যে মানুষটি চিরকাল বিলাসী জীবনযাপন করে গেছে, সে মানুষটি যখন চরম আর্থিক দুর্দশায় পতিত হয় তখন তার জন্য করুণা ছাড়া আর কিছুই আসে না। হ্যাঁ ভদ্রলোক তখন সমাজের করুণারই পাত্র ছিলেন। সুখের পায়ারা সব উড়ে উড়ে দূরে সরে গেছে, অচেনা হয়ে গেছে। তিনি তাঁর সঞ্চয়ের সিংহভাগ দিয়ে ছোটখাট একটি একতলা টিনশেড বাড়ি তৈরী করেছিলেন পরিবারকে শহরে রেখে ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা করাবার জন্য। তিনি ও তাঁর স্ত্রী দুজনেই এ ব্যাপারে স্থির প্রতিজ্ঞ ছিলেন। বাসস্থান না হয় হলো, কিন্তু পরিবারের অন্ন বস্ত্র শিক্ষা চিকিৎসা এবং অন্যন্য নাগরিক ব্যয় মেটানোর উপায় কী? তাঁর এক পুত্র চার কন্যা। সবাই পড়াশোনা করছে স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় অবধি। কনিষ্ঠ সন্তান তখনো স্কুলে ভর্তি হয়নি। বাড়ি করার ফলে সাত জনের পরিবারের ঠাঁই মিললেও খাই মেটাবার প্রয়োজনটাও অনেক গুরুতর।
অতএব ভদ্রলোক অবশিষ্ট সঞ্চয় নিয়ে ব্যবসায় নামলেন। কিন্তু সারাজীবন চাকরী করে এসে ব্যবসায় হাত দিলে যা হবার কথা তাই হলো, তিনি যে ডাল ধরেন সেটাই ভেঙ্গে পড়ে। ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে যখন সব শেষ- তখন তাঁকে ধারকর্জ শুরু করতে হয়, গ্রামের জমিজমা, পরিবারের সোনাদানা বিক্রি শুরু করতে হয়। এমন অবস্থায় আত্মীয় স্বজনদের কেউ কেউ পরামর্শ দিল গ্রামে চলে যেতে, ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা বন্ধ করে কাজেকর্মে লাগিয়ে দিতে। এমন টানাটানি সংসারে পড়াশোনা করে কী হবে। ছেলেটা ইন্টার পাশ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার বিলাসীতা করছে কেন? তাকে এমএ পাশ করতে হবে কেন? কোথাও একটা কাজকর্ম করে বাপকে আর্থিকভাবে সাহায্য করলেই পারে।
এটা খুবই যৌক্তিক এবং বাস্তব কথা। একজন অফারও নিয়ে আসলো একটা পেট্রোল পাম্পের ক্যাশিয়ারের চাকরী, ১২০০ টাকা বেতন।
নিরুপায় ভদ্রলোক এই প্রস্তাবে প্রায় নিমরাজী হয়ে গেলেও রুখে দাঁড়ালেন ভদ্রলোকের স্ত্রী। তিনি কিছুতেই ছেলেকে এখন চাকরী করতে দেবেন না। পড়াশোনা শেষ করতে হবে। উপোষ করে হলেও তিনি পড়াশোনা করাবেন ছেলেমেয়েদের। হ্যাঁ শুধু ছেলে নয়, চার কন্যার সবাইকে তিনি পড়াবেন। একটা রীতিমত পাগলামী। এমন পাগলামীতে কেউ সায় দেয় না। আত্মীয় স্বজন দূর থেকে করুণার দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে অপেক্ষা করছে কখন এদের চুড়ান্ত পতন ঘটবে। পতনটা নিশ্চিত, শুধু সময়ের অপেক্ষা।অতএব ভদ্রলোক অবশিষ্ট সঞ্চয় নিয়ে ব্যবসায় নামলেন। কিন্তু সারাজীবন চাকরী করে এসে ব্যবসায় হাত দিলে যা হবার কথা তাই হলো, তিনি যে ডাল ধরেন সেটাই ভেঙ্গে পড়ে। ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে যখন সব শেষ- তখন তাঁকে ধারকর্জ শুরু করতে হয়, গ্রামের জমিজমা, পরিবারের সোনাদানা বিক্রি শুরু করতে হয়। এমন অবস্থায় আত্মীয় স্বজনদের কেউ কেউ পরামর্শ দিল গ্রামে চলে যেতে, ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা বন্ধ করে কাজেকর্মে লাগিয়ে দিতে। এমন টানাটানি সংসারে পড়াশোনা করে কী হবে। ছেলেটা ইন্টার পাশ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার বিলাসীতা করছে কেন? তাকে এমএ পাশ করতে হবে কেন? কোথাও একটা কাজকর্ম করে বাপকে আর্থিকভাবে সাহায্য করলেই পারে।
এটা খুবই যৌক্তিক এবং বাস্তব কথা। একজন অফারও নিয়ে আসলো একটা পেট্রোল পাম্পের ক্যাশিয়ারের চাকরী, ১২০০ টাকা বেতন।
পেছনে তাকিয়ে পরিবারের জ্যৈষ্ঠ সন্তানটি অবাক হয়, শিউরে ওঠে। কী ভয়াবহ দিন পার হয়ে এখানে এসেছে! কিসের জোর, কার মনোবল, কার আত্মবিশ্বাস, কেমন অপরিনামদর্শীতা? যদি এমন না হয়ে সত্যি সত্যি বিপর্যয় ঘটতো?
বিশ বছর আগে প্রয়াত ভদ্রলোক তাঁর সন্তানদের সাফল্য দেখে যেতে পারেননি। তিনি কী এখন ওই পার থেকে দেখে দেখে আনন্দিত হচ্ছেন? যে কনিষ্ঠ সন্তানকে তিনি অনিশ্চিত জীবনে ক্লাস থ্রিতে রেখে চলে গিয়েছিলেন সে এখন দেশের একটা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, উচ্চতর ডিগ্রী আনার জন্য ইউরোপ গেছে। বাকী সন্তানেরাও সবাই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে নিজ নিজ ক্ষেত্রে। এই সব কী তিনি কখনো স্বপ্নেও ভেবেছিলেন?
তাঁর সন্তানেরা এখন সব সুসময়ে বাবার জন্য আকুল হয়ে কাঁদে। কেন বাবা এসব দেখে যেতে পারলো না। আরেকটু পরে গেলে কী এমন অসুবিধা হতো? [পাঠকের ধারণা হবে না, এই লাইনটি লিখতে লেখকের চোখ দিয়ে টপটপ করে জল গড়িয়েছিল]
তাঁর সন্তানেরা এখন সব সুসময়ে বাবার জন্য আকুল হয়ে কাঁদে। কেন বাবা এসব দেখে যেতে পারলো না। আরেকটু পরে গেলে কী এমন অসুবিধা হতো? [পাঠকের ধারণা হবে না, এই লাইনটি লিখতে লেখকের চোখ দিয়ে টপটপ করে জল গড়িয়েছিল]
তবু শান্ত্বনা। তাদের মা আছে এখনো। মা সবকিছু দেখেছে। যে মায়ের সেদিনের দৃঢ়তায় তাদের আজকের এই সংহত অবস্থান তিনি এখনো আছেন। তাঁর সাথেই তাদের নিত্য বসবাস।
আমি একজন অকৃতজ্ঞ অযোগ্য মানুষ। যাদের কারণে জীবনে আমার এতকিছু পাওয়া হলো তাদের চিরকাল করে গেছি অবহেলা। তাদের প্রতি কখনো সুবিচার করতে পারিনি। ভালোবাসাটুকুর প্রকাশও কখনো প্রকাশ্যে ঘটাতে পারিনি। তাদের আড়ালে চুপচাপ একটা ব্লগে লিখে রাখছি নিজেকে শান্ত্বনা দেবার মতো করে। তোমরা আমাদের জন্য যা করেছো, দিয়েছো, আমি আমার সন্তানদের তার কণামাত্রও দিতে পারবো না। সন্তান হিসেবে আমি যেমন অযোগ্য ছিলাম, পিতা হিসেবেও। আমাকে যারা ভালোবাসে তারা ভুল করেই বাসে। এই ভুলটা আমি শোধরাই না। কারণ আমি চিরকাল ভালোবাসারই কাঙাল।
যে দুজন মানুষের জন্য আমার এই লেখাটি, তাঁদের ছবিটবি দেবার দরকার আছে কিনা কিছুক্ষণ ভাবলাম। তারপর ঠিক করলাম, ছবি দিতে দ্বিধা কেন। তাঁরা কে, অন্তত ছবি দেখে জানুক। ওশিন-শিহান-সামিহা-মাতৃকা বড় হয়ে কখনো এই লেখা পড়লে জানবে দাদা-দাদী/নানা-নানী তাদের বাবা-ফুফু/মামা-খালাদের জন্য কী করেছিল।
দুজনের একসাথে তোলা এটাই সর্বশেষ ছবি। শুনে এ যুগে অনেকে অবাক হবে যে এরা দুজন এই প্রথম কক্সবাজার বেড়াতে এসেছে। একই জেলার মানুষ হয়েও(কক্সবাজার চট্টগ্রামের অধীনে ছিল একসময়) আগে কেন আসেনি? জানি না। ছেলেমেয়েদের মানুষ করতে গিয়ে নিজেদের ঘুরে বেড়ানোর শখ বিসর্জন দিয়েছিলেন হয়তো। ছবিটা ১৯৯৪ সালের ফেব্রুয়ারী মাসের।
No comments:
Post a Comment