Saturday, April 14, 2018

শাহীন আখতারের 'অসুখী দিন': তাৎক্ষণিক পাঠানুভূতি

দেশভাগ, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, উদ্বাস্তু সমস্যা, আরোপিত দুর্ভিক্ষ, আজাদ হিন্দ ফৌজ, সুভাষ বসুর অন্তর্ধান, ইত্যাদি ইস্যু নিয়ে একাধিক বইপত্র পড়া সত্ত্বেও জানার অনেক বাকী থেকে গেছে। সম্প্রতি 'অসুখী দিন' পড়ে মুখোমুখি হতে হলো অজানা এক বাস্তবতার। জানলাম দেশভাগের প্রাক্কালে শিলং অঞ্চলে বাঙালী খাসিয়ার দ্বন্দ্ব। শিখলাম 'উডখার' নামে নতুন একটি শব্দ বা গালি।

কিছু কিছু উপন্যাস পড়া উচিত অখণ্ড অবসর এবং নিরবচ্ছিন্ন মনোযোগের সুযোগ থাকলেই। শাহীন আখতারের 'অসুখী দিন' তেমন একটি বই। আমার দুর্ভাগ্য উপরোক্ত দুটিরই অভাব ছিল আমার। এক নাগাড়ে অখণ্ড অবসর নিয়ে পড়তে পারিনি। তাতে করে বড় কোন সমস্যা না হলেও কোন কোন জায়গায় উপন্যাসটিকে দুর্বোধ্য মনে হচ্ছিল। উপন্যাসটির কাঠামো নির্মিত হয়েছে দুটি স্মৃতি কথা এবং ছোট্ট একটি ডায়েরীর যোগফল দিয়ে। পাঠক যাত্রা শুরু করবেন দুই স্মৃতিচারণের সমান্তরাল প্রবাহ দিয়ে। একই উপন্যাসে দুটি সমান্তরাল চরিত্রের বিবরণ যখন অব্যাহতভাবে চলতে থাকে তখন তার মধ্যে সংযোগ স্থাপনের জন্য পাঠকের পক্ষে একটা প্রবল তাগিদ থাকে। পড়তে পড়তে সেই তাগিদটা আমিও অনুভব করেছিলাম কিন্তু কখনো সেই সংযোগ রেখা স্পর্শ করতে পারছিলাম, কখনো আবার খেই হারিয়ে ফেলছিলাম।

এভাবে চলতে চলতে ঘটনা যখন বাড়ির উঠোন ছাড়িয়ে দেশের রাজনীতি পেরিয়ে মহাযুদ্ধের বিশাল ব্যাপ্তির মধ্যে হারিয়ে যেতে বসে তখন পাঠক সেই সংযোগটি পেয়ে যায়। যেখানে দুই স্মৃতিকথায় বর্ণিত দুই চরিত্রের যোগাযোগ ঘটেছিল। তবে সেই সংযোগ ঠিকানাটি একটি জংশনের মতো। যেখানে দুই যাত্রী দুই আলাদা ট্রেনে উঠে যাবে যদিও গন্তব্য তাদের একই স্টেশন।

শাহীন আখতারের 'অসুখী দিন' পড়তে বসে পাঠক হিসেবে একই গন্তব্যের দুই ট্রেনের যাত্রীর অনুভূতি নিয়ে এগিয়ে যেতে হয়। একটি ট্রেনে বাংলাদেশের সাবিনা, যার পিতা সুভাস বোসের আজাদ হিন্দের সৈনিক ছিলেন। অন্য ট্রেনে অনিতা সেন, যার দাদা আজাদ হিন্দের হয়ে যুদ্ধে গিয়ে ফেরেননি।

সাবিনার পিতা এবং অনিতার দাদা যে আজাদ হিন্দ ফৌজের সহযোদ্ধা ছিলেন সেটা পাঠক বইয়ের ফ্ল্যাপেই জেনে যাবেন। কিন্তু যুদ্ধ শেষে সাবিনার বাবা ফিরে এলেও তাঁর সহযোদ্ধা নীরু ফেরেনি। কেন ফেরেনি সেই উত্তর অনিতা সেনের স্মৃতিকথায় নেই। সেই পরিণতিটার সন্ধান করে গেছে অনিতা সেন।
নীরুর শেষ পরিণতি জানতেন সাবিনার বাবা। সিলেট থেকে ট্রেনে চড়ে সাবিনা যখন সময় কাটাবার জন্য ১০০ টাকায় কেনা পুরোনো বইটি পড়তে শুরু করেন তখনো কল্পনা করেননি এই বইয়ের সাথে তাঁর পিতার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ একটি অধ্যায়ের গভীরতম যোগাযোগ আছে যে অধ্যায় তাঁর জীবন থেকে বুদবুদের মতো উবে গিয়েছিল।

অনিতার স্মৃতিকথা পাঠ শেষে সাবিনার আসল কাজ শুরু হয়। সাবিনা তার মায়ের মাধ্যমে বাবার কাছ থেকে নীরুর পরিণতির কথা জানতে পারেন। এরপর সাবিনা সিদ্ধান্ত নেয় যে কোন উপায়ে অনিতা সেনের কাছে পৌঁছে দিতে হবে বাবার দেয়া নীরুর শেষ পরিণতির তথ্যটি। কিন্তু এত বছর পর অনিতা সেনকে খুঁজে বের করা সম্ভব? হ্যাঁ সেও সম্ভব হয়েছিল। সংবাদকর্মী সাবিনাকে তাঁর মেজভাই অনুরোধ করেছিল বাবার জীবনের হারিয়ে যাওয়া অধ্যায় নিয়ে তাদের পরিবারের সোনালী ইতিহাস লেখার জন্য। অনিতা সেনের স্মৃতিকথা তাঁকে সেই সেই পথটা বাতলে দিল কিছুটা। সেই পথ ধরে অনিতা সেনের ব্যাপারে খোঁজ নিতে কলকাতা গিয়ে যেসব সুত্র মেলে তাতে জানা যায় অনিতা সেন এখনো জীবিত আছেন। সাবিনা তখনই সিদ্ধান্ত নেন শিলং গিয়ে অনিতা সেনের সাথে দেখা করবেন।

কিন্তু উপন্যাসের শেষ পর্বে শিলং পৌঁছে যাবার পর তার জন্য অপেক্ষা করছিল অন্য এক বিস্ময়। তবে একজন পাঠকের জন্য বইটা পড়ে সেই বিস্ময়ের মুখোমুখি হওয়াটাই সঙ্গত।

পাঠমুগ্ধতার পাশাপাশি উপন্যাসে কিছু তথ্য বিষয়ে একটু সমালোচনা করা যাক। পাঠক হিসেবে আমার পর্যবেক্ষণ

১. অনুমান করা হয়েছে সিলেট স্টেশন এড়িয়ে হিল সেকশন রেলওয়েতে করে শিলং থেকে চট্টগ্রাম এসেছিলেন মোয়াজ্জেম হক ও নীরদচন্দ্র সেন। কিন্তু শিলং থেকে চট্টগ্রামের কখনোই কোন রেল যোগাযোগ ছিল না।

২. হিরোশিমাকে একটি দ্বীপ বলে উল্লেখ করা হয়েছে একাধিকবার। কিন্তু হিরোশিমা দ্বীপ নয়। উপকূলীয় শহর।

৩. মুক্তিযুদ্ধের আগেকার উত্তাল সময়ে জনপ্রিয় একটি শ্লোগান উল্লেখ হিসেবে করা হয়েছে 'সংগ্রাম সংগ্রাম ১১ দফার সংগ্রাম'। কিন্তু এর চেয়ে 'জয় বাংলা' বা 'তোমার আমার ঠিকানা পদ্মা মেঘনা যমুনা' শ্লোগানটি বেশী জনপ্রিয় ছিল বলে মনে হয়।

৪. শুধুমাত্র মাইজভাণ্ডারী গান শোনার অপরাধে কাশেম মিয়ার মতো অনাহারী পঙ্গু অথর্ব একটা মানুষকে হত্যা করাটা ঠিক বাস্তবসম্মত মনে হয়নি। জঙ্গী ওহাবীরা হত্যার জন্য আরো ভালো টার্গেট বেছে নিতেই দেখা গেছে। কাশেম মিয়ার হত্যাকাণ্ডটি উপন্যাসের জন্য কেন প্রয়োজন ছিল সেটা বোঝা যায়নি।

৫. অনিতা সেনের ভাবনায় রাশিয়ার বিপ্লবী তানিয়ার আত্মাহুতি দেবার ছোট্ট ঘটনাটি কাজ করে, কিন্তু তানিয়ার ঘটনাটি সেই আমলে এত দ্রুত ভারতে পৌঁছে যাওয়াটা একটু অবিশ্বাস্য ঠেকেছে।

এমন ছোটখাট অসঙ্গতি ছাড়া বইটি পড়তে ভালো লেগেছে। সবশেষে উপন্যাসের একটি বিশিষ্টতার কথা না বললেই নয়।

উপন্যাসটিতে মোয়াজ্জেম হকের চরিত্রের মাধ্যমে দেশভাগের চেনা বেদনার অচেনা কিছু চিত্র আমরা পেয়ে যাই। আছে কিছু মর্মান্তিক সত্য, অপ্রিয় বাস্তবতা। চল্লিশের দশকে যারা ভারতের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করেছিলেন সুভাষ বসুর নেতৃত্বে, সেই স্বপ্নবাজদের একদল ছিল ভারতীয়, আর ছোট্ট একটা দল ছিল অভারতীয়, সাবিনার বাবা মোয়াজ্জেম হক ছিলেন অভারতীয় দলে। যার স্বপ্ন সফল কিংবা ব্যর্থ হয়েছিল কিনা সেটা ভাবার জন্য পাঠককে কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকতে হবে। ইংরেজের হাত থেকে দেশ স্বাধীন হয়েছিল ঠিক, কিন্তু সেই দেশটি পাকিস্তান, যার সূচনাতেই হোঁচট খেয়ে পড়তে হয়েছিল মোয়াজ্জেম হককে। কেননা তাঁর নেতা পাকিস্তানের কেউ নন, পাকিস্তানে তিনি অবাঞ্ছিত।

যেসব মানুষ স্বাধীন ভারতবর্ষ চেয়ে পাকিস্তানের নাগরিক হতে বাধ্য হয়েছিলেন, তাদের সেই স্বপ্নগুলো বুদবুদের মতো মিলিয়ে গিয়েছিল। সেই মানুষগুলোকে আমাদের কারো মনে নেই। কেননা ওই স্বপ্নভঙ্গের পরপরই বাংলাদেশ পাকিস্তানের যাঁতাকলে পিষ্ট হতে শুরু করে, বাহান্নর ভাষা আন্দোলন দিয়ে যাত্রা করে যার সমাপ্তি ঘটে আরো অনেক বেশী রক্তক্ষয়ী চেতনা সমৃদ্ধ একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে। ফলে মুক্তিযুদ্ধের স্বাপ্নিকদের সামনে অপাংক্তেয় হয়ে পড়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের স্বাধীনতা সৈনিক মোয়াজ্জেম হক। তিনি এই প্রজন্মের কাছে অচেনা। এই অচেনা মানুষকে 'অসুখী দিনে'র মাধ্যমে আমাদের সামনে হাজির করেছেন শাহীন আখতার।



No comments: