Wednesday, March 21, 2018

তাঁরা দুজন, আমাদের জন্য দাঁড়িয়ে ছিলেন

যে মানুষটি চিরকাল বিলাসী জীবনযাপন করে গেছে, সে মানুষটি যখন চরম আর্থিক দুর্দশায় পতিত হয় তখন তার জন্য করুণা ছাড়া আর কিছুই আসে না। হ্যাঁ ভদ্রলোক তখন সমাজের করুণারই পাত্র ছিলেন। সুখের পায়ারা সব উড়ে উড়ে দূরে সরে গেছে, অচেনা হয়ে গেছে। তিনি তাঁর সঞ্চয়ের সিংহভাগ দিয়ে ছোটখাট একটি একতলা টিনশেড বাড়ি তৈরী করেছিলেন পরিবারকে শহরে রেখে ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা করাবার জন্য। তিনি ও তাঁর স্ত্রী দুজনেই এ ব্যাপারে স্থির প্রতিজ্ঞ ছিলেন। বাসস্থান না হয় হলো, কিন্তু পরিবারের অন্ন বস্ত্র শিক্ষা চিকিৎসা এবং অন্যন্য নাগরিক ব্যয় মেটানোর উপায় কী? তাঁর এক পুত্র চার কন্যা। সবাই পড়াশোনা করছে স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় অবধি। কনিষ্ঠ সন্তান তখনো স্কুলে ভর্তি হয়নি। বাড়ি করার ফলে সাত জনের পরিবারের ঠাঁই মিললেও খাই মেটাবার প্রয়োজনটাও অনেক গুরুতর।

অতএব ভদ্রলোক অবশিষ্ট সঞ্চয় নিয়ে ব্যবসায় নামলেন। কিন্তু সারাজীবন চাকরী করে এসে ব্যবসায় হাত দিলে যা হবার কথা তাই হলো, তিনি যে ডাল ধরেন সেটাই ভেঙ্গে পড়ে। ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে যখন সব শেষ- তখন তাঁকে ধারকর্জ শুরু করতে হয়, গ্রামের জমিজমা, পরিবারের সোনাদানা বিক্রি শুরু করতে হয়। এমন অবস্থায় আত্মীয় স্বজনদের কেউ কেউ পরামর্শ দিল গ্রামে চলে যেতে, ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা বন্ধ করে কাজেকর্মে লাগিয়ে দিতে। এমন টানাটানি সংসারে পড়াশোনা করে কী হবে। ছেলেটা ইন্টার পাশ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার বিলাসীতা করছে কেন? তাকে এমএ পাশ করতে হবে কেন? কোথাও একটা কাজকর্ম করে বাপকে আর্থিকভাবে সাহায্য করলেই পারে।

এটা খুবই যৌক্তিক এবং বাস্তব কথা। একজন অফারও নিয়ে আসলো একটা পেট্রোল পাম্পের ক্যাশিয়ারের চাকরী, ১২০০ টাকা বেতন।

নিরুপায় ভদ্রলোক এই প্রস্তাবে প্রায় নিমরাজী হয়ে গেলেও রুখে দাঁড়ালেন ভদ্রলোকের স্ত্রী। তিনি কিছুতেই ছেলেকে এখন চাকরী করতে দেবেন না। পড়াশোনা শেষ করতে হবে। উপোষ করে হলেও তিনি পড়াশোনা করাবেন ছেলেমেয়েদের। হ্যাঁ শুধু ছেলে নয়, চার কন্যার সবাইকে তিনি পড়াবেন। একটা রীতিমত পাগলামী। এমন পাগলামীতে কেউ সায় দেয় না। আত্মীয় স্বজন দূর থেকে করুণার দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে অপেক্ষা করছে কখন এদের চুড়ান্ত পতন ঘটবে। পতনটা নিশ্চিত, শুধু সময়ের অপেক্ষা।

৩০ বছর পর।

পেছনে তাকিয়ে পরিবারের জ্যৈষ্ঠ সন্তানটি অবাক হয়, শিউরে ওঠে। কী ভয়াবহ দিন পার হয়ে এখানে এসেছে! কিসের জোর, কার মনোবল, কার আত্মবিশ্বাস, কেমন অপরিনামদর্শীতা? যদি এমন না হয়ে সত্যি সত্যি বিপর্যয় ঘটতো?

বিশ বছর আগে প্রয়াত ভদ্রলোক তাঁর সন্তানদের সাফল্য দেখে যেতে পারেননি। তিনি কী এখন ওই পার থেকে দেখে দেখে আনন্দিত হচ্ছেন? যে কনিষ্ঠ সন্তানকে তিনি অনিশ্চিত জীবনে ক্লাস থ্রিতে রেখে চলে গিয়েছিলেন সে এখন দেশের একটা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, উচ্চতর ডিগ্রী আনার জন্য ইউরোপ গেছে। বাকী সন্তানেরাও সবাই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে নিজ নিজ ক্ষেত্রে। এই সব কী তিনি কখনো স্বপ্নেও ভেবেছিলেন?

তাঁর সন্তানেরা এখন সব সুসময়ে বাবার জন্য আকুল হয়ে কাঁদে। কেন বাবা এসব দেখে যেতে পারলো না। আরেকটু পরে গেলে কী এমন অসুবিধা হতো? [পাঠকের ধারণা হবে না, এই লাইনটি লিখতে লেখকের চোখ দিয়ে টপটপ করে জল গড়িয়েছিল]

তবু শান্ত্বনা। তাদের মা আছে এখনো। মা সবকিছু দেখেছে। যে মায়ের সেদিনের দৃঢ়তায় তাদের আজকের এই সংহত অবস্থান তিনি এখনো আছেন। তাঁর সাথেই তাদের নিত্য বসবাস।

আমি একজন অকৃতজ্ঞ অযোগ্য মানুষ। যাদের কারণে জীবনে আমার এতকিছু পাওয়া হলো তাদের চিরকাল করে গেছি অবহেলা। তাদের প্রতি কখনো সুবিচার করতে পারিনি। ভালোবাসাটুকুর প্রকাশও কখনো প্রকাশ্যে ঘটাতে পারিনি। তাদের আড়ালে চুপচাপ একটা  ব্লগে লিখে রাখছি নিজেকে শান্ত্বনা দেবার মতো করে। তোমরা আমাদের জন্য যা করেছো, দিয়েছো, আমি আমার সন্তানদের তার কণামাত্রও দিতে পারবো না। সন্তান হিসেবে আমি যেমন অযোগ্য ছিলাম, পিতা হিসেবেও। আমাকে যারা ভালোবাসে তারা ভুল করেই বাসে। এই ভুলটা আমি শোধরাই না। কারণ আমি চিরকাল ভালোবাসারই কাঙাল।

যে দুজন মানুষের জন্য আমার এই লেখাটি, তাঁদের ছবিটবি দেবার দরকার আছে কিনা কিছুক্ষণ ভাবলাম। তারপর ঠিক করলাম, ছবি দিতে দ্বিধা কেন। তাঁরা কে, অন্তত ছবি দেখে জানুক। ওশিন-শিহান-সামিহা-মাতৃকা বড় হয়ে কখনো এই লেখা পড়লে জানবে দাদা-দাদী/নানা-নানী তাদের বাবা-ফুফু/মামা-খালাদের জন্য কী করেছিল।




দুজনের একসাথে তোলা এটাই সর্বশেষ ছবি। শুনে এ যুগে অনেকে অবাক হবে যে এরা দুজন এই প্রথম কক্সবাজার বেড়াতে এসেছে। একই জেলার মানুষ হয়েও(কক্সবাজার চট্টগ্রামের অধীনে ছিল একসময়) আগে কেন আসেনি? জানি না। ছেলেমেয়েদের মানুষ করতে গিয়ে নিজেদের ঘুরে বেড়ানোর শখ বিসর্জন দিয়েছিলেন হয়তো। ছবিটা ১৯৯৪ সালের ফেব্রুয়ারী মাসের।




Tuesday, March 20, 2018

প্রযুক্তির গাধা

১. প্রযুক্তির গাধা

লিখতে চেয়েছিলাম মানুষ 'প্রযুক্তির দাস'। কিন্তু লিখতে হলো 'প্রযুক্তির গাধা'। মোবাইল প্রযুক্তির দিকে তাকালে ব্যাপারটা বোঝা সহজ। যেদিন থেকে মোবাইল প্রযুক্তি চালু হলো সেদিন থেকে মানুষ বদলে যেতে শুরু করলো। বিশেষ করে স্মার্টফোনের যুগে। স্মার্টফোন আসার পর মানুষ কতটা স্মার্ট হয়েছে জানি না, কিন্তু তার দশগুন হয়েছে গাধা। স্মার্টফোনকে যদি একটা মুলো আর মানুষটিকে একটি গাধা হিসেবে কল্পনা করা যায় তাহলে দেখা যাবে গাধাটি বছর বছর নতুন নতুন মুলোর পেছনে ছুটছে। নতুন মুলোয় নতুন কিছু নেই। সেই একই খিদে মেটায়। পাঁচ বছর আগের স্মার্ট ফোনে যেসব কাজ করতাম, নতুন ফোনেও তাই করি। বাড়তি কিছুই আবিষ্কার হয়নি। তবু বাজারে নতুন মুলো আসলেই মন আইঢাই করে। গড়ে বছরে অন্ততঃ একবার মোবাইল ফোন বদলায় সামর্থ্য থাকলে। আগের ফোন কার্যকর থাকলেও।

পৃথিবীর সবচেয়ে দ্রুততম সম্প্রসারিত বাণিজ্য মোবাইল ফোন। বর্তমানে বিশ্বের ৪৭৭ কোটি মানুষের হাতে মোবাইল আছে। বাকী যে কজনের হাতে মোবাইল পৌঁছেনি তাদের বয়স নেহাত ৬ বছরের নীচে বলেই। ৬ বছরের বেশী বয়সী জনগোষ্ঠির ৯০% এর হাতে মোবাইল চলে এসেছে। এটা খুব ভালো খবর মনে হতো যদি সেই ৯০% মানুষের জন্য অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসার ব্যবস্থা থাকতো। কিন্তু তা হয়নি। আমরা স্মার্টফোনের গাধা হিসেবে থেকে গেছি। কখনো কখনো ভাতের পয়সাতেও ভাগ বসাতে দিচ্ছি মোবাইল কোম্পানীকে।


২. ফেলে দেয়া জঞ্জাল থেকে

বাতিল জিনিসের ঝুড়ি পরিষ্কার করতে গিয়ে আজ এই পুরোনো নষ্ট মোবাইলটি হাতে পড়লো আজ। মোবাইলটির বয়স আমার কনিষ্ট সন্তানের সমান। প্রায় সাড়ে আট বছর। আমি কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলাম এটার দিকে। ছবি তুলে নিলাম। এই মোবাইলের সাথে অনেক স্মৃতি জড়িত আমার। মোবাইলটি যখন প্রথম কেনা হয় তখন এটা একটি বিস্ময়কর বস্তু ছিল। তখনো স্মার্টফোনের যুগ আসেনি দেশে। আনস্মার্ট ফোনের মধ্যে এটা ছিল সবচেয়ে কার্যকরী যন্ত্র। এটা দিয়ে স্মার্টফোনের অনেক কাজ করা যেত, এমনকি টিভি দেখাও চলতো।



সেই যুগে এই মোবাইলের দাম পড়েছিল সাড়ে বারো হাজার টাকা। ছিনতাইকারীর চোখে পড়ে আবার ভয়ে পথেঘাটে মোবাইল কানে তুলতাম না। খুব যত্নে আদরের সাথে রাখতাম। এটার একটা চমৎকার খোপ ছিল, যার ভেতর মোবাইলটা রাখা যেতো। আমি এটা কেনার কদিন পরই কক্সবাজার গিয়েছিলাম। সমুদ্র সৈকতের গর্জন সাথে নিয়ে কথা বলেছিলাম প্রিয়জনের সাথে। কত ছবি ভিডিও করেছি এটা দিয়ে, সব কোথাও হারিয়ে গেছে। সময়ের সাথে সাথে নতুন নুতন মডেলের মোবাইল বাজারে আসলো। নতুন নতুন ফিচারে মনোযোগ দিতে দিতে কখন যে এটাকে বাতিল কাগজের ঝুড়িতে ফেলে দিয়েছিলাম মনেই পড়ে না। আসলে কোন কিছুই চিরকাল একই গুরুত্ব পেতে পারে না। আমাদের প্রয়োজনের খিদে মেটাতে না পারলে সে যত দামী, যত আদরের বস্তুই হোক না কেন, তাকে বাতিল না করে উপায় থাকে না।

ব্যাটারিটা ফেলে দিয়ে মোবাইলটা আমার পুত্রকে খেলনা হিসেবে ব্যবহার করতে দিলে সে খুব খুশী হলো। আমিও খুশী, কেননা আরো কিছুদিন অন্তত মোবাইলটা চোখের সামনে দেখা যাবে। পুরোনো জিনিসের প্রতি আমার কেমন একটা মায়া কাজ করে। আমার ছেলেবেলার, চল্লিশ বছর পুরোনো খেলনাও রয়ে গেছে দুয়েকটা।

মহাকাল এক্সপ্রেসের প্যাসেঞ্জার

ঠিকঠাক চললে মানুষের সভ্যতা টেনেটুনে অন্ততঃ আরো কয়েক হাজার বছর চলতে পারতো। কিন্তু বিশ শতকে মানুষের হাতে পৃথিবী ধ্বংসের মতো যন্ত্রপাতি চলে এসেছে। এখন এই সভ্যতা যদি এসব মারাণাস্ত্র ব্যবহার না করে আরো ৫০০ বছরও টিকে যায় সেটা হবে একটি বিস্ময়কর ঘটনা। হাজার বছরের মধ্যে যদি অন্য কোন লোভনীয় গ্যালাক্সি/গ্রহে পাড়ি জমাবার প্রযুক্তি এসে যায় তখন হয়তো পুরোনো এই গ্রহটি বিপদের মধ্যে পড়ে যাবে। ধনী দেশগুলো নতুন গ্যালাক্সিতে রাজ্য স্থানান্তর করে এই গ্রহটিকে পরিত্যক্ত ঘোষণা করে বস্তির মতো আগুন ধরিয়ে দিতে পারে। অবশ্য তার আগেই শিল্প দুষণে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল নরক হয়ে উঠার সম্ভাবনা। যে ভবিষ্যত আমরা দেখবো না, সেই ভবিষ্যতের এমন চিত্র আমাদের ব্যথিত করে।

কিন্তু এই কল্পনার বিপরীত ঘটনাও ঘটতে পারে। মানুষ হয়তো ক্রমশঃ সভ্য হয়ে উঠবে। যুদ্ধের বদলে ক্ষুধা আর দারিদ্র দূর করার গুরুত্ব বুঝতে শিখবে। পরিবেশ বান্ধব প্রযুক্তি সারা বিশ্বে ব্যবহৃত হবে। মানব সভ্যতা বিস্তৃত হবে আরো পাঁচ হাজার বছর। গ্রহে গ্রহে মানুষ বিচরণ করবে, গ্যালাক্সি জুড়ে মানব সমাজের শাখা প্রশাখা ছড়িয়ে পড়বে। অন্য গ্যালাক্সির সভ্যতার সাথে আমাদের সংযোগ ঘটবে। মহাবিশ্বের অজানা জ্ঞান উন্মোচিত হবে। সুদূর গ্যালাক্সির কোন গ্রহে বসে কোন পৃথিবীর বংশজাত কোন মানব একদিন দূরবীনে চোখ রেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলবে, ওই তো, ওই নীল গ্রহটিতে একদিন আমাদের পূর্বপুরুষের বসতি ছিল, ক্ষেতখামার ছিল, এখন সেখানে কে কোথায় আছে বহুকাল খবর রাখি না। গত দেড় হাজার বছর ওই গ্রহের সাথে নাকি কোন যোগাযোগ হয়নি। নতুন গ্যালাক্সিতে এসে মানুষ ভুলে গেছে আদিম পিতার কথা।

আমাদের কল্পনার দৌড় খুব সীমিত। ৫০০ কিংবা ৫০০০ বছর পর এই পৃথিবীর ভবিষ্যত কী দাঁড়াবে সেটা না জেনেই চলে যেতে হবে আমাদের।

ডায়নোসরের সভ্যতা ১৬ কোটি বছরের মতো। ৬ কোটি বছর আগে যে মহাজাগতিক দুর্ঘটনাটি তাদের ধ্বংস করেছিল তার নাম Cretaceous–Paleogene (K–Pg) extinction event । মানুষের সভ্যতাও যদি তেমন কোন আঘাতে ধ্বংস হয়ে যায় তাহলে আমাদের সব লিখিত ইতিহাসও নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। ডায়নোসর যুগের কোন লিখিত ইতিহাস পাওয়া গেলে জানা যেতো সেই মহা দুর্ঘটনার আগের সভ্যতার অগ্রগতি। ১৬ কোটি বছরে তাদের জগতে কতগুলো হিটলার চেঙ্গিস খানের জন্ম হয়েছিল। যে  উল্কার দানাটা পৃথিবীতে এসে আঘাত হেনেছিল সেই গোলাটা কী নিছক দুর্ঘটনা ছিল নাকি কোন মহাজাগতিক যুদ্ধের প্রতিক্রিয়া আমরা জানি না। অথবা সেটা কোন গ্যালাক্সির দুষ্টু বাচ্চার গুলতি থেকে এসে পড়েনি, সেটাও কেউ নিশ্চিত বলতে পারে না।

ডায়নোসর যুগ কোনো উন্নত প্রযুক্তির সভ্যতায় বিবর্তিত হয়েছিল কিনা, সেই প্রযুক্তিতে তাদের কোন বংশধর অন্য কোন গ্যালাক্সিতে পাড়ি দিয়েছিল কিনা তার কোন রেকর্ড মানুষের খতিয়ানে নেই। আমাদের বর্তমান সভ্যতায় এখনো মানুষের জ্ঞান খুব সীমিত, এখনো মানুষের দৃষ্টি অতি নগণ্য দূরত্ব অতিক্রম করেছে। গ্যালাক্সি নিয়ে গবেষণার জ্ঞান যখন চরম উৎকর্ষতায় পৌঁছাবে, তখন হয়তো এমন অনেক অদ্ভুত প্রাচীন সভ্যতার নকশা আবিষ্কৃত হবে। হয়তো ডায়নোসর যুগেও ছিল মানুষ জাতের কোন একটা প্রাণী যাদের কোন চিহ্নমাত্র নেই এখন। আমাদের জানা ইতিহাসে তেমন কিছু নেই, কেননা এযাবত যাদের ফসিল/চিহ্ন মানুষের নাগালে এসেছে তাদের নিয়েই তৈরী আমাদের জানা ইতিহাস। যাদের কোন চিহ্ন কোথাও নেই, তাদের কোন ইতিহাস নেই। হয়তো হাওয়ায় ছড়িয়ে থাকা কোটি বছর পুরোনো কোন কণিকা থেকে আবিষ্কৃত হয়ে যাবে অদ্ভুত অজানা ইতিহাস। কে জানে? এটা তো অনস্বীকার্য যে ৬ কোটি বছর আগের সেই মহাজাগতিক দুর্ঘটনায় নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া প্রাণীদের সংখ্যা আবিষ্কৃত ফসিলের কোটি কোটি গুন বেশী। ১৬ কোটি বছরে কতগুলো সভ্যতা জন্মে আবার মরে গেছে সেটা কেউ জানে না। বিস্মিত হবার কত উপাদান জমে আছে ভবিষ্যতের কোটায়। যে ভবিষ্যত প্রযুক্তি সম্পর্কে এখন আমরা কল্পনাও করতে পারি না সে ভবিষ্যত উন্মুক্ত করে দেবে বিচিত্র থেকে বিচিত্র সব প্রাগৈতিহাসিক উপাদান। বর্তমান অনতিক্রম্য দূরত্বকে করে দেবে অতি নিকট। সেই ভবিষ্যতে জন্ম নিতে না পারার আক্ষেপ থেকে এই এলোমেলো ভাবনাগুলো জন্ম নিল।



[শিরোনাম কৃতজ্ঞতা : শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের 'মহাকাল মেলের প্যাসেঞ্জার' থেকে উদ্ভুত]


Monday, March 19, 2018

প্রিয়ন্ময়ীর জন্য

প্রতিদিন একবার করে আমি তোমার জন্য কাঁদি। সেদিন থেকেই। তুমি আমাকে চেনো না। আমিও তোমাকে চিনি না। আমাদের কখনো দেখা হবে না। তবু যতদিন তোমাকে আমার মনে থাকবে ততদিন আমি কাঁদবো।

প্রথম যখন এয়ারপোর্টের গোলাপী লাগেজের পেছনে তোমার ফুটফুটে মুখটা ভেসে থাকতে দেখেছি ততক্ষণে ঘটনা ঘটে গিয়েছিল। তবু আমি শুধু প্রার্থণা করছিলাম তোমাকে যেন কেড়ে না নেয়। তোমাকে যেন ফিরিয়ে দেয়। আমি তখনো জানতাম না যা ঘটার ঘটে গেছে ইতিমধ্যে। অবোধ মানুষ আমি।

দুদিন পর জেনেছি তুমি বাবাকে জড়িয়ে ধরেই, বাবার বুকের উষ্ণতা নিতে নিতে চলে গেছো অনন্তের পথে। তোমার মা এখনো জানে না, তুমি চলে গেছো। তুমি ভয় পেয়ো না। বাবা তো আছে তোমার সাথে। প্রিয়ক তোমাকে ছাড়েনি। তোমাকে বুকে নিয়ে বাবাও গেছে তোমার সঙ্গী হয়ে।

আমি তোমার জন্য প্রতিদিন অন্তত একবার চোখ ভেজাই প্রিয়ন্ময়ী। তোমার সাথে আমার কোন জন্মান্তরেও দেখা হবে না। আমি তোমার কেউ না। তবু আমি তোমাকে অভয় দেই, নিজেকে শান্ত্বনা দেই। তুমি তোমার বাবার কাছে আছো। বাবা তোমার জন্যই তো ফিরে আসেনি। তোমাকে নিয়ে ফেরার জন্য বিমানের ফাঁক গলে বের হয়ে যায়নি।

প্রিয়ন্ময়ী, আমাদের কখনো দেখা হবে না। তুমি আমার কেউ না। কিন্তু আমার বুকে তোমার জন্য একটা দাগ থেকে যাবে জেনো। একটা অচেনা কষ্ট।

আমি এখন নিয়তি নামের কুৎসিত ব্যাপারটাকে ঘেন্না করি।
তিন বছরের ওই নির্মল শিশুটি নিয়তির এমন কী চক্ষুশূল হয়েছিল!!!

[নেপালের বিমান দুর্ঘটনায় হারিয়ে যাওয়া প্রতিটি মানুষের জন্য কাঁদছে অনেক মানুষ। পরিবারগুলো  কাঁদবে আরো অনেকদিন। পরিবারের বাইরেও কেউ কেউ কাঁদে, কাঁদবে]

যদি....সব পাখী ঘরে আসে, সব নদী ফুরায় এ জীবনে সব লেনদেন......

একটি সাধারণ্যে প্রায় অনুল্লেখযোগ্য ব্যক্তিগত ঘটনা। ঘটনাটি শুধু আমার একার জন্যই গুরুত্বপূর্ণ। শিশুদের মতো আমিও চকোলেট পছন্দ করি। তাই বিদেশ থেকে কেউ আমাকে কোন উপহার পাঠাবে বললে আমি শুধু চকোলেটের আবদার করি।

Delafaille নামের বিশ্বখ্যাত চকোলেটটি কখনো আমি চোখেও দেখতাম না যদি ইন্টারনেটের সাথে যুক্ত না হতাম। এই চকোলেট তৈরী হয়েছে বেলজিয়ামে। বেলজিয়াম থেকে প্যাকেটজাত হয়ে রপ্তানীর জাহাজে চড়ে পৌঁছে যায় আমেরিকার কোন বিখ্যাত শহরের সুপারস্টোরে। সেখান থেকে শপিং ব্যাগে চড়ে একটি বাড়িতে যায় ডেলাফেলি। সেই বাড়িতে আরেক দফা মোড়কে আবৃত হয়। সেই মোড়কটি একটি সুটকেসে প্রবেশ করার কয়েকদিন পর আবারো তাকে গাড়িতে চড়তে হয়। গাড়িটি এয়ারপোর্টে যাবার পর লাগেজটি এয়ারপোর্টের ব্যাগেজ সেকশানে হস্তান্তরিত হয়। তারপর তাকে মস্ত বড় একটি উড়োজাহাজের পেটের ভেতর চালান করে দেয়া হবার পর চারদিক সুনসান নীরব। দীর্ঘ যাত্রা শেষে আটলান্টিক মহাসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্য পেরিয়ে উড়োজাহাজটি নেমে আসে ঢাকা এয়ারপোর্টে। ঢাকায় নামার পর তাকে খুঁজে পাওয়া যায় না। তখনই শুরু হয় তোলপাড়। দীর্ঘ দেড় সপ্তাহের তোলপাড় শেষে যখন তাকে পাওয়া যায় তখনো সে অক্ষত। অবশেষে গন্তব্যে পৌঁছে হাঁপ ছেড়ে বাঁচে।

কিন্তু তখনো তার যাত্রা বাকী ছিল। আরো দুইশো মাইল পাড়ি দিতে হয় একটি মালবাহী গাড়িতে। তারপর তাকে নেবার জন্য উপস্থিত হয় কাংখিত ব্যক্তিটি। তার হাত ধরে একটি বিশেষ দিবসে সে আমার হাতে এসে পৌঁছায়। আমি এত সুন্দর মোড়কের চকোলেট কখনো চোখেও দেখিনি, খাওয়া তো দূরে থাক। আমি চকেলেটের দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকি। তারপর যত্ন করে ফ্রিজের ঠাণ্ডা কেবিনেটে রেখে দেই। এমন চমৎকার রূপোলী ফিতা ছিড়ে চকোলেটের বাক্সটি বের করতে ইচ্ছে করছিল না। থাকুক আরো কিছুকাল। এই সুন্দর অক্ষয় থাকুক, তারপর শীত কেটে যখন বসন্তের হাওয়া দিতে শুরু করলো, তখন আমি তাকে বের করে হাতে নিলাম। ডেলাফেলির সাথে আমার সাক্ষাতটা প্রত্যাশিত ছিল, কিন্তু এতটা আনন্দদায়ক তা বুঝিনি আগে।

আমি বারবার তাই প্রযুক্তি, ইন্টারনেট এসবের কাছে কৃতজ্ঞ হই। আমাকে জীবনে নতুন নতুন আনন্দের সাথে যুক্ত করেছে প্রযুক্তির ব্যবহার। আমি যে কটি বছর সুখী নিরুপদ্রপ যাপন করতে পেরেছিলাম, সে বছরগুলো আমার জীবনে এসেছিল প্রযুক্তির কারণেই। একটা মানুষ ৬০ বছর আয়ুর মধ্যে যদি ১০ বছরও সুখী থাকে, সেটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। বিদেশ থেকে চকোলেট উড়ে আসার মতো ঘটনা সব মানুষের জীবনে ঘটে না এই দরিদ্র দেশে। বিশেষ দিনে তো নয়ই। তাই ঘটনাটি বিশেষ গুরুত্ব পেয়ে গেল এক অভাজনের কাছে।

তাই যদি কখনো সব পাখি ঘরে নাও আসে, সব নদী এ জীবনের সব লেনদেন নাও চুকায়, তবু বাকী অন্ধকার একদিন এসে উপস্থিত হতেও পারে।

Wednesday, March 14, 2018

বাঙালীর উত্তমকাণ্ড

১.
হিয়া নামের ২ বছরের যে অবোধ শিশুটি নেপালের বিমান দুর্ঘটনায় মাকে হারিয়েছে গতকাল, সে বড় হয়ে জানবে তার মায়ের মৃত্যুর কয়েক ঘন্টার মধ্যে তাকে দখলে নেবার জন্য মামলায় জড়িয়ে পড়েছিল তার জীবিত স্বজনেরা। শিশুটির নিহত মা নাবিলা ইউ এস বাংলায় চাকরী করতেন। ব্র্যাভো বাঙালী।

২.
তিন বছর বয়সী আরেক শিশু আকাশে ওড়ার শখ করেছিল বিমানে করে।  বিধাতা সে শখ পূরণ করার ব্যবস্থাটি রেখেছিলেন অদ্ভুতভাবে। শিশুটি আকাশে উড়বে ঠিক আছে, কিন্তু আকাশ থেকে প্রাণ নিয়ে নামতে পারবে না বলে ঠিক করা ছিল। আকাশ তোমাকে চায়নি বাবু!

৩.
চার বছর প্রেম করার পর বিয়ে করার সাতদিনের মধ্যে নেপালে হানিমুনে যাচ্ছিল আগ্রাবাদ সিডিএর ইলা আপার ছেলে ফয়সাল। বিমানের ধ্বংসাবশেষ থেকে আবিষ্কৃত হলো নতুন বউয়ের মেহেদী লাগানো হাতের দুটি আঙুল তখনো ধরে রেখেছিল ফয়সাল। হাত ছাড়েনি আগুন মরণেও!

৪.
ক্যাপ্টেন আবিদ সুলতান যে বিমানটি তিন বছর আগে কানাডা থেকে উড়িয়ে এনে ইউএস বাংলায় যুক্ত করেছিলেন, সে বিমানটির শেষকৃত্যটিও তিনি নিজ হাতেই করলেন কাঠমুণ্ডু এয়ারপোর্টে। এবং নিজের জীবন দিয়েই। আপনি পদত্যাগ করেও বাঁচতে পারলেন না অব্যবস্থাপনার হাত থেকে।

৫.
কো-পাইলট পৃথুলা রশীদ এ দুর্ঘটনায় নিজের প্রাণ দিয়েও রেহাই পায়নি বর্বরতম মানসিকতার ইতর বাঙালীর নোংরা জিব থেকে। এদেরকে শুয়োরের বাচ্চা বলে গালি দিলে শুয়োরও লজ্জিত হবে। এই কুলাঙ্গার জাতিটা ফেসবুকের বাইরে কত শতাংশ?

৬.
নেপালে বিমান দুর্ঘটনার কাছাকাছি সময়ে মীরপুর বস্তিতে আগুন লাগিয়ে ৫০০০ পরিবারকে নিঃস্ব করে দেয়া হলো এক রাতের মধ্যেই। তাদের জন্য আমি মর্মাহত হলেও আমার চোখে জল আসেনি। আমার চোখে জল এসেছে নেপালের ঘটনায় নিহত ৫০ জনের জন্য। ইতরের মতো আমিও অজুহাত দিলাম মানুষ তো বরাবরই শ্রেণীস্বার্থপর প্রাণী ছিল হে! 

অতএব তুমি উত্তম বলে আমি বিপুল পরিমান ঈর্ষাবোধ করতে পারলেও আমি অধম বলে সামান্য লজ্জাবোধও করি না।

Sunday, March 11, 2018

ওপার বাংলা, এপার বাংলা

বাংলা ভাষার পাঠকমাত্রেই একটা বিষয়ে একমত হবেন যে অন্তত বইপত্র বিষয়ে রাজনৈতিক মানচিত্র অকার্যকর। অর্থাৎ আমরা যখন বই কিনি, তখন আমাদের মাথায় কখনো কাজ করে না বইটি এপার বাংলা নাকি ওপার বাংলার। আমাদের বুকশেলফে উভয়বাংলার বই একই আদরে সাজানো থাকে। এই বিষয়টি খুব চমৎকার লাগে আমার। এই কারণেই বোধহয় আমি চট্টগ্রামের মানুষ হলেও সুদূর কলকাতাকে আমার ঢাকার চেয়ে খুব বেশী অনাত্মীয় মনে হয় না। কোন কোন ক্ষেত্রে আমি কলকাতার প্রতি বেশী মাত্রায় নস্টালজিক। বিশেষ করে উনিশ শতকের কথা এলে। যেন আমি কখনো এই শহরে বাস করেছিলাম। এই নস্টালজিয়ার কিছুটা তৈরী করেছে সুনীল, সমরেশের মতো সাহিত্যিকগণ। কলকাতা নিয়ে তাই আমার কিছু বাড়তি আহ্লাদ কাজ করে। এর বাইরেও বোধহয় আরো কিছু আছে।

একটা উদাহরণ দেই।

আমি ভারতে খুব বেশী জায়গায় যাইনি। কলকাতা, দিল্লী, সিমলা পর্যন্ত আমার দৌড়। সেবার সিমলা থেকে ফেরার পথে ছোটখাট একটা দুর্ঘটনা ঘটেছিল। অন্য কোনদিন লিখবো ঘটনাটি। সেই দুর্ঘটনার পর একটা অনিশ্চিত অবস্থায় দিল্লী এসে পৌঁছানোর পর হাঁপ ছেড়ে বাঁচি। মনে হলো একটু চেনা জায়গায় আসতে পেরেছি। কিন্তু দিল্লী থেকে রাজধানী এক্সপ্রেসে যখন শিয়ালদার প্ল্যাটফর্মে পা রাখলাম, তখন পূর্বেকার সব ধকল নিমেষে মুছে গিয়ে মনে হলো আমি নিজের শহরে ফিরলাম। তখনই আমার বুকে একটা বিশাল স্বস্তিদায়ক আত্মবিশ্বাস জাগলো যে এখানে আমি স্বাধীন।

আসলে এই স্বাধীনতা হলো ভাষার। বাংলা ভাষায় প্রাণ খুলে কথা বলার স্বাধীনতা। যেটার অভাবে দিল্লী, সিমলায় আমার প্রাণ আইঢাই করছিল। আমার আর কলকাতার মাতৃভাষা এক। সুতরাং আমার নস্টালজিয়াতে কলকাতার একটা অবস্থান থাকেই।

আরো একটা কারণে এই নস্টালজিয়া আসতে পারে- সেটা জিনগত। আমাদের পূর্বপুরুষের কেউ কেউ কলকাতায় এসে পড়াশোনা করেছেন, চাকরীবাকরী করেছেন। দেশভাগের পর যা এফোড় ওফোড় হয়ে যায়। যে কারণে দেশভাগ নিয়ে যে কোন পুস্তক আমাদের বুকেও সমান ঘা দিয়ে যায়। যে কারণে ঋত্বিক ঘটকের চলচ্চিত্রের বেদনা আমাদের বেশী আলোড়িত করে। যে কারণে দেবেশ রায়ের 'বিষাদবৃক্ষ' আমাদের খুব নাড়া দেয়। অসীম রায়ের 'আবহমান' পড়ে আমরা উনিশ শতকে ফিরে যাই। কিংবা তপন রায় চৌধুরীর 'বাঙালনামা' পড়ে মনে হয় এই তো তিনি আমার পাশের বাড়িতেই ছিলেন সেদিন।

এমন বইপত্রের গ্রুপেও যখন দুই বাংলার মানুষদের একই সাথে মেতে উঠতে দেখি তখন আমার মনে পড়ে যায়- রাজনৈতিকভাবে দেশ দুটো আলাদা হলেও বইয়ের মানচিত্রে আমাদের একটা সার্বজনীন একতা আছে। বাংলা ভাষার বই ভূগোলে আমাদের যে ঐক্য, সেই ঐক্যটা একটা তানপুরার মতো। সে তানপুরার সুর আমার বড় প্রিয়। কলকাতা না গিয়েও আমি সে সুর পাই বাড়ির কাছের 'বাতিঘর' থেকে। তবু প্রাচীন বৃক্ষ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা পুরোনো কলকাতার ফুটপাতে হাঁটার লোভে আমি কিছুদিন পরপর নিজেকে শোনাই - চল, আবারো কলকাতা ঘুরে আসি কদিনের জন্য। পাসপোর্ট-ভিসা-ইমিগ্রেশন-কাঁটাতার যন্ত্রণা না থাকলে যে কোন সময় বাসে উঠে পড়তাম।

এই যে একান্ত বোধগুলো লিখলাম এটা কেবল এপার বাংলার। ওপার বাংলার মানুষের তেমন কোন বোধ কাজ করে কী? মাঝে মাঝে জানতে ইচ্ছে করে।

ফিকশন পড়ি না কেন?

আমাদের ব্যস্ত জীবনে বই পড়ার জন্য আলাদা সময়  বরাদ্দ করা কঠিন কাজ। আলাদা সময় নিয়ে আয়েশ করে চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে বইয়ের পাতা উল্টে যাবার যে কল্পনা সেটা প্রায় সোনার পাথর বাটি। সেদিন সমমনা একজনের সাথে বইপড়া নিয়ে আলাপ করতে গিয়ে প্রসঙ্গ উঠলো - ফিকশন বিষয়ে। অনেকদিন ফিকশন পড়ছি না আমরা দুজনেই। অর্থাৎ গল্প উপন্যাস থ্রিলার ইত্যাদি বিষয় কেন আজকাল আমাদের দুজনকেই টানতে পারছে না।

আমাদের দুজনেরই বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি চলে এসেছে। পড়াশোনার জন্য এই বয়সে আমাদের পছন্দ ঘুরে গেছে নন ফিকশনের দিকে। আমরা বইয়ের দোকানে গিয়ে এখন আর গল্প উপন্যাস খুঁজি না। খুঁজে খুঁজে পড়ি যতসব কাঠখোট্টা বিষয়। এর কারণ কী? বয়সের সাথে সাথে জীবন থেকে রসকষ কমে যেতে থাকে? আমার সহযাত্রী বললেন, চল্লিশ থেকে পঞ্চাশের মধ্যেকার বয়সটা ফিকশন থেকে দূরে থাকে মানুষ। আবার পঞ্চাশ থেকে ষাটের দিকে যেতে যেতে ফিকশনের প্রতি ঝোঁক বাড়ে। এটা নেহাতই একটা নিজস্ব মতামত। তবে এই সংক্ষিপ্ত আলোচনায় আমরা দুজন নিজেদের বোঝাতে চেষ্টা করলাম যে আমরা এখন যে গল্প উপন্যাস কিনে পড়ছি না সেটার জন্য দায়ী আমাদের বয়স। একটা সময় পার হবার পর আমরা আবারো গল্প উপন্যাস পড়া শুরু করবো।

কিন্তু ধারণাটি ভুল প্রমান করে গত এক সপ্তাহে তিনটি উপন্যাস পড়ে ফেলার পর ভাবতে লাগলাম, এই যে বয়সের সীমাবদ্ধতার অজুহাত দিয়ে অনেকদিন গল্প উপন্যাস পড়িনি তার  জন্য আমি কতটা ক্ষতিগ্রস্থ হলাম। লেখক/প্রকাশক কতখানি ক্ষতিগ্রস্থ হলেন?

দায়টা যারই হোক, আমাদের বই পড়ার মতিগতিকে নিয়ন্ত্রণ করার পেছনে সময় দুঃসময়ের একটা ভূমিকা থাকে। যে কারণে আমি দীর্ঘদিন পর তিনখানা উপন্যাস পড়ে উঠতে পারলাম তার প্রথম কারণ ঔপন্যাসিক শওকত আলীর প্রয়ান।

তাঁর প্রস্থানের কয়েকদিন পর এক রাতে হঠাৎ মনে পড়ে গেল কয়েক বছর আগে তাঁর 'প্রদোষে প্রাকৃতজন' আধপড়া রেখে উঠে গিয়েছিলাম কোন জরুরী কাজে। ফিরে এসে আর বসা হয়নি।

একটা নির্দোষ গ্লাণি নিয়ে 'প্রদোষে প্রাকৃতজন' বইটা আবারো নামিয়ে নিলাম। পড়া শেষ করলাম দুদিনে। বেঁচে থাকা মানুষের চেয়ে চলে যাওয়া মানুষের মূল্য বেশী আমাদের কাছে। পড়া শেষ করে আক্ষেপ হলো আরো আগে কেন পড়া হলো না বইটি।

একই সুত্রে মনে পড়লো নবারুণ ভট্টাচার্যের হারবার্টও পড়ার জন্য রেখেছিলাম বেশ কিছুকাল আগে। তারপর ওটাও নামালাম এবং শেষ করলাম। ওটা শেষ করে যখন স্তব্ধ হয়ে বসে আছি, তখন ইচ্ছে করলো একটা পাঠানুভূতি লিখে মনটা হালকা করি। কিন্তু শরীরে কেমন একটা জ্বরজ্বর বোধ করলো হঠাৎ। ল্যাপটপ খোলার বদলে কিণ্ডল খুলে আরামদায়ক কিছু পড়ার জন্য খুঁজলাম।

এরকম শারিরীক অস্বস্তিকর সময়ে ফিকশনই ভালো। কিণ্ডলে আঙুল বোলাতে বোলাতে পেয়ে গেলাম সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ'র পঞ্চাশ দশকের উপন্যাস 'আগলি এশিয়ান' এর অনুবাদ 'কদর্য এশীয়'। ইন্টারনেট থেকে বইটা নামিয়েছিলাম বছর দুই আগে। কিন্তু ফিকশন থেকে দূরে থাকার কারণে পড়া হয়ে ওঠেনি। এই ঝোঁকে টানা তৃতীয় উপন্যাস হিসেবে পড়া হয়ে গেল বইটি।

পড়া শেষে প্রথম যে প্রশ্নটি উদয় হলো, পঞ্চাশের দশকে বাংলা ভাষাকে সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহর চেয়ে আধুনিকভাবে আর কেউ উপস্থাপন করেছেন কী? আমার পড়াশোনা নিতান্তই কম, তাই প্রশ্নটির উত্তর বোদ্ধাদের জন্য মূলতবী রাখতে হলো।

কিন্তু 'আজকাল ফিকশন পড়ি না' বলেও একটানা তিনটা উপন্যাস শেষ করার কৃতিত্ব কার? সময়ের? লেখকের? নাকি পাঠকের মতিভ্রমের?

Saturday, March 10, 2018

১৭ ডিসেম্বর ১৯৭১ : পাক বাহিনীর চট্টগ্রাম আত্মসমর্পনে সমাপনী বিভ্রাট


১৭ ডিসেম্বর ভোরবেলা মেজর থাপার নেতৃত্বে ভারতীয় বাহিনী যখন শহরে প্রবেশ করছিল তখন চট্টগ্রাম শহর একদম থমথমে। পাক বাহিনীর একাংশ কক্সবাজার হয়ে বার্মা পালিয়ে যাবার চেষ্টায় ছিল বলে শোনা গিয়েছিল। তাদেরকে বাধা দেবার জন্য দোহাজারীর কাছে সাঙ্গু নদীর সেতুটা ধ্বংস করারও পরিকল্পনা গ্রহন করেছিল পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে আসা মেজর জেনারেল উবানের নেতৃত্বে একদল কমাণ্ডো। শেষমেষ পাকিস্তানীরা ওদিক দিয়ে পালায়নি এবং সেতুও ধ্বংস হয়নি। জেনারেল উবানের দল চট্টগ্রাম শহরে আসার কথা থাকলেও শেষমেষ হেডকোয়ার্টারের নির্দেশে দক্ষিণ চট্টগ্রামেই থেকে যায়। চট্টগ্রামে পাক বাহিনীর আত্মসমর্পনের দায়িত্বপ্রাপ্ত হয় ঢাকা থেকে আসা যৌথ বাহিনী। সেই সময়ে পাকিস্তানী বাহিনীর একাংশ আগ্রাবাদ হোটেলে আশ্রয় গ্রহন করেছিল। ঢাকায় যেমন হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল রেডক্রস ঘোষিত নিরপেক্ষ জোন, সরকারীভাবে ঘোষিত না হলেও চট্টগ্রামে তেমনি আগ্রাবাদ হোটেল ছিল বিদেশী নাগরিকদের আশ্রয় কেন্দ্র। রেডক্রসের বিদেশী কর্মীগনও এই হোটেল থেকেই কার্যক্রম পরিচালনা করছিলেন। তাঁরা পাক বাহিনীর আত্মসমর্পনে মধ্যস্থতার ভূমিকায় ছিলেন।

জাপানের তাদামাসা হুকিউরা রেডক্রস কর্মী। পুরো মুক্তিযুদ্ধ কালে তিনি বাংলাদেশে অবস্থান করেছিলেন। প্রধানত হাতিয়া অঞ্চলে কাজ করলেও ঢাকা চট্টগ্রামে যাতায়াত ছিল কর্মসুত্রে। ঢাকার আত্মসমর্পন পর্বে উপস্থিত ছিলেন তিনি। তারপর তিনি চট্টগ্রামের আত্মসমর্পন পর্ব প্রত্যক্ষ করার জন্য চট্টগ্রামে চলে আসেন ষোল তারিখ রাতেই।

রেডক্রস কর্মী তাসামাদা হুকিউরা ছাড়াও তখন আগ্রাবাদ হোটেলে ছিলেন পশ্চিম জার্মানীর কোখ, অস্ট্রিয়ার ইয়ানৎস এবং ফরাসী জাঁ পিয়েরে। ১৭ ডিসেম্বর সকালে পাকিস্তানী বাহিনী আত্মসমর্পনে সম্মত হয় ভারতীয় বাহিনীর কাছে। কিন্তু সেই আবেদন নাকচ করে যৌথ বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পন করতে বলা হয়। আত্মসমর্পনের জন্য নেভাল বেইস ও ক্যান্টনমেন্ট এই দুই জায়গায় জড়ো হতে বলা হয়েছিল পাক বাহিনীকে। কিন্তু বেশ কয়েকশো সৈন্য আগ্রাবাদ হোটেলে আশ্রয় নেবার সংবাদে হোটেলের চারপাশে হাজারখানেক মুক্তিযোদ্ধা অবস্থান নিয়ে ঘেরাও করে ফেলে এবং মুক্তিবাহিনী দাবী জানাতে থাকে হোটেলে অবস্থান করা পাক বাহিনীকে তাদের হাতে তুলে দিতে যাতে তারা প্রকাশ্য গণ আদালতে বিচার করতে পারে।

মুক্তিযোদ্ধাদের উত্তেজিত দেখে তাসামাদা অঘটনের আশংকা করলেন। শেষ মুহুর্তে বড় ধরনের একটা হত্যাকাণ্ড ঘটতে পারে কেননা হোটেলের ভেতর  আত্মগোপন করে পাকিস্তানীরা হুমকি দিচ্ছে তারা হোটেলের বিদেশী অতিথিদের জিম্মি করে আত্মরক্ষার চেষ্টা করবে। একই সময়ে মুক্তিবাহিনীর স্থানীয় কমাণ্ডারের সাথে রেডক্রসের আলোচনা চলছিল আত্মসমর্পনের বিষয়ে। ভারতীয় বাহিনী আসতে আরো খানিক সময় লাগবে। সেই অবকাশে পরিস্থিতির অবনতি ঘটার সম্ভাবনা আছে। তাসামাদা তাঁর সহকর্মী পিয়েরেকে শহরের কেন্দ্রস্থলে ভারতীয় বাহিনীর কাছে খবর পাঠান। পিয়েরে দ্রুততার সাথে মেজর থাপারকে নিয়ে ফিরে আসার সময় প্রায় ৩০ ট্রাক ভারতীয় সৈন্য আগ্রাবাদ হোটেলে পৌঁছে যায়।

ওদিকে ততক্ষণে সেদিন সকালেই ক্যাপ্টেন রফিকের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী চট্টগ্রাম শহরে প্রবেশ করে সার্কিট হাউস থেকে পাকিস্তানী পতাকা নামিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করে ফেলেছে।

অবশেষে কোন দুর্ঘটনা ছাড়াই ১৭ই ডিসেম্বর ১৯৭১ সকালে রেডক্রসের উপস্থিতিতে বাংলাদেশ-ভারতের যৌথবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পন করলো পাকিস্তানের তিন বাহিনী। চট্টগ্রামে সেদিন তিন বাহিনী মিলে মোট ৮৬১৮ জন পাকিস্তানী সৈন্য আত্মসমর্পন করেছিল। আগ্রাবাদ হোটেল থেকে রাজাকার ও পাকিস্তানী মিলিয়ে ৭৫১ জনকে বন্দী করা হয়। ভারতীয় সৈন্যদের চিরকাল শত্রুজ্ঞান করলেও সেদিন পাকিস্তানীরা তাদের কাছেই আশ্রয় নিতে কতোটা আকুল  হয়েছিল তার সাক্ষী রেডক্রস কর্মী তাসামাদা হুকিউরা।


[রক্ত ও কাদা : তাসামাদা হুকিউরা]

উচ্ছিন্ন উচ্চারণ : পুরোনো ডায়েরী ১৯৯৪

মাঝে মাঝে দুর কোন স্থান থেকে কে যেন আমায় ডাকে। কোন অচিন বাঁশীর সুরে সে ডাক আমার কানে বাজতে থাকে। হৃদয়ে কম্পন তোলে একটানা হাহাকার। ইচ্ছে হয় সব ছেড়েছুড়ে ছুটে যাই তার পানে। আমি জানিনা কোথা হতে এ আহবান আসে। তবু মানসচক্ষে যেন দেখতে পাই ভরা পূর্নিমার রাতে বয়ে যাওয়া সেই পাহাড়ী নদী। পার ঘেঁষে সারি সারি পাইনের সবুজ বনানী বুকে নিয়ে দাড়িয়ে আছে সুউচ্চ পাহাড় শ্রেনী। সেই অচিনপুর থেকে রাত্রির কুয়াশা ভেদ করে ভেসে আসে এক অনাবিল আহবান। এত করুন সে ডাক মাঝে মাঝে আমি সহ্য করতে পারিনা। অজানা কোন কষ্টে জ্বলতে থাকে চোখ দুটো। সে ডাক আমার নিঃসঙ্গ জীবন আরো নিঃসঙ্গতর করে তোলে। কেন আমার কাছে এমন আহবান আসে আমি বুঝি না। আর কারো এমনটি হয় কিনা জানি না। সাধারন যে কোন ডাকের চেয়ে এর শক্তি অনেকগুন বেশী। অন্তর ছিড়েখুড়ে এ ডাক বেরিয়ে যায়। আমাকে স্থির থাকতে দেয় না। আর আমিও যেন প্রতীক্ষায় থাকি সে ডাকের জন্য। কখন আসেকখন আসে। অথচ কিছুই জানিনাকোথায় সেই পাহাড়ী নদীপাইনের বন আর কুয়াশার বুক চিরে ভেসে আসা জ্যোৎস্নার বান। যখন সে ডাকটা আসে তখন সেই অচিন জায়গার পরিষ্কার একটা ছবি আমার চোখে ভেসে ওঠে। স্বপ্নের চেয়ে অনেক সুন্দর এই ছবি। নদী থেকে কিছু দুরে পাহাড়ের কোল ঘেষে দাড়িয়ে থাকা ছোট্ট একটা বাংলোর উচু বারান্দায় একটা চেয়ারে বসে আছি আমি। বাড়ীটার কোথাও আলো জ্বলছে না। পাশের জঙ্গল থেকে ভেসে আসছে কোন বুনো ফুলের গন্ধ। নিস্তব্ধ রাত। একটানা ঝিঁঝিঁ পোকা ডেকে যাচ্ছে। রূপোলী আঁচল বিছিয়ে মাথার উপর মস্ত চাঁদ। কোথাও কেউ নেই। সে আমাকে ডাকছে সেও নেই। তবু কান্নার সুরের মতো একটা অচেনা ধ্বনি ভেসে আসছে দুর পাহাড় থেকে। এসব কিছুই আমি পরিষ্কার দেখতে পাই। আর আমার বুকের ভেতর হু হু করে ওঠে। কে সেকেন এমন করে ডাকেসে কি আমার স্বপ্নের মানবী যার মুখ আমি জীবনেও দেখিনি। আমি যাবো সেখানেযাবোনাকি যাবো না। আমি নিশ্চয়ই যাবো। আমার সব কাজ শেষ করে আমি নিশ্চয়ই যাবো সেখানে। যেখানে বাঁশীতে অচেনা সুর তুলে আমাকে ডাকছে একাকী এক বৈষ্ণবী।

১৭/১০/১৯৯৪


===========================================

জেগে ওঠার পর অনুভব করলাম অনন্য এক সত্ত্বা বোধির অন্তঃস্থলে বেদনার্ত হয়ে আছে। স্বপ্নে এসে কথা বলে গেল সে। জাগরণে নেই কাছে।












দুহাজার আঠারোর কড়চা

১.
আমি তেমন উন্নত প্রজাতির মানুষ নই, কিন্তু জেনেশুনে কখনো কারো ক্ষতি করিনি। দৈনিক যেসব ক্ষতির কাজ করি সেসব আমার নিজেরই। আমার সময়, অর্থ, চরিত্র, ধর্ম, অধর্ম, সবকিছুতে আমি কেবল নিজের ক্ষতিই করে গেছি। এর সবটাই জেনেশুনে। আমার আজকাল বেশী মানুষ ভালো লাগে না। এমনকি বন্ধুবান্ধবের সঙ্গও আমাকে আনন্দ দেয় না। বইপত্র, সিনেমা, লেখালেখি, এসবের বাইরে আর কিছুর সাথে আমার সম্পর্ক নেই। আমি যাদের বন্ধুত্ব কামনা করি তাদের মধ্যে এই বিষয়গুলো উপস্থিত থাকতে হয়। কিন্তু এই বিষয়ে আগ্রহ আছে তেমন মানুষ আমার বন্ধুচক্রে কম। তাই প্রাণের বন্ধু ব্যাপারটা আজকাল বিরল হয়ে গেছে বাস্তবে। চাইলে অনেকের মতো ভার্চুয়াল বন্ধুতা গড়ে তোলা যায়, তাদের সাথে মেতে দুনিয়া ভুলে থাকা যায়। কিন্তু তাতেও আমার মন সায় দেয় নি কখনো। কেমন একটা অবিশ্বাস কাজ করে অদেখা অচেনা মানুষের জন্য। অচেনা মানুষ হঠাৎ আপন হয়ে হঠাৎ বিগড়ে যেতে পারে তুচ্ছ কারণেও। তার কোন দায়বোধ নেই বলে। মাঝে মাঝে কম বয়সীদের সাথে মেলামেশা করে দেখেছি, কিন্তু তাতে কেমন যেন হংস মাঝে বক মনে হয় নিজেকে।

২.
আমি যেসব আঘাত পাই, তার জন্যও নিজেই দায়ী। কিছু বিষয়ে আমার পরনির্ভরশীলতা আছে। ব্যাপারটা নিতান্তই মানসিক। বাস্তবে কারো কোন সাহায্য ছাড়াই চলতে পারি। কিন্তু ওই যে মানসিক নির্ভরশীলতার একটা ব্যাপার ঘটে গিয়েছে বছর বছর ধরে, সেখানে হঠাৎ করে হোঁচট খেলে সব বিগড়ে যায়। অথচ কেউ আমাকে বলেনি পরনির্ভরশীল হতে। আমার নিজেরই সৃষ্ট জগত ওটা। যে নক্ষত্রের ক্ষীণ আলো আমার জন্য খরচ হয়, তাতে নীহারিকার কিছু এসে যায় না। কিন্তু সেই আলোক রশ্মি যদি কোন কারণে বন্ধ হয়ে যায়, তখন আমি দুচোখে অন্ধকার দেখি। দোষটা নক্ষত্রের নয়, আমারই। আরো যে নক্ষত্র আছে আমি তাদের কাছ থেকে আলো নিয়েই পথ চলতে পারি। অথচ সেটা না করে নির্দিষ্ট নক্ষত্রের দিকে তাকিয়ে থাকি। আমি কক্ষপথে বন্দী একটা গ্রহ যেন। এসবের জন্য কাউকে দায়ী করা চলে না। ওই নক্ষত্রে মালিক আমি নই, সেই নক্ষত্রের গতিপথ আমার জানার কথা নয়।

৩.
দুমাসের জন্য যে কাজে হাত দিয়েছিলাম, এক বছর পার হয়ে যাচ্ছে, এখনো শেষ হয়নি। কদিন পরপর একেকটা ঝামেলা এসে হাজির হয়, আমি পিছিয়ে পড়তে থাকি। আমাকে কেউ কোন ডেডলাইন দেয়নি। আমি নিজের শৃংখলে নিজেই আটকে গেছি। কাজটা না হলে কারো কিছু এসে যাবে না। আমারও আর্থিক লাভ ক্ষতির কিছু নেই। তবু ধাক্কাগুলো ভোগায় বেশী। ইতিহাসের কাজে নেমে লাভ কিছু হয়েছে অবশ্য। পড়াশোনা করা গেছে বেশ। নতুন কিছু বইপত্র কেনা হয়েছে। এবার বইমেলার কোন বই কিনিনি। বাতিঘরে গিয়ে যে কয়েকটা বই কিনেছি তার সবই ইতিহাসের বই।  দুটো অনুবাদ কিনেছি (বাবরের জীবনী আর মানুচ্চির ভারত ভ্রমণ) যার মূল বইয়ের পিডিএফ আছে আমার।  তবু বাংলাটা কিনে রাখলাম চট করে উল্টে দেখার জন্য। তবে এর মধ্যে দুর্লভ ও উল্লেখযোগ্য বই হলো কৈলাশচন্দ্র সিংহের 'রাজমালা'। রাজমালার আরো দুটি সংস্করণ আছে আমার। চট্টগ্রামের ইতিহাসের সুত্র হিসেবে এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। এই সুত্রগুলো নিয়ে কাজ করার জন্য একবার আগরতলা যাবার ইচ্ছে আছে, আগরতলা থেকে উদয়পুর, ত্রিপুরার প্রাচীন রাজধানী। পাণ্ডুলিপি এখনো মনমতো করে লিখতে পারিনি। যতদিন না হয় ততদিন প্রকাশ আটকে থাকবে।

৪.
বেলা শেষে জীবনের কাছে আমি কৃতজ্ঞ হয়ে পড়ি। আমাকে তুমি ভরিয়ে দিয়েছো। এতটা আমার প্রাপ্য ছিল না কখনো। এবার তুমি অন্য দিকেও কিছু দাও। যেদিকে শূন্য সেদিকে।





খোরাক

বইটি আগাগোড়া চষে ফেলেও কাংখিত খোরাক না পেয়ে হতাশ হয়ে অতৃপ্তির ঢেকুর তুললো সে।

বুকশেলফের প্রতিটি বইয়ের সাথে পরিচয় ঘটেছে তার। তবে এককালে যে কোন বইয়ের দশ পাতা চষে যে আনন্দ পাওয়া যেতো, আজকাল কোনটির একশো দেড়শো পাতা চষেও সেই আনন্দ নেই। বেশুমার পরিশ্রম হয় তবু বই থেকে আনন্দ পাওয়া দিন দিন কঠিন হয়ে যাচ্ছে।

একসময় নিউজপ্রিন্টেও ভাল ভাল বই ছাপা হতো, সেগুলো হজমে বেশ আরাম ছিল। মনে পড়ে যায় কোন এক সুদূরকালের রূপকথার গল্প। তখন সবাই মিলে ঝিনুক পুস্তিকা থেকে প্রকাশিত রবীন্দ্র রচনাবলীর প্রথম দুই খণ্ড কী আনন্দের সাথে গিলেছিল মহানন্দে।

এখনকার যেনতেন বইগুলোও শক্তমক্ত কাগজে ছাপা। মলাট যেমন কঠিন পুরু, তার উপর লেমিনেটিং করা। এতসব ভেদ করে একটা বইয়ের ভেতরে প্রবেশ করা কী সহজ কাজ? ভেতরে ঢুকেও শান্তি কোথায়, হোয়াইট প্রিন্ট ছাড়িয়ে অফসেট কাগজ পেরিয়ে এখন কার্টিজ পেপারেও বই ছাপা হচ্ছে।

মানুষের প্রযুক্তির উন্নতি বটে! কিন্তু আমাদের তো সেই পুরোনো দাঁত নিয়েই এখনো খেয়ে যেতে হচ্ছে!

মনে মনে গজগজ করতে করতে ২০ ফেব্রুয়ারী কেনা এক ঝাঁক নতুন উপন্যাসের ভাঁজ থেকে বের হয়ে এলো উইপোকাটি।