বদ ঝামেলায় পড়া গেল দেখি। অফিসের গাড়ি নেই আজ, তিনজনে আধ কিমি হেঁটে ইপিজেডের মোড়ে আসলাম টেক্সির খোঁজে। ছুটির পর এমনিতেই জ্যাম থাকে এখানে। কিন্তু আজ মনে হচ্ছে যানজটের গনতান্ত্রিক মচ্ছব। শত শত গাড়ি, বাস-ট্রাক-ট্রেলার-রিকশা-টেক্সি-কার-মাইক্রো একটার পাছায় আরেকটা যে যার মতো গিট্টু লাগিয়ে স্টার্ট বন্ধ করে বসে আছে। ট্রাফিক পুলিশ কোথাও পালিয়েছে। হাজারে হাজারে মানুষ হেঁটে যাচ্ছে।
এমন সময় দেবদুতের মতো কোত্থেকে একটা টেক্সি এসে দাঁড়াতেই কয়েকশো লোক একযোগে ছুটে আসছিল ওটা ধরতে। কিন্তু আবুল হোসেনের কপাল আমাদের। দৌড়ে প্রথম হয়ে তিন জনে চড়ে বসলাম পঞ্চাশ টাকার ভাড়া একশো পঞ্চাশ টাকায় রফা করে। একটা চিপা রাস্তা দিয়ে নিয়ে যাবে আগ্রাবাদ।
টেক্সিটা চলতে শুরু করতেই অচেনা দুই নাছোড় লোক আঠার মতো টেক্সিঅলার দুপাশে সেঁটে বসে গেল। 'ভাই এটা আমাদের রিজার্ভ টেক্সি, আমরাই যাবো, আপনারা নেমে যান ভাই'- এরকম অনেক অনুনয় বিনুনয়ে কাবু করা গেল না ওদের। টেক্সিওয়ালাও ওদের নামাতে ব্যর্থ হয়ে জনপ্রতি বিশ টাকার ট্যাক্স বসিয়ে নিল। তাতেও রাজী ওরা। এবার টেক্সীওয়ালা খুশী। ১৯০ টাকার কামাই হবে ৫০ টাকার রাস্তায়। দুই যাত্রীও খুশী পঞ্চাশ টাকার ভাড়া ২০ টাকায় পেয়ে। শুধু আমরাই নাখোশ, দেড়শো টাকাই দিতে হবে আমাদের।
বিকল্প চিপাগলি দিয়ে কিছুদূর যাবার পর আবারো নতুন জ্যামে আটকে গেলাম। গলির মধ্যে শতশত রিকশা ধাক্কাধাক্কি করে রাস্তা বন্ধ করে দিয়েছে প্রায়। টেক্সি থেমে গেছে। সামনের দুজন টেক্সিওয়ালার সাথে বকবক করে যাচ্ছে শুরু থেকেই। দেখা গেল দুজনের গ্রামের বাড়ি ব্রাম্মনবাড়িয়া। টেক্সিওয়ালারও তাই। দেশীলোক পেয়ে খুশীতে গল্প জমিয়ে মারছে ওরা। রাস্তায় জ্যাম নিয়ে বিন্দুমাত্র উদ্বেগ দেখা গেল না তিনজনের মধ্যে। এই অতি সখ্যতায় আমাদের তিনজনের গা জ্বালা করছে।
জ্বালা কমাতে আমরা নেমে দাঁড়ালাম খোলা বাতাসে। পাশের দোকান থেকে সিগারেট ধরিয়ে টেক্সির পেছনে দাঁড়ালাম তিনজনে। কতোক্ষণ লাগবে এই জট ছাড়তে বলা মুশকিল। হঠাৎ টেক্সিটা স্টার্ট দিল, আমাদের অবাক করে দিয়ে টেক্সিটা আমাদের ফেলে রেখেই ফুড়ুত করে একটানে বেরিয়ে গেল সামনের দিকে। আমরা ডাক দেবার আগেই টেক্সিটা দূরে চলে গেল পেছনের লালবাতি দুটো অদৃশ্য হয়ে গেল অন্ধকারে। ব্যাটা খেয়ালই করেনি আমরা তিনজনের কেউ উঠিনি। এই মাঝপথে নামিয়ে দেয়ার জন্য টেক্সি ড্রাইভারকে শাপশাপান্ত করছি অমনি পারভেজ হো হো করে হাসতে শুরু করলো। কি হইছে জিজ্ঞেস করাতেও হাসছে ব্যাটা। গড়িয়ে পড়ছে হাসতে হাসতে। জুবায়ের ধমকে উঠলো,
-হাসিস কেন ব্যাটা গাড়ল? বিপদে তো তুমিও পড়ছো
-ধুরো ব্যাটা আমার কিসের বিপদ, এখান থেকে তো ত্রিশ টাকা রিকশা ভাড়ায় আগ্রাবাদ পৌঁছে যাবো। আমি হাসছি ওদের কি হবে ভেবে।
-ওদের কি হবে? ওরা তো আরামেই পৌঁছাবে
-পৌঁছালো। তারপর?
-তারপর আর কি, নেমে গিয়ে বাড়ি যাবে
-বাড়ি যাবে, কিন্তু দেড়শো টাকার ভাড়া কে দেবে? ওরে তোদের তিনজনের এই দোস্তালি তো দশ মিনিটেই খতম রে, আমাদের ফেলে গেলি, এখন তো নিজেদের মাংস নিজেরা কামড়ে খাবি। তুর কিয়া হবে রে কালিয়া!
এবার পারভেজের সংক্রামক হাসি তিনজনকেই একসাথে আক্রমন করলো।
অন্যের দুর্দশায় এত হাসি আমরা জীবনে আর কখনো হাসিনি।
No comments:
Post a Comment