বাংলা ভাষার পাঠকমাত্রেই একটা বিষয়ে একমত হবেন যে অন্তত বইপত্র বিষয়ে রাজনৈতিক মানচিত্র অকার্যকর। অর্থাৎ আমরা যখন বই কিনি, তখন আমাদের মাথায় কখনো কাজ করে না বইটি এপার বাংলা নাকি ওপার বাংলার। আমাদের বুকশেলফে উভয়বাংলার বই একই আদরে সাজানো থাকে। এই বিষয়টি খুব চমৎকার লাগে আমার। এই কারণেই বোধহয় আমি চট্টগ্রামের মানুষ হলেও সুদূর কলকাতাকে আমার ঢাকার চেয়ে খুব বেশী অনাত্মীয় মনে হয় না। কোন কোন ক্ষেত্রে আমি কলকাতার প্রতি বেশী মাত্রায় নস্টালজিক। বিশেষ করে উনিশ শতকের কথা এলে। যেন আমি কখনো এই শহরে বাস করেছিলাম। এই নস্টালজিয়ার কিছুটা তৈরী করেছে সুনীল, সমরেশের মতো সাহিত্যিকগণ। কলকাতা নিয়ে তাই আমার কিছু বাড়তি আহ্লাদ কাজ করে। এর বাইরেও বোধহয় আরো কিছু আছে।
একটা উদাহরণ দেই।
আমি ভারতে খুব বেশী জায়গায় যাইনি। কলকাতা, দিল্লী, সিমলা পর্যন্ত আমার দৌড়। সেবার সিমলা থেকে ফেরার পথে ছোটখাট একটা দুর্ঘটনা ঘটেছিল। অন্য কোনদিন লিখবো ঘটনাটি। সেই দুর্ঘটনার পর একটা অনিশ্চিত অবস্থায় দিল্লী এসে পৌঁছানোর পর হাঁপ ছেড়ে বাঁচি। মনে হলো একটু চেনা জায়গায় আসতে পেরেছি। কিন্তু দিল্লী থেকে রাজধানী এক্সপ্রেসে যখন শিয়ালদার প্ল্যাটফর্মে পা রাখলাম, তখন পূর্বেকার সব ধকল নিমেষে মুছে গিয়ে মনে হলো আমি নিজের শহরে ফিরলাম। তখনই আমার বুকে একটা বিশাল স্বস্তিদায়ক আত্মবিশ্বাস জাগলো যে এখানে আমি স্বাধীন।
আসলে এই স্বাধীনতা হলো ভাষার। বাংলা ভাষায় প্রাণ খুলে কথা বলার স্বাধীনতা। যেটার অভাবে দিল্লী, সিমলায় আমার প্রাণ আইঢাই করছিল। আমার আর কলকাতার মাতৃভাষা এক। সুতরাং আমার নস্টালজিয়াতে কলকাতার একটা অবস্থান থাকেই।
আরো একটা কারণে এই নস্টালজিয়া আসতে পারে- সেটা জিনগত। আমাদের পূর্বপুরুষের কেউ কেউ কলকাতায় এসে পড়াশোনা করেছেন, চাকরীবাকরী করেছেন। দেশভাগের পর যা এফোড় ওফোড় হয়ে যায়। যে কারণে দেশভাগ নিয়ে যে কোন পুস্তক আমাদের বুকেও সমান ঘা দিয়ে যায়। যে কারণে ঋত্বিক ঘটকের চলচ্চিত্রের বেদনা আমাদের বেশী আলোড়িত করে। যে কারণে দেবেশ রায়ের 'বিষাদবৃক্ষ' আমাদের খুব নাড়া দেয়। অসীম রায়ের 'আবহমান' পড়ে আমরা উনিশ শতকে ফিরে যাই। কিংবা তপন রায় চৌধুরীর 'বাঙালনামা' পড়ে মনে হয় এই তো তিনি আমার পাশের বাড়িতেই ছিলেন সেদিন।
এমন বইপত্রের গ্রুপেও যখন দুই বাংলার মানুষদের একই সাথে মেতে উঠতে দেখি তখন আমার মনে পড়ে যায়- রাজনৈতিকভাবে দেশ দুটো আলাদা হলেও বইয়ের মানচিত্রে আমাদের একটা সার্বজনীন একতা আছে। বাংলা ভাষার বই ভূগোলে আমাদের যে ঐক্য, সেই ঐক্যটা একটা তানপুরার মতো। সে তানপুরার সুর আমার বড় প্রিয়। কলকাতা না গিয়েও আমি সে সুর পাই বাড়ির কাছের 'বাতিঘর' থেকে। তবু প্রাচীন বৃক্ষ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা পুরোনো কলকাতার ফুটপাতে হাঁটার লোভে আমি কিছুদিন পরপর নিজেকে শোনাই - চল, আবারো কলকাতা ঘুরে আসি কদিনের জন্য। পাসপোর্ট-ভিসা-ইমিগ্রেশন-কাঁটাতার যন্ত্রণা না থাকলে যে কোন সময় বাসে উঠে পড়তাম।
এই যে একান্ত বোধগুলো লিখলাম এটা কেবল এপার বাংলার। ওপার বাংলার মানুষের তেমন কোন বোধ কাজ করে কী? মাঝে মাঝে জানতে ইচ্ছে করে।
No comments:
Post a Comment