Monday, December 26, 2016

স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র : প্রয়োজন আছে শুদ্ধি অভিযানের

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র ত্রিশ বছর আগে প্রকাশিত হলেও অধিকাংশ বাঙালীর তা পড়া হয়নি। যদিও 'দলিলপত্র' শব্দটি যুক্ত আছে এখানে দলিলপত্রের পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়া ব্যক্তিদের সাক্ষাতকার, বিবৃতি নেয়া হয়েছে। সেই সব বিবৃতির শতভাগ সত্যতা আমরা নিশ্চিত করে বলতে পারি না। কেউ কেউ মিথ্যে সাক্ষী দিয়েছেন নানামূখী স্বার্থে। কিছু কিছু সাক্ষাতকার পরস্পরবিরোধী। একই ঘটনা নিয়ে যখন একাধিক ব্যক্তির বিবৃতি দেখা যায় তখন সেই বক্তব্যগুলোর মধ্যে অনেক পার্থক্যও দেখা যাচ্ছে। তথ্যের ভুল এবং অসঙ্গতিগুলো যাচাই করার জন্য আরো একাধিক সুত্রের সাহায্য নিয়ে বিবেচনা করা উচিত। দলিলপত্রে বর্ণিত সব ঘটনাকে তাই শতভাগ শুদ্ধ বলা যাবে না। মুক্তিযুদ্ধের দলিলপত্রের সচেতন মিথ্যাগুলোকে চিহ্নিত করার জন্য আরেকটি প্রকল্প হাতে নেয়া উচিত।

বাংলাদেশ সরকার প্রকল্পটি গ্রহন করে ১৯৭৩ সালে, কিন্তু কাজ শুরু হয় ১৯৭৮ সালে। প্রথম খণ্ড প্রকাশিত হয় ১৯৮২ সালে পঞ্চদশ খণ্ড প্রকাশিত হয় ১৯৮৫ সালে । এই সময়কালে বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতার দিনরাত আমূল বদলে যায়, সরকার পরিবর্তিত হয় একাধিকবার, প্রতিটি সরকার ভিন্ন ভিন্ন মতের অনুসারী। যার ফলে প্রকল্পের মধ্যে যোগ্যতম মানুষেরা থাকা সত্ত্বেও মিথ্যে সাক্ষ্যগুলো যুক্ত হয়ে গেছে কিছু কিছু জায়গাতে। এ যাবত যেসব মিথ্যের যোগানদারের কথা পাওয়া গেছে তাদের সবাই উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা এবং সেসব মিথ্যের মধ্যে অংশগ্রহন ছিল খোদ তৎকালীন সরকার প্রধানেরও।

বাংলাপিডিয়া অনুসারে প্রকল্পটিতে তথ্যগুলো যেভাবে সাজানো হয়েছে-

দলিল এবং তথ্য প্রামাণ্যকরণের জন্য সরকার নয় সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করেন। এর গঠনকাঠামো ছিল নিম্নরূপ: চেয়ারম্যান প্রফেসর মফিজুল্লাহ কবীর, সদস্য সচিব হাসান হাফিজুর রহমান, সদস্যবৃন্দ: প্রফেসর সালাহউদ্দীন আহমদ, প্রফেসর আনিসুজ্জামান, ড. সফর আলী আকন্দ, ড. এনামুল হক, ড. কে.এম করিম, ড. কে.এম মোহসীন ও ড. শামসুল হুদা হারুন। ইতিহাস রচনার দায়িত্বপ্রাপ্ত হলে এই কমিটি শেষ পর্যন্ত স্বাধীনতা যুদ্ধ সংক্রান্ত দলিল ও তথ্য প্রকাশকেই অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ বলে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।

কিন্তু দলিলপত্র সংগ্রহের সীমা স্বাধীনতা যুদ্ধকেন্দ্রিক হওয়া সত্ত্বেও, মুক্তিযুদ্ধের পশ্চাতে বিশাল পটভূমিরও রয়েছে সমান গুরুত্ব। মুক্তিযুদ্ধকে এই পটভূমি থেকে বিচ্ছিন্ন করা যায় না। এই পটভূমির ঘটনাবলী যাকে মুক্তি সংগ্রাম বলা যায় তার অনিবার্য পরিণতি ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ। অর্থাৎ মুক্তিসংগ্রামের স্বরূপ জানা ছাড়া ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধকে যথাযথভাবে ব্যাখ্যা করা অসম্ভব। এই কারণে দুখন্ডে পটভূমি সংক্রান্ত দলিলপত্র প্রকাশ করা হয়েছে।

প্রধানত বিশেষ ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ এবং বিষয়ভিত্তিক (themetic) ভাবে খন্ডগুলি পৃথক করা হয়েছে। যেমন-
 
প্রথমখন্ড: পটভূমি (১৯০৫-১৯৫৮);
দ্বিতীয় খন্ড: পটভূমি (১৯৫৮-১৯৭১);
তৃতীয় খন্ড: মুজিবনগর: প্রশাসন;
চতুর্থ খন্ড: মুজিবনগর: প্রবাসী বাঙালিদের তৎপরতা;
পঞ্চম খন্ড: মুজিবনগর: বেতার মাধ্যম;
ষষ্ঠ খন্ড: মুজিবনগর: গণমাধ্যম;
সপ্তম খন্ড: পাকিস্তানি দলিলপত্র (সরকারি ও বেসরকারি);
অষ্টম খন্ড: গণহত্যা, শরণার্থী শিবির ও প্রাথমিক ঘটনা; নবম খন্ড: সশস্ত্র সংগ্রাম (১);
দশম খন্ড: সশস্ত্র সংগ্রাম (২);
একাদশ খন্ড: সশস্ত্র সংগ্রাম (৩);
দ্বাদশ খন্ড: বিদেশি প্রতিক্রিয়া, ভারত;
ত্রয়োদশ খন্ড: বিদেশি প্রতিক্রিয়া: জাতিসংঘ ও বিদেশি রাষ্ট্র;
চতুর্দশ খন্ড: বিশ্ব জনমত;
পঞ্চদশ খন্ড: সাক্ষাৎকার;

ষোড়শ খন্ড: কালপঞ্জী, গ্রন্থপঞ্জী ও নির্ঘণ্ট। (তবে পরিকল্পনায় থাকলেও ষোড়শ খন্ডটি প্রকাশিত হয় নি এবং সর্বশেষে পঞ্চদশ খন্ডটি প্রকাশিত হয় ১৯৮৫ সালে।)

এই প্রকল্পের আওতায় প্রায় সাড়ে তিন লক্ষ পৃষ্ঠার দলিল সংগ্রহ করা হলেও প্রকাশ করা হয়েছে মাত্র পনের হাজারের বেশি নির্বাচিত দলিল।

সুতরাং বলা চলে এই প্রকল্পটি নিয়ে আরো কাজ করার অবকাশ আছে। গবেষণা এখনো শেষ হয়নি। বিশ্লেষণের অনেক বিষয় এখনো অবিশিষ্ট আছে। প্রকাশিত খণ্ডগুলোর অসঙ্গতিগুলো নিয়ে আলোচনার অবকাশ আছে। নতুন প্রজন্মের মধ্যে বিভ্রান্তি এড়ানোর জন্য এই কাজটা করা জরুরী।


Saturday, December 24, 2016

জুলফিকার আলী ভুট্টো : রক্তাক্ত একাত্তরের জন্য দায়ী শীর্ষ নরাধম দানব

এদেশে ইয়াহিয়া খানকে যতটা জোরালোভাবে দানব রাক্ষসের সাথে তুলনা করা হয় জুলফিকার আলী ভুট্টোকে ততটা জোরালোভাবে করা হয় না কেন যেন। অথচ এই নরাধম নরকের কীট অমানুষের বাচ্চাটাই বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ মানুষের হত্যা ধর্ষণ ধ্বংসযজ্ঞের জন্য দায়ী। এই ক্ষমতালিপ্সু ইতরের কারণেই বাংলাদেশে ১৯৭১ নামের একটি রক্তাক্ত বছর দেখেছে ইতিহাস। মানুষবেশী রাজনৈতিক কোট পরা এই ইতর হারামজাদা মরার আগেও কখনো একবার সামান্যতম দুঃখপ্রকাশ করেনি তার ইতরামির জন্য। এই নরাধম ইতরটা যাদের উস্কে দিয়ে বাংলাদেশের মাটি রক্তাক্ত করেছিল সেই সামরিক বাহিনীর পদাঘাতে ক্ষমতাচ্যুতি এবং ফাঁসিতে লটকে মরার পরেও তার অপরাধকে ক্ষমা করা যায়  না।




১৯৭১ সালের ১৫ ডিসেম্বর নিউইয়র্কে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের সভা থেকে চুড়ান্ত ঔদ্ধত্য দেখিয়ে ফেরার আগেই পাকিস্তানের মৃত্যু হয়ে পরপারে পৌঁছে গেছে। পঁচিশে মার্চেই অবিভক্ত পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটির মৃত্যু ঘটে গিয়েছিল। তবু এই বেজন্মা ইতরের বাচ্চাটা বৃটিশ টেলিভিশনকে দেয়া সাক্ষাতকারে নিজেকে দুই পাকিস্তানের স্বপ্নে ডুবিয়ে রেখেছিল। সাক্ষাতকারের মধ্যে জানোয়ারটার চেহারার অভিব্যক্তিটা দর্শনীয়।
হায় রে নরাধম নির্বোধ, তোর জন্য যে  মর্মান্তিক পরিণতি অপেক্ষা করছিল সেটা তোর উপযুক্ত পুরস্কারই ছিল।

[ ভুট্টো নামক ইতরটাকে প্রাপ্য গালি দেবার ক্ষেত্রে কিছুটা শব্দ সংকট হয়েছে। কুকুর শুকর জাতীয় প্রাণীবাচক গালিগুলো তাকে সম্মানিত এবং ওই প্রাণীগুলোকে অপমানিত করা হয় বলে তা ব্যবহার করা হলো না]

Saturday, December 17, 2016

বিজয় দিবস ২০১৬

১. আনন্দ ও বেদনা
সব আনন্দের পেছনে সুপ্ত বেদনা লুকোনো থাকে না। কিন্তু সব সৃষ্টির পেছনে একটি ধ্বংসের ইতিহাস থাকে, যেমন থাকে জন্মের সাথে গর্ভযন্ত্রণা। বিজয় দিবসের আনন্দ উদযাপনেও একটা নীরব গ্লানি আছে। সেই গ্লানিটা ১৪ ডিসেম্বর। একাত্তরের ষোলই ডিসেম্বর যখন সমগ্র বাংলাদেশ আনন্দ প্লাবনে ভাসছে, সেদিন বাংলাদেশের অনেক বাড়িতে কান্নার ঢেউ বয়ে যাচ্ছিল। আমরা এক জাহানারা ইমামের ডায়েরী পড়ে কেঁদেছি, কেঁদেছি  রমা চৌধুরী, মুশতারী শফি, কিংবা শহীদ আজাদের মায়ের কথা পড়ে। এমন হাজারো কাহিনী সমগ্র বাংলাদেশের মানচিত্র জুড়ে। আমাদের পতাকার মাঝখানে যে লাল বৃত্ত, সেই বৃত্তটি ওই সব অমোছনীয় বেদনার রং। বিজয়ের আনন্দ প্রকাশে আমরা বুকের ভেতর সেই বেদনাকেও বহন করি।

২. বাংলাদেশের লাল সবুজ পতাকা


বিজয় র‍্যালী ২০১৬ চট্টগ্রাম। উপর থেকে কী চমৎকার লাগে পতাকার এই দৃশ্য। মুগ্ধ হয়ে তাকিয়েছিলাম যতক্ষণ দেখা যায়। সম্মিলিতভাবে পতাকা বহন করার এই দৃশ্যটি দেখে সাধ জাগে অপশক্তির হাত থেকে অক্ষত রাখতে সমগ্র বাংলাদেশটিকেও যদি সবাই এভাবে টানটান করে ধরে রাখতো!

৩.
বাপ্পা মজুমদারের চমৎকার একটা টিউন শুনে মন ভালো হয়ে গেল। জোয়ান বায়েজের সং অব বাংলাদেশ বাজিয়েছেন।

৪.
ফেসবুকে মিশুর দেয়াল থেকে পাওয়া গেল বাংলাদেশের পতাকার প্রথম রূপকার শিবনারায়ন দাসের একটি সাক্ষাতকার।

বিজয় দিবসের এইসব আনন্দ ভাগাভাগি করে উদযাপন করতে পেরে ভীষণভাবে তৃপ্ত।

Thursday, December 15, 2016

তৌকিরের 'অজ্ঞাতনামা': ভালো সিনেমা তৈরীর একটা প্রচেষ্টা

তৌকিরের 'অজ্ঞাতনামা' দেখা হয়ে গেল ইউটিউবের সৌজন্যেই। আমার মতে একটি ভালো সিনেমা তৈরীর প্রচেষ্টার ভালো উদাহরণ। সিনেমার ইস্যুটা খুবই বাস্তব, সম্ভবতঃ কিছু কিছু বাস্তবতা এর চেয়েও নিষ্ঠুর। প্রবাসী বাঙালীদের অপাঘাতে মৃত্যুর খবর আমরা পত্রিকায় পড়ার পরে তাঁদের দেশে থাকা পরিবারের চিত্রটা আমাদের জানা হয় না। এই অংশটা যথেষ্ট  চমৎকারভাবে এসেছে। প্রথমার্ধকে বাহবা দিতে হয় সেজন্য।

তবে আর দশটি সিনেমার মতো এই সিনেমায় কিছু দুর্বলতাও রয়ে গেছে।

কিছু দুর্বলতা কারিগরী, কিছু দুর্বলতা চিত্রনাট্যের। কারিগরী দুর্বলতাগুলো অধিকাংশই দৃশ্যায়নে আলোর ব্যবহারজনিত। নাটক এবং সিনেমার  মধ্যে যে কারিগরি পার্থক্য থাকে তা এই সিনেমাতে উৎরাতে পারেনি। যাকে আমরা সিনেমাটোগ্রাফি বলি, তাতে এই সিনেমাতে উপস্থিত ছিল না। কোলকাতার বাংলা সিনেমাগুলো যারা দেখেন, তাঁদের কাছে এই পার্থক্যটা প্রকট।

চিত্রনাট্যের দুর্বলতাগুলো চাইলে এড়ানো যেতো। দ্বিতীয়ার্ধে যখন লাশের তৃতীয় পরিচয় উদঘাটিত হয় তারপর লাশ নিয়ে ঢাকার বিভিন্ন মন্ত্রনালয়ে ধর্না দেবার ব্যাপারটা বাস্তবসম্মত মনে হয়নি। এমনকি পুলিশ হিসেবে মোশাররফ করিমের ভূমিকাটা প্রথমার্ধে মোটামুটি ঠিক থাকলেও দ্বিতীয়ার্ধে অবাস্তব লেগেছে। এখানে পুলিশের চরিত্র ছেড়ে বেরিয়ে মোশাররফ একদম টাইপড করিম হয়ে গিয়েছে।

তবে এই ছবির সবচেয়ে চমৎকার চরিত্র ছিল আসিরউদ্দিনের ছেলেটি। যদিও একেবারে অপ্রাসঙ্গিক তুলনা, তবু তাকে দেখে চট করে মনে পড়ে যায় পথের পাচালীর অপুর কথা। বাবার মৃত্যু সংবাদ অনুধাবন করতে না পারা একটি শিশু পাতার নৌকা ভাসিয়ে দিচ্ছে অজানার উদ্দেশ্যে - বুকের মধ্যে ব্যথা ছলকে ওঠে এখানটায়।

অজ্ঞাতনামা নিয়ে খুব বেশী আহলাদ কিংবা একেবারে প্রত্যাখ্যান কোনটাই করা উচিত না। কিন্তু এরকম সিনেমা বানানোর প্রচেষ্টাগুলোকে উৎসাহিত করা দরকার আমাদের পচে যাওয়া সিনেমা জগতকে মানুষের কাছে ফিরিয়ে আনতে। এই সিনেমাটিকে অন্ততঃ ফারুকীর টেলিভিশনের মতো ফাজলামি মনে হয়নি। ক্রিকেটের মতো বাংলা চলচ্চিত্রেও তরুণ নির্মাতারাই আমাদের ভরসা।




Tuesday, December 13, 2016

তিন কাকের স্বর্গারোহন




শহরের সমস্ত সবুজ লোপাট হয়ে যাবার পর বৃক্ষহীন উদ্বাস্তু  হাজারো কাকের ভিড়ে তিন তরুণ কাকের খুব বন্ধুত্ব হলো। তিন কাকের নাম- এক, দুই, তিন। আধুনিক কাক জানে, বৃক্ষের বদলে ইলেকট্রিকের তারেও জমতে পারে তারুণ্য সভা কংক্রিটের পিলারে তৈরী অ্যাপার্টমেন্ট বাসা। 

ত্রিরত্নের আকাশবিহার সকাল বিকাল দুপুর ভেসে ভেসে ভেসে বেড়ানো। উড়ে উড়ে চিল তাড়ানো। ঘুরে ঘুরে পাহারা যেন শহরে যেন আর কোন পাখি প্রবেশ করে খাবারে ভাগ না বসায়। কখনো তাই কোন কোকিল এসে ডিম পাড়েনি তাদের বাসায়। সন্ধ্যে হলেই আবার যে যার স্বাধীন বাসায়। নিরিবিলি কা কা স্বাধীন জীবনে খুঁটে খুঁজে কেটে যাচ্ছিল দিন।

একদিন নগরপিতার ঘোষণা। এবার সবুজে সাজবে নগরীঘাসপাতার চাষ হবে ছাদের কার্নিশে। আকাশ ভেঙ্গে বর্ষা নামলেও সেই সবুজ ধুয়ে যাবে না ঘোলা নর্দমায়। এবার নগরী হবে সত্যিকারের প্রাচ্য রানী। স্বর্গের পথ খুলে দেয়া হবে এই শহরে। বিশ্ব তাকিয়ে রবে প্রবল বিস্ময়ে।

মানুষ কাকের ভাষা বোঝে না, কিন্তু কাক মানুষের ভাষা শিখে ফেলেছে। রিকশাওয়ালা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সব ভাষাতেই কাকেদের কর্ণকূহর অভ্যস্ত। লিখতে পারে না, বলতে পারে না, কিন্তু বুঝতে কোন সমস্যা হয় না। কাকেরা দেখেছে এই নগরপিতা সবুজে সাজানোর ঘোষণা দিয়ে শহরের সকল বৃক্ষ  নিধন করে সেখানে কংক্রিটের চাষ করেছে। যেখানে ছিল সবুজ বনানী সেখানে উঠেছে দালানের পর দালান। যেখানে ছিল পাহাড়ি বুনোঝোপের সজীব ছায়ার মাঝে কুলকুল করে বয়ে যাওয়া ঝরনা সেখানে এখন ধাতব নলের কৃত্রিম ফোয়ারা। শহরজুড়ে কেবল ইট সিমেন্ট কংক্রিটের মেলা। তার ফাঁকে ফাঁকে সিরামিকের টবে বৈচিত্র্যহীন বিদেশী পাতাবাহারের সস্তা প্রদর্শনী। যেখানে পাখি নেই, প্রজাপতি নেই, অন্ধকারে দীপ জ্বালানো জোনাকী নেই। প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ এক নগরী থেকে প্রকৃতিকে চিরতরে নির্বাসনে পাঠিয়ে যখন সবুজে সাজার ঘোষণা এলো তখন মানুষেরা না বুঝলেও কাকেরা বুঝে নিল এই প্রহসন।  

তাই প্রাচ্যের রানী হোক বা না হোক স্বর্গের ঘোষণা শুনে তিন বন্ধু সিদ্ধান্ত নিল ওরাও স্বর্গে যাবার সুযোগ নেবে। শুনেছে স্বর্গে একবার ঢুকলে আর ফিরতে হয় না, অনন্ত সুখ সেখানে। কিন্তু কবে খুলবে স্বর্গের পথ? অপেক্ষায় দিন গুনতে শুরু করলো তিন বন্ধু কাক।

কয়েকদিন পর। 

এক দুপুরে খুব বৃষ্টি হলো। ছুটির শহর চুপচাপ ভিজলো। তিন বন্ধুতে এক কার্ণিশে বসে খুব গল্প করলো। স্বপ্নের ক্যানভাসে ইচ্ছেমতো রঙ চড়াতে চড়াতে বেলা নেমে যাচ্ছিল। হঠাৎ বৃষ্টি থেমে শেষ বিকেলের সূর্য উঁকি দিল। অমনি পুব আকাশ রাঙিয়ে দিগন্ত জুড়ে মেঘের ফাঁক থেকে অদ্ভুত একটা রঙিন আলোর রেখা ভেসে উঠলো।

এক- 'ওই তো স্বর্গের দরোজা  দেখা দিয়েছে'

দুই- 'আমি জানতাম স্বর্গের দরোজা খুলবেই'

তিন- 'উড়ে চলো স্বর্গের পথে'

অতঃপর দেরী না করে তিনজনই উড়াল দিল। উড়তে উড়তে তিনজনই উড়াল দিল। উড়তে উড়তে...... উড়তে তো উড়ছেই। কিন্তু সাত রঙে সাজানো স্বর্গের দরোজা যেন আরো দূরে সরে যায়। কিছুতে ছুঁতে পারে না তাকে। কোথায় স্বর্গ, কোথায় তার সাজানো দুয়ার? সবই মায়ার খেলা।

তিন নম্বর কাক সবার আগে ক্লান্ত হয়ে নেমে আসলো ইলেকট্রিকের আড্ডা খুঁটির তারে। বসে বসে দেখছে বাকী দুই বন্ধু তখনো উড়ে উড়ে স্বর্গের দরোজা ছুঁতে চেষ্টা করছে। ওরাও ক্লান্ত হয়ে ফিরে আসবে একসময়। তারপর আবারো এই মিথ্যে প্রতিশ্রুতির পুরোনো শহরের কংক্রিটের মধ্যে প্রতিদিনের ক্লান্ত জীবন। এই শহর আর কখনো ফিরবে না সবুজে। 

তবু কাকেরা শান্ত্বনা পেল পূর্বপুরুষের রেখে যাওয়া একটি বাণীর কথা ভেবে- 

যে শহর যত বেশী আবর্জনাময় 
সে শহর কাকেদের স্বর্গ নিশ্চয়।

Monday, December 12, 2016

আজ সোমবার

অদ্ভুত কিছু শরীরবৃত্তীয় বিচ্যুতি ঘটছে আবারো। কিছুকাল পরপর টের পাই বিচ্যুতির ঘটনা। কম্পিউটার পর্দায় অতিরিক্ত মনঃসংযোগে মস্তিষ্কে কোন চাপ তৈরী করে যাচ্ছে হয়তো। দৃষ্টি এবং মস্তিষ্ক দুটোর মধ্যে কোনটা বেশী চাপ গ্রহন করছে সেটা বুঝতে চেষ্টা করতে গিয়ে হৃদযন্ত্রে ওলটপালট শব্দের অস্তিত্বও পাই মাঝে মাঝে। ডাক্তারের সান্নিধ্য এবং আশ্বাসে কিছুটা উপশম ঘটে। কিছু হয়নি আপনার - শুনতে ভালোই লাগে। কয়েকদিন ছুটি নিন, ভালো করে ঘুমান, চাপমুক্ত থাকুন। বয়স হচ্ছে ক্যালেণ্ডারে, তবু কাজের সময় বয়স মনে থাকে না, রাখি না। এখনো কত কাজ বাকী। হাসানের মতো অসময়ে চলে যাবার কথা ভাবলে মন খারাপ লাগে।

আবার জীবনানন্দের মতো এও ভাবি-

চিরদিন শহরেই থাকি
পড়ে থাকি পাটের আড়তে
করি কেরানির কাজ—শুভে-লাভে যদি কোনোমতে
দিন যায় চ'লে
আকাশের তলে
নক্ষত্রেরা কয় কোন্‌ কথা
জোৎস্নায় প্রাণের জড়তা
ব্যথা কেন পায়
সে সব খবর নিয়ে কাজ কিবা হায়

Thursday, December 8, 2016

রবিশংকর ও জর্জ হ্যারিসনের 'কনসার্ট ফর বাংলাদেশ' এবং একজন জোয়ান বায়েজ

[এই লেখাটি ১৯৭১ এ মুক্তিযুদ্ধে মানবিক সহায়তার উদ্যোগ নিউইয়র্কে অনুষ্ঠিত Concert for Bangladesh এর অংশগ্রহনকারী সব শিল্পীর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ এবং অংশগ্রহনকারী শিল্পীদের নির্ভূল তালিকা দেবার চেষ্টা।]

জর্জ হ্যারিসনের বাংলাদেশ কনসার্ট সম্পর্কে সচেতন বাংলাদেশীরা সবাই জানে। কিভাবে সে আয়োজন হয়েছিল, কিভাবে তা সারা পৃথিবী মাতিয়েছিল। সেই গল্পে যাবো না এখানে। আমি শুধু কৃতজ্ঞতা জানাতে সেই উদ্যোগের সাথে জড়িত নামগুলো লিপিবদ্ধ করে রাখছি।

রবিশংকর ও জর্জ হ্যারিসনের Concert for Bangladesh
রবিশংকর এবং জর্জ হ্যারিসন, এই দুজনের কাছেই স্বাধীন বাংলাদেশের মানুষ চিরঋণী থেকে যাবে সেদিনের সেই অসাধারণ উদ্যোগটির জন্য। সেদিন ওই মঞ্চে আরো যারা গেয়েছিলেন, তাদের কাছেও আমাদের ঋণ। এসব ঋণ অপরিশোধ্য, শুধু ইতিহাসের খাতায় তাদের নামগুলো জমা করে রাখা যায়।



Concert for Bangladesh-এ যে গানগুলো গাওয়া হয়েছিল তার তালিকা বিচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন জায়গায় লেখা হলেও তাঁদের গাওয়া গান ও নাম একসাথে পাওয়া সহজ নয়। তাই কনসার্টের হোমপেজ, উইকিপেজ সহ বিভিন্ন জায়গা থেকে তথ্যগুলো সংগ্রহ করে আর্কাইভ করা হলো।

ওইদিন দুটো কনসার্ট হয়েছিল। প্রথম কনসার্ট দুপুর ২.৩০মিনিট, দ্বিতীয় কনসার্ট সন্ধ্যা ৮.০০।

প্রথম কনসার্ট ২.৩০মিনিট

এই কনসার্টে দুটো পর্ব ছিল। প্রথম পর্বে ভারতীয় সঙ্গীত বাজিয়েছেন চারজন-
Ravi Shankar — Sitar
Ustad Ali Akbar Khan — Sarod
Ustad Alla Rakha — Tabla
Kamala Chakravarty — Tanpura 

দ্বিতীয় পর্বে পাশ্চাত্য সঙ্গীতে অংশ নিয়েছিলেন নীচের শিল্পীগন।
Wah-Wah - GEORGE HARRISON
Something - GEORGE HARRISON
That's The Way God Planned It - DON PRESTON
It Don't Come Easy - RINGO STARR
Beware Of Darkness - GEORGE HARRISON
While My Guitar Gently Weeps - GEORGE HARRISON & ERIC CLAPTON
Jumpin' Jack Flash - LEON RUSSELL
Young blood - LEON RUSSELL
Here Comes The Sun - GEORGE HARRISON
A Hard Rain's A-Gonna Fall - BOB DYLAN
Blowin' In The Wind - BOB DYLAN
It Takes A Lot To Laugh, It Takes a Train to Cry - BOB DYLAN
Just Like A Woman - BOB DYLAN
My Sweet Lord - GEORGE HARRISON
Bangla Desh - GEORGE HARRISON

দ্বিতীয় কনসার্ট
দ্বিতীয় কনসার্ট শুরু হয় রাত আটটায়। প্রথম কনসার্টের চেয়ে দ্বিতীয় শো আরো বেশী জমজমাট ছিল। আরো বেশী লোক সমাগম হয়েছিল। গানও ছিল বেশী। সান্ধ্যকালীন দ্বিতীয় শো-তেও উপরের গানগুলো গাওয়া হয়। তার সাথে আরো চারটি গান যুক্ত হয়েছিল।

Awaiting On You All - GEORGE HARRISON
Love Minus Zero/No Limit - BOB DYLAN
Hear Me Lord - GEORGE HARRISON
Mr. Tambourine Man - BOB DYLAN

আরো দুটি ব্যান্ড এবং একটি ব্যাকিং ভোকাল টীম মঞ্চে সাপোর্টিং টিম হিসেবে ছিল। তাদের তালিকা-
The Band• Jesse Ed Davis — rhythm guitar
• Tom Evans — acoustic guitar
• Pete Ham — acoustic guitar
• Mike Gibbins — percussion
• Jim Keltner — drums
• Joey Molland — acoustic guitar
• Don Preston — guitars, backing vocals
• Carl Radle — bass guitar
• Klaus Voormann — bass guitar

The Hollywood Horn • Jim Horn, Allan Beutler, Chuck Findley, Jackie Kelso, Lou McCreary, Ollie Mitchell

The Backing vocals • Don Nix, Jo Green, Jeanie Greene, Marlin Greene, Dolores Hall, Claudia .

সেদিন ওই আসরে মোট ১৯টি গান গাওয়া হয়েছিল যার মধ্যে জর্জ হ্যারিসন একাই ৯টি গান গেয়েছিলেন এবং বব ডিলান গেয়েছিলেন ৬টি।


কনসার্টের পোস্টার




এই লিংকে গিয়ে কনসার্টে অংশগ্রহনকারী সব আর্টিস্টের নাম ও ছবি দেখা যাবে

'বাংলাদেশ কনসার্ট' এর দীর্ঘ মেয়াদী সাফল্যের তালিকা অনেক দীর্ঘ। সবটা লিখতে গেলে একটি বই হয়ে যাবে। এই উইকি লিংকে মোটামুটি ভালো একটা সারাংশ আছে তার। এখন শুধু কনসার্টের একটি তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ার কথা জানাই। দুটি শো-ই এতটা সফল হয়েছিল যে শো শেষে বব আনন্দের আতিশয্যে জর্জকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন- "তিন তিনটে শো হলো না কেন"! অথচ সেই সময়ে বব ডিলান সঙ্গীত থেকে দূরে সরে ছিলেন, সবকিছু থেকে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় হতাশাপূর্ণ জীবন কাটাচ্ছিলেন, এমনকি  ড্রাগেও আসক্ত হয়ে পড়েছিলেন বলে শোনা যায়।

'কনসার্ট ফর বাংলাদেশ' এর লাইভ প্রোগ্রামের গানগুলো দিয়ে একটা ডকুমেন্টারি বানানো হয়েছিল। যার বিক্রি ছিল আকাশচুম্বী। ওই টাকা থেকে শুধু বাংলাদেশ নয়, এশিয়া আফ্রিকার আরো দেশ মিলিয়ন ডলারের সাহায্য পেয়েছিল। তবে ওই ফিল্ম বা প্রোগ্রামের ভিডিও বাংলাদেশে খুব বেশী মানুষ দেখেছে বলে মনে হয় না। আগ্রহীদের জন্য লিংকটি দেয়া হলো।

একটি ভুল ছবি

'কনসার্ট ফর বাংলাদেশ' অ্যালবামের ছবিটি নিয়ে কিছু প্রশ্ন জাগে। ছবিটা একটি ভুল বার্তা বহন করেছে। এই ছবিটি যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশ সম্পর্কে ধারণা দেয় না। এই কনসার্টটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের দিকে বিশ্বজনমতের দৃষ্টি আকর্ষণ করা এবং সেই জনগোষ্ঠির জন্য সাহায্য। অথচ এই ছবিটি দেখে শুধু দুর্ভিক্ষ পীড়িত একটি জাতির চেহারাই ভেসে ওঠে।



জর্জ হ্যারিসনের Bangla Desh বনাম জোয়ান বায়েজের Song of Bangladesh

একটি তথ্য প্রায়ই গুলিয়ে যেতে দেখেছি বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম এবং ওয়েবসাইটে। জর্জ হ্যারিসন যেমন বাংলাদেশকে নিয়ে Bangla Desh গানটি লিখেছেন তেমনি জোয়ান বায়েজও বাংলাদেশকে নিয়ে লিখেছিলেন Song of Bangladesh. অধিকাংশ জায়গায় দেখি জোয়ানের গানটি কনসার্ট অব বাংলাদেশের অংশ বলে ঘোষণা করা হয়। কিন্তু ম্যাডিসন স্কয়ারের ১  আগষ্ট ১৯৭১সালে 'কনসার্ট' অব বাংলাদেশে' জোয়ান বায়েজ ছিলেন না। তাঁকে রাখা হয়নি অজ্ঞাত কোন কারণে (এই লেখককে ব্যক্তিগত যোগাযোগের সুত্রে জোয়ান বলেছেন 'ভুলবশতঃ' তাঁকে রাখা হয়নি সেদিন)।


ম্যাডিসন স্কয়ারের কনসার্টে না গাইলেও জোয়ান বায়েজ নিজস্ব মানবিক বোধ জাগিয়ে যে গানটি লিখে, সুর দিয়ে, গেয়ে শুনিয়েছিলেন, তা এক কৃতিত্ব হিসেবে অন্যতম শ্রেষ্ঠ কাজ। তাঁর এই কাজ দিয়ে আমাদের ঋণের বোঝাকে আরো ভারী করেছেন। বস্তুতঃপক্ষে জোয়ান বায়েজের গানটি জর্জের গানটির চেয়ে অনেক বেশী প্রাণস্পর্শী সব দিক দিয়েই। একাত্তর নিয়ে যতগুলো গান কবিতা লেখা হয়েছে, আমার বিচারে ওই গানটি অন্যতম সেরা। কিন্তু আশ্চর্যজনক ভাবে জোয়ানের গানটি সেভাবে পরিচিতি বা স্বীকৃতি পায়নি।

তাঁর গান সম্পর্কে অভিজিত রায়ের এই লেখাটি সবচেয়ে সুন্দর। ইউটিউবে খুব সহজে গানটি মেলে। Story of Bangladesh নামে লেখা গানটি পরে তাঁর Come from the shadows অ্যালবামে Song of Bangladesh নামে রাখা হয়েছে।

এই গানটি সম্পর্কে ইউটিউবে এক ভিনদেশীর মন্তব্যটা বেশ ভালো লেগেছিল বলে টুকে রেখেছিলাম। তিনি এত আপ্লুত হয়েছেন যে বলেছেন, "I have no relation to bangladesh in any kind but i love this song of her..It is sung with pure emotion and gives me goosebump everytime."

কথাটা একবিন্দুও মিথ্যা নয়। এই গানটি যতবার শোনা হয়, চোখ ভিজে যায়। প্রিয় জোয়ান, বাংলাদেশ চিরকাল ঋনী থাকবে তোমার কাছে।


বর্তমান Concert of Bangladesh : একটি সাহায্য সংস্থা

Concert of Bangladesh নামটি এখনো সক্রিয়ভাবে টিকে আছে পরিবর্তিত নাম George Harrison Fund for UNICEF নিয়ে। কিন্তু তাদের ওয়েব সাইটের ঠিকানা এখনো বাংলাদেশের নাম নিয়েই দাঁড়িয়ে আছে। http://theconcertforbangladesh.com বাংলাদেশের পাশাপাশি তাঁদের সাহায্য তালিকায় আরো দরিদ্র দেশের নামও যুক্ত হয়েছে যাদের মধ্যে রয়েছে রোমানিয়া, এঙ্গোলা, ইথিওপিয়া, ব্রাজিল, ভারত ইত্যাদি। জর্জের স্ত্রী অলিভিয়া হ্যারিসন এর সাথে জড়িত আছেন। তিনি ইউনিসেফের হয়ে একবার বাংলাদেশে এসেছিলেন ২০১১ সালে।

১৯৭১ সালের ১ আগষ্ট ম্যাডিসন স্কয়ারের কনসার্টের পর যে ফাণ্ড যোগাড় হয়েছিল অ্যালবাম বিক্রি করে, তা প্রত্যাশার চাইতে বহুগুন বেশী ছিল। সেই টাকা শুধু বাংলাদেশ না, পৃথিবীর আরো অনেক দেশের দুস্থ মানুষকে বন্টন করা হয়েছে, হচ্ছে। বিলি বন্টনের কাজ করতে গিয়ে একটি প্রতিষ্ঠানই দাঁড়িয়ে যায়। বর্তমানে ওই ফাণ্ড পরিচালনা করে হ্যারিসন পরিবার এবং ইউনিসেফ।
কিন্তু একটা ব্যাপার দুর্ভাগ্যজনক। কনসার্টটি যে মানুষগুলোকে সাহায্য করার জন্য করা হয়েছিল সেটা এত সাফল্য লাভের পরও টাকাগুলো সেই মানুষগুলোর কাছে পৌঁছেনি। ফাণ্ডের টাকাটা বাংলাদেশে এসেছিল অনেক ঘাটের জল খেয়ে আরো তেরো বছর পর।

কত টাকা আয় হয়েছিল একদিনের একটি কনসার্টে? জর্জ হ্যারিসনকে কনসার্ট করার প্রস্তাব দেবার সময় রবিশংকরের ধারণা ছিল বিশ-ত্রিশ হাজার ডলার ফাণ্ড যোগাড় হবে। কিন্তু কনসার্টের সময় দেখা গেল প্রায় ৪০ হাজার টিকেট বিক্রি হয়ে গেছে এবং কনসার্টের পরের সপ্তাহে আয়োজকরা নগদ বিক্রির মোট ২৪৩,৪১৮ ডলার হস্তান্তর করেছিল ইউনিসেফকে। ১৯৭১ এর ডিসেম্বরের মধ্যে Capitol Records নামের একটি রেকর্ড কোম্পানী কনসার্টের লাইভ অ্যালবাম বিক্রির অগ্রিম টাকা জমা দেয় ৩,৭৫০,০০০ ডলার।

কিন্তু টাকাটা বাংলাদেশকে দেয়া যায়নি কনসার্টটি ইউনিসেফের অনুমোদনপ্রাপ্ত ছিল না বলে। প্রায় এক যুগ মার্কিন সরকারের রাজস্ব বিভাগ টাকাটা আটকে রাখে। যদিও আটকে রাখা, কর মওকুফ না করা ইত্যাদি বিষয় আইনের ব্যাপার, কিন্তু  তবে ওই সময়কালে অ্যালবামের বিক্রিত অর্থের পরিমান আরো কয়েকগুন বৃদ্ধি পায়। সেই ফাণ্ড থেকে ১৯৮৫ সালে ইউনিসেফ ১২ মিলিয়ন ডলার বাংলাদেশের বন্যা দুর্গতদের জন্য দান করে।

নব্বই দশকে জর্জ হ্যারিসন বলেছিলেন ওই ফাণ্ডে ইতিমধ্যে প্রায় ৪৫ মিলিয়ন ডলার জমা হয়েছে এবং জাতিসংঘ তার দায়িত্ব নিয়েছে। বাংলাদেশ কনসার্টের নামে গড়ে তোলা সেই ফান্ডের নতুন নাম দেয়া হয় George Harrison Fund for UNICEF.


শেষ কথা:
এই লেখায় মাত্র কয়েকজন ভিনদেশী হিতাকংখীর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাবার চেষ্টা ছিল। বিশেষ করে তিনজনের প্রতি। কিন্তু ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধকালে আরো অনেক বিদেশী বন্ধু আমাদের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। তাঁদের সবার নাম পরিচয় আমরা পাইনি। যারা দীর্ঘদিন ধরে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের তথ্য অনুসন্ধান করে আসছেন তাঁরা নিশ্চয়ই একদিন খুঁজে পাবেন সেই নামগুলো। তবু অজানা সেই সব বন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা রেখে যাই।



----------------------------------------------------------------------------------------------------------------
তথ্যসুত্র:
১. http://theconcertforbangladesh.com
২. George Harrison – In His Own Words, superseventies.com
৩.  Neal Alpert, "George Harrison's Concert for Bangladesh
৪. "Sweet Sounds", Time, 17 April 1972
৫.  Living in the Material World, Klaus Voormann 
৬. Wikipedia: The Concert for Bangladesh 


Wednesday, December 7, 2016

দুই বন্ধু এবং একটি অনন্য গানের গল্প

যে গানের প্রথম লাইন এরকম - I'll put flowers at your feet and I will sing to you so sweet, সে গানের প্রকৃতি সম্পর্কে অনুমান করা কঠিন। মনে হতে পারে এই নিবেদনটা নেহাতই প্রণয়ঘটিত। কয়েকদিন আগে জোয়ান বায়েজ-এ মগ্ন হবার পর থেকে এই গানটি অসংখ্যবার শুনেছি। এটা কী শুধু একটা গান! এমনও গান হয়! এত আকুলতা দিয়ে কেউ গাইতে পারে? এমন অশ্রু ভেজা কন্ঠ আমি আর একটিও কী শুনেছি?

জোয়ানের আরো কিছু গানের মতো এই গান লেখার পেছনেও ছোট্ট একটি ইতিহাস আছে। সেটা জানলে গানটি আরো বেশী উপভোগ্য হয়।

এটি কতখানি গান আর কতখানি কবিতা তা জানি না। কিন্তু এটা জানি এটি বন্ধুর কাছে লেখা একটি মানবিক আবেদনপূর্ণ চিঠি। জোয়ান তাঁর দূরে সরে যাওয়া প্রিয় বন্ধুকে আহবান করছেন সমকালীন পৃথিবীতে চলমান এক বর্বর যুদ্ধ বাস্তবতার বিরুদ্ধে শান্তির দাবীসমৃদ্ধ সঙ্গীতময় আন্দোলনে নেতৃত্ব দেবার জন্য। বন্ধুতার যুগলবন্দী একটা সময়ে  দুজনে একসাথে অনেক গান গেয়েছে, হাতে হাত রেখে পথে হেঁটেছে, কনসার্ট করেছে, অ্যালবাম বের করেছে, নাগরিক অধিকারের জন্য সোচ্চার আন্দোলন করেছে। তারপর হঠাৎ কী কারণে এই একজন সবকিছু বাদ দিয়ে ঘরে ঢুকে দরোজা বন্ধ করে দিল। সঙ্গীত জগতের সাথে, সমাজের সাথে, বন্ধুদের সাথে মাসের পর মাস, বছরের পর বছর বিচ্ছিন্ন।

১৯৬৬ থেকে ১৯৭২ পর্যন্ত দীর্ঘ ছয় বছর প্রায় জনবিচ্ছিন্ন অবস্থায় কাটানো জোয়ান বায়েজের সেই বন্ধুটির নাম বব ডিলান। কোন কারণে ওই সময়টাতে নিজেকে একদম গুটিয়ে নিয়েছিলেন সবকিছু থেকে। এই সময়কালে মাত্র ছোট্ট একটি অ্যালবাম বেরিয়েছিল ববির, আর কিছুই ছিল না।

সারা বিশ্বে তখন ষাট দশকের অস্থিরতা, স্নায়ুযুদ্ধের তিক্ততা চরমে, ভিয়েতনাম যুদ্ধের নির্মমতা চুড়ান্তে। হাজারে হাজারে মানুষ মরছে অসম এক যুদ্ধের পরিণতিতে। সারা বিশ্বে প্রতিবাদ উঠেছে। যুদ্ধের প্রধান যোগানদার আমেরিকাতেও হাজার হাজার মানুষের যুদ্ধ বিরোধী বিক্ষোভ। সেই বিক্ষোভে যোগ দিয়েছে কবি সাহিত্যিক শিল্পী অনেকেই। যুদ্ধবিরোধী মিছিলের এক প্রতিবাদী কন্ঠের নাম জোয়ান বায়েজ। আন্দোলন করতে গিয়ে জেলও খেটেছিলেন ১৯৬৭ সালে।

ববির সাথে জোয়ানের পরিচয় ১৯৬১ সালে। ধরতে গেলে মুখচোরা ববিকে জোয়ানই টেনে এনেছিল সঙ্গীতের জগতে। তার আগে ববিকে তেমন করে কেউ চিনতো না। দুজন একসাথে বন্ধুতায় আবদ্ধ ছিল ১৯৬৫ পর্যন্ত। তারপর হয়তো সম্পর্ক ক্লান্তি কিংবা ভুল বোঝাবুঝির কারণে দুজনের মধ্যে বাড়তে শুরু করে দূরত্ব। সেই অবস্থাতে ১৯৬৬ সালে এক মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় বব ডিলান মারাত্মকভাবে আহত হলেন। সেই দুর্ঘটনাটি একটু রহস্যময়। কিন্তু দুর্ঘটনার পরেই তিনি স্বেচ্ছানির্বাসনে চলে গেলেন। কেন সেই 'দুর্ঘটনা'টি ঘটলো, সেই গল্প অন্য সময়ে।

তবু সেই নির্বাসনকালের মধ্যেও একদিন তাঁকে আমরা পাই। ১ আগষ্ট ১৯৭১ সালে ম্যাডিসন স্কয়ারের বাংলাদেশ কনসার্টে। সদ্য ভেঙ্গে যাওয়া বিটলসের বন্ধু জর্জ হ্যারিসনের ডাকে বাংলাদেশ কনসার্টে এসেছিলেন তিনি। রবিশংকরের সাথে মিলে জর্জ যখন কনসার্টের আয়োজন করছিলেন, তখন বব ডিলানের  নামও ছিল তালিকায়। কিন্তু জনবিচ্ছিন্ন ববি কনসার্টে আসবেন কিনা সেই অনিশ্চয়তায় ভুগছিল সবাই সবাই, প্রথম পর্বের অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেছে, মঞ্চে গাইছেন একের পর এক পপ সঙ্গীতের দিকপাল, তবু ববির দেখা  নেই।

যখন হ্যারিসনের পালা এলো, তিনি গিটারের পাশে আটকানো শিল্পীর তালিকাটির দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুঁচকে ববের নামটির দিকে তাকিয়েছিলেন, তখন হঠাৎ দেখা গেল হারমোনিকা আর গীটার হাতে নার্ভাস ভঙ্গীতে মঞ্চে যখন উঠে আসছেন সবার প্রিয় ববি। কী অদ্ভুত, সেই আসরে বব ডিলান তাঁর বিখ্যাত পাঁচ পাঁচটি গান গেয়ে মাতিয়ে ফেললেন আসর।

কাছাকাছি সময়ে তাঁর বন্ধু জোয়ান বায়েজও বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের জন্য লেখা অদ্ভুত সুন্দর সেই গান 'স্টোরি অব বাংলাদেশ' গানটি লিখে ফেলেছেন। গানটি পরে 'সং অব বাংলাদেশ নামে তাঁর Come from the Shadows অ্যালবামে যুক্ত হয়। ম্যাডিসন স্কয়ারের বাংলাদেশ কনসার্টে জোয়ান বায়েজকে ভুলবশতঃ(?) রাখা না হলেও তিনি মানবতার স্বপক্ষে তাঁর চিরাচরিত দায়িত্বটি পালন করে গেছেন।

বাংলাদেশের যুদ্ধ শেষ হলো। আমরা স্বাধীন একটি পতাকা আর মানচিত্র পেলাম। কিন্তু ভিয়েতনামের মুক্তি মেলেনি তখনো। আমেরিকার নাপাম বোমার আঘাতে শত শত ভিয়েতনামী নারী পুরুষ শিশু নির্বিচারে মারা যাচ্ছিল। সেই যুদ্ধে আমেরিকার অংশ নেবার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ চলছিল ১৯৬৫ সাল থেকেই।

১৯৭২ সালে এসে জোয়ান যুদ্ধ বিরোধী আন্দোলনে প্রিয় বন্ধুকে মিস করতে শুরু করছিলেন। ববির ভক্তকূল যেভাবে মিস করছিলেন, তারো চেয়ে বেশী। বব ডিলানের ভক্তেরা তাদের প্রিয় ববির বাড়ি পর্যন্ত ঘেরাও করতে শুরু করলেও তিনি তা না করে যুদ্ধ বিরোধী শান্তির মিছিলে ভিয়েতনামের অসহায় মানুষের পক্ষে, আমেরিকার আগ্রাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেতৃত্ব দেবার জন্য ববিকে ডাকার জন্য একটি চিঠি লিখলেন। সেই চিঠির ভাষা অনুপম শব্দের এক কবিতায় রূপ নিল এবং কবিতাটি সুর পেয়ে পরিণত হলো মানবিকতার আহবান সমৃদ্ধ অপূর্ব এক ভেজা কান্নায়। এই গানের আহবানে যে প্রেমের প্রকাশ, সেই প্রেমটি ছিল অসহায় মানুষের জন্য, মানবতার জন্য। বিবেকের দুয়ার খুলে প্রিয় বন্ধুকে সামনে এসে দাঁড়ানোর আহবান।

কান পেতে শুনেছো তুমি কখনো কোন নির্জন রাতে, ওরা কাঁদছে, ওরা ডাকছে, অসহায় শিশুরা মারা যাচ্ছে, তুমি কী তাদের কান্না শুনতে পাচ্ছো ববি? আমি তোমার পায়ে গোলাপ দেবো, তোমার জন্য গাইবো গান। তবু তুমি নেমে আসো, আমাদের নিয়ে চলো মুক্তির মিছিলে।

এই অংশটি ঠিক অনুবাদ নয়, কিন্তু জোয়ান এমন কথাই বলতে চেয়েছিলেন তাঁর চিঠিতে। সুরের ভাঁজে তাঁর সেই আকুলতা মানুষের মুক্তির জন্য, স্বাধীনতার জন্য, মানবাধিকারের জন্য। সেই অসাধারণ কবিতা কিংবা গানটি-

I'll put flowers at your feet and I will sing to you so sweet
And hope my words will carry home to your heart
You left us marching on the road and said how heavy was the load
The years were young, the struggle barely had its start
Do you hear the voices in the night, Bobby?
They're crying for you
See the children in the morning light, Bobby
They're dying

No one could say it like you said it, we'd only try and just forget it
You stood alone upon the mountain till it was sinking
And in a frenzy we tried to reach you
With looks and letters we would beseech you
Never knowing what, where or how you were thinking
Do you hear the voices in the night, Bobby?
They're crying for you
See the children in the morning light, Bobby
They're dying

Perhaps the pictures in the Times could no longer be put in rhymes
When all the eyes of starving children are wide open
You cast aside the cursed crown and put your magic into a sound
That made me think your heart was aching or even broken
But if God hears my complaint He will forgive you
And so will I, with all respect, I'll just relive you
And likewise, you must understand these things we give you

Like these flowers at your door and scribbled notes about the war
We're only saying the time is short and there is work to do
And we're still marching in the streets with little victories and big defeats
But there is joy and there is hope and there's a place for you
And you have heard the voices in the night, Bobby
They're crying for you
See the children in the morning light, Bobby
They're dying
.......................................................................
TO BOBBY (Words and Music by Joan Baez)
© 1972 Chandos Music (ASCAP)


জোয়ানের কন্ঠ এতটা করুণ সুরে আর কখনো বাজেনি বোধহয়। একটা আহবান কতোটা প্রাণস্পর্শী হতে পারে তা এই গানটি না শুনলে বোঝা যাবে না। শুনে অবাক লাগতে পারে যে ববি এমন একটি প্রাণস্পর্শী আহবানেও সাড়া দেননি। বরং তিনি এসব ডাকাডাকিতে বিরক্তই হয়েছিলেন বলে পরবর্তীকালে তাঁর আত্মজীবনীর সুত্রে জানা গেছে। তার কারণটা তিনি জানেন, সময় জানে। সময় মানুষকে নিষ্ঠুর হতে বাধ্য করে কখনো কখনো।

কিন্তু জোয়ান বায়েজ থেমে যাননি। তিনি সরাসরি যুদ্ধ কবলিত ভিয়েতনামে উড়াল দেন আরো কয়েকজন শান্তিকর্মীর সাথে যার মধ্যে ছিলেন ন্যুরেমবার্গ আদালতের প্রসিকিউটর এবং কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের অধ্যাপক টেলফোর্ড টেলর। Committee for Solidarity with the American People এর আমন্ত্রণে ১৯৭২ সালের ডিসেম্বরের ১৮ তারিখ হ্যানয় পৌঁছান তিনি। ১৮ থেকে ৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত ১২ দিন তিনি বোমা মাথায় করে হ্যানয়ে অবস্থান করেন আর যুদ্ধের ধ্বংসলীলা দেখতে থাকেন ঘুরে ঘুরে। পরে জানা গেছে তাঁর অবস্থানকালের ১২ দিনেই আমেরিকা বি-৫২ বোমারু বিমান প্রায় ১ লক্ষ টন বোমা নিক্ষেপ করেছিল হ্যানয় ও হাইফং শহরে যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ৬ বছরে ইংল্যাণ্ডের মোট বোমাবর্ষনেরও চেয়েও বেশী। পরের ঘটনা আমাদের জানা। ১৯৭৩ সালে আমেরিকা লজ্জাজনক পরাজয় বরণ করে ফিরে এলো ভিয়েতনাম থেকে।

ববিও গানে ফিরে এসেছিল তার কিছুকাল পর। জোয়ানের সাথে একসাথে এক মঞ্চে গেয়েছেন আবারো। গাইলেও সেই সম্পর্কের ফাটল আর জোড়া লাগেনি। আরো বহু বছর পর (৪৪ বছর পরে ২০০৯ সালে) ববি তার প্রিয় জোয়ানির (Joanie বলে ডাকতেন তাঁকে) কাছে জনসমক্ষে ক্ষমাপ্রার্থনা করেছিলেন সম্পর্ক ভেঙ্গে দেবার জন্য। 

ম্যান, অনেক দেরী করে ফেলেছেন! 





-----------------------------------------------------------------------
তথ্যসুত্র:
1. Joanbaez.com
2. Baez, Joan (1987). And A Voice To Sing With
3. "1967: Joan Baez arrested in Vietnam protest". BBC News. October 16, 1967
4. Joan Baez in Hanoi: 12 Days Under the Bombs By Tim Cahill, Rolling Stone Magazine, February 1, 1973
5. 'Joan Baez gets her apology' By Peter Howell, The Star, Sep. 21, 2009
6. Wikipedia- Joan Baez and Bob Dylan



Tuesday, December 6, 2016

গ্রামীনফোন : ১৯ টাকার ব্লগ

গ্রামীন ফোনের Flexi Plan নামে একটা রিচার্জ সিস্টেম আছে যেটা দিয়ে খুব চমৎকার ভাবে কল টাইম আর ইন্টারনেট, এসএমএস ইত্যাদি কেনা যায়। এখানে কিনলে কলরেটে ডিসকাউন্ট পাওয়া যায় ভালো। ১০০ মিনিটের প্যাক কিনলে যে কোন ফোনে কল করার রেট ছিল ভ্যাট ইত্যাদি মিলিয়ে ৭৬ টাকা। এক মিনিটে খরচ ৭৬ পয়সা যেখানে সাধারণ কলরেট হলো মিনিটে ১.৬৫ পয়সা। সাধারণ কল রেটে বিরাট ফাঁকি আছে, সরকারকে বলা হয় এক রেট, গ্রাহকদের কাছে কাটা হয় আরেক রেটে। পালসের সরল গরল অংকের হিসেব অধিকাংশ গ্রাহক বোঝে না। প্রথম মিনিটে এক রেট, দ্বিতীয় মিনিটে আরেক রেট। আরে ফোনে কথা বলার জন্য এত অংক কে করবে বসে?

সেই হিসেবে ফ্লেক্সি প্ল্যানের হিসেবটাতে গোঁজামিল কম। বছরখানেক ধরে এই সিস্টেমের ব্যবহার করছি এবং প্রশংসা করে অন্যদেরও এটা ব্যবহার করার জন্য উৎসাহিত করছিলাম। কিন্তু আজ সকালে রিচার্জ করতে গিয়ে দেখি ৭৬ টাকার হিসেবটা ৯৫ টাকা হয়ে গেছে নিঃশব্দে। এই যে কল রেট ১৯ টাকা বাড়লো, শতাংশের হিসেবে সেটা ২৫%। এই বৃদ্ধি হলো  কোন ঘোষণা ছাড়াই। মোবাইল কোম্পানীগুলো নিশ্চিত যে ঘোষণা ছাড়াই রেট বাড়ানোর সর্বময় অধিকার রয়েছে তাদের। তাই এটা কাউকে জানাবার প্রয়োজনও বোধ করে না।

 গ্রাহক সুবিধার অফার নিয়ে যেসব পুশ মেসেজ প্রতিদিন এসে ইনবক্স ভর্তি করে, তার মধ্যে কোনদিন কাজের কোন বার্তা পাইনি। অফারগুলো যেমন দিনে বিশবার আসে, সেখানে এমন দামবৃদ্ধির ঘোষণাটাও আসতে পারতো না? কিন্তু দেখুন ফ্লেক্সিপ্ল্যানের অ্যাপস আপডেট করার অফার বার্তাগুলো ঠিকমতো আসলেও দাম বাড়ার ঘোষনাটা আসতে পারেনি। অতীতেও দেখেছি দাম বাড়ানোর ঘটনাগুলো নীরবেই ঘটে।

ধরা যাক এক কোটি গ্রাহক ১০০ টাকা করে রিচার্জ করবে এই সপ্তাহে। তাদের কাছ থেকে বাড়তি নেয়া হবে ১৯ কোটি। একদম নিঃশব্দে হজম হয়ে যাবে এই ১৯ কোটি টাকা। স্বাধীনতা ও গনতন্ত্রের পরিবেশে নীরব বাটপারির কী চমৎকার নিদর্শন!

মাত্র ১৯ টাকা নিয়ে কেউ এক পাতা লেখার সময় নষ্ট করে? করতাম না, কিন্তু এটা কয়েক কোটি গ্রাহকের স্বার্থ, প্রতিদিন যা নিয়ে ছেলেখেলা করা হয় কিন্তু সবগুলো মিডিয়ার মুখ বন্ধ করা আছে বিজ্ঞাপনের পুরস্কার দিয়ে। নিজের ব্লগে হলেও একটু দাগ রেখে দেয়া আর কি।



Monday, December 5, 2016

পত্রিকার কাটিং

পত্রিকার কাটিং জমানো অভ্যেস ছিল বহুকাল আগে। সে অভ্যেস প্রযুক্তির বানে কবেই ভেসে গেছে। তবু আজ একটি পত্রিকার কাটিং ডিজিটাইজ করে রাখলাম। বড় কোন কাগজে এই প্রথম লেখা ছাপালো। প্রথম সবকিছুর স্মৃতির আমেজই আলাদা। বিস্তারে প্রকাশিত লেখাটা ইত্তেফাকের সম্পাদকের পছন্দ হলে তিনি নিজের পত্রিকার জন্য নিয়ে নিলেন। কাটিং ডিজিটাইজ করার সুবিধা হলো কাগজ হারালেও লেখার কপিটা থাকবে।




তারিখ ৫ ডিসেম্বর ২০১৬, দৈনিক ইত্তেফাক

Sunday, December 4, 2016

বখতিয়ার খিলজির একটি পরাজয় পালক

ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজিকে ভারতবর্ষে সবাই চেনে। ভারতবর্ষের বাইরেও অচেনা নন তিনি। উপমহাদেশে মুসলমান রাজত্বের সূচনা তাঁর হাত দিয়েই হয়েছিল। কারো কাছে তিনি মহানায়ক, কারো চোখে তিনি মহাভিলেন। বখতিয়ার খিলজির বীরত্বের কিংবদন্তি সবাই জানলেও তাঁর শেষ অভিযান সম্পর্কে খুব বেশী মানুষ জানে না। শেষ অভিযানটি তাঁর খ্যাতির মুকুটে একটি পরাজয়ের পালক হিসেবে থেকে গিয়েছিল।

সুদূর পশ্চিম এশিয়া থেকে ঘোড়া ছুটিয়ে ভারতবর্ষে ঢুকে একের পর এক রাজ্য জয় করা শেষে বখতিয়ার খিলজি বঙ্গবিজয় করেছিলেন ১২০৪ খৃষ্টাব্দে। বঙ্গবিজয়ের পর তিনি খুব বেশীদিন ক্ষমতার স্বাদ উপভোগ করতে পারেননি। কেননা বঙ্গবিজয়ের দুবছরের মধ্যে অনিবার্য দুর্ভাগ্য তাঁর নজরকে টেনে নিয়ে গিয়েছিল হিমালয়ের উত্তরের দুর্গম প্রায় অগম্য রাজ্য তিব্বতের দিকে। শোনা যেত নিজস্ব নিঃসঙ্গতায় মগ্ন পৃথিবী বিচ্ছিন্ন দেশ তিব্বতে আছে সোনা, রূপা, মূল্যবান রত্নরাজি। উপরি হিসেবে আরো আছে বিশ্বখ্যাত বাণিজ্য পথ সিল্ক রুট যেটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে চীনের সাথে বিশ্ববানিজ্যের দরোজায় খাম্বা গেড়ে বসে যাওয়া যাবে।

খোঁজ খবর নিতে গিয়ে মিলে গেল আলী মেক (Ali Mech) নামের এক হিমালয়বাসী উপজাতীয় বাসিন্দার, যে পথ দেখিয়ে বখতিয়ার বাহিনীকে বাংলা থেকে তিব্বতে নিয়ে যাবে। যুগে যুগে এই উপমহাদেশের মানুষ বিদেশী শক্তির এমন সহায়ক গাইড হিসেবে কাজ করে আসছে। আলেকজাণ্ডার বা  খিলজি বা ভাস্কো-দা-গামা কেউ তাদের সেবা থেকে বঞ্চিত হননি।

অতঃপর ১২০৬ খৃষ্টাব্দের এক শুভদিনে দশ হাজার সৈন্যের বিশাল বাহিনী  নিয়ে বখতিয়ার খিলজি উত্তরবঙ্গের দেবকোট (Debkot- দিনাজপুর সংলগ্ন প্রাচীন গৌড়ের অংশ ছিল) নগরী থেকে যাত্রা শুরু করেন। যাত্রার পূর্বে তাঁর বিশ্বস্ত সহযোগী আলী মর্দান খিলজিকে দেশ রক্ষার দায়িত্ব দিয়ে নিশ্চিন্তে ঘোড়া ছোটালেন।  ব্রহ্মপুত্রের উৎসমুখ ধরে এগিয়ে তাঁর বাহিনী কামরূপ রাজ্যে প্রবেশ করে। তারপর কামরূপের রাজার সাহায্যে তিস্তা নদীর প্রাচীন সেতু পেরিয়ে, সিকিম ভূটানের মাঝামাঝির  পার্বত্য এলাকা দিয়ে তিব্বতের চাম্বি উপত্যকায় (Chumbi Valley) প্রবেশ করলেন।

খিলজি বাহিনী চাম্বি উপত্যকায় পৌঁছে বিজিত নগরীকে ধ্বংসস্তুপে পরিণত করার কর্মসূচীতে নেমে পড়লো। কিন্তু গ্রামগঞ্জ লণ্ডভণ্ড করতে করতেই দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া তিব্বতীরা একসময় জেগে উঠলো। গড়ে তুললো অভিনব এক গেরিলা বাহিনী। সেই মধ্যযুগে এমন গেরিলা বাহিনীর উল্লেখ আর কোথাও পা্ওয়া যায় না। সেই বাহিনী পাহাড় পর্বতের নানান অংশ থেকে আক্রমন শুরু করলো দেশ প্রতিরক্ষার প্রবল প্রত্যয়ে। 

কিছুদিন পরই তিব্বতী গেরিলা বাহিনীর চোরাগোপ্তা হামলায় খিলজি বাহিনীর নাভিশ্বাস উঠলো। উপায় না দেখে বখতিয়ার খিলজি তাঁর বাহিনীকে পিছু হঠার নির্দেশ দিলেন। কিন্তু ততক্ষণে ফেরার পথও বন্ধ প্রায়। কামরূপের রাজা হয়তো আসার পথে ক্রোধ চেপে সাহায্য করেছিল, কিন্তু এখন খিলজি বাহিনীর বিপদ দেখে সুযোগ বুঝে  বিগড়ে গেল এবং তিস্তা সেতু অবরোধ করে রাখল। বিপর্যস্ত খিলজি প্রায় সব সৈন্যকে পেছনে রেখে বিকল্প কোন পথে মাত্র শ খানেক সৈন্য নিয়ে বাংলায় ফিরে আসতে সক্ষম হয়েছিলেন। বাকীদের পরিণতি জানা যায়নি।
১২০৬ সালটি বখতিয়ার খিলজির জন্য অভিশপ্ত একটি বছর। সে বছরই তিব্বতের ব্যর্থ অভিযান শেষ করে ফিরে আসার পর বখতিয়ার খিলজি অসুস্থ হয়ে পড়েন। ইতিহাস বলে মধ্যযুগে রাজাধিরাজদের অসুস্থ হওয়া একটা বিপদ। খুব কাছের লোকেরা তখন হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। অসুস্থ অবস্থায় বখতিয়ার খিলজিকে হত্যা করে দেশ রক্ষার মহান দায়িত্ব পালন করেছিল তাঁরই সহযোগী আলী মর্দান খিলজি।

বখতিয়ার খিলজিকে হত্যার পর বাংলার মসনদ নিয়ে খিলজি বংশের কামড়াকামড়ি চলেছিল অনেকদিন। সে ইতিহাসে না গিয়েও  বলা যায় বাংলার ইতিহাসে বিশ্বাসঘাতকতা হাজার বছরের ঐতিহ্য। বখতিয়ার খিলজি সেই ঐতিহ্যের একটি উদাহরণ মাত্র। সেরকম উদাহরণ খিলজি পরবর্তীকালে বহুবার ঘটে চলেছে। এমনকি এই বিশ একুশ শতকেও তা বহমান।



চাম্বি উপত্যকার একটি অংশ। হয়তো এই পথেই ঘোড়া ছুটিয়েছিল খিলজি বাহিনী







তথ্যসুত্র:
১. Buddhism and Islam on the Silk Road -Elverskog, Johan (2011-06-06). 
২. The River of Golden Sand: The Narrative of a Journey Through China and Eastern Tibet to Burmah- William John Gill; Henry Yule (9 September 2010). 
৩. A Comprehensive History of Medieval India: Twelfth to the Mid-Eighteenth Century- Farooqui Salma Ahmed (2011). 
৪. বাংলাপিডিয়া


Saturday, December 3, 2016

সন্ধ্যার মেঘের রঙ খুঁজে হৃদয়....

কোন কোন নাগরিক সন্ধ্যার আকাশেও মেঘটেঘ এলোমেলো দাঁড়িয়ে পড়ে কোন শিল্পকলার ধার না ধারে। কংক্রিট ছাদে দাঁড়িয়ে মলিন শিল্পরসহীন আকাশের দিকে চোখ পড়ে মাঝে মাঝে এবং এই সব বহু দেখা নীরস আকাশ দেখেও কখনো কখনো ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপে অলস চুমুক দিতে দিতে প্রিয় কবির বইয়ে পাতা উল্টে যাওয়া যায়। প্রিয় মুহূর্তের একটি ঝলক মহাকালের খাতায় বিনাশ হয়ে যাবার মুহূর্তে..........




গানের সুরের মতো বিকালের দিকের বাতাসে
পৃথিবীর পথ ছেড়ে — সন্ধ্যার মেঘের রঙ খুঁজে
হৃদয় ভাসিয়া যায় — সেখানে সে কারে ভালোবাসে! —
পাখির মতন কেঁপে — ডানা মেলে — হিম চোখ বুজে
অধীর পাতার মতো পৃথিবীর মাঠের সবুজে
উড়ে উড়ে ঘর ছেড়ে কত দিকে গিয়েছে সে ভেসে —
নীড়ের মতন বুকে একবার তার মুখ গুঁজে
ঘুমাতে চেয়েছে, তবু — ব্যথা পেয়ে গেছে ফেঁসে —
তখন ভোরের রোদে আকাশে মেঘের ঠোঁট উঠেছিল হেসে!

আলোর চুমায় এই পৃথিবীর হৃদয়ের জ্বর
কমে যায়; তাই নীল আকাশের স্বাদ–সচ্ছলতা–
পূর্ণ করে দিয়ে যায় পৃথিবীর ক্ষুধিত গহ্বর;
মানুষের অন্তরের অবসাদ — মৃত্যুর জড়তা
সমুদ্র ভাঙিয়া যায় — নক্ষত্রের সাথে কয় কথা
যখন নক্ষত্র তবু আকাশের অন্ধকার রাতে —
তখন হৃদয়ে জাগে নতুন যে — এক অধীরতা,
তাই লয়ে সেই উষ্ণ আকাশের চাই যে জড়াতে
গোধূলির মেঘে মেঘে, নক্ষত্রের মতো রব নক্ষত্রের সাথে!

আমারে দিয়েছ তুমি হৃদয়ের যে — এক ক্ষমতা
ওগো শক্তি, তার বেগে পৃথিবীর পিপাসার ভার
বাধা পায়, জেনে লয় লক্ষত্রের মতন স্বচ্ছতা!
আমারে করেছ তুমি অসহিষ্ণু — ব্যর্থ — চমৎকার!
জীবনের পারে থেকে যে দেখেছে মৃত্যুর ওপার,
কবর খুলেছে মুখ বার বার যার ইশারায়,
বীণার তারের মতো পৃথিবীর আকাঙক্ষার তার
তাহার আঘাত পেয়ে কেঁপে কেঁপে ছিড়ে শুধু যায়!
একাকী মেঘের মতো ভেসেছে সে — বৈকালের আলোয় — সন্ধ্যায়!

সে এসে পাখির মতো স্থির হয়ে বাঁধে নাই নীড় —
তাহার পাখায় শুধু লেগে আছে তীর — অস্থিরতা!
অধীর অন্তর তারে করিয়াছে অস্থির — অধীর!
তাহারই হৃদয় তারে দিয়েছে ব্যাধের মতো ব্যথা!
একবার তাই নীল আকাশের আলোর গাঢ়তা
তাহারে করেছে মুগ্ধ — অন্ধকার নক্ষত্র আবার
তাহারে নিয়েছে ডেকে — জেনেছে সে এই চঞ্চলতা
জীবনের; উড়ে উড়ে দেখেছে সে মরণের পার
এই উদ্বেলতা লয়ে নিশীথের সমুদ্রের মতো চমৎকার!

গোধূলির আলো লয়ে দুপুরে সে করিয়াছে খেলা,
স্বপ্ন দিয়ে দুই চোখ একা একা রেখেছে ঢাকি;
আকাশে আঁধার কেটে গিয়েছে যখন ভোরবেলা
সবাই এসেছে পথে, আসে নাই তবু সেই পাখি! —
নদীর কিনারে দূরে ডানা মেলে উড়েছে একাকী,
ছায়ার উপরে তার নিজের পাখায় ছায়া ফেলে
সাজায়েছে স্বপ্নের পরে তার হৃদয়ের ফাঁকি!
সূর্যের আলোর পরে নক্ষত্রের মতো আলো জ্বেলে
সন্ধ্যার আঁধার দিয়ে দিন তার ফেলেছে সে মুছে অবহেলে!

কেউ তারে দেখে নাই; মানুষের পথ ছেড়ে দূরে
হাড়ের মতন শাখা ছায়ার মতন পাতা লয়ে
যেইখানে পৃথিবীর মানুষের মতো ক্ষব্ধ হয়ে
কথা কয়, আকাঙক্ষার আলোড়নে চলিতেছে বয়ে
হেমন্তের নদী, ঢেউ ক্ষুধিতের মতো এক সুরে
হতাশ প্রাণের মতো অন্ধকারে ফেলিছে নিশ্বাস
তাহাদের মতো হয়ে তাহাদের সাথে গেছি রয়ে;
দূরে প’ড়ে পৃথিবীর ধূলা — মাটি — নদী — মাঠ — ঘাস —
পৃথিবীর সিন্ধু দূরে — আরো দূরে পৃথিবীর মেঘের আকাশ!

এখানে দেখেছি আমি জাগিয়াছ হে তুমি ক্ষমতা,
সুন্দর মুখের চেয়ে তুমি আরো ভীষণ, সুন্দর!
ঝড়ের হাওয়ার চেয়ে আরো শক্তি, আরো ভীষণতা
আমারে দিয়েছে ভয়! এইখানে পাহাড়ের পর
তুমি এসে বসিয়াছ — এই খানে অশান্ত সাগর
তোমারে এনেছি ডেকে — হে ক্ষমতা, তোমার বেদনা
পাহাড়ের বনে বনে তুলিতেছে বিদ্যুতের ফণা
তোমার স্ফুলিঙ্গ আমি, ওগো শক্তি — উল্লাসের মতন যন্ত্রণা!

আমার সকল ইচ্ছা প্রার্থনার ভাষার মতন
প্রেমিকের হৃদয়ের গানের মতন কেঁপে উঠে
তোমার প্রাণের কাছে একদিন পেয়েছে কখন!
সন্ধ্যার আলোর মতো পশ্চিম মেঘের বুকে ফুটে,
আঁধার রাতের মতো তারার আলোর দিকে ছুটে,
সিন্ধুর ঢেউয়ের মতো ঝড়ের হাওয়ার কোলে জেগে
সব আকাঙক্ষার বাঁধ একবার গেছে তার টুটে!
বিদ্যুতের পিছে পিছে ছুটে গেছি বিদ্যুতের বেগে!
নক্ষত্রের মতো আমি আকাশের নক্ষত্রের বুকে গেছি লেগে!

যে মুহূর্ত চলে গেছে — জীবনের যেই দিনগুলি
ফুরায়ে গিয়েছে সব, একবার আসে তারা ফিরে;
তোমার পায়ের চাপে তাদের করেছ তুমি ধূলি!
তোমার আঘাত দিয়ে তাদের গিয়েছ তুমি ছিঁড়ে!
হে ক্ষমতা, মনের ব্যথার মতো তাদের শরীরে
নিমেষে নিমেষে তুমি কতবার উঠেছিলে জেগে!
তারা সব ছলে গেছে — ভূতুড়ে পাতার মতো ভিড়ে
উত্তর — হাওয়ার মতো তুমি আজও রহিয়াছ লেগে!
যে সময় চলে গেছে তাও কাপে ক্ষমতার বিষ্ময়ে — আবেগে!

তুমি কাজ করে যাও, ওগো শক্তি, তোমার মতন!
আমারে তোমার হাতে একাকী দিয়েছি আমি ছেড়ে;
বেদনা — উল্লাসে তাই সমুদ্রের মতো ভরে মন! —
তাই কৌতুহল — তাই ক্ষুধা এসে হৃদয়েরে ঘেরে,
জোনাকির পথ ধরে তাই আকাশের নক্ষত্রেরে
দেখিতে চেয়েছি আমি, নিরাশার কোলে বসে একা
চেয়েছি আশারে আমি, বাঁধনের হাতে হেরে হেরে
চাহিয়াছি আকাশের মতো এক অগাধের দেখা! —
ভোরের মেঘের ঢেউয়ে মুছে দিয়ে রাতের মেঘের কালো রেখা!

আমি প্রণয়িনী, তুমি হে অধীর, আমার প্রণয়ী!
আমার সকল প্রেম উঠেছে চোখের জলে ভেসে! —
প্রতিধ্বনির মতো হে ধ্বনি, তোমার কথা কহি
কেঁপে উঠে — হৃদয়ের সে যে কত আবেগে আবেশে!
সব ছেড়ে দিয়ে আমি তোমারে একাকী ভালোবেসে
তোমার ছায়ার মতো ফিরিয়াছি তোমার পিছনে!
তবুও হারায়ে গেছ, হঠাৎ কখন কাছে এসে
প্রেমিকের মতো তুমি মিশেছ আমার মনে মনে
বিদ্যুৎ জ্বালায়ে গেছ, আগুন নিভায়ে গেছ হঠাৎ গোপনে!

কেন তুমি আস যাও? — হে অস্থির, হবে নাকি ধীর!
কোনোদিন? — রৌদ্রের মতন তুমি সাগরের পরে
একবার — দুইবার জ্বলে উঠে হতেছ অস্থির! —
তারপর, চলে যাও কোন দূরে পশ্চিমে — উত্তরে —
ইন্দ্রধনুকের মতো তুমি সেইখানে উঠিতেছ জ্বলে,
চাঁদের আলোর মতো একবার রাত্রির সাগরে
খেলা কর — জোছনা চলে যায়, তবু তুমি যাও চলে
তার আগে; যা বলেছ একবার, যাবে নাকি আবার তা বলে!

যা পেয়েছি একবার, পাব নাকি আবার তা খুঁজে!
যেই রাত্রি যেই দিন একবার কয়ে গেল কথা
আমি চোখ বুজিবার আগে তারা গেল চোখ বুজে,
ক্ষীণ হয়ে নিভে গেল সলিতার আলোর স্পষ্টতা!
ব্যথার বুকের’ পরে আর এক ব্যথা — বিহ্বলতা
নেমে এল উল্লাস ফুরায়ে গেল নতুন উৎসবে;
আলো অন্ধকার দিয়ে বুনিতেছে শুধু এই ব্যথা,
দুলিতেছি এই ব্যথা — উল্লাসের সিন্ধুর বিপ্লবে!
সব শেষ হবে — তবু আলোড়ন, তা কি শেষ হবে!

সকল যেতেছে চলে — সব যায় নিভে — মুছে — ভেসে —
যে সুর থেমেছে তার স্মৃতি তবু বুকে জেগে রয়!
যে নদী হারায়ে যায় অন্ধকারে — রাতে — নিরুদ্দেশে,
তাহার চঞ্চল জল স্তব্ধ হয়ে কাঁপায় হৃদয়!
যে মুখ মিলায়ে যায় আবার ফিরিতে তারে হয়
গোপনে চোখের’ পরে — ব্যথিতের স্বপ্নের মতন!
ঘুমন্তের এই অশ্রু — কোন্‌ পীড়া — সে কোন্‌ বিস্ময়
জানায়ে দিতেছে এসে! — রাত্রি — দিন আমাদের মন
বর্তমান অতীতের গুহা ধরে একা একা ফিরিছে এমন!

আমরা মেঘের মতো হঠাৎ চাঁদের বুকে এসে
অনেক গভীর রাতে — একবার পৃথিবীর পানে
চেয়ে দেখি, আবার মেঘের মতো চুপে চুপে ভেসে
চলে যাই এক ক্ষীণ বাতাসের দুর্বল আহ্বানে
কোন্‌ দিকে পথ বেয়ে! — আমাদের কেউ কি তা জানে।
ফ্যাকাশে মেঘের মতো চাঁদের আকাশ পিছে রেখে
চলে যাই; কোন্‌ — এক রুগ্ন হাত আমাদের টানে?
পাখির মায়ের মতো আমাদের নিতেছে সে ডেকে
আরো আকাশের দিকে — অন্ধকারে, অন্য কারো আকাশের থেকে!

একদিন বুজিবে কি চারি দিকে রাত্রির গহ্বর!
নিবন্ত বাতির বুকে চুপে চুপে যেমন আঁধার
চলে আসে, ভালোবেসে — নুয়ে তার চোখের উপর
চুমো খায়, তারপর তারে কোলে টেনে লয় তার —
মাথার সকল স্বপ্ন, হৃদয়ের সকল সঞ্চার
একদিন সেই শূন্য সেই শীত — নদীর উপরে
ফুরাবে কি? দুলে দুলে অন্ধকারে তবুও আবার
আমার রক্তের ক্ষুধা নদীর ঢেউয়ের মতো স্বরে
গান গাবে, আকাশ উঠিবে কেঁপে আবার সে সংগীতের ঝড়ে!

পৃথিবীর — আকাশের পুরানো কে আত্মার মতন,
জেগে আছি; বাতাসের সাথে সাথে আমি চলি ভেসে,
পাহাড়ে হাওয়ার মতো ফিরিতেছে একা একা মন,
সিন্ধুর ঢেউয়ের মতো দুপুরের সমুদ্রের শেষে
চলিতেছে; কোন্‌ — এক দূর দেশ — কোন্‌ নিরুদ্দেশে
জন্ম তার হয়েছিল — সেইখানে উঠেছে সে বেড়ে;
দেহের ছায়ার মতো আমার মনের সাথে মেশে
কোন্‌ স্বপ্ন? — এ আকাশ ছেড়ে দিয়ে কোন্‌ আকাশেরে
খুঁজে ফিরি! — গুহার হাওয়ার মতো বন্দি হয়ে মন তব ফেরে!

গাছের শাখার জালে এলোমেলো আঁধারের মতো
হৃদয় খুঁজিছে পথ, ভেসে ভেসে — সে যে কারে চায়!
হিমেল হাওয়ার হাত তার হাড় করিছে আহত,
সেও কি শাখার মতো — পাতার মতন ঝরে যায়!
বনের বুকের গান তার মতো শব্দ করে গায়!
হৃদয়ের সুর তার সে যে কবে ফেলেছে হারায়ে!
অন্তরের আকাঙ্ক্ষারে — স্বপনেরে বিদায় জানায়
জীবন মৃত্যুর মাঝে চোখ বুজে একাকী দাঁড়ায়ে;
ঢেউয়ের ফেনার মতো ক্লান্ত হয়ে মিশিবে কি সে — ঢেউয়ের গায়ে!

হয়তো সে মিশে গেছে — তারে খুঁজে পাবে নাকো কেউ!
কেন যে সে এসেছিল পৃথিবীর কেহ কি তা জানে!
শীতের নদীর বুকে অস্থির হয়েছে যেই ঢেউ
শুনেছে সে উষ্ণ গান সমুদ্রের জলের আহ্বানে!
বিদ্যুতের মতো অল্প আয়ু তবু ছিল তার প্রাণে,
যে ঝড় ফুরায়ে যায় তাহার মতন বেগ লয়ে
যে প্রেম হয়েছে ক্ষুব্ধ সেই ব্যর্থ প্রেমিকের গানে
মিলায়েছে গান তার, তারপর চলে গেছে রয়ে।
সন্ধ্যার মেঘের রঙ কখন গিয়েছে তার অন্ধকার হয়ে!

তবুও নক্ষত্র এক জেগে আছে, সে যে তারে ডাকে!
পৃথিবী চায় নি যারে, মানুষ করেছে যারে ভয়
অনেক গভীর রাতে তারায় তারায় মুখ ঢাকে
তবুও সে! কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ চোখে ছবি দেখে একা জেগে রয়!
মানুষীর মতো? কিংবা আকাশের তারাটির মতো —
সেই দূর — প্রণয়িনী আমাদের পৃথিবীর নয়!
তার দৃষ্টি — তাড়নায় করেছে যে আমারে ব্যাহত —
ঘুমন্ত বাঘের বুকে বিষের বাণের মতো বিষম সে ক্ষত!

আলো আর অন্ধকারে তার ব্যথা — বিহ্বলতা লেগে,
তাহার বুকের রক্তে পৃথিবী হতেছে শুধু লাল! —
মেঘের চিলের মতো — দুরন্ত চিতার মতো বেগে
ছুটে যাই — পিছে ছুটে আসিতেছে বৈকাল — সকাল
পৃথিবীর — যেন কোন্‌ মায়াবীর নষ্ট ইন্দ্রজাল
কাঁদিতেছে ছিঁড়ে গিয়ে! কেঁপে কেঁপে পড়িতেছে ঝরে!
আরো কাছে আসিয়াছি তবু আজ — আরো কাছে কাল
আসিব তবুও আমি — দিন রাত্রি রয় পিছে পড়ে —
তারপর একদিন কুয়াশার মতো সব বাধা যাবে সরে!

সিন্ধুর ঢেউয়ের তলে অন্ধকার রাতের মতন
হৃদয় উঠিতে আছে কোলাহলে কেঁপে বারবার!
কোথায় রয়েছে আলো জেনেছে তা, বুঝেছে তা মন —
চারি দিকে ঘিরে তারে রহিয়াছে যদিও আঁধার!
একদিন এই গুহা ব্যথা পেয়ে আহত হিয়ার
বাঁধন খুলিয়া দেবে! অধীর ঢেউয়ের মতো ছুটে
সেদিন সে খুঁজে লবে অই দুরে নক্ষত্রের পার!
সমুদ্রের অন্ধকারে গহ্বরের ঘুম থেকে উঠে
দেখিবে জীবন তার খুলে গেছে পাখির ডিমের মতো ফুটে!
..............................................................................................................
['অনেক আকাশ' - ধূসর পাণ্ডুলিপি, জীবনানন্দ দাশ]

Friday, December 2, 2016

কন্ঠে যার বেজেছিল বাংলাদেশের সুর

জগত চেনে তাঁকে। আমি জানতাম শুধু নাম। ছবিও হয়তো দেখেছি দূর থেকে। তেমন কিছু পড়িনি। একটি মাত্র গান শুনেছি, তাঁর অনেক গানের মাত্র একটি। যে গান দিয়ে তিনি বিশ্বজয় করেননি, জয় করেছেন একটি জাতির হৃদয়। হৃদয় দিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য গান গেয়ে বাংলাদেশের জনমানচিত্রে গ্রহন করেছেন স্থায়ী আসন। সে আসন কতোটা গভীর তা তিনি নিজেও হয়তো জানেন না।

যে গান দিয়ে তিনি বাংলাদেশের হৃদয় মানচিত্রে স্থান করেছেন তার বাইরে আর কোন গান শোনা হয়নি আমার। শোনা হয়নি ইংরেজি গানের প্রতি আমার আগ্রহের মাত্রা এবং যাতায়াত খুব কম বলেই। কাল রাতে অন্য একটি গান খুঁজতে গিয়ে তাঁর নামটা ইউটিউব স্ক্রিনে ভেসে উঠলো। চেনা নামের প্রতি শ্রদ্ধার কারণেই গানটি শোনার জন্য ক্লিক করলাম। একটি গান শেষ হবার পর মেনু থেকে আরেকটি গান, তারপর আরেকটি......., এভাবে একের পর এক ক্লিক করতে করতে কতোগুলো গান শোনা হলো হিসেব রাখিনি। এক সময় আবিষ্কার করলাম যে আমি জোয়ান বায়েজ নামের অসাধারণ একটা মেয়ের প্রেমে পড়ে গিয়েছি। হ্যাঁ সেই জোয়ান বায়েজ, যিনি আমাদের স্বাধীনতার জন্য 'বাংলাদেশ বাংলাদেশ' বলে আমেরিকার বাতাসে স্বাধীনতাকামী মানুষের বুক ভাসানো কান্না ছড়িয়ে দিয়েছিলেন ১৯৭১ সালে। তাঁর কন্ঠ, তাঁর ব্যক্তিত্ব, অভিব্যক্তি সবকিছু আমাকে ভাসিয়ে নিয়ে গেলো। মনে হলো আমার বহুকালের চেনামুখ এতদিন পরে খুঁজে পেলাম, যে ছিল আমার পাশের বাড়ির মেয়েটি।




বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে জোয়ান বায়েজ

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য তিনি যা করেছেন, তা নিয়ে আমাদের অনুভুতি কী, সে সম্পর্কে যা বলতে ইচ্ছে করছে, তা আমার ভাবনার চেয়েও গুছিয়ে লিখেছিলেন অভিজিত রায় ২০১১ সালে-

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের আপামর জনগণ যখন দেশের জন্য যুদ্ধ করছে, লড়ছে না-পাক বাহিনীর হাত থেকে প্রিয় দেশ-মাতৃকাকে মুক্ত করতে,  সে সময় ত্রিশ বছর বয়সী এক নারী শিল্পী বেছে নিয়েছিলেন যুদ্ধের এক অভিনব মাধ্যম, নিজের মতো করে। গিটার হাতে বাংলাদেশের মানুষদের উপর গণহত্যার প্রতিবাদ জানালেন তিনি। রচনা করলেন এক অমর সঙ্গীতের – SONG OF BANGLADESH।  যে সঙ্গীতের চরণে চরণে মূর্ত হয়ে উঠেছিলো বাংলাদেশের ইতিহাসের  অব্যক্ত বেদনা। ছাত্রদের উপর গণহত্যা, সেনাবাহিনীর তাণ্ডব, মানুষের হাহাকার, কুমারী মায়ের অসহায় দৃষ্টি, লাঞ্ছনা, বঞ্চনা, প্রতিরোধ সব কিছুই যেন মূর্ত হয়ে উঠেছে গানটিতে –জোয়ান বায়েজের কথা আর সুরের এক স্বপ্নিল যাদুস্পর্শে । পুরো গানটিতে ২২ বার তিনি ‘বাংলাদেশ’ –এর নাম উচ্চারণ করে যুদ্ধরত একটি জাতির স্বীকৃতি দিলেন বিশ্বের দরবারে, স্বীকৃতি দিলেন মুক্তিকামী একটি জাতির, অর্ধ গোলার্ধ দূরের অচেনা অজানা একটি ছোট্ট দেশের, নাম বাংলাদেশ।

বিদেশ বিভূঁইয়ের এক শিল্পীর বাংলাদেশের প্রতি দরদের ব্যাপারটা হয়তো আমাদের জন্য অদ্ভুত মনে হবে, কিন্তু জোয়ানের জন্য তা ছিলো না কখনোই। তিনি সব সময়ই ছিলেন সংগ্রামী। সংগ্রামের প্রেরণা পেয়েছিলেন সেই ছোটবেলাতেই, তার পরিবারের কাছ থেকে।  তার বাবা আলবার্ট বায়েজ ছিলেন খুব বিখ্যাত পদার্থবিদ, এমআইটির অধ্যাপক ছিলেন অনেকদিন। তাঁর আবিষ্কৃত এক্স রে ডিফ্রেকশন মাইক্রোস্কোপ এখনো মেডিকেলের জগতে ব্যবহৃত হয়।    অথচ যখন এই বিখ্যাত পদার্থবিদকে ম্যানহ্যাটন প্রোজেক্টে কাজ  কাজ করার জন্য তাকে অনুরোধ করা হয়েছিলো তিনি পারমাণবিক বোমা তৈরির প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে অস্বীকৃতি জানান। এমন কি যুক্তরাষ্ট্র সরকারের দেওয়া প্রতিরক্ষা প্রকল্পের লোভনীয় চাকুরী কিংবা পুরস্কারকেও হেলায়  প্রত্যাখ্যান করেছিলেন তিনি তখন। বাবার এই আত্মত্যাগ, ঋজু মনোভাব খুব নাড়া দিয়েছিলো ছোট্ট জোয়ানের মনে। বড় হয়ে তিনিও তাই দাঁড়াতে পেরেছিলেন অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে। তিনি গান গাওয়ার পাশাপাশি ক্রমশ: বিভিন্ন রাজনৈতিক এবং সামাজিক আন্দোলনের সাথে জড়িত হয়ে উঠেন। ষাটের দশকে মার্টিন লুথার কিং এর সাথে মিলে ‘সিভিল রাইটস মুভমেন্ট’এর সাথে জড়িত হন, জড়িত হন ‘ফ্রি-স্পিচ মুভমেন্টের’ সাথেও। সেখানেই তিনি পরিবেশন করেন তার বিখ্যাত গান ‘উই শ্যাল ওভারকাম সাম ডে’ বা ‘আমরা করব জয়, একদিন’ গানটি –

httpv://www.youtube.com/watch?v=RkNsEH1GD7Q

জোয়ান আজীবন যুদ্ধবিরোধী শান্তিকামী সৈনিক।  আজও তিনি ইরাকের উপর মার্কিন আগ্রাসনের বিরুদ্ধে একই ভাবে সোচ্চার। ২০০৩ সালে ৬২ বছর বয়সে সানফ্রান্সিস্কোতে কনসার্ট করেছিলেন  ইরাক যুদ্ধের অবসান চেয়ে।  বর্ণবাদের বিরুদ্ধে, শান্তি ও মানবাধিকারের স্বপক্ষে আজও তিনি এক জোরালো কণ্ঠস্বর। তিনি সমকামী, রূপান্তরকামী সংখ্যালঘু মানুষদের অধিকারের ব্যাপারেও গান গেয়েছেন অনেক, এমনকি তার ‘উই শ্যাল ওভারকাম’ গানটি একটু পরিবর্তন করে সংখ্যালঘুদের অধিকারের  দাবীতে পোস্ট করেছেন ইউটিউবে ২০০৯ সালে।  তবে, ভিয়েতনাম যুদ্ধের বিরুদ্ধে তার বিদ্রোহ ছিলো সবচেয়ে প্রকট।  যুদ্ধের প্রতিবাদ করতে গিয়ে দুই দুইবার গ্রেফতার হন ১৯৬৭ সালে।  তিনি এসময় মার্কিন সরকারকে ট্যাক্স দিতেও অস্বীকার করেন। তিনি রেভেনিউ সার্ভিসের কাছে পাঠানো একটি চিঠিতে বলেন  –

    “I do not believe in war. I do not believe in the weapons of war … and I am not going to volunteer 60% of my year’s income tax that goes to armaments.”

তিনি বাংলাদেশের গণহত্যার খবরে বিচলিত হবেন না তো কে হবেন? জোয়ান হয়েছিলেন। সুদূর আমেরিকায় বসে ভেবেছিলেন আমাদের কথা, আমাদের প্রিয় মাতৃভূমির কথা। লিখেছিলেন একটি অসাধারণ গান, যেটি প্রস্তুত করা হয়েছিলো ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে ১৯৭১ সালের অগাস্ট মাসে অনুষ্ঠিত ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ এর জন্য। যদিও ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ এ জর্জ হ্যারিসনের গাওয়া বাংলাদেশ গানটির কথা অনেকেই জানেন,  কিন্তু কোন এক অজ্ঞাত কারণে জোয়ান বায়েজের গানটি সেভাবে পরিচিতি পায়নি। জর্জ হ্যারিসনের গানটির কথা  মাথায় রেখেও আমার কাছে জোয়ান বায়েজের এই বিষাদময় সুরেলো গানটিই বেশি প্রিয় ছিলো সবসময়ই। আজো – প্রতিবার যখনই গানটি শুনি  চোখ ভিজে উঠতে চায়, বুকের গহীন কোনে কোথায় যেন বেজে উঠে রিনি রিনি এক ব্যথার সুর। ঠিক যেমন প্রতিবছর একুশের সকালে ‘আমার ভায়ের রক্তে রাঙানো’ গানটা শুনলেও যে অনুভূতি হয় মনে!


এবং সেই গানটি

জোয়ান বায়েজ Song of Bangladesh গানটি ১৯৭২ সালে প্রকাশিত Come from the Shadows অ্যালবামে অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। এই গানটি তিনি নিজে লিখেছেন, সুর দিয়েছেন এবং নিজের কন্ঠে গেয়েছেন। তিনটি কাজ তিনি কতো আন্তরিকতার সাথে করেছিলেন সেটি বুঝতে হলে গানটি চোখ বন্ধ করে শুনতে শুনতে ১৯৭১ সালের আমেরিকার কোন একটা কনসার্টের হাজারো মানুষের ভিড় ঘিরে থাকা একটি মঞ্চে উঠে একটি সুদূর অচেনা আক্রান্ত জনপদের কথা ভাবতে হবে, অনাগত স্বাধীনতার গর্ভ যন্ত্রণার মর্মস্পর্শী ভাষাকে বুঝতে হবে। যে ভিনদেশী মেয়েটি আমার দেশের জন্য গানটি গেয়েছিল সে তো আমার চিরচেনা বোন কিংবা বন্ধু কিংবা প্রেয়সীর চেয়ে কোন অংশে কম নয়।

    Bangladesh, Bangladesh
    Bangladesh, Bangladesh
    When the sun sinks in the west
    Die a million people of the Bangladesh

    The story of Bangladesh
    Is an ancient one again made fresh
    By blind men who carry out commands
    Which flow out of the laws upon which nation stands
    Which is to sacrifice a people for a land

    Bangladesh, Bangladesh
    Bangladesh, Bangladesh
    When the sun sinks in the west
    Die a million people of the Bangladesh

    Once again we stand aside
    And watch the families crucified
    See a teenage mother’s vacant eyes
    As she watches her feeble baby try
    To fight the monsoon rains and the cholera flies

    And the students at the university
    Asleep at night quite peacefully
    The soldiers came and shot them in their beds
    And terror took the dorm awakening shrieks of dread
    And silent frozen forms and pillows drenched in red

    Bangladesh, Bangladesh
    Bangladesh, Bangladesh
    When the sun sinks in the west
    Die a million people of the Bangladesh

    Did you read about the army officer’s plea
    For donor’s blood? It was given willingly
    By boys who took the needles in their veins
    And from their bodies every drop of blood was drained
    No time to comprehend and there was little pain

    And so the story of Bangladesh
    Is an ancient one again made fresh
    By all who carry out commands
    Which flow out of the laws upon which nations stand
    Which say to sacrifice a people for a land

    Bangladesh, Bangladesh
    Bangladesh, Bangladesh
    When the sun sinks in the west
    Die a million people of the Bangladesh

SONG OF BANGLADESH
Joan Baez.
© 1972 Chandos Music (ASCAP)


এই গানটি ১৯৭১ সালের ১ অাগষ্ট নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ারে 'কনসার্ট ফর বাংলাদেশে' গাওয়া হয়েছে বলা হলেও জোয়ান বায়েজের কাছ থেকে ব্যক্তিগত সুত্রে যাচাই করে জানা গেছে ভুলবশতঃ কনসার্ট অব বাংলাদেশে তাঁর নামটি রাখা হয়নি। ভুলটি ইচ্ছাকৃত ছিল কিনা সেটা জানার উপায় নেই। তবে ভারতীয় গবেষক শ্রীনাথ রাঘবনের* একটি প্রবন্ধের সুত্রে জানা গেছে ১৯৭১ সালের জুলাই মাসের শেষ সপ্তাহে বায়েজ স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ১২ হাজার দর্শকের সামনে গান করেন। মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ে আরেকটি বিশাল কনসার্টে তিনি ‘সং ফর বাংলাদেশ’ শিরোনামে গান করেন।

[*"কনসার্ট ফর বাংলাদেশ, জোয়ান বায়েজের গান ও অ্যালেন গিন্সবার্গের কবিতা"- শ্রীনাথ রাঘবন, প্রথম আলো ১৬ ডিসেম্বর ২০১৩]


গান শোনা হলো, তারপর...

গান শেষ হবার পর তাঁর জীবনী পড়লাম, জীবনী পড়া হলে তাঁকে নিয়ে তৈরী ডকুমেন্টারী, ছবি, সাক্ষাতকার হাতের কাছে যা পেলাম প্রায় সব পড়লাম। এক নাগাড়ে গত ২৪ ঘন্টার মধ্যে জাগ্রত সবটুকু সময় তাঁকে দিয়ে দিলাম। আমার দৈনিক সব কর্মসূচী বাদ দিয়ে আমি শুধু তাঁকে সঙ্গী করে কাটিয়ে দিলাম।

মাত্র একটা দিনে কতোটা গান শোনা যায়? বড়জোর বিশ বা পঁচিশটি। কিন্তু তাতেই জোয়ান বায়েজের কন্ঠ বুকের খুব গভীরে অনুভব করেছি। এ যেন ভিনদেশী কেউ নয়, যেন আমার দেশের ভাটিয়ালী গান গাইছে বিদেশী সুরে, এই কন্ঠ আমার অচেনা নয়, এই ইংরেজি যেন চেনা বাংলা ভাষা। কেউ এত সহজ কথায়, সহজ সুরে, সহজ বাদনে এমন করে গাইতে পারে, তাঁকে না শুনলে বুঝতাম না। বিপ্লবের ভাষা সঙ্গীতে এসে এত চমৎকার সুরে বাজে তখন তা দেশ কাল জাতি ধর্ম সবকিছুর উপরে চলে যায়। আমি স্পেনিশ ভাষার বিন্দু বিসর্গ বুঝি না, অথচ তাঁর গুয়ান্তানামেরা গানটি কী সুন্দর বুঝে গেলাম। প্রতিটি ভাষার, প্রতিটি সংগ্রামের নিজস্ব একটি কান্না আছে, সেই ক্রন্দনের সুরেই অনুদিত হয় অচেনা ভাষাও। গান শুনতে তাই ভাষা বোঝা সবসময় জরুরী না। ভাষা না বুঝেও উপভোগ করা যায় সঙ্গীত।

এই গানটি খুঁজতে গিয়েই তাঁকে খুঁজে পাওয়া - 500 miles
বব ডিলানের সাথে তাঁর সম্পর্কসুত্রে গাওয়া এই গানটি অসাধারণ- Diamond and Rust
এই গানটি শুনে হঠাৎ ধ্বক করে উঠেছিল বুকের ভেতর, এ যেন আমার চেনা কেউ।
মুগ্ধতার সাথে নস্টালিজক স্মৃতি এসে ভর করে এই গানটি শুনে।
যুদ্ধের বিপক্ষে এমন কোমল প্রতিবাদ সভ্যতার গালে সজোরে চড় কষায়
এই গান বুঝতে কী ভাষা খুব জরুরী?
আরো কতো গান শোনা বাকী তাঁর। শোনা গানগুলো আরো কতোবার শোনা হবে, আরো অনেক সময় কাটবে তাঁর সাথে। তাঁকে নিয়ে তৈরী করা এই ডকুমেন্টারি ভিডিওটি সংগ্রহে রেখে দেয়া যায়।


অসমাপ্ত উপসংহার

কিছু কথা এখনো বাকী।  কথাগুলো এখনো সাজানো হয়নি, সাজানো হয়ে গেলে যোগ করা হবে। শুধু একটি ছবি দেখি আজ। এই ছবিটি আজ সারাদিন খুব কথা বলেছে। যতক্ষণ ধরে গান শুনেছি এই ছবি, এই দৃষ্টি বারবার এসে চোখের সামনে দাঁড়িয়েছে। এ যেন বলতে চায় আমি তোমার বাংলাদেশের মেয়ে। দেশ মানে কোন মানচিত্র নয়, দেশ মানে এক লোকের পাশে অন্য লোক। কেন এই দৃষ্টি, কেন এই চোখের সামনে এসে দাঁড়ানো, সেই কথা আরেকদিন।





[অসমাপ্ত.....]



Wednesday, November 30, 2016

তিব্বত, দালাইলামা এবং একজন বাঙালী অতীশ দীপঙ্কর

১.
তিব্বত একটি দুর্গম এলাকা। এশিয়ার অন্যতম বিচ্ছিন্ন এলাকা। সমগ্র দক্ষিণ এশিয়া থেকে প্রায় বিশ হাজার ফুট উঁচু দু্ই হাজার মাইল দীর্ঘ হিমালয় পর্বতমালা দ্বারা আলাদা করা। এতসব দুর্গম পর্বত, দুঃসহ আবহাওয়া, ক্ষেত খামারের জায়গা নেই, খনিজ সম্পদেরও কোন প্রাচুর্য নেই, তবু ঔপনিবেশিক কাল থেকে তিব্বতের প্রতি বড় বড় শক্তিমান রাষ্ট্রগুলোর আগ্রহের কারণ কী? একের পর এক মিশন পাঠিয়ে তিব্বতের সাথে সম্পর্ক গড়ে তোলার এই চেষ্টা কেন? ধর্মকর্ম নিয়ে ব্যস্ত থাকা তিব্বতি লামাদের জোর করে দুনিয়ার ঝামেলার দিকে টানার কী দরকার ছিল?

তিব্বত নিয়ে পড়তে পড়তে ভাবনাগুলো ঘুরপাক খাচ্ছে।

তিব্বত তখনো একটি প্রচলিত রাষ্ট্র ছিল না। তিব্বতের শাসনকাজ চলে ধর্মগুরুর হাতে। তিব্বত হাজার বছর ধরে নিজের পথে চলছে। তিব্বত কখনো স্বাধীন ছিল না, আবার পরাধীনও নয়। তিব্বত বরাবরই চীনের হাতে। সেই তিনশো বছর আগের ইতিহাসেও তাই দেখি। কিন্তু আবার সেই চীন তিব্বতকে গিলেও স্বস্তিতে থাকেনি কখনো। তিব্বত তার পেটের মধ্যে আছে ঠিকই, কিন্তু সে কখনো সুখে ভাবতে পারছে না তিব্বত তার। দখল করলেই তাকে পাওয়া যায় না, তিব্বত তার অন্যতম একটা উদাহরণ।

দখল করেও না পাওয়ার অতৃপ্তির কারণেই তিব্বতের উপর চিরকাল নিষেধাজ্ঞা বজায় রেখেছে চীন সরকার। আসলে তিব্বত নিজেই নিজেকে নিষেধাজ্ঞার বেড়াজালে আটকে রেখেছে হাজার বছর ধরে। সেই নিষেধের বেড়া তুলতে না পেরে মহাশক্তিমান চীন সেই বেড়ার উপর একটি সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দিয়ে বলেছে - আম্মো নিষেধ কইলাম!

২.
তিব্বতের প্রতি আমার কোন মোহ ছিল না। কিন্তু সমস্যা করেছে দুজন বাঙালী। বাঙালী কোথাও কিছু করেছে সেটা জানার পর আরেকজন বাঙালের কৌতুহল আকাশচুম্বী হয়। জাতপ্রেমের কারণে তিব্বত নিয়ে পড়ার আগ্রহ হলো। দুই বাঙালীর একজন শরতচন্দ্র দাশ, আরেকজন অতীশ দীপঙ্কর। শরতচন্দ্র দাশ নিয়ে লিখেছি কিছু, এবার অতীশ দীপঙ্করের কথা বলি।

যে তিব্বত আজ নিষেধাজ্ঞার বেড়াজালে নিজেদের আটকে রেখেছে শত শত বছর ধরে, সেই নিষেধাজ্ঞার জনক তিব্বতের ধর্মগুরু দালাই লামা বাহিনী। বর্তমান দালাই লামা ১৪তম। ১ম দালাই লামার যাত্রা শুরু হয়েছিল ১৩৯১ সালে। মনে হচ্ছে বহুকাল আগের কথা? হতেই পারে। চোদ্দশতক তো আজকের কথা নয়। কিন্তু তারও চারশো বছর আগে অতীশ দীপঙ্কর নামে এক বাঙালী বৌদ্ধ তিব্বতে গিয়েছিলেন। হয়তো গিয়েছিলেন তিব্বতে বৌদ্ধ ধর্মের মশালকে আরেকটু উঁচুতে তুলে ধরতে। ধরেও ছিলেন। শুনে অবাক হতে পারেন সেই মশালই হাজার বছর ধরে বয়ে বেড়াচ্ছে তিব্বতের লামারা। যে দালাই লামারা চোদ্দ শতকে যাত্রা শুরু করে বৌদ্ধ ধর্মের একচ্ছত্র নেতা হয়েছেন, তাদের মাথার উপর ছাতা হয়ে এখনো রয়েছে একজন বাঙালী অতীশ দীপঙ্কর।

দালাই লামার যাত্রা শুরু সম্পর্কে উইকিতে লেখা আছে
The Book of Kadam, the main text of the Kadampa school, to which the First Dalai Lama, Gendun Drup, first belonged

যে বই এবং যে স্কুলের শিক্ষা দিয়ে দালাই লামার যাত্রা শুরু সেই দুটোই অতীশ দীপঙ্করের সৃষ্টি।

এমন বিখ্যাত একজন মানুষ সম্পর্কে আমাদের জানার পরিমান খুবই কম। তিনি তিব্বত গিয়েছিলেন এটা জানতাম কিন্তু তিব্বতে তিনি কী রোপন করে এসেছেন তা জানতাম না।

অতীশ দীপঙ্করের জন্ম ৯৮২ সালে বাংলাদেশে। ঢাকার অদূরে বিক্রমপুরের বজ্রযোগিনী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাসস্থান এখনও 'নাস্তিক পণ্ডিতের ভিটা' নামে পরিচিত। এটা খুব আশ্চর্য যে তাঁর মতো এত বড় ধর্মগুরুকে নাস্তিক উপাধি পেতে হয়েছিল। কেন তা হয়েছিল তার প্রেক্ষাপট জানাও সম্ভব নয় এত শত বছর পর।

১২ বছর বয়সে ৫ম শতকে বিহার অঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ে আচার্য বোধিভদ্র তাঁকে শ্রমণ রূপে দীক্ষা দেন এবং তখন থেকে তাঁর নাম হয় দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান।
This distinctive portrait of Atiśa originated from a Kadam monastery in Tibet and was gifted to the Metropolitan Museum of Art, New York in 1933 by The Kronos Collections. In this graphic depiction, Atiśa holds a long, thin palm-leaf manuscript with his left hand, which probably symbolizes one of the many important texts he wrote, and he makes the gesture of teaching with his right hand



তাঁর তিব্বত যাত্রা নিয়ে ছোট একটা অংশ পড়া যাক আনন্দবাজারের গৌতম চক্রবর্তীর বরাতে-

"১০৪০ খ্রিস্টাব্দের এক সকালে নাগসো, ভূমিসিংহ, ক্ষিতিগর্ভ প্রমুখ ১৯ জন শিষ্যকে নিয়ে বিক্রমশীল মহাবিহার রওনা থেকে রওনা হলেন মহাপণ্ডিত। সঙ্গে রয়েছেন আর এক শিষ্য বীর্যচন্দ্র। তিনি দীপঙ্করেরই ছোট ভাই। সংসারাশ্রমে তাঁর নাম ছিল শ্রীগর্ভ। আর দীপঙ্করের নাম ছিল চন্দ্রগর্ভ। মহাবিহার থেকে বেরিয়ে দীপঙ্কর ও তাঁর সঙ্গীরা গেলেন বুদ্ধগয়া। বোধিবৃক্ষের কাছে প্রার্থনা জানিয়ে রওনা হলেন তাঁরা। সেখান থেকে আজকের চম্পারণ, রক্সৌল হয়ে নেপালের দিকে। নেপাল সীমান্তের কাছে ছোট্ট মিত্রবিহার। সেখানে কয়েক জন বৌদ্ধ ভিক্ষু থাকেন। মিত্রবিহার থেকে ক্রমশ এগিয়ে চলা। মাঝপথে স্বয়ম্ভূনাথের রাজা তাঁর সেনাধ্যক্ষকে পাঠালেন এই দলটিকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য।

স্বয়ম্ভূনাথ থেকে পালপা। জ্বরে দীপঙ্করের সঙ্গী বীর্যসিংহর গা পুড়ে যাচ্ছে। কিন্তু এ রাজ্যে অদ্ভুত নিয়ম। পথে বীর্যসিংহের মৃত্যু হলে তাঁর সম্পত্তি যাবে সরাইখানার মালিকের হাতে। বীর্যসিংহ মারা গেলেন এক নদীর ধারে। রাতের অন্ধকারে তাঁকে দাহ করে, তাঁর ডুলিতে পোশাকআশাক সাজিয়ে চলল দলটি। দেখলে মনে হবে, বীর্যসিংহ বসে আছেন। পালপাতে সাদর আতিথ্য জানালেন রাজা অনন্তকীর্তি। নিজের 'দৃষ্ট ওষধি' নামের হাতিটি তাঁকে দান করলেন দীপঙ্কর। ওই হাতির পিঠে চেপেই বোধগয়ার বজ্রাসনীয় মহাবিহার থেকে তিনি এসেছেন এ রাজ্যে। অনন্তকীর্তিকে দিয়ে শুধু শপথ করিয়ে নিলেন, এ হাতিটিকে কখনও যুদ্ধের কাজে লাগানো যাবে না। অনন্তকীর্তি গুরুপদে বরণ করে নিলেন মহাপণ্ডিতকে। দীপঙ্করের নির্দেশেই 'থাম' অঞ্চলে তৈরি করালেন এক বৌদ্ধবিহার।

সেই 'থাম'ই আজকের থামেল। ডিস্কোথেক, ঝাঁ-চকচকে হোটেলে সজ্জিত কাঠমাণ্ডুর রঙিন এলাকা। পালপা জায়গাটা পোখরার অনতিদূরে তানসেন অঞ্চলে।

কিন্তু পালপায় এখনও শেষ হয়নি তাঁর কাজ। আর কয়েক দিন বাদে গৌড়বঙ্গের সিংহাসনে অভিষিক্ত হবেন তাঁর স্নেহধন্য ন্যায়পাল। এখান থেকেই পালবংশের নতুন রাজাকে চিঠি লিখলেন দীপঙ্কর, "রাজসিংহাসনে বসেও নম্র এবং বিনীত হবে।"

পালপা ছেড়ে এক দিন বেরিয়ে এলেন ভিক্ষু। এ বার আরও উত্তরে মুক্তিনাথের রাস্তা। সেই রাস্তা বেয়ে মানস সরোবর। সাত রাত সেখানে থাকলেন দীপঙ্কর। মানস সরোবরের পাশ দিয়ে নারি রাজ্যে যাওয়ার পথ। ঘোড়ায় চড়ে চলেছেন বৃদ্ধ ভিক্ষু, কণ্ঠে ধ্বনিত হচ্ছে 'অতি ভাল। অতি মঙ্গল।' নারি আজ আর নেই। কিন্তু মানস সরোবরের পাশ দিয়ে যদি চিনের উইগুর অঞ্চলের কিছু আগে আসা যায়, 'গু জে' ধ্বংসাবশেষ। ওখানেই ছিল নারি রাজ্য। আজও সেখানে আছে থোলিং মহাবিহার। তিব্বতে প্রথম তিন বছর দীপঙ্কর সেখানেই ছিলেন।
"


৩.
শরতচন্দ্র দাশের খনন এখনো শেষ হয়নি আমার। তিব্বত অভিযানের ঔপনিবেশিক কুটনীতির সাথে মহাদেশীয় ভূরাজনৈতিক তত্ত্ব বোঝার চেষ্টাও অব্যাহত। মাঝপথে একটু অতীশ দীপঙ্কর ভ্রমণ হয়ে গেল। পড়তে পড়তে লাইনচ্যুত হয়ে পড়া পুরোনো অভ্যেস। বদভ্যাস হলেও তাতে নতুন কিছু আবিষ্কারের আনন্দ আছে। সেই কারণে হাওয়া বদলকে নিরুৎসাহিত করা হয়  না।

Monday, November 28, 2016

বাংলাদেশ কেন হজম হয়ে যায়নি

যোগ্য এবং শক্তিশালী নেতৃত্বের অভাবে আস্ত একটা দেশ, জাতি, রাষ্ট্র, তার অস্তিত্ব হারিয়ে আরেকটা দেশের পেটের মধ্যে হজম হয়ে যেতে পারে। বড় মাছ যেভাবে ছোট মাছকে গিলে ফেলে, একটা দেশ তেমনি আরেকটা দেশকে গিলে খেতে পারে। আমাদের নিকটতম প্রতিবেশী উদাহরণ আরাকান বার্মার পেটে, সিকিম ভারতের পেটে, তিব্বত চীনের পেটে হজম হয়ে গেছে।

বাংলাদেশও কারো না কারো পেটে হজম হয়ে যেতো যদি শেখ মুজিবের জন্ম না হতো। যারা মনে করেন যে 'কেউ একজন' থাকলেই দেশ এগিয়ে যায়, তাদের বুঝতে হবে 'যে কেউ একজন' জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করতে পারে না। জাতিকে ঐক্যবদ্ধ রাখার ক্যারিশমা, সেই ব্যক্তিত্ব, সেই বিচক্ষণতা- গাছেও ধরে না, বাজারেও কিনতে পাওয়া যায় না।

বর্তমানে চলমান রোহিঙ্গা সমস্যার দিকে তাকিয়ে পুরোনো উপলব্ধিটা নতুন করে অনুভব করলাম। একসময় আরাকানও একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র ছিল। এতটাই শক্তিশালী ছিল যে মহামতি মোগল সম্রাটদের একশো বছরের বেশী লেগেছে আরাকানকে সরিয়ে চট্টগ্রাম দখল করতে। সেই শক্তিশালী রাষ্ট্র আরাকান এখন মধ্যযুগের ইতিহাসের একটি অংশ মাত্র। সুতরাং 'নিজে যুদ্ধ না করে' স্বাধীন একটি রাষ্ট্রের জন্ম দেয়া শেখ মুজিবের প্রতি কৃতজ্ঞ হয়েই থাকতে হবে আমাদের।

[হজম হয়ে যাওয়া প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলির ইতিহাস পড়তে পড়তে চেনা উপলব্ধি নাড়া দিচ্ছে আবারো]