Sunday, March 11, 2018

ফিকশন পড়ি না কেন?

আমাদের ব্যস্ত জীবনে বই পড়ার জন্য আলাদা সময়  বরাদ্দ করা কঠিন কাজ। আলাদা সময় নিয়ে আয়েশ করে চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে বইয়ের পাতা উল্টে যাবার যে কল্পনা সেটা প্রায় সোনার পাথর বাটি। সেদিন সমমনা একজনের সাথে বইপড়া নিয়ে আলাপ করতে গিয়ে প্রসঙ্গ উঠলো - ফিকশন বিষয়ে। অনেকদিন ফিকশন পড়ছি না আমরা দুজনেই। অর্থাৎ গল্প উপন্যাস থ্রিলার ইত্যাদি বিষয় কেন আজকাল আমাদের দুজনকেই টানতে পারছে না।

আমাদের দুজনেরই বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি চলে এসেছে। পড়াশোনার জন্য এই বয়সে আমাদের পছন্দ ঘুরে গেছে নন ফিকশনের দিকে। আমরা বইয়ের দোকানে গিয়ে এখন আর গল্প উপন্যাস খুঁজি না। খুঁজে খুঁজে পড়ি যতসব কাঠখোট্টা বিষয়। এর কারণ কী? বয়সের সাথে সাথে জীবন থেকে রসকষ কমে যেতে থাকে? আমার সহযাত্রী বললেন, চল্লিশ থেকে পঞ্চাশের মধ্যেকার বয়সটা ফিকশন থেকে দূরে থাকে মানুষ। আবার পঞ্চাশ থেকে ষাটের দিকে যেতে যেতে ফিকশনের প্রতি ঝোঁক বাড়ে। এটা নেহাতই একটা নিজস্ব মতামত। তবে এই সংক্ষিপ্ত আলোচনায় আমরা দুজন নিজেদের বোঝাতে চেষ্টা করলাম যে আমরা এখন যে গল্প উপন্যাস কিনে পড়ছি না সেটার জন্য দায়ী আমাদের বয়স। একটা সময় পার হবার পর আমরা আবারো গল্প উপন্যাস পড়া শুরু করবো।

কিন্তু ধারণাটি ভুল প্রমান করে গত এক সপ্তাহে তিনটি উপন্যাস পড়ে ফেলার পর ভাবতে লাগলাম, এই যে বয়সের সীমাবদ্ধতার অজুহাত দিয়ে অনেকদিন গল্প উপন্যাস পড়িনি তার  জন্য আমি কতটা ক্ষতিগ্রস্থ হলাম। লেখক/প্রকাশক কতখানি ক্ষতিগ্রস্থ হলেন?

দায়টা যারই হোক, আমাদের বই পড়ার মতিগতিকে নিয়ন্ত্রণ করার পেছনে সময় দুঃসময়ের একটা ভূমিকা থাকে। যে কারণে আমি দীর্ঘদিন পর তিনখানা উপন্যাস পড়ে উঠতে পারলাম তার প্রথম কারণ ঔপন্যাসিক শওকত আলীর প্রয়ান।

তাঁর প্রস্থানের কয়েকদিন পর এক রাতে হঠাৎ মনে পড়ে গেল কয়েক বছর আগে তাঁর 'প্রদোষে প্রাকৃতজন' আধপড়া রেখে উঠে গিয়েছিলাম কোন জরুরী কাজে। ফিরে এসে আর বসা হয়নি।

একটা নির্দোষ গ্লাণি নিয়ে 'প্রদোষে প্রাকৃতজন' বইটা আবারো নামিয়ে নিলাম। পড়া শেষ করলাম দুদিনে। বেঁচে থাকা মানুষের চেয়ে চলে যাওয়া মানুষের মূল্য বেশী আমাদের কাছে। পড়া শেষ করে আক্ষেপ হলো আরো আগে কেন পড়া হলো না বইটি।

একই সুত্রে মনে পড়লো নবারুণ ভট্টাচার্যের হারবার্টও পড়ার জন্য রেখেছিলাম বেশ কিছুকাল আগে। তারপর ওটাও নামালাম এবং শেষ করলাম। ওটা শেষ করে যখন স্তব্ধ হয়ে বসে আছি, তখন ইচ্ছে করলো একটা পাঠানুভূতি লিখে মনটা হালকা করি। কিন্তু শরীরে কেমন একটা জ্বরজ্বর বোধ করলো হঠাৎ। ল্যাপটপ খোলার বদলে কিণ্ডল খুলে আরামদায়ক কিছু পড়ার জন্য খুঁজলাম।

এরকম শারিরীক অস্বস্তিকর সময়ে ফিকশনই ভালো। কিণ্ডলে আঙুল বোলাতে বোলাতে পেয়ে গেলাম সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ'র পঞ্চাশ দশকের উপন্যাস 'আগলি এশিয়ান' এর অনুবাদ 'কদর্য এশীয়'। ইন্টারনেট থেকে বইটা নামিয়েছিলাম বছর দুই আগে। কিন্তু ফিকশন থেকে দূরে থাকার কারণে পড়া হয়ে ওঠেনি। এই ঝোঁকে টানা তৃতীয় উপন্যাস হিসেবে পড়া হয়ে গেল বইটি।

পড়া শেষে প্রথম যে প্রশ্নটি উদয় হলো, পঞ্চাশের দশকে বাংলা ভাষাকে সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহর চেয়ে আধুনিকভাবে আর কেউ উপস্থাপন করেছেন কী? আমার পড়াশোনা নিতান্তই কম, তাই প্রশ্নটির উত্তর বোদ্ধাদের জন্য মূলতবী রাখতে হলো।

কিন্তু 'আজকাল ফিকশন পড়ি না' বলেও একটানা তিনটা উপন্যাস শেষ করার কৃতিত্ব কার? সময়ের? লেখকের? নাকি পাঠকের মতিভ্রমের?

No comments: