১.
সোজা পথগুলো রূদ্ধ। বাঁকা পথেই রওনা দিল সে।
সবচেয়ে সোজা ছিল সল্টগোলা বারিকবিল্ডিং হয়ে আগ্রাবাদ পেরিয়ে টাইগার পাস লালখান বাজার। এটা হবে না, বারিকবিল্ডিং থেকে আগ্রাবাদ হয়ে দেওয়ানহাট পর্যন্ত দাউ দাউ জ্বলছে।
দ্বিতীয় বিকল্প পোর্টকানেকটিং রোড হয়ে আগ্রাবাদ এক্সেস রোড দিয়ে বাদামতলি মোড় পেরিয়ে সোজা উত্তরে। তাতেও জ্বলছে আগুন আগ্রাবাদ এক্সেস রোডে।
তৃতীয় বিকল্প নয়াবাজার দিয়ে ঈদগাহ ঢাকা ট্রাংকরোড দিয়ে পাহাড়তলীর জিলিপির প্যাচ পেরিয়ে আমবাগান হয়ে টাইগারপাস।
তৃতীয় পথটা যথেষ্ট বাঁকা তবু তাতেই রওনা দিল সে। আর কোন পথ নেই। কিন্তু তৃতীয় পথে এসেও আমবাগানে থেমে যেতে হলো। আর যাবে না গাড়ি। সামনে প্রচণ্ড জ্যাম, তারও সামনে গণ্ডগোল। আশ্চর্য হলো সে, পুরো শহরটাই কি নারকীয় তাণ্ডবের আওতায় চলে আসলো?
আমবাগান নেমে, একে খান পাহাড়ের গলিতে ঢুকে পড়লো সে। এই রাস্তাটা নিরাপদ, এটা নিশ্চয়ই গন্তব্যের কাছাকাছি পৌঁছে দেবে।
অনিশ্চয়তায় ভর দিয়ে নতুন এই পথে হাঁটতে থাকে। এই রাস্তায় পৃথিবীর সকল নির্জনতা যেন লুকিয়ে আছে। পাহাড়ের উপর উঠতে উঠতে দেড় শতক পুরোনো স্থাপনা বাড়ি ইত্যাদি দেখতে দেখতে শহরের বিদ্যমান তাণ্ডব খানিক সময়ের জন্য ভুলে থাকতে পেরে স্বস্তি পেল সে।
ঘন্টাখানেক হাঁটার পর সে যে রাস্তায় উঠলো সেটা পরিচিত। বাঘঘোনা হয়ে গলিপথ পেরিয়ে যখন ওয়াসার মোড়ে পৌঁছুলো তখন সামনে অনেক লোকের ভিড়। সব ভিড় রাস্তার পশ্চিম দিকে। পূর্বদিক সুনসান নির্জন। অথচ তাকে যেতে হবে পূর্বদিকেই।
রাস্তা জনশূন্য,যানবাহনশূন্য। এমনকি রিকশাও চলছে না। ফুটপাতেও কেউ হাঁটছে না। জমিয়তুল ফালাহ মসজিদের পাশের এই রাস্তায় কখনো এত নির্জনতা দেখেনি সে। রাস্তাটা পেরুতে হলে এই নির্জনতা পেরুতে হবে। মাঝখানে একদল দাঙ্গা পুলিশ। না, দুই দল। একদল মার্চ করছে বন্দুক হাতে। অন্যদল হেলমেট পরে বিক্ষিপ্ত ধমক দিচ্ছে লোকজনকে। ওই পথটুকু তাকে পেরুতেই হবে।
ওয়াসা থেকে আলমাস। মাত্র কয়েকশো গজ। একটা দৌড় লাগালে পৌঁছে যাবে সে। কিন্তু দৌড় লাগালে পেছনে গুলি ছুটে আসবে নিশ্চিত। আবার কাপুরুষের মতো এখানে দাঁড়িয়ে থাকাও পছন্দ হলো না তার। একটু ভেবে মার্চ করতে থাকা পুলিশের পেছনে সেও মার্চ করতে শুরু করলো। সামান্য যাবার পর রাস্তার ঠিক মাঝখানে একটা গাড়ির ঝলসে যাওয়া কংকাল। ঘন্টাখানেক আগেও এটা একটা চকচকে কার ছিল, তবে টয়োটা নাকি নিশান বোঝা গেল না। পুড়ে কয়লা। আরোহী বেঁচেছে কি পুড়েছে জানে না সে। না বাঁচলে অবাক হবার কিছু নেই।
আচ্ছন্নের মতো পুলিশ দলের পেছনে পেছনে হাঁটতে লাগলো সে। সামনে কি আছে জানে না। পুলিশের সামনে দৌড় দেয়া অপরাধ হলেও পেছন পেছন অনুসরণ করা অপরাধ কিনা জানে না সে। পুলিশ ঘুরছে ডানদিকে ভিআইপি টাওয়ারের দিকে। সে কোনদিকে যাবে?
তখনি কোথা থেকে ১৩/১৪ বছরের একটা ছেলে পাশ দিয়ে ছুটে যেতে যেতে তাকে বললো, 'ওদিকে একটু আগে দুজন রিকশা আরোহী গুলিতে মারা গেছে। একটা বাচ্চা আর তার মা। মিছিল থেকে গুলি চালিয়েছে। ওদিকে যাবেন না'। ছেলেটার কথা শুনে চমকে গিয়েও সামলে নিল। কোন এক মা মেয়ে মারা গেছে। কিন্তু তাকে মরা চলবে না। জীবিত ফিরতে হবে বাসায় অপেক্ষায় থাকা আরো দুজন মা মেয়ের কাছে। ঝাপসা চোখ সামলে সে বাঁয়ে ঘুরলো। ব্যাটারি গলি দিয়ে ঢুকতে পারলে চিন্তা নাই।
ব্যাটারী গলি দিয়ে ঘুরার সময় দেখতে পেলো চট্টেশ্বরী মোড়েও ধোঁয়া, তখনো পুড়ছে। হাতে কালচে লোহার রড হাতে একদল লোক ব্যারিকেড দিয়ে রেখেছে। চোখ ফেরাতে না ফেরাতেই দুয়েকজন লোহার রড উঁচু করে ইশারা করতেই আকাশবাতাস কাঁপিয়ে গুড়ুম করে উঠলো। ওগুলো রড নয় রাইফেল। গুলির লক্ষ্য সে নয়, পুলিশ। তবু অবুঝ বুলেট না বুঝে ঢুকে যাবে বুকের খাঁচায়। ছুটছে সবাই, ছুটলো সেও। এক ছুটে ব্যাটারি গলিতে ঢুকে গেল। বুকের ভেতর তখনো ধড়ফড়, মাত্র বেঁচে যাওয়া হৃদপিণ্ডটা।
আরো বেশ কিছুদূর হেঁটে, নানান গলি ঘুপচি পেরিয়ে যখন সে বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছালো সেখানেও সুনসান নীরবতা। এই রাস্তা কখনো জনশূন্য দেখেনি সে। কলাপসিবল গেট খুলে সিঁড়ি ভেঙ্গে বাসায় পৌঁছে হাঁপাতে হাপাতে কলিংবেল। দরোজা খুললো উদ্বিগ্ন চেহারার পারমিতা। জিজ্ঞেস করলো, কি হয়েছে বাংলাদেশের? সে কোন উত্তর খুঁজে না পেয়ে চুপ করে থাকলো। ভাবছে কোনদিকে যাবে সে? গতবার যাদের ভোট দিয়ে জেতাতে পারেনি, এবার তাদের ভোট না দিয়েও কি হারাতে পারবে? এতদিন পর নিজের উপর ঘেন্না হচ্ছে তার।
২.
সোজা পথেই রওনা দিল আরেকজন। যুদ্ধের প্রথম ধাক্কা শেষ হবার পর পথঘাট পরিষ্কার। দুই পক্ষই সরে গেছে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে। সন্ধ্যার আলো জ্বলতে শুরু করেছে রাস্তার দুপাশের দোকানগুলোতে। কোন মোড়েই ট্রাফিক নেই। জ্যামও নেই। গাড়িতে চোখ বুজে আসলো আরামে। শোনা যাচ্ছিল শহরে খুব যুদ্ধ হয়েছে, দাঙ্গা লেগেছে। কোথাও তার কোন চিহ্ন নেই। আজব দুনিয়া। এত গুজব রটায় মানুষ!
চিটাগং ক্লাব পেরিয়ে এল গাড়ি। সার্কিট হাউসটা পেরোলেই পৌঁছে যাবে গন্তব্যে। গাড়িটা থেমে গেল সার্কিট হাউসের সামনেই। পুলিশের ব্যারিকেড এখানে। শত শত সবুজ পুলিশ। ড্রাইভার বললো, আর যাওয়া যাবে না।
নেমে গেল সে। পায়ে হেঁটে বাকী পথ যেতে কোন সমস্যাই না। কিন্তু সান্ধ্যকালীন প্রচণ্ড ভীড় সমৃদ্ধ কাজির দেউড়ির মোড়ে আজ একটা গাড়িও নেই, একজন মানুষও হাঁটছে না। সব দোকান বন্ধ। সব রাস্তা অন্ধকার। মাত্র সন্ধ্যা নেমেছে, কিন্তু যেন গভীর রাত।
সে কিছুই বুঝতে পারলো না। আশংকার মেঘ দানা বাঁধছে। ডানে, বামে, সামনে পেছনে সবখানে চকচকে হেলমেটের পুলিশ। একটা পোড়ানো জ্বীপ ঘিরে কয়েকজন দাঁড়িয়ে। সাইরেন বাজিয়ে হঠাৎ একটা পুলিশের অ্যাম্বুলেন্স। সে দ্রুত পেরিয়ে গেল মোড়। তারপর বাজার পেরুলো। পেছনে তাকাচ্ছে না।
কোথাও মানুষ নেই এই রাস্তায়। সে একা হাঁটছে আবছা অন্ধকারে। কিছু একটা ঘটেছে অথবা ঘটবে। খেয়াল করে দেখলো, সবগুলো বন্ধ দোকানের ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে আছে একাধিক চোখ। ফিসফিস করছে নিজেদের মধ্যে। এক বুড়ো দারোয়ান ফিসফিস করে বললো, জোরসে হাঁটেন। কোথাও ঢুকে পড়েন। ওই ওরা সোজা ওদিকে গেছে।
কারা? শিবিরের ছেলেরা। মানে তার সামনের দিকে শিবির। পেছনে পুলিশ। দুই পক্ষের হাতের অগ্নিবর্ষক নল। নিশ্চয়ই অগ্নিবর্ষক নলই ক্ষমতার উৎস। সে কোন শব্দ না শুনেই ঢুকে পড়লো বাড়ির গেটের ভেতর।
ওখানে তাকে ঢুকিয়ে যারা গেট বন্ধ করে দিল তারা জানালো - এই কিছুক্ষণ আগেই গোলাগুলিতে মারা গেছে দুজন।
একটি মন্তব্যঃ
এই একজন, অথবা দুজন অথবা এরকম কয়েকজন অথবা আরো কয়েক লক্ষ বা কোটি মানুষ এই দৃশ্যপট কিংবা এর চেয়ে অনেকগুন ভয়াবহ দৃশ্যপট অতিক্রম করছে। তবু আপনি বলছেন - গণতন্ত্রের দোহাই, জনস্বার্থে এটা তেমন বড় কোন ক্ষতি নয়। গণতন্ত্রের স্বার্থে এদের পোড়া কংকাল প্রকল্পে আত্মত্যাগ করুন। দেশকে ভালোবাসুন এবং যারা বাসে না, তাদের সহ্য করুন।