আমাদের বাসায় যারা এসেছেন তারা নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছেন ড্রইং রুমে এক সেট পুরোনো আমলের কাঠের সোফা আছে। পাঁচ আসনের সোফা সেটে দশটি ফোম বসানো। সেগুন কাঠের সোফাটি এখনো সম্পূর্ণ অক্ষত। আসলে খুব বেশী পুরোনো বলা চলে না। গুনে গুনে ৩২ বছর মাত্র। অর্ধশতকও পূর্ণ হয়নি। এমন ডিজাইনের ফার্নিচার আজকাল কেউ সাজিয়ে রাখে না ড্রইংরুমে। আর্থিক সামর্থ্য আসার পর মানুষ পুরোনো জিনিসপত্র ফেলে দিতে শুরু করে। আমরাও ফেলে দিয়েছি অনেকগুলো। কিন্তু এটা এখনো ব্যবহার অনুপোযোগী হয়নি বলে ফোম আর কাভার বদলে রেখে দিয়েছি। এই সোফাসেটটা আমাদের পরিবারের কালের সাক্ষী বলা চলে। এর উপর দিয়ে অনেক ঝড়বাদল, অনেক ঘটনা দুর্ঘটনা ঘটে গেছে। তবু সে টিকে আছে। তালগাছের মতো একা দাঁড়িয়ে। কেন রেখেছি তাকে? বলছি একটু পরে।
গত দুই দশকে আমাদের আত্মীয় স্বজনে যেসব পরিবার মধ্যবিত্ত ছিল, তাদের সবার চেহারা বদলে গেছে। দাদা কিংবা নানার পরিবারের যে বংশধর, সবাই নানান দিকে ব্যাপক উন্নতি করেছে। তিন দশক আগে যে পরিবারগুলো টেনেটুনে দিন পার করতো, তারা সবাই এখন স্বচ্ছলতার মগডালে উঠে গেছে। কেউ কেউ এত উপরে উঠেছে যে পেছনের কালি ঝুলি মোছামুছি করতে করতে বর্তমানকে এতটা তেল চকচকে পিছলা করেছে তাতে আমার দৃষ্টি হোঁচট খায় মাঝে মাঝে। অতীতের কোন চিহ্ন রাখতে চায় না বাঙালীরা। এটাই মনে হয় স্বাভাবিক আচরণ।
কিন্তু আমি কেন যেন পুরোনোকে পুরোপুরি বাদ দিতে পারি নি। কিছুটা উন্নতি আমিও করেছি, সন্দেহ নেই। কিন্তু সে উন্নতির পেছনে আমার অতীতের ভূমিকাকে আমি বারবার টেনে আনি। এ আমার মধ্যবিত্ত সংকীর্ণতা। সবাই মধ্যবিত্ত থেকে বের হয়ে যাবার আপ্রান চেষ্টা চালালেও, আমি যেন সেটাকেই আঁকড়ে ধরে রাখতে চাইছি। অথবা মধ্যবিত্ত চরিত্র আমাকে ছাড়তে চাইছে না।
সেই যে সোফাসেটের কথা বলেছি, ওটা তার একটা উদাহরণ। নতুন ফ্ল্যাটে ওঠার পর ড্রইংরুমে দুই সেট সোফার দরকার হয়ে পড়ে। নইলে ঘরটা খালি খালি লাগছিল। এক সেট পুরোনো সোফা রয়ে গেছে, ওটাকে বাদ দেয়া হবে কিনা সেটা নিয়ে পারিবারিকভাবে সিদ্ধান্ত নেয়া হলো। ওটা থাকবে সাথে নতুন একটা কেনা হোক। যখন আমি নতুন সোফাসেট অর্ডার দিতে গেছি, তখন শো রুমের চোখ ধাঁধানো বিশাল বপুর হাল ফ্যাশনের সোফাগুলো আমাকে টানতে পারছিল না। আমি একটি মলিন চেহারার সোফাসেট অর্ডার দিলাম। পুরোনো সোফাটার সাথে যেন মানানসই হয়। যদি পুরোনোকে বাদ দিয়ে নতুন দুই সেট কিনি, তাহলে আমার ড্রইংরুমে একটা বড়লোকী ছাপ এসে যায়। এহেন আধুনিক ফ্ল্যাটবাড়িতে সবাই বড়লোকি ছাপ নিয়ে থাকতে চায়। কিন্তু ওটা আমি চাই নি। আমি আমার বর্তমান লেভেল থেকে আর এক ধাপও উপরে উঠতে রাজী নই।
সে না হয় বোঝা গেল। কেউ কেউ আরো বেশী উন্নতি চায় না। থেমে যায় এক জায়গায় পৌঁছে। কিন্তু সেই সোফা কাহিনীটা কী?
আদতে এই সোফাটার সাথে আমার বাবার খুব ঘনিষ্ট স্মৃতি জড়িত। বাবা খুব শখ করে কিনেছিলেন অনেক দাম দিয়ে। যখন টাকার অনেক দাম ছিল, যখন অল্প টাকায় অনেক কিছু কেনা যেত, যখন মাত্র ১০০ টাকা দিয়ে বস্তাভর্তি বাজার করা যেতো, যখন ১ টাকা দিয়ে দুই মাইল রিকশা চলতো, দেড় টাকা কেজি চাল বিশ টাকা কেজি মাংস খেতো লোকে, যখন ৩ টাকার কলম আর দুই টাকার কাগজ দিয়ে দশটা পরীক্ষা দেয়া যেতো, যখন ৪০০ টাকা দিয়ে দুই বেডের বাসা ভাড়া পাওয়া যেতো, তখন বাবা ৬০০০ টাকা দিয়ে আসল সেগুন কাঠের এই সোফাটি কিনে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেন।
সোফা কিনে তাক লাগানোর কথা শুনে আজকাল অবাক হবে অনেকে। সোফা কিনে তাক লাগানোর আগে রঙিন টিভি কিনেও তাক লাগিয়েছিল বাবা। আমাদের যে সকল আত্মীয় স্বজনের চকচকে উন্নতির কথা বললাম, তাদের কারো বাসাতে তখনো এমন সোফাসেট কিংবা রঙিন টিভির প্রবেশ ঘটেনি। তা বলে তারা যে হতদরিদ্র ছিল তাও নয়। কিন্তু টানটান নিন্মমধ্যবিত্ত জীবন সবার। রঙিন টিভি তখন চোখের ক্ষতি করতো বলে প্রায়শ আমরা শুনতাম। তবে সোফাসেট শরীরের কোন ক্ষতি না করলেও বাবার মধ্যে একটা সংকোচ কাজ করেছিল এটা কেনার পর। তাই সোফা যখন কেনা হয় তখন বাবাকে একটা মিথ্যা কথা বলতে হয়েছিল। বাবা যখন প্রভূত আর্থিক উন্নতির সোপানে দাঁড়ানো। তবু আত্মীয় স্বজন যেন মনে কষ্ট না পায়, সে কারণে সোফা কেনার সময় বাবা সবাইকে বলেছিল, তার এক বন্ধু ঢাকা চলে যাবার সময় সোফাগুলো কম দামে গছিয়ে গেছে। সেই মিথ্যাটা আমরা অনেকদিন চালু রেখেছিলাম।
এই সোফাতে বসে বাবা প্রতিদিন খবরের কাগজ পড়তো, সারাদিন চুমুকে চুমুকে চা খেতো, অতিথি আসলে আদর আপ্যায়ন করে বসাতো, গল্প করতো হরদম। নতুন বাড়িতে ওঠার পর বাবার অবসর যাপনের একটা প্রিয় সঙ্গী ছিল এই সোফাসেট।
এই সোফাসেট কেনার সময় বাবা কী জানতো এটার আয়ু বাবার চেয়ে অনেক বেশী হবে? অত খেয়াল করে কেউ কেনে না। কিন্তু আমি এই বয়সে এসে, পঞ্চাশের কাছাকাছিতে, শোপিস বা ফার্নিচারের মতো জড় পদার্থ যা কিছুই কিনি, মনে মনে বলি, এটার আয়ু আমার চেয়ে বেশী হবে।
আমি আমৃত্যু মধ্যবিত্তই থেকে যাবার চেষ্টা করবো। আমার পুত্র হয়তো চেষ্টা করতে পারে মধ্যবিত্তের শেকল ছিঁড়ে বের হয়ে যেতে। আমার মধ্যবিত্ত বাবাকে ছেড়ে আমি উচ্চতর সিঁড়িতে যেতে চাই না। জীবিত বাবাকে নিয়ে আমি যে আহলাদ করতে পারিনি, অনুপস্থিতিতে আমি সেটা করে যাচ্ছি নিরন্তর। তার একটি হলো এই সোফাসেট। আমি প্রতিদিন তার কাঠের হাতলে হাত বুলিয়ে বাবার স্পর্শ নেই সকলের অলক্ষ্যে। এ আমার অক্ষম ভালোবাসা প্রচেষ্টা।
No comments:
Post a Comment