রাজনীতির প্রতি তার কোন আগ্রহ বা যোগাযোগ ছিল না ৬২ কি ৬৬তেও। এমনকি ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের সময়ও সে নিবিষ্ট মনে চাকরী করে যাচ্ছিল। কিন্তু জেলফেরত শেখ মুজিবকে তার বিশেষ পছন্দ হয়ে গেল। মাওলানা ভাসানীর চেয়েও ব্যক্তিত্ববান নেতা মনে হলো শেখ মুজিবকে। রাজনীতি না করলেও শেখ মুজিবের ভাষণের জন্যই তার শক্ত ভক্তে পরিণত হয় সে। ইলেকশনের সময় অফিস কামাই দিয়েও ভোটের কাজ করেছে সে(আসলে সিনিয়রকে ভোটের প্রচারের কথা বলে ঘরে এসে ঘুমিয়েছে)। তবে শেখ মুজিবকে দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেখতে ভালোই লাগতো তার।
১৯৭০ এর নির্বাচনে শেখ মুজিবের বিপুল বিজয়ের মিষ্টি খাওয়ার কিছুদিন পর সে একটা দাওয়াতে গিয়ে দেখা পেল মিনারা বেগমের। সেদিন থেকে তার চোখ থেকে দেশের স্বপ্ন মুছে গিয়ে নতুন স্বপ্ন জায়গা করে নিল। চুড়ান্ত সুখের সময় মিনারা বেগমের সাথে বিয়েটা যখন ঠিকঠাক, দেশে স্বাধীনতা আন্দোলনের ডাক দিল শেখ মুজিবুর রহমান।
সেই উত্তাল সময়ে মিনারা বেগমের পরিবার বিয়ের অনুষ্ঠান করতে রাজী তো হলোই না বরং ঢাকা শহর অনিরাপদ জায়গা বলে ১৫ মার্চের দিকে মিনারাকে নিয়ে গ্রামের দিকে নিরুদ্দেশ হয়ে গেল। মাথায় বাজ পড়লো যেন তার। প্রেমটা ক্রোধে রূপ নিয়ে মিনারা বেগমের দিক থেকে ঘুরে গিয়ে শেখ মুজিবের দিকে নিবদ্ধ হলো। এরকম সুন্দর সময়ে আন্দোলনের ডাক দেবার কোন মানে আছে? দুদিন পরেই ক্ষমতায় বসবি। দেশ জাহান্নামে যাক, আমি মিনারাকে চাইই।
কিন্তু মিনারকে পেতে হলে শান্তি আসতে হবে দেশে। তার মতো ইয়াহিয়াও শান্তির খোঁজে পাগল তখন। সশস্ত্র পাক আদম আসতে শুরু করে জেটপ্লেনের পেট ভর্তি হয়ে। আন্দোলন থামিয়ে শান্ত করা হবে দেশ।
পাকি মিলিটারি ২৫শে মার্চের এক রাতেই হাজার হাজার ঘুমন্ত মানুষকে পরপারে পাঠিয়ে ঢাকা শহরকে রক্তে স্নান করিয়ে শান্ত করে দিল। পাকিস্তানী ক্র্যাক ডাউনের পরপর সেও আর দেরী না করে শান্তির পক্ষে যোগ দিল। ২৩ নম্বর ওয়ার্ডের শান্তি কমিটির সভাপতি হিসেবে প্রতিদিন সে স্বপ্ন দেখতে শুরু করলো শান্তির। শান্তি খোঁজার ফাঁকে ফাঁকে শান্তিবালাদেরও মাঝে মাঝে ধরে এনে খানসেনাদের সাপ্লাই দেয়। মাঝে মাঝে নিজেও তাদের মধ্যে দুয়েকটাকে নিয়ে মিনারাকে না পাওয়ার খেদ মেটায়।
কিন্তু মরার দেশ। আপন পর বুঝলো না। ইন্ডিয়ার চক্রান্তে পা দিয়ে ছেঁড়া লুঙ্গি গেঞ্জি পরে কাঁধে রাইফেল ঠেকিয়ে এক লাখ পাকিস্তানীকে পেঁদিয়ে আত্মসমর্পণে বাধ্য করালো। দেশ স্বাধীন হয়ে গেল ১৬ই ডিসেম্বর। সব হিসেব উল্টে যাওয়াতে সে ১৭ই ডিসেম্বর রাতেই ইঁদুরের গর্তে ঢুকে গেল।
গিরিগিটি রক্ত তার গায়ে। তিন বছর গর্তে থাকার সময়ও ভাবছিল এবার কোনমতে রক্ষীবাহিনীর সাথে খাতির করা যায় কিনা। কিন্তু গর্ত থেকে বেরুবার সাহস হচ্ছিল না। কেবল দুর্ভিক্ষের দোলাচলে গর্ত ছেড়ে বেরিয়ে এলো। বেরিয়ে এসে মিনারার খোঁজ পেয়ে গেল অন্য ঘরে। মিনারা তখন দুই বছরের এক বাচ্চার মা। বিয়ে হয়ে গিয়েছিল তার স্বাধীনতার পরপরই।
মিনারার বিয়ের খবরে সে গজব বর্ষণ করলো শেখ মুজিবের চোদ্দ গুষ্টির উপর। খোদার লানত বর্ষিত হোক তার উপর।
মার্চে প্রদত্ত লানত আগস্টে ফলে যাওয়াতে সে বুঝে যায় খোদার কতবড় পেয়ারা বান্দা সে। চাহিবামাত্র দাবী পূরণ করলো খোদা। ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ তার ঈদের দিন। পরদিন থেকে সে যেন আবারো স্বাধীনতা ফিরে পেল। দেরী না করে এবার ইসলামের খেদমত করার সুযোগ করার জন্য দুটো বিবি হাসিল করে নিল পাঁচ বছরের ব্যবধানে। ইসলামের খেদমত করতে করতে একটা ইসলামী ব্যাংকের পরিচালক হয়ে গেল জামাতে ইসলামীর সদস্য মর্যাদায়। এতদিনে মানুষ ভালো জিনিসের কদর করতে শিখেছে।
সবকিছু ঠিকঠাক চলছিল দুই যুগ। ২০০৭ সালে এসে ক্ষমতার বিরাট পালাবদল ঘটে গেল আবারো। ইসলাম আবারো ফসকে গেল দেশ থেকে। ২০০৯ সালে মরহুম শেখ মুজিবের দল ক্ষমতায় এলো। তাতেও ইতরবিশেষ হতো না তার। গিরিগিটির মতো রং বদলাতে শিখে গেছে ততোদিনে।
কিন্তু তার লুঙ্গি ধরে টান দিল অন্য একজন। ২৩ নং ওয়ার্ডের এক বুড়ি গত মাসে পত্রিকায় সাক্ষাৎকার দিয়ে বলেছে ১৯৭১ সালে কমপক্ষে তিনটা খুন আর অসংখ্য ধর্ষণের জন্য দায়ী ড. শামশের উদ্দিন এখন মধ্যপ্রাচ্য প্রাইভেট ব্যাংক লিমিটেডের পরিচালক। পত্রিকায় সাফিয়া খাতুনের নাম দেখেই মনে পড়লো মিনারা বেগমের এই বান্ধবীকে পাকিস্তানীদের হাতে তুলে দেবার আগে নিজেও একবার স্বাদ নিয়েছিল।
সেই এক রাতের চেনা মেয়েটি তাকে এত বছর পরেও মনে রেখেছে দেখে সে শিউরে উঠলো। কিন্তু সে বুঝলো না এত বছরে এত পরিবর্তনের মধ্যেও প্রায় অচেনা মেয়েটা তার খোঁজ রাখলো কি করে। (শামশের শুনলে জ্ঞান হারাতো যে তাকে ফাঁসির দড়িতে ঝোলানোর আকাংখায় এত বছর অনুসরণ করেছে তারই এককালের প্রেয়সী মিনারা বেগম।)
ধীরগতির ট্রাইব্যুনাল আর তদন্ত প্রক্রিয়ার বেড়াজাল পেরিয়ে ফাঁসির দড়ি তাকে খুঁজতে শুরু করার আগে সে আবারো গা ঢাকা দিল মধ্যপ্রাচ্যের এক ইঁদুরের গর্তে। শেখের বেটির উপর আরেকটা লানতের অপেক্ষায় আছে সে।
No comments:
Post a Comment