিকালে দোকানে বসতেন। এভাবেই চলছিল। কিন্তু সেই পুরোনো জৌলুস তো ফিরে আসলোই না, বরং ঠগবাজদের পাল্লায় পড়ে দাদা বারবার আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হলেন। শেষমেষ ব্যবসা বন্ধ করে গ্রামে ফিরে জমিজমা দেখাশোনা শুরু করেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত গ্রামেই বসবাস করেছেন। দাদা শহরে বসবাস পছন্দ করতেন না। তিনি সবচেয়ে বেশী ভয় পেতেন হাসপাতালকে। তার ভয় ছিল শহরে বাস করলে কোনদিন অসুস্থ হয়ে অ্যাম্বুলেন্সে করে মেডিক্যাল যেতে হবে, আর মেডিক্যাল থেকে জীবিত ফিরবেন না। তিনি গ্রামেই মরতে পছন্দ করতেন। তার ইচ্ছে পুরন হয়েছিল। কাকডাকা এক ভোরে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে গ্রামেই শান্তির মৃত্যু খুঁজে নেন তিনি। ১৯৭৬ সালে দাদার যখন মৃত্যু হয় আমার বাবা তখন আমাদের নিয়ে শহরে নাগরিক জীবন শুরু করেছেন। সিজিএস কলোনী আমাদের আবাসস্থল।

এখন আমার মনে হয় দাদাই আমাদের শহুরে জীবনের ভিত্তিস্থাপন করেন। কারন তিনি বার্মা থেকে ফিরে শহরে ব্যবসা শুরু করার সময় বাবাকে সেই যে শহর চিনিয়েছিলেন, সেটাই বাবার চোখ খুলে দিয়েছিল। দাদা নিজেও জানতেন না তিনি সেদিন তার উত্তরসূরীদের দিক পরিবর্তন করে দিচ্ছেন। পরে দাদার বাকী সন্তানেরা অর্থাৎ বাবারা পাঁচ ভাইই শহরমূখী হয়ে জীবনকে বদলে ফেলতে শুরু করে। এটা একটা বিশাল ব্যাপার। দৃষ্টি খুলে দেয়া। চোখের বাঁধন উন্মোচন করে দেয়া। দাদা আর তার চার ভাই প্রায় একই রকম মধ্যবিত্ত জীবন যাপন করেছেন ঠিকই, কিন্তু অন্য ভাইদের মতো শহর বিমূখ ছিলেন না। দাদার বাকী ভাইদের কেউ ছেলেমেয়েদের শহর চেনায়নি মানে শহরভিত্তিক কিছু করেনি। শহর-গ্রাম নিয়ে গ্রামে একটা বিতর্ক দেখা যায়। কেউ গ্রাম ছেড়ে শহরে বসবাস করলে সেটা গ্রামের প্রতি আস্থাহীনতা বলে ধরা হয়, এই আস্থাহীনতা তাঁর পূর্বপুরুষের প্রতি একপ্রকার অবজ্ঞা বা অপমান বলেও ধরা হয়। তাই সম্ভব হলে কেউ চাইতো না গ্রাম ছেড়ে শহরে কিছু করতে। বার্মা গিয়েছো টাকা কামাতে, ফিরে আসো গ্রামে, যা করার এখানেই করবে। আমাদের পূর্বপুরুষ কী শত শত বছর বসবাস করেনি এখানে? তখন কী শহর ছিল? এসব ভাবনা গ্রামে খুব প্রাধান্য পেতো।

আমার দাদাও শহরে বসত করতে চায়নি। তাই শহরে তখন সস্তায় এত জমি থাকা সত্ত্বেও ( আগ্রাবাদে যেখানে আমাদের প্রাক-সাম্প্রতিক আবাস ছিল সেই এলাকায় দাদা একরের পর একর ধূধূ জমি কিনতে পারতেন) এক কাঠাও কেনার চেষ্টা করেননি, কারন তখন এসব এলাকায় ভদ্রলোকের বসতি ছিল না। কিন্তু বাবাকে শহরে নিয়ে এসে ছোট্ট যে কাজটি করে গিয়েছিলেন, সেটিই পরবর্তীতে পুরো পরিবারের দিকপরিবর্তনে বিশাল ভুমিকা রেখেছে। দাদার অন্যভাইয়েরা সেটা করেনি। ফলে তাদের পরবর্তী বংশধরেরা পিছিয়ে পড়েছে শিক্ষাদীক্ষা সহ জীবনের সবক্ষেত্রে। এটা নিয়ে আমার একটা মনোকষ্ট আছে। একই মায়ের পেটের পাঁচ ভাই, এক সামাজিক অবস্থানে বসবাস ছিল অথচ এত পার্থক্য দুই জেনারেশান পরে। কারনটা শুধুমাত্র শিক্ষার আলো। শহরবাস এবং শিক্ষা দুটোই মানুষের জীবনে বিরাট ভুমিকা রাখে। শিক্ষার স্পর্শেই মানুষ আলোর স্পর্শ পায়। আমি বলি, এক মুহুর্তের একটা সিদ্ধান্তও পাল্টে দিতে পারে একটা শতাব্দী।

মধ্যবিত্ত পিতাঃ
আমার বাবাও মধ্যবিত্ত জীবন যাপন করছিলেন। বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে সামান্য বেতনের চাকরী। কিন্তু স্বাচ্ছন্দ্য শহুরে মধ্যবিত্ত জীবন, আনন্দ বেদনার কাব্য। দশটায় অফিস যেতেন পাঁচটায় ফিরতেন। হঠাৎ বাবার মাথায় পোকা উঠলো বড়লোক হবার। ধুম করে চলে গেলেন বিদেশে। মা একটু দিশেহারা প্রথমে। একা কীভাবে শহরে থাকবেন। কেউ কেউ বললো শহরের বাসা ছেড়ে দিয়ে গ্রামে চলে যেতে। পরীক্ষামূলকভাবে কদিনের জন্য বোয়ালখালীতে নানাবাড়ীতে গেলাম। আমি তখন ক্লাস ফোরে পড়ি আগ্রাবাদ কলোনী স্কুলে। দুচারজন বন্ধুবান্ধবও গজিয়েছে ইতিমধ্যে। গ্রামে গিয়ে স্কুল দেখলাম। ক্লাস ফোর কোথায়। এমা, এখানে দেখি খোলা হলরুমের মতো একটা ঘরে ওয়ান, টু, থ্রী, ফোর পাশাপাশি ক্লাস করছে। এ কেমন স্কুল। সিনিয়র জুনিয়র মানসম্মান নাই। আমার ভালো লাগলো না। পড়াশোনায় মন বসলো না। অবস্থা দেখে মা শহরে ফেরার সিদ্ধান্ত নিল। আবার আগের জায়গায়।

বাবা প্রায় আট বছর জাপানী কোবে ষ্টীল মিলে চাকরী করে যখন দেশে ফিরে আসেন তখন আমি কলেজে উঠে গেছি। বাবার হাতে অঢেল টাকা পয়সা। এমনিতেই বিদেশে যাবার আগেও পাকিস্তানী আমল থেকেই বাবা সুটেট বুটেড মানুষ, আগ্রাবাদ হোটেলের মতো থ্রী-ষ্টার হোটেলে তাঁর নিত্য যাওয়া আসা। এখনতো আরো বেড়েছে জৌলুস। দেদারসে খরচ করতো বাবা। টাকা ধার নেয়ার জন্য লোকে লাইন দিত। সুখের পায়রাদের সেই প্রথম ব্যাকরন বইয়ের বাইরে উড়তে দেখেছি। বাবা ছিল দিল খোলা উদার। টাকাকে ধরে রাখার কোন চেষ্টা নেই। মধ্যবিত্তের কাটাতারের বেড়া পেরিয়ে আমরা প্রায় বড়লোক হয়ে গেছি। গ্রামে শহরে প্রচুর জমিজমা কেনা হয়েছে, বাড়ী করা হবে শহরে। ব্যবসায়ে হাত দিচ্ছেন বাবা। চারিদিকে স্বচ্ছলতার উৎসব। বাবার বন্ধুরা ব্যবসায় সফলতার মুখ দেখতে শুরু করছিল বিশেষ করে কেডিএস এবং এস এ গ্রুপের মালিক । তারাও উৎসাহ দিল ব্যবসায় ঢোকার জন্য। উৎসাহ পেয়ে বাবা নানান রকম ব্যবসায় হাত দেয়া শুরু করলো। খাতুনগন্জ, মাদারবাড়ী, কদমতলীতে আমদানী পন্যের ব্যবসায় দাড় করানোর জন্য প্রানান্তকর চেষ্টা। ব্যবসা বিনিয়োগের পাশাপাশি বাকী টাকা দিয়ে ছোট্ট একটা বাড়ীও করে ফেললেন আগ্রাবাদের ১০ কাঠা প্লটটাতে। এরপর মাস যায়, বছর যায়। ব্যবসা থেকে ভালো সংবাদ আসে না। একের পর এক ক্ষতির সংবাদে বাবা স্থবির বিমুঢ় হয়ে যেতে থাকে। ক্ষতি পোষাতে বিক্রি করতে হয় একের পর এক জমি। তবু ক্ষতি পুষিয়ে ওঠে না। বাবার মুখের দিকে তাকালে কষ্ট হতো তখন। বাবা খুব সিগারেট খেতেন। এত বেশী যে সর্বাধিক ভোক্তা হিসেবে কোন এক বছর 555 কোম্পানী থেকে ডিনার সেট পুরস্কার পর্যন্ত পেয়েছিলেন। সেই বাবা এখন গোল্ডলীফও কিনতে পারেন না। ষ্টার ফিল্টার ধরেছিলেন শেষে। কী অদ্ভুত মানুষের জীবন। এক স্বচ্ছল সফল মানুষ ক'বছরের মধ্যেই সবকিছু হারিয়ে ফিরে আসে মধ্যবিত্তের টানাপোড়েনে। যে ব্যাংকে বাবার লক্ষ লক্ষ টাকা জমা থাকতো সেখানে আমি একদিন যখন দুশো টাকার একটা চেক ভাঙাতে গেছি ব্যাংকের অফিসার কেমন করে আমার দিকে তাকালো, করুনাই হবে হয়তো! মৃত্যূর আগ পর্যন্ত বাবা মধ্যবিত্তই ছিলেন।

পহেলা বৈশাখে আমি চিরকাল উৎসবের মেজাজে কাটিয়েছি। গ্রুপ থিয়েটারে যখন ছিলাম তখন ডিসি হিলে আগের দিন বর্ষবিদায় পরের দিন বর্ষবরন ছিল নিয়মিত প্রিয় অনুষ্ঠান যাতে সক্রিয় অংশগ্রহন ছিল আমার। চাকুরীতে ঢোকার পর থেকে উৎসবে যোগ দেয়া হতো না, কারন পহেলা বৈশাখে আমার বিদেশী কোম্পানীর ছুটি নাই। তবু পরিবারের অন্যান্য সদস্যের কেউ না কেউ তাতে অংশ নিত সানন্দে। সেবার পয়লা বৈশাখে আমার সব বোনেরা ভোরে চলে গেল ডিসি পার্কে। ওরা কখনো সবাই একসাথে যেতো না বাসায় আম্মাকে একা রেখে। কেউ না কেউ থাকতো আম্মার সাথে। সেবারই প্রথম গেল। আমি তখনো ঘুমিয়ে। গতকাল বাংলাদেশ কেনিয়াকে হারিয়ে আইসিসি ট্রফি চ্যাম্পিয়ান হয়েছে সেই সুখ গায়ে মেখে আরো একটু গড়িয়ে নিচ্ছি। অফিসে যাবার জন্য বেরুবো সাতটার একটু পরে। হঠাৎ মার কন্ঠ পেলাম, উদ্বিগ্ন। বললো, দেখতো তোর বাবা ঘুম থেকে উঠছে না কেন? আমি ভাবলাম, বাবা তো দেরীতেই উঠে, এত তাড়াতাড়ি ডাকার দরকার কি। তবু মার কন্ঠে কি একটা যেন ছিল, আমি গেলাম বাবার ঘরে। মশারি আধখোলা, বাবা শুয়ে আছে ঘুমে। অস্বাভাবিক লাগলো না। কাল রাতে বাবা হঠাৎ প্রচন্ড বমি করে, ব্লাড প্রেশার বেশী ছিল বোধহয়। আমরা মাথা ধুয়ে দিলে ঘুমিয়ে পড়েছিল। কিন্তু সেই ঘুম যে আর ভাঙবে না, কে জানতো।

আমি যখন বাবা ঠান্ডা কপালে আমার হাতটা রাখি, তখনো আমার কোন ধারনা নাই কী দেখতে যাচ্ছি। আমি বাবাকে গা ধরে ঝাকালাম, ডাকলাম। বাবা বাবা। নড়ছে না। নাকের কাছে হাতটা নিলাম, একি? গরম নিঃশ্বাস কই? হাত ধরলাম, পালস খুজলাম। আমার মাথা খারাপ হয় নি তো। না না। আবার দেখতে হবে। আমি মার দিকে তাকালাম। বোবা আমার ভাষা। আমি বললাম, ডাক্তার ডাকতে হবে। আমি দৌড়ে পাশে এক বন্ধুর বাসায় গেলাম। ইনামের বোন ডাক্তারী পাশ করেছে মাত্র। বাসায় মা ছাড়া একটা প্রানীও নেই। আমি পাগলের মতো ইনামের বাসায় গিয়ে বললাম, "বাবা তো ঘুম থেকে উঠছে না। মুন্নীকে ডেকে বল সে যেন একটু দেখে কী হয়েছে, অ্যাম্বুলেন্স ডাকতে হবে বোধহয়।" ওখান থেকে মেজ চাচার বাসায় ফোন করলাম, বললাম- 'বাবা ঘুম থেকে উঠছে না। তোমরা একটু আসো।' আবার আরেক দৌড়ে গেলাম আরেক বন্ধু পারভেজের বাসায়। ওকে বললাম তুই একটু আমার বাসায় যা, বাবা ঘুম থেকে উঠছে না, কি হয়েছে বুঝতে পারছি না। আমি মোড়ে এসে একটা টেক্সী নিলাম। ছোট চাচাদের বাসায় ফোনে পাইনি, টেক্সি নিয়ে গেলাম ওদের বাসায়, ওরা সবাই অবাক আমাকে দেখে। বললাম, 'বাবা ঘুম থেকে উঠছে না, তোমরা একটু যাও, কি হয়েছে জানি না।' আমি এই একলাইন বলে দৌড়ে বেরিয়ে গেলাম। কোথায় যাবো? মনে পড়লো ডিসি পার্কে যেতে হবে। আমার বোনেরা সবাই ওখানে আছে, ছোটবোন সুমীর গান গাওয়ার কথা আজ। ওদের নিয়ে আসতে হবে।

আমি পার্কের কাছাকাছি যেতেই প্রচন্ড ভীড়ের মধ্যে পড়লাম। টেক্সী দুরে দাঁড় করিয়ে হাঁটা দিলাম ভেতরের দিকে। এত মানুষ, এত মানুষ। কোথায় খুঁজে পাবো ওদের হাজার হাজার মানুষের ভীড়ে। সবাই হাসি-খুশীতে উচ্ছল। কিন্তু আমার চোখ পড়ছিলনা কিছুতে। আমি কাঁদছিলাম না। কিন্তু আমি কিছু ভাবছিলামও না। আমার ভাবনা ছিল শূন্য, একেবারে শূন্য। আমি হাজারো মানুষের ভীড়ে উদভ্রান্তের মতো এদিক সেদিক ছোটাছুটি করে খুঁজছি আমার বোনদের। কোথায় ওরা? কীভাবে পাবো এত মানুষের ভীড়ে? আজ কী শাড়ী পরে এসেছে ওরা, হলুদ না বাসন্তী? পহেলা বৈশাখে মেয়েরা কী রঙের শাড়ি পরে? আমার কিছুই মনে পড়ছিল না। আমি বিভ্রান্ত হয়ে দাড়িয়ে আছি ভিড়ের মধ্যে। লোকজন আমাকে দেখে কী ভাবছিল জানি না। কিন্তু আমি কিছু ভাবছিলাম না। আমি ছিলাম শূন্য, একেবারে শূন্য মানব। আমি জানিনা আমার বাবার কী হয়েছে। শুধু জানি বাবা ঘুম থেকে উঠছে না, উঠবে না। বাবা নেই। কীভাবে আমি ওদের মুখ দেখাবো এখন, কোন মুখে বলবো সেকথা। ওরা বাবাকে জীবিত জেনে ঘর থেকে বেরিয়েছে সকালে। পহেলা বৈশাখের এই উৎসবে এসেছে, ১০ বছর বয়সী সবচেয়ে ছোটবোন দিশা আর কখনো আসেনি পহেলা বৈশাখের মেলায়। ওর বায়না ছিল আপুদের কাছে এবার নিয়ে যেতে হবে ডিসি পার্কের পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানে। তাই ওকেও নিয়ে এসেছে এই নববর্ষের উৎসবে। এই বিপুল উৎসবে আমি এখন কীভাবে তাদের বলি, বাবা আর নেই? বাবা ছিল, এখন নেই। কিভাবে বলি আমাদের বাবা আমাদের না বলে কোন অজানায় চলে গেছে, এই পৃথিবীতে আমরা আর কোনদিন খুঁজে পাবো না আমাদের প্রিয় বাবাকে। কোথাও না। কীভাবে করি আমি সেই কঠিন উচ্চারন।

ঠায় কয়েক মিনিট দাড়িয়ে হঠাৎ বোধ হলো, আমি এখানে কি করছি? বাসায় মা একা, দখিনের বেডরুমে বাবার পাশে বসে আছে, বাবা আমার চির ঘুমে। নিশ্চয় এঘুম ভাঙবে না। আমি এখন ফিরে যাই, ওদের খুজে পাবো না বোধহয়। না জানি মা একা একা কী করছে। চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে খুঁজলাম আবার শেষবারের মতো। তখনি চোখ আটকে গেল এক জায়গায়। ওই তো দিশাকে দেখা যায়। হাসছে। ওরা সবাই ওখানে বসে গল্প করছে, গান শুনছে। আমি এখন ওখানে গিয়ে দাঁড়াবো। ওরা আমাকে দেখে অবাক হয়ে যাবে। বলবে, ভাইয়া তুমিও চলে এসেছো অফিস ফাঁকি দিয়ে? না, আমি ওদের অবাক হতে দেবো না। আমি মুখটা নির্বিকার করে থাকবো। এই উৎসবের মেলায় আমি কোন ক্রন্দনের সুত্রপাত হতে দেবো না। যত কান্না ওরা বাসায় গিয়ে কাঁদুক। বাইরের মানুষের আনন্দে ব্যাঘাত ঘটাবো না আমরা ক'ভাইবোন। আমি এখন কিছুই বলবো না।

আমি সোজা ওদের কাছে গিয়ে বললাম, "চল এখন বাসায় চল, বাবার অসুখ করেছে।" কান্না চেপে কী করে শব্দগুলো উচ্চারন করেছিলাম এখন অবাক লাগে। আমি একফোঁটা কাঁদিনি। আমি শক্ত, শূন্য হয়ে ছিলাম। ওরা আমার পিছু পিছু এসে টেক্সীতে উঠলো। পুরো রাস্তা নিশ্চুপ। একটা কথাও বলিনি আমরা। নিঃশব্দের উচ্চারনগুলো কিভাবে ভাব বিনিময় করেছিল আজ মনে পড়ে না। বাসার সামনে যখন টেক্সীটা থামলো, গেটের সামনে দেখলাম অনেক মানুষের ভীড়, অনেক মানুষ। আর আমার উৎসব ফেরত বোনেরা হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে দৌড়ে ছুটলো বাসার দিকে। তারপর?...........থাক, আর বলতে পারছি না। বুকটা ভার হয়ে গেছে এত বছর পরও।

তবে সেইদিন থেকে পহেলা বৈশাখ আমাদের জীবনে হারাম হয়ে গেল। আমরা আর কখনো পহেলা বৈশাখে হাসতে পারিনি। সবাই যখন পান্তা ইলিশে ব্যস্ত থাকে, আমরা তখন ছুটে যাই বাবার কবরের পাশে যেখানে আমাদের খুব প্রিয় বাবা একাকী শুয়ে আছে অনেক বছর ধরে। গিয়ে অপরাধী মনে চুপচাপ কিছুক্ষন কাটিয়ে চলে আসি। বাবার তো এরকম একা থাকার কথা ছিল না এসময়ে। সেই আমার মধ্যবিত্ত বাবা।


মধ্যবিত্ত আমিঃ
বাবার যখন মৃত্যূ হয় তখন আমার মাত্র নতুন চাকরী। বেতন খুব কম। এই টাকায় সংসার চলবে না। ছোট চার বোন পড়াশোনা করছে স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত। তাদের সবকিছু দেখাশোনার ভার এখন আমার উপর। বাবা থাকতে আমি কোন কাজ করতাম না বাসায়। কোনদিন ইলেকট্রিক, গ্যাস, ওয়াসার বিল দেই নি। এমনকি জানিও না কোথায় কিভাবে দিতে হয়। সব কিছু বাবাই করতেন। এমনকি বাজারটাও। আজ এতকিছু আমি কী করে সামলাবো। ভাবনাগুলো চাপা দিয়ে শক্ত হবার চেষ্টা করলাম। বাবার মধ্যবিত্ত জীবনের অবসান হলো, এবার আমার মধ্যবিত্ত জীবনের শুরু। জীবনের আসল পরীক্ষা। শক্ত হাতে ধরতে হবে জীবনের হাল। এতগুলো মানুষের ভার যেন আমি বইতে পারি। আমি যেন ভেঙ্গে না পড়ি। আমার কাধ যেন হয় অনেক শক্ত, মজবুত।

আমি পেরেছিলাম। হ্যাঁ, একে অদ্ভুত এক দৈবী সহায়তা বলবো আমি। যখন যা দরকার আমি পেয়ে গেছি। কীভাবে যেন সব হয়ে গেছে। বাবার মৃত্যূর এক মাসের মধ্যে আমার প্রমোশন হলো। ব্যাপক ইনক্রিমেন্ট। গোটা চাকরী জীবনে এই বিষ্ময় কাটেনি। ঠিক যখন দরকার তখনি পেয়ে গেছি। এরপরও পেয়েছি। পেয়েই গেছি একের পর এক। প্রয়োজন তৈরী হবার আগেই পাওয়া। কখনো কোন কাজে সমস্যা হয়নি আমার। একদিনও অর্থকষ্ট দেখতে হয়নি আর। তরতর করে না হলেও ধাপে ধাপে উপরে উঠেছি। নিজ পায়ে দাড়িয়েছি। যতটুকু শক্ত হয়ে দাড়ানোর কথা ছিল, তার চেয়েও বেশী। যোগ্যতার চেয়ে বেশী পেয়েছি আমি। যতটুকু পাবার কথা ছিল, তার চেয়ে বেশী পেয়ে গেছি। আমার আর কিছু চাইবার নাই জীবনের কাছে। আমি ভাবি পেয়েছি অনেক বেশী দিয়েছি অনেক কম। হিসেবের সমীকরনটা মেলাতে হবে এবার বাকী জীবনে। তবে কেউ যেন না ভাবেন এই পাওয়াটা আর্থিক পাওয়া, এই পাওয়াটা বরং অনেক বেশী আত্মিক।

আমি এখনও মধ্যবিত্ত জীবন যাপন করি, মধ্যবিত্ত জীবনটা উপভোগ করি। মধ্যবিত্ত জীবনে টানাপোড়েনের এমন কিছু অনুভুতি আছে যা মানুষের চেতনাকে জাগিয়ে রাখে। আমি বড়লোক হতে ভয় পাই কারন বড়লোক মানে বেশী টাকা, আর মানুষের অনেক বেশী টাকা থাকাটা ভয়ংকর। একজন মানুষের সেই পরিমান টাকা থাকা উচিত যে পরিমান টাকা সে নিয়ন্ত্রন করতে পারে। মানুষের উচিত টাকাকে নিয়ন্ত্রন করা। কিন্তু টাকা যখন মানুষকে নিয়ন্ত্রন করে, মানুষ তখন অমানুষ হয়ে যায়। সেজন্যই আমি অনিয়ন্ত্রিত টাকাকে ভয় পাই এবং অনুপার্জিত টাকায় আস্থা নাই। অর্থের চেয়ে সম্মানের প্রতি জোর দেয়া চাই, দুর্নীতির হাতছানিকে গুডবাই জানাই। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আমি মধ্যবিত্ত জীবনই যাপন করতে চাই, সবকিছু পেয়ে যাওয়া বোরিং মানুষ হয়ে বেঁচে থাকতে চাই না। জীবনের সব চাওয়া যেন কানায় কানায় পূর্ন না হয়। একটু অপূর্নতা জীবনকে সমৃদ্ধ করে, সুন্দর করে। মধ্যবিত্ত ছাড়া কে আর এই অপূর্নতার স্বাদ পায়? কে না জানে - খিদে না থাকলে খাওয়ারও আনন্দ নেই।

No comments: