১.
ভকভক করে বেরুনো কালো ধোঁয়ার পাহাড় সামনে থাকা হলুদ বাসটিকে প্রায় আড়াল করে দিল। ধোঁয়া বেরুচ্ছে ওই নচ্ছার হলুদ ময়লা বাসটা থেকেই। ভাগ্যিস জানালাগুলো বন্ধ ছিল, নইলে এই বিশ্রী ভারী ধোঁয়ার কবলে পড়ে ধোপদুরস্ত সাদা শার্টের তেরোটা বাজতো। তবে নতুন কেনা নিশান ব্লু বার্ডের সাদা শরীরের পালিশের বারোটা বেজে গেছে নিশ্চয়ই। এই গাড়িটা নিয়ে অতিরিক্ত আহলাদ আছে নকীবের। সিঙ্গাপুর থেকে আসা পালিশ দিয়ে প্রতিদিন মেকাপ করায় গাড়িকে।
সল্টগোলা থেকে বাসটার পেছনে আছে নকীবের নিশানটা। ওভারটেক করার অনেক চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু কিছুতে সাইড দিচ্ছে না ধ্বজভঙ্গ বাসটা। বেদম গুপুরগুপুর শব্দ করতে করতে ঢিমিয়ে ঢিমিয়ে চলছে আর বিকট শব্দে হর্ন বাজিয়ে যাচ্ছে। একবার পাশ দিয়ে ওভারটেক করতে যেতেই ইচ্ছা বা অনিচ্ছাকৃতভাবে পাছার ধাক্কা মারতে চাইলো। চট করে পিছিয়ে এল নিশান ব্লুবার্ড।
নিশানের ড্রাইভার অস্ফুট কন্ঠে বাসের ড্রাইভারের পিতামাতার জন্ম নিয়ে কটুক্তি করলো। কিন্তু ড্রাইভার দূরে থাক, বাসের বাম্পারেও শুনতে পেল না সেটা। নকীব গাড়িতে না থাকলে জানালা খুলে খিস্তি করতো হয়তো নিশান ড্রাইভার। নকীব বললো, বাদ দাও মোখলেস।
প্রতিদিন এরকম হাজারো উৎপাত রাস্তায়। এটা বাংলাদেশ, যেমন খুশী তেমন গাড়ি রাস্তায় নামাও, কেবল চার ছয়টা চাকা থাকলে আর জায়গামত তেল দিলে ফিটনেস পাশ।
ধোঁয়ার পর্বত সরতেই বাসের চেহারা স্পষ্ট দেখা গেল। এই প্রথম খেয়াল করলো নকীব। ভয়াবহ রকমের চেহারার বাস। গত কদিন ধরে এই বাসটা প্রায়ই সামনে এসে পড়ছে। যেন ওর গতিকে ধীর করে দেবার জন্যই কোত্থেকে হাজির হয় সামনে। আরো অনেক বিদঘুটে গাড়ি দেখেছে এদেশে, কিন্তু এটার মতো আর একটাও না। ছয়টা চাকার উপর টিন পিটিয়ে একটা বডি তৈরী করা হয়েছে। জানালা দরজার বালাই নাই। পেছনদিকে কোন কালে কাঁচের অস্তিত্ব ছিল কিনা কে জানে, এখন সেখানে ছেঁড়া একটুকরো পলিথিন পতপত করে বাতাসে উড়ছে। পলিথিন আটকে থাকার জন্য ক'খানা বাঁশের কঞ্চি ঠেসে দেয়া আছে বেড়ার মতো। পেছনে সিগন্যাল বাতি লাগাবার কোন চিহ্ন নাই। শ্রেফ জং ধরা টিনের তৈরী একটা বডি। এটি হয়তো কোন ফেলে দেয়া ট্রাককে বাস হিসেবে চালানো হচ্ছে।
এসব গাড়ি শহরে চলার অনুমতি পায় কি করে? বিআরটিএ বা পুলিশ কি করছে? এই একটা গাড়ি পঞ্চাশটা গাড়ির চেয়েও বেশী দুষিত করছে শহর। গাড়িটার নম্বর রেখে অভিযোগ করা দরকার। নম্বর কতো? নাহ গাড়িটার কোন নাম্বারই নেই। ড্রাইভার জানালো এরা সকালে শুধু গার্মেন্টস শ্রমিক টানার কাজ করে। এরকম আরো অনেক নম্বরবিহীন গাড়ি কেবল সকালে চলে। তখন পুলিশ থাকে না রাস্তায়। থাকলেও টোকেনে ম্যানেজ হয়ে যায়।
সল্টগোলা রেলক্রসিং এর কাছে এসে নিশান আবারো চেষ্টা করলো ওভার টেকের। বাসটা আবারো পাছার ঝাঁকুনি দিয়ে ডানদিকে চলে এলো বিকট ধোঁয়াপর্বত নির্গত করে।
দেখে শুনে এবার প্রচন্ড বিরক্ত হলো নকীব। বেআইনী দুষিত গাড়ি চালাচ্ছিস ভালো কথা, কিন্তু অন্য গাড়িকে সাইট দিবিনা কেন? তোর বাপের রাস্তা নাকি? নকীব নিজেই অশ্লীল গালি দেয় মনে মনে। ইচ্ছে করে গাড়ি থামিয়ে দুটো থাপ্পড় দেয়। কিন্তু সামনে যাবার সুযোগ না পেলে থামায় কিভাবে। তাছাড়া নিজ দেশের এসব অনিয়ম অনাচার সহ্য করে নেবার যোগ্যতার নামই দেশপ্রেম। এই ভেবে নিজের অক্ষমতাকে শান্ত্বনা দিয়ে চোখ বন্ধ করে এয়ারকন্ডিশনের শীতল পরশ উপভোগ করতে লাগলো।
২.
বেশ কয়েকমাস পর।
নকীবের গাড়িটা পোর্টকানেকটিং রোডে এক পথচারীকে ধাক্কা দিয়ে আহত করার দায়ে লোকজন সেটা আটক করে পুলিশের হাতে তুলে দিল। নকীব ছিল না তখন গাড়িতে। খবর পেয়ে অফিস থেকে পরিচিত সার্কেলে ফোন করে ওসিকে ম্যানেজ করলো। গাড়ি ছাড়াতে বিকেলের পর থানায় যেতে বললো ওকে।
সন্ধ্যার দিকে নকীব থানায় গেল গাড়িটা ছাড়াতে। ওসি তখন বাইরে। তাকে বসতে দিল ডিউটি অফিসার। থানায় তেমন বেশী লোকজন নেই। সবাই বাইরে কাজে ব্যস্ত।
বসতে বসতে বাইরে মলিন লুঙ্গিপরা একটা লোক তার দৃষ্টি আকর্ষণ করলো। বারান্দার বেঞ্চিতে একা বসে আছে লোকটা। বিমর্ষ চেহারা। নারকেলের ছোবড়ার মতো লালচে চুল আঙুলের মুঠো করে টানছে। চুলে তেল সাবান পড়েনি বহুদিন বোঝা যাচ্ছে। কোন বিপদে পড়ে থানায় এসেছে কে জানে। থানা হলো বিপদগ্রস্থ লোকদের নরক, আর অপরাধীদের স্বর্গ।
সময় কাটানোর জন্য লোকটার সাথে খাজুরে আলাপ করার ইচ্ছে হলো তার। বিচিত্র লোকদের সাথে কথা বলতে ভালো লাগে তার। কতো অজানা দিক জানা যায়। কুড়িয়ে পাওয়া ঠোঙ্গার কাগজে পড়া আংশিক গল্পের মতো।
-আপনার গাড়িও কি এক্সিডেন্ট করছে?
-হু
-মারা গেছে কেউ?
-না
-তাইলে কি সমস্যা?
-আঁর গাড়ি শেষ( আমার গাড়ি শেষ)
-শেষ মানে?
-ট্রলি গুতা মাইজ্জে (কন্টেনার ট্রলি গুতো মেরেছে)
-ট্রলিকে ধরেন নাই
-না, মারিয়েরে ধাইয়ে (মেরে ভেগেছে)
-নম্বর রাখেননি?
-নম্বর ন ফাই (নম্বর পাইনি)
-আপনি কি ড্রাইভার?
-জী
-মালিক কোথায়
-আঁই মালিক। (আমিই মালিক)
-বাহ আপনিই মালিক?
নকীবের অবাক হওয়াটা লোকটাকে আহত করলো। তাই তাড়াতাড়ি সহানুভুতির টোন নিয়ে বললো সে-
-এখন কি করবেন?
-আর কি কোয়ালত যা আছে তা গইজ্জুম (কপালে যা আছে তাই করবো)
-ব্যাডলাক আপনার।
-হ লাক আঁর ব্যাড। ধরা খাইয়ি। গাঁতাত ফজ্জি ( ধরা খেয়েছি গর্তে পড়েছি)
তারপর সে যা বললো তার সারমর্ম হলো- এখন থানার কর্তারে দিতে হবে ২০ হাজার, গ্যারেজে দিতে হবে ৪০ হাজার, রাস্তায় নামাতে আরো ১০ হাজার, সবকিছু ঠিক করতে যে ঋন নেবে তা শোধ করতে লাগবে দুই মাস বা চাইর মাস। সেই দুই মাস বৌ ছেলেমেয়ে নিয়ে আধবেলা খাবে। এই গাড়ির ইনকামে সে দুই মেয়ের বিয়ে দিয়েছিল, আর দুই মেয়ে বিয়ের অপেক্ষায় আছে, একটা ছেলে স্কুলে পড়ছে। সবই গাড়িটার একার ইনকাম দিয়ে।
লোকটার মুখে যেন কথার নদী বইতে থাকে। বলতে বলতে সে ভেঙ্গে গুড়িয়ে যায়। রুক্ষ চেহারার মানুষটার খোলস ভেঙ্গে অন্য একটা মানুষ বেরিয়ে পড়ে। এবার সত্যিই মায়া লাগলো নকীবের।
-এই গাড়ি ছাড়া আপনার আর কোন আয়ের পথ নেই?
-না, এই গাড়ি আঁর ৩০ বছরের লক্ষী। এত বছর আঁরে টিকায় রাইখ্যে এই গাড়ি। এখন আঁই ন জানি হন্ডে যাই।
-কিন্তু থানাকে আপনি খামাকা টাকা দেবেন কেন? দোষ কি আপনার ড্রাইভারের?
-না দোষ ট্রলির
-তাহলে আপনার সমস্যা কোথায়
-আঁর সমস্যা তো আঁই নিজেই
-কেন?
-আঁর গাড়ির কোন কাগজপত্তর নাই।
-বলেন কি?
-আঁছা হতা হইলাম। তিরিশ বচ্ছর ধরি রাস্তাত গাড়ি চলের হাগজ ছাড়া। খনদিন এত বড় ধরা ন হাই। ডরে অন্য কেওরে গাড়ি ন দি। নিজেই নিজর গাড়ি চালাই। সমিস্যা অইলি ফুলিশর ফিডত আত বুলাই গেই গুই। হনদিন খন একসিডেন্ট ন গরি। আজিয়া কোয়ালর দোষত একসিডেন্ট গইরলাম, ফুলিশ্যা গাড়ি থানাত লই আইস্যি। থানাত গাড়ি একবার ডুকিলি ফইসা ছারা বাইর অইত ন ফারে, দোষি অক বা ন অক। আঁই দশ আজার টেঁয়া যোগার গজ্জি হনমতে, আর ন ফারির। কিন্তু ওসি হইয়িদে বিশ আজারর হম অইতু ন। দেরি গইল্লে রেট চল্লিশ আজারত উডি যাইবো হইয়েরে বাইরে গেইয়ু গুই (সত্যি বললাম। তিরিশ বছর ধরে রাস্তায় চলছে কাগজ ছাড়া। কোনদিন এত বড় ধরা খাই নাই। ভয়ে গাড়ি অন্য কারো হাতে দেই নাই। নিজের গাড়ি নিজেই চালাইছি। সমস্যা হলে পুলিশের পিঠে হাত বুলায়া চলে গেছি। কোনদিন একটা এক্সিডেন্ট করি নাই। আজকে কপালের দোষে এক্সিডেন্ট করলাম, পুলিশ গাড়ি থানায় নিয়ে আসছে। থানায় গাড়ি একবার ঢুকলে বিনা খরচে বের হতে পারে না, দোষী হোক আর নির্দোষী হোক। আমি দশ হাজার টাকা যোগাড় করছি কোনমতে, আর পারতেছি না। কিন্তু ওসি তো ২০ হাজারের কমে রাজী না। দেরী হলে রেট চল্লিশ হাজার উঠে যাবে বলে ধমক দিয়ে চলে গেছে বাইরে।)
- হুম। আপনি চিন্তা করবেন না চাচা। এই থানার ওসি আমার পরিচিত চ্যানেলের। আমি চেষ্টা করবো আপনার টাকা কিছুটা হলেও মওকুফ করাতে। কিন্তু আপনার গাড়িটা কোথায়?
-অই ত গেটর বাদ্দি ডানমিক্কা (ওই তো গেটের বাইরে ডানদিকে)।
নকীব গেটের দিকে তাকিয়ে দেখলো পুলিশের নীল ক্রেনের হুকের সাথে ঝুলছে বিদঘুটে দর্শনের ঝুরঝুরে একটা বাস। পেছনের পলিথিন ছিড়ে বাঁশের কঞ্চিগুলো বেরিয়ে পড়েছে।
No comments:
Post a Comment